ধারাবাহিক: অফ-ট্র্যাক বান্দরবান —এর একটি পর্ব
আমরা প্রচন্ড উচ্চতায় দীর্ঘ পথ বেয়ে রুমানা পাড়ায় উঠে যখন প্রচন্ড ক্লান্ত, তখন আবুবকর ঘোষণা করলেন তাঁরা দুটো ঝরণা দেখতে যাবেন, কে কে যাবে? “আমরা” বলতে যে, কামরুলকেও যোগ করা হচ্ছে, এটা নিশ্চিত; কারণ আমরা তিনজন ছাড়া কামরুলকে নিয়েই এই পথে ট্রেক করার পরিকল্পনা ছিল আবুবকরের। আর আমি তখন নিজের চিত্তের উপর বাজি ধরে রাজি হয়ে গেলাম চ্যালেঞ্জটা নেবার জন্য।
আবুবকর বললেন, ঝরণার ছবি তুলতে ক্যামেরা নিতে হবে। কিন্তু কামরুল প্রথমেই তার এসএলআরকে সরিয়ে রাখলো, না বাবা, আমি এই রিস্ক নিবো না। নাকিব কিংবা রাসেলও নিজেদের ক্যামেরা এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে নষ্ট করতে দিতে চাইলো না। আমি তখন সাহস করে বললাম, ঠিক আছে, আমি আমার আইফোন নিচ্ছি। (কারণ ওটা পকেটেই পুরে রাখা যায়)
ব্যস, আসন্ন অন্ধকারের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সবাই-ই টর্চ নিয়ে নিলাম, ব্যাগ রাখলাম কারবারির ঘরে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এবারে আমি পুরাই পাঙ্খা হয়ে গেলাম। শুধু একটা পানির ছোট্ট বোতল নিয়ে নিলাম অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে। আমাদের দুই গাইডও চললো আমাদের সাথে, আপেলের হাতে আছে আমাদের আনা দা। কারবারির ছোট ভাই আমাদেরকে ঝরণা দেখাতে নিয়ে যাবে, তাই তাকে অনুসরণ করে আমরা চললাম দুটো ঝরণা দেখতে, যে-পথে উঠে এসেছিলাম এই চরম উচ্চতায়, সে-পথে আবার নিচের দিকে।
অন্ধকার হয়ে আসছে পথ, কিন্তু তাতে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই বিন্দুমাত্রও। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— ঝরণা দেখতে হবে অন্ধকার নামার আগেই। পাহাড়ের চড়াই উঠা যতটা কঠিন, উৎরাই পেরোন তার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সেরকমটা হলো না, আমাদের শরীরের ওজন হালকা করায়। দ্রুতই নেমে গেল আমাদের ছয়জনের দলটা।
যে-পথে এসেছিলাম, সে-পথে নেমে নেমে সাঁকোর আগেই ডানদিকে একটা পাতাঝরা পথে আমাদের নিয়ে চললো কারবারির ভাই ‘লালহিম’। পথটা কিছুটা এগিয়ে নিচে নেমে গেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সামনে একটা ছোট্ট ঝিরি পার হবার জন্য একটা গাছ ফেলা, ধরার কোনো জায়গা নাই ওটাতে, ওটা ধরে দলটা খুব দ্রুতই পার হয়ে গেল।
এরপর হঠাৎ মনে পড়লো আমরা আসরের নামায পড়িনি। তাই দ্রুত ঝিরির পানিতে ওযু করে গামছা বিছিয়ে তিনজন আসর সেরে নিলাম। চললাম সামনে। এবারে কোমর পানি দিয়ে ঝিরি পেরোতে হলো। তারপর ঝিরি ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে শুনতে পেলাম ঝরণার শোঁ শোঁ আওয়াজ।
এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো একটা অল্প-উচ্চতার ঝরণা। ওটা নামতে তেমন কষ্ট হলো না। ওটা পেরিয়ে সামনে যেতেই হঠাৎ করে সামনে দেখা গেল কয়েক ফুট সামনে পায়ের নিচের পাথুরে জমিন উধাও।
বুঝতে কষ্ট হলো না, ওখানটাতেই ঝিরির পানি গিয়ে সবেগে আছড়ে পড়েছে নিচে। আবুবকর ভাই তাঁর কাজে ব্যস্ত, জিপিএস ট্র্যাক করছেন। আমি আমার ফোনখানা বের করে ছবি তুলতে চাইলাম। কিন্তু পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে মরতে চাইলাম না। কারণ ইতোমধ্যেই আবুবকর আমাদের জানিয়েছেন, স্থানীয়রা তাঁকে কী বলেছে: এখানে নাকি এক পাহাড়ি মেয়ে মারা গেছে ঝরণা থেকে পড়ে। তারপরও গাইড বিকাশের হাত ধরে কোনো রকমে যথাসম্ভব সামনে ঝুঁকে, উপর থেকে ঝরণার ছবি নিতে চাইলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে, ফ্ল্যাশ ছাড়া প্রায়ান্ধকার ছবিগুলো কোনো মানেই রাখে না, তবুও, ছবি তো! (লালহিম পরে আমাদের নিশ্চিত করেছে, মারা যাওয়া সেই কিশোরি কিছুটা মানসিক বৈকল্যের শিকার ছিল।) (বিস্তারিত: পরিশিষ্ট ২-এ দেখুন)
এবার আবুবকর ডাকলেন আমায়। লালহিম আমাদেরকে ঝরণার পাশের একটা পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেল। পাহাড়ে উঠলাম। এরপর শুরু হলো নিচে নামা। খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামা। এই ব্যাপারটা এখন আমাদের যেনবা অভ্যাস হয়ে গেছে। তবুও সব সময়ই পাহাড়ে পাহাড়ে নতুন নতুন অবস্থা, নতুন নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন অনুষঙ্গের সাথে উঠতে-নামতে হয়, তাই থ্রিলটা সবসময়ই সমান প্রায়। লালহিম পথ তৈরি করা ছাড়াই নামছে। তাকে অনুসরণ করছে আমাদের গাইড বিকাশ আর আপেল। তাদের পিছনে আমরা।
গাছের শিকড়, ঝুলে থাকা ডাল, উপড়ে পড়া মোটা গাছ, মুখ-বের-করা পাথর, পাহাড়ি বাঁশের ঝোঁপ ধরে ধরে আমরা নামছি। আমাদের আপেল বাবাজি তার দা-খানা দিয়ে কোপ দিয়ে পথ পরিষ্কার করে করে নামছে। একসময় আবুবকর তার খুব কাছাকাছি চলে গেলেন। আর অমনি ও-ব্যাটা উপর থেকে মাটির দিকে দায়ের কোপ দিল, আর…
…সেই কোপ গিয়ে পড়লো আবুবকরের পায়ের আঙ্গুলে। রক্ত বেরোতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। কিন্তু অত্যন্ত মনের জোর দিয়ে আবুবকর যখন বললেন, আরে, কিছু হয় নাই, তুমি এগোও —তখন সত্যিই মনে হলো এ ব্যাটা রোবট। আবুবকর প্রমাণ করলেন, তিনি আসলেই একজন অভিযাত্রী। এই পথ কিংবা জঞ্জাল পেরিয়ে আমরা অল্প সময়েই নেমে এলাম সেই ঝরণাটারই পাদদেশে।
অপূর্ব অনুভূতি। এই কিছুক্ষণ আগে যে ঝরণার উপরে দাঁড়িয়ে অসাধ্য কিছু বলে মনে হচ্ছিল, এখন সেই ঝরণার মালভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি তার সম্পূর্ণ দেহ। লালহিম জানালো, এটাই সেই তিন-ধাপ-ঝরণা। উপরে আমরা একটা ছোট্ট ধাপ রেখে এসেছি, এইমাত্র আমরা দ্বিতীয় ধাপটা উপর-নিচ থেকে দেখা সম্পন্ন করলাম আর তারও নিচে আছে তৃতীয় ধাপটা। ডানদিকে দ্বিতীয় ধাপটা রেখে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি আবারো পাথুরে জমিন কয়েক ফুট সামনে থেকে উধাও, তবে এখানে বেশ খাড়া ঝরণা।
আবুবকর জানালেন, খুব বেশি উঁচু না ঝরণার দ্বিতীয় ধাপটা: জিপিএস-এ দেখাচ্ছে ১৩২ ফুট। আমরা এগিয়ে গিয়ে তৃপ্তি ভরে পানি খেয়ে নিলাম। সেখানে দেখতে পেলাম দারুণ এক পাখি। কামরুল খুব মিস করলো পাখির ছবিগুলো। খুব ইচ্ছা করছিল, গোসল করে ফেলি। কিন্তু কেন জানিনা, সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে এখানে সময় নষ্ট না করার তাগিদ অনুভব করলো সবাই।
আমাদের খুব ইচ্ছা হলো নিচের ঝরণাটার ছবিও তোলা। লালহিম এবং পাহাড়িদের মতে ওটা আরো বেশি উঁচু। কিন্তু একেতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তার উপর আরো বেশি খাড়া পথ নামতে হবে। তাই আবুবকর একটা অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি শুধু লালহিমকে পাঠাবেন। লালহিম এই সিদ্ধান্তে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না বোধহয়। কিন্তু তাকে যেভাবে বুঝিয়ে দিলেন, সেভাবেই সে জিপিএস ডিভাইসটা নিয়ে চলে গেলো আবার পাহাড়ের ঢালে। সেখান ধরে সে যাবে নিচে, তৃতীয় ঝরণার পাদদেশে।
সে, ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই জিপিএস আপনা-আপনি ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড (ভৌগোলিক স্থানমান) আর এলেভেশন বা উচ্চতা ট্র্যাক করে নিবে। আমরা যখন দ্বিতীয় ঝরণার পাদদেশে দাঁড়িয়ে গুগল আর্থের মাহাত্ম-কীর্তন করছি, ততক্ষণে, এই মাত্র দেড় মিনিটের মাথায় লালহিম হাপাতে হাপাতে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। ওর অবস্থা দেখে আমরা সবাই-ই একটু বিচলিত হলাম, কী হয়েছে!
আবুবকর বুঝে গেলেন, তুমি ভয় পাইছো? লালহিম অস্বীকার না করলেও স্বীকার করলো না ঠিক, তবু তাকে দেখে বোঝা গেল, পাহাড়ে থাকলেও অন্ধকার পাহাড়কে সে ভয় করে, যখন একা থাকে। জিপিএস ডিভাইসটা হাতে নিয়ে এলেভেশন দেখলেন আবুবকর, দেখাচ্ছে ১৩০ ফুট। তাহলে কি পাহাড়িরা ভুল বলে? হিসাবে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপটাই বেশি উঁচু। (আমার আর কামরুলের এখন যথেষ্ট সন্দেহ হয়, ও ব্যাটা লালহিম হয়তো ভয়ে পুরোটা পথ নামেইনি, তাই হিসাবটা ভুল হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।) (পরিশিষ্ট ৩ দ্রষ্টব্য)
যাইহোক, আসন্ন অন্ধকারকে সমীহ করে আমরা উঠবার চিন্তা করলাম। আবারো সেই পথে উপরে উঠে আসতে লাগলাম আমরা। একটু আগে মোটামুটি আলোতে অনেক কিছু দেখা যাচ্ছিল, এখন গাছের ছায়ায় তা অনেক বেশি অন্ধকার লাগছে। তাই পায়ের নিচের মাটিটা কোথাও কোথাও আন্দাজ করেই পা ফেলতে হচ্ছে। উপরে উঠে এসে আমরা আর দেরি করলাম না। মাগরিবের নামায ওখানেই পড়ে নিয়ে পাড়ার দিকে চললাম। পথে নিজেদের জুতাটুতা ভালোমতো পরিষ্কার করে নিলাম। আরেকটা ঝরণা না দেখেই আমরা পাড়ার পথ ধরলাম।
আপেল চলেছে সামনে, আমি আর আপেল গল্প করতে করতে সবার সামনে এগোচ্ছি। বাকিরা আসছে পিছনে, বেশ কিছুটা পিছনে পড়ে গেছে গল্প করতে করতে। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয় — আমি এত কষ্টের পরও এখন আর শরীরে তেমন কষ্ট অনুভব করছি না। আর আপেলের সাথে তাড়াতাড়ি ওঠার প্র্যাক্টিসটা করতে করতে বেশ ভালোই উঠতে পারছি পাহাড়ি ছাগলের মতো। আমি নিজেকে একটা ছাগল ভেবে কি তৃপ্তি পেলাম?!!!
উঠে এলাম রুমানা পাড়ায়। অন্ধকার পাড়ায় তখন ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে, অবশ্যই কুপির আলো। এপর্যায়ে রুমানা পাড়া আর বমদের সম্পর্কে একটু বলি:
রুমানা পাড়া, একটা বম পাড়া। আগে নাম ছিল সানকুপ পাড়া, সেটা ছিল ‘সানকুপ’ নামক কারবারির নামে। রুমা খালের শেষে পাড়াটার অবস্থান বলে এর নাম রুমানা পাড়া হয়েছে পরে। অন্যান্য বম পাড়ার মতোই রুমানা পাড়াও যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাড়া-প্রধানকে বলা হয় ‘কারবারি’। পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও আছে একটা গির্জা। বমরা পিতৃতান্ত্রিক এবং মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় স্বর্ণালঙ্কার এবং গৃহস্থালি অনেক কিছু দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। এটা যৌতুক-প্রথার মতো হলেও ঠিক যৌতুক হিসেবে গণ্য হয় না, প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার ঘরগুলো বাঁশের তৈরি, চাল দেয়া শন বা খড় দিয়ে। জানালাগুলো থাই-জানালার মতো স্লাইডিং, তবে স্লাইডিং প্যানেলটা তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে, এবং বেশ সাবলীল (smooth)। রুমানা পাড়ার লোকজন বাজার করতে যায় রুমা বাজারে, সেটা মোটামুটি দুই দিনের কাজ। একদিন লাগে গিয়ে বাজার করতে, সেখানে একরাত থাকে, তার পরদিন বাজার নিয়ে ফিরে আসে তারা। কারবারিরা বংশপরম্পরায় কারবারি হয়ে থাকেন। তাঁরা সরকার থেকে রেশন পান, এবং সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে সেই রেশন পাড়ায় পৌঁছে দেয়।
পাড়াটার নাম “রুমানা” নাকি “রুমনা” —এই বিষয়ে কামরুল আর আমার মধ্যে মতভেদ আছে। আমি বলছি “রুমনা” কামরুল বলছে “রুমানা”, অবশ্য এব্যাপারে কামরুলের যুক্তিটা শক্তিশালী। আমি ‘রুমনা’ বলছি, কারণ কোনো এলাকার স্থানীয়রা যে নামে এলাকাটাকে ডাকে, তা-ই নাম হিসেবে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যখনই তাদেরকে কোনো প্রভাবমুক্তভাবে নামটা বলতে দেয়া হয়, তখন তারা উচ্চারণ করে ‘রুমনা’। কামরুল ‘রুমানা’ বলছে, কারণ পাড়ার কারবারির মুখে সে শুনেছে ‘রুমানা’।
কারবারি আমাদেরকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে “রুমানা” নামটা না বম, না বাংলা, বরং এটা মারমা ভাষা। মারমা ভাষায় “রুঃ” মানে হলো “পাগল” আর “মা” মানে হলো “মেয়ে”। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই ‘রুমা খাল’ থেকে ‘রুমানা পাড়া’ নামকরণ হয়। এই ‘পাগল মেয়ে’ নামকরণে আছে দারুণ এক রোমান্টিকতা, নৃতাত্ত্বিক ঐকতান— য়িন-য়িয়াঙ, বৈপরিত্বের মিলন: একসময় রুমা খালে, বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ মারা যেত। যারা মারা যেত, তাদের মধ্যে নারী ছিল না, শুধু পুরুষরা মারা যেত। তাই রুমাকে, প্রকৃতিদেবী গণ্য করে আদিবাসীরা একে এক মেয়ে কল্পনা করে নেয়, আর সেই মেয়েই যেনবা ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছে এভাবে। তাই সেই মেয়ে হয়ে যায় ‘পাগল মেয়ে’, মানে ‘রুঃমা’, যা থেকে হয় ‘রুমা’।
এই যাবতীয় আলোচনা থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, কামরুলের দাবি ঠিক, অর্থাৎ মারমা ভাষা অনুযায়ী পাড়াটার নাম ‘রুমানা’ই ঠিক। কিন্তু বম ভাষার উচ্চারণশৈলীতে সম্ভবত ‘রুমানা’ উচ্চারিত হয় না, তাই তারা বলে ‘রুমনা’। এখন যেহেতু পাড়াটায় মারমা-রা নয়, বরং বমরা থাকে, তাই আমি এর ‘রুমনা’ নামকে অগ্রগণ্য ধরবো; কোন খাতায় কী লেখা আছে, সেসবের বিচার করতে আমি রাজি না।
যাহোক, আমরা ঝরণা দেখে অন্ধকার রাতে পরিশ্রান্ত হয়ে যখন কারবারির ঘরে ফিরে আসি, রাসেল তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে, আর নাকিব গল্প করছে কারবারির সাথে। কারবারি, আর-সব পাহাড়িদের মতো ছিপছিপে শরীরের একজন ক্লিন-শেভ্ড মানুষ, লুঙ্গি আর শার্ট পরে বসে আছেন নাকিবের পাশে। কুপির আলোয় পরিবেশটা বেশ সুন্দর।
কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, আমাদের গাইড বিকাশ বেশ রেগে আছে। কী হলো? শুনলাম, আমরা ঝরণায় যাবার আগেই কারবারির থেকে একটা মুরগি কিনে রেখে গেছেন আবুবকর। নাকিব আর রাসেলকে ওটার ওজন কত হয় দেখতে বলা হয়েছিল, নাকিব সেটা দেখে রেখেছে। কিন্তু এতক্ষণ আমরা আসিনি, ওরা কেন সেটা জবাই করে রাখলো না? ক্ষিধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। অথচ রান্নার সিকি ভাগও প্রস্তুত করা হয়নি।
রাগটা অযৌক্তিক না। ক্ষিধের ঠ্যালায় নাড়িভুড়ি হজম হবার জোগাড়। পা থেকে অ্যাংকলেট আর নী-ক্যাপ খুলে আমি আর আবুবকর গেলাম মুরগিটা, থুক্কু মোরগটা জবাই করতে। ওটাকে ঝুড়ির নিচ থেকে বের করে যতবারই আমি একহাতে ডানা আর পা আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে গলা ধরতে যাই, অমনি ডানা হাত থেকে ফসকে যায়। এভাবে তিনবার হবার পর, আবুবকর বেশ বিরক্ত হলেন। আমিও নিজের উপর বিরক্ত হলাম, [শ্লীল গালি] হাতের গ্রিপটা কি এতোটাই ছোট হলো যে, মোরগটা ধরতে পারছি না। …এবারে আবুবকর নিয়ে যখন ধরতে চাইলেন, তখনই আবিষ্কার করলাম আমরা, এরা, মোরগটার উড়ে যাওয়া রোধ করতে ডানাদুটো একসাথে করে পাটের রশি দিয়ে আটকে রেখেছে। তাই ডানা ছোট হয়ে যাওয়ায় আমার হাত থেকে ফসকাচ্ছিল। হয়তো এভাবেই এই পাহাড়ের চূঁড়ায় মোরগ পালে এরা। বাঁধন কাটার পরে বেশ সহজেই জবাই করা হলো ওটা। জবাই করার পর হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়লো, এরা থাকে অনেক উঁচু পাহাড়ে, তাই পানির ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী হতে হবে। আমরা খুব অল্প পানি খরচ করে হাত ধুয়ে নিলাম।
পরে শুনলাম, নাকিবেরও সময়টা ঠিক ব্যস্ততাহীন কাটেনি। রাসেলকে রীতিমতো নার্সের মতো পরিচর্যা করেছে সে। মূভ দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে। মালিশ করে দিয়েছে পা। ও বেচারাকে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুইয়ে দিয়েছে আরামের জন্য, যদিও নিজেও বেচারা ব্যথায় কাতর ছিল। কিন্তু মোরগটা জবাই না করার অপরাধ থেকে তবু তাকে অব্যহতি দেয়া গেল না।
হঠাৎ শোনা গেল ঢোলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। পাহাড়িরা জংলি গান ধরে বসলো নাকি —এমন প্রশ্নে যখন কপালটা কুঁচকে উঠতে যাচ্ছিল, তখন আবুবকর জানালেন গির্জা থেকে আসছে আওয়াজ। কান পেতে শুনলাম, সুরে সুরে লয়ে লয় মিলিয়ে গানের কথা ভেসে আসছে গির্জা থেকে, সাথে পড়ছে ঢোলের তাল। বুঝতে কষ্ট হলো না, শাস্ত্রীয় খ্রিস্টধর্ম এখানে এসে শাস্ত্র ধরে বেশ জুত করতে পারেনি, তাই পৌত্তলিক বমদের ধর্মান্তরিত করতে তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বাদ না দিয়ে ‘ধর্ম’ বানিয়ে জুড়ে নিয়েছে— এজন্য একে আমি বলি লৌকিক খ্রিস্টধর্ম।
গির্জার সার্মন শেষে ঘরে ঢুকলেন এক পুরুষ, হাতে একটা বই। জানতে পারলাম ওটা বাইবেল। তিনি আমাদের সাথে পরিপূর্ণ ইংরেজিতে কথা বললেন। তাঁর শুদ্ধ ইংরেজি বোলে জানা গেল, তিনি ভারতের ত্রিপুরাতে লেখাপড়া করেন। সেখানে যাবার বর্ণনা দিলেন, কী করে তাঁরা পাহাড়ের পর পাহাড়, উঁচু উঁচু পাহাড় পায়ে হেঁটে কয়েকদিন পরে গিয়ে ত্রিপুরার বর্ডার পার হোন। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা যাবার এই বর্ণনা যতটা না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় এক সাধারণ বম যুবকের শিক্ষা-স্পৃহা। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না, কারবারি নিজেই অসন্তুষ্ট চিত্তে তাঁর ছোট ভাই লালহিমের বদনাম করলেন, ফাইভ পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে সে।
একদিকে বিকাশ আর আপেল মিলে মোরগ কেটে ধুতে লাগলো, তাদেরকে সহায়তা করলো লালহিম আর কামরুল, আমিও পরে গিয়ে সঙ্গী হলাম। মোরগ ধোয়া শেষ করে কারবারির রান্নাঘরেই রান্না করতে বসলো বিকাশ। আরেকটা কুমড়া কাটা হয়েছে, আপেল আর লালহিম কেটে-কুটে একটা পাত্রে রাখছে। কামরুল আর আমি যখন পরে ওদের সাথে যোগ দিলাম, তখন কামরুল আবিষ্কার করলো, ক্ষিধে পেটে ঐ কাচা কাচা কুমড়া বেশ দারুণ উপাদেয় খাবার হয়ে উঠতে পারে। কামরুলকে দেখে আমিও এক টুকরা নিয়ে মুখে পুরে তাজ্জব বনে গেলাম, বেশ মিষ্টি, কুমড়াটা। কাচা কাচাই কামড়ে খাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। আমি আর কামরুল অনেকক্ষণ ধরেই খেয়ে গেলাম ঐ কাচা কুমড়া। বিষয়টা আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল।
আমরা যখন রান্নাবাটি খেলছিলাম, থুক্কু, করছিলাম, তখন ওদিকে আবুবকর আর রাসেল মিলে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন কারবারির। আর নাকিব তুলছিল স্থিরচিত্র। কুপির আলোয় ক্যামেরার ভিডিওতে চেহারা দেখার প্রশ্নই উঠে না, তাই নাকিব ওর এলইডি-চার্জলাইটটা জ্বালিয়ে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করলো। কিন্তু ভিডিওটা দেখার পরে বোঝা গেলো স্টুডিওর আলো কেন এতো উজ্জ্বল কিসিমের হয়। রাসেল তার বয়ে আনা ক্যামেরাটাকে ট্রাইপডের উপর বসিয়ে ভিডিও করার দায়িত্ব নিল। আবুবকর আর রাসেল প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে থাকলেন কারবারির থেকে।
এদিকে যখন এই ডকুমেন্টারি নির্মাণ চলছিল, তখন আমরা রান্নাঘরে বসে গল্প করছিলাম। বিকাশ রান্না করছে, আমরা প্রয়োজনীয় সহায়তা করছিলাম। কারবারির ঘর থেকে একটা ডেকচি ধার করা হয়েছে। যে হাতাটা দিয়ে নাড়ছে বিকাশ, ওটা একটা বাঁশের টুকরা, একটা ছোট্ট কঞ্চিসহ কাটা হয়েছে টুকরাটা। এরকম প্রাকৃতিক জিনিসই পাহাড়িদের নিত্যসঙ্গী। চুলাটা তৈরি করা হয়েছে কাঠের মেঝের উপর মাটি জমা করে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে তার উপর। চুলার তিনটা পায়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শিল-পাটার শিলের মতো দেখতে তিনটা লম্বাটে পাথর। চুলার কয়লা নেড়ে দেয়ার জন্য এক টুকরা বাঁশকে গরম করে বাঁকিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক চিমটা। একটা কুপি সাধারণ বাঙালি ঘরাণার হলেও আরেকটা কুপি ছিল আকর্ষণীয়: একটা টিনের পটের মধ্যে ভরা হয়েছে মাটি। তার মধ্যে গেঁথে একটা টিনের ফানেল দাঁড় করানো হয়েছে। ফানেলটাই আসল কুপির আঁধার, ওটার উপরটা বন্ধ করে কুপির সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়েছে। এসব ছাড়াও এদের নিজস্ব নিচ-চারকোণা-উপর-ছড়ানো-গোলাকৃতি ঝুড়ি, লম্বাটে কিরিচ-আকৃতির দা, বাঁশের ঘুটনি ইত্যাদি তো আছেই।
আমাদের বিকাশ বাবাজি, রান্না করতে করতে গল্প করছিল, যেকোনো পাহাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হলো বম মেয়েরাই। ও বেচারা বম মেয়েদের খুব ভক্ত। কিছুক্ষণ পরেই তার কারণ এবং যৌক্তিকতা পাওয়া গেল, কেননা এই বেচারা ইতোমধ্যেই এক বম পাড়ার একজন বম মেয়ের কাছে নিজের হৃদয়টাকে বন্ধক রেখেছে। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ আর কিছুটা গাল-লাল-করা ভালোবাসার আহ্লাদে মোবাইল বের করে নায়িকার ছবিখানাও কামরুলকে দেখিয়ে দিল।
যাহোক, রান্না হয়ে গেলে আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে ওদের সবাইকে ডেকে আমরা খেতে বসে গেলাম। লালহিমও আমাদের সাথে খাবে। খেতে বসে আর দেরি করলাম না। ক্ষিধায় যে পেট জ্বলে যাবার জোগাড়। খাবার মুখে দিতেই স্বাদ ছাপিয়ে যে জিনিসটা মুখে লাগলো, তা হলো গরম আর ঝাল। প্রচন্ড ঝাল করে রেঁধেছে বিকাশ। আমি ঝাল প্রায় খাই-ই না, কিন্তু এত্ত ঝাল, তবু ক্ষিধার ঠ্যালায় পটাপট গিলছি। বাকিদেরও একই দশা— বিকাশ, আপেল আর লালহীম অবশ্য ব্যতিক্রম।
এই ঝালের কারণ জানতে চাইলে বিকাশ জানালো, পাহাড়িদের নাকি এই ঝালের কারণেই ম্যালেরিয়া হয় না। সত্য-মিথ্যা কিংবা ডাক্তারি বিদ্যার প্রমাণ আমার কাছে নেই, তবে এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধকের কথা আমায় বেশ আকর্ষণ করলো। কারণ সোয়াইন ফ্লু যখন দেখা দিয়েছিল, তখন একদল জাপানি বিশেষজ্ঞ জানালেন, যেসকল দেশে মশলাদার খাবার বেশি খাওয়া হয়, সেসকল দেশে সোয়াইন ফ্লু খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। সোয়াইন ফ্লু, মশার কারণে না হলেও দুটোর মধ্যে একটা সূত্র মিল পড়ায় বিষয়টা আমার কাছে যৌক্তিকই মনে হলো।
খেয়ে-দেয়ে আমরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। সামনের ঘরটায়, মানে, কারবারির একমাত্র ঘরটায়ই আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা। এই ঘরটার পাশেই শ্রেফ একটা রান্নাঘর ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। ঘরটার একপাশে কারবারির পরিবার, আরেক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে আমাদের শোবার ব্যবস্থা। “শোবার ব্যবস্থা” শুনে মনে করার দরকার নেই, একেবারে খাট-পালং দিয়ে শোবার ব্যবস্থা। একইভাবে, কয়েক প্রস্থ কম্বল দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিচে আর উপরে দিয়ে বাঁশের চাটাইয়ের মেঝেতেই ঘুমানোর বন্দোবস্ত করা হলো। শোবার আগে সেদিনও পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। মশা এখানেও নেই দেখে, ওডোমস মাখলাম না। (ওডোমস হলো মশা নিরোধক মলমবিশেষ)
ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ফযরের নামায পড়ে আরেকটা দিন শুরু করার প্রস্তুতি নিলাম। নাকিব, খুব ভোরেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা সেরে ফেলেছে। ঠিক নাস্তা করার আগ-মুহূর্তে রাসেলের আবারো যখন কাজটায় যাবার প্রয়োজন হলো, তখন সবাই যার-পর-নাই বিরক্ত হলো। কামরুল ওকে সঙ্গ দিল। আমিও যে মহাপুরুষ, সব বন্ধ করে বসে আছি, ব্যাপারটা তা না। গত রাতে, শান্ত পরিবেশে, আমার টর্চ নিয়ে একটা ল্যাট্রিনে বসে কাজ সেরে নিয়েছিলাম। ল্যাট্রিনটা পাহাড়ের খাঁজে বসানো, নিচে কিছু বাঁশ দিয়ে একটা পাটাতন বানিয়ে, তার মাঝখানে গর্ত রাখা হয়েছে। চট দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটাকে ‘চেষ্টা’ বলাটাই সমিচীন হবে। রাতে উপদ্রব না থাকলেও, সকালে নাকিব এবং রাসেলের অভিজ্ঞতা হয়েছে, ওরা যখন কাজ সারছে, ঠিক নিচে গপাগপ তা সাবাড় করায় ব্যস্ত ছিল বম পাড়ার পালিত বরাহরা।
নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকার সময় হঠাৎ রাসেলের চোখ পড়লো রান্নাঘরের মেঝেতে কারবারির ছোট্ট বল্টুটা হাতে, পাহাড়িদের বড় দা নিয়ে বসে বসে জুম থেকে তুলে আনা আদার টুকরায় কোপ বসাচ্ছে। নাকিব ক্যামেরা বের করতে করতে দৃশ্যটা মিস হয়ে গেল। তবে দৃশ্যটা যতটা না উপভোগ্য ছিল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কজনক ছিল আমাদের জন্য।
যাহোক, রাতের খাবারের রেখে দেয়া অংশটুকু খেয়ে উফ্-আফ্ করতে করতে অবশেষে বেরোলাম আমরা কারবারির ঘর থেকে। যাবার আগে কারবারিকে তাঁর বিল পরিশোধ করলেন আবুবকর, মোরগের দাম শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ হলেও আবুবকর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব শান্ত কন্ঠেই বিষয়টার ইস্তফা দিয়ে (পরিশিষ্ট ১ দ্রষ্টব্য) ইতি টানলেন রুমানা পাড়ার। সাকুল্যে কারবারিকে দেয়া হলো ৳১,২০০ (মোরগের দামই ছয়শো-সাতশো’র উপরে ছিল)।
রুমানা পাড়া খুবই ছিমছাম, পরিষ্কার পাড়া। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলোয় চোখ যা বোলানো যায়, ততটুকু বোলালাম আমরা। এখানকার ঘরগুলো এক কিংবা বড়জোর দুই কক্ষের, পেছন দিকে থাকে বারান্দার মতো বড় একটা বাড়তি অংশ: যেখানে পানি ফেলা, হাত-পা ধোয়া, বাচ্চাদের পেশাব করানো থেকে শুরু করে বাঁশের ফাঁক গলে নিজেদের মুত্র বিসর্জনের কাজও তারা সেরে থাকে।
একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, বম পাড়ায় নারকেল গাছ। বেশ কিছু ঘরের পাশে বেড়া দিয়ে নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, তা ওরা না জেনেই হয়তো কাজটা করে। কারণটা হলো, বজ্রপাত। নারকেল গাছ, বজ্রপাত আকর্ষণ করে। ফলে, কোনো ঘর কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ে, তা নারকেল গাছের উপর পড়ে, মানুষের জীবন বাঁচে। আর, রুমানা পাড়ার মতো উঁচু বম পাড়াগুলোর জন্য এগুলোর গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ মেঘের স্তরের খুব কাছাকাছি, এমনকি মেঘের স্তরেই থাকে পাড়াগুলো।
আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে লালহিম। সে আমাদেরকে গতকালকের অবশিষ্ট ঝরণাটা দেখিয়ে দিয়ে চলে আসবে। আমাদের পথটা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নিচে নামছে। আজকের গন্তব্য? অবশ্যই সামনের ঝরণাটি। কিন্তু তারপর?
অনাকাঙ্ক্ষিত ক’টি উৎসের পথে আমাদের পথ যে চলবে, সেটা জানা ছিল না তখনও আমার। আবুবকর যেন গভীর এক ষড়যন্ত্র করলেন!
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
পরিশিষ্ট ১
কিছুদিন আগে রুমানা পাড়ার কারবারি নাকিবকে ফোন করেছিলেন, মানে মি’ছা কল দিলে নাকিব ফোন করে। তিনি রুমা বাজারে বাজার করতে এসেছিলেন (দুই দিনের ফাঁড়ি)। আমাদেরকে আবারো আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর পাড়ায়। …এখানে একটু বলে রাখি, ওখানে মোরগের এতো দাম হওয়ার কারণ হলো তাদেরকে ওখানে অনেক কষ্ট করে পালন করতে হয় ওগুলো।
পুনশ্চ, যাদের কাছে মনে হচ্ছে এই ভ্রমণ-বৃত্তান্তটা খুব বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, তাদের অবগতির জন্য জানাতে চাচ্ছি, এটা একজন ভ্রমণকারীর বৃত্তান্তের চেয়ে একটু বেশিই একজন ভবিষ্যত ভ্রমণকারীর তথ্য-ভাণ্ডার। তাই এতে তথ্য যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কোনো কার্পণ্য না করেই।
পরিশিষ্ট ২ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫)
ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্স-এর শ্রদ্ধেয় আকাশ ভাই বলছেন, ঝরণার নাম “জিংসিয়াম সাইতার”, যার মূল নামকরণ করা হয়েছিল “জিংসিয়াম (যুবতির নাম – Zingsiam) ত্লাকনাক (তিন ধাপ – Tlaknak) সাইতার (ঝরণা – Saitar)”- নামকরণে জড়িত ছিলেন ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্স দল, নতুন রুমনা পাড়ার কারবারি কাপ্রিং ব্যোম, এবং জিংসিয়ামের আপন ভাই ন্যল ব্যোম । ঝরণাটিতে যে মেয়ে মারা গিয়েছিল, সে কিশোরী নয়, বরং ২৪/২৫ বছরের যুবতি ছিল। এই মৃত্যু নিয়ে উদ্ভট এবং বিকৃত বিভিন্ন তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। এজন্য প্রকৃত ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো:
মেয়েটি মারা গেছে ঝরণার পাশের পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে। যেখানে মারা গিয়েছিল, তার ভৌগোলিক স্থানাংক হলো 21°57’42.61″N 92°32’30.37″E। স্থানটা ঝরণার দ্বিতীয় ধাপের কাছে আর রুমনা পাড়ার সীমানার মধ্যে। রুমনা পাড়ার কারবারি আর গির্জার সার্মনদাতার ভাষ্য শুনে এবং মেয়েটির ভাই নল-এর দেয়া তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, মেয়েটির এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগ ছিল। একদিন সকালে সে ঐ পাহাড়ে কাজে যায় এবং রাত পর্যন্ত পাড়ায় ফিরেনি। তাই রাতে পাড়ার লোকজন তাকে খুজতে বের হন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে পাহাড়ের ঢালে তার ঝুড়ি আর দা দেখতে পান এবং ওখান থেকে কিছু পাতা ঝর্ণার দিকে সরানো ছিল (মানুষ পড়ে গেলে যেমনটা হয়)। লোকজন ঝর্ণার নিচে নেমে তাকে মাথা ফাটা আর হাত ভাঙ্গা অবস্থায় মৃত দেখতে পান (ঐ স্থান থেকে ঝর্ণার উচ্চতা ১২৮ ফুট)। এ থেকে ধারণা করা হয় সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। পাড়ার লোকজন লাশ না তুলে আর্মি ক্যাম্প-এ খবর দেয় এবং আর্মির অনুমতি নিয়ে লাশ, পাড়ায় আনতে আনতে রাত আনুমানিক ২টা বাজে। ঐদিন পাড়ায় কোনো পর্যটক ছিলেন না বা আসেনওনি। এবং এটা এখনকার পর্যটনস্বর্গ বান্দরবানের ঘটনা না, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। – তথ্যগুলো আবুবকর ভাই এবং সম্ভ্রান্ত ট্রেকিং ও গবেষক দল ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্স থেকে নিশ্চিত হয়ে লিখছি।
পরিশিষ্ট ৩ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫)
ঝরণাটির ধাপের বর্ণনায় আমার একটা ভুল আছে: যেটাকে এখানে প্রথম ধাপ বলা হয়েছে, সেটা আসলে ধাপ হিসেবে গণ্য হবেই না। যেটাকে এখানে দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে বর্ণনা করা আছে, সেটা আসলে প্রথম ধাপ। আর এরও নিচে আরো দুটো ধাপ আছে।
vai ami akta akta kore apnader sobgolo kisti pore jachi . khub valo lagse . r o valo laglo ovijatrar sathe akto romanch jog howey pora akta sobi jeno .r setar o bistarito deben kinto
সব ছবিই যথাসম্ভব বিস্তারিত দেয়ার চেষ্টা করি। রোমাঞ্চ পুরো অভিযানেই আমাদের ছিল। আপনাকেও রোমাঞ্চে জড়াতে পেরেছি জেনে ভালো লাগলো। 🙂