ধারাবাহিক: অফ-ট্র্যাক বান্দরবান —এর একটি পর্ব
হতাশায় যখন নেমে আসছি বেতকাঁটায় আটকে আটকে, তখন মোটেই ভালো লাগছিল না আমার। নিচে নেমে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। হতাশাটা আমি নাকিবের মাঝেও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আঁশ। দলনেতা আবুবকর একটা সূক্ষ্ম পথ যেন দেখতে পেলেন। সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন দুই গাইডকে।
নির্দেশনামতো, গাইডরা আলোচনা করতে গেল ঐ দুই পাহাড়ির সাথে, আগের ঝরণাটায়। আবুবকর বাতলে দিলেন, ওঁদেরকে বলেন, আমাদের একটু উপকার করতে, পথ পাচ্ছি না আমরা, আমাদেরকে একটু পথ দেখিয়ে দিতে বলেন, আগে থেকে টাকা-পয়সার কথা বলার দরকার নেই।
হয়তো অসম্মতি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর আমাদের সহায় হলেন। ঐ দুই ব্যক্তি আমাদেরকে ঝরণাটা পার হতে সহায়তা করবেন। কিন্তু, ওমা!
…ওরা দেখি বীরদর্পে এগিয়ে এসে হাতের দা দিয়ে ঝরণার একেবারে লাগোয়া ৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়টার ঝোঁপ-ঝাড় কাঁটা শুরু করলেন। আমার তো মাথা নষ্ট— এরা এই দিকে উঠতে বলবে নাতো!! দেখা গেল ব্যাপারটা তাই। আবুবকর, দলকে তাড়া দিলেন, ‘সবাই খুব তাড়াতাড়ি করেন। এরা আপনাদের জন্য থেমে থাকবে না।’ আল্লা’র নাম নিয়ে শুরু করলাম ওদের পিছু পিছু। থাকলাম, সবার পিছনে।
আর এই প্রথম সার্ভাইভাল গাইডটার কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, যদি তুমি তোমার হতাশাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পার, তাহলে তা তোমায় উৎরে দিবে, কর্মোদ্যম বাড়িয়ে দিবে। তর তর করে বেয়ে উঠতে লাগলাম ঐ চূড়ান্ত খাঁড়া ঢাল। আমার ডান হাতের কনুই ভাঙা, ভিতরে দুটো স্পাইক ভরা; কিন্তু উঠতে লাগলাম সুস্থ মানুষের মতো। ওদিকে পাহাড়ি দুজন পাখির মতো তরতরিয়ে ঝোঁপ সাফ করে করে উঠে যেতে লাগলেন। আবারো নাকিবকে সহায়তা করতে থাকলাম। উঠতে উঠতে খেয়ালই করলাম না, কখন উঠে গেলাম আমরা পাহাড়টার চূঁড়ায়। তাকিয়ে দেখি, রাসেলও পেরেছে।
এটা অবিশ্বাস্য! সত্যি অবিশ্বাস্য!! এই অসম্ভবকে কিভাবে সম্ভব করলাম আমরা!!! …ঠিক তখনই বুঝে গেলাম, কোনো ব্যাপারই না আমাদের এই ট্রেইলে যেকোনো, হ্যা, যেকোনো বাধা ডিঙানো, ইনশাল্লাহ।
আমি এদিকে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চিন্তা করছি, ওদিকে দল চলে গেছে অনেক সামনে। এই উঠার কোনো ছবি নেই, তোলার প্রশ্নই উঠে না, সত্যি। তবু এই অভিজ্ঞতা আমাদেরকে মনোবল যোগাবে আজীবন। এবার এগিয়ে চলা: দুই পাহাড়ি যেনবা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তাদেরকে অনুসরণ করছে আবুবকর আর বাকিরা। আমি, নাকিব আর রাসেল পিছিয়ে পড়লাম। রাসেলকে রেখে এগিয়ে যেতে পারছি না, আর ইচ্ছে করে যাচ্ছিও না। কারণ আবুবকর শিখিয়েছেন, যে সবার পিছনে থাকে, সে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
রাসেল তার ক্ষতিগ্রস্থ পা টেনে টেনে চলছে। পাথুরে ঝিরিতে গতি বাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব না। ওদিকে দলও চলে যাচ্ছে অনেক সামনে। সামনের বাঁক পেরিয়ে যাওয়ায় ওদের দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে ওরা ‘কুউউ’ বলে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, ওরা সামনে আছে, আমরা কি আসছি কিনা। প্রত্যুত্তরে আমিও চিৎকার করে জানান দিচ্ছি, আসছি, এগোও। আমি ঠিক করলাম, রাসেলকে সেনা কায়দায় একটু মোটিভেট করা যাক, পেছন থেকে তাড়া দিতে থাকলাম। বলতে থাকলাম, “মূভ, মূভ। …হ্যা হ্যা মূভ… পা চালাও।”
এভাবে চলতে থাকলাম আমরা। কিন্তু রাসেল বেশ বিরক্ত হলো, “আরে বাবা চলতে পারলে তো…”। সবই বুঝি, কিন্তু ওকে বসে পড়বার সুযোগ দিলে ও’ আর উঠতে পারবে না। চলতে থাকলেই ও চলতে পারবে শেষাবধি।
অনেক দূর পথ আমরা খুব অল্প সময়ে, বলতে গেলে প্রায় দৌঁড়েই চলে এলাম। নাকিবও বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে দলটা থামলো একটা দুমাথা ঝিরির সংযোগস্থলে। ঝিরিটা এখানে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে, একটা গেছে সোজা সামনে, আরেকটা গেছে ডান দিকে। দুই পাহাড়ি এখানে কেন থামালেন?
জানা গেল, তারা আমাদেরকে রুমানা পাড়ার একটা সম্ভাব্য (নিশ্চিত নয়) পথের সন্ধান দিচ্ছেন, আর সেটা এখান থেকেই শুরু। তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে দুটো ম্যাংগো বার খেতে দিয়ে বিদায় জানানো হলো। দলনেতা আবুবকর নির্দেশ দিলেন, সবাইকে পানি নিয়ে নিতে। কারণ এখান থেকে আমাদের পাহাড়ে উঠতে হবে, আমরা এবারে ঝিরি ছেড়ে দিব, আর পানির উৎস থাকবে না। আমরা পাথরের উপর বসে একটা বিস্কুটের প্যাকেট সাবাড় করে দিলাম।
খাবারের প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়, কামরুল আর আবুবকর তাদের নিজেদের জন্য বেশ কিছু খেজুর আর চকলেট এনেছিল। পাহাড়ে চড়ার এবং চলার জন্য খেজুর খুব উপাদেয় খাদ্য। তারা সেগুলো আমাদের সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল গত রাতে এনেঙ পাড়ায়ই। পথে হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায়ই সেগুলো থেকে কিছুটা দিয়ে নিজেদের মুখকে ব্যস্ত রেখেছি।
তবুও বিস্কুট খেয়ে তারপর পানি খেয়ে নিলাম সবাই। আমার বোতল খানিকটা সবসময়ই ভরা ছিল, তারপরও ভালো করে ভরে নিলাম। প্রশ্রাব করে পরিষ্কার হয়ে গেলাম সবাই।
সামনের দিকে একটা ঝিরি, ডান দিকে একটা ঝিরি আর ঠিক বাম দিকে একটা পাহাড়ে ওঠার পথ। এটাই হয়তো গেছে রুমানা পাড়ায়। আমাদের ওঠা শুরু। এটা হলো নিরবিচ্ছিন্ন পাহাড়ে ওঠা, এর মানে হলো আমরা অনবরত উঠতেই থাকবো অনেকক্ষণ ধরে। এটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
রাসেলকে সবার সামনে দেয়া হলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পিছিয়ে পড়তে শুরু করলো। সবাইকে এগিয়ে যেতে দিয়ে রাসেল রইলো পিছনের দিকে। এবারে ওর কষ্ট একটু বেশি হচ্ছে, কারণ ও ডান পা ভাঁজ করতে পারছিল না হাঁটুর ব্যাথার কারণে। আর সমতলে হাঁটার সময় পা বেশি ভাঁজ করতে হয় না, কিন্তু পাহাড়ে ওঠার সময় পা বেশ ভালোমত বাঁকা তো করতেই হয়, পায়ের উপর চাপ রেখে শরীরটাকে তোলার সময় শরীরের ওজনটা গিয়ে পড়ে ঐ হাঁটুতেই। রাসেলের রীতিমতো কষ্ট হতে লাগলো।
কামরুল আগে থেকেই রাসেলকে সঙ্গ দিচ্ছে যখন দরকার, এবারে সে থেকে গেল রাসেলের পিছনে। আমি থাকলাম ওর সাথে। ভ্রমণের শুরুতে কামরুলকে “আছেন”-জাতীয় আপনি সম্বোধন করলেও এখন বেশ “তুমি..তুমি” এমনকি “তুই…তুইও” করছি সবাই। এবং এই প্রথম কামরুল জানলো যে, রাসেলের শুধু বাম পায়ের পাতায় নয়, ডান পায়ের হাঁটুতেও ব্যাথা পেয়েছে।
যাহোক, পাহাড়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা না। বন্ধু সাকিব বলে দিয়েছিল, পাহাড়ে ওঠার সময় এক বোতল পানিও মনে হয় অনেক বড় বোঝা। তার কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য মনে হচ্ছে। একটুখানি উঠলেই শরীরে ক্লান্তি ধরতে চায়। বিশেষ করে হাঁটুতে চাপ পড়ে খুব বেশি। দুদিন ধরে হাঁটার পর পরিশ্রান্ত পায়ের হাঁটু নিশ্চয়ই এই ধকল সওয়ার জন্য প্রস্তুত না। আবার অন্য বিচারে কিছুটা হলেও প্রস্তুত, পরিশ্রম করতে করতে বেশ ধাতস্থ হয়ে গেছে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু তবু কষ্ট হতে থাকে। তারপরও আমি যথেষ্ট দ্রুত উঠতে পারতাম (কামরুল বলছিলও), কিন্তু রাসেল, আর, তাকে সাপোর্ট দেয়া কামরুলকে ফেলে রেখে উঠতে ঠিক মন চাইলো না।
রাসেল পাঁচ-সাত পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিশ্রাম নিয়ে আবার উঠছে। কোথাও কোথাও তার পাছায় ঠ্যালা দিয়ে তাকে সহায়তা করার দরকার পড়ছে। পানি চাইলো রাসেল, আমি বোতলটা বের করে দিয়ে বললাম, অল্প খেতে। কারণ দুটো: (১) পানি আমারও লাগবে, এবং পাহাড় থেকে না নামা পর্যন্ত পানি চাইলেও পাবো না; (২) সার্ভাইভাল গাইডে পড়েছি, একসাথে বেশি পানি নয়, অল্প অল্প কিন্তু নিয়মিত পানি পান করতে হয়। কিন্তু আমার কারণদুটো আমার মনেই থাকলো, ও বেচারা আমার পুরো বোতলটাই সাবাড় করে দিলো। কিছুটা মেজাজ খারাপও হলো, কিন্তু অসুস্থ মানুষকে দিয়ে পানি বহন করানোটাও ঠিক সমর্থন করলো না মন।
এভাবে ধীরে ধীরে উঠছি আমরা। উপরে উঠতে উঠতে আমরা অনেক উপরে উঠে গিয়েও দেখি পথ আর ফুরাবার নয়। উঠছি তো উঠছিই। উপরে উঠেও ওদের দেখা পাচ্ছি না, অনেক আগে চলে গেছে ওরা। কামরুল আমাকে ইঙ্গিতে বললো, আবুবকরের এই উদাসীনতা ওর ভাল্লাগছে না। এটা ঠিক না। বেচারার হেল্পওতো লাগতে পারে। আবুবকরের সেনা-অধ্যায়ের ‘রাসেল’ অংশটায় কামরুল মতদ্বৈততায় ভুগছে।
উপরে উঠতে উঠতে একসময় পিছন ফিরে তাকালাম। বিকেল সাড়ে চারটার পড়ন্ত রোদে পিছনের পাহাড়টা কিংবা অপূর্ব পাহাড়ের সারি দেখার মতোই। কিন্তু আমার কাছে আইফোনটা ছাড়া কোনো ক্যামেরা নেই, কামরুলও ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার অবস্থায় নেই। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ফোনেই তুললাম ছবি।
একটা প্রশ্ন সব সময় আমাকে কুঁড়ে খেত যে, মানুষ এতো বোকা কেন, চলার পথে সামনে কোনো পাহাড় পড়লে মানুষ সেটা ডিঙাতে যায় কোন দুঃখে, মানুষ চাইলেই আরো কম কষ্টে পাহাড়টাকে মাঝখানে রেখে পাশ কাটিয়ে ওপাশে চলে যেতে পারে। কিন্তু এবার আমার ভুল ভাঙলো, কারণ যেখানে এরকম পাহাড় আছে, সেটা আসলে পাহাড় নয়, পাহাড়শ্রেণী। পাশাপাশি একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অনেকগুলো পাহাড়। তাই যদি আপনি পাহাড় না ডিঙিয়ে পাশ কাটাতে যান, তাহলে সেটা শ্রেফ পন্ডশ্রম হবে, কারণ মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এরকম পাহাড়শ্রেণীর ওমাথায় গিয়ে পাশ কাটিয়ে ওপারে যাওয়া আর মঙ্গল গ্রহে যাওয়া এক কথা।
আমাদের পথ উপরে উঠছেই, উঠছেই। আমি শঙ্কিত হলাম, কারণ ঐ পাহাড়ি দুজন আমাদেরকে নিশ্চিত করতে পারেননি এটাই রুমানা পাড়ার পথ কিনা। যদি এত্তো এত্তো কষ্ট করার পর সাব্যস্ত হয় যে, আমরা ভুল পথ ধরেছি, তাহলে সেটা শুধু বিপদজনকই হবে না, খুব বেশি হতাশাজনকও হবে। সার্ভাইভাল পরিস্থিতিতে হতাশা, অন্যান্য ফিযিক্যাল বিপদ থেকে অনেক বেশি বিপদজনক।
উপর থেকে কেউ আমাদেরকে ডাক দিল, আমরাও ডাক দিয়ে জানান দিলাম, আসছি। তবে একটাই স্বস্তি যে, পথটা অবশ্যই জংলি না, এটা মানুষের তৈরি পরিষ্কার পথ— মানুষের হাঁটা পথ। রাসেলকে বেশ কষ্ট করে উঠতে হচ্ছে, আর কামরুল সহায়তা করেই যাচ্ছে, আমিও কখনও করছি। তবে বেচারার কষ্টটা সত্যিই হচ্ছে।
আমার ঘাঢ়ের ব্যথাটা কষ্ট দিচ্ছে। কামরুলকে বলতেই ও আমার ব্যাগটার দিকে তাকালো। শিওর ব্যাগটা ঠিকমতো শরীরে ঝোলাইনি আমি। সে আমাকে শিখিয়ে দিল, কিভাবে ফিতা ধরে টেনে ওটাকে আরো আঁটোসাটো করে শরীরের সাথে আঁকড়ে নেয়া যায়। ওর কথামতো যখন করলাম, সত্যিই ব্যাগটা আরো হালকা হয়ে গেল। এবং দুপাশের ফিতা সমান হওয়ায় ব্যাগের ওজনটা দুকাঁধে সমানভাগে ভাগ হয়ে গেল। ধন্যবাদ দিলাম কামরুলকে। ব্যাগটা সত্যিই হালকা লাগছে।
কামরুলের সাথে কথা হচ্ছে আমার। সে তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছে। সে বললো, ত্রিপুরা পাড়া যেটা কাল দেখেছিস, ওরা বেশি উঁচুতে থাকে না। কিন্তু বমরা (চরম বাজে গালি) থাকে সেই রকম উঁচুতে। “সেই রকম” বলতে যে সে চরম উঁচু পাহাড়ের ইঙ্গিত করছে, তা আমরা বুঝে গেছি, আর ঐ বাজে গালিটা এটাও বুঝিয়ে দিল যে, এধরণের উচ্চতার পাড়া বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তার মোটেই আনন্দদায়ক ছিল না, আর এটাও বোঝালো, বমদের পাড়ার উচ্চতা হয় মাত্রাতিরিক্ত।
দীর্ঘক্ষণ চড়াই পেরিয়ে অবশেষে আমরা তুলনামূলক সমতল একটা কাঁশঘেরা পথে উঠে এলাম। পথটা দারুণ! পথের ধকলসত্ত্বেয় এই রূপ উপভোগ করতে বিশেষ প্রেষণার দরকার পড়লো না। পথটা এগিয়ে গিয়ে একসময় ডানদিক ধরলো। সেপথে কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে নাকিবকে দেখা গেল, নিচু হয়ে বসে, ওপাশের পাহাড় থেকে আমাদের পথ বাৎলে দিচ্ছে, ডান দিকে আয় তোরা।
আবুবকর, এবারে কামরুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, তোমার অন্তত আরো দ্রুত হওয়া দরকার। কামরুল তখন চিৎকার করে জানালো, আরে মিয়া রাসেলের ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যথা লেগেছে, পা বাঁকা করতে পারছে না। সংবাদটা আবুবকর এই প্রথম শুনলেন, এবং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যতটা সবেগে কামরুলের উপর চটেছিলেন, ততটাই হঠাৎ চুপ করে গেলেন ঘটনার প্রগাঢ়তায়।
নাকিবের দেখানো পথে এগিয়ে গিয়ে দেখি, নদী নেই, খাল নেই, একটা সাঁকো। এটা আবার কী! ঠিক এখানটায় পাহাড়টা খাড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে, একটা গভীর খাদ। এই খাদের কারণেই আমার নাকিবকে মনে হয়েছিল আরেকটা পাহাড়ে, আসলে পাহাড় একটাই। সাঁকো পেরিয়ে রাসেল, কামরুল ওপারে গেলে আমিও পার হলাম। সাঁকো পেরোনোর অভ্যাস আমার আছে, সিলেটের মানুষেরা এক বাঁশের সাঁকো পেরোয় হরহামেশা, আর এখানে আছে তিন বাঁশের সাঁকো, তাই মোটেও কষ্ট হলো না।
ওপাশে গিয়ে আরো অনেকক্ষণ হাঁটা লাগলো, একসময় চোখে পড়লো একটা এপিটাফ বা কবর-ফলক, ক্রুশ আঁকা। স্বস্তি পেলাম, যাক অবশেষে আমরা অবশ্যই একটা পাড়ার কাছে আছি। পথটা উপরে উঠে গেল, আমরাও পথের সঙ্গী হলাম। এখানে ডানে চোখে পড়লো য়্যাব্বড় একাঙ্গি গাছ। অনেক নিচের খাঁদ থেকে উঠে এসেছে গাছগুলো, আর উঠে গেছে যেনবা আকাশ ফুড়ে।
ডানে-বামে, রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু কবর-ফলক, একটা বেড়া দেয়া কবর পার হয়ে শেষ ঢালটা উঠতে গিয়েই সামনে চোখে পড়লো টিনের চাল, টিনের বেড়ার ঘর। আশ্চর্য হলাম দুটো কারণে: (এক) এরকম উচ্চতা আর গহীনে একটা আধুনিক পাড়া কেমন করে! (দুই) পাহাড়িরা টিন দিয়ে ঘর বানায় নাকি!
বামপাশে একটা জবা-ফুলের-গাছ রেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি এই অতি-উচ্চতায় পাহাড়ি-সমতলে এক অপূর্ব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন পাড়া। পাড়ার পরিচ্ছন্ন রূপটা দেখে আমি সরাসরি কামরুলের দিকে তাকালাম, ও ব্যাটা ঠিকই বলেছে। বমরা আসলেই একেকটা (কামরুলের চরম গালি)— নাহলে এতো উঁচুতে পাড়া বানায় নাকি মানুষে? যে টিনের ঘরটি ঢাল থেকে দেখা যাচ্ছিল, ওটা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টা সামনে রেখে যখন বামে তাকালাম, আমি এই পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের দিগন্তে যেন হারিয়ে গেলাম। কী অপূর্ব এই দৃশ্য! কী অপূর্ব!!
পড়ন্ত সূর্যের তেরছা আলো পড়া পাহাড়শ্রেণীর প্রত্যেকটা ভাঁজ যেন নতুন করে ডাকছে আমাকে। যদিও পাহাড়গুলোতে অত গাছ নেই, শুধু ঘাসের চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে ওগুলো নিথর, কিন্তু এই রূপ ভুলবার নয়, উপরের হু হু বাতাস আমাকে যেনবা তৃতীয়বারের মতো আরেক স্বর্গে নিয়ে গেল। কী দৃষ্টিনন্দন! কী মহোময়!!
এগিয়ে গেলাম আমরা তিনজন। দেখি পাড়ার সব ছেলেপিলেরা আমাদেরকে উৎসুক হয়ে দেখছে। আবুবকর ইতোমধ্যেই তাঁর বোঝা নামিয়ে রেখেছেন কোথাও। আমরা কাছে যেতে দেখি কথা বলছেন স্থানীয় এক কিশোরের সাথে। কিশোরের চেহারা সুন্দর, মাথায় ব্রুসলি-কাটিং চুল, পরনে শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। পাহাড়িদের চুলগুলো এতোটাই সিল্কি আর ল্যাপটানো যে, এদের বোধহয় স্টাইলের মধ্যে এই ব্রুসলি কাটিং চুলই আসে।
আবুবকরকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হলাম: এটা রুমানা পাড়া। জানে পানি এলো শুনে, আবারো আমরা সঠিক পথেই আছি। আবুবকর জানালেন, আমরা আজকে রাতে এখানকার কারবারির ঘরে উঠবো। আপনারা আপনাদের ব্যাগগুলো ওঘরে রেখে আসুন। ঐ যে ঐ ঢালে নেমে সামনেই যে ঘরটা দেখবেন, ওখানে রেখে আসেন।
বেলা তখন প্রায় সোয়া পাঁচটা। এত্তো উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে যখন আমাদের সবারই শরীর প্রচন্ড ক্লান্তিতে বিশ্রাম চাচ্ছিল, এবং বিশ্রামের জন্য একটা পাড়া আর একটা সুন্দর ঘর পেয়ে সেই ক্লান্তি যখন জেঁকে ধরতে চাচ্ছিল, তখনই আবুবকর বোমা ফাটালেন:
এখানকার লোকজন বলছেন, কাছেই দুইটা ঝরণা আছে। আমরা এখন সেই ঝরণা দুইটা দেখতে যাচ্ছি, কে কে যাবেন?
এ ব্যাটা বলে কী? মাথা খারাপ নাকি? পাগল হলো নাকি? এত ক্লান্ত শরীরে এখন আমাদেরকে নিয়ে যাবে ঝরণা দেখাতে? রাসেলের তো যাবার প্রশ্নই উঠে না। নাকিবও সাফ ‘না’ জানিয়ে দিল। কিন্তু আমার কেন জানি না জেদ চাপলো, আরে রাখ্ শরীর। না গেলে তো মিস করবো এই ঝরণা। তাছাড়া সঙ্গে কামরুল আর আবুবকরের মতো ট্রেকার থাকতে পিছানোর কোনো মানেই হয় না। …আমি রাজি হয়ে গেলাম।
(চলবে…)
– মঈনুল ইসলাম