ধারাবাহিক: অফ-ট্র্যাক বান্দরবান —এর একটি পর্ব
শেষ পর্যন্ত সমাধান বেরুলো:
আমরা তিনজন: উদ্দেশ্য বগালেক, কিওক্রাডাং (গাইড: সিয়াম)
ওরা দুজন: উদ্দেশ্য বগামুখ পাড়া, তারপর নিজস্ব পরিকল্পিত পথ (গাইড: একজন)
রাতের খাবার শেষ হলে আবু বকর ঢাকায় ভ্রমণ বাংলাদেশ-এর বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে স্থানীয় গাইডকে খবর দিলেন। সে ব্যস্ত থাকায় পাঠালো পরিচিত গাইড সুমন দত্তকে। আবু বকর আর কামরুলের পথের বর্ণনা শুনে জানালো, তার সময় হবে না, তবে তার বড় ভাইকে ব্যবস্থা করে দিতে পারে। বড় ভাইকে খবর দিয়ে মামুনের রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো সুমন। সুমনের বড় ভাইকে যখন নিজেদের গন্তব্যপথের বর্ণনা দিলেন আবু বকর, তখন হঠাৎ পাশ থেকে কথা বলে উঠলো এক কিশোর, সে নাকি ওপথে আগে একবার গিয়েছিল। তারপর শুরু করলো দুর্ধর্ষ বর্ণনা। সেখানে নাকি বড় বড় ঝর্ণা, পানির তীব্র স্রোত, বানরের ডাকাডাকি; সেখানে ও’ গিয়েছিল মাছ ধরতে, রাতে সেখানে থেকেছে তারা, গা ছমছমে পরিবেশ; ঝিরির পানির তোড়ে তার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত ছিল। তার বর্ণনা শুনে আবু বকর তাকেই গাইড নিতে চাইলে সে ঐ ভয়ংকর জায়গায় যেতে রাজি হলো না। তাই আবার সুমনের বড় ভাইয়ের দিকে মুখ ফেরালের আবু বকর। সে ৪০০০ টাকা চাইলো। আবু বকর শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে তাকে ৳৩৫০০ বলে রাজি করালেন। ওমনি ঐ কিশোরও লাফিয়ে উঠলো, সেও যাবে, তবে তাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া লাগবে না, ফ্রি-তেই যাবে। (আসলে সে এই সুযোগে পথটা ভালো করে চিনে আসবে, আর পরবর্তি অভিযানকারীদের থেকে পয়সা কামাবে —বুদ্ধিমান ছেলে!)
কথা পাকাপাকি করে আমরা রুমে ফিরলাম। ওদিকে আমাদের তিনজনেরও বেশ লোভ লাগতে থাকলো বর্ণনা শুনে। জীবনে এমন সুযোগ আর আসবে কখন? একবারই এসেছে হাতের কাছে, কিভাবে সেটা হাতছাড়া হতে দিইইবা? ভাবতে ভাবতে একসময় নাকিব আর আমি চোখাচোখি হলাম। চোখে-চোখেই কী যেন পরামর্শ করে ফেললাম দুজনে।
রুমে ফিরে আলোচনা চলতে থাকলো আমাদের। ঐ দুজনের আমাদেরকে সাথে নিতে আপত্তি নেই। আমাদের একমাত্র সমস্যা হলো অফিস। অফিস থেকে মাত্র দুদিন ছুটি নিয়েছি। এখন যদি আবার অফিসে ফোন করে ছুটি বাড়ানোর কথা বলি, অফিস কিছুতেই রাজি হবে না। তাই যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। ঠিক করলাম গা ঢাকা দিব। অফিসকে কিছুই না জানিয়ে হারিয়ে যাব জঙ্গলে, ফিরে এসে জঙ্গলের দোহাই দিব, পথ হারিয়ে ঘুরে মরেছি, আর ফোন করিনি, কারণ নেটওয়ার্ক থাকেনা গহীন জঙ্গলে। বাসায় ফোন করে বলে দিলাম, বাস দেরি করায় আমাদের শিডিউলে বড় ধরণের পরিবর্তন হয়েছে, তো আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ফিরবো ইনশাল্লাহ। এর মধ্যে যোগাযোগ সম্ভব হবে না, কারণ নেটওয়ার্ক থাকবে না।
ব্যস, সব ঠিকঠাক। আমরা প্ল্যান করেছিলাম ২টা, প্ল্যান ‘এ’ আর প্ল্যান ‘বি’। এখন আমরা প্ল্যান ‘সি’ অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছি। রাতেই হিসাব করতে হলো, আমাদের কাছে কী কী আছে:
আবুবকর ও কামরুল: দুজনের একটা ডোম টেন্ট (গম্বুজ তাবু); দুজনের একটা বেডিং; গরম থাকার পোষাক; প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার; কামরুলের এসএলআর ক্যামেরা; দুজনের ব্যাকপ্যাক (Knapsack); পায়ে ট্রেকিং-উপযোগী জুতা; জনপ্রতি টর্চলাইট ইত্যাদি। (ওরা দুজনে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে ঔষধ খেয়ে এসেছে)
আমি, নাকিব, রাসেল: আমার বিছানার চাদর, নাকিবের গায়ে দেয়ার চাদর, অল্প-শীত নিবারক কাপড় (আমার আর নাকিবের); আমার ব্যাকপ্যাক, নাকিবের সাধারণ পিঠে-ঝোলানো-ব্যাগ, রাসেলের রশি-ব্যাগ; আমার মশা নিবারক ওডোমস ক্রিম; জনপ্রতি টর্চলাইট; নাকিবের 12x অপটিক্যাল যুম ক্যামেরা, রাসেলের এসএলআর ক্যামেরা, ট্রাইপড ইত্যাদি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা ওদের ছিল, তা হলো পাহাড়ে-জঙ্গলে চলার, পাহাড় বেয়ে উঠা-নামার, থাকার অভিজ্ঞতা, যা আমাদের কারোরই ছিল না (শুধু স্বপ্নটা ছিল)।
যেহেতু আমাদেরও ঐ শীতের রাতে থাকতে হবে, তাই আমাদের থাকার জন্য বড় একটা পলিথিন শীট কিনে নেয়া হলো। সম্মিলিত অর্থে কিনে নেয়া হলো পেঁয়াজ, ম্যাগি নুডল্স, ম্যাংগোবার, চকলেট, গজ-ব্যান্ডেজ ইত্যাদি। কামরুল জানালো আমরা যে রাবারের জুতা নিয়ে গেছি, ওটা বিপদ ডাকতে পারে। তাই রুমা বাজার থেকে তিনজন তিনজোড়া রাবারের জুতা কিনে নিলাম প্রতি জোড়া ৳১১০ [টাকা] দিয়ে। যাবার আগে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাতীত একটাও জিনিস যাতে না যায়, সেজন্য রাতেই আমরা সব প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে বাকি জিনিসগুলো আলাদা করে ফেললাম। ওগুলো রাসেলের একটা অফিস ব্যাগে পুরে রাখলাম, ওটা মামুনের রেস্টুরেন্টে রেখে যাওয়া হবে।
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো খুব জরুরি, তবু আমাদের বারোটার মতো বেজে গেলো। নাকিব, বুঝলাম খুব উত্তেজিত। একটু পরপর নানান সম্ভাবনার কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। একসময় মশারির নিচে, হোটেল রুমের খাটে তিনজন ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাত!
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২; ভোর ৫:০০টা
ঘুম ভাঙলো মোবাইলের অ্যালার্ম শুনে। সময় হলো স্বর্ণসম। আবুবকর আর কামরুলও উঠে পড়েছে। আমরা ফযরের নামাযে যেতে চাইলাম, কিন্তু হোটেলের গেট বন্ধ। নিজেদের টয়লেটকর্ম শেষ করে ফযর, হোটেল রুমেই সারলাম। ৬টার সময় গাইড আসার কথা।
কিন্তু দেখা গেল, ছয়টা পেরিয়ে গেলেও তাদের খবর নেই। ফোন নাম্বারও রাখা হয়নি। ওদিকে আমাদের গাইড সিয়ামকে ম্যানেজ করার একটা উপায় বের করেছেন আবুবকর। শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করলাম, আমরাই বেরিয়ে যাই মামুনের হোটেলে, সেখানে নাস্তা করার পাশাপাশি আমরা খুঁজে নিব ওদেরকে।
আগের দিন স্থানীয় এক পরিচিত জনের থেকে “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর পরিচিতি কাজে লাগিয়ে আবুবকর আরেকটা ফর্ম বিনামূল্যে জোগাড় করে ফেলেছিলেন। ওটা পূরণ করে ফেলা হলো আমাদের পাঁচ জনের নামে। মামুনের হোটেলে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে আমরা গাইডের খবর নিতে গেলাম। সিয়াম ইতোমধ্যে চলে এসেছে, তাকে আবুবকর ম্যানেজ করেছে। আবুবকর নিজের টাকায় হোক, ভ্রমণ বাংলাদেশের টাকায় হোক, খাবার চাল কিনে দেবার কথা বলে ক্ষান্ত করেছে তাকে। ওদিকে গাইড বিকাশ দত্তের (সুমনের বড় ভাই, আমাদের মূল গাইড) দোকানে গিয়ে দেখি সে আর আপেল মল্লিক (অত্যুৎসাহী কিশোর) মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। যাহোক ওদেরকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বলে আমরা রেস্টুরেন্টে ফিরে নাস্তা দিতে বললাম।
