স্কুল-জীবন: মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

হাতের পাতা করাতের মতো সোজা করে মুখের সামনে ধরে গাজী ধীরে ধীরে বললো, “স্যার, আস,সালা—মু আ-লাই-কুম।” অমরেশ স্যার ঘুরে তাকালেন। হাতের বেতটা উঁচিয়ে ধরলেন, “মশকরা করোস! মশকরা করোস!” বলেই গাজীর পাছায় সপাং সপাং তিন ঘা…। গাজী ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। বুঝতে পারছে না, সে কী করেছে!

সরকারি স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য যে চেষ্টা-চরিত চলছিল, তার পিছনে মুখ্য মদদদাতা হলেন আমার সেঝ মামা, বকুল মামা ডাকি আমরা তাঁকে। গ্রাম থেকে আসা আমার মেধা হয়তো শহুরেদের সাথে প্রতিযোগিতায় পারতো না, তাই মামা যার-পর-নাই চেষ্টা… সোজা বাংলায় তদবির করে যাচ্ছিলেন কোনো এক সরকারি কর্মকর্তাকে। মামাদের দোকান থেকে বিনা পয়সায় সেন্ট, এটা-সেটা উপহার দিয়ে বেচারাকে পটিয়ে পাটিয়ে অবশেষে মামা ব্যবস্থা একটা করে ফেললেন। কিন্তু শর্ত হলো ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে, তারপর যা লাগে উনি ব্যবস্থা করবেন। আম্মা আর মামা যে এতো কাঠখড় পুড়িয়ে ব্যবস্থাদি করছেন, একটু ঝানু হয়ে পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে হবে, তা না স্থানু, বিকারগ্রস্থের মতো পরীক্ষা দিলাম, কারণ আমি এই ভর্তিযুদ্ধ ব্যাপারটাই বুঝতাম না। দ্বিতীয়বারের মতো পরীক্ষা দিলাম, এবং যথাবিহীত, ঐ ব্যক্তি ব্যবস্থা করে দিলেন – আমার সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হলো। অকপট ঘুষের বলে সরকারি স্কুলে ভর্তির এই কালিমা আজীবনেও ঘুচবে কিনা জানি না, কিন্তু এটা যে আমার জীবনটা তৈরি করেছে, তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। তবু আমি ঘুষের পক্ষে সাফাই গাইছি না, গাইবোও না। দাগ থেকে দারুণ কিছু হলেও দাগ, দাগই। ☹️ কিন্তু মামার সেই চেষ্টা, আগ্রহ, আমার আর আমার পরিবারের ভালো করার মনোবাসনা – খাটো করে দেখবার নয় — মামা দীর্ঘজীবি হোন, সুস্থ থাকুন।

বাসার পাশেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সিক্সে পড়তাম। সেখানে প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও দেয়া হয়ে গেছে, এরপর জানা গেল, সরকারি স্কুলে আমার ভর্তি হয়ে গেছে, আমাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেখানে চলে যেতে হবে। তারিখটা ২৫ মে ১৯৯৬ চলে গেলাম, মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলে – পাকিস্তান আমল থেকে এই নামেই অনেকে চেনে স্কুলটাকে। এই স্কুলে ভর্তি হয়েই প্রথম শিখেছিলাম ’s (এপোস্ঠোফি এস – একবচন) আর s’ (এস এপোস্ঠোফি – বহুবচন)-এর ভিতর পার্থক্যটা — ইংরেজি নামটা নির্ভুল: Motijheel Government Boys’ High School — ‘উঁচু ছেলেদের স্কুল’ না, বরং ‘ছেলেদের উঁচু স্কুল’ — মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়

পাক্কা ছেলেদের স্কুল, কোনো মেয়ে নেই। স্কুলের পোষাকটা বিচিত্র — সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা মোজা, সাদা কেড্‌স – মানে পুরা দরবেশ — শুধু কোমরের বেল্টটা কালো। ভদ্র ছেলের মতো দিবা শাখার ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘গ’ শাখায় গিয়ে বসলাম, আসলে আমাকে সেভাবেই বসানো হলো। পরে জেনেছিলাম, সব ক্লাসেরই ‘ক’ আর ‘খ’ শাখা হলো প্রভাতি (মর্নিং শিফ্‌ট), আর ‘গ’ আর ‘ঘ’ শাখা হলো দিবা (ডে শিফ্‌ট)।

ষষ্ঠ শ্রেণী

শাখা: গ

মোট ছাত্র সংখ্যা: ৬৪ জন
উপস্থিত: ৫৬ জন
অনুপস্থিত: ৮ জন

পুরোন স্কুল, ক্লাসরুমগুলো বেশ বড়। আর সামনের ব্ল্যাকবোর্ডটা রুমের এমাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়ানো। বোর্ডের একেবারে বাম দিকে আবার পেইন্ট করে ছক কাগজের (গ্রাফ পেপারের) মতো ছক কাটা ছিল। বোর্ডের একেবারে ডান পাশে চক দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে একটা বিয়োগ অংক করা: এতো জনের মধ্যে এতজন উপস্থিত, এতজন অনুপস্থিত। এই পানির মতো সহজ অংকটা প্রতিদিন ক্লাস-ক্যাপ্টেনই করতো।

স্কুল ড্রেসে দরবেশ লেখক
স্কুল ড্রেসে দরবেশ লেখক

এখানে ক্লাসে, ক্লাস-ক্যাপ্টেন হলো ক্লাসেরই ভালো একটা ছাত্র, ওর নাম ‘অনি’। অনি লম্বা-চওড়া, সুন্দর চেহারার একটা ছেলে। ক্লাসের কর্তৃত্বটা সে খুব সাহস আর নেতৃত্বের সাথেই করতো। যখনই ক্লাসে শিক্ষক থাকতেন না, ছেলেরা ক্লাসে হৈ-হট্টগোল শুরু করে দিত, অনি দৌঁড়ে গিয়ে দাঁড়াতো সামনে। সেখানে একটা অনুচ্চ চৌকি আছে, আর স্যারদের টেবিলটা ঐ চৌকির উপর বসানো থাকে, যাতে স্যার একটু উঁচুতে বসে পুরো ক্লাসে নজর বোলাতে পারেন। অনি ব্যাগের ভিতরে চক রাখতো, আর ওখানে গিয়েই ছাত্রদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতো। নে এবার কথা বল্‌। যে কথা বলবে, অনি তার নামটা বোর্ডে লিখে রাখবে। পুরো ক্লাস চুপ। সাথে সাথে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। অনি সবার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেদের মধ্যে এমন একটা অস্বস্থিকর অবস্থা, যেন নড়লেই নামটা লিখে ফেলবে অনি। কেউ কেউ এর মধ্যেই অনির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে, গল্পের ‘আমি কিন্তু টুপটাপ’-এর মতোই কথা বলে বসে, ওমনি অনি টুপ করে নামটা বসিয়ে নেয়। সবাই বুঝে যায়, অনি এখন সিরিয়াস। যার নাম একবার উঠে গেছে, সে তো এবার আরো বেশি কথা বলতে পারে। কিন্তু তাতেও অনি আরো বেশি স্টার মার্ক যোগ করে নামের সাথে। স্টার মার্ক পাওয়া এখানে ডিস্টিংক্‌শন না; যত স্টার, শাস্তি ততগুণ হবে তার। …অনি আবার দয়া পরবশও হতো — ভালো নেতার গুণ ওর মধ্যে সব সময়ই দেখেছি। যাদের নাম উঠে গেছে, তারা যদি এবারে নিপাট ভদ্দরনোক হয়ে যায়, চুপ করে বসে থাকে, তাহলে তাদের নামটা কাটা যায়। স্টারমার্ক পাওয়াদের স্টার কমতে থাকে। কখনো কখনো অনি বেমালুম ক্ষমাও করে দিত পাপীদের। এতক্ষণ ঠিকই নাম লিখেছে, যেই স্যার ক্লাসে ঢুকলেন, ওমনি ও’ সব নাম মুছে দিলো। অনি সত্যিই দারুণ একজন নেতা ছিল ক্লাসের। আমার দেখা প্রথম সত্যিকারের একজন নেতা ছিল সে — নিঃসন্দেহে।

প্রথমদিন ক্লাসে এসে দরজার সাথেই একেবারে ডান সারির সামনের বেঞ্চে ‘ইশতিয়াক’ নামের একটা ছেলের পাশে বসেছিলাম। এই স্কুলের বেশিরভাগ বেঞ্চ চার হাত লম্বা সাধারণ হাই বেঞ্চ আর লো বেঞ্চ না, বরং আড়াই হাত লম্বা হাই আর লো বেঞ্চ আবার আড়াআড়ি তক্তা দিয়ে আটকানো থাকতো। পা তুলে ভিতরে ঢুকে বসা লাগে। কোনো কোনো হাই বেঞ্চ আবার ডেস্কের মতো। প্রতিটা ক্লাসে এরকম ডেস্কের চারটা সারি থাকতো, মাঝখানে, চলাচলের জন্য আইল। …যাহোক, এই স্কুলে এসে শুনি, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা সমাগত। পরীক্ষা দিলাম, সেই পরীক্ষা ১০০ নম্বরে না, ৫০ নম্বরে। গণিতে ৫০-এ ৪৯ পেয়ে রীতিমতো ক্লাসকে মাত করে ফেললাম। ক্লাস ক্যাপ্টেন অনি এলো আমি কোথা থেকে এসেছি জানতে। কারণ তার নতুন প্রতিদ্বন্ধী এসেছে।

👣

এই স্কুলে টিফিন দেয়া হতো। প্রতিদিন প্রথম ক্লাসে, ক্লাসের প্রত্যেকের ‘মামা’ সম্পর্কের একজন লোক একটা খাতা নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন, শিক্ষক বোর্ডের ডান কোণায় তাকিয়ে উপস্থিত ছাত্রসংখ্যাