ধারাবাহিক: অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান —এর একটি পর্ব
প্রথমাধ্যায়: অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান : প্রথমাধ্যায়
থানচি থেকে ভাগ্যক্রমে তিন্দু, আর সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে তিন্দুর অভিজ্ঞ চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনায় আমাদের অজানা লেকের সন্ধান লাভ (কাল্পনিক মানচিত্রে অবশ্য), এবং একজন গাইড নুং চ মং পাওয়া গেছে। সাথে রয়েছেন ওদিকে যাওয়া আরেকজন পাহাড়ি থং প্রি মুং। সুতরাং দুজন গাইডসহ আমরা তিনজন – আমি, রাসেল আর প্রভা, তিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করেছি, তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | ০৯:০০
তিন্দু বাজার থেকে নদীতে নেমে বায়ে গেলে থানচি, আর ডানে গেলে রেমাক্রি বা রেমকরি উপজেলা। আমরা নদীর পাড় ধরেই নাফা খুম যাবো, তাই গাইডের নির্দেশিত পথে ডানদিকে চলা শুরু করলাম।
ঢাকায়… আমার অফিসে, অফিস-লগ্ন শেষে Google Earth খুলে বসে আছি। আবু বকর তাঁর মূল্যবান সময় ব্যয় করে বসে আছেন আমার পাশে – আমাদেরকে একটা জুৎসই পরিকল্পনা করে দিতে। সব পাড়ার নাম আমার ম্যাপে নাই, তবু বাংলা ট্রেক^ আর তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কয়েকটা জিপিএস (.gpx, .gdb ইত্যাদি) ফাইল নামিয়ে গুগল আর্থে বসিয়ে পাড়াগুলোর কয়েকটার নাম উদ্ধার করলেন। তারপর স্যাটেলাইট-চিত্রে একটা জায়গায় কার্সর রেখে বললেন, এটাই সম্ভবত পদ্মমুখ, কারণ এখানে সাঙ্গু এসে একটু বড় হয়েছে বলে জানি। ম্যাপে কার্সর রেখে বললেন: আপনারা এই যে এখান থেকে পদ্মমুখে যাবেন, তারপর নৌকা নিয়ে থানচিতে – দুটার আগে পৌঁছাতে পারবেন। এরপর আমি স্যাটেলাইট-চিত্রে একটা সরল রেখা টেনে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি মাঝখানে একটা লেকমতো…। আবু বকরকে জানালে তিনিও আশ্চর্য হলেন, আসলেই তো! এপর্যন্ত প্রকাশিত জিপিএস রিডিংগুলো বসানো হয়েছে, দেখা গেলো লেকটাকে মাঝখানে রেখে সবাই ডানে-বামে ঘুরাঘুরি করেছে। তাই ধরে নেয়া যায়, এই লেকে এখনও পর্যন্ত কেউ যায়নি। তখনই মাথার মধ্যে পোকাটা ঢুকে যায় আমার।
যেহেতু প্রথম যাচ্ছি, তাই জিপিএস ট্র্যাক করা খুব দরকার। কিন্তু আমাদের সাথে কোনো জিপিএস গ্রাহকযন্ত্র (GPS tracking device) নেই, সহসা একটা কিনে ফেলাও সম্ভব না— বিস্তর দাম। তখনই মনে পড়লো আমার ক্যামেরাতে (Nikon P510) জিপিএস ট্র্যাক করা যায়। তবে সমস্যা একটাই, এবং প্রকট: এই ক্যামেরার ব্যাটারি খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়, আর জিপিএস চালু থাকলে রীতিমতো বন্যার মতো। তবু ওটাকেই সম্বল করে চলেছি, এপর্যন্ত একটা ব্যাটারি দিয়ে এই দুদিন ছবি তুলেছি, আর একটা ব্যাটারি রিযার্ভ আছে – খুব সযত্নে ছবি তুলতে হবে।
পথটা পাথুরে, পার হয়েই এবারে ডানে পাহাড়ে উঠে গেছে। প্রভা আর রাসেল সামনে, আমি ছবি তুলে এগোচ্ছি, তাই পিছনে। দুই গাইড গল্প করে করে আসছে আমার পিছনে – দুজনেরই মনোভাব দেখে মনে হলো: আরেএ’ শহরের পোলাপান, হাঁটতে কি পারবে? যাক যদ্দুর পারে, আমরা তো ধরেই ফেলবো। …পাহাড়ে উঠা শুরু। প্রভার প্রথম অভিজ্ঞতা, আমার আর রাসেলের অফ-ট্র্যাক বান্দরবানের অভিজ্ঞতা সম্বল।
প্রভাকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দিলাম: মুখ বন্ধ, নাক দিয়ে শ্বাস নাও। প্রভা একটু স্বাস্থ্যবান আর ওর আবার অ্যাক্রোফোবিয়া আছে, আমরা উঠছি উঁচুতে, ও’ কি পারবে উপরে উঠে নিজেকে সামাল দিতে? পথটা ধীরে ধীরে খাড়া হচ্ছে, প্রভারও কষ্ট বাড়ছে। প্রথম তো, একটু কষ্ট হবেই। কিছুক্ষণ চললে সামলে উঠবে। রাস্তার উপর একটা গাছ পড়ে আছে, ওটা টপকে এগোতে হলো।
কিন্তু প্রভা বেশ ধীরে চলছে। এতো ধীরে চললে তো সমস্যা। আমি তাই এবারে ওকে পার করে একটু এগিয়ে গেলাম, কারণ উপরে উঠার সময় জিরাতে গেলে আরো বেশি বসে যায় শরীর, তখন আমি নিজেই আটকে যাবো। যতই উপরে উঠছি, নদীটা তত অপূর্ব হয়ে উঠছে, আশেপাশের পাহাড় আরো মোহনীয় লাগছে। কিন্তু পিছন ফিরে দেখি, প্রভা বসে পড়েছে।
সঙ্গী হয়েছে রাসেলও। রাসেল বাবাজিও একটু মোটাসোটা, তাই সুযোগ পেয়ে সেও বসে গেছে – পাহাড়, তারও চরম শত্রু। নাহ, এভাবে হলে তো মহা সমস্যা! পথ শুরু না করতে করতেই ঝিম ধরা…। আমি তাড়া দিলাম। প্রভা দেখলাম গ্লগগ্লগ করে পানি গিলছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে আবার আমারও গোড়ালিটা মচকানো, তা নিয়েই এসেছি, সকালের দিকে কষ্ট দেয়, তখন পায়ের পাতার সামনের অংশে ভর দিয়ে চলি। ওটা নিয়েও দুশ্চিন্তা করছি।
যাক, আবার উঠেছে ওরা। পথ চলা শুরু। পাহাড়ের উপরে উঠছি আমরা, এদিকে ডানপাশে একটা পাড়া আছে: বাঊ পাড়া (ব-আকার-দীর্ঘ-ঊ.. কিন্তু)। ওদেরকে সামনে যেতে দিলাম, তাতে যদি গতি বাড়ে। এবারে উপরে উঠে এলাম। বায়ে বিশাল একটা পাহাড় খুব যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, নাম: লাংলপ তং। মারমা ভাষায় ‘তং’ মানে হলো পাহাড়, ‘লাংলপ’ হলো বাঁদুড় – বাঁদুড়ের পাহাড়ের উপরে আছে আরেকটা পাড়া: বুড়া কারবারি পাড়া। …এবার একটু নেমে যাওয়া পথ… মানে নামতে থাকা আরকি… কামরুলের শেখানো বুলি প্রভাকে বললাম, ‘টো’র (পায়ের আঙ্গুল) উপর ভর দিয়ে নামো’।
