ধারাবাহিক: অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান —এর একটি পর্ব
পায়দল থানচি থেকে নাফা খুম রওয়ানা, পথ-প্রদর্শক, মানে গাইড হলো খইশামু মারমা; হাঁটা পথ এনে তুললো নৌকায়, আর সেই নৌকা এসে ভিড়লো পদ্মমুখে। ফুরিয়ে যাওয়া তেল ভরে নিতে গিয়ে নৌকা যখন ফুরফুরে মেজাজে চলার কথা, তখন কয়েকজন লোক আমাদেরকে এই গাইড নিয়ে যেতে মানা করতে থাকলেন বেশ জোরেশোরে। মহা বিপদে পড়লাম!
নাকিব এসবে তেমন কিছুই যেন বুঝে না, রাসেল আর আমার মাথা খারাপ। আমি শুনছি খইশামু’র কথা, সে অকথ্য ভাষায় বলে ‘ঐ সাদা গ্যাঞ্জির সাথে কিসের কথা? ওই [অশ্রাব্য গালি]-রে নিয়ে যাও, আমি আর যাবো না’। আর, রাসেল শোনে ওপাশের কথা, ‘এই লোক আপনাদেরকে ভুল বোঝাচ্ছে’। …থানচি সম্পর্কে আমি মোটামুটি অজ্ঞ, রাসেল আবার তার বন্ধুদের অভিজ্ঞতায় থানচি সম্পর্কে কিছুটা হলেও জ্ঞান রাখে। তাই সব শুনে আমার আর নাকিবের সাথে আলোচনায় দাঁড়ালো: শোন্, আমার মনে হয়, নাফা খুম আজকে সম্ভব না। আমাদের মনে হয় সামনে তিন্দুতে চলে যাওয়া উচিত, ওখানে গেলে আর্মি ক্যাম্পও আছে, নিরাপত্তা থাকবে। কালকে সকালে উঠে তোরা থানচিতে ফিরতে পারবি। এই লোককে নিয়ে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
এদিকে আমি আমার ব্যাগটা কাঁধে তুলতে যেতেই… ক্যাঁট করে ফিতার একটা হুক ভেঙে এক কাঁধ পড়ে গেল। সামনে আরো বহু কঠিন ট্রেক বাকি, অথচ ব্যাগের এক কাঁধ ছেঁড়া!! মহাবিপদে পড়ে গেলাম। নাকিব তখন এগিয়ে এলো – ব্যাগটার ফিতা নিয়ে নিচের ফিতার সাথে প্যাঁচিয়ে কষে একটা গিট্টু (ওভারহ্যান্ড নট) দিলো। ব্যস, ব্যাগ আবার পাঙ্খা হয়ে গেলো।
দিবারাহ সাথে, নাকিব ঐ দলের দলপতি হলেও সে এই পথে নতুন – তাই স্বভাবতই আমি আর রাসেল তাদেরকে নিরাপদ রাখার এক অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে গেছি। …সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত আমরা নৌকায় উঠলাম আবার। তবে সিদ্ধান্ত হলো:
- খইশামুকে বাদ দিয়ে দিতে হবে;
- আজকে নাফা খুম বাদ, তিন্দুতে রাত কাটাতে হবে;
- ওদেরকে তিন্দুতে নিরাপদে রেখে আমরা তিনজন আমাদের পথ ধরবো।
তিন্দুতে যাবো বলায় খইশামু বললো, নৌকাকে আরো ৳১,০০০ [টাকা] দিতে হবে। মানে কী? কিন্তু যাচাই করার কোনো উপায় নেই, আমাদের এখন তিন্দু যাওয়া দরকার। ইফতি আমাদের হয়ে খরচ করছে, খরচ একহাতে হওয়া ভালো – ও-ই টাকা বের করে দিলো।
সকালে যেখানে ৫জন করে একেকটা বোটে আনার কথা বলছিলো মাঝিরা, এখন সেখানে এক নৌকায়ই আমরা ১০জন, সাথে ১০টা ব্যাগ; খইশামু আর সাথের ছেলেটা; নৌকার মাঝি; আর, পদ্মমুখ থেকে সাদা গ্যাঞ্জি এসে উঠেছেন আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে (এমনটাই তিনি বললেন) – অর্থাৎ মোট এখন ১৪জন আর ব্যাগ। কিভাবে কী, আল্লা’ জানে।
ইঞ্জিন চালু হলো, গতি সঞ্চার হওয়ার আগে গাইড খইশামু উঠলো, কিন্তু সামনে দাঁড়ানোসত্ত্বেয় সে কেন জানিনা পিছনের দিকে গিয়ে উঠলো। ওদিকে আবার দিবারাহ বসা – বিষয়টা সন্দেহজনক। ব্যাটা, এই অল্প সময়েও গিয়ে মদ খেয়ে এসেছে। …সবুজ পানি কেটে ছুটে চলেছে নৌকা, শ্যাওলা নয়, বরং পানির গুণগত মান ভালো বলে সবুজাভ লাগছে; তাছাড়া আশেপাশে সবুজ পাহাড়, সবুজ বনানীর ছায়া আর প্রতিফলনকে আপনি অস্বীকার করছেন কেন? পানির নিজের রং নেই, প্রতিফলন কিংবা অন্তর্নিহিত উপাদানেই রঙের জন্ম হয়।
সামনেই বিরাট বিরাট সব পাথর যেনবা পথটা আটকে বসে আছে। হায় হায়, পথ কই? আমাদের কি এখানেই নামতে হবে? নৌকা দেখা গেলো মাঝি একটু বাঁকা করে নদীর বাম দিকে নিয়ে গেলেন। পানির পরত খুব হালকা, আমি ভাবলাম নামতে হবে নিশ্চিত; কিন্তু অপূর্ব কসরতে তিন-ব্লেডের একাঙ্গী প্রপেলারটা অল্প অল্প পানিতে ছুঁইয়ে নৌকাকে দারুণভাবে গতিশীল রাখলো মাঝি। তবে কাটিয়ে নেয়ার কৃতিত্বটা সাদা গ্যাঞ্জির, কারণ এ-বেচারা নৌকার সামনে বসে বাঁশ দিয়ে মেঝে খুঁচিয়ে নৌকার নাক ঘুরিয়ে দিচ্ছিলো। …পার হলাম বড় ইয়ারেঁ – এদিকেই আগে নামার কথা ছিল আমাদের।


আশেপাশের পাহাড়ের ঢালে গাছপালা কম, বড্ড বেশি পাথুরে মনে হচ্ছে এগুলোকে। এই পাথুরে পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষ কিংবা পানির তোড়ে ধুয়ে আনা নিঃশেষই পদে পদে আমাদের পথরোধ করতে থাকলো। পাথরের কারণে নদীর গতিপথ বদলে কখনও ডানে, কখনও বামে যাচ্ছে, নৌকাও তাকে অনুসরণ করতে চাইছে, কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না। শেষমেষ আমাদের সবাইকে নেমে ধাক্কা দিতে হচ্ছে। পানিতে পটাপট নেমে দানিয়েল, প্রভা, তরুণ, আমি, ইফতি, নাকিব, এবং সবশেষে রাসেলও নৌকাকে ধাক্কা দিয়ে এগোতে সহায়তা করছি।
মাঝি হাল ধরছে, আর সাদা গ্যাঞ্জি, সাথের ছোট ছেলেটা আর খইশামুও হাত লাগাচ্ছে। ঠাঁই পেরিয়ে যেই আবার গভীর পানিতে চলে যাচ্ছে, সাথে সাথে ধেই করে নৌকায় উঠে পড়তে হয়। আমি হাওড়ের ছেলে, এই অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু প্রভা একবার পড়লো বিপাকে; পরে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে উঠতে হলো আবার। নাকিবও আরেকবার, সেবারতো রীতিমতো সাঙ্গু-স্নানই করে ফেললো বেচারা। ‘ছোট’ বলে আবির আর দিবারাহকে সবাই-ই লিফ্ট দিলো, কিন্তু ব্যাটা ধাড়ি ইঁদুর শান্ত, বসে আছে কেন? দুই হাত দিয়ে নৌকার দুই কিনারা কষে ধরে মাঝ বরাবর দাঁত শক্ত করে বসে আছে – বসে থাকবে না? ও ব্যাটা তো এই হাঁটু-সমান পানিতেও সাঁতার জানে না। 🙂


এই পরিশ্রমে তরুণ আর প্রভা বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলো, তরুণ এসে পানি সেঁচার কাজে লেগে গেলো। কিন্তু খইশামুকে দেখলেই গা জ্বলে যাচ্ছে, যতবারই পানি থেকে উঠে নৌকায় বসছে, সামনে থাকলেও কষ্ট করে ঘুরে পিছনে এসে বসছে। ব্যাটা বিরক্তির চূড়ান্ত করে ফেলছে। কে জানে, পছন্দ হচ্ছে না বলে হয়তো ওর সব কাজই এখন সন্দেহজনক!
ঐ তো তিন্দু দেখা যাচ্ছে – পাহাড়ের উপরটা চেছে তৈরি হয়েছে; দূর থেকেও বড্ড পরিচিত লাগলো তিন্দুকে; কারণ এর দর্শন আজকে প্রথম হলেও এর সাথে পরিচিতি আমার সেই ২০১১’র ২০ আগস্ট – বাংলা উইকিপিডিয়ায় আমি এই ইউনিয়ন সম্পর্কে নিবন্ধ^ লিখেছিলাম। তাই বিট-বাইটে গড়া জগতটাকে স্বচক্ষে দেখার আনন্দটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। অপূর্ব এক অনুভূতি হচ্ছিলো আমার মনের ভিতর, যা আমার কোনো সঙ্গীই বুঝতে পারেনি।
তিন্দু পাড়া (স্থানাঙ্ক: 21°43’20.58″N, 92°27’36.90″E), তিন্দু ইউনিয়ন থানচিরই প্রশাসনিক অঞ্চল। এর একটা কোণা চীন (মিয়ানমার) সীমান্তে যুক্ত, তাই এখানে মোতায়েন আছে বিজিবি। তিন্দু কাইং, মিমবখইয়া আর ক্রাইক্ষ্যং -এই তিনটি মৌজা মিলে এই ইউনিয়ন।
পাড়ার কাছাকাছি হতেই আমরা অনেকেই নৌকা থেকে নেমে হেঁটে চলতে লাগলাম। বাকিরা হাঁটছে, হাঁটছে খইশামুও। কিন্তু আমি আর রাসেল সেই পুরোন কাসুন্দিই ঘাঁটছি: কিভাবে, কী বুদ্ধিতে খইশামুকে খসানো যায়? বেশ কিছু ভয় হচ্ছে: খইশামুকে হাসিমুখে ফিরিয়ে দিতে হবে, না দিলে সে একজন পাহাড়ি, আরো বিপথগামী পাহাড়িকে সঙ্গী করে অন্যায় কিছু একটা করে বসতে পারে। সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের সাথে একজন মেয়ে আছে। (নারী কি সমস্যা? -আমাকে নয়, আমাদের সমাজকে জিজ্ঞাসা করা উচিত) রাসেল আরো একটা বিষয়ে চিন্তিত: আমাদের ভাড়া করা গাইড, তাকে শোয়াতে হবে আমাদেরই সাথে – আমাদের সাথে, মানে একজন মেয়ের কয়েক হাত দূরে, এই ‘মাতাল’ খইশামুকে…!
খইশামু সম্পর্কে আমি অতটা নেতিবাচক না হলেও ইফতি, নাকিব, শান্ত, তরুণ -এরা একটু বেশিই নেতিবাচক। এর মূল কারণটা অনেক পরে জেনেছি: গত রাতে আমি যখন গাইডের ব্যাপারে কথা বলছিলাম, তখন শোবার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলো ওরা; তখন খইশামু নাকি বলেছে: মামা, আপনারাতো মেয়ে নিয়ে আস্ছেন এনজয় করবেন, এখানে কুনো সমস্যা নাই, মামা, এনজয় করেন; সারা রাত এনজয় করেন। তখন নাকি সে মদের ব্যবস্থাও করতে পারবে বলেছে। এই ‘এনজয়’ শব্দটা আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি, কারণ চার্চের কল্যাণে এরা বাংলার চেয়ে ইংরেজি শব্দে স্বচ্ছন্দবোধ করে, আর বন্ধু-বান্ধবরা কোথাও তো এনজয় মানে আমোদ করবার জন্যই যাবে। তাছাড়া সে যেহেতু মাতাল, তাই অন্যকেও মদ খাবার প্রস্তাব দেয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘মেয়ে নিয়ে এনজয়’ -এজাতীয় কথাবার্তাকে কেউই আর ভালো অর্থে দেখতে চাইছে না – তাই খইশামু হয়ে উঠলো খাঁটি ভিলেন। আমি আর রাসেল কানাঘুষা করছি দেখে খইশামু আবার সেই আগের কথায় ফিরে এলো: না দাদা, আমি আর যাবো না। তুমরা যাও। আমরা আবারো পিঠ হাতাই, আরে দাদা, কী সব বলো? চলো, তিন্দুতে আগে দুপুরে কিছু খাই, তারপর কথা বলি।
প্রসঙ্গত বলে রাখি: আমার সাথে খইশামুর সখ্যতার একটা বিশেষ কারণ আছে: আর-সবাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেও আমি বলছি ‘শুদ্ধ পাহাড়ি ভাষায়’! সেটা আবার কী? এই ভাষাটা রপ্ত করেছি আবু বকরের থেকে। পদ্ধতিটা হলো: বাংলা ভাষায়ই কথা বলতে হবে, তবে দ্রুত না বলে ধীরে ধীরে আর শব্দগুলোকে ভেঙে উচ্চারণ করতে হবে। যেমন: ‘চলো তিন্দুতে যাই আগে’ না বলে বলতে হবে ‘চ-লো তিন্দু-তে যাই আ-গে’। অনেকেই যেমন মার্কিন ইংরেজি বোঝেন না দ্রুতগতিতে কথা বলে যাওয়ার কারণে, তেমনি আমরা যখন দ্রুত গতিতে কথা বলি (যেমনটা আমরা সচরাচর বলি আরকি) তখন পাহাড়িরাও সহজে ধরতে পারে না কথাগুলো। একারণেই আসলে খইশামু আমার সাথে গল্প করে মজা পেয়েছে বেশি, কারণ কম্যুনিকেশনটা টু-ওয়ে ছিল।
যাহোক, তিন্দু ঘাটে যেতে যেতে এই সিদ্ধান্ত পাক্কা যে, খইশামুকে আমরা খসাবো, কিন্তু কেউই জানিনা, কিভাবে সেটা সুন্দর করে মিমাংসা করা যায়। নৌকা থেকে নেমেও আমরা আলোচনায়। এদিকে নৌকাওয়ালা চলে যাবে, সে আমাদের কাছে আরো ৳৫০০ [টাকা] দাবি করছে – একথা সাদা গ্যাঞ্জি এসে আমাদেরকে যখন জানালো, মেজাজ খুব খারাপ হলো। আমি সাফ “না” করে দিলাম, বললাম, খইশামুর সাথে আলাপ করেন, এতো টাকা দিতে হবে জানলে আমরা এদিকে আসতাম না।
এমনিতেই খইশামু আপদকে নিয়ে মহা গ্যাঞ্জামে আছি, এর মাঝে ‘ট্যাকা ট্যাকা’ গান শুনতে মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। সবদিক সামাল দেবার জন্য নিশ্চিন্তে একটু সময় দরকার চিন্তার, শান্তিতে একটু আলোচনা করার। আগেভাগে তাই গাইড দুজনসহ ইফতি আর নাকিবকে পাঠিয়ে দিলাম খাবার আর থাকার ব্যবস্থা করতে।
আমাদের তিনজনেরও একটা পরিকল্পনা আছে, ওদিকে সময়ের কঠিন সব হিসাব-নিকাশ আছে। তাই রাসেল যৌক্তিকভাবেই ভাবছে, আমাদের তিনজনের দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে পড়া উচিত। সময় নষ্ট করা ঠিক না। ওরা, এখানে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু তবু আমি নিরাপত্তার প্রশ্নে নিশ্চিন্ত হতে পারছি না (রাসেল নিজেও পুরোপুরি নিশ্চিত না সে যা বলছে)। ওদেরকে এখনও একা রেখে যাবার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। অগত্যা দুপুরের খাবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাঝি আর সাদা গ্যাঞ্জিকেও খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমরাও শান বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে অনুচ্চ পাহাড়ের উপরে তিন্দু পাড়ায় উঠলাম।
উপরে ডানদিকে গিয়ে ওদের সবাইকে পেলাম একটা হোটেলের সামনে – পাহাড়ে এগুলো হলো ‘কটেজ’। দোতলা ঘরের নিচতলায় খাবারের হোটেল, উপরে থাকার ব্যবস্থা। নাকিব এগিয়ে জানালো: রাতে থাকা, সাথে দুপুর আর রাতের খাওয়া মিলিয়ে জনপ্রতি গুনতে হবে ৳১০০। ব্যস, উপরে উঠে ব্যাগ রেখে ভারমুক্ত হলাম!
এবারে রাসেল আর আমি নতুন পরিকল্পনায় রত। এই পাড়ায় আর্মি না, বিজিবি (প্রাক্তন বিডিআর) আছে। যদি এই ব্যাটাকে না করে দেয়ার পরে রেগেমেগে গিয়ে বিজিবির কানে উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়, বলে দেয়: এই ছেলেগুলো একটা মেয়ে নিয়ে উল্টাপাল্টা… ঘটনা তখন রং ছড়াবে। তাই ওর আগেই আমাদেরকে বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে।
এর মাঝে খইশামু আন্দাজ করে ফেলেছে তার দিন শেষ। সে আবার এপাড়ার ক’জনকে নিয়ে হোটেলে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী সব আলোচনা করছে, দূর থেকে আমাদের কাছে এ সবই কূটকৌশল! ওদের খাওয়া শেষে খইশামু আমায় ডাকলো, মোহন ভাই, এদিকে শোনো।
কাছে গেলে সে আবার পুরোন কথা আওড়ালো, আমি চলে যাই। আমি আর যাবে না। তুমি ঐ সাদা গ্যাঞ্জি… ব্যস, বারবার একই কথা বলায় আমি পেয়ে গেলাম একটা ছুতা। বান্দরবানের প্রথম ভ্রমণে হাসান ভাইয়ের বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনি করলো আমার কানে: “অচেনা জায়গায় ঝগড়া লাগলে কক্ষণো সবাই ওদিকে যেওনা” -একটা নাটক সাজিয়ে ফেললাম মুহূর্তের মধ্যে, জোরে চিৎকার করে উঠলাম, রেগে গেলাম আদতে: কী বারবার এক কথা বলো দাদা তুমি। একটা নতুন জায়গায় এসেছি, আমি এর সাথে কথা বলবো, ওর সাথে কথা বলবো। বলে ক’জনকে সাক্ষীও মেনে ফেললাম, বলেনতো দাদা, আমি নতুন জায়গায় আপনাদের সাথে কথা বললে এটা কি আমার অপরাধ? সে বারবার এক কথা বলে, মেজাজ খারাপ করে। রেগেমেগে আগুন হয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম হোটেল থেকে। নাকিব পথরোধ করলো আমার। আমি তখন নাকিবের শান্তনাবাক্য শুনছি মর্মে দাঁড়িয়ে নিচুকন্ঠে নাকিবকে বললাম, আমি রাগ করেছি সীন থেকে বের হয়ে আসতে। এবারে তোরা ব্যাটাকে বিদায় দে। এবারে ব্যাটার যা রাগ, সব আমার উপর। তোরা আপোষ করে বিদায় দে।
কিন্তু যে পরিকল্পনা আমি মনে মনে করেছি, সে পরিকল্পনাটা আমিই শুধু জানি। বাকিদের পক্ষ থেকে তাই তেমন একটা সাড়া পাবার মতো কার্যোদ্ধার হলো না। তবে এতটুকু লাভ হলো, আমি সীন থেকে সরে থাকতে পারলাম। আমি ওযু করে নামায পড়তে গেলাম (মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা সমান; খইশামুর মন ভেঙ্গে জান্নাত হাসিলের ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষা?!)।
এদিকে নাকিব কিছুটা কাজ এগিয়ে নিলো। খইশামু বিদায় নিতে প্রস্তুত। শেষমেষ সে আমার সাথে দেখা করলো উপরে উঠে, ‘মোহন ভাই, আমি চলে যাই…’ একটু আশা, তার মোহন ভাই আগের প্রত্যেকবারের মতোই এবারেও তাকে রাখার প্রশ্নে জোর আবেদন করবেন। কিন্তু আমি এগিয়ে এসে তার ডান হাত দুহাতের মাঝখানে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললাম, “দাদা, আমি সবার সাথে আলোচনা করেছি, ওরা কেউই আর সামনে যাবে না। আমাদেরও আর গাইডের দরকার নেই। এখান থেকে থানচি যাওয়া যাবে। তাই অযথা আপনাদের কষ্ট দিয়ে কী লাভ?” ইফতিকে ইশারা করলাম; হাতে ৳৫০০ [টাকা] ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “অ-নেক কষ্ট ক-রসো দাদা, এই টা-কাটা রা-খো।”
সে কিছু একটা বুঝলো। প্রথমে টাকাটা মুঠে পুরলেও শেষটায় টাকাটা দোতলার মেঝেতে ফেলে চলে গেলো। আমি টাকাটা তরুণের হাতে দিয়ে মিমাংসা করতে পাঠালাম। তরুণের মতো চূড়ান্ত ‘মাথা গরম’ ছেলেও তখন প্রচন্ড ধীরতার পরিচয় দিলো। তরুণ আর দানিয়েল গিয়ে মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে ঐ পাঁচশ’ টাকার সাথে আরো ৳২০০ [টাকা] দিয়ে ব্যাটাকে শান্ত করে নদীর ঘাট অবধি পৌঁছে দিলো। যাক, এক আপদ বিদায় হলো। এদিকে দোতলা থেকে নামতেই সাদা গ্যাঞ্জি সামনে: সে, মাঝির হয়ে আগের মতোই পাঁচশো টাকার আবদার করছে। তাকে আমাদের অর্থকড়ির টানাটানির কাহিনী বলে বোঝালাম, এতো টাকায় আমরা জীবনেও সামনে পা বাড়াতাম না। শেষে তার হাতে ৳২০০ [টাকা] ধরিয়ে দিয়ে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে এই দুনিয়া ক্ষ্যান্ত করা হলো।
এবারে রাসেল আর আমি খুব দ্রুত চললাম। খইশামুকে ঘাটে রেখে তরুণরা ফিরে এলেও ওই ব্যাটা যদি আমাদের আগে বিজিবি ক্যাম্পে চলে যায়? আমরা একে-ওকে জিজ্ঞেস করে বিজিবি ক্যাম্পের দিকে চললাম। তিন্দু পাড়া থেকে নিচে নেমে পাশের উঁচু পাহাড়ে উঠতে হয় বিজিবি ক্যাম্পে যেতে। ঐ পাহাড়ের সিঁড়ি থেকে দেখলাম, খইশামু এখনও ঘাঁটে, নৌকার অপেক্ষায় আছে। কিছুটা স্বস্থি হলো।
আমরা নিজেদের মধ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নিলাম। কারণ প্রভার ভাষ্যে ‘প্রশাসন’ বড় আজিব জিনিস: দেখা হলেই রিমান্ডের মতো প্রশ্নের ফুলঝুরি ছোটে; তখন নিজেদের কথার ফাঁদে নিজেদেরকে আটকানো চলবে না। রাসেলের প্রস্তাব হলো, খইশামুর নামোচ্চারণ করা ঠিক হবে না, কারণ বেচারা আর যা-ই হোক, আমাদের কিন্তু উপকার করেছে। তার দোষ হলো সে মাতাল।
পাহাড়ে ওঠার পথে দুই বিজিবি জোয়ান আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলো। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না দুজনের। সেখানে…
…আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছে বিজিবি? বলিপাড়ার বিজিবি’র চেহারা আমরা এখনও ভুলিনি।
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
আপনাদের লিখায় আর ছবিতে না দেখা জায়গা আর না জানা জিনিস জানা হচ্ছে 🙂