ধারাবাহিক: ট্যুর টু শরিয়তপুর ২০১০ —এর একটি পর্ব
~ হাওয়া ভক্ষণ, নদী-হন্টন, কান ঝালাফালা ~
ঢাকা থেকে সারা বিকাল আর রাত ধরে মোটরসাইকেলে করে আমরা চারজন পৌঁছেছি রবিনের বাড়িতে, শরিয়তপুরের কার্ত্তিকপুরে। ফুফা-ফুফুর সাথে প্রাথমিক সাক্ষাৎপর্ব শেষ করে আমরা এসে খাবার টেবিল ঘিরে বসেছি। ফুফু আমাদের শরবত দিতে দিতেই বলতে শুরু করলেন আরেক কাহিনী: এই বাড়িতে ভূতের উপদ্রবের বিস্তারিত। ২০০৭ সালের ৬ জুলাই আমরা সাতজন এই বাড়িতে একবার এসেছিলাম, তখন এবাড়িতে কেউ থাকতো না, তখনই আমরা কিছু টের পাইনি। আর এখন ফুফা-ফুফু বসতি করছেন, অথচ “ভূত”! শুরুতেই মাথায় এলো ভূমিদস্যুর কথা, নিশ্চয়ই বাড়ি-ছাড়া করার পায়তারা করছে কোনো শত্রু।
ফুফা-ফুফু যখন ঘটনা শুরু করলেন- ‘এইতো, এই মাসের প্রথম দিকে হঠাৎ টিনের চালে রাতে ঢিলাঢিলি শুরু করলো’, তখন শাকিল ভাইয়ের চেহারায় ব্যাখ্যাতভাবে মুচকি একটা হাসি। ‘তারপর শুরু করলো ঘরের মধ্যে মাটির ঢেলা ফালানো’। তখনও শাকিল ভাইয়ের চেহারায় ব্যাখ্যাত হাসি। তিনিও আমারই মতো করে ভাবছেন: এটা মানুষেরই কাজ। ব্যাখ্যাটা বলার জন্য উশখুশ করছেন শাকিল ভাই, আর তখনই বোমা ফাটালেন ফুফু- ‘এরপর একদিন এই ড্রেসিং টেবিল থেকে তেলের বোতল উড়িয়ে মারলো ওদিকে, আমার সামনে’। শাকিল ভাই চোখ বড় বড় করে ফেললেন, “আপনের সামনে!” ফুফু দেখালেন ঐ ড্রেসিং টেবিলটার কত দূরে কোথায় তিনি ছিলেন, মাত্র তিন ফুট দূর থেকে দেখেছেন, বোতল বাতাসে ভর করে উড়ে যাচ্ছে। চিরুনিকে ছুঁড়ে মারছে অদৃশ্য এক শক্তি। পাউডারের কৌটা উড়ে যাচ্ছে। শুধু ফুফুই না, ফুফাও পাশে দাঁড়িয়ে অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছিলেন এই অসম্ভব ঘটনা। ফুফাও তখন দেখালেন তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা বোতল তাঁর কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে গেলো দেয়ালে আছাড় খেতে। কেউ আহত হলো না, কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলো না। একদিন দিনের বেলাও হলো এই উপদ্রব। বন্ধ করে রাখা ফ্রিজ থেকে বোতল বা বাটি বের করে রেখে গেলো টেবিলে। একদিন রাতে ফুফু, ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন; হঠাৎ প্লাস্টিকের টী-টেবিলটার একমাথা তুলে রেখে দিলো কেউ সোফার উপরে। ফুফু আর টিভির মাঝখানে টী-টেবিলটা ছিল, একেবারে চোখের সামনের ঘটনা। এরপর থেকে ফুফু সাবধানতাবশত টিভির পাশে বসে টিভি দেখতেন, যাতে টিভি ফেলে দিতে গেলে সেটা খপ করে ধরতে পারেন।
তারপর নাকিবের এক মৌলভী চাচাকে দিয়ে বাড়ি বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হলে আপাতত সমস্যার সমাধান হলো। কিন্তু খালি বাড়িতে ফুফা-ফুফুর মনে খচখচ করতে থাকে। তাই গ্রামেরই এক ছেলেকে এনে বাড়িতে রাখলেন। কিন্তু তখন আবার শুরু হলো উপদ্রব। মাটির ঢেলা পড়লো এসে বিছানায়। তারপর সেই ছেলেকে মানা করে দিলেন। আর এবারে পাকাপোক্ত করে বাড়ি বন্ধ করতে আবার নাকিবের চাচাকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসে সরা-পড়া দিয়ে বাড়ি বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। সরা-পড়া ব্যাপারটা হলো রান্নার ডেকচিতে ব্যবহারোপযোগী মাটির সরা, যেগুলোতে ফাউন্টেন পেন দিয়ে আরবি সূরা কিংবা দোয়া লিখে দেয়া হয়। আমি সেখানে সূরার আয়াতই দেখলাম।
আমি এই বিশেষ ভূতটার নাম জানি: Poltergeist (বিস্তারিত জানতে ইংরেজি উইকিপিডিয়া নিবন্ধ: Poltergeist^ দেখা যেতে পারে)। ‘পোল্টারগাইস্ট’ জার্মান শব্দ, যার অর্থ “আওয়াজ করা প্রেত”। বিভিন্ন পুরাণকাহিনীতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়, ঘরের জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করে দিতে এর জুড়ি নেই আর প্রচন্ড শব্দ করে উৎপাত করাই এর/এদের কাজ। কিন্তু কী ব্যাখ্যা এর? ব্যাখ্যা আপাতত পেলাম না। তারপরও মনে প্রাণে চাইলাম যেন নিজের চোখে একবার দেখতে পাই ঘটনাগুলো, তাহলে অন্তত দৃঢ়কন্ঠে বলতে পারবো “আমি দেখেছি”। (রহস্য ২)
রাতে ১টার দিকে আমরা নদীর পাড়ে গেলাম একবার। সেখান থেকে পরিষ্কার আকাশে আবারো তারা দেখে দিক ঠিক করে নিলাম। খুব ভালো লাগছিল নিরবতা, কিন্তু রবিনের আর তর সইছে না, তার এমনই ঘুম পেয়েছে যে, সে পারলে এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে যাবে। অগত্যা ফিরতি পথ ধরলাম। কিন্তু পথে হঠাৎ করে আমাদের গায়ের উপর কেউ একজন পেশাব করে দিলো।
আরে কে?
উপরে টর্চের আলো ফেলে গাছের ডালে কাউকে বসে থাকতে দেখলাম না। তখন আবারো আমাদের গায়ে পেশাব করলো কেউ। ঘটনা সুবিধার না। জ্বীন-ভূত সব পেশাব-টেশাব করা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ঘটনা জানতেই হবে। কারণ একই ঘটনা আগেও ঘটেছে, যখন রাতের বেলা আমরা মোটর সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম কার্ত্তিকপুর। কিছুক্ষণ পর পরই আমাদের গায়ে পেশাব করে দিচ্ছিলো অজ্ঞাত কেউ। অথচ বৃ্ষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই।
রহস্যভেদ হলো। রবিন সনাক্ত করলো ওটা একটা শিল-কড়ই গাছ। আমি মানুষটা গাছ ভালো চিনিনা। তাই নিশ্চিত হবার উপায় ছিল না। আমরা আগেও লক্ষ করেছি, কোনো এক প্রকার নির্দিষ্ট গাছের নিচে মোটর সাইকেল এলেই গায়ে পানি লাগছে। এমনকি ঐ গাছের নিচের পিচঢালা পথও সম্পূর্ণ ভিজে চুপচুপে। এবারে ভালো করে সঙ্গে করে আনা এলইডি-বাতির তীব্র আলো দিয়ে গাছটাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। গাছ থেকে অনবরত ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে। বিজ্ঞান আমি জানি না, যতটুকু জানি, তাতে জানি যে, রাতের বেলা গাছ প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি বের করে দেয় বাতাসে। কিন্তু এই গাছ বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি: সরাসরি পেশাব করে দেয়। মনে মনে শিল-কড়ইয়ের একটা নামও ঠিক করলাম: “পেশাব-বৃক্ষ”।
রাতে কিছুই ঘটলো না। আরামসে ঘুম দিলাম। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো, কিন্তু ফযর ইতোমধ্যেই মিস হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙলে আশেপাশের বিচিত্র এক শব্দে কান ঝালাফালা হয়ে যাবার জোগাড়। কিসের শব্দ? …ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। হায়রে শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকাকে এমন মরিয়া হয়ে ডাকতে আমি আর জীবনে শুনিনি। একটা ডাকা বন্ধ করে তো আরেকটা শুরু করে, না, না… একদল ডাকা বন্ধ করে তো আরেকদল… হায় ঈশ্বর!
নাস্তা-টাস্তা সেরে মোটর সাইকেল নিয়ে বাজারে গেলাম। বাজারের পাশেই কাত্তির্কপুর ব্রিজ। ঐ কংক্রিটের ব্রিজটার উপর মোটর সাইকেল রেখে যখন আমরা দাঁড়িয়েছি, তখন মাথার উপর খাড়া রোদ। কিন্তু মার্চ মাসের এই রোদকে ম্লান করে দিয়ে আমাদেরকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে যেন বাতাস। তীব্র বাতাস। নাকিব চেষ্টা করলো বাতাসের প্রতিকূলে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে ব্রিজ থেকে পড়ে যাবার, কিন্তু তীব্র বাতাস তাকে ঠিকই আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলো ব্রিজে। বাতাসে রোদ নস্যি হয়ে গেলো। উপভোগ করতে লাগলাম প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যকে। নদীতে পানি খুব কম, আর সেই অল্প পানিতে বাতাসের তীব্র ঝাপটায় রোদ পড়ে অপূর্ব সব রঙের মিশেল ঘটিয়েছে। সত্যি সত্যিই দেখলাম, পানির মধ্যে শত শত রং, হলুদ, সবুজ, সাদা, নীল, কালো, ধূসর…। মনে মনে চিনলাম, চিত্রকলার ইমপ্রেশনিস্টদের ভাবধারা। হাতের কাছে একটা ঈযল আর ক্যানভাস থাকলে শিওর, তখন তখনই পানির সেই ছবিটা আঁকতাম আমি।
আমাদের এই স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোকে ক্যামেরায় বন্দি করা গেলে যেন আরো ভালো লাগতো। তখন শাকিল ভাই ওনার আধুনিক মোবাইল ফোনসেটটা বের করে এগিয়ে এলেন। তুললেন আমাদের ছবি, বাতাসে উড়ে যাওয়ার ছবি, পানির ছবি, গাছের ছবি, নদীর ছবি…।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এতো বাতাস কেন এখানে? লক্ষ করলাম, নদীটা পুরোপুরি উত্তর-দক্ষিণমুখী এখানে। দখিনা বাতাসের একটা নামডাক সবসময়ই আছে। তার উপর এখানে বিপুল জায়গা জুড়ে কোনো বাধা নেই, মানে শহরে উঁচু উঁচু দালান তুলে যেমন বাধা সৃষ্টি করা হয়, এখানে তেমনটা নেই, নদীর উপর স্থাপনা বলতে এই ব্রিজখানা। তাই কোনো বাধা ছাড়াই বাতাস তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। মনে মনে স্বীকার করলাম, নিশ্চয়ই পৃথিবী ঘুরছে, আর সে কারণেই বাতাসের এই তীব্র প্রবাহ। আমরা দালান দিয়ে এই বাতাসকে আটকে শহরকে ভ্যাপসা করে তুলছি। …ফেরার সময় হলো।
বাজার থেকে ফিরে আসার সময় কুড়িয়ে পেলাম একটা সবুজ পোকা। রবিন জানালো এটা ঝিঁঝিঁ পোকা। ব্যস, আর যায় কই, সাথে করে নিয়ে এলাম বাড়ি অবধি। যত্ন করে রাখলাম, ঢাকা যাবার সময় নিয়ে যেতে হবে।
দুপুরে গেলাম নদীতে গোসল করতে। সেখানে, রবিন আগে নেমে নিশ্চিত করলো গভীর আছে নদী, তাই বরাবরের মতো এবারেও রীতিমতো ঝাঁপ দিলাম আমি। ছুপ্পুশ করে ঢুকে গেলাম পানির নিচে, তারপর ভুশ করে ভেসে উঠলাম। সাঁতরে চললাম আরো সামনে। কিন্তু হঠাৎ করেই পায়ে ঠেকলো মাটি। আরে! নদীর মাঝখানে মাটি! উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। শেষে সবাই-ই এই জেগে থাকা চরের মধ্যে চপচপে পানির মধ্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করে দিলাম। রীতিমতো খেলাধুলা। কয়েক মিনিটের জন্য আমরা দশ-বারো বছরের বাচ্চা হয়ে গেলাম সবাই। এর মাঝে বেশ কয়েকবার, প্রায় প্রত্যেকেরই পা কাটলো শামুকে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যেই-সেই। আমরা বলতে পারবো, নদীতে হাঁটতে পারি আমরা।
নদী হন্টন শেষ করে বাড়ি ফিরে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করলাম, কারণ নদীর পানিতে শ্যাওলা ভরা, আর সেগুলো কাপড়-চোপড়তো বটেই, মাথায়ও লেগেছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে মোটর সাইকেল নিয়ে আবার চললাম আগের বার এসে দেখে যাওয়া রামসাধুর মন্দির দেখতে। দলের কারোরই তেমন একটা ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখি আমাকে নিয়ে চললো রামসাধু অভিমুখে। আমি যেতে চাইলাম, কারণ সেখানে পুরোন বাড়ি আছে, সেগুলো দ্বিতীয়বার দেখলে হয়তো কিছু একটা জানতে পারবো।
যাবার পথে দেখি রসের হাঁড়ি নিয়ে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেই ব্যক্তি যখন বললো এগুলো খেজুরের রসের হাড়ি, তখন তো আমাদের আকাশ থেকে পড়ার যোগাড়। এই মার্চ মাসে খেজুরের রস! লোকটার থেকে জেনে নিলেন শাকিল ভাই, পরদিন ভোরে রস পাওয়া যাবে কিনা। সে আমাদেরকে ভোর ছয়টা বাজে এখানে এসে রস সংগ্রহের কথা জানালো। আমরা একবাক্যে সবাই রাজি হয়ে গেলাম, “আমরা আসবো”।
রামসাধুর মন্দিরে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, হিন্দু সাধুরা আমার দিকে আতঙ্কের চোখে তাকাচ্ছেন। দাঁড়িওয়ালা মুসলমান যুবক, জিন্সের পা গুটিয়ে যে হাঁটছে, সে আবার এসেছে হিন্দুতীর্থ দেখতে, শিওর বোমা ফাটানোর মতলব। আমার ইচ্ছা ছিল তাঁদেরকে সালাম বা আদাব দিয়ে তাঁদের ভুলটা ভাঙিয়ে দেয়া। কিন্তু মনের কোণের কোনো এক তীব্র আত্মসংবৃতির কারণে করলাম না সেটা। তাঁরা আরো বেশি রহস্যাচ্ছাদিত হয়ে আমার দিকে নজর রাখলেন। আমি জুতা খুলে গিয়ে রামসাধুর ঘরটা দেখে এলাম। পুরোন বাড়িটার খসে পড়া সিমেন্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা আগেকার আমলের পাতলা ইটের চেহারা দ্বিতীয়বার পরখ করলাম। কিন্তু অনভিজ্ঞ চোখে কিছুই ধরা পড়লো না নতুন করে।
সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ক্রিকেট খেলবো গ্রামের ছেলেদের সাথে। গিয়ে দেখি স্থানীয় মাঠে বিশাল ম্যাচ হচ্ছে। কিন্তু সেটা যেহেতু আগে থেকে সংগঠিত ম্যাচ, তাই ভাগ বসালাম না আমরা। আর কোথাও কোনো ক্রিকেট খেলা হচ্ছে না দেখে এসে এখানেই বসে বসে খেলা উপভোগ করতে লাগলাম স্থানীয় গিলক্রিস্ট, টেন্ডুলকার, ম্যাক গ্রা, আর সাঈদ আনোয়ারদের। বেশ উপভোগ্য খেলা। কিন্তু আসরের নামায পড়া হয়নি আমাদের। তাই অগত্যা উঠে পড়লাম আমরা।
