ধারাবাহিক: বাংলাদেশী স্লামডগ আর ভিক্ষুকেরা —এর একটি পর্ব
গত পর্বটি যারা পড়েছেন, তারা হয়তো এবারে বাংলাদেশের এসব তথাকথিত ভিক্ষুকদের ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছেন। বিগত কিছুদিন যাবত আমি নতুন করে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববার প্রয়াস পেয়েছি। সেসব চিন্তা-ভাবনাগুলোই এবারে উল্লেখ করছি:
বাসে প্রায়ই এক অন্ধ যুবক উঠে, চরম ভন্ড। একদিন দেখি, বাস তার কাউন্টারে থামার সাথে সাথেই সে বেশ দ্রুত গতিতে এসে গাড়ির গায়ে এমনভাবে হাত রাখলো, যেন সে জানে, সে একটা বাসের গায়ে হাত রাখছে, এবং বাসটার ঠিক কাছাকাছি এসেই সে ওমন ব্রেক কষলো, মনে হলো সে জানে বাসটা ওখানটায়ই আছে। তারপর সে বীরদর্পে বাসে উঠে পড়ে, মনেই হয়না একজন অন্ধ লোক উঠছে। উঠেই সে নাটকীয়তা করে বলে ‘হায়াল্লা আলহামদুলিল্লা ইয়া রসূল হাআ-ল্লা’। তারপর উচ্চস্বরে, চরম উচ্চস্বরে গান ধরে “নবীর নামে সুর ধরিয়া, পাখি যায় গান করিয়া, সেই নামে আকুল হইলো মাওলা আমার কাদের গনী…” গানটা সে পুরোটাই গাবে, এতে বাস বিশাল লম্বা হোক, আর ছোট্টই হোক। গান শুরু করবে দরজা দিয়ে উঠেই, আর গান গাইতে গাইতে পুরো বাস চক্কর দিয়ে আবার দরজার কাছে আসতেই শেষ হয়ে যায় তার গান- এক্কেবারে পার্ফেক্ট টাইমিং, সবসময়ই।
আমার বোন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরবে, বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। এমন সময় বয়স্ক এক ভিক্ষুকের দিকে ওর নজর গেলো। সে শুধুমাত্র মাথায়-ঘোমটা-দেয়া মেয়েদের কাছে যাচ্ছে, কারণ তাদের মন দয়াপরবশ এবং তাদেরকে জেঁকে ধরা গেলে তাদের থেকে উদ্ধার করা যাবে টাকা। একটা মেয়েকে ভাত-খাবার-টাকা চেয়ে সে এমনভাবে ধরলো যে, সেই মেয়েটার মন গলে গেলো এবং জানতে চাইলো কত টাকা লাগবে ভাত খেতে। প্রত্যুত্তরে সে ৪০-৫০ টাকার কথা বললে মেয়েটা ৪০টাকা দিয়ে দিলো। টাকাটা পেয়ে সেই ভিক্ষুকের কোনো ইটালিয়ান হোটেলে গিয়ে খাওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেলো সে তা না করে অন্যান্যদের কাছে ভিক্ষার হাত পাতছে…
আরেক ছেলে উঠে মাঝেমাঝে, ভোকাল কর্ডে মনে হয় আল্লাহ সাইরেন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। উঠে যখন গান ধরে, কানের পর্দা ছিড়ে যাবার জোগাড় হয়। যাহোক, কারো ভোকাল কর্ড সাইরেনের মতো হওয়ার সাথে ভিক্ষা দেয়া-না দেয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
সমস্যা হলো এদের আবেদনে। এরা কী আবদার নিয়ে আমাদের কাছে হাত পাতে? কেউ হাত পেতে বলে, সে এতিম; কেউ বলে, মরণব্যাধী; কেউ বলে, হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য খরচ দরকার; কেউ বলে… না, এদের মধ্যে কেউ কেউ বলে না, দেখায়। আজকের আলোচনা এইসব দেখানো স্লামডগদের নিয়ে।
এরা কী দেখায়?
