ধারাবাহিক: বাংলাদেশী স্লামডগ আর ভিক্ষুকেরা —এর একটি পর্ব
অস্কার পাবার পর বিদেশী নির্মাতা কর্তৃক নির্মিত ভারতীয় প্রেক্ষাপটনির্ভর “স্লামডগ মিলেনিয়ার” ছবিটি বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল, অনেকেই দেখেছেন। এমনকি স্টার সিনেপ্লেক্সেও টিকিট কেটে দেখেছেন বাঙালি। ছবিটি আমাদের এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক, এবং এই আলোচনার অনেক বিষয়বস্তুই প্রায় অনুরূপভাবে উঠে এসেছে এই সিনেমায়।
আমার এক বন্ধু ছিল, নাম প্রান্তিক। ছিল বলাটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, কারণ সে এখনও আমার বন্ধু, ইনশাল্লাহ চিরদিনই থাকবে। কিন্তু তবু ছিল বলছি এজন্য যে, সে এখন বাংলাদেশে নেই, রয়েছে লন্ডনে। প্রান্তিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো, সে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। শুধু কথাই না, সে যখন কথা বলে তার প্রাসঙ্গিকতা অসম্ভব সুন্দর। সে-ই আমাকে প্রথম বলেছিল ভিক্ষুকদের হাঁড়ির খবর। সে আমাকে কী বলেছিল, তা বলার আগে আমি কয়েকটা দৃশ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরি:
দৃশ্য ১
“এ্যাক্টা ইস’কুল, ড্রেস’ কিন’বো, কিসু টা-কা দিয়া- যান।” -অযাচিত কমা আর উর্ধ্বকমা দেখে দ্বিধান্বিত হবেন না। কারণ কথাটা এভাবেই সুরে সুরে আউড়ে যাচ্ছিলো একটি নয় বছর বয়সী ছেলে। সেদিন বাসে উঠে দেখি শেষের সীটে এক বালক বসা, আমি ভেবেছিলাম যাত্রী হয়তো। যখনই বাস চলা শুরু করলো, সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়িয়ে সীটে সীটে হাত পেতে ঘুরতে লাগলো আর ঐ বাক্যটি একই সুরে, একই তালে আওড়াতে লাগলো। আপনার মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ছেলেটির সত্যিই একটা স্কুল ড্রেসের দরকার (হতেও পারে)। তবে অভিজ্ঞতা বলে, ছেলেটি শ্রেফ একজন ভিক্ষুক, মোটেই কোনো স্কুলড্রেসহীন ছাত্র নয়।
দৃশ্য ২
“‘চাইড্ডা ভিক্কা দিয়া যা-ন, আমরা গরীব ইনসান। আখিরাতে সওয়াব পাইবেন পাহাড়ো সমান। …” -সুরে সুরে, তালে তালে কথাগুলো কোরাসে আউড়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে কয়েকজন বিকৃত মানুষ; আবেদন খুব স্বাভাবিক: ভিক্ষা চাই। কেউ কেউ তাদের থালায় ফেলছেন পঞ্চাশ পয়সা, কেউবা একটাকা, কেউ পাঁচটাকা, কেউ দশটাকা, কেউ হয়তো আরো বেশি। অভিজ্ঞতা বলে, এরা পেশাদার ভিক্ষুক এবং মিলিওনিয়ার হওয়ার পরও এরা ভিক্ষাবৃত্তিই করবে।
এরকম অসংখ্য দৃশ্য বর্ণনা করা যাবে, যার সবগুলোই অতি পরিচিত। সংক্ষেপে কয়েকটির কথা না বললেই নয়:
- জ্যামে গাড়ি আটকেছে, আর একজন মহিলা, কোলে একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে।
- …রাস্তার পাশে, ফুটপাতে শুয়ে রয়েছে একজন নগ্ন বা অর্ধ্বনগ্ন মানুষ, তার সামনে একটা থালা, লোকজন তাতে ভিক্ষা দিচ্ছে।
- …বাসে উঠে এসেছে একজন মানুষ, হয়তো ক্র্যাচে ভর দিয়ে, নয়তো নিজের হাতে ভর দিয়ে, লোকজনের কাছে ভিক্ষা চাইছে।
- …রাস্তায় রাস্তায় কিংবা ফুটপাতে ফুটপাতে চার চাকাবিশিষ্ট নিজস্ব পরিবহনে করে একজন মানুষ অন্য আরেকজনের সহায়তা নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা চাইছে, তার পা-দুটো উরু থেকে উধাও, কিংবা হাতদুটো কাঁধ থেকে উধাও, কিংবা চোখদুটোর জায়গাটায় একটা গভীর গর্ত।
- …কোমরের সাথে রশি দিয়ে একটা ব্যাগ বাঁধা, তাতে লালাভ-হলুদাভ তরল আর তা থেকে একটা পাইপ চলে গেলে কাপড়ের ভিতরে কোথাও, দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকটার সিরিয়াস অপারেশন হয়েছে এবং ডাক্তার ক্যাথেড্রাল লাগিয়ে দিয়েছে বিষাক্ত পুঁজ-রক্ত বেরিয়ে যাবার জন্য। সে সিরিয়াসলি ভিক্ষা চাইছে তার এই অসুস্থতার চিকিৎসা করানোর জন্য।
- …একজন লোক হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে, যার পিঠটা অস্বাভাবিক রকম উঁচু, কিংবা মুখের মধ্যে প্রচুর ফোড়া, কিংবা শরীরের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে।
- …একজন লোক হাতে একটা কাগজ নিয়ে ভিক্ষা চাইছে, বক্তব্য হলো ডাক্তার তাকে চিকিৎসার জন্য বলেছেন যাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে, যা বহন করার সামর্থ্য তার নেই, ভিক্ষা করে পূরণ করতে হবে।
…কতো আর বলবো? বলে শেষ করা যাবে না। আপাতত এতটুকুতেই চলবে। মূল কথায় যাওয়া যাক।
প্রান্তিক আমাকে বলেছিল, এই যে ভিক্ষুকদেরকে দেখছিস, তুই কি জানিস এদের পিছনে রয়েছে একটু শক্তিশালী চক্র? এরা ছোটবেলাতেই বস্তি থেকে বাচ্চাদেরকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর পরিকল্পিতভাবে এদের হাত-পা কেটে ফেলা হয়। এরপর তাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে ভিক্ষা করার জন্য। হাত-পা কাটা দেখলে এদের প্রতি মায়া জন্মাবে, লোকজন ভিক্ষা দিবে। এদেরকে ট্রাক দিয়ে এসে নামিয়ে দিয়ে যাবে, আবার সন্ধ্যা হলে এসে তুলে নিয়ে যাবে। …তুই দেখবি রাস্তার পাশে অচেতনের মতো পড়ে আছে ছোট্ট শিশু, কিংবা মহিলাদের কোলে ঘুমিয়ে আছে শিশুটি; রাস্তার গাড়িঘোড়ার প্রচণ্ড শব্দ, প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে এরা ঘুমিয়েই চলেছে, ঘুমিয়েই চলেছে, কেন জানিস? কারণ এদেরকে প্রতিদিনই প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়। এরকম ঘুমের ঔষধ নিয়মিত খাওয়ানোর কারণে এরা খুব বেশিদিন বাঁচবে না, হয় কয়েক সপ্তাহ, কিংবা কয়েক মাস। এরা মারা যাবেই। আর মারা যাবার পরে শুরু হবে এদেরকে নিয়ে মূল ব্যবসা। রাস্তায় লাশটা শুইয়ে রেখে দাফনের নাম করে ভিক্ষা চাওয়া হবে। তুই জানিস না, এইসব বাচ্চাদেরকে ভাড়ার বিনিময়ে বস্তি থেকে তুলে আনা হয়।