আসরের নামায পড়ে রবিন পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো নতুন পথে। পথটা আমি চিনলাম, এই পথ দিয়ে আগের বার এসে আমরা কুমোর পাড়ায় গিয়েছিলাম। কুমোর পাড়া দেখার মতো জায়গা, কিন্তু রবিন এবার অন্যপথে নিয়ে চললো। এনে হাজির করলো একটা পুকুর আর তার পাশে এক মসজিদের সামনে। মোটর সাইকেল থামিয়ে নাকিব যখন নামতে গেলো তখন পা লেগে শাকিল ভাইয়ের গাড়ির সাইড ইন্ডিকেটর বাতির শেডটা ভেঙে গেলো। নাকিব না দেখেই কাজটা করেছে, কিন্তু সাথে সাথেই মন খারাপ হয়ে গেলো শাকিল ভাইয়ের। নাকিব সেই মনটা ভালো করার চেষ্টা করলো, কিন্তু শাকিল ভাই কোনো এক অজানা জগতে ডুব দিলেন।
মসজিদের স্থাপত্য নকশা দেখে তো আকাশ থেকে পড়লাম: এ-তো রীতিমতো আরব দেশের মসজিদ। মসজিদ দর্শন শেষে চোখ পড়লো পাশেই আরেকদল ক্রিকেটারের উপর। এই দলটা স্পেশাল। কারণ এই দলে যারা খেলছে, তারা আগের দলের মতো কিশোর-যুবক না, এরা ক্ষুদে অলরাউন্ডার।
আমরা তো দশ বছরের বাচ্চাই, সাথে সাথে গিয়ে ভিড়ে গেলাম ঐ দলে। চারজন দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম সমতা রক্ষার্থে। শাকিল ভাই আর আমি এক দলে, নাকিব আর রবিন এক দলে। শুরু হলো খেলা। প্রথম দফায় নাকিবদের দল বোলিং করলো। শাকিল ভাই একখানা ছক্কা হাঁকিয়ে সে কী খুশি! ভুলে গেলেন গাড়ির বাতি ভাঙার দুঃখ। খুশিতে ডগোমগো। বিপক্ষ দলকে টার্গেট দিয়ে বোলিংয়ে এলাম আমরা। উইকেটও পেয়ে গেলাম এক খানা। এক ক্ষুদে ব্যাটসম্যান ব্যাটে বল লাগিয়ে, সাথে সাথে ব্যাটটা জায়গায় ফেলে দেয় দৌঁড়। ঐ দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি আমরা। আর তখনই আবিষ্কার করলাম খেলার সবচেয়ে বড় দর্শককে: এক বৃদ্ধ বসেছিলেন আরেক যুবকের সাথে, তিনি তো রান নেয়া কিংবা বল ছুঁড়ে মারার আনন্দে রীতিমতো দুলে দুলে হাসছেন। তাঁর সেই অনাবিল হাসি ছড়িয়ে পড়লো আমাদের হৃদয়ে। কিন্তু খেলা অসমাপ্তই থেকে গেলো। মাগরিবের আযান হয়ে গেলো, আমরা চললাম সৌদি আরবে – ঐ আরবি মসজিদে নামায পড়তে।
নামায শেষে আবার আমরা এসে দাঁড়ালাম ঐ ব্রিজে। এবারে সন্ধ্যা হবার দৃশ্য উপভোগ করতে করতে বাতাস ভক্ষণ পর্ব শেষ করে রাতে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু সমস্যা হয়েছে রবিনদের বাড়ি যাবার সহজ পথটাতে ফেলা হচ্ছে মাটি, তাই ওপথে মোটর সাইকেল নিয়ে যাওয়া যায় না, ঘুরপথ ধরে যেতে হয়। রবিন আর নাকিব পড়ে গেলো পিছনে, অগত্যা আমাদের দুজনকেই গত রাতের অভিজ্ঞতা সম্বল করে এগিয়ে চলতে হলো বাতি জ্বালিয়ে।
দুজনের একজন ভুল করলে আরেকজন ঠিক করে নিচ্ছিলাম পথ, আর তাতেই দুজনের নির্ভরশীলতা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছিল আমার আর শাকিল ভাইয়ের। সেরাতে বাড়ি ফিরে গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা শেষ করে ঘুমাতে গেলাম আমরা।
পরদিন ভোরের মিশন হলো খেজুর রস সংগ্রহ করা। মার্চ মাসের খেজুরের রস যে অমাবস্যার চাঁদ, সে আর বলে বুঝানোর দরকার নেই। কিন্তু জুটলো কি সে রস আমাদের পাতে? …হুঁ হুহ! কাহিনী সহজ নয় মোটেও; এখনও অনেক পথ বাকি…।
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
পেশাব-বৃক্ষের(!) বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা পুরোপুরি সঠিক।