আবার উঠা… খানিকটা নামা… আবার উঠা… মানে পথটাই এখন পাহাড়ের খাঁজ ধরে এভাবে চলছে… প্রভা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, অপেক্ষা করছে, শেষ পর্যন্ত বসেই পড়লো। নাহ্! ভালোই কষ্ট হচ্ছে ছেলেটার, কিন্তু সান্তনার চেয়ে আমার দুশ্চিন্তাই বেশি হলো: সামনে আরো বিশাল পথ বাকি…।
প্রভা গলগল করে পানি খাচ্ছে। বসে আছে ঝিম মেরে। কিছুই বুঝতে পারছি না। রাসেলকে আটকে রাখার কোনো মানে পেলাম না, দ্বিতীয় গাইড দিয়ে বললাম তুমি চলতে থাকো; আমরা আসছি। এবারে প্রভা ডাকলো আমাকে: নয়ন ভাই।
…এবং প্রভা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলো, রীতিমতো বোমা ফাটালো: ভাই, আমি ব্যাক করি।
আমি আশ্চর্য হলাম, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে আমি তার প্রশংসা না করেই পারলাম না। যে ছেলে হুজুগে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, সে ছেলে পাহাড়ে এসে হুজুগে চলতে থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলো, তা অনেক ম্যাচুর্ড ছেলেও নিতে পারবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু প্রভা নিলো। সে তার বাস্তবতা ঠান্ডা মস্তিষ্কে মেনে নিয়েছে।
প্রভা বিদায় নিচ্ছে, আমি ওকে বিদায় দিচ্ছি, রাসেল এসবের কিছুই জানে না; দূর থেকে চিৎকার করে জানতে চাচ্ছে কী হচ্ছে… আমি শ্রেফ দাঁড়াতে বললাম ওকে। প্রভা তার নিজের জন্য আনা চকলেট, খেজুর সব দিতে চাইলো, আমি ‘লাগবে না’ জানিয়ে ট্রেক শুরু করার আধা ঘন্টার মাথায় ওকে বিদায় দিলাম। প্রথম গাইড নুং চ মং-কে বললাম, দাদা আপনি ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবেন?
দাদা দেখলাম রাজি হলেন, আমি তাঁর ব্যাগটা নিতে চাইলাম, কিন্তু আমার কষ্ট হবে ভেবে তিনি সেটা দিলেন না। প্রভা ফিরে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে দল থেকে… বিদায় প্রভা। তোর এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তকে সালাম।
প্রভা দৃষ্টির আড়াল হলে আমি সামনের পথ ধরলাম। বেশ কিছুটা সামনে গিয়ে ও’-দুজনকে পেলাম। রাসেল খুব আফসোস করলো, কিন্তু দুজনেই প্রশংসা করলাম তার এই সিদ্ধান্তকে। রাসেল একটা সিগারেট ফুঁকলো, তারপর আমরা চলা শুরু করলাম। …প্রভার বিদায়কে সম্মান জানাতে কিনা জানি না, আমার ক্যামেরার প্রথম ব্যাটারিটা নিঃশেষ হয়ে গেলো তখন।
উঁচু… নিচু… উঁচু… নিচু… চলছে পথ। এখন আমাদের সঙ্গী: গাইড থং প্রি মুং (দ্বিতীয় গাইড)। শর্ত হলো আমরা এগিয়ে যাবো, ততক্ষণে মূল গাইড প্রভাকে দিয়ে এসে আমাদের সঙ্গী হবে। থং প্রি মুং ধুপধাপ এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমিও পায়ে পা মিলিয়ে চলেছি… একটু পরে সে পিছন না ফিরে পারলো না: আ-পনে তো ভালো-ই চ-লতে পা-রেন! আমি হাসলাম।