প্রান্তিকের কথাগুলো শ্রেফ শুনেছিলাম সেদিন, শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। কথাগুলো সে আমায় বলেছিল ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। তার দুবছর পরই একুশে টেলিভিশনে দেখলাম রিপোর্ট: কী করে একজন লোক প্রতিদিন ভোরবেলা বাচ্চার মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাকে ভাড়া করে এনে অন্য আরেক মহিলার হাতে তুলে দেয়। সেই মহিলা সারাদিন ঐ বাচ্চাকে খাওয়ানোর কথা বলে ভিক্ষা চায়। দিনশেষে বাচ্চাকে আবার ফিরিয়ে দেয়া হয় মায়ের কাছে, সাথে গুঁজে দেয়া হয় সামান্য টাকা। সেদিন দেখলাম।
এরপর ২০০৯ সালে এলো “স্লামডগ মিলেনিয়ার”; ভারতেও যে একইভাবে বস্তির শিশুদের তুলে এনে পেশাদার ভিক্ষুক বানানো হয়, সেটা বিস্তারিতভাবে দেখানো হলো। তাতে কী লাভ হলো? বস্তির ছেলেগুলো বস্তিতেই থাকলো, পরিচালক অস্কারের টাকা পেলেন, নায়িকা উঠে এলেন লাইমলাইটে, আর বস্তির ছেলেমেয়েরা আগের মতোই ভিক্ষুক হতে থাকলো।
২০১০ সালের অক্টোবর মাসে আমাদের মসজিদের ইমাম খতিব শুয়ায়েব খান যখন ভিক্ষা দেয়া বিষয়ে কথা বললেন, তখন পুরোন কথাগুলো সব আবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তিনি বললেন, মুহাম্মাদ [আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর উপর] কখনও কোনো মিসকিনকে ফিরিয়ে দিতেন না। অল্প ক’টা পয়সা হলেও তিনি হাতে তুলে দিতেন। তাই আমাদেরও অনুচিত হবে ভিক্ষুকদেরকে ফিরিয়ে দেয়া; তারা যখন হাত পাতে তাদের হাতে সামান্য হলেও অর্থ তুলে দেয়া, আর যদি দেয়া একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে খুব অমায়িকভাবে ফিরিয়ে দেয়া। কিন্তু,…
কিন্তু, যারা বর্তমানে আমাদের কাছে হাত পাতে, সম্ভব হলে তাদের ক্ষেত্রে একটু বাছাই করা কর্তব্য -একারণে যে, গণহারে ভিক্ষা দিতে থাকলে ‘ভিক্ষা’ নামে একটা আলাদা পেশাকে উশকে দেয়া হয়। তাই ভিক্ষা দেয়ার সময় যথাসম্ভব তাহ্কিক করা (বাছাই করা)। কারণ মুহাম্মদ [স.] ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে জঘন্য হিসেবে দেখেছেন বলেই তিনি একজন ভিক্ষুককে তার সম্পদ বিক্রী করে কুড়াল কিনে দিয়ে কাঠ কেটে রোজগার করতে বলেছিলেন।
ইমাম সাহেবের কথাটা মানা দরকার এজন্য যে, প্রান্তিকের কথাটা সত্যি। আর প্রান্তিকের কথাটা সত্যি হলে সত্যিই এরকম ভিক্ষা-পেশায় জড়িত হয়ে আছে প্রচুর মানুষ, আর ভবিষ্যতেও জড়িত হবে আরো বহু বহুজন। একটা নিকৃষ্ট পেশাকে আমরাই উশকে দিয়ে সহায়তা করছি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে।
কিন্তু কী করে বুঝবো: কোন ভিক্ষুক সত্যিকারেই ভিক্ষা পাবার জন্য যোগ্য (needy)?
আমি আসলে এবিষয়টা বলতে পারি না। তবে আমি নিজে কিছু বিষয় চিন্তা করে রেখেছি, যে বিষয়গুলো দিয়ে আমি যোগ্য ভিক্ষুক বাছাই করে থাকি, তবে এর কোনো একটি পয়েন্টকে এককভাবে ব্যবহার করি না:
- শারীরিক অক্ষমতা থাকতে হবে (যা ভিক্ষা করার অন্যতম কারণ হবে)
- ভিক্ষা করার মতো কোনো উদ্দেশ্য থাকতে হবে (“চাইড্ডা ভিক্ষা দ্যান” -বললো আর দিয়ে দিলাম এমন না)
এই দুটো পয়েন্ট ছাড়াও অভিজ্ঞতা দিয়ে মাপার চেষ্টা করি ভিক্ষুককে, যেমন:
- যে ভিক্ষুক প্রথম ব্যক্তির সামনে এসে যে কথা বলবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যক্তির কাছেও গিয়ে হুবহু একই কথা বলবে, একবাক্যও ছাড়বে না, সে নিশ্চিত পেশাদার ভিক্ষুক এবং ডায়লগটা তার মুখস্থ।
- যে ভিক্ষুক তার সমস্যাকে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলছে সে পেশাদার ভিক্ষুক, বিপদে পড়ে হাত পাতেনি।
- যে ভিক্ষুক তার ডায়লগটাকে সুরারোপিত করে নিয়ে এসেছে এবং সুরে কোনো ব্যতয় হচ্ছে না, সে পেশাদার ভিক্ষুক।
- যে ভিক্ষুক তার দাবিকে তুলে ধরার জন্য জোরালোভাবে কোনো দলিলের দ্বারস্থ হতে বলছে (মানে হাতে একটা প্রেসক্রিপশন দেখাচ্ছে, কিংবা এক্সরে প্লেট দেখাচ্ছে) সে আবশ্যিকভাবে না হলেও পেশাদার ভিক্ষুক ধরে নেয়া যায়। কারণ আপনি একটা অপারেশনের জন্য অর্থ ভিক্ষা চাইলে এমনিতেই হাত পাতবেন, যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে তখন তা দেখাবেন; অযথা দেখিয়ে বেড়াবেন না -এটা আমার থিওরি।
- একজন পেশাদার ভিক্ষুক জানে, বাসে উঠে সব যাত্রীর কাছে গিয়ে একবার করে হাত পাততে হয়, সুতরাং যে বাসের সবার কাছে গিয়ে গিয়ে হাত পাতছে, সে পেশাদার ভিক্ষুক (আমার ভুলও হতে পারে)।
এবারে একটা ঘটনা বলে আজকে শেষ করি: একদিন আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। মালিবাগে বাসে উঠলো একজন লুঙ্গি পরা লোক। উঠেই সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। তারপর অনেক কষ্টে তার কান্না থামিয়ে সে যা বললো, তা হলো: ভাই, আমি রিকশা চালাই, এই চৌধুরিপাড়াতে। আমার একটা বাচ্চা এক্সিডেন্ট করছে। তারে খিলগাঁওয়ে ‘অমুক’ হাসপাতালে (আমি নাম ভুলে গেছি) ভর্তি করছি।… আর বলতে পারলো না লোকটা। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। বাকিটা আমাদেরকে বুঝে নিতে হলো। এখানে এ বোঝা গেলো যে, লোকটার এভাবে মুখস্থ ডায়লগ আউড়ে হাত পাতার অভ্যাস নেই। এমনকি লোকটার উচিত ছিল বাসের প্রতিজন যাত্রীর কাছে গিয়ে গিয়ে হাত পাতা, সে ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো। চোখ মুছতে লাগলো। আমরা ডেকে এনে হাতে অর্থ তুলে দিলাম। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না যে, এই ব্যক্তির দরকারটা সত্য। লোকটি ছলনা করছে না। অভিনয় এতো সহজ না। (আমার ভুল হতেও পারে, কিন্তু কেন জানি গোঁয়াড়ের মতো আমি বিশ্বাস করি আমি ভুল করিনি এই লোকটিকে চিনতে)
এতোটুকু পড়ার পর কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে যাবে: বাঁচা গেলো, আর ভিক্ষা দেয়া লাগবে না। যা কামাচ্ছি, নিজে খেয়ে নিলে দোষ হবে না। কারণ আল্লাহ যদি জিজ্ঞাসা করে, তাহলে বলা যাবে আমি সঠিক ভিক্ষুক, needy ভিক্ষুক নির্বাচন করতে পারি নাই, তাই ভিক্ষা দেই নাই। …আসলে ব্যাপারটা হুবহু সেরকম না। আপনি তাহ্কিক (বাছাই) করতে পারলে তাহ্কিক করুন। না পারলে আর কী করা, দান করতে থাকুন। তবে পেশাদার ভিক্ষুককে দান না করা থেকে আরো মোক্ষম কাজটি হলো তাকে আয়ের একটা উৎস তৈরি করে দেয়া, যেমনটা মুহাম্মদ [স.] নিজে করেছিলেন (এজন্য মুহাম্মদ [স.] নিজের পকেটের পয়সাও খরচ করেননি, শুধুমাত্র একটু শ্রম আর মেধা ব্যয় করেছিলেন)। দান করতে থাকুন, মুসলমান দান করলে সম্পদ কমছে মনে হলেও আসলে তা বাড়ে -এটা ইসলামের শিক্ষা।
– মঈনুল ইসলাম