এরা দেখায় এরা অসহায়।
- একজন আছে, হাতটা কাঁধের জোড়া থেকে ভেঙে ঝুলে আছে, সেটা দেখানোর জন্য সে বাম হাতের শার্টের হাতা ভাঁজ করে কাঁধ অবধি তুলে রাখে (ছবি দ্রষ্টব্য);
- একজন আছে, পা বাঁকা, সেটা দেখানোর জন্য সে ঐ পায়ের প্যান্টের পা ভাঁজ করে হাঁটু অবধি তুলে রাখে;
- একজন আছে, অন্ধ, তার বর্ণনা তো দিলামই;
- এক মহিলা আছে, বিকৃত মুখমণ্ডল, তার মুখের চোয়ালের একটা দিক এসিড দিয়ে ঝলসিয়ে ঝুলিয়ে দাঁতগুলো বের করে দিয়েছে কেউ;
- একজন আছে, পায়ে রড লাগানো, সেটা দেখানোর জন্য ঐ অবস্থায়ই সে বাসে বাসে ভিক্ষা করে;
- একজন আছে, বোবা, মুখে অস্ফূট শব্দ করে সে যোগাযোগ করে সাধারণ্যের সাথে;
- একজন আছে কিডনি রোগী, হলুদ পেশাব সমৃদ্ধ ক্যাথাড্রাল মুত্রথলিতে লাগিয়ে কিংবা লুঙ্গির নিচে গুঁজে সে অর্থান্বেষণ করে… এরকম আরো অসংখ্য।
এরা তাহলে কেন অসহায়? এরা আতুড়, ল্যাংড়া, কালা, বোবা, অন্ধ -এজন্য এরা অসহায়।
আসলে কি অসহায় এরা?
একজন আতুড় মানুষ, পাছা ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে যে চলতে পারে, সে কি তাহলে অসহায় হলো? সে তো চাইলে যেকোনো বসে-বসে-করার-মতো-কাজ করতেই পারে। যখন চলার দরকার হবে, পাছা ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে চলতে পারবে। সে চাইলে যেকোনো হস্তশিল্পের কাজ করতে পারে। সে চাইলে বসে বসে দোকানদারী করতে পারে। যে লোকটা ল্যাংড়া, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে, সবচেয়ে বড় কথা, পায়ের অস্বাভাবিকত্বসত্ত্বেয় সে চলমান বাসে নিজের ভারসাম্য ঠিকই রক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাহলে তার পায়ের ত্রুটির ফলে সমস্যাটা থাকলো কোথায়? সে অসহায় হতো তখনই, যখন তাকে তার পায়ের ত্রুটির জন্য এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো অথবা শুয়ে বা বসে থাকতে হতো। অথচ সে দিব্যি চলাফেরা করছে, দুহাত দিয়ে ভারসাম্য রেখে চলছে, অন্য পা দিয়ে ভারসাম্য রেখে চলছে…
মনে রাখতে হবে, তাদের এসব বিদঘুটে শারীরিক অবস্থা তাদের পঙ্গুত্ব নয়, অসহায়ত্ব নয়, বরং অস্বাভাবিকত্ব। আর আপনি তাদেরকে ভিক্ষা দিচ্ছেন তাদের অস্বাভাবিকত্বের জন্য। একজন মানুষের অস্বাভাবিকত্ব তাকে ভিক্ষা দেওয়ার মানদন্ড হতে পারে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে আমার যখন আক্কেল দাঁত উঠে, তখন সবাই মিলে আমাকে ভিক্ষা দেয়া উচিত, কারণ সেটা স্বাভাবিক নয়। আমি আমার মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম, একজন মানুষের অস্বাভাবিকত্বের উদাহরণ দিতে… তিনি বললেন, তাঁর হঠাৎ অতিরিক্ত গরম লাগছে -এটা অস্বাভাবিক। তাহলে তো কারো হঠাৎ করেই গরম লাগতে থাকলে তাকে ভিক্ষা দেয়া উচিত। কারণ আমরা [ভিক্ষাস্বরূপ বা দানস্বরূপ] টাকা দিয়েই যেকোনো অস্বাভাবিকত্বের সমাধান করে ফেলার একটা সহজ সূত্র বানিয়ে নিয়েছি।
মনে রাখতে হবে, কারো অস্বাভাবিকত্ব ভিক্ষা দিয়ে ঘোচানো যায় না। এজন্য দরকার পথনির্দেশনা, আত্মিক সহায়তা। ভিক্ষাকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছে, তাদেরকে ভিক্ষা দেয়া মানে তাদের ভিক্ষা-পেশাকে মদদ দেয়া, প্রেষণা দেয়া। বরং তাদেরকে পারলে, সম্ভব হলে টেনে, ধরে নিয়ে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা গেলে কাজে লাগবে বলে মনে হয়।
-মঈনুল ইসলাম