সকালের নাস্তা বলতে আছে ভাত, আলুভর্তা, ডাল। আমাদের কারোই তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু নাকিবকে দেখলাম সে পরোটা খাবে। সে চলে গেল অন্য আরেকটা রেস্টুরেন্টে। আমি নাকিবকে নিয়ে একটু সন্দিঘ্ন হলাম। জঙ্গলে যা পাওয়া যাবে, তা খেতে হবে; সেখানে তার যেভাবে পছন্দ গড়ে উঠছে, সেটা ঠিক জঙ্গলোপযোগী না —প্যাকেজ ট্যুর হলে ঠিক আছে। ওর আবার টয়লেট সংক্রান্ত সুঁচিবাই আছে, ভালো টয়লেট না হলে পায়খানা-প্রশ্রাবে ঝামেলা হয়। ওদিকে মাকড়সাকেও ওর তীব্র ভয়। একটু চিন্তিতই হলাম।
যাহোক, অবশেষে ৮টার দিকে আমরা রওয়ানা করলাম। রাসেলের ট্রাইপড বহন করলেন আবুবকর, তাঁর ব্যাগের সাথে বেঁধে নিয়ে। তিনি অতিরিক্ত ওজন বহন করতে রাজি হলেন, কারণ শিঘ্রই তাঁকে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট (HMI)-এ ট্রেনিংয়ে যেতে হবে, আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে চাচ্ছেন। আমাদের পূরণ করা ফর্মটা নিয়ে গাইড, আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে অনুমতি নিয়ে এসেছে। যাত্রা শুরুর মুহূর্তে বাজারের কামারের থেকে একটা নতুন দা শান দিয়ে নিয়ে নিল বিকাশ, সম্ভবত ভাড়ায়।
আমাদের যাত্রা শুরু হবে বগামুখ পাড়ার দিকে, ঠিক যে পথে বগা লেকে যায় অভিযাত্রীরা। পথে পুলিশ ক্যাম্পে রাখা খাতায় আমাদের নাম-পরিচয় লিখতে হলো আবার। ততক্ষণে গাইড বিকাশ একটা গাছের ডাল আর রাবার-ইলাস্টিক দিয়ে গুলতি বানিয়ে নিলো। আমাদের হাঁটা শুরু হলো পাকা রাস্তা দিয়ে।
এখানে একটু আমাদের পোষাক-আশাক সম্পর্কে বলা দরকার: আমাদের পরনে টিশার্ট, প্যান্ট (কেউ ফুল ট্রাউযার, কেউ থ্রি-কোয়ার্টার ঝোলা প্যান্ট), রাসেল পরেছে হাফ প্যান্ট। কামরুল আর আবুবকরের পরামর্শে আমরা সবাইই কিনে নিয়েছি ‘অ্যাংকলেট’ আর ‘নী-ক্যাপ’। এগুলো সাধারণত ফুটবল খেলোয়াড়রা পরে থাকেন, যা রাবারের আঁটোসাঁটো বন্ধনীবিশেষ। নী-ক্যাপ পায়ের পাতা দিয়ে পাজামার মতো পরে হাঁটুতে তুলে নিতে হয়, আর অ্যাংকলেট পায়ের পাতাসহ গোড়ালিতে পরতে হয়। এগুলো কেন পরতে হয়, তা আপনারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন। আর অবশ্যই আমাদের তিনজনের পায়ে রুমা থেকে কেনা ১১০টাকা দামের জুতা। যেগুলোর উপর আমার আর নাকিবের মোটেই ভরসা নেই। প্রত্যেকের সাথে রয়েছে গামছা। গামছা কেন, তাও আপনারা সময়ে সময়ে এর বহুধা ব্যবহার থেকে জানতে পারবেন।
‘থানা পাড়া’র ভিতর দিয়ে আমাদের পথটা চলে গেছে। থানা পাড়া একটা ত্রিপুরা পাড়া, মানে ত্রিপুরা উপজাতির বাস এ পাড়ায়। সমতলে যেমন আমরা ‘গ্রাম’ বলি, সেগুলো হলো ‘পাড়া’। ইট সো’লিং করা উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছি। রাস্তাটা এগিয়ে গিয়ে রুমা খালের উপর দিয়ে ব্রিজ ধরে বগা লেকের দিকে গেছে। আমরা সে ব্রিজটা না ধরে পাশ দিয়ে খালে নেমে গেলাম।
প্রকৃত যাত্রা আমাদের এখান থেকে শুরু হলো।
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম