পহেলা বৈশাখ বলে যে দিনটি পালন করছেন, সেটা আসলে চৈত্র্য সংক্রান্তি।
রহস্যপত্রিকা জুন ২০০৩ সংখ্যায় সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি লিখে বসলেন একটা নিবন্ধ “১লা বৈশাখ বিতর্ক” (পৃ.৫২), তিনি সেখানে যা লিখেছেন তা হজম করতে আমার বেশ বেগ পেতে হলো: এটা কী শুনছি!
তিনি লিখেছেন
…তারই মাঝে ৯টি বছর স্বৈরশাসন করে গেলেন হুসাইন [মোহাম্মদ] এরশাদ। তাঁর শাসনামলে তিনি একজন খুদে (ক্ষুদে) বিজ্ঞানীকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে পুরো বাংলা সালটিকে একদিন পিছিয়ে নিয়ে গেলেন, অর্থাৎ তাঁর প্রবর্তিত নিয়মানুযায়ী প্রকৃত ১লা বৈশাখের একদিন আগে বাংলাদেশে ১লা বৈশাখ পালিত হয়ে যাবে। …ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও প্রকৃত ১লা বৈশাখ পালিত হয়।
কথাটা আমি পড়লাম, জানলাম, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারলাম না। তবে মাথায় রেখে দিলাম। একদিন ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে (১৪১৫-১৪১৬ বঙ্গাব্দ) বাংলা ক্যালেন্ডার (দিনপঞ্জিকা) নিয়ে বসলাম। তারপর আমি যা পেলাম, সেটা আমাকে আশ্চর্য করলো:
বৈশাখ ৩১ | আশ্বিন ৩০ |
জ্যৈষ্ঠ ৩১ | কার্ত্তিক ৩০ |
আষাঢ় ৩১ | অগ্রহায়ন ৩০ |
শ্রাবণ ৩১ | পৌষ ৩০ |
ভাদ্র ৩১ | মাঘ ৩০ |
ফাল্গুন ৩০ | |
চৈত্র্য ৩০ | |
৫ মাস | ৭ মাস |
---|
আপনারা কি কিছু ধরতে পারছেন?
খেয়াল করলে বুঝবেন, লেখকের দাবি অনুযায়ী বর্তমান দিনপঞ্জিকাটি হলো পরিবর্তিত পঞ্জিকা। এই পঞ্জিকায়, হিসাবে একটা অমিল লক্ষ করা যাচ্ছে। বরং আমরা যৌক্তিকভাবে ৬ মাস-৬ মাস সাজাতে পারি। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত মাসওয়ারি তারিখের একটা যৌক্তিকতা থাকতে পারে… আপনি যদি শ্রেফ চৈত্র্য মাসটাকে ৩১ দিনের করে ফেলেন, তাহলেই পুরো দিনপঞ্জিকাটি ৬মাস-৬মাস ভাগ হয়ে যায়, আর টানা ৬মাস হয় ৩১ দিনের, টানা ৬মাস হয় ৩০ দিনের।
আমার টনক নড়লো: তাহলে কি লেখক সত্যি বললেন? নাহ! এখনও ঠিক প্রমাণ হয় না।
এরই মাঝে আমার হাতে পড়লো অক্ষর বাংলা কীবোর্ড নামে একটা বাংলা লেখার সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটা ইন্সটল করে অতিরিক্ত হিসেবে সাথে পেলাম একটা ডিজিটাল বাংলা ক্যালেন্ডার। খুব খুশি হয়ে নিজের জন্ম তারিখে, জন্ম বছরে বাংলা কত তারিখ ছিল তা বের করতে উদ্ধত হয়ে গেলাম। পেয়ে গেলাম। খুশি আর ধরে না, আত্মীয়দেরও কয়েকজনের বাংলা তারিখটি বের করে দিলাম।
তারপর হঠাৎ মনে পড়লো ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা কত তারিখ ছিল? কে না জানে: ৮ ফাল্গুন। ডিজিটাল বাংলা ক্যালেন্ডার খুলে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ বাছাই করতেই দেখালো ১৩৫৮-১৩৫৯ বঙ্গাব্দ। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস বাছাই করে দিতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ!
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ: ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ: ২১ ফেব্রুয়ারি: ৯ ফাল্গুন।
April 14, 2010৩১ চৈত্র্য ১৪১৬
চৈত্র্য সংক্রান্তি |
April 15, 2010১ বৈশাখ ১৪১৭
পহেলা বৈশাখ |
হিসাবটা খুব সহজ। যদি এখনকার হিসাবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হয় তবে মূল হিসাবে ছিল ১৫ এপ্রিল। ১৫ এপ্রিলের জায়গায় যদি ১৪ এপ্রিল হয়, তবে ২১ ফেব্রুয়ারির জায়গায় ২০ ফেব্রুয়ারি ধরতে হবে… তাহলে ঠিকই বেরিয়ে আসে ৮ ফাল্গুন।
কিন্তু রহস্য এখনও আমার কাছে রহস্য। কেন এরশাদ এই কাজ করবেন? কে সেই ক্ষুদে বিজ্ঞানী? কী তাদের যুক্তি?
একটা যুক্তি আমার মাথায় আসছে, সেটা হলো: ৬মাস ৩০ দিনের আর ৬মাস ৩১ দিনের হিসাব করলে বছরে মোট দিনসংখ্যা হয় ৩৬৬। সেখানে ৫মাস ৩১ আর ৭মাস ৩০ দিনের করে নিলে বছরে মোট দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৫। …কিন্তু এটাওতো খোঁড়া যুক্তি, কারণ পৃথিবীর বার্ষিক গতির হিসাবে পৃথিবীর বছর ৩৬৫১/৪ দিন। সে কারণে গ্রেগোরীয় ক্যালেন্ডারে লীপ ইয়ার বা অধিবর্ষ আছে। যদি হিসাবের সূক্ষ্মতার কারণেই করা হতো, তবে বাংলাতেও অধিবর্ষ চালু করা হতো। তা তো দেখি না।
কোন চ্যানেলে রিপোর্টটা দেখেছিলাম এখন আর মনে করতে পারছি না, তবে ঠিকই মনে আছে, রিপোর্টে বলা হয়েছিল:
পুরোন ঢাকার ব্যবসায়ীরা পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে দুভাগ হয়ে গেছেন। দুই পক্ষ দুই দিন পহেলা বৈশাখ পালন করছেন।
চৈত্র্য সংক্রান্তি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব, মুসলমানদের নয়। এখন মুসলমানরা পঞ্জিকা বদলে সনাতনীদের উৎসবকে বদলে দেবার কী অধিকার রাখেন? অথচ সনাতনীরা সংখ্যায় অল্প বলে তাদের দাবি আর ধোপে টিকছে না। কোথায় ১৪ এপ্রিল চৈত্র্য সংক্রান্তি পালিত হবে, সেখানে ১৩ এপ্রিল সেটা পালন করে বাঙ্গালি আজ বাঙ্গালিয়ানা দেখায়।
আমি আসলে কিছুই বুঝলাম না।
– মঈনুল ইসলাম
——————————————-
হালনাগাদ –
এই পোস্টটি ওখানেই শেষ হয়ে যায় এবং বন্ধু সাকিব এবং শ্রদ্ধেয় রাগিব ভাই মন্তব্য করেন ব্লগপোস্টে। সাকিবের মন্তব্যটি অবশ্যই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। আমি আলোচনার সুবিধার্থে মন্তব্যটি এখানে উদ্ধৃত করছি:
আমি যতটুকু জানি বাংলা ক্যালেন্ডার এও লিপ-ইয়ার তথা অধিবর্ষের দিন আছে । কিন্তু নিয়ম হচ্ছে ইংরেজী যে সন এ লিপিয়ার হবে বাংলাও সেই সনে লিপইয়ার গণনা করা হবে। তা যদি না করা হতো তাহলে ইংরেজী যে সনে ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিন সে সনেও আমরা ১৪ তারিখে পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারতাম না।
সুতরাং বাংলা ক্যালেন্ডারে এরশাদ সরকার (রহস্যপত্রিকা অনুযায়ী) যদি বদল এনে থাকেন, তো সেটার যৌক্তিকতা হলো ৩৬৫ দিনে বছর গণনা ও অধিবর্ষে ৩৬৬ দিনে বছর গণনার সুবিধা পেতে। অর্থাৎ গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্য বিধানে এই কাজটি করা হয়েছে।
পরে রাগিব ভাই আরেকটি তথ্য জানালেন মন্তব্য করে:
As far as I remember, the corrected Bangla Calendar was created by Bangla Academy through Dr. Shahidullah. The main discrepancy is, as Sakib points out above, with the leap years. Also, the old calendar was inconsistent in number of days per month, so it was not unusual to have 32 days in some months!!!Right now, Bangladesh uses the amended Bangla calendar, according to the specification of Bangla Academy. That was created prior to 1971 … Ershad has little to do with it other than enforcing it’s adoption.
বাংলা করলে দাঁড়ায়:
যদ্দুর আমার মনে পড়ে ড. শহীদুল্লাহ’র মাধ্যমে বাংলা একাডেমী থেকে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধন করা হয়েছিল। মূল ফারাকটা হলো, যেমনটা সাকিব বলেছে, অধিবর্ষে। এছাড়াও, পুরোন পঞ্জিকাটা মাসপ্রতি দিনসংখ্যায় একটু এলোমেলো ছিল, তাই কোনো মাসে ৩২ দিন থাকাটা অস্বাভাবিকই ছিল!!! এখন বাংলাদেশে সংশোধিত বাংলা পঞ্জিকা ব্যবহার করা হয়, যা বাংলা একাডেমী থেকে নির্ধারিত। এটা সম্ভবত ১৯৭১ পরবর্তি সময়ে করা … এরশাদের আসলে খুব অল্পই করার ছিল এটা নিয়ে, তিনি শুধু একে চালু করেছিলেন বলা যায়।
এই পরিবর্তিত বাংলা ক্যালেন্ডার এরশাদ নিজে করেননি, বরং বাংলা একাডেমীর প্রবর্তিত ক্যালেন্ডারকে তিনি বাস্তবে প্রয়োগ করেছিলেন মাত্র। অর্থাৎ, রহস্যাবৃত পুরো বিষয়টা একটা মিমাংসায় পৌঁছেছে।
তবে যে ব্যাপারটা আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে, তা হলো, যেহেতু আমাদের কাছে সঠিক কোনো সাল নেই এখনও পর্যন্ত যে, কবে থেকে বা কোন সাল থেকে এই পরিবর্তনটা করা হয়েছে, তাই অন্তত এরশাদ-শাসনের আগের বছরগুলোর হিসাব করার সময় বর্তমান গণনার থেকে সবসময় একদিন পিছিয়ে হিসাব করতে হবে। যেমন: ঐ কম্পিউটার সফ্টওয়্যারটি যে রিডিং দিয়েছে, তার থেকে একদিন পিছিয়ে হিসাব করে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের সাল-তারিখ বের করতে হবে।
সাকিব এবং রাগিব ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ, রহস্যের কিনারা করার জন্য।
আমি যতটুকু জানি বাংলা ক্যালেন্ডার এও লিপ-ইয়ার তথা অধিবর্ষের দিন আছে । কিন্তু নিয়ম হচ্ছে ইংরেজী যে সন এ লিপিয়ার হবে বাংলাও সেই সনে লিপইয়ার গণনা করা হবে। তা যদি না করা হতো তাহলে ইংরেজী যে সনে ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিন সে সনেও আমরা ১৪ তারিখে পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারতাম না।
সাকিব, দারুণ কথা মনে করিয়ে দিয়েছো তো! এটা ভাবা হয়নি। হয়তো আমার হাতে লিপইয়ারের বাংলা ক্যালেন্ডার না থাকায়…। যাহোক, তোমার কথা সত্যি হলে এই দিন কমানোর একটা যুক্তি পাওয়া গেলো: ৩৬৬ দিনকে ৩৬৫ দিন করা। ভালো। এটা হলে ভালো।…কিন্তু তাছাড়া কি আর কোনো যুক্তি কাজ কেছ এদের মাথায়?সাকিব, ধন্যবাদ।
As far as I remember, the corrected Bangla Calendar was created by Bangla Academy through Dr. Shahidullah. The main discrepancy is, as Sakib points out above, with the leap years. Also, the old calendar was inconsistent in number of days per month, so it was not unusual to have 32 days in some months!!!Right now, Bangladesh uses the amended Bangla calendar, according to the specification of Bangla Academy. That was created prior to 1971 … Ershad has little to do with it other than enforcing it's adoption.
Ragib vai, thanks for your review.
পঞ্জিকা সংক্রান্ত কোনও লেখা পেলে মনযোগ সহকারে পড়ি, আপনারতাও পড়লাম। আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। যদি কিছু মনে নাকরেন তাহলে আমি কোনো বিতর্ক নাকরে কিছু যোগ করতে চাই। আমাদের প্রচলিত বঙ্গীয় (বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর) অঞ্চলের পঞ্জিকাটি বাংলা পঞ্জিকা নামে সমধিক পরিচিত। এটির তারিখ ও বার সম্পূর্ণ সূর্য নির্ভর আর তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও কর্ণ চন্দ্র ও রবি নির্ভর। সূর্যের দ্রাঘিমাংশ ধরে ইদানিং কোনও বৎসর ১লা বৈশাখ ১৪ আবার কখনও ১৫ এপ্রিল শুরু হয়। খ্রীষ্টিয় ক্যালেন্ডারের কোনও নির্দিষ্ট তারিখ ধরে যেমন প্রতিবৎসর ঈদ উদযাপন করা যায়না তেমনি কোনও নির্দিষ্ট তারিখ ধরে ১লা বৈশাখ শুরু হয়না।
১লা বৈশাখ নির্ধারনের নিয়ম: সূর্য্যের রাশি চক্র পরিভ্রমন কালে (৩৬০ ডিগ্রি) যেদিন রাত্র ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে আসে তার পর দিন ১লা বৈশাখ। উদাহরণ: ধরুন এবৎসর ১৩ এপ্রিল সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে রাত্র ১২টার মধ্যে আসল তাহলে ১৪ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ হবে, আবার তা পরের বৎসর ১৫ই এপ্রিল হতে পারে। দয়া করে এই ব্লগটি দেখুন। তাছাড়াও অনলাইন ভিত্তিক বাংলা পঞ্জিকা সাইট দেখুন।
ধন্যবাদ
উত্তমদা, অনেক অনেক ধন্যবাদ, ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য এবং বিষয়টা শেয়ার করার জন্য। এখানে মনে করার কিছুই নেই। যা সত্য, তাকে সত্য বলাটাই আসলে আমার উদ্দেশ্য। সূর্যের বিচারে বৎসরের আগুপিছু হওয়াটা, আপনি যেমনটা বলছেন, যদি সত্যি হয়, হতেও পারে। আমি এখনও বাংলা একাডেমীর নিয়মটা পুরোপুরি জানি না। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতেও কিন্তু সূর্যের প্রকৃত হিসাব ধরা হয় না, উল্টোপাল্টা থেকে যায় বলে ফেব্রুয়ারিতে +২৪ ঘন্টা আর প্রতি ১০০০ বৎসরে -২৪ ঘন্টা করে করে হিসাবটা মেলানো হয়। বাংলা একাডেমী যদি গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার পুরোপুরি মেনে চলে, তাহলে আর কোনো ঝামেলা থাকে না।
আপনার ব্লগ অনেক রীচ। সময় করে পড়ে দেখার আগ্রহ রাখি।
আরেকটা কথা, আমার এই পোস্টের উদ্দেশ্য কিন্তু দিন-তারিখ ঠিক করে বৈশাখ উদযাপন নয়, বরং মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করা যে, বর্তমান সময়কে হিসাব করে তৈরি কোনো পঞ্জিকা দিয়ে এরশাদ পূর্ববর্তি (কিংবা বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত পদ্ধতি পূর্ববর্তি) সময়ের কোনো দিনের হিসাবে যেন সচেতন থাকেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।