সুভাষচন্দ্র অন্তর্ধান এবং শেষ কথা

সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনা জানলাম। জানলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা-কাহিনীতে কিভাবে তিনি এলেন। জানলাম, অন্তর্ধানের ১৯ বছর পরে নেহরুর মরদেহের পাশে তাকে দেখা গিয়েছিলো – বলছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর। কিন্তু ঘটনাটা কী? হচ্ছেটা কী?

সুভাষচন্দ্র অন্তর্ধান অনুসন্ধান

সুভাষচন্দ্র বসু’র মৃত্যুর ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধীও সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ বিমানধ্বস থেকে বেঁচে ফেরা সুভাষচন্দ্রের সহযাত্রী হাবিবুর রহমান-এর সাথে কথা বলার পর গান্ধিজী মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হোন।

কিন্তু সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না। অবশ্য পুরো দোষ তাদেরকেও দেয়া যায় না, সুভাষ বসুর মৃত্যু নিয়ে যে কিছু প্রশ্ন ছিলো – তা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। তাছাড়া নেতাজি’রও কিছু অভ্যাস ছিলো যা সন্দেহের তীর তাঁর দিকে দিতে বাধ্য করে। যেমন: ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় গৃহবন্দী দশা থেকে নিজের বেশ বদলে পালিয়ে আফগানিস্তান আর সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে তিনি জার্মানি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এছাড়া সুভাষচন্দ্র বসুর অনুসারীদের কাছে তাই তাঁর জীবিতাবস্থার গুরুত্বটাই বেশি বলে শুরু হলো একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের (conspiracy theory) আবির্ভাব।

এই যে নেহরুর মরদেহের পাশে সুভাষচন্দ্রকে দেখতে পাওয়া – এটাও ছিলো তেমনই একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কিন্তু আপনারা বলতেই পারেন, ছবি তো আর “তত্ত্ব” না – বাস্তব প্রমাণ – সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এতোটুকু জানিয়ে রাখতে চাই যে, মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করা হয় ১৯৪৮-এ। সেই মহাত্মা গান্ধীর দাহ অনুষ্ঠানেও নাকি উপস্থিত ছিলেন নেতাজি।

শুধু তাই না নেতাজি বেঁচে আছেন – অনুসারীরা এমন বিশ্বাসকে পোক্ত করবার জন্য “সুভাষবাদি জনতা” নামে সংগঠনও বানিয়ে ফেলে, সেখান থেকে পত্রিকা প্রকাশ করে সেই মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করে।

এসব ধুম্রজাল কাটাতে প্রথম উদ্যোগটা খোদ ব্রিটিশ সরকারই নিয়েছিলো। মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় তারা জাপানকে অনুরোধ করে একটি তদন্ত করায়; ৩ সপ্তাহান্তে সেই তদন্তের সারমর্ম ছিলো: ১৮ আগস্ট বিমান দুর্ঘটনা হয়, আর সে রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু ভারতীয়রা এই প্রতিবেদন মানেনি, কারণ তাঁর সহযাত্রীরা তাঁর লাশ দেখেননি, আর জাপানীরাও তাঁর মরদেহের ছবি ছাপেনি।

প্রায় ১ বছর পরে হরীন শাহ নামক একজন ভারতীয় সাংবাদিক আরেকটি তদন্ত করে বই আকারে প্রকাশ করেন: “Verdict from Formosa: The Gallant End of Netaji”। কিন্তু হরীন শাহ-এর এই বই ভারতীয়দের কাছ অব্দি পৌঁছেনি সেসময়।

এদিকে ধুম্রজালের শেষ নেই দেখে ১৯৫৬-তে ভারত সরকার, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর প্রাক্তন মেজর জেনারেল শাহ নাওয়াজ খান-এর অধীনে আরেকটি তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তিনি নেতাজির বড় ভাইকে সাথে নিয়ে তদন্ত করেন এবং ৬৭জন প্রত্যক্ষদর্শীর স্বাক্ষ্য নেন, যার মধ্যে নেতাজির ডান হাত হাবিবুর রহমানও ছিলেন। সেই তদন্তের সারমর্মও ছিলো: বসু বিমান দুর্ঘটে মৃত্যুবরণ করেন। সেই প্রতিবেদন ভারতের সংসদ গ্রহণ করে নেয় ঠিকই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নেতাজির ভাই এই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর না করে ১ মাস পরে অন্য আরেকটি প্রতিবেদন নিজেই জমা করায় আবার চলতে থাকে ধুম্রজাল: সেখানে তিনি ভাইকে জীবিত দাবি করেন।

শাহনাওয়াজ কমিশন প্রতিবেদন করতে তাইওয়ান যাননি, কারণ তখন ভারত-তাইওয়ান কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়নি। কিন্তু কেন তাঁরা তাইওয়ান গেলেন না, এজন্য এই প্রতিবেদন লোকে গ্রহণ করলো না, ধুম্রজালে মজে থাকলো।

বাধ্য হয়ে ১৯৭০-এ ইন্দিরা গান্ধী সরকার বিচারপতি জি ডি খোসলাকে তদন্তের দায়িত্ব দেন, সাথে ছিলেন প্রস্তাবকারী রাজনীতিবিদ সমর গুহ। তাঁরা কিছুই বাদ রাখেননি, তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনাস্থলে গেছেন, দাহ করা শ্মশানে গেছেন, ২০০’র বেশি লোকের স্বাক্ষ্য নিয়েছেন, এমনকি জাপান, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াও গিয়েছেন। তাঁরা যদিও কিছু বিচিত্র ঘটনা শুনেছেন, তবে শেষ পর্যন্ত সারমর্ম দিয়েছেন: বসু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু তবু ধুম্রজাল কাটেনি।
তার কারণ, ঐ সমর গুহকে ইন্দিরা গান্ধী জেলে বন্দী করে ফেলায়, উনি নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। আর সেসময়ই “গুমনামি বাবা” তত্ত্ব সামনে আসতে থাকে: যেখানে নেতাজি একজন সাধু দরবেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিন্তু সেটাই।

শেষ পর্যন্ত বাজপায়ী সরকার মুখার্জি কমিশন গঠন করে আরেকবার তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জি তাঁর প্রতিবেদনে আগের সব প্রতিবেদন অস্বীকার করে ৩টি প্রশ্ন করেন:

  1. এটা কিভাবে সম্ভব যে, প্লেন নিচে পড়লো, পাইলটরা মরে গেলো, নেতাজিও মরে গেলেন, কিন্তু বাকিরা বেঁচে গেলেন?
  2. পরের দিন প্রথম সারির দৈনিক সেন্ট্রাল ডেইলি নিউজ কোনো খবরই ছাপায়নি কেন?
  3. নেতাজির কোনো মৃত্যু সনদ বা ডেথ সার্টিফিকেট নেই কেন?

কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকলেও তিনি জানার চেষ্টা করেননি, কিংবা জানতে চাননি:

  1. আগের সব প্রতিবেদনই বলছিলো, প্লেন ২০-৩০ মিটার উপর থেকে পড়েছে, তাই কিছু মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব নয় (এমনকি কিছুদিন আগেই বিমানধ্বসে আমাজনে ৪ শিশু বেঁচে গিয়েছিলো, যদিও পাইলট আর তাদের মা মারা গিয়েছিলেন)
  2. সেন্ট্রাল ডেইলি নিউজ প্রথম সারির সংবাদপত্র হলেও “তাইয়ান দিদি সিম্পাওঁ” আর “তাইওয়ান নিচি নিচি সিম্বুন” পত্রিকাগুলো ঠিকই তাঁর মৃত্যুর খবর ছেপেছিলো।
  3. ঐ সময় জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হারছে – এমন একটা সময় তাদের জন্য ভিনদেশের এক নেতাকে নিয়ে মাথাব্যথা না থাকাটা খুবই স্বাভাবিক

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অন্যরকম মজা: অণুজ ধর নামক এক লেখক ঐ “গুমনামি বাবা” তত্ত্বকে জনপ্রিয় করবার জন্য লেখালেখি শুরু করে দেন, তিনি দাবি করেন নেতাজি ১৯৮৫ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এক সাধু হিসেবে। একজন সাধু উচ্চমার্গীয় কথা বলেন বলেই তাকে কেন নেতাজি হতে হবে – এই হিসাব তিনি মেলাননি। কিন্তু তিলের সাথে তাল জোড়ার বিষয়টা যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে সিদ্ধান্তও আজীবনই আসবে না। মানুষ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুব পছন্দ করে: এটা নিয়ে গল্প ফাঁদা যায়, মোহগ্রস্থ করা যায় – তাই মানুষ সামনে সত্য দেখেও অস্বীকার করেন।