রাসেলও খারাপ এগোচ্ছে না, তবে একটু ধীর; মোটাসোটা মানুষ একটু ধীর হবেই, স্বাভাবিক। তবু আমি এগিয়ে চলেছি পাহাড়িদের মতো করে, যাতে রাসেলও তাড়া অনুভব করে। কিন্তু একটু পরপর সে আমাকে ডেকে বলে, এই ব্যাটা আস্তে হাঁট; তুমি মামা আরেক আবু বকর হ’য়ো না। আমি মনে মনে আবারো হাসি: হাঁটতে থাকলেই হাঁটা যায়, জিরালে ঝিমাতে হয়।
আজকে সন্ধ্যার আগে নাফা খুম শেষ করে আরো সামনে যাওয়া আমাদের লক্ষ্য, তাই কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই পথ চলছি – সামনে যেতে হবে দ্রুত, আরো দ্রুত… বড্ড দেরি করে ফেলেছি বেরোতে। …হঠাৎই নজরে এলো মাটিতে পড়ে থাকা চালতা। গত বছরও এভাবে চালতা পেয়েছিলাম ট্র্যাকে। একটা প্রতিবেদনে পড়েছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের ৩৬২ ধরণের লেবু ঘরাণার টক ফল নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (BARI) একটা মেলা করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের এই অঞ্চলটি লেবুজাতীয় টক ফলের আদি জন্মস্থান। চালতা লেবুজাতীয় না হলেও টক স্বাদের ফল; তারমানে কি পাহাড়ে টক স্বাদের ফল ভালো জন্মে? সার্ভাইভারদের ব্যাপারটা জানা থাকলে কাজে লাগবে হয়তো।
আরো সামনে এগোলাম। মোটামুটি আরো আধা ঘন্টা হাঁটলাম আমরা একটু জিরিয়ে, কিংবা দাঁড়িয়ে। পৌঁছে গেলাম বড় পাথর এলাকায়। বড় পাথর, রাজা পাথর —এগুলো পর্যটনস্থল বলে শুনেছি। আমরা তবে একটা পর্যটনস্থল দেখছি! তবে আর-সবার মতো নৌকা থেকে নয়, পাহাড়ের উপর থেকে। আগের বারের মতো এবারও, রেমাক্রি পর্যন্ত সবাই-ই নৌকায় করে যায়, আমরা যাচ্ছি পায়দল।
বিরাট বিরাট পাথরই এখানকার দর্শনীয় বিষয় – হুহ! পাহাড়ের উপর থেকে ওগুলোকে নুড়ি পাথর মনে হচ্ছে – ক্যামেরার যুম কাজে লাগিয়ে দেখলাম বড় একটা পাথরে নীল রং দিয়ে লেখা: শিশুর কথা শুনুন -ইউনিসেফ।
আরেকটু সামনে এগোলাম, এদিকে হলো রাজা পাথর এলাকা। কিন্তু বড় পাথরের চেয়ে যে জিনিসটা আমার নজর কেড়ে নিলো, তা হলো একটা বিশা–ল বট গাছ। অ্যাভাটার চলচ্চিত্রের মাদার ট্রি-টার কথা মনে করিয়ে দিলো – অল দ্যা ট্রিয নিয়ারবাই আর ইন্টারনালি কানেক্টেড উইথ দ্যা মাদার ট্রি। মনে হলো, এই বটগাছটাই আশেপাশের কতগুলো গাছকে বুক ফুলিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছে হয়তো।
