অচেথন ১৯: অন্যমনষ্ক

মানুষ কেবল একমনষ্কই হতে পারে।

যাকে আপনি অন্যমনষ্ক বলছেন, সে আসলে অন্যদিকে একমনষ্ক।

মঈনুল ইসলাম

ভারতীয় হিন্দুত্বে বোকা বনে গিয়েছিলেন ভাস্কো দা গামা

একজন অভিযাত্রীর ‘বিশ্বাস’ যেন তার আবিষ্কারকে কলুষিত না করে।

– মঈনুল ইসলাম

…এমনটাই বলতে চাই এবং বিশ্বাস করি আমি। কিন্তু পর্তুগিজ পরিব্রাজক ভাস্কো দা গামা (Vasco da Gama), যিনি সেই সুদূর পর্তুগাল থেকে আফ্রিকা, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভারত আবিষ্কার করে বদলে দিয়েছিলেন পর্তুগালের ভাগ্য, বদলে দিয়েছিলেন ভারত, বাংলাদেশসহ ভারত উপসাগরের অনেক দেশের ভাগ্য, সেই অভিযাত্রী কিন্তু নিজের বিশ্বাস দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলেন [নতুন] আবিষ্কারের আনন্দ।

ভাস্কো দা গামা একজন নেতা (ক্যাপিতো) হলেও লেখালেখির ধারেকাছে বোধহয় ছিলেন না। অন্তত ভারত আবিষ্কারের প্রথম অভিযাত্রার এতো উদ্যমী আর দুঃসাহসিক অভিযানেরও তার লেখা কোনো ইতিহাসই নেই। ভারত আবিষ্কারের সেই অভিযানের একমাত্র জীবিত লেখনীটি পাওয়া যায় তার ৪টি জাহাজের একটির একজন নাবিক জোয়াওঁ জে সা’র (João de Sá) পক্ষ থেকে, যিনি São Rafael নামক একটি ক্যারাক-এর (এক প্রকার পর্তুগিজ জাহাজ) সাধারণ নাবিক ছিলেন। (কেউ আবার বলেন লেখাটি আসলে অন্য আরেকজন নাবিক আলভারো ভেল্যিয়ো’র (Álvaro Velho))

যাহোক, ভাস্কো দা গামা’র সেই ঐতিহাসিক অভিযাত্রার যে বর্ণনা তার সঙ্গীর থেকে পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, পর্তুগিজরা ভারতের কালিকূট (বর্তমান কেরালার Kozhikode) বন্দরে যেদিন পৌঁছেছিলেন (২০ মে ১৪৯৮), সেদিন তারা নিজেদের বিশ্বাসের দৃঢ়তার কারণে নতুন আবিষ্কার করা আরেকটি বিশ্বাসকে ভুল বুঝেছিলেন।

কী দেখেছিলেন আর কী বুঝেছিলেন তারা?

কী দেখেছিলেন তারা, আর কী বুঝেছিলেন, তার বর্ণনা কয়েকটি ছবিতে নিচে দেয়ার চেষ্টা করলাম:

সোজা বাংলায় ভাস্কো দা গামা আর তার দলের ১৩ জন সদস্য ঐ হিন্দু মন্দিরকে খ্রিষ্টানদের গির্জা ভেবে ভুল করেছিলেন।

কেন এই ভুল বুঝাবুঝি?

চোখের সামনে সত্যকে রেখে কেন ভুল বুঝে মানুষ? ভাস্কো দা গামা আর তার দলের ১৩ জন মানুষইবা কেন একটি জ্বলজ্বলে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে বুঝেছিলেন ভুল?

  • প্রথমত, পর্তুগিজরা তখন ক্রুসেডের (মুসলমানবিদ্বেষী খ্রিষ্টান ধর্মযুদ্ধ) আদর্শে পরম খ্রিষ্টান, আর পৃথিবীময় শুধু খ্রিষ্টানদেরকেই খুঁজছিলেন।
  • দ্বিতীয়ত, নিজের বিশ্বাসে পরম অন্ধ হলে চোখের সামনে সত্য রাখলেও মানুষ সত্যকে অস্বীকার করে। ভারতীয় এই সর্বেশ্বরবাদী ধর্মকে (হিন্দুধর্ম) ইউরোপীয় একেশ্বরবাধী নজরে দেখলে তো ভুল বোঝাই স্বাভাবিক।

মূলত এরই প্রতিফলন হয়েছিলো এখানেও। একজন তো মজা করে বলেই বসেছেন: “পর্তুগিজরা ভারতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তুমরা মুসলমান?’ ভারতবাসী জবাবে বলেছে, ‘না’। পর্তুগিজরা বুঝে নিয়েছে, ‘ও, তাইলে তুমরা খ্রিষ্টান’।” 😆

কোনো আবিষ্কারকে আবিষ্কারকের সত্যান্বেষী চোখে না দেখার খেসারত হলো: ভুল বোঝা। ভুল দিয়ে সত্যকে ঢাকার চেষ্টা, নতুন আবিষ্কারকে পুরোন জানা দিয়ে প্রতিস্থাপন করার মিথ্যা প্রয়াস:

– মঈনুল ইসলাম


তথ্য-উৎস:
The Journal of the First Voyage of Vasco da Gama (1497-1499) – Project Gutenberg (Page 52)
https://www.gutenberg.org/files/46440/46440-h/46440-h.htm#Page_52

ভিডিওর মাধ্যমে এই বর্ণনার উপস্থাপনা:
https://www.youtube.com/watch?v=75rnC3ZrmhY

প্রচ্ছদের ছবি: ফ্র্যাংক প্লগম্যান-এর ব্লগ

বাংলায় নমুনা লেখা (Bangla Lorem Ipsum) তৈরির পেছনের কথা

আমার পেশাগত কাজেই ওয়েব ডিযাইন, কিংবা ওয়েব ডেভলপমেন্টের সময় আমরা যখন প্রয়োজনীয় লেখার যোগান পেতাম না, তখন লাতিন হরফের lorem ipsum দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতাম। তখন বাংলায় বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ওয়েবপোর্টাল তৈরি করবার সময় লোরেম ইপসামের মতোই কিছু একটার খুব অভাব অনুভব করি। তখন তো লোরেম ইপসাম জেনারেটর তৈরির জ্ঞানগম্যি ছিলো না বলে সাহিত্যজ্ঞান দিয়ে তৈরি করি “অর্থহীন লেখা”। সেটাই একটা ব্লগের মাধ্যমে প্রকাশ করি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে। সেসময় অনেকেই এর উপকার ভোগ করেছেন, অনেক ওয়েবসাইটে এখনও ‘অর্থহীন লেখা’র অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

দীর্ঘদিন থেকে ব্লগটা বন্ধ ছিলো বলে ২০২৩-এ এসে আমি একটা বাংলা লোরেম ইপসাম জেনারেটর তৈরির পরিকল্পনা করি। প্রথমত সেখানে আমার সেই ‘অর্থহীন লেখা’টা থাকবে, আর সাথে মানুষের নাম তৈরি করবার যন্ত্রও থাকবে। ঠিক তখনই সাইফুল ইসলাম রাসেল-এর তৈরি BanglaLorem-এর কাজটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো আমার, যা মূলত Corporate Ipsum-এর আদলে তৈরি করা। সেখানে কোডগুলো অবশ্য অগোছালো ছিলো, আর বেশ কিছু deprecated কোডও ছিলো। ঠিক করলাম, তাঁর এই কাজটাকেও পুণর্জীবিত করা যেতে পারে। তখন এই তিনটে জিনিসকেই একত্র করে কাজে হাত দিলাম।

কী আছে এতে?

