কী মনে হচ্ছে শিরোনাম দেখে? আশ্চর্য হবার কিছুই নেই… শুনুন এবার তবে একটা কন্সপাইরেসি থিওরি, এই থিওরির প্রবক্তা আমি নিজে।
উইকিলিক্স
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নামের একজন অস্ট্রেলীয় ব্যক্তির উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটি সংগঠন উইকিলিক্স। যার এক/দুজন ব্যতীত কোনো বেতনভোগী কর্মচারী নেই। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে হ্যাকাররা অনলাইনে গোপন চ্যাটের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ করে থাকে, কিংবা কোথাও গোপনে সাক্ষাৎ করে। আর তারাই নিজেদের হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ই-মেইল, ম্যাসেজ ইত্যাদির তথ্যাদি লিক করেন বা ফাঁস করেন উইকিলিক্সে। সংগঠনটি সব ধরণের গোপন তথ্য ফাঁস করতে আগ্রহী নয়, বরং সেসব ব্যক্তিদের তথ্য ফাঁস করতে আগ্রহী, যারা কোনো রাষ্ট্র কিংবা উল্লেখযোগ্য সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের দাবি হচ্ছে –এজাতীয় ব্যক্তিদের গোপনীয়তা বলে কিছু থাকতে পারে না, এদের যাবতীয় কাজকর্ম স্বচ্ছ হওয়া উচিত, এদের সব কাজ সাধারণ্যের নজরদারিতে আসা উচিত। সংগঠনটি অতীতে অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করলেও ইরাকে, মার্কিন বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে দুজন সাংবাদিককে হত্যার ভিডিও ফুটেজ প্রচার করে আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে। তারপর একের পর এক মার্কিন গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্বব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত হতে শুরু করে প্রবলভাবে। কেউ কেউ সাধুবাদ দেন, কারণ এরকম গোপন তথ্য জানার ফলে জানা সম্ভব হচ্ছে মার্কিন সরকার কিভাবে ধ্বংসের প্রয়াস নিয়েছে, আর কেউ কেউ ধিক্কার দিচ্ছেন, কারণ সব গোপনীয়তা ফাঁস করতে হয় না। আরেকটা কথা, Wiki শব্দটা আছে বলে একে উইকিপিডিয়া কিংবা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের সাথে গুলিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই। Wiki, জাভা দ্বীপপুঞ্জের একটা শব্দ, যার অর্থ হলো “দ্রুত”। বর্তমানে এমন প্লাটফর্মকে Wiki দিয়ে সূচিত করা হয়, যাতে সবার প্রবেশাধিকার ও সম্পাদনার অধিকার আছে।
ফেসবুক ও উইকিলিক্স
ফেসবুকের সাথে উইকিলিক্সের কোনো সম্পর্ক নেই… আপাতত এমনটা মনে হলেও সম্প্রতি তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে^ () (এসম্পর্কে আরো দেখুন পরিশিষ্ট ১)। বরং এটা জানা গেছে যে, উইকিলিক্স-এর তথ্য ফাঁস করার কাজটিতে সহায়তা করছে ফেসবুক। এটা একটা গুজব হতো যদি ফেসবুক নিজে কিছু না বলতো। কিন্তু আশ্চর্য করে দিয়ে ফেসবুক এব্যাপারে কথা বলছে, জানাচ্ছে, তাদের সংরক্ষিত তথ্য, তথ্য ফাঁসের কাজে ব্যবহৃত হয়। একজন আইটি প্রফেশনাল জাহিদ রাসেল বললেন, ‘ফেসবুক এমনটা করতে পারে সেটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, কারণ ফেসবুক তার কোনো তথ্য মুছে না।’ (এসংক্রান্ত আরেকটি প্রবন্ধ আপনারা পড়তে পারবেন দৈনিক প্রথম আলো’য় ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর সম্পাদকীয় পাতায় (পৃ. ১২) প্রকাশিত ড. মিয়াস ক্রিস্টেনসেন-এর “পরের হাতে কলকাঠি” নামক নিবন্ধটি^ () থেকেও।)
উইকিলিক্স কী করছে?
সোজা-সাপ্টা কথা হলো উইকিলিক্স সব মানুষের গোপন নথি-ভিডিও, অডিও, ছবি, ই-মেইল বার্তা, মুঠালাপির বার্তা ইত্যাদি থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্যগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছে বা ফাঁস করে দিচ্ছে। তারমানে দাঁড়াচ্ছে, উইকিলিক্স এমন জায়গায় প্রবেশ করছে, যেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই!! –আদতে এমনটাই মনে হচ্ছে। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে গুপ্ত পদ্ধতিতে তথ্য আদান-প্রদান করে [মার্কিন অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা] এফবিআই ও [বহিঃগোয়েন্দা সংস্থা] সিআইএ, তাদের তথ্যও ফাঁস করেছে উইকিলিক্সের বন্ধু হ্যাকাররা। এতে উইকিলিক্স এমন একটা বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান আমার-আপনার কাছে তুলে ধরছে যে, উইকিলিক্স গোপনীয় তথ্য বের করছে, সুতরাং অনায়াসে উইকিলিক্স-কে বিশ্বাস করা যায়।
এই বিশ্বাস করার ব্যাপারটা উইকিলিক্স তৈরি করেছে ইরাকের কিছু গোপন ভিডিও ফুটেজ লিক করে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রত্যেকটা পত্রিকা, সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট উইকিলিক্স-এর জন্য আলাদা পৃষ্ঠা কিংবা কলাম রাখছে, যেখানে উইকিলিক্সের ফাঁস করা তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়। একটা ওয়েবসাইটের তথ্য গণমাধ্যমে তখনই তুলে ধরা হয়, যখন তাকে ‘সত্য’ বলে বিশ্বাস করা হয়। সব দেশের পত্র-পত্রিকা এখন উইকিলিক্সের তথ্যগুলোকে সত্য বলে তুলে ধরছে, ধরে নিচ্ছে। ‘ধরে নিচ্ছে’ –কারণ যাচাই করার কোনো উপায় নেই। উইকিলিক্স এমন সব গোপন বার্তা প্রকাশ করছে, যার সত্যতা কেবল সেই বার্তা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই জানেন। এখন যদি তা সত্যি নাও হয়, তাহলে ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পা-উপরে-আর-মাথা-নিচে দিয়েও যদি দাবি করেন, তা সত্যি নয়, কে বিশ্বাস করবে? কেউ করবে না। সবাই ধরে নিবে, নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যই এমনটা করছেন তারা। বাংলাদেশেই এমনটা হয়েছে (এখানে মানবজমিন পত্রিকার নিবন্ধের একটি লিংক ছিল, যা হারিয়ে ফেলেছি)। (আমি তাদের পক্ষে সাফাই গাইছি না, বরং বলতে চাচ্ছি এমনটা হলে কাকে সত্য বলে বুঝবো?)
তাহলে কী দাঁড়ালো?
উইকিলিক্স ঈশ্বর! নতুন পৃথিবীর ডিজিটাল ঈশ্বর! যার কথা খন্ডানোর কোনো উপায় নেই, আসলে উপায় নেই বললে ভুল হবে, খণ্ডানোর কোনো মানদন্ড নেই।
—
কন্সপাইরেসি
একটি গোপন সংগঠন, মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের উপরে, আড়ালে বসে, কলকাঠি নাড়াচ্ছে। ফ্রিম্যাসন বলে তাদের সুপরিচিতি থাকলেও তাদের এই বিশ্ব পরিচালনার পিছনে কর্তৃত্বের ব্যাপারটি আজও কন্সপাইরেসিই রয়ে গেছে মূল ধারায়। কিন্তু যারা কন্সপাইরেসি বিশ্বাস করেন, তারা অনেকগুলো আলগা সুতা মিলিয়ে ঠিকই তা বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি পান। কন্সপাইরেসির এতটুকুতে আমার কোনো অবদান নেই। আমার থিওরিটুকু হলো: সেই গোপন সংগঠনটি পৃথিবীর জন্য এমন একটা আধুনিক ঈশ্বর তৈরির চিন্তা করলো, যা দিয়ে খুব সুকৌশলে সব কিছু: রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদিতে- নিজ দেশের এমনকি পৃথিবীর সব দেশের উপর খবরদারি করা যাবে।
এজন্য অস্ট্রেলীয় এই যুবককে তার পথে চলতে দিয়েছে, তারপর তাকে ছাঁচে তৈরি করেছে, তার অজান্তে। তাকে একটা নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চলতে বাধ্য করেছে। এবং তার ফলাফলস্বরূপ উইকিলিক্সের জন্ম হতে মদদ দিয়েছে। এবারে সেই ঈশ্বরকে যখন কাজে লাগানো শুরু হলো, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে মার্কিনীরাই তা তৈরি করেছে, সুতরাং এর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করার মোক্ষম ধাপটি হলো মার্কিন নথি ফাঁস করে দেয়া। সবাই তখন ব্যাপারটাকে দেখবে, দেখেছো বিশ্বের এক নম্বর গোপন দেশের সবচেয়ে গোপন সংস্থা সিআইএ’র গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে, তারমানে এরা কতটা শক্তিশালী! ব্যস, ঐ একটা টোপই যথেষ্ট। সারা পৃথিবীর মানুষ এর পর থেকেই উইকিলিক্স-কে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বিশ্বাসকে আরেকটু পোক্ত করতে মার্কিন সরকার উইকিলিক্সকে মামলার মুখে রেখেছে। আর তার ফলস্বরূপ বিশ্বাস এমনই চরম হয়েছে যে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও দেয়া হয়ে গেছে।
একটা ব্যাপারে চিন্তা করুন, উইকিলিক্স নিজে কাজগুলো করছে না, করছে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা অজানা কিংবা জানা অগণিত হ্যাকাররা। এবারে ধরা যাক, আমি হলাম মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। আমি চাইলাম আপনি হ্যাকারের জন্য আমার তথ্যগুলো উন্মুক্ত করে দিবো, কারণ আমি জানি উইকিলিক্সের সাথে আপনার সম্পর্ক আছে। সুতরাং তথ্যগুলো আপনি পাওয়ামাত্রই উইকিলিক্সের কাছে হস্তান্তর করবেন। ব্যাপারটা খুব সহজ। আমি গোপন প্রোটোকলে তথ্যটা না পাঠিয়ে তুলনামূলক কম গোপনীয় প্রোটোকলে তথ্যটা পাঠালাম, আপনি হ্যাকার তা আবিষ্কার করে মহাভারত উদ্ধার করে ফেললেন এবং গোপন তথ্যটিকে বুক ফুলিয়ে উইকিলিক্সে দিলেন। ব্যস, সারা বিশ্বময় রটে গেলো তথ্যটি। এভাবেই যে সেই গোপন সংগঠনটি তাদের ভিতরকার তথ্যগুলো ইচ্ছে করেই বের করে দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা আপনি হুট করে অস্বীকার করতে পারবেন না।
—
একবার চিন্তা করে দেখুন তো: উইকিলিক্স যদি এখন একটা নথি প্রকাশ করে বলে বাংলাদেশের খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাকে মারার ষড়যন্ত্র করেছেন, কিংবা হাসিনা, খালেদাকে মারার পরিকল্পনা তৈরি করেছেন- তখন ব্যাপারটা কী হবে? দুই নেত্রীর মধ্যে এবং/অথবা দুই দলের মধ্যে তৈরি হবে অন্তর্দ্বন্দ্ব। তা রূপ নেবে অসন্তোষে। তারপর ঝগড়ায়। তারপর সম্মুখ বিরোধে। তারপর সংঘর্ষে। তারপর যুদ্ধে।। খুব সহজেই দুটো দলের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব তৈরি করে দিতে পারে উইকিলিক্সের কয়েকটা গোপন নথি, ঠিক তেমনি এভাবে খুব সহজেই কয়েকটা বিরোধপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে লাগিয়ে দিতে পারে যুদ্ধ। …এভাবেই সেই অদৃশ্য শক্তি শ্রেফ তথ্যের মাধ্যমে কলকাঠি নাড়তে পারে সারা বিশ্বময়। যেকোনো দেশে শ্রেফ তথ্য দিয়ে তৈরি করে দিতে পারে যুদ্ধ।
একটা বহিঃশত্রুর দ্বারা তথ্যের অস্ত্র দিয়ে নিজ দেশকে জখম করার আগে আমাদেরও এরকম হ্যাকার তৈরি করতে হবে, যারা আমাদের জন্য ক্লাসিফাইড তথ্যগুলো হ্যাক করবে, তা উইকিলিক্সে প্রকাশ করুক চাই না করুক, অন্তত উইকিলিক্সের প্রকাশিত তথ্যের বিপরীতে যাচাই করার কাজে লাগবে। উইকিলিক্সের তথ্যের উপরে চোখ বন্ধ করে শত্রু তৈরি না করে দেশের প্রয়োজনে যাচাই করে নেয়া যাবে।
সব কন্সপাইরেসির ক্ষেত্রেই যে ব্যাপারটা থাকে, বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। আপনি বিশ্বাস করুন চাই না করুন, তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না।
-মঈনুল ইসলাম
_______________________
পরিশিষ্ট ১:
The Wall Street Journal প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, ফেসবুক আপনাকে বিক্রী করে দিচ্ছে। (পড়ুন: Selling you on Facebook by Julia Angwin and Jeremy Singer-vine^ ()), যারা বাংলায় পড়তে চান তাদের জন্য এই ব্লগটি (“আপনি কি জানেন, ফেসবুক আপনাকে প্রতিনিয়ত বিক্রি করছে!”)^ () প্রস্তাব করছি।