নিচেই বড় আকারের পাথর, আমাদের পথ গিয়ে নিচে নামলো এবার। ওখানে দেখি ছোট ছোট দোকান খুলে বসেছে পাহাড়িরা। এখানে আগত ভ্রমণকারীদের থেকে আয় করার উপায়। আমাদের প্রথম গাইডকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, অনেক পিছনে কোথাও আছেন। আমরা ঠিক করলাম, এখানটায় তাঁর অপেক্ষা করবো। ব্যাগগুলো দোকানে রেখে হাত-পা ঝাড়ার একটা সুযোগ হলো। কয়েকটা খেঁজুর বের করে তিনজনেই খেয়ে নিলাম। খেঁজুর হলো কার্বোহাইড্রেটের বিশাল উৎস, এছাড়া আছে প্রোটিন, ভিটামিন কত্ত কী…। বেশি না বুঝলে এতটুকু বুঝলেই চলবে, কার্বোহাইড্রেটের সোজা বাংলা হলো শক্তি। …তাকিয়ে দেখি, উপরে যে বটগাছটা রেখে এসেছিলাম, ওটার পাশ থেকে একটা ফাঁপা বাঁশ লাগিয়ে পাহাড়ি ঝরণার জল সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখান থেকে পানি নিয়ে খেলাম — ঠান্ডা বরফ পানি, প্রাণটা জুড়িয়ে দিলো। বোতল দুটো ভরে নিলাম।
ঢাকায় ফিরে গুগল আর্থে যখন পথটা দেখছিলাম, তখন উপলব্ধি করলাম কেন মানুষ এই পথটা নৌকা নিয়ে যায়: পাহাড় দিয়ে আসায় আমরা রাজা পাথর আর বড় পাথরের মূল মূল আকর্ষণগুলোই মিস করেছি। যাহোক, কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হবে।
প্রায় পনেরো মিনিট পরে এলেন আমাদের প্রথম গাইড, রীতিমতো দৌঁড়ে। তিনি ভেবেছিলেন, আমাদেরকে আর পাবেন না, এখানে না পেলে ফিরেই যেতেন নাকি। যাহোক, দল আবারো প্রস্তুত। এখানে আর না জিরিয়ে দাদাকে জিরোবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি আরেকটু সামনে গিয়ে জিরাবেন বললেন। আরেকটু সামনে হেঁটে গেলাম আমরা, সামনে আরেকটা দোকান। এখানে ডিম সিদ্ধ খেলাম সবাই। গাইড দুজন চা খেলেও আমি খেলাম না, কারণ আমি শুনেছি, চা, শরীর থেকে পানি বের করে দেয় (রমযান মাসে সেহরীর সময় তাই ডাক্তাররা চা খেতে নিষেধ করেন)।
নুং চ মং জানালেন, প্রভাকে তিন্দুপাড়া পর্যন্ত নিতে হয়নি, তার কিছুটা আগেই সে তাকে ছেড়ে দিয়েছে, ও’ একা যেতে পারবে বলে। বিদায় দেবার আগে দাদার ব্যাগে পুরে দিয়েছে তার নিজের জন্য আনা রেশনটুকু: চকলেট বার, খেজুর, ম্যাংগো বার – বড্ড মায়া লাগলো তখন: বেচারা, ছেড়ে গিয়েও ফেলে যায়নি আমাদের!
ফুলসেট হয়ে আবার চলা শুরু, পরবর্তি গন্তব্য রেমাক্রি বাজার। আমরা এখন যেখানে, সেখানে বায়ে আছে মিবক্ষ্যাঁ তং (মারমা নাম), পাশ দিয়ে গেছে মিবক্ষ্যাঁ ঝিরি। মিবক্ষ্যাঁ ছড়া ধরে গেলে নাকি সাউদাঁউ পাড়া পড়বে। আমরা নদীর একেবারে পাড় ঘেঁষে চলেছি, মাঝে মাঝেই নৌকায় করে ভ্রমণার্থীরা পার করছেন, রাসেল খুব উৎসাহ ভরে তাদেরকে ‘হাই’-মার্কা ইঙ্গিতে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানায় – সামাজিক ছেলে! একবার একদল তার ‘হাই’-এর উত্তর দিলো না বলে সে খুব কষ্ট পেলো: এরা কি মানুষ!
গত বছর রুমা থেকে বাঙালি গাইড নিয়েছিলাম, ভাষা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার খাঁটি পাহাড়ি গাইড, কারণ তিন্দুতে বাঙালি খুব একটা আসে না, এদের বাংলা সম্পর্কে জানাশোনা বেশ কম। আমি তাও আবু বকরের বিশেষ ‘পাহাড়ি-বাংলা’য় কথা বলছি বলে দাদারা আমার কথা বুঝতে পারছেন; রাসেল কথা বলে যায়, তারা দুজন কিঞ্চিৎ বুঝেন, অনেক সময় না বুঝেই ‘হা’ ‘হু’ করেন, কিংবা হাসিমুখ ধরে রাখেন। তবু রাসেল বলে যায়, আমি থামাই না… কথা বলতে থাকলে পথের কষ্ট যদি ভুলতে পারে আমাদের বকবক মেশিন, তাহলে কথা চলুক।
আমাদের সহচর গাইড আমাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ ছিলো, তাই কথাটথা প্রয়োজনে বলছে, কিন্তু প্রধান গাইড নুং চ মং দেখি বেশ চুপচাপ। আমি এগিয়ে গিয়ে পিঠে হাত রেখে হেসে হেসে বললাম, ‘দা-দা, আম,রা কিন্তু ম-জা ক’রে ক’রে হাট,বো। চুপ ক’রে হা-টা যা-বে না।’ রাসেলও সায় দিলো, ‘কথা বলতে হবে। কথা না বললে বোরিং লাগে। দাদা, কথা বলতে বলতে গল্প করতে করতে হাঁটবেন কিন্তু।’ …কাজ হলো, নুং চ মং বুঝে গেলেন, দূরত্ব রাখার দরকার নেই সঙ্গীর সাথে; বুঝে গেলেন, আমরা মুনিব নই, বন্ধু।
নদীর এক্কেবারে কিনারা, আবার সেখানেই গিয়ে পাথুরে পাহাড়টা মিশেছে জলে, তাই ঢালু খাঁজে পা বাঁকা করে ফেলে হাঁটতে হচ্ছে; বিষয়টা কষ্টসাধ্য, কারণ জায়গাটা পিচ্ছিল, পা মচকালে মহা বিপদ হয়ে যাবে। শরীরের ওজন তাই যথাসম্ভব উড়ুউড়ু রাখার চেষ্টা করছি। আমার ক্যামেরা সবসময়ই হাতে, ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে পেটে বাঁধা; দুহাত খালি করার দরকার হলেই ব্যাগে ভরছি ক্যামেরা। ছবি তুলছি, আবার বন্ধ করে দিচ্ছি, যাতে শেষ ব্যাটারিটা জিইয়ে রাখা যায় লেক অবধি – মাঝখানে আরো একটা দিন বাকি।
পথে কোথাও পাখি দেখলে সবাইকে শ… শ… শ… বলে দুহাত ছড়িয়ে আটকে দিই, …নীরবতা… ঐ-যে পাখিটা… ক্যামেরার 42x যুম দিয়ে পাখিটা তোলার চেষ্টা করি। দাদারা বোধহয় পাগল ঠাওরাচ্ছেন!
ঘড়িতে তখন ১১:১৫। এটা আমি এখন আপনাদের বলতে পারছি ক্যামেরার মেটা ডাটা থেকে, তখন কিন্তু আমার মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছি চার্জ ধরে রাখার জন্য। আমার ঘড়ি পরবার কোনো অভ্যাস নেই, তাই সময় ঠাওর করতে পারছি না, আন্দাজে হিসাব করছি হয়তো এক ঘন্টা হলো, দু ঘন্টা হলো…। তবে সময়ের চেয়ে বেশি হিসাব করছি সূর্যের আলোর, আজকের মধ্যে নাফা খুম শেষ করে সামনে এগোতে হবে।
নদীর পানি এখানে খুবই স্বচ্ছ, পানির নিচে ডুবে থাকা বিশালাকায় পাথর দেখা যাচ্ছে, এবং দৃশ্যটা খুবই সুন্দর! বলে বোঝানোর মতো না, ছবিতে কতটুকু বোঝা যাবে আমি জানি না। …এবারে নদীর কিনারায় বালি; নদীর লাগোয়া অংশে জল এসে বালিকে ভিজিয়ে দিয়েছে। ভাবলাম আলগা ঝুরঝুরে বালির চেয়ে ঐ ভেজা, এঁটে থাকা বালি পা ফেলার জন্য যথেষ্ট মজবুত গ্রাউন্ড হবে, তাই ওখানে পা দিলাম… আর অমনিই…
…ফেঁসে গেলাম।
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
ভাল হইসে ভাই…
Nice.carry on.want next…please…
wow…..