ধারাবাহিক: অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান —এর একটি পর্ব
তিন্দু থেকে পায়দল রেমাক্রি বাজারে যাওয়ার পর, সেখান থেকে দুপুরে রওয়ানা করেছি নাফা খুমের উদ্দেশ্যে। নাফা খুমে পৌঁছতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নাফা খুমে গোসল করতে হবে -এটাই এখন কাজ। খুমের জলে ঝাঁপ দেবো ভাবছি, কিন্তু ডুবো-পাথরের ভয় করছি।
যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে এলাম: আমার এখন ঝাঁপ দেয়াটা শখ — প্রয়োজন নয়। তাই মশা মারতে কামান দাগার মানে হয় না। এখন গাছের লতা খুঁজে পাথর বেঁধে মাপুনি বানিয়ে ঝাঁপ দেয়ার চেয়ে দিনের আলোয় সামনে যাওয়াটা বেশি দরকার। তাই বামদিকের পাথরগুলো দিয়ে ধাপে ধাপে নিচে, জলের কাছাকাছি গেলাম। তারপর ঝুপ্পুশ করে একটা লাফ – স্যাঁৎ করে ঢুকে গেলাম জলের তলে। প্রচন্ড ঠান্ডা জল। কিন্তু সাঁতার কাটতে বেশ লাগছে। সাঁতরে সামনে এগোলাম, ঝরণার দিকে। যেখানটায় ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলাম, সেখানে পৌঁছে আল্লা’কে লাখোকোটি ধন্যবাদ দিলাম, পানির সামান্য নিচেই বিশাল বড় পাথর বেরিয়ে আছে। ঝরণার পানির ফেনার কারণে উপর থেকে ঠাহর করা যায়নি একে। ভাগ্য ভালো, ঝাঁপ দিলে এতক্ষণে হাত আর মাথা থ্যাঁতলে আযরাইলের সাক্ষাৎ পেয়ে যেতাম।
সাঁতরে এগোনোর চেষ্টা করলাম ঝরণার দিকে। ঝরণার মোটামুটি কাছেই চলে গেলাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করাসত্ত্বেয় আমি সাঁতরে আর ঝরণার নিচে যেতে পারছি না। পানির তোড় আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বেশিক্ষণ ঝুঝলাম না, ক্লান্ত হবার কোনো মানে নেই। ভালোমতো ডুব দিয়ে উঠে এলাম। রাসেল আর বাকি দুই গাইড, ঝরণার উপরেই ঝিরিতে অল্প পানিতে গোসল সারলেন।
আমি সবসময়ই সত্য কথার পক্ষে, এই ট্যুরের শুরুতেও আমি, রাসেল আর দিবারাহ’র (প্রথমাধ্যায় পর্ব ৪ দ্রষ্টব্য) বিরোধিতাসত্ত্বেয় সত্য-কেই সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু রেমাক্রি বাজারে গাইড যে মিথ্যা বললেন!!! না, গাইড মিথ্যা বলেননি: কারণ আমাদের উদ্দেশ্য শুধু নাফা খুম নয়, নাফা খুম পার হয়ে সন্ধ্যার আগে জিন্না পাড়া পৌঁছানোই আজকের মূল উদ্দেশ্য। তিন্দু পাড়ার চেয়ারম্যান আমাদেরকে এই পরিকল্পনাই লিখে দিয়েছেন। তাই আমাদেরকে এবারে জিন্না পাড়ার পথ ধরতে হবে।
নাফা খুমের উৎসের দিকেই পথটা যাবে। আমরা ঝিরি ধরে, নাফা খুমকে বিদায় জানিয়ে পড়ন্ত বিকালে পথ ধরলাম জিন্না পাড়ার দিকে। রাতে ট্রেক করার প্রস্তুতি আমরা নিয়ে এসেছি, কিন্তু অধিকাংশ অভিযাত্রীর কাছেই অপরিচিত পথে রাতে ট্রেক করাকে কেন জানি না অসমর্থনীয় দেখেছি। এই জানুয়ারির (২০১৩) শেষেই আবু বকরের একটা অফ-ট্র্যাকে টর্চের আলোয় আটকে পড়ার ঘটনা জেনেছি। এমনকি, দ্রুত করার জন্য থং প্রি মুং-ও তাড়া দিচ্ছিলেন আমাকে। রাতকে এরা বড় ভয় করে। হয়তো পাহাড়ে ‘রাত’ ভয়ংকরই!
ঝিরির পাড় ধরেই আমাদের একঘেয়ে পথ চলা, আগে যেমনটা চলছিলাম। শুধু পার্থক্য হলো, এখন সবাই গোসল করে বেশ চাঙা হয়েছি, তাছাড়া বিস্কুট দিয়ে ভালো একটা নাস্তাও হয়েছে। নাফা খুম থেকে একটু সামনে গেলেই ডানদিকে একটা পাড়া, ফিরে এসে গুগল আর্থে দেখেছি, তখন এটার অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানা ছিল না। তার আরো একটু সামনে গেলে বামদিকে আরো একটা পাড়া। তখন এগুলো আছে, বুঝিনি। তবে গুগল আর্থে যেমনটা দেখা যায়, তেমনটাই… এরপর বহুদূর পথ বড্ড একাকী… নির্জন!
দু’পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, তার মাঝখানে ঝিরি, তার পাড়ে পাথর আর পাথর। পাথরকে পাশ কাটিয়ে কিংবা টপকিয়ে পথ ধরে হাঁটতে হচ্ছে। তবে এটা অফ-ট্র্যাক না, এপথে পাহাড়িরা যাওয়া-আসা করে, পাহাড়ি ট্রেইল আছে। বিশাল বিশাল পাথর পথের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। একটা পাথর চোখে পড়লো, বিশশাল! গাইড নুং চ তো উঠেই পড়লেন উপরে, লাফ দিয়ে। বিশাল পাথরটার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফের পথ চলা। বলা উচিত পাথরের জঞ্জাল ধরে পথ চলা।
তবে দুপাশে পাহাড় থাকায় পড়ন্ত সূর্যটা বড্ড বেশি আড়াল হয়ে গেছে। আলো কমতে বসেছে। আমাদের সাথে রাতে ট্রেক করার সব প্রস্তুতিই আছে, তবু পাহাড়িদের ভয়কে আলিঙ্গন করা আমাদের বাঙালির ঠিক সাজে কিনা জানি না। তাই পা চালিয়ে চলছি বরাবরের মতোই। রাসেলও দিব্যি ভালো হাঁটছে।
একটা জায়গায় এলাম, বেশ ঘন গাছ-গাছালি মাথার উপর। গাইড নুং চ বললেন, এখানকার নাম চিগো হয়। বাঘের থাবা বা বাঘের কামড় থেকে নাকি এই নাম। নাম শুনে ধারণা করতে হয়, একসময় বাঘের বিচরণ ছিল এখানে। কিন্তু মানুষের বিচরণ তার জন্য কাল হয়েছে বোধহয়।
ইতিউতি পাথর ডিঙিয়ে পথচলা… আসরের নামায পড়া হয়নি। তাই ঝিরির পানিতে ওযু করে একটা পাথরের উপর গামছা বিছিয়ে নামায আদায় করতে গেলাম। দুজন ভিনধর্মী গাইড আর আমাদের অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) রাসেল তখন অদূরে বসে ধূয়া পান করছে। সিগারেট শেষ হতে-না-হতে নামায শেষ হয়ে গেলো দেখে রাসেল বিশেষ আশ্চর্য হলো। জানালাম, ভ্রমণে নামায ছোট্ট হয়ে আসে: কসর নামায – চার রাকা’ত হয়ে যায় মাত্র দু’রাকা’ত।
আবার পথ চলা…
কখনও পাহাড়ের গায়ের খুব কাছে চলে যায় ট্রেইল, তখন পাহাড়ের গায়ে হাত রেখে ব্যালেন্স করে হাঁটতে হয়। আবার পাথরের দঙ্গল। কখনও ঝিরি ধরে পা ভিজিয়ে ওপাশে গিয়ে পথ চলা তো আবার এপাশে এসে পাথর ডিঙানো। তবে চারজনই বেশ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছি।
গাইড নুং চ আমার কাছে ঘেঁষে এলেন, ‘দা-দা, আম’রা জিন্না’ পা-ড়া যাওআর দক্কার নাই। আগে একটা পাড়া আসে, ওটাতে তাকবো।’ ভাঙা বাংলায় যা বললেন, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া দরকার, এর আগে পাড়া আছে আপনি নিশ্চিত? উত্তরে বললেন, ‘জ্বি’। ওখান থেকে আমাদের পথে যাওয়া যাবে তো? উল্টা দিকে হবে না তো? —এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরি, কারণ তিন্দু’র চেয়ারম্যান আমাদেরকে এদিকে জিন্না পাড়ার কথা বলেছেন, অন্য পাড়া থাকলে তিনি তার কথাই বলতেন। দেখা গেলো, নুং চ বেশ দৃঢ়। আমাদের মূল লক্ষ্যে যেতে এই পাড়াটাই শ্রেয় হবে জিন্না পাড়ার চেয়ে। তাই নুং চ’র বাতলে দেয়া বুদ্ধিতেই ভরসা করলাম। চললাম, এদিকে জিন্না পাড়া ব্যতীত অন্য পাড়ার উদ্দেশ্যে।
দুপাশের পাহাড় ঘেরা ঝিরি’র ট্রেইল পেরিয়ে এবারে বেশ সমতলে বেরিয়ে এসেছি। প্রায়ান্ধকার হয়ে উঠেছে পরিবেশ। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে পাড়াটা, নিশ্চয়ই কোনো মারমা পাড়া, কারণ ঝিরি থেকে খুব বেশি একটা উঁচু না পাড়াটা। ঝিরিতে মাছ ধরছে কেউ কেউ। নুং চ পথ দেখালেন। আমি আর নুং চ এগিয়ে গেলাম, পাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে। রাসেল আর থং প্রি মুং-কে রেখে গেলাম পিছনে।
অনুচ্চ পাহাড়ের উপরে উঠে গেলাম আমরা দুজন: এ হলো ঔলাওয়া পাড়া, বানানান্তরে ঐলাওয়া পাড়া (স্থানাঙ্ক: 21°44’43.97″N, 92°32’11.52″E)। ঘরগুলো অন্যান্য মারমা পাড়ার মতোই, মেঝে থেকে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে বানানো ঘর, টিন কিংবা ছনের চাল, সামনে বাঁশের বারান্দা, মারমা ভাষায় যাকে বলে তা-মিয়াং। পাড়ার উপরটা চেছে ফেলা পাহাড়, এখানে-ওখানে একটা-দুটা গাছ, একটু ঝোঁপ -এইতো। পাড়া মানেই তো কুকুর, একজায়গায় চোখ আটকে গেলো — ঠান্ডা থেকে বাঁচতে কুকুরের তিন/চারটা বাচ্চা গোল হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে — খুব মায়া লাগলো। …স্নেহ-মমতা অনেক হয়েছে, এবার থাকার জায়গা দরকার।
নুং চ একটা ঘরে গিয়ে জানতে চাইলেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরটা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক — পাড়ায় থাকার ব্যবস্থা নেই। এখান থেকে জিন্না পাড়া ঐতো দূরে দেখা যায় (স্থানাঙ্ক: 21°45’27.58″N, 92°32’7.25″E), কিন্তু জিন্না পাড়া বেশ উঁচু একটা পাহাড়ের উপরে। শেষমেষ ঐ উঁচু পাহাড়ে গিয়ে উঠতে হবে মনে করে কিঞ্চিৎ কষ্ট পেলাম। নুং চ-কে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম বাঙালি-লুঙ্গি পরা একজনকে অনুসরণ করে। নুং চ ফিরে এসে জানালেন স্কুল ঘরের একপাশে থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। আমি শুনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম — একটা খড়ের গাঁদায়ও রাত কাটানো এই পাহাড়ে অনেক বড় পাওয়া, আর এ-তো বেড়া দেয়া স্কুলঘর। সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম।
কিন্তু যে দুজন আমাদেরকে জায়গা দিলেন, তারা দেখা গেলো খুবই লজ্জাবনত। তাদের পাড়ায় কয়েকজন মেহমান এসেছেন, আর তাদেরকে কোনো জায়গা না পেয়ে স্কুলঘরে থাকতে দেয়া হচ্ছে – বিষয়টা তারা না-চাইতে মেনে নিচ্ছেন যেন। বারবার বলছেন, আপনাদের কষ্ট হয়ে যাবে। আমি তখন বারবারই বলছি, দাদা, আপনাদেরকে কষ্ট দিয়ে দিচ্ছি।
স্কুলঘরটা অনুচ্চ পাহাড় থেকে একটু নিচে টিলা-সমতলে; নাম: ঐলাওয়া পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাংলাদেশ সরকার আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের সমাজ উন্নয়ন অঙ্গের আওতায় নির্মিত। স্কুলটার নির্মাণশৈলীতে কোনো পাহাড়ি ছাপ নেই: বাঁশের বেড়া, টিনের চালা থেকে মাটিতে লাগানো পাকা করা মেঝে, Z-ফ্রেমের দরজা-জানালা — আর-দশটা বাঙালি স্কুলের মতো। ছোট্ট স্কুলটাতে মাত্র তিনটা দরজা, তারই একেবারে ডানদিকের দরজাটা খুলে দিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি।
বাঙালি-লুঙ্গি পরা ব্যক্তির নাম উচ্চয়য়, আর আরেকজনের নাম অং থোয়াই চিং মারমা; দুজনই এই স্কুলের শিক্ষক। অং থোয়াই’র ভাগ্নে হলেন উচ্চয়য়। ডানদিকের ঘরটা খুলে বেঞ্চগুলো একটার উপর আরেকটা তুললে ওপাশে ভিতরে একটু প্রশস্থ একটা জায়গা বেরিয়ে এলো। মামা-ভাগ্নে মিলে নিজেদের ঘর থেকে একটা চাটাই, তিন-চারটা নিজেদের বোনা কম্বল, অন্য মানুষের ঘর থেকে খুঁজে আরো দুয়েকটা কম্বল নিয়ে এসে আমাদেরকে দিলেন। পাহাড়ের শীতের ব্যাপারে ভালোই জানি, এই কম্বল যে আমাদের খুব দরকার এরাও বুঝলেন। তবু আমাদের কষ্ট হয়ে যাবে বলে তারা খুবই অবদমিত।
নুং চ আর উচ্চয়য়-কে পাঠালাম খাবারের ব্যবস্থা করতে, এদিকে অং থায়াইকে জানালাম কোথায় যেতে চাচ্ছি আমরা। অং থোয়াই খুবই বিজ্ঞ একটা ভাব নিয়ে কথা বলেন, জানেন বোধহয় সে তুলনায় কম। তবে যতটুকু বুঝলাম, ঠিক ফাঁকা কলসি হিসেবে বেশি বাজছেন ব্যাপারটা সেরকম না, এই লোকের কথা বলার ধরণটাই এমন। …যে লেকে যেতে চাচ্ছি আমরা, শুনে একটু কল্পনা করতেই জানালেন, ‘হ্যা, আছে তো! বগা লেকের সাথে…’
…না, আমরা বগা লেক যাচ্ছি না। কিন্তু যেখানে যাচ্ছি, বগা লেকের সাথে সেই লেকের যে সম্পর্কের কথা জানালেন অং থোয়াই, শুনে তো আক্কেল গুড়ুম আমার আর রাসেলের! জানালেন, এব্যাপারে তাঁর দুলাভাই আরো ভালো তথ্য দিতে পারবেন, তিনি এব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ।
এদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। নুং চ ফিরে এসে জানালেন চাল আর চারটা ডিম কেনা হয়েছে। মুরগি পাওয়া যায়নি। যথেষ্ট ভালো খাবার। আমরা কাপড়-চোপড় বদলে নিতে চাই, কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে টর্চের আলো ছাড়া কোনো আলো নেই। যাবার আগে আমি মোমবাতি আর লাইটার নিয়ে গেছিলাম, কাজে লাগলো — ব্যাগটাতো আর এমনি এমনিই ভারি হয়নি! মোমবাতি জ্বালিয়ে শীতের কাপড় চড়ালাম গায়ে, ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে।