আমার কাজের ডিযাইন হিসেবে আমি Corporate Ipsum Chromium Extension-এর ডিযাইনটাকে প্রাথমিক আদল হিসেবে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। প্রথমেই নাম তৈরির কাজটি করতে শুরু করলাম। এই নাম তৈরির ধারণা আমি প্রথম পেয়েছিলাম Laravel-এর Faker প্যাকেজ থেকে। সেই ধারণা নিয়েই বাঙালি মানুষের নামের “শুরুর অংশ” আর “শেষাংশ” জোড়া লাগিয়ে কাজে হাত দিলাম। জাভাস্ক্রিপ্ট দিয়ে খুব দ্রুত একটা বানিয়েও ফেললাম।

কিন্তু শুরুতেই ঘটলো বিপত্তি!

যে নামগুলো তৈরি হচ্ছে, তা খুবই বিদঘুটে শোনাচ্ছে। যেমন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ খাতুন, বনলতা আলম কিংবা মোহাম্মদ রোজারিও। ঠিক করলাম এর একটা বিহীত করা দরকার। বুঝলাম বাংলাতে যেমন নামের প্রশ্নে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে, তেমনি লিঙ্গের প্রভাব আছে। তাই বাধ্য হয়ে নামের অংশগুলোকে ধর্ম আর লিঙ্গে ভাগ করতে বাধ্য হলাম। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দু – এই চার ধর্মের মানুষের নাম খুঁজে নামের দুটো অংশ বসালাম। তার মধ্যে আবার পুরুষ আর নারীর নাম আলাদা করলাম। তারপর এগুলোর সমন্বয় করে নাম তৈরি করলাম। সহজ কাজটা একটু জটিল হলো বটে, তবে এবারে নামগুলো বাস্তবসম্মত হয়ে উঠলো।

বাংলালোরেম-এর জেনারেটর নিয়ে কাজ করবার সময় আমি বাংলাদেশের পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের “তরুণ কিশোর” কবিতাটি ব্যবহার করলাম। কবিতাটি এই প্রথম বোধহয় দেখলাম কিংবা এই প্রথম মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। কবিতাটি আমার মনে ধরলো বেশ (ঈশ্বরের কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কমনা করি)। এই কবিতাটি ব্যবহার করবার সময় গদ্য-বাক্য তৈরি করবার সুবিধার্থে কবিতার কয়েকটা চরণকে একত্রে জুড়ে নিতে বাধ্য হলাম অবশ্য। তবে আশানুরূপ ফলাফল পেয়ে ভালো লাগলো।

টেক্সট জেনারেটরটির বাংলা নাম দিলাম “রচনাযন্তর”। ইংরেজি ‘generator’ শব্দটির বাংলা দেখলাম ‘উৎপাদক’। নামটা কেমন জানি বিশ্রী শোনাচ্ছিলো আমার কানে। তাই আমি নাম দিলাম “রচনাযন্ত্র”, একটু সাবলীল করে করলাম “রচনাযন্তর”। কিন্তু রচনাযন্তরটিতে লক্ষ করলাম, মূল কবিতার বিভিন্ন hyphen ‘শব্দ’ তৈরির সময় বিশ্রীভাবে শেষে দেখা দিচ্ছে। তাই তারও বিহীত করলাম।

দেখতে কেমন?

পেশায় ডিযাইনার হওয়ায় বেশ কয়েকবার ডিযাইন বদল করলাম। সবশেষে তিনটি tab-এ তিনটি ফিচার আলাদা করে মনে হলো, এবারে কিছুটা গোছানো হয়েছে কাজটা। তাই শেষ পর্যন্ত প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম…

কী কী করা যাবে?

এই যন্ত্রটি দিয়ে যে কাজগুলো করা যাবে:

  1. রচনাযন্তর দিয়ে
    • বাংলা অনুচ্ছেদ তৈরি করা যাবে (সর্বোচ্চ ১০০ অনুচ্ছেদ)
    • বাংলা বাক্য তৈরি করা যাবে (সর্বোচ্চ ১০০ বাক্য)
    • বাংলা শব্দ তৈরি করা যাবে (সর্বোচ্চ ১০০ শব্দ)
    • অনুচ্ছেদ, বাক্য, কিংবা শব্দ সম্পূর্ণটুকু এক ক্লিকে কপি করা যাবে
  2. নাম হিসেবে
    • ধর্মনির্বিশেষে পুরুষের নাম পাওয়া যাবে
    • ধর্মনির্বিশেষে নারীর নাম পাওয়া যাবে
    • তৈরিকৃত প্রতিটা নামের উপর ক্লিক করলে ঐ নামটি কপি হয়ে যাবে
    • তৈরিকৃত সকল নাম একত্রে এক ক্লিকে কপি করা যাবে
  3. একটি পূর্ণাঙ্গ নমুনা লেখা হিসেবে “অর্থহীন লেখা” পাওয়া যাবে
    • পূর্ণাঙ্গ লেখাটি এক ক্লিকে কপি করা যাবে

কোথায় পাওয়া যাবে এই যন্ত্র?

যন্ত্রটি নিচের লিংক থেকে যে-কেউ বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। ভালো লাগলে Github-এর কোড রেপোযিটোরিতে ⭐ Star দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশও করতে পারবেন।

অচেথন ১৮: স্বর্গ-নরক

পৃথিবীতে কোনো স্বর্গ নেই, তুমি এক নরক থেকে আরেক নরকেই যাবে।
স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে পরপারে…

মঈনুল ইসলাম

(ডিজিটাল চিত্রকলা: মঈনুল ইসলাম, Midjourney AI)

সুন্দরবনে, মরিচঝাঁপি গণহত্যা ১৯৭৯

১৯৪৭-এ ভারত আর পাকিস্তান ভাগাভাগি হবার পরে পূর্ব পাকিস্তান মানে এখনকার বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা ভারতে চলে যেতে থাকেন। তখন নিম্নশ্রেণীর নমশুদ্র হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে জায়গা পাননি। তাদেরকে জায়গা করে দেয়া হয়েছিলো দূরে, দণ্ডকারণ্যের পাথুরে জঙ্গলে। সেখানে টিকে থাকতে না পেরে তারা যখন আবার পশ্চিমবঙ্গে ফেরত আসতে থাকেন, তখন ঐ সময়কার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আশ্বাসে এই উদ্বাস্তু লোকগুলো নিজেদের চেষ্টায় আশ্রয় নিয়েছিলো সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি নামক একটা চরে। সেটা তখন উষর ছিলো, শুধু বড় বড় ঘাস, গরান গাছ গজিয়েছিলো।

সেখানে তারা স্কুল করেছিলো, দোকান করেছিলো, ফার্মেসি ছিলো, পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিলো, চাষাবাদের বন্দোবস্ত করেছিলো। তারা সেখানে বসতি করলেও, পরে এটা একটা অভয়ারণ্য বলে সেই জ্যোতি বসুই দ্বীপের লোকজনকে উচ্ছেদ করতে পুলিশ পাঠান। অথচ, তখনকার ভারত সরকারের মানচিত্রেও এটা কোনো অভয়ারণ্য ছিলো না – ছিলো শ্রেফ একটা চরাঞ্চল।

এই উচ্ছেদ এতোটাই নির্মম ছিলো যে, পুলিশ ঘিরে ধরে তাদের নৌকা ডুবিয়ে দিচ্ছিলো যাতে তারা আশপাশের দ্বীপ, চর থেকে খাবার সংগ্রহ করতে না পারে। পুলিশের গুলিতে, দ্বীপের ঘরবাড়িতে দেয়া আগুনে পুড়ে, খাবার খেতে না পেয়ে, নৌকাডুবিতে পানিতে ডুবে, ক্ষুধার কষ্টে ফাঁসি দিয়ে, জেলহাজতে নির্যাতনে অনেক কষ্টে মারা যায় শত শত দ্বীপবাসী উদ্বাস্তু হিন্দু

ঠিক তার পরদিনই হিন্দুদের বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পূঁজা ছিলো – স্কুলের বাচ্চারা পূঁজার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো সেদিন – কিন্তু পুলিশ সরস্বতীর প্রতিমাও ভেঙে দিয়েছিলো, অনেক বাচ্চাকেও মেরে ফেলেছিলো। অনেকে ক্ষুধার জ্বালায় ঘাস খেয়ে বেঁচেছিলো। কয়েক ট্রাক, লঞ্চ ভর্তি করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। লাশগুলোকে পোড়ানো তো দূরের কথা, মাটি চাপাও পর্যন্ত দেয়া হয়নি, বস্তাবন্দী করে টাইগার প্রোজেক্টে বাঘকে খাওয়ানো হয়েছিলো। বিষয়টা ছিল ডেকে এনে অপমান করবার মতো – আশ্রয় দিয়ে খুন করার মতো জঘন্য ব্যাপার।


মরিচঝাঁপি গণহত্যার এই তথ্যটুকু আমি অল্পবিস্তর লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে জড়ো করেছি – ভুলভ্রান্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক, কারণ আমি ইতিহাসবেত্তা নই। এই বর্ণনায় নিপীড়িতের দৃষ্টিকোণ প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। কিন্তু তৎকালীন স্থানীয় সরকারের কিংবা পুলিশের দৃষ্টিকোণ এখানে প্রকাশ পায়নি। অর্থাৎ এই বর্ণনা একপেশে। মূলত এই লেখার অবতারণা অন্যপক্ষের দৃষ্টিকোণটা জানার আগ্রহ থেকে। আক্রমণ না করে গঠনমূলক আলোচনা প্রত্যাশা করছি…

ছবি ইন্টারনেট থেকে…

জলহিতৈষী আমির খান

আমির খানকে কে না চিনেন! বলিউডের পপুলার মুভিগুলোর পাশাপাশি, মনে ছাপ রেখে দেয়া মুভির নির্মাতা, অভিনেতা – পুরো দস্তুর এক প্যাকেজ তিনি। তাঁর যে অনেক দাতব্য সংগঠন আছে, সেটা আমরা অনেকেই জানি না।

আমাদের দেশে তো এখন সবাই স্টাইলে উঠেছে। কুয়া (well) থেকে কেউ আর পানি তুলে না। টিউবওয়েল (tube well) না হলে যে ইজ্জত থাকে না। আর পানির স্থায়ী সমাধান করবার জন্য মোক্ষম ব্যবস্থা পেয়ে গেছে সবাই – লাগাও ডীপ টিউবওয়েল (deep tube well)। তাও হয় না, হাত দিয়ে চাপ দিলে কি আর ইজ্জত থাকে? মোটর লাগিয়ে মাটির গভীর গভীরতর গভীরতম প্রোকষ্ঠ থেকে শত শত বছর ধরে তিলে তিলে জমানো বিশুদ্ধ পানি, হ্যাঁ মাগনা ফিল্টার করা পানি, তুড়ি মেরে তুলে এনে হাত-পা ধুই।

কিন্তু, এই পাশের দেশ ভারতের অনেক জায়গায় মানুষ ডীপ টিউবওয়েল দিয়েও পানি পান না। শুষ্ক মৌসুমে সরকার থেকে পানির ট্রাক দিয়ে পানি দেয়া হয় শ্রেফ খাবার জন্য – বাকি আর কিছু যদি থাকে, মরে যাও।

আমির খান একটা টকশো উপস্থাপনা করতেন। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন, ভারতের একটা বড় জনগোষ্ঠী সুপেয় পানি এমনকি পান অযোগ্য পানিরও কষ্টে ভুগছে। তিনি ঠিক করেন এই সমস্যার সমাধান খোঁজা দরকার, আর তিনি জানতেও পারেন যে, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানও বের করা সম্ভব। দরকার স্থানীয়দেরকে নিয়ে একটা মস্ত বড় পরিকল্পনা, আর তাদের দুর্বার সহায়তা।

তিনি আর তাঁর স্ত্রী কিরণ রাও প্রতিষ্ঠা করেন “পানি ফাউন্ডেশন” (Paani Foundation)। বিশেষজ্ঞদের জড়ো করেন। পথ বের করেন। গ্রামে গ্রামে পানির পেয়ালা (water cup) তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু করেন। এই কাপ সেই কাপ না, এই কাপ geologic level-এর কাপ – বড় বড় বাঁধ আর তার সামনে ট্রেঞ্চ – permaculture-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ!

তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়, ইনশাআল্লাহ। সব সম্ভব। শুধু একটু হিম্মত করতে হবে। মাত্র ৪৫ দিনে বদলে দিলেন পুরো এলাকার চেহারা… এবং তারও চেয়ে বড় কথা, এই যুদ্ধ শুধু জল পাবার নয়, এই যুদ্ধ একই সাথে বলীয়ান করেছে সেসব অঞ্চলের অর্থনীতিকে, সমাজ ব্যবস্থাকে, শিখিয়েছে সম্মিলিত কাজের সুফল।

১০ মিনিটের এই ভিডিওটা দেখতে পারেন…

আর আমাদের জন্য শিক্ষা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার আগে যেন সাবধান হই… জলকষ্ট বড় কষ্ট – জলকষ্টে যাবার আগে জলের বহুধা ব্যবহার এখনই নিশ্চিত করি, ভূগর্ভস্থ পানির (ground water) থেকে চাপ কমিয়ে ভূপৃষ্টের জল (surface water)-এর বহুধা ব্যবহার নিশ্চিত করি, সন্তুষ্ট থাকি।

– মঈনুল ইসলাম

প্রচ্ছদের ছবি: freepressjournal.in; শুষ্কতার ছবি: indiawaterportal.org; সবুজ ছবি: paanifoundation.in

বই পর্যালোচনা: মসলার যুদ্ধ

ছোটবেলা মসলার যুদ্ধ নিয়ে আমাদের পাঠ্যবইতে কিছু পড়েছিলাম কিনা মনে নেই। কিন্তু রাঁধুনী একবার “মসলার যুদ্ধ” তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছিলো, আর সেখানে সমুদ্রে কয়েকটা অ্যান্টিক জাহাজের একটা দৃশ্য ছিলো। দৃশ্যটা আমার মনে খুব গেঁথেছিলো। কিন্তু তবু ইতিহাসটা অতোটা গভীরে ঢুকে ঘেঁটে দেখার ইচ্ছা আর হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি কোনো একটা কারণে বাংলাদেশের উপকূল নিয়ে আমি একটু গভীরে যাবার চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় তারিফুর রহমান নামের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে বইটি কিনেছিলাম। বইটা কেনা কতটা দারুণ ছিলো বলার জন্য এতটুকু বললেই যথেষ্ট হবে: এক বসায় পড়ে শেষ করেছি

লেখক সত্যেন সেনকে আমি চিনি না। কখনও তাঁর লেখা পড়িনি। কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে আমি তাঁর লেখার প্রেমে পড়ে গেছি। ইতিহাস বই যে এতো দারুণ করে লেখা যায়, আমি এই লেখা না পড়লে কিছুটা হলেও হয়তো অপরিচিতই থেকে যেতাম। আমাদের পাঠ্যবইতে ইতিহাসকে সবচেয়ে বীতশ্রদ্ধ করে ফেলা হয় সালের পরে সাল উল্লেখ করতে করতে। পরীক্ষাগুলোতেও নাম্বার পেতে হলে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সাল মনে রাখতে হয়। এই সাল মনে রাখতে রাখতে ইতিহাসের মতো গল্পের বিষয়, বাস্তব গল্পের রোমাঞ্চকর বিষয় আমাদের কাছে কখনোই রসকষপূর্ণ মনে হয় না। কিন্তু এখানেই সত্যেন সেনের কৃতিত্ব: তিনি লেখায় সালের উল্লেখ কিছু করেছেন বৈকি, কিন্তু পুরো বইটাই তিনি শ্রেফ গল্পাকারে বাস্তব ঘটনাগুলোই বিধৃত করেছেন। একেবারে নিরেট গল্প – বাস্তব ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ।

বইটিতে তিনি পর্তুগীজদের, ডাচদের (ওলন্দাজদের), ইংরেজদের, আরবদের, ভারতীয়দের, চীনাদের – সবার কথাই নিয়ে এসেছেন। কার কোন গুণ তাদের কিভাবে এগিয়ে দিচ্ছিলো – সেটাও উল্লেখ করেছেন, আবার কার কোন দোষের কারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছিলো – সেটাও উল্লেখ করেছেন। এবং মসলার যুদ্ধের পেছনের গল্পটা বুঝতে হলে যে আপনাকে ক্রুসেডের গল্পটাও জানতে হবে – এটাতেও লেখকের অসাধারণ মুন্সিয়ানারই পরিচয় পাওয়া গেছে।

বইটা কেনার সময় রকমারি.কম-এ যখন সার্চ করি, তখন দুটো বই ইন-স্টক দেখাচ্ছিলো, তখন তুলনামূলক অপরিচিত প্রকাশনীর বদলে ঐতিহ্যবাহী মুক্তধারা প্রকাশনীকে এগিয়ে রেখেছিলাম। ৳১০[টাকা] বেশি দিয়ে হলেও এঁদের বই কিনেছিলাম। কিন্তু কেনার পরে যার-পর-নাই বিরক্ত হয়েছি। মুক্তধারার বই মানে একসময় শুধু নিউজপ্রিন্টের বই পেতাম। এই বইটা দেখলাম অফসেটে প্রিন্ট করা – ঐটুকুই সার হয়েছে। বইটাতে আমার কাছে কোনো যত্নের চেষ্টা করা হয়নি বলেই মনে হয়েছে। বইয়ে প্রচুর বানান ভুল পেয়েছি। ঐতিহাসিক বইয়ে বানান ভুল একটু গুরুতর অপরাধ মনে হয় আমার কাছে, কারণ অনেক নাম শুধু বানান ভুলের কারণে তথ্যের অনুসন্ধানযোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। অথচ এটা ছিলো ১৯৮০’র প্রথম প্রকাশের পর বইটির পঞ্চম প্রকাশ। পাঁচ বারেও বানান ভুল সংশোধনের কি কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি?

চকচকে একটা প্রচ্ছদ করার চেষ্টা করা হয়েছে – যেটা এই বইয়ের অ্যান্টিক মূল্যকে শ্রেফ জলাঞ্জলি দেয়ার নামান্তর হয়েছে – কোথায় পর্তুগীজ ক্যারাভেল, ক্যারাক, গ্যালিয়ন – আর প্রচ্ছদে দেখা যায় একটা ডিজিটাল নৌকা থেকে কামান দাগা হচ্ছে – শ্রেফ বিরক্ত হয়েছি এই প্রচ্ছদে।

এরকম একটা ঐতিহাসিক বই, মূল বইতে না থাকলেও পরবর্তী মুদ্রণ কিংবা সংস্করণে বাড়তি কিছু জিনিস যোগের দাবি রাখে। যেমন: ঐসময়কার [নিদেনপক্ষে একটা] মানচিত্র, কিংবা উল্লেখিত দেশগুলোর অবস্থান এবং সমুদ্রপথে গমনাগমনের পথ উল্লেখ করে একটা আধুনিক মানচিত্রও দেয়া যেতো। কিছুই নেই – লেখকের মূল গল্পের সাথে কিছুই যোগ করার প্রয়াস তো ছিলোই না, উল্টো নিজের সুনামের ডঙ্কা বাজিয়ে ৳১০[টাকা] বেশি দাম ধরে বিশ্রী প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরকম একটা অসাধারণ বইতে বিন্দুমাত্র উপযোগ যোগ না করে পঞ্চম মুদ্রণ অবধি পথচলায় মুক্তধারার প্রতি আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি।

আমি বই পড়ি খুব ধীরে। কিন্তু ৭০ পৃষ্ঠার অসাধারণ এই বইটি আমি এক বসায় শেষ করতে পেরেছি – এক বসায় শেষ করা এটা আমার দ্বিতীয় বই। বইটা আমার এতোটাই ভালো লেগেছে, কিংবা বইটা ভালো লাগার মতোই একটা বই বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শেষ করবো বইটার একটা অসাধারণ উক্তি দিয়ে। লেখক লিখেছেন:

…যুগ যুগ ধরে এই রীতিই প্রচলিত হয়ে আসছে। পররাজ্য লুণ্ঠন বা জয় করবার জন্যই হোক, অথবা মানুষকে অত্যাচার বা শোষণ করবার জন্যই হোক, কি খ্রীস্টান, কি হিন্দু, কি মুসলমান সকলের [ঈশ্বরকেই] ভক্তদের সঙ্গে এই কাজে শরীক হতে হয়। অতীতেও তাঁদের (ঈশ্বরদের) এই দায়িত্ব ছিল, বর্তমানেও তা শেষ হয়ে যায় নি।

সত্যেন সেন (মসলার যুদ্ধ)

বই: মসলার যুদ্ধ
লেখক: সত্যেন সেন
মূল্য: ৳১২৫.০০
আইএসবিএন: 978-984-8858-86-8

মঈনুল ইসলাম

সোঁদরবনের সুপেয় জল

সুন্দরবনের করমজলের ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর, বাকপটু মানুষ। নিজেকে পরিচয় দিলেন, বন বিভাগের ‘ওসি’ হিসেবে। টুকটাক লেখালেখির বাতিক আছে বলেই মুখে খইও ফোটে বোঝা গেলো। আমাদেরকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আজাদ সাহেব। চা চলছে, আর ওদিকে আমাদের আশেপাশেই বানরদের পুরো একটা বহর – সুযোগ পেলেই খাবার ছিনিয়ে নিতে হাজির। এইমাত্র তাদেরই দুরন্ত একটা তো সবার অলক্ষে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘাঢ়ে পাড়া দিয়ে গেলো…

আমাদেরই কোনো এক প্রশ্নের উত্তরে আজাদ সাহেব চা-বিক্রেতা নারীকে দেখিয়ে বলছিলেন, “এখন তো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, আমরাই আমাদের জন্য (বন বিভাগের কর্মীদের জন্য) সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানি থেকে এদেরকে (হকারদেরকে) দেই। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এরা নিজেরাই মোংলা থেকে পানি সাথে করে নিয়ে আসে।”

নতুন করে আবিষ্কার করবার কিছু ছিলো না – ঘরের চাল থেকে চুইয়ে নামা বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে বন-জীবন যায় এখানকার বনবিভাগের কর্মকর্তাদের। আমার এক সঙ্গী জিজ্ঞেস করলেন, “চালের ময়লা, গাছের পাতা এগুলো পানিতে পড়ে যায় না?”

আজাদ সাহেব সরলভাবেই উত্তর করলেন, “ওগুলো পানির নিচে গিয়ে জমে থাকে।” একটু থেমে যোগ করলেন, “শুধু কি পাতা? বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন? ওসব চিন্তা করলে কি আর চলে?”

বলছিলেন, “বৃষ্টির পানি খেতে খেতে এখন আর বাড়ি গেলে পানি খেতে ভালো লাগে না”। ফেরার পথে সুন্দরবন আর বাঘ নিয়ে নিজের লেখা কম্পিউটার কম্পোজ করা কয়েক তা কাগজ ধরিয়ে দিলেন আমাদের হাতেও।

পানীয় জল নিয়ে যখন কথা হচ্ছিলো, তখনই পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পশুর নদ – একটু উজানেই সে রূপসা আর মোংলা নদীর সব জল একত্র করেছে – শত শত লিটার জল নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সে, গন্তব্য বঙ্গোপসাগর। নদীগুলোতে নাব্যতা কম, কিংবা ভারত, চীনে একাধিক বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে স্রোত কম থাকায় বঙ্গোপসাগরের নোনা জল প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার ঠেলে উঠে এসেছে এই মোংলা অবধি। এখানকার নদীর পানি, ভূগর্ভস্থ পানি সবই তাই নোনা। শুষ্ক মৌসুমে এখানে মানুষ সুপেয় পানি কিনে খায়।

পশুর নদ ধরেই জালিবোটটা আমাদেরকে নিয়ে ফিরতি পথ ধরলো। বিশাল নদের জলস্রোত ঠেলে ফেরার পথে একটু নীরবতা… ভাবছিলাম, টয়লেটের সিস্টার্ন থেকে যে জলটুকু ভুশ্‌ করে ঢেলে দেই নোংরা পরিষ্কারের জন্য, সেই জলটুকু কিন্তু নোনা না – মিঠাপানি। আর এই মিঠাপানির জন্যই এতো হাহাকার! থেমে থেমে একটাই কথা বারবার উঁকি দিচ্ছিলো আমার মনে:

“বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন?”

“বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন?”

বই পর্যালোচনা: সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে

তখনও আমার বাসায় ইন্টারনেট ছিলো না; বন্ধু নাকিবের থেকে কয়েকটা ডকুমেন্টারি নিয়ে এসেছিলাম; তারই একটা ছিলো “Man-Eating Tigers of The Sundarbans” – দেরি না করে দেখতে বসে গিয়েছিলাম। আর একটু পরে যখন দেখলাম ভিডিওটাতে বাংলাদেশের পাশাপাশি একজন বাংলাদেশীই মূল উপজীব্য – তখন আগ্রহটা আরো বেড়ে গিয়েছিলো। বলছি মনিরুল খানের কথা। তিনি ২০০৪-এ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঘ-এর উপর পিএইচডি ডিগ্রী নেন। অনেক দেরিতে হলেও তিনি বাঘ নিয়ে বাংলায় একটি বই লিখলেন। যদিও তিনি এর আগে ইংরেজিতে লিখেছেন, কিন্তু সেগুলো কখনও পড়া হয়ে উঠেনি।

বইয়ের নাম: “সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে”
প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন

যাঁর বই পড়ছি, তাঁকে যেহেতু আগে থেকে চিনতাম, তাই বইটার আবেদন অন্যরকম ছিলো। তবে মনিরুল খানকে দেখলে একটাই কথা আমার সব সময় মনে হয়, এই ব্যক্তি হাসতে জানেন না। আর যিনি হাসতে জানেন না, তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ আমার অর্ধেকে নেমে আসে। কিন্তু এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমার অর্ধেক আগ্রহ নিয়েও বইটা পড়ে যাই…

যেহেতু বাঘ দেখাই এই বইয়ের মূল উপজীব্য, তাই শুয়ে-বসে-দৌঁড়ে-সাঁতরে-সাইক্লোনে পর্যুদস্ত হয়ে বিভিন্নভাবে লেখক আর সঙ্গীরা বাঘ দেখেছেন। বাঘ দেখার মূল কারণ ছিলো, এটা তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো – বাঘ নিয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রী নিবেন, তাই বাঘকে পর্যবেক্ষণ করেই তো গবেষণা অভিসন্দর্ভ লিখতে হবে। লেখক সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। বিভিন্ন ছুতায় তিনি সুন্দরবনের বাঘকে দেখেছেন, দেখতে চেয়েছেন।

বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন আরেকজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরী। প্রাঞ্জল ভূমিকাংশ পেরিয়ে “বাঘের হাতছানি” নামক লেখা দিয়ে লেখক তাঁর লেখার অবতারণা করেন। সেই পঞ্চাশের দশকে মধুপুর গড়ে তাঁর বাবার বাঘ দেখা দিয়ে শুরু। তারপর ১৯৯৫-এর অক্টোবর মাসে তাঁর পা পড়ে সুন্দরবনে, আর এর পর একের পর এক শুধু বাঘেরই গল্প। লেখক বলছিলেন, “দীর্ঘদিন সুন্দরবনে ঘুরাঘুরি করেও আপনি বাঘ না-ও দেখতে পারেন। কিন্তু বাঘ আপনাকে ঠিকই দেখবে।”

লেখক বাঘ দেখার ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি জেলে-বাওয়ালি-মৌয়ালদের বাঘের আক্রমণ থেকে ফিরে আসার গল্পও শুনিয়েছেন। প্রতিটা অধ্যায়েই আছে কিছু সাদাকালো ছবি – যেহেতু নিজে তিনি একজন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীও, তাই জুৎসই ছবিগুলোও বাড়িয়ে দিয়েছে বইয়ের মর্যাদা। অনেক বাঘের গল্প-ছবির মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ঐ ছোট্ট ব্যাঘ্রশাবকটাকে – কী সুন্দর তুলতুলে চেহারা – অথচ কী ভয়ংকর এক শিকারী হতে চলেছে সে…।

বনে যেহেতু আছেন একজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, তিনি যে শুধু বাঘই দেখেছেন, তা কিন্তু না। তিনি বাঘের পাশাপাশি অন্য প্রাণীদেরকেও যে দেখছিলেন, সেটা লেখার পরতে পরতে বোঝা যায়। তবে বাঘের গল্পে সীমাবদ্ধ থাকতে গিয়ে সেসব বর্ণণা তিনি দীর্ঘায়িত করেননি। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বাঘেদের বিভিন্ন স্বভাব – একটা নিতান্ত ছোট্ট ফিঙে (ব্ল্যাক ড্রঙ্গো) কিভাবে সুন্দরবনের রাজা বাঘকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো – সেই দৃশ্যই কলমবন্দী করেছেন লেখক গবেষক মনিরুল খান।

লেখক লিখেছেন,

আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম পরে যখন কেউ বইটি পড়বে, আমার অভিজ্ঞতাগুলো জানবে, তত দিনে বাঘ আর সুন্দরবনের কী অবস্থা দাঁড়াবে জানি না। …এই বই সাক্ষ্য দেবে, আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম।

আমার মতে, বইটিতে অনেক অনেক বাঘ দেখার বর্ণনা থাকলেও একজন গবেষক এভাবে বাঘকে পর্যবেক্ষণ করলে বাঘের কী উপকার হয়, তা আমি বুঝলেও সাধারণ পাঠকের কাছে তা পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন লেখক – ভবিষ্যত সংস্করণে লেখার বিভিন্ন পরতে এই পর্যবেক্ষণ কিভাবে বাঘের আবাস, বিচরণ, নিরাপত্তা, মানুষের সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত করবে, লেখক তারও উল্লেখ করবেন বলে আমার অনুরোধ – তাহলে সাধারণ পাঠক বাঘ দেখার সাথে বাঘ গবেষণার সম্পর্কের সুতাটা টানতে পারবেন।

যারা সুন্দরবন ভালোবাসেন, সুন্দরবনে আগ্রহ রাখেন, ভালোবাসেন বাংলার গর্ব, প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে, বইটা আমি বলবো তাদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। প্রথমা প্রকাশন থেকে যেহেতু প্রকাশিত, তাই বানান, বিন্যাস আর বইয়ের পাতা থেকে শুরু করে বাইন্ডিং পর্যন্ত যত্নের ছাপ দেখা যায়। বইটির দাম ৳২২০।

অহাস্য বদনের মনিরুল খান আমাকে হাসি দিয়ে জয় না করতে পারলেও জয় করেছেন তাঁর কাজ দিয়ে। সুন্দরবন গবেষণা যে যেনতেন কাজ নয়, তা শুরুতেই খসরু চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই অসাধ্য সাধনকারী উল্লেখযোগ্য একজন ব্যক্তির বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় কোনো নিবন্ধ নেই দেখে আমি যার-পর-নাই হতাশ হয়েছি। তাই কালবিলম্ব না করে লেখকের জন্য একটি বাংলা উইকিপিডিয়া ভুক্তি তৈরি করতে দ্বিধা করিনি। বইটি লিখে তিনি যেমন আমাকে আলোড়িত করেছেন, তেমনি তাঁর প্রতি ভালোবাসাস্বরূপ আমার তরফ থেকে থাকলো এই উইকিপিডিয়া নিবন্ধটি: https://bn.wikipedia.org/wiki/মনিরুল_খান ❤ (উন্মুক্ত লাইসেন্সে একটা ছবি পেলে সোনায় সোহাগা হতো)

– মঈনুল ইসলাম


বই: সুন্দরবনে বাঘের সন্ধানে
মনিরুল খান
প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০২১
মূল্য: ৳২২০.০০
আইএসবিএন: 978-984-95400-7-6

কীর্তিনাশার বুক চিরে এফোঁড়-ওফোঁড়

সৌন্দর্য, বিশুদ্ধতা, আর ক্রমোন্নতির প্রতীক, পবিত্র ফুল ‘পদ্ম’ (Lotus) – সংস্কৃত সেই ‘পদ্ম’ই কি বিদেশীদের বুলিতে হয়ে গেছে পদ্মা (Padma)? উজান থেকে ধেয়ে আসা গঙ্গা আর যমুনা একত্র হয়ে যেনবা আরো এক তেজস্বিনী সে। রাজা রাজবল্লভ (১৭০৭-১৭৬৩) ‘রাজনগর’ পরগণার বিরাণ ভূমিতে নবরত্ন, সপ্তরত্ন, একবিংশ রত্ন প্রভৃতি নামে যেসব সুউচ্চ অট্টালিকার কীর্তি গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, সেই স-ব কীর্তি ১৮৭০-এর দিকে এমন এক নদী এসে গ্রাস করে ফেলে, ১৭৮০ সালে প্রণীত ব্রিটিশ ভূজরিপবিদ বেনেল সাহেবের মানচিত্রেও যার অস্তিত্ব ছিলো না। তাক লাগানো সেসব কীর্তির বিনাশ থেকেই সেই নদীর নাম হয় ‘কীর্তিনাশা’ – ‘পদ্মা’ বললে যাকে চিনবেন অনেকেই।

বইয়ে-পত্রে নদীর গতিপথ হয় চার প্রকারের। সাধারণত প্রাকৃতিক জলধারা এক্কেবারে সরল-সোজা (Straight) হয় না; হলেও খুব অল্প দূরত্ব পর্যন্তই সেটা হয়ে থাকে। কিন্তু নদীর সর্পিলতা (sinuosity) বা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলার কারণে চলমান জলধারা যখন বাইরের দিকটাতে ধাক্কা দিয়ে ক্ষয় করে ফেলে, তখন ভেতরের দিকটাতে জলের চাপ কম হওয়ায় সেখানে পলি জমে হয়ে যায় আঁকাবাঁকা (Meandering)। এমন নদীরা তাই সময়ের বিবর্তনে কোথা দিয়ে বয়ে গিয়েছিলো, তার ছাপও রেখে যায়। সেই আঁকাবাঁকা নদীও আবার কোনো কোনো অংশে চুলের বেনীর (Braided) মতো অসংখ্য ছোট ছোট ধারায় রূপ নিতে দেখা যায়। সাধারণত বেশি ঢালু কিংবা বেশি পলিময় নদীর ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা যায়। এরকম জলধারার মাঝখানে জেগে থাকে ছোট ছোট অস্থায়ী দ্বীপ, যেগুলোকে braided bars বলা হয়ে থাকে। আবার বিবর্তনের ধারায় বেনীর মতো আলাদা জলধারার কিছু কিছু আবার একত্র (Anastomosing) হয়ে বড় হয়ে যায়।

আমাদের পদ্মা মূলত আঁকাবাঁকা নদী, যা সময়ের বিবর্তনে কোথাও নিজের বেশি বড় বাঁকের চূট কেটে (chute cutoff) আবার সোজাও হয়ে যায়। কোথাও আবার গভীরতা কিংবা পলির আধিক্যে সে বেনীর মতোও হয়, আবার পরক্ষণে হয়তো পানির তীব্র তোড়ে হয়ে যায় একত্র। কিন্তু পদ্মা নদীর এতো পলি আসে কোত্থেকে? বিজ্ঞানীদের ধারণা ১৯৫০-এর আসাম-তিব্বত ভূমিকম্পের কারণে যে ভূমিধ্বস হয়েছিলো, তা-ই অর্ধশতাব্দি ধরে বয়ে চলেছে পদ্মা।

পদ্মা নদীর গতিপথের বিবর্তন: ১৯৮৮-২০১৮ (নাসা আর্থ অবযারভেটরি)

উপরের এই ছবি হলো দ্যা মাঈটী পদ্মার সবচেয়ে ক্ষয়িষ্ণু অঞ্চল – ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নাসা’র ল্যান্ডস্যাট ৫, ৭ ও ৮ স্যাটেলাইট দিয়ে তোলা ১৪টি ছবির সমন্বিত রূপ। নদীর বামের পয়েন্টটা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, আর ঠিক মাঝখানের পয়েন্টটা মাদারিপুরের চরজানাজাত। এই চরজানাজাতের অংশটিতে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, কতটা বিবর্তিত হয় পদ্মা সময়ে সময়ে।

অথচ এখানেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ু সেতু: পদ্মা সেতু (Padma Bridge)। বোঝাই যাচ্ছে কতটা চ্যালেঞ্জিং কাজটা। এই খরস্রোতা পদ্মার ক্ষয়িষ্ণু বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে একটা সংযোগ সেতু করাটা অনেকের কাছেই মনে হয় অসম্ভব। আশার কথা হলো, গবেষণা বলছে, পদ্মার ক্ষয় এখন আর আগের মতো নেই – আগের তুলনায় ক্ষয়ের মাত্রাটা এখন অনেক কম। তাই কেউ কেউ বলেন, সেতুটা হলে বরং সুফলই মিলবে – সেতুর কারণে সেখানকার ভুমিক্ষয় কমবে।

যুগ যুগ ধরে দুটো আলাদা নদীর ঔরসজাত সন্তান হিসেবে বয়ে চলা পদ্মার বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়া এমন মানবকর্ম অবশ্যই উচ্চাভিলাষী – এক অনবদ্য কীর্তি। তবে মানুষের কর্ম চিরঞ্জীব নয়; অনেক প্রতীক্ষার পদ্মা সেতুর জন্য এই নদী যেন আবার ‘কীর্তিনাশা’ না হয়ে উঠে – এটাই প্রত্যাশা।

প্রচ্ছদের ছবি: নাসা আর্থ অবযারভেটরি

তথ্য সহায়তা

  • প্রাথমিক নথি: নাসা আর্থ অবযারভেটরি
  • কীর্তিনাশা ও রাজবল্লভ – তানিম জুবায়ের; ১৯ জুলাই ২০১৯; ভুসুকু পার দিনলিপি
  • বাংলাপিডিয়া এবং উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন নিবন্ধ
  • নদীর চূট কাটা: ইউটিউব ভিডিও – চ্যানেল: Wout van Dijk
  • নদীর পাড়ক্ষয়ের চার প্রকার – lrlr.landscapeonline.de
  • নদী কেন বাঁক নেয়: ইউটিউব ভিডিও – চ্যানেল: MinuteEarth

একজন য়িন য়্যুজান আর সর্ববৃহৎ মরু জঙ্গল

শুভ সকাল পৃথিবী!

ধুলি ধুসরিত ভূমির উপর দাঁড়িয়ে চীনের উত্তরে গবি মরুভূমির বাসিন্দারা যখন দেখেন, মরু শুধু মরুই নয়, সেই মরু দিনের পর দিন শুধু বড়ই হচ্ছে, আর গ্রাস করে নিচ্ছে নিজেদের সবকিছু… দিনে দিনে শুষে খেয়ে ফেলছে বেঁচে থাকার সব রসদ… তখন তাদের মাঝেই একজন দাঁত কিড়মিড় করে বেঁকে বসলেন: নাহ, আর নয়, উষর মরুকে করিবো উর্বর!

এশীয় ধুলিঝড়, এশিয়া, আফ্রিকা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় আমেরিকা অবধি (ছবি: নাসা)

য়িন য়্যুজান নিজের গবাদি পশু বিক্রী করে ৬০০ চারা কিনে মরুভূমির বুকে গাছ লাগানোর এক অকল্পনীয় যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিলেন। তাঁর স্বামীর সহায়তায় গাছ লাগাতে পারলেও মরুর ধুলিঝড়ে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১২টি গাছ টিকতে পেরেছিলো। ঐ ১২টি গাছকে সম্বল করে বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে তার বিনিময়ে গাছের চারা নিয়ে ৩০ বছর ধরে মরুর জলহীন নড়বড়ে, অস্থির বালুতে লাগিয়ে গেছেন গাছ। শুরুতে তিনি Willow আর Poppler লাগালেও এদের আয়ুষ্কাল কম হওয়ায় পরবর্তিতে উনি পাইন গাছ লাগাতে শুরু করেন।

য়িন য়্যুজান-এর এই যজ্ঞ বৃথা যায়নি; তাঁর কাজ সরকারকে আকৃষ্ট করেছে। তারা বুঝতে পারলো মরুকেও জঙ্গল বানানো যায়। ১৯৭৮ সালে “থ্রি নর্থ শেল্টার ফোরেস্ট প্রোগ্রাম” নামক ২০৫০ সাল অবধি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বনায়ন কার্যক্রম হাতে নিলো সরকার। ২০০৯ সাল অবধি ৫,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে মানুষ মরুকে জঙ্গলে রূপান্তর করতে পেরেছে। কোটি কোটি চারা রোপনের মাধ্যমে মরুভূমিকে জঙ্গলে রূপান্তরের এই মহাযজ্ঞ এখনও চলছে সেই দেশে।

যেহেতু মরুতে গাছ গজানোটা প্রাথমিক লক্ষ্য, তাই এখানে আসলে মনোকালচার করা হচ্ছে: মানে একজাতের গাছ দিয়েই জঙ্গল তৈরি করা হচ্ছে। আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরিতে এটা আবার অতোটা সহায়ক না; গাছ, ফুল-ফলের বৈচিত্র্য না থাকায় এসব জায়গায় পাখি বাস করতে চায় না। তাছাড়া মরুতে মাটির নিচের পানি যাও আছে, এসব আগ্রাসী গাছ তা শুষে আরো নিঃশেষ করে দিতে পারে বলেও অনেকে ক্রিটিসাইয করেছেন এই প্রকল্পকে।

কিন্তু দিন শেষে, জঙ্গল যে জল ধরে রাখে, জমিকে উর্বর করে, আর এই জঙ্গল সাফ করে মনোকালচার থেকে বেরিয়ে এসে অন্য গাছের বৈচিত্র্য দিয়ে নতুন জঙ্গল তৈরি করার একটা রাজপথ তৈরি করে দিচ্ছে এই উদ্যোগ – তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।

এই মহাযজ্ঞ সম্বন্ধে জানা যাবে রয়টার্স-এর এই ভিডিও থেকে…

মঈনুল ইসলাম

তথ্য-উৎস

  • বিভিন্ন বার্তা-সংস্থার ইউটিউব ভিডিও এবং প্রতিবেদন
  • মূল বিষয়বস্তু: https://en.wikipedia.org/wiki/Great_Green_Wall_(China)
  • য়িন য়্যুজান-এর উইকিপিডিয়া নিবন্ধ: https://en.wikipedia.org/wiki/Yin_Yuzhen

প্রচ্ছদের ছবি: china.org.cn

শুয়ান ৎসাং-এর অলৌকিক ঘটনা

“শুয়ান ৎসাং” নামটা শুনে আপনি হয়তো থমকে যাবেন। কিন্তু আমি যদি “হিউয়েন সাঙ” বলি তাহলে হয়তো তাঁকে কেউ কেউ চিনেও থাকতে পারেন, নিদেনপক্ষে পাঠ্যবইতে কোনো না কোনো সময় পড়ে থাকবেন তাঁর নাম। তিনি হলেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, যিনি মুহাম্মদ [স.]-এর মৃত্যুর বছরদুয়েক আগে, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে ভারতে এসেছিলেন শ্রেফ বৌদ্ধ পুঁথি সংগ্রহ করবার জন্য, বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা করবার জন্য। কিভাবে এসেছিলেন, তা বিশাল গল্প – সে অন্যসময় করা যাবে। আজ শুনি তিনি ভারত আসার পরে কী ঘটেছিলো।

সেই সুদূর চীন থেকে ভারত আসতে, পথে বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা বার কয়েক ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলেন; কিন্তু শুধু ভারতেই তাঁরা ডজনখানেকবার ডাকাতির সম্মুখিন হয়েছিলেন। একবার তো প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরেছেন কোনোমতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গঙ্গা’র তীরে এসে কোনো একসময় তিনি ধরা পড়ে গেলেন আরেকদল ডাকাতের হাতে। এরা আবার দেবী দূর্গার উপাসনা করে, আর দূর্গার জন্য নরবলী দেয়াতে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করতো, দেবী দূর্গার প্রাসাদ হলো এই গঙ্গার উজানে, বরফে ঢাকা পর্বতের কোথাও…। শুয়ান ৎসাং-কে শান্তশিষ্ট মানুষ দেখে তাদের বিশ্বাস জন্মালো, যদি এঁকে দেবীর জন্য বলী দেয়া যায়, তাহলে দেবী তাদের প্রতি সদয় হবেন। শুয়ান ৎসাং বুঝে গেলেন, এখানেই ইতি ঘটতে চলেছে তাঁর কাঙ্ক্ষিত ভারত ভ্রমণের… তাঁর আর বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা করা হবে না…

ডাকাতেরা যখন বলি দেয়ার মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করছে, শুয়ান ৎসাং তখন জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে শান্তশিষ্ট হয়ে বসে, ধর্মে শেখা বিভিন্ন শ্লোক যপ করতে থাকলেন একমনষ্ক হয়ে…

সময় যায়… শুয়ান ৎসাং-এর মৃত্যুর ঘন্টা বাজতে থাকে…

কিন্তু শুয়ান ৎসাং-এর প্রার্থণা কাজে লাগে – একসময় তীব্র বাতাস বইতে শুরু করে… বাতাসের তোড়ে গাছ ভেঙে পড়তে থাকে… নদীতে ডুবে যায় নৌকা…

ডাকাতেরা ভয় পেয়ে যায় যে, দেবী বোধহয় রুষ্ট হয়েছেন তাদের কাজে; আর মুক্তি পেয়ে যান শুয়ান ৎসাং।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বৌদ্ধধর্মে কোনো ঈশ্বর ধারণা নেই। কোনো ধর্মকে হেয় করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয় – এটা শুয়ান ৎসাং-এর জীবনী থেকে পাওয়া একটা ছোট্ট ঘটনামাত্র। জানে বেঁচে গিয়ে শুয়ান ৎসাং-এর পরের গন্তব্য নালন্দা মহাবিহার… সে গল্প আরেকদিন…