কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে - পাহাড়ের উল্টো পিঠে - নিশাচর

কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে – পাহাড়ের উল্টো পিঠে : পর্ব ৩

পাইন্দু খাল ট্রেক করতে গিয়ে পাহাড়ি ঢল এড়াতে জঙ্গলের সাথে যেভাবে যুদ্ধ করতে হলো, তারপর পথহারা আমরা পথের দিশা পেয়ে এগিয়ে গেলাম একটা পাড়ার দিকে। কোমর পানির স্রোত পেরিয়ে আমরা যখন পাড়ায় পৌঁছলাম, তখন সেই পাড়াবাসীদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমরা: কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাবো? আমরা এখানে কেন এসেছি? ওদের পাড়ায়ইবা কেন এসেছি? আবু বকরের মতোই আমারও ভ্রু কুঞ্চিত হলো, বুঝতে বাকি রইলো না, আমরা এই পাড়ায় অযাচিত!

কিন্তু আবু বকর তাঁর মিশনারী হাসিখানা উপহার দিয়ে যখন কথা বললেন, তখন প্রশ্নকারীরাও হাসলো। প্রশ্নের আশানুরূপ উত্তর হয়তো তারা পেলো না (কী আশা করছিলো, কে জানে?), আপাতত প্রশ্ন থেকে ক্ষান্ত দিলো, কিন্তু পরক্ষণে প্রশ্নবোধক চেহারায় পাশের জনের সাথে কথা বললো তাদের ভাষায়। আমি আর আবু বকর দ্রুত পাহাড়ের উপরে চলে এলাম। আবু বকর, মোহন আর তানভিরের প্রতি নাখোশ প্রকাশ করলেন। বোট ততক্ষণে ঘাটে এসে লেগেছে, আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। এখন, গাইড ছাড়া আমাদের আসার খবরটা রুমা বাজার অবধি পৌঁছে যাবে।

আবু বকর না থেমে, সামনে এগিয়ে গেলেন। রাস্তাটা একটু নেমে আবার উপরের দিকে উঠে গেছে। সামনেই পাড়াটা। একটু উপরের দিকে উঠে গিয়ে প্রথম বামদিকের ঘরটাতে উঁকি দিলেন আবু বকর। কথা বললেন ঘরের নারীর সাথে, বুঝলেন এটা হেডম্যানের ঘর। জিজ্ঞেস করলেন, “হেডম্যান ঘ-রে আছেন?” হেডম্যান কথা বললেন এবারে। আবু বকর তাঁকে জানালেন আমাদের কথা। জিজ্ঞেস করলেন আমরা থাকতে পারবো কিনা? উত্তরে না-সূচক মাথা নাড়লেন তিনি।

আবু বকর চরম আশ্চর্য হলেন। এই প্রথম কোনো পাড়ায় আমরা এতো প্রতিকূলতা দেখছি। এতক্ষণ যেন সবাই আমাদেরকে বলতে গেলে তাড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। আর এখন স্বয়ং হেডম্যান আমাদেরকে না করে দিচ্ছেন! 😮

তাই আবু বকর আবারো জানতে চাইলেন, “থাকতে পারবো না?” 😮

হেডম্যান এবারে ইশারায় আর অল্প দু-এক শব্দে যা জানালেন, “তাঁর ঘরে থাকা যাবে না। কিন্তু সামনে কারবারি আছেন, তাঁর সাথে কথা বলে দেখতে হবে।” বলে পাড়ার উপরের দিকে হাত ইশারায় দেখালেন তিনি। আমরা একটু আশ্বস্থ হয়ে এবারে পাড়ার উপরের দিকে উঠে যেতে থাকলাম। একটু উঠে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, পাড়ার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা সিঁড়ি! পাহাড়ে পাকা সিঁড়ি অমাবশ্যার চাঁদের চেয়েও দুর্লভ আর অনভিপ্রেত। যাহোক, কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে একটা দোকান দেখা গেলে সেখানেই থামলেন আবু বকর।

“নমষ্কার, কে-মন আ-ছেন? একটা বিস্কুট হবে তো?” আবু বকর, দোকানে ঢুকেই দোকানীর কাছে একটা বিস্কুট চাইলেন। বিস্কুট নিয়ে তা খুলে তিনি টেবিলে রাখলেন। আমার বিস্কুট খাবার ইচ্ছা নেই, পানির তৃষ্ণা পেয়েছে বড্ড, তাই জগ থেকে পানি ঢেলে খেলাম প্রাণ ভরে। এদিকে আবু বকর বিস্কুট খেতে শুরু করেছেন, দুয়েক টুকরা দোকানীকে, আর দোকানে বসা এক লোককে দিলেন। পাশাপাশি কথাও চালিয়ে গেলেন। ঐ দোকানেই পাওয়া গেল কারবারিকে। কারবারির সাথে কথা বললেন আবু বকর, আমরা আজকে তাঁর পাড়ায় থাকার ইচ্ছাপোষণ করেছি, থাকা যাবে কিনা? এবারে বরফ গললো, থাকার পক্ষে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লেন কারবারি।

তারপর জানা গেল, এই দোকানের পিছনেই কিংবা বলা যায়, পিছনে, উপরেই যে ঘরটা, তা-ই কারবারির। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হবে আজকে। যাক, জানে পানি পেলাম। ততক্ষণে মোহন আর তানভিরও চলে এসেছে। বাইরে বৃষ্টির পরিমাণও সামান্য বেড়েছে। এই পাড়ার নাম: পাইন্দু হেডম্যান পাড়া।

পাইন্দু হেডম্যান পাড়া, বান্দরবানের রুমা উপজেলার একটি পাড়ার নাম। পাড়াটি পাইন্দু খালের মুখ থেকে খুব কাছাকাছিই অবস্থিত। ‘পাইন্দু’ হেডম্যানের নাম থেকেই পাড়ার নামকরণ। আর তাঁর থেকেই পাইন্দু খালেরও নাম এসেছে। ভৌগোলিক স্থানাংক গুগল আর্থ অনুসারে 22° 4’34.08″N, 92°22’2.61″E, রুমা বাজার থেকে মোটামুটি ৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। পাড়াটি একটি মারমা পাড়া। পাড়ায় কারবারিও আছেন, আছেন হেডম্যানও। পাড়ার লোকজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাড়ায় আছে একটি খিয়াং (বৌদ্ধ উপাসনালয়), আর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

পাইন্দু হেডম্যান পাড়ার কারবারির ঘর - নিশাচর
পাইন্দু হেডম্যান পাড়ার কারবারির ঘর – নিশাচর

আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে, পাশেই লাগোয়া একটা ঘরের বারান্দায় ঠেক দেয়া গাছের গুড়ির গায়ে খাঁজ কেটে তৈরি করা সিঁড়িতে পা দিয়ে উঠে গেলাম বাঁশের তৈরি উন্মুক্ত বারান্দায়। মারমা ভাষায় এগুলোকে তামিয়াং বলে। এই উন্মুক্ত বারান্দা থেকে এবারে আবদ্ধ এক বারান্দায় ঢুকলাম আমরা, একজন বয়স্ক নারী ধান গুছিয়ে রাখছেন সেখানে। এই বারান্দার একটা দরজা দিয়ে বাঁশের তৈরি ঘরে ঢুকলাম আমরা।

ঘরটা অন্ধকার, তাই সৌরবিদ্যুৎচালিত বাতি দিয়ে আলোকিত করা হলো। ঘরের আসবাব বলতে যা চোখে পড়ছে, তা একটা শোকেস, তাতে কাচের, প্লাস্টিকের আর অ্যালুমিনিয়ামের বাসন-কোসন রাখা। পাশে একটা বস্তা রাখা। আর সৌরবিদ্যুতের একটা বড় ব্যাটারি রাখা। ব্যাটারির উপরের দিকে বুদ্ধের ছবি লাগিয়ে মালা-টালা দিয়ে একটা ঘরোয়া উপাসনাগার তৈরি করা হয়েছে। এখানেই মেঝেতে শুতে হবে আমাদেরকে।

আবু বকর তাঁর ব্যাগ থেকে ক্যাম্পিং ম্যাট বের করে মেঝেতে বিছালেন। মোহন ওর স্লিপিং ব্যাগটা খুলে বিছালো। সবাই নিজেদের ভেজা কাপড়গুলো খুলে ব্যাগ থেকে শুকনো কাপড়গুলো বের করে পাল্টে নিতে থাকলাম। তখনই আবিষ্কার করলাম, মানচিত্র শরীরের প্রথম স্তরে রাখার যে শিক্ষা অজানা লেকের অভিযানে পেয়েছিলাম, তা রক্ষা করতে গিয়ে এবার প্যান্টের পকেটে রেখেছিলাম ম্যাপ, পানিতে নামার সময় মনে ছিল না, সব ভিজে গুবলেট হয়ে গেছে।

অজানা লেকের অভিযানে বান্দরবান ২০১৩ : প্রথমাধ্যায় : পর্ব ৫

…তো, যে শিক্ষা সেবার হয়েছিল, এবার সেটা আরেকটু পোক্ত হলো: শরীরের প্রথম স্তরে রাখা প্রতিটা জিনিসই জলরোধী করা উচিত। কারণ, বৃষ্টিতে ভিজা, কাদায় পিছলে পড়া ছাড়াও শরীরের ঘামেও প্রয়োজনীয় জিনিস নষ্ট হতে পারে। তাই পলিথিন বা জল নিরোধক কোনো কিছু দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিরাপদ করা সব সময়ই উচিত।

