অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান - নিশাচর

অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান ২০১৩ : চূড়ান্তাধ্যায়

« অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান : প্রথমাধ্যায়
« অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান : দ্বিতীয়াধ্যায়
« আগের পর্ব

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | ০৯:০০

অজানা লেকের অভিযানে তিন্দু থেকে আমি, রাসেল আর প্রভার দলটা বেরিয়ে পড়ার পর কিছুক্ষণ চলার পরই প্রভা বুঝতে পারলো তার পক্ষে আর সামনে এগোন সম্ভব না। তাই নুং চ-কে সাথে দিয়ে তাকে ফেরত পাঠালাম আমরা আবার তিন্দুতে। (দ্বিতীয়াধ্যায়:পর্ব ১ দ্রষ্টব্য)

অনেক কষ্ট হচ্ছিলো ওর। কেন যেন ওর পা ওর সাথে বেঈমানী করছিলো। নুং চ-ও অনেক সহায়তা করলেন ওকে। পাহাড়, যা আমরা পেরিয়ে এসেছিলাম, ততটুকু আবার ডিঙিয়ে ফিরে যেতে তার রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছিল। কিন্তু তবু সে তাড়াহুড়া করছিল, যদি নাকিবদেরকে পাড়ায় গিয়ে ধরা যায়।

পাড়ার কাছাকাছি হলে প্রভা স্বপ্রণোদিত হয়েই নুং চ-কে চলে যেতে বললো – শেষবারের মতো কুলাকুলি করলো নুং চ’র সাথে। যাবার আগে নুং চ’র ব্যাগে নিজের আনা রেশনটুকু (চকলেট, খেজুর) ঢুকিয়ে দিলো তার ছেড়ে আসা দুই সঙ্গীর জন্য। নিজের কষ্টকে আমলে না এনে পা টেনে টেনে তিন্দুর দিকে এগিয়ে চললো প্রভা। নদীর পাড়ের মাঝারি আকারের পাথরগুলোকে একেকটা দৈত্য মনে হতে লাগলো – মাথার উপরের রোদটাকেও অসহ্য লাগছে, তার চেয়েও বেশি অসহ্য লাগছে ঐ পা জোড়াকে – রাবারের মতো হয়ে গেছে। মনের সামনে রাখা আর গহীনে জমিয়ে রাখা যতপ্রকার গালাগাল আছে, সব ঝাড়া প্রায় শেষ – কারো উপর নয়, নিজের অদৃষ্টের উপর। শরীরের এই অবস্থায় যতটা পারা যায় দ্রুত করার চেষ্টা করছে সে। আগে গেলে নাকিব ভাইদেরকে ধরতে পারবে তিন্দুতে।

 

আমাদের দলটা তিন্দু ছাড়ার পর দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো নাকিব। দলে ছিল আরো ছয় জন: ইফতি, তরুণ, দানিয়েল, শান্ত, দিবারাহ, আবির। একটা নৌকা এলেই ওরাও বেরিয়ে পড়বে থানচির দিকে, আজকেই ঢাকার পথ ধরতে হবে ওদেরকে।

নাকিব ততক্ষণে তিন্দু পাড়াটা একটু চক্কর দিলো। তাদের বিশাল ব্রয়লারে জুমের আদা জাল দেয়ার ছবি তুললো নিজের ক্যামেরায়। ঘাটে নৌকা আসার আগেই সবাই নাকিবের নেতৃত্বে নিজেদের বোঁচকাবাচকি গুছিয়ে তিন্দুর ঘাটে অপেক্ষারত। এর আগে নাকিব, গতরাতে থাকা আর খাওয়া বাবদ কটেজ-মালিক মে দাও-কে টাকা পরিশোধ করে বেরোল।

ইঞ্জিনবোট আসার আগে কতইনা মজা করছে একেকজন। বোট এলে সাতজনের দলটা সাথে সাথে উঠে পড়লো বোটে। বোট চালু হয়ে গেলো। এখানে আরো কিছুটা সময় কাটাতে না পারার আক্ষেপ রেখেই দলটা চললো ফিরতি পথে – থানচির দিকে। এবারে আর ভাড়া নিয়ে হাবিজাবি নেই, ভাড়া এবারে ওদের জানা – জনপ্রতি ৳১২০।

বোটটা ভটভট আওয়াজ তুলে থ্রটল করলো। সবাই বিদায় জানালো প্রচণ্ড উন্মত্ত এক ঝড়ের বেগে কত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা এই তিন্দুর মায়াকে, বোট এগিয়ে চললো থানচির দিকে। মোড় যখন ঘুরছে বোট, তখন তারা ঘুণাক্ষরেও একবার পিছন ফিরে তাকাবার কথা চিন্তা করেনি – যদি তাকাতো, তাহলে অনেক দূরে তিন্দুর দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে থাকা প্রভাকে ঠিকই দেখতে পেত তারা।

বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো প্রভা… নাকিবদের দল চললো ঢাকা যাবার সংগ্রামে সামিল হতে।

 

দূরে একটা বোট যাচ্ছে এদিক থেকে, বুঝতেও পারেনি প্রভা ওটাতে করেই নাকিবরা চলে যাচ্ছে। কোনোরকমে পা টেনে টেনে সিঁড়ি ভেঙে পাড়ায় উঠলো সে। একেকটা সিঁড়ি টপকাতে একেক বছর লাগছিল যেন। মে দাও-এর কটেজে যখন শুনলো ওরা চলে গেছে, তখন আরো মুষড়ে পড়লো যেন খানিকটা। মে দাও সাদরে তাকে বসতে দিলো। পানি খেলো যেনবা এক গামলা। হয়তো হতাশা ঘিরে ধরেছে ওকে – একা হয়ে যাবার হতাশা। এবারে নিজের চিন্তা নিজেকেই করে নিতে হবে। ওরাই ধরাধরি করে তুললো তাকে দোতলার ঘরটাতে। একটু চিন্তা করতে চাইলো পরিস্থিতিটা। নয়ন ভাইদের দলটা অজানার পথে গেছে, নাকিব ভাইদের পথটা গেছে থানচিতে। ওখানে গিয়ে বাস ধরতে দেরি হলে পরের বোটটা ধরা গেলে এখনও ওদেরকে ধরার সুযোগ হাতছাড়া হয়নি। আশান্বিত হলো সে। আশার আলো চিন্তাকে আবার সুতোয় গাঁথলো নতুন করে। ব্যাগ হাতড়ে ব্যাথানাশক ঔষধ বের করলো প্রভা খাবে বলে। শরীরের কষ্ট যদি কিছুটা প্রশমন করা যায়, ক্ষতি কী? …অনেকক্ষণ পরে মে দাও জানালেন, একটা বোট আটকানো হয়েছে, এক্ষুণি ঘাটে গেলে ওটাতে চড়া যাবে।

ঐ শরীরে যতটা দ্রুত করা যায় আর কি… ঘাটে গিয়ে পরের বোটে চড়লো প্রভা। পায়ে ব্যথাসত্ত্বেয় কিছুটা চাঙা লাগছে এখন – অবশ্যই নাকিব ভাইদেরকে থানচিতে গিয়ে ধরা যাবে।

 

নাকিবদের বোটটা এগোচ্ছে, আর বোটে বসা প্রত্যেকেরই ক্যামেরা চলছে পটাপট। মাছ ধরার দৃশ্য, নদীতে নারীদের গোসল করার দৃশ্য কিংবা শামুক কুড়ানোর দৃশ্য, ছোট্ট মেয়েদের ক্যামেরা দেখে মুখ আড়াল করার দৃশ্য… একসময় বোট এসে ভিড়লো পদ্মমুখে। আর সেখান থেকে বোটে চড়লেন গতকালকের সেই সাদা গ্যাঞ্জি লোকটা। একপশলা হাসি সবার মুখে – চিনতে পারার হাসি।

বোট যখন থানচি ঘাটে ভিড়লো, তখন এই সাদা গ্যাঞ্জির ভাড়াটাও চুকাতে হলো নাকিবদের। দ্রুত করতে হবে, সবকিছু সময়ের কঠিন হিসাবে বাঁধা – চেয়ারম্যানের দোকানে রাখা জিনিসপত্র সংগ্রহ করলো সবাই দ্রুত। তারপর সোজা বাসস্ট্যান্ডে দে ছুট। বেশিক্ষণ নাই বাস ছাড়ার।

বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দুপুর সাড়ে বারোটার বাসের টিকেট কেটে উঠে পড়লো দলটা – থানচির এই অ্যাডভেঞ্চারকে পিছনে ফেলে লক্ষ্য এবার বান্দরবান। দলে মানুষ বেশি হলে হৈ চৈ হারিরিরি চলবেই। কখনও আবার ইফতি বাবাজি তরুণকে নকল করে বলে উঠছে: দাদা গুমাচ্চেন? কখনওবা আবির আগা-মাথাহীন একটা কিছু বলে বসছে। …কাটায় কাটায় সাড়ে বারোটায় থানচি থেকে বাস ছাড়লো বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।

আর ওরা বুঝতেই পারলো না, ঠিক ঐ সময়ই থানচি শহরের আরেক মাথায় একটা বোট লেগেছে। আশান্বিত প্রভা থানচিতে পা রেখেছে।

 

কোনো উপায় নেই যোগাযোগের। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। প্রভা থানচিতে, আর নাকিবের সাতজনের দলটা তখন থানচি ছেড়ে বাসে। চেয়ারম্যানের দোকানেই নিজের ক্যাম্প করলো প্রভা। এর পরের বাস সাড়ে চারটায়। অপেক্ষা… অপেক্ষা… অপেক্ষা…

 

নাকিবদের বাস বান্দরবান গিয়ে পৌঁছলে ওরা তাড়া অনুভব করলো, হাতে সময় কম। দ্রুত  না করলে ঢাকায় যাওয়া হবেনা ওদের। এক্ষুণি চট্টগ্রামের বাস ধরতে হবে। কারণ, চট্টগ্রামে বন্ধু নিঝু ওদের জন্য চট্টগ্রাম মেইলে সাতটা সিট কেটে রেখেছে, ট্রেন ছাড়বে সাড়ে ১০টায়। দ্রুত চট্টগ্রামের টিকেট করে ওরা কিছু খেয়ে নিলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাস ছাড়তে একটু দেরি। জিরিয়ে নিলো ওরা। বাস ছাড়ার সময় হলে আগেভাগে বাসে উঠে পড়লো। বাস ছাড়লো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।

ঐ সময়ই বান্দরবানের আরেক প্রান্তে থানচি থেকে প্রভার বাস এসে ভিড়লো।

 

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | বিকেল

আমি আর রাসেল থানচি থেকে বান্দরবান ফিরে বাসস্ট্যান্ডে প্রভাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যার-পর-নাই আশ্চর্য হলাম – এ ব্যাটা এই দুই দিন এখানে থেকে কী করেছে!

“সব বলবো, আগে হোটেলে চলেন।” প্রভাই আমাদেরকে হোটেলে ওর বুক করা রুমে নিয়ে আসে। অথচ সারা পথ রাসেল কত পরিকল্পনা করছিলো, কোনো এক হোটেলে গিয়ে জাতীয় মামাকে বলবে, এই নাও টাকা, একটা রুম দাও, আর নাহলে একটা বাথরুম দাও, গোসল করে ফ্রেশ হই। কে জানতো আমাদেরকে ভিআইপি স্বাগত জানাতে প্রভাই দাঁড়িয়ে থাকবে বান্দরবানে।

প্রভা এখানে আসার পরে হরতাল শুরু হয়ে যায়। আটকা পড়ে যায় বেচারা। আমাদের সাথে অজানার পথে বেরোতে না পারার কষ্ট-দুঃখ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আর, বান্দরবানের এই স্বর্গে এসে সে শিডিউল সময়ের আগে কোনোভাবেই ঐ ঢাকার আস্তাকুড়েতে যেতেও চাচ্ছিল না। নিজে নিজেই মোক্ষম সিদ্ধান্ত নিলো – পকেটে আছে টাকা, যাবো না এবার ঢাকা, বান্দরবানে শুয়ে শুয়ে কাঁদবো আমি একা। কাঁদলো কিনা জানি না, আমরা যখন বান্দরবানের গহীনে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছিলাম, প্রভা তখন বান্দরবান মুখস্থ করছিল।

হোটেলে ঢুকে ব্যাগ রেখেই আগে গেলাম টিকেট বুক করতে সৌদিয়ায়। সৌদিয়ায় গিয়ে (তিনজনে ৳১,২৪০) ঢাকার রাতের বাসের টিকেট করলাম। বাস ছাড়ার আগে অঢেল সময়: চলে গেলাম বান্দরবানের সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে – অণির্বাণ তিরিশ। বান্দরবান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে তাদেরই পরিচালিত ক্যান্টিন – খাবার মান খুবই ভালো। এবারে গিয়ে দেখি ওটার নাম হয়ে গেছে আরেকটা। কারণ হলো, আগে এক ব্যাটালিয়ন এখানে কাজ করতো, এখন আরেক ব্যাটালিয়ন। পেট পুরে এটা-ওটা (বিশেষ করে বসনিয়া রুটি) খাওয়া-দাওয়া শেষে ঢাকার বাসে উঠলাম।

 

ভোরে ঢাকায় নেমে যাত্রাবাড়ির জ্যামে বসে থাকতে থাকতে জাবর কাটছিলাম নুং চ মং-এর ভালোমানুষি, তিন্দুর চেয়ারম্যান আর হেডম্যানের হৃদ্যতা, পাড় মাতাল খইশামু মারমার কামুক আন্তরিকতা, টাকার মেশিন থং প্রি মুং-এর গলাকাটা ছুরির ধার, সাদা গ্যাঞ্জির বিপদে সহায়তার মানসিকতা, রুনাজন পাড়ার ঐ লোকটির কলা দিয়ে আতিথেয়তা, কাইন্দং পাড়ার উ সাই খয়-এর বিনামূল্য মেহমানদারী, ওংফু খিয়াং-এর থানচিতে বসে বান্দরবানে সহায়তা করা, ড্রাইভার নাজমুলের (ছদ্মনাম) গাড়ি ভাড়া করার জন্য নিঃস্বার্থ দৌঁড়াদৌঁড়ি… বলে কি আর শেষ করতে পারবো তেরো পর্বে লেখা এই তিনদিনের মহাপরিক্রমা এই একটা অনুচ্ছেদে? যানবাহন নিঃসৃত তাপ আর সূর্যিমামার চেহারাদর্শনহেতু ঘামে ভিজে ভিজে খুব মিস করছিলাম নাফা খুমের শীতল জলের ঐ টুপ করে দেয়া ডুবটা।

আবারো হয়তো বেরিয়ে যাবো কোথাও ডুব দিতে… ঈশ্বরই জানেন, এই মোহময় শহুরে জগৎ থেকে ছাড়া পাওয়া হবে কি?

(…সমাপ্ত)

-মঈনুল ইসলাম
wz.islam@gmail.com

পুনশ্চ: এই ঘটনা লিখে শেষ করতে পারিনি, ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নো পড়ে পড়ে রবার্ট ল্যাংডনের সাথে আমাদের হংস-প্রভা চেলে গেছে তুরষ্ক – ইস্তাম্বুলে। আর একই সময়ে  দিবারাহও ইন্টার্নশিপ করতে চলে গেছে কামাল আতাতুর্কের ঐ পেইগান-মুসলিম শহরে। …পাঠক, এ দুটোর মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার দরকার নেই।

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

5 thoughts on “অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান ২০১৩ : চূড়ান্তাধ্যায়”

    1. http://www.facebook.com/soothtruthbd ঠিকানায় এই পোস্টের পরবর্তিতে পুকুরটা অবস্থান গুগল ম্যাপ্‌স-এ প্রকাশের কথা উল্লেখ করেছিলাম। ওটা অনুসরণ করে দেখলে বুঝবেন সাকা হাফং থেকে পুকুরটা কত দূর।
      আমাদের ঔলাওয়া পাড়া থেকে তংক্ষিয়্যং পাড়ায় পৌঁছার পুরো ট্রেকটা আপনাকে আবার পিছু ফিরে যেতে হবে ওখান থেকে সাকায় যেতে হলে।

  1. এত কাহিনী নিয়ে না লেখেও পারতেন। আর আপনারা শুরুর দিকের ট্রেকার এইভাবে এই ছোট ট্রেইলে এত বড় করে উপস্থাপন না করলেও চলতো।

মন্তব্য করুন