নেতাজি যখন থার্ড ডিগ্রী বার্ন নিয়ে হাসপাতালে মারা যান, তখন সেখানে দুজন নার্সসহ উপস্থিত ছিলেন খোদ সহযাত্রী হাবিবুর রহমান। তিনি নিজে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, নেতাজির শরীর পুড়ে তিনি মারা যান, তিনি প্রমাণস্বরূপ নিজের হাতও তদন্তকারীদের দেখিয়েছেন। কিন্তু তবু নেতাজি সম্পর্কে এতোগুলো নিশ্চিত প্রমাণ থাকাসত্ত্বেয় গাল্পিক মানুষ নেতাজিকে বাঁচিয়ে রাখে, গল্প ফাঁদে।

ভারতীয় সেনাদের ‘নায়ক’

কলকাতা ১৯২৮: কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধাদের সাথে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (ছবি: নেতাজি – এ পিকটোরিয়াল বায়োগ্রাফি)

আগেই বলেছি, অহিংস ধারণা নয়, বরং যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে – এমন একটা মতাদর্শ ছিলো সুভাষচন্দ্র বসুর। যেকোনো দেশের সশস্ত্র বাহিনীরও কিন্তু মতাদর্শ এটাই। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও নেতাজি’র আলাদা একটা কদর আছে – তারা উভয়েই একই মতাদর্শের সৈনিক।

তাই নেতাজির প্রতি ভারতীয় সেনানায়কের দুর্বলতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদের সাথে মেজর করনা’র কথোপকথনটি সেই আদর্শগত জায়গা থেকেই আন্তরিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়ারই প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু ছিলো না।

ছবির প্রমাণ কতটা প্রামাণ্য?

আজকের যুগে ফটোশপ করা যায়, কিন্তু সে যুগে তো ফটোশপ করা যেতো না। তাহলে ছবির প্রমাণগুলো কেন প্রামাণ্য দলিল হতে পারে না?

প্রথমত সব ছবিই ভুয়া – এমন দাবি করা ঠিক হবে না। তবে সব ছবিতে সাদা দাড়ি, টাক মাথা, আর সাদা কাপড় পরা ব্যক্তি দেখলেই তাঁকে নেতাজি ভাবাটা আসলে একপ্রকারের স্কটোমা – দেখেও না দেখার রোগ।

দ্বিতীয়ত সে যুগেও ছবি জালিয়াতি করা যেতো। এমনকি ফিল্ম ক্যামেরার যুগেরও বহু আগে, ক্যামেরা ওব্সকিউরা’র যুগেও যে মানুষ ছবি ওয়াশ করবার সময় জালিয়াতি করতে পারতো, Vox তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলো যে, কিভাবে সেই অষ্টাদশ শতাব্দিতেও ভূতের ছবি তোলা হতো আসলে ল্যাবে ছবি ওয়াশ করার ক্যারিক্যাচার কাজে লাগিয়ে। আর যেখানে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করবার জন্য আলাদা কিছু মানুষ প্রস্তুতই ছিলো, সেখানে উনিশ শতকের শেষাংশে এরকম লোভনীয় ছবি জালিয়াতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

শেষ কথা

সুভাষচন্দ্র বসু কি মারা গিয়েছিলেন? নাকি তিনি অসম রাজ্যের নাগা পাহাড়ে সন্ন্যাসী হয়ে আছেন? মঙ্গোলিয়া হয়ে সোভিয়েত চলে গিয়েছিলেন? নাকি চীনা সেনাবাহিনীতে আছেন? নাকি তিনি দরবেশ বাবা হয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন?

সিদ্ধান্ত আপনার: আপনি কি দরজাটা তালা দিয়ে সামনে পা বাড়াতে চান; নাকি দরজাটা ঠিকই তালা দিয়ে গিয়েও আবার ফিরে নবটা ঘুরিয়ে দেখতে চান…

ফিরে গিয়ে আবারও নবটা…

– মঈনুল ইসলাম

প্রচ্ছদের ছবি: তথাকথিত ‘গুমনামি বাবা’ এবং সুভাষচন্দ্র বসু

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*