আবু বকর জানতে চাইলেন, খাবার কী আছে? জানা গেলো কিছুই নেই। মরার দ্যাশে এসে পড়েছি, প্রথম থেকেই না না না, এখন খাবারেও না! জানা গেল, বার্ড ফ্লু হয়ে খাবার উপযোগী সব মুরগি মারা গেছে। তো আছে কী? কারবারি জানালেন, “মার্ফা”। নামটা আগেও শুনেছি, কিন্তু কী জিনিস জানা হয়নি। আবু বকর, মার্ফা খেতে চাইলেন না। তাঁর চেহারা দেখেই বুঝলাম, এটা আশা করেননি তিনি। বুঝে নিলেন, আজকে নিজেদের রসদেই চলতে হবে।

মোহন তখন জানতে চাইলো, মার্ফা জিনিসটা কী?

আবু বকর জানালেন, মার্ফা শসাজাতীয় এক প্রকারের ফল। শুনেই বুঝলাম, পানি পানি হবে তরকারি, বিশেষ স্বাদের কিছু হবে না বলেই আবু বকর নিরুৎসাহিত।

নামাজ পড়া হয়নি, আগে নামাজ আদায় করা দরকার। তাই ওখানেই পশ্চিম দিক জেনে নিয়ে যোহরের কসর দুই রাকাত নামাজ আগে আদায় করলাম। বাইরে, নিচের দোকানটা থেকে খোলা দরজা দিয়ে অনবরত তামাকের বোঁটকা দুর্গন্ধ উড়ে উড়ে আসছে দোতলার এই ঘরটায়। আর ঐ দোকানটাতে রীতিমতো জটলা করেছে পাড়ার লোকজন। বড় গলায় কথা বলছে তারা। কখনও তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় (ভুলও হতে পারে) তারা কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে। …এই পাড়ায় ঢোকা থেকে শুরু করে এপর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তাতে এই পাড়ায় আজকের যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে আমরা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং আমরা যে এই পাড়ার জন্য আজকে সাক্ষাৎ মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছি, এটা আর আশা করি ভেঙে বলা লাগবে না।

এ, ও আসছে আমাদের সাথে দেখা করতে। এক ব্যাক্তির সাথে আবু বকর কথা বলতে আরম্ভ করলেন। উদ্দেশ্য একটাই, পাইন্দু খালের উজান সম্বন্ধে আরো বেশি করে জেনে নেয়া। লোকটার থেকে পাড়াগুলোর নাম লিখে নিলো ওরা। লোকটার নাম জানতে চাইলাম। যে নাম ওরা উচ্চারণ করছে, তা লিখলাম আমি এরকম: কা সি শে। পরে ওখানকার শিক্ষিত একজনকে আবু বকর বললেন লিখে দিতে, তিনি লিখলেন: হ্লা সিং শৈবুঝেন এবার ন্যাটিভদের গুরুত্ব! এই ব্যাপারটাকে বোঝানোর জন্য আমার একটা অচেথন ছিল:

"গোত্রের ইতিহাস বা ব্যাখ্যা স্বগোত্রীয়ের কাছে পায় আতিশয্য, আর বহির্গোত্রীয়ের কাছে হারায় মৌলিকত্ব।" অচেথন - মঈনুল ইসলাম - নিশাচর

এরই মধ্যে আসরের নামাযের সময় এসে গেছে বলে আমি ওযু করতে যাবো মনস্থ করলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে চললাম পাইন্দু খালে ওযু করতে। বেরিয়ে তো আমি থ – পাকা সিঁড়ি পেরিয়ে সামনে এগোতে কাচা অংশে গিয়ে দেখি শুয়োরের খোয়াড়ের মতো কাদা। একেবারে এঁটেল মাটির কাদায় মাখামাখি। আমরা কারবারির ঘরে আশ্রয় নেবার পর যা বৃষ্টি হয়েছে, তাতেই এই অবস্থা। জায়গাটা আবার ঢালু, পিছলা না খেয়ে নামাই মহা মসিবতের কাজ। খুদ পাড়াবাসীকেই দেখলাম বেশ কসরত করে নামতে হয়। বুঝলাম না, এই স্থায়ী সমস্যাটাকে জিইয়ে রাখার মানে কী? ঝিরি থেকে বালু তুলে এনে ফেললেই তো কিছুটা সমাধান হতো।

যাহোক, শান্ত, জনমানবহীন পাইন্দু খালের ঘোলাজলে ওযু সেরে ফের ঐ কাদায় মাখামাখি হয়ে ফিরলাম ঘরে। আমার জুতায় ট্র্যাকশন বেশি বলে সব কাদা ওতে আটকে থাকে। যাহোক ফিরে এসে, বাইরের বারান্দায় যথাসম্ভব জুতা থেকে কাদা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, তারপর ঘরে এসে আসরের নামায সারলাম। এই পথে আবার ওযু করতে যাবার কোনোই ইচ্ছা আমার নেই। এশার আগ পর্যন্ত এই ওযুই ধরে রাখতে হবে। ☺️

পাইন্দু পাড়ার কারবারির ঘরের বারান্দা, ভিতরের বারান্দা থেকে বাইরের উন্মুক্ত বারান্দা দেখা যাচ্ছে - নিশাচর
পাইন্দু পাড়ার কারবারির ঘরের বারান্দা, ভিতরের বারান্দা থেকে বাইরের উন্মুক্ত বারান্দা দেখা যাচ্ছে – নিশাচর

এই ঘরের অন্যান্য আসবাবের মধ্যে আছে একটা পায়ে-চালিত সেলাই মেশিন, দাঁড়িয়ে ওজন মাপার স্কেল, ধানভর্তি কিছু বস্তা আর দুয়েকটা ঝুড়ি। রুমা বাজারের খুব কাছাকাছি বলে এতো আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে। মাথার উপরে টিনের চাল থেকে নিচের পাটাতন অবধি কিছু টিন মুড়িয়ে রাখা, আরো কিছু বাঁশের বড় বড় ঝুড়ি রাখা, আর রাখা একটা জিনিস। এই জিনিসটাও একটা ঝুড়ি, তবে কাঠের তৈরি। এটা আসলে একটা দোলনা। চারকোণা কাঠের ঝুড়িটার চারকোণায় রশি লাগিয়ে উপরের চৌকাঠে ঝুলিয়ে নিলেই ওটা শক্তপোক্ত দোলনা হয়ে যায়। এই ঘরের একটা বল্টু এখন বড় হয়ে গেছে, বুঝতে পারলাম, ওটা ওরই ছিল, যখন ও’ ছোট ছিল।

পিতা-পুত্র (পাইন্দু হেডম্যান পাড়া) - নিশাচর
পিতা-পুত্র (পাইন্দু হেডম্যান পাড়া) – নিশাচর

এই ঘরে যে শিক্ষিত ব্যক্তিটি আছেন, তিনি এই ঘরের মেয়ের জামাই। রুমাতে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছেন রাজশাহীতে, সেখানেই পড়ালেখা করেছেন। এখন নিজেদের সংস্কৃতিরও অনেক কিছুই জানেন না। জানা গেল, তার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে। শুনে আবু বকর বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন, কিভাবে হলো সবকিছু, জানার জন্য। জানা গেল, দূর সম্পর্কের আত্মীয় তারা, প্রথম দেখা হয়েছিল রুমা বাজারে এক বৌদ্ধ পূর্ণিমার মেলাতে। মেয়েও শিক্ষিত। তারপর শহুরেদের মতো মুঠালাপীর নম্বর বিনিময়, অতঃপর ফোনে ফোনে প্রেমের প্রগাঢ়তা। তারপর দুজনে পালিয়ে বিয়ে করেন বান্দরবানে। সেখানে এক মাস থাকেন। উভয় পরিবারই নাকি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল। সেই প্রেমেরই পরিণতি এই বিয়েতে এবং এখন তাদের এক ছেলে সন্তান। স্ত্রীকেও দেখলাম আমরা, বেশ সুন্দরী তিনি। রুমাতে একটা স্কুলে তিনিও শিক্ষকতা করেন।

এই ঘরে আরেকটা জিনিস আছে দেখার মতো, খুব ইচ্ছা ছিল ছবি তুলে আনার। কিন্তু পরে ভুলে গেছি। এটা হলো একটা ক্যালেন্ডার। একটা বৌদ্ধ দিনপঞ্জি। আমরা যে গ্রেগরীয় দিনপঞ্জি অনুসরণ করি, তার বর্ষ হিসাব ‘খ্রিস্টাব্দ’ দিয়ে করা হয়। মুসলমানরা অনুসরণ করে চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে দিনপঞ্জি, সেখানে বর্ষ হিসাবকে ‘হিজরি’ বলা হয়। আর এই দিনপঞ্জির হিসাব ‘বুদ্ধাব্দ’ দিয়ে। এইরকম একটা কিছু যে আছে, জীবনেও জানতাম না। পরে ঢাকা এসে ঘাঁটতেই দেখি, এটা বহু আচরিত। বাংলা উইকিপিডিয়ায় ছোট হলেও এই নামে একটা নিবন্ধও আছে (দেখুন: Wikipedia icon বুদ্ধাব্দ – উইকিপিডিয়া^)। ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিদ্ধার্থের (গৌতম বুদ্ধ) নির্বাণ (মুক্তি) প্রাপ্তির দিন (বিশাখা বা বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা – বৌদ্ধ পূর্ণিমা) থেকে এই বর্ষ গণনা শুরু। আমাদের চারজনের জন্যই ব্যাপারটা দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।

মাগরিবের তিন রাকা’ত কসর নামাজও সারলাম। সন্ধ্যা হতেই শুরু হলো বৃষ্টি। টিনের চালের কারণে বৃষ্টির আওয়াজটা দারুণ উপভোগ করছি। এই দুর্যোগের মাঝে আজকে তাঁবু টানাতে হলে রীতিমতো নাভিশ্বাস বেরিয়ে যেত। জিনিসপত্র শুকনা রাখাতো আছেই, নিজেদেরকে শুকনা রেখে আগুন জ্বালানোই মসিবত হয়ে যেত। তবে হলে, সেটাও একটা চরম অভিজ্ঞতা হতো। দাদী, আম্মা’র কাছ থেকে শিখেছি, দুর্গাপূজার সাথে বৃষ্টির একটা সম্পর্ক থাকে, দুর্গাপূজার সময় বৃষ্টি হবেই। আমরা ভাবলাম, সেটাই হয়তো, কাল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তখনও আমরা জানতামই না, সমুদ্র উত্তাল, সেন্ট মার্টিনে আটকা পড়েছে শ’তিনেক পর্যটক, সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর সতর্কতা দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া সত্যিই খারাপ!

সন্ধ্যা হয় সাড়ে ৫টার দিকে। আমরা বসে বসে তথ্য সংগ্রহ করছি, এর-ওর সাথে গল্প করছি। মোহন ব্যাটা শুয়ে আছে তো শুয়েই আছে। যেন রাজ্যের ঘুম নিয়ে এসেছে সে। হয়তো ঘুমে, হয়তো আদো জাগরণে। কিন্তু ব্যাটা শুয়েই আছে। অলস সময়ই বলা যায়। রান্না-বান্না’র আয়োজনে যাচ্ছি না দেখে, কারবারি একটু উশখুশ করতে থাকলেন। সাড়ে ৬টার দিকে এসে আবারও তাগাদা দিলেন, কী খাবো আমরা। মার্ফা যে খাবো না, সেটা আবু বকর আবারও জানিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, ডিম আছে কিনা? জানা গেল, ডিম আছে। ডাল আছে কিনা? জানা গেল ডালও আছে।

আহা, বেহেস্তি খাবার! ট্রেকে এসে এই খাবার কে-ইবা পায়। মার্ফার যে বর্ণনা শুনেছি, তার তুলনায় বহুগুণ ভালো হবে। আবু বকর কিছুটা ইচ্ছে করেই রাঁধার দায়িত্বটা তাঁদের উপরই ছেড়ে দিলেন। তানভির, ডিমগুলোকে অন্তত নিজেরা রাঁধার আগ্রহ জানালেও, আবু বকর তাও তাদেরই ঘাঢ়ে চাপিয়ে দিলেন।

এপর্যন্ত আলাপে যা যা হলো, তার একটা সারমর্ম দিই: আপস্ট্রিমের (উজানের) পাড়াগুলোর নাম লিখে নেয়া হয়েছে। কিন্তু পাড়াগুলোর নাম নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আছে, কারণ একই পাড়ার একাধিক নাম পাওয়া যাচ্ছে। ঘাটে যে মাঝি’র বোট এসে লেগেছিল, সে আসলে খালের ঐ পাড়ের বাঙালি মুসলমানদের একজন, নামটা ধরে নেই জহির (ছদ্মনাম)। সেও এই পাড়ার লোকজনদের মতো আমাদের প্রতি বিভিন্ন প্রকারে সন্দেহবাদী। কালকে আপস্ট্রিমে উঠার ব্যাপারে তার নৌকা পাওয়া যাবে, কিন্তু সে যে টাকা বলছে, তাতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তার বক্তব্য হলো, আজকেই ঝিড়ির এই অবস্থা, তার উপর বৃষ্টি হচ্ছে, কালকে উপরে উঠতে গেলে রিস্ক বেশি, এবং পথে কয়েক জায়গায় বিপদ আছে, এক জায়গায় এই সপ্তাহেই একটা নৌকা উল্টে গিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে, আমরা চিন্তা করেছি প্রয়োজনে তাকেই গাইড নিয়োগ দিয়ে আমরা পরবর্তি পাড়ার দিকে আপস্ট্রিমে রওয়ানা করবো ইনশাল্লাহ। কিন্তু সব ক্যালকুলেশনের সাথেই বৃষ্টির একটা বড়সড় হিসাব-নিকাশ আছে।

মাঝখানে জহির, ইশারা করে তানভিরকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনারা পানি খাবেন?” হাত মুঠ করে বুড়ো আঙ্গুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করায় আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম। আগ বাড়িয়ে উত্তর দিলাম ওকে, আপনি যে পানির কথা বলছেন, আমরা ওটা খাই না। শুনে সে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে এখানে (মানে এই বৌদ্ধদের পাড়ায়) উঠছেন ক্যান?” উত্তরে আমি হাসলাম। কিন্তু মনে মনে প্রচন্ড রাগ করলাম। ব্যাটা সবাইরে মদখোর ভাবোস নাকি?

পরে আবু বকরকে কথাটা অনুযোগের সুরে যখন বললাম, তখন আবু বকর উল্টো কথা বললেন, “আপনার মতো আমিও প্রথম প্রথম খুব রেগে যেতাম। পরে দেখেছি, অধিকাংশ মানুষ, যারা জীবনেও হয়তো মদ ছুঁয়ে দেখেনি, তারা নিষিদ্ধ ঐ জিনিস একবার চেখে দেখার লোভে হলেও পাড়াগুলোতে এলে সহজলভ্য পেয়ে মাতাল হয়ে যায়।” …কথাটা শুনে মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম। নামেমাত্র এই মুসলমান দিয়ে মসজিদ ভর্তি করে আমরা কোন বেহেস্তী দেশ প্রত্যাশা করছি আল্লা’ মালুম। মনে ইসলাম নাই, সংবিধানে ইসলাম নিয়ে চিল্লাহল্লা!

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ। আমরা রান্নাঘরে যাবার অনুমতি পেলাম। আমাদেরকে কাচের প্লেট বের করে দিয়ে কারবারি আপ্যায়ন করলেন। কলসিতে রাখা খাবার পানি আর আবু বকরের অনুরোধে পাহাড়ি ঝাল মরিচ বের করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি। আমরা তাকিয়ে দেখি, চারটা ডিমকে একত্র করে ভাজি করে ফেলেছেন কারবারির বউ। আবু বকর আফসোস করলেন তানভিরের কথা শোনেননি বলে।

গরম ভাতের সাথে গরম ডিম ভাজি আর ডাল মিশিয়ে স্বর্গীয় খাবার যখন মুখে দেয়া হলো, তখন তার অমৃত স্বাদ ছাপিয়ে মুখে লাগলো গরম। আমার পাহাড়ে যাবার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, পাহাড়ি মরিচগুলো চরম ঝাল হয়, আর অফ-ট্র্যাক বান্দরবানে রুমনা পাড়ার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, পাহাড়িরা প্রচুর ঝাল খায় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক হিসেবে। যেহেতু আমি ম্যালেরিয়ার ওষুধ না খেয়ে চরম ভুল করেছি, ইতোমধ্যে মশার কামড়ও খেয়ে ফেলেছি, মনে মনে আল্লা’র নাম যপে তাই ম্যালেরিয়ার পাহাড়ি নিদান হিসেবে এই ট্যুরে বেশি বেশি করে ঝাল খাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া অন্যান্যবারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, পাহাড়ে এসে ঝাল খেয়ে দারুণই লাগে, যদিও আমি আমার জগতে মোটেই ঝাল খেতে পারি না। আমাদের তিনজনের এতো এতো বিজ্ঞাপনের পরও তানভির মরিচ না নেবারই সিদ্ধান্ত নিলো। মোহন তো মরিচ লেপ্টে নিয়ে খেতে বসেছে, আর বিজ্ঞাপন করে চলেছে এর চরম ঝালের মজার কথা। কিন্তু মুখের ভিতরে ঝালের চেয়ে বেশি লাগছে গরম। খাবারের একেবারে শেষ পর্যায়ে, বিজ্ঞাপনের আতিশায্যের ঠ্যালায় আর থাকতে না পেরে তানভির শেষ পর্যন্ত একটা মরিচ নিয়ে ট্রাই করে দেখলো বটে। ☺️ ভাত খাওয়া শেষ করে আবু বকর চুলা থেকে গরম পানি নামিয়ে, ব্যাগ থেকে সীরিয়্যাল বের করলেন। দুধ কোথায় পাবো, তাই গরম পানিতে গুলে গুলে চারজনই খেয়ে নিলাম। পেট পরিপূর্ণ। …পলিথিনগুলো আবু বকর চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেললেন। পাহাড়ে গিয়ে যত্রতত্র পলিথিন ফেলে পরিবেশের যে তেরোটা বাজানো হচ্ছে – এ হলো তার প্রতি একটা প্রতিবাদ।

এবারে আর কী করার? পাহাড়িরা সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে যায়। সুতরাং তথৈবচ, আমরাও ঘুমিয়ে যাই। কালকে বৃষ্টি না থাকলে কঠিন আরেকটা পরিশ্রমের দিন আছে আমাদের জন্য। আমি আমার ব্যাগ থেকে দ্বিতীয় স্লীপিং ব্যাগটা বের করে নিলাম। মোহনেরটা হবে আমাদের তোষক, আর আমারটা হবে আমাদের কাঁথা। কিছুক্ষণ প্রস্তুতিতে ব্যয় করে আমরা ঘুমাতে গেলাম: আবু বকর ডানে, তারপর আমি, আমার বামে মোহন, তারপর তানভির – শুয়ে পড়লাম। তাদেরও কেউ কেউ গিয়ে শুয়ে পড়লেন। এই প্রথম, পাহাড়ের কোনো ঘরে একাধিক ঘর দেখলাম, এরা এই কোঠার পিছনে খুব ছোট্ট একটা কোঠা বানিয়েছে। তাই এই কোঠায় আমরাই শুধু ঘুমালাম। বাতি বন্ধ করে দিলেন কারবারি এসে। দরজাটাও ভেজিয়ে দিলেন।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ড। টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির এক অপূর্ব কলতান, এক মোহময় আমেজ এনে দিয়েছে, যেন ঘুমুতেই বলছে আমাদেরকে। এই সাত-সন্ধ্যাবেলায়ও কখন যে ঘুমে চোখ বুজে এলো বুঝিনি। … রাতে একবার ঘুম ভাঙলো, বাইরের দোকানটাতে তখনও লোকজন উচ্চস্বরে কথা বলেই যাচ্ছে। পাহাড়ে তো এতো রাতে মানুষ সজাগ থাকে না! আমরা কি আসলেই মহা আপদ হয়ে এসেছি নাকি এই পাড়ায়!! কিন্তু রাত ক’টা বাজে দেখার উপায় নাই। আমার মোবাইল ফোনটা শুধু কল করার জন্য চালু করি, বাকি সময় বন্ধ করে রাখি, এই অন্ধকারে অন করার কোনোই ইচ্ছা নেই। হয়তো দশটা-এগারোটা হবে… আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

গভীর রাতে একবার ঘুম ভাঙলো। রাতে পেশাব করে শুইনি, এখন ভালো বেগ পেয়েছে। পেশাব করা দরকার। পাহাড়ে পেশাব তো দূরে থাক, পায়খানার জন্য ব্যবস্থা হলো উন্মুক্ত স্থানে। তাই আসলে লোকে লোকারণ্য পাড়ায় রাতে আমরা উদ্যোগ নেইনি। এখন চিন্তা করলাম, পেশাব করতে যাওয়া উচিত। কিন্তু তাবলিগে গিয়ে একটা ব্যাপারে শিখেছি, সব সময় বের হলে কমপক্ষে দুজন বের হওয়া। তাছাড়া আবু বকরও রাতে বলেছিলেন, পেশাব করার কথা। চিন্তা করলাম, ডাক দেই তাঁকে। আবু বকরকে দিয়ে একটা টর্চ কিনিয়েছিলাম, ওটা এই পাড়ায় সৌরবিদ্যুতে চার্জও দেয়া হয়েছে কয়েক ঘন্টা; ওটা হাতে নিয়ে বের হলাম দুজনে। পুরো পাড়া নিঃস্তব্দ। কিন্তু নিচে নামলাম না। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। নিচে নেমে ভেজার কোনো মানে হয় না। তাই, ঐ উন্মুক্ত বারান্দায় বসেই নিচের ফাঁক ফাঁক বাঁশের তর্জার ফাঁক গলে কৃতকর্ম সেরে নিলাম। বাচ্চাদেরকে এই স্থানে কাজ সারাতে দেখেছি আগে। ☺️

ক’টা বাজে দেখার ইচ্ছা ছিল খুব, কিন্তু মোবাইল চালু করে চার্জ নষ্ট করার কোনোই ইচ্ছা নেই। আবার এসে, বাঁশের বেড়ার দরজাটা আগের মতোই ভেজিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমাঝম শব্দ। রাতে ঠান্ডা লাগলো, কিন্তু স্লিপিং ব্যাগের কম্বলটা ভালোই সাপোর্ট দিলো, আর চারজন গাদাগাদি করে শোয়ায় কিছুটা ওমও পেলাম। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব কষ্ট হচ্ছে – নিচের স্লিপিং ব্যাগটা পাতলা বলে তলার বাঁশের পাটাতনের শক্ত তলটার কারণে পিঠে ব্যাথা করছে খুব। কিন্তু তবু আবার ঘুম লেগে গেলো।

ঘুম ভাঙলো সকালে, কোনো এক সময়। ততক্ষণে পাহাড়িরা ভাত দিয়ে নাস্তাও করে ফেলেছে। পুরো পাড়া সরব। কিন্তু বাইরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আবু বকরের কোনোই ইচ্ছা নেই বৃষ্টির মধ্যে বেরোনোর। আসলে আমাদের অবস্থাও সেরকম নেই, বৃষ্টিতে ভিজে সব নষ্ট করার কোনোই মানে নেই। বৃষ্টি থেমে গেলে বেরিয়ে পড়া যাবে। তাই একটু অলস সময়ই পার করছি আমরা। আর, এই ট্যুরটা সেরকম কোনো বাধাধরা স্কেজ্যুলে তৈরি না বলে, খুব একটা গা-ও করছি না আমরা কেউ। পাহাড়ে সময় কাটাতে এসেছি, বৃষ্টির মধ্যে নাহয় ঘুমিয়েই কাটালাম প্রকৃতির কোলে।

পাহাড়িরা সুযোগ পেলেই বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখে। চাল থেকে চুয়ে পড়া পানি যেখানে পড়ছে, উন্মুক্ত বারান্দার সেই জায়গায় ডেকচি, বলতি রেখে সেই পানি ধরা হচ্ছে। আমাদের ডেকচিটাও সেখানে রেখে পানি জমিয়ে ফেললাম অল্পক্ষণেই। তারপর সেই পানিতে ওযু করে অত্যন্ত দুঃখের সাথে ফযরের কাযা আদায় করলাম।

পাইন্দু পাড়ায় দেখা সবুজ গোখরা - নিশাচর
পাইন্দু পাড়ায় দেখা সবুজ গোখরা – নিশাচর

এর মধ্যে বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে দেখি কি, পাড়ার বাচ্চা কয়েকটা একত্র হয়ে বাঁশের আগায় কী একটা নিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। আবু বকর বুঝতে পেরে ডাক দিলেন, “সাপ নাকি? তুমরা মারছো?” ওরা এগিয়ে এলে ওটার ছবি তুললাম। তানভির ঢাকায় ফিরে উইকিপিডিয়ায় ঘেঁটে তার কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেছে:

ইংরেজি নাম Spot-tailed Pit Viper, বাংলা নাম: দাগিলেজা সবুজ বোড়া। বৈজ্ঞানিক নাম Trimeresurus erythrurus। বাংলাদেশ, ভারত আর মিয়ানমারে এদের দেখা পাওয়া যায়। সব বোড়া সাপের মতোই এরা খুবই বিষাক্ত। আর দেখেই বুঝতে পারছেন, গাছের সবুজের মধ্যে কত অনায়াসে মিশে গিয়ে এরা শিকার করতে পারে। (বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু হেডম্যান পাড়ায় এই সাপটির দেখা পাওয়ার তারিখ: ১১ অক্টোবর ২০১৬)

আমাদের রেশন থেকে নুডলস আর স্যুপ একত্র করে রান্না করলাম আমরা। তাতে মেশানো হলো পাহাড়ি ঝাল মরিচ বেশি করে। ঝাল করে না খেলে কি আর মজা আছে? মরিচ কাটার সময় ডাক পড়লো মোহনের আনা ছুরিটার। দেখে তো আমি থ’ – এটা কোনো ক্যাম্পিং নাইফ না, বরং একটা কিচেন নাইফ। সিলেটি একটা বাক্য মনে পড়ে গেলো: “নিজ’র নাই তো বিয়া বাড়িতও নাই”। মরিচ কাটার জন্য যদিও ঐ ছুরিই যথেষ্ট, কিন্তু গাছ কাটা লাগলে… আমি আর ভাবতে পারলাম না। খাওয়া শেষে আবারও সীরিয়্যাল খেয়ে পেটপূজার ইতি টানা হলো। নিজেদের ডেকচিটা আবারও বৃষ্টির মধ্যে রেখে দিলাম জল জমার জন্য, যাতে ধুয়ে নেয়া যায়। আবু বকর ডেকচিটা নিয়ে এসেছেন ব্যাগে পুরে, ক্যাম্পিং ট্রিপে নিজেদের সরঞ্জামাদি আ মাস্ট

খাওয়া-দাওয়া শেষে ল্যাটানি যখন চলছে, তখন কোনো এক সময় কারবারি এসে আবু বকরকে যা বললেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, আপনারা বেরিয়ে পড়েন। এখন বের হলে রুমা বাজারে চলে যেতে পারবেন দ্রুতই (মানে, রুমা গেলে ওখান থেকে গাইড পাবেন, যাবার পথ পাবেন, অন্য কোথাও যান)। বাইরে তখনও বৃষ্টি চলছে। যদিও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এখন – আর অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, আজকে সারাদিনই বৃষ্টি অনবরত পড়তেই থাকবে, সিলেটি ভাষায় যাকে বলে চালে-মাটিয়ে লাগা। কিন্তু এই বৃষ্টিতে বের হলে একেতো সামনের অজানা পথে কী বিপদে পড়তে হবে কে জানে? তার উপর সাথের সব কিছু ভিজে নষ্ট হবে। কিন্তু কারবারির বক্তব্যের সারমর্ম জ্বলজ্বলে স্পষ্ট: রাস্তা মাপেন

সিরিয়াসলি! 😮

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

মন্তব্য করুন