আমি আর নুং চ গেলাম রান্না করতে। উচ্চয়য় আমাদেরকে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে, তাঁর বাবার নাম মংলীগিহ, অং থোয়াই’র দুলাভাই। এঘরে সৌরবিদ্যুতের আলো। রান্নাঘরে গেলাম, সেখানে তাদের ঘরের রান্না চলছে। চুলা খালি হলে পরে আমরা তাদেরই একটা ডেকচি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আনা রসদ থেকে ডাল ভিজালাম। এদেরই ঘর থেকে চাল কেনা হয়েছে, সেই চাল ধুয়ে নিয়ে সঙ্গে করে আনা পিয়াঁজ, হলুদ, লবণ, তেল ইত্যাদি দিয়ে ডাল চড়ালাম আমরা। আমি বাসায় রান্নার ধারে-কাছেও যাই না, তাবলীগে একবার খেদমতের দায়িত্বে ছিলাম — রান্নার অভিজ্ঞতা আমার তাই খুবই কম। নুং চ’রও খুব বেশি না। দুই অনভিজ্ঞ তাই চারজনের জন্য আধা কেজি ডাল বসিয়ে দিলাম চুলায়। হায়! হায়!! পরে দেখে, ঘরের মেয়েরা হেসে কুটিকুটি। …ডালের মধ্যে দিলাম ঝাল-ঝাল পাহাড়ি মিনি-মরিচ; পাহাড়িরা অনেক ঝাল খায়, আমিও তাই পাহাড়িদের মতোই ঝাল খেতে চাইলাম, যদিও বাস্তবে আমি ঝাল এক্কেবারেই খাই না। কিন্তু তখন চিন্তা করলাম, পাহাড়ে গিয়েছি, পাহাড়িদের মতো করে খাবো।
এদিকে রান্না যখন চলছে, আমি মংলীগিহ’র থেকে কিছু তথ্য বের করতে চাইলাম। তিন্দুর চেয়ারম্যান আমাদেরকে যে পথের কথা বলেছেন, সেপথে শুনেছি বড় বড় পাহাড় পাড়ি দিতে হবে, সেটা সত্যি কিনা। মংলীগিহ বেশ চাপা স্বভাবের, ইশারায়ই অনেক কথা বলতে চান। শেষমেষ যা জানলাম, আমাদের গন্তব্যে যেতে দুটো পথ হতে পারে – একদিকে গেলে তিনটা পাহাড় পাড়ি দিতে হবে, অন্যদিকে দুটো পাহাড়। তবে তিনটা কিংবা দুটো — সব পাহাড়ই বেশ খাড়া। তিনিই জানালেন, দিনের প্রচন্ড রোদে বেশ কষ্ট হবে পথে। তবে তাদের বাহাদুরিও শুনলাম: এই পাহাড়গুলো বেয়েই তিনি বহুবার থানচি থেকে মাথায় করে এক মণ চালের বস্তা নিয়ে এসেছেন এই পাড়ায়। সেকথা শুনে বেশ হিম্মত পেলাম। আশাব্যঞ্জক কথা হলো ওপথে তিনিও কালকে সকালে যাবেন, তাঁর সাথে যেতে হলে সাড়ে সাতটায় রওয়ানা করতে হবে। আমরা অবশ্যই যাবো।
আমি একটা ছবি তুলতে চাইলে দেখলাম মংলীগিহ মানা করে দিলেন। কিন্তু উচ্চয়য় যখন ক্যামেরার ছবির সুনাম করলেন, তখন মংলীগিহ না-পেরে যেন অনুমতি দিলেন। আমি ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুলে যখন ডিসপ্লেতে দেখালাম, তখন বেশ খুশি হয়ে গেলেন তিনি।
পাহাড়িরা আগেভাগে ঘুমিয়ে পড়েন। আমাদের রান্না হয়ে গেলে তাঁদেরকে খেয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিয়ে আমরা আবার স্কুলঘরে ফিরে এলাম। ফেরার পথে মংলীগিহ’র ঘর থেকে কাঠের চ্যালা নিয়ে স্কুলঘরের পাশে একটা গর্ত করে আগুন জ্বাললাম আমরা। শরীরটা যতটা ব্যাথা করবে ভাবছিলাম, ততটা করছে না। ব্যাথা সব আমার ঐ মচকে যাওয়া গোড়ালিতে। তাই আগুনে সেঁকে ব্যথা দূর করার চেষ্টা করলাম।
আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আমি আর রাসেল তখন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, শেখ মুজিব, জয় বাংলা ইত্যাদি ইস্যুতে সত্য-মিথ্যা ইত্যাদির ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে রাসেল ভালোই একটা ব্রিফিং দিয়ে দিল আমায় – কমিউনিটি ব্লগ থেকে শিখেছে এসব। ইতিহাস-শিক্ষণ পর্ব শেষে ভক্ষণ পর্বে গেলাম। ঘন, আধা-সেদ্ধ ডালের সাথে জুমে চাষ করা চাল, আর সেদ্ধ ডিম – অমৃত খাবার যেন। ঝালটা অবশ্য রাসেলের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো – ওব্যাটা একটা ফার্মের মুরগী।
খাওয়া-দাওয়া শেষে দ্রুত শুয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করলাম। যখন স্কুলঘরে ফিরছি, তখন মাথার উপর পূর্ণিমার ফকফকা চাঁদ যেন সব মায়া ঢেলে দিচ্ছে এধরায়। সেই মায়াকে ফায়ার করে ফার্মের মুরগী’র তখন বিষ্টা ফেলার দরকার পড়লো— এখন দরকার বদনার। অং থোয়াই-কে বলে একটা বদনার ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু তবু ব্যাটা যায় না। কী হলো? একটা বোতলও লাগবে। কেন!! এক বদনা পানিতে তার পোষায় না। লাও ঠ্যালা! আমি তো খাবার পানির বোতল দেবার প্রশ্নই উঠে না, সে শেষে তারই একটা বোতল নিলো। তাও ব্যাটা যায় না। আবার কী হলো? মামা, তুই একটু আয়, একজন আমারে পাহারা না দিলে আমার হয় না। যারা অফ-ট্র্যাক পড়েছেন, তারা বুঝতে পারছেন, মারমা পাড়াতে খোলা আকাশের নিচে নিজেকে মেলে ধরতে হয়। শহরের এই ছেলেটা দরজা আটকাবার সুযোগ পাচ্ছে না বলে অ্যালার্ম হিসেবে দরকার একজন লোক। আমি এশার নামায পড়বো, তাই গেলাম না। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় গাইড থং প্রি মুং-কে নিয়ে যাবে। এই বিতিকিচ্ছাই সে করছে… আমি ততক্ষণে বেরিয়ে গেলাম নিচে, ঝিরিতে।
চাঁদের আলোয় পথ চলতে চাইলাম, টর্চটা তাই বন্ধ রাখলাম। রাতে, নিঝুম পাহাড়ে, একাকি হেঁটে ঝিরিতে নামছি – আমার বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছে না। ঝিরিতে গিয়ে ওযু করলাম, তারপর ফিরে এলাম ঘরে, রাসেল তখনও যাচ্ছে। ওর যা ইচ্ছা করুক, তাও সকালে যেন পেইন না দেয়, এখনই যা করার করে ফেলুক। গামছাটা বিছিয়ে এশার নামায পড়লাম, চাঁদের অবস্থান আর সপ্তর্ষি দেখে পশ্চিম আগেই ঠাওর করে এসেছি – একটু বাঁকা হয়ে পড়তে হবে কেবলার দিকে।
নামায পড়তে পড়তে নুং চ ঘুমিয়ে সারা। আমি শোবার প্রস্তুতি নিলাম। ব্যাগ ভর্তি করে শীতের কাপড় নিয়ে এসেছি, কারণ আমাকে শীতই বেশি কাবু করে। ডাবল পরে নিলাম গায়ে, তারপর কম্বল গায়ে দিয়ে শু’লাম। রাসেল তার কৃতকর্ম শেষ করে ফিরে এলো, কিন্তু অসন্তুষ্ট – নারে, হলো না। যাও, কামান দেগেও মশা মারা গেলো না!
শোয়ার প্যাটার্ন: আমি-রাসেল-থং প্রি মুং-নুং চ মং। কিন্তু শোবার সময়ই লক্ষ করলাম, দরজা, ভিতর থেকে আটকে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। শেষে একটা বেঞ্চ দিয়ে আটকানো হলো দরজা। এদিকে যেখানে মাথা দিয়েছি, সেখানে বাইরে থেকে বিশাল সব ফোকর, ভিতরের বেড়ায়ও একইরকম ফোকর। যে-কেউ হাত গলিয়ে ঘুমন্ত আমার ক্যামেরটা বগলদাবা করে ফেলতে পারে। শহুরে আমাদের আর কিছু থাকুক না থাকুক – সন্দেহবাতিক একটা মন ঠিকই আছে। তাই হাতের মধ্যে ক্যামেরার ব্যাগ আর ক্যামেরার ফিতা প্যাঁচিয়ে ঘুম দিলাম।
রাতে বেশ ঠান্ডা পড়লো, কিন্তু আজকে দুটো কম্বল আর ডাবল র্যাপিং-এর কারণে বেশ উষ্ণই অনুভব করলাম। স্বপ্নহীন একটা গভীর ঘুম দিলাম। সকাল সাড়ে ছয়টায় যদি রওয়ানা করতে হয়, তাহলে উঠতে হবে কমপক্ষে একঘন্টা আগে, নাস্তাও করতে হবে। আমরা না গেলেও মংলীগিহ্ ঠিকই চলে যাবেন। তাঁকে ধরতেই হবে যে করে হোক। ফযরের অ্যালার্ম বাজলো, কিন্তু ঘুমের গভীরতায় সজাগ হতে পারলাম না। পুরোটা দিনের পরিশ্রমের পরে ঘুম কি ভাঙবে সাড়ে পাঁচটায়?
না, একটু দেরিই হয়ে গেলো। ঘুম ভাঙলো সাড়ে ছয়টায়। মংলীগিহ্ পগার পার। উঠে, আমি আর নুং চ চলে গেলাম নাস্তা তৈরি করতে। নাস্তা তৈরি করে এসে আমি যখন আমার হিসাব মিলিয়ে ফেলেছি, রাসেল তখন তার রাতের বকেয়া হিসাব মিলাতে গেল, স্বাভাবিকভাবেই থং প্রি ছিলেন পাহারাদার এবং বদনার পাশাপাশি এক বোতল পানিও বরাদ্দ ছিল তার জন্য। যেকোনো ট্যুরেই এই একটা বিষয় নিয়ে রাসেল সবচেয়ে বেশি যন্ত্রনা দেয়।…যাহোক চাল আর রাতের থেকে যাওয়া ডাল দিয়ে একটা অপরিমিত মিশ্রণের খিঁচুড়ি রান্না করলেন নুং চ। তা দিয়েই নাস্তা সারা হলো।
ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ার উদ্যোগ। রাতের থাকা (৳৩০০), ডিম ৪টা (৳৬০) আর চাল (৳৩০) বাবদ মোট ৳৩৯০ [টাকা] বুঝিয়ে দিলাম অং থোয়াই চিং-এর হাতে। খুবই লাজুক ভঙ্গিতে টাকাটা নিলেন তিনি। আমরা শেষমেষ বিদায় নিলাম সবার থেকে। পায়ে অ্যাংকলেট আর নী-ক্যাপ ফের পরে নিয়ে জুতা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ঔলাওয়া পাড়া থেকে উত্তর দিকে নেমে এলাম ঝিরিতে। এই ঝিরি ধরেই কিছুদূর এগিয়ে যেতে হবে। আমার পিঠে বিশাল ব্যাগ, আর পেটের মধ্যে বাঁধা ক্যামেরার ব্যাগ। কিছুদূর যাবার পর বুঝলাম, এভাবে ক্যামেরার ব্যাগ থাকলে পাহাড়ে উঠতে সমস্যা হবে, কারণ পাহাড়ে উঠার সময় হাঁটু বারবার ক্যামেরার ব্যাগের নিচে এসে লাগবে। তাই ক্যামেরা হাতে নিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা পুরে নিলাম পিঠ-ব্যাগের ভিতর। ব্যাগটা রীতিমতো টানছে পেছন দিকে।
এটি হলো নাইক্ষ্যং ঝিরি, পাশেই নাকি নাইক্ষ্যং পাড়াও। ঝিরিতে কিছু পাখির দেখা পেলাম। ঝিরি থেকেই নিয়ে নিতে হবে পানি… পাহাড়ে আর পানি পাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে পাহাড়ে চড়াই শুরু… সামনে দুটো পাহাড়, আর ঐ সুদূ-রে কাঙ্ক্ষিত সেই লেক।
অজানা লেকের অভিযানে দুই গাইড আর আমাদের দুজনের অভিযাত্রা সত্যিকার অর্থেই যেন শুরু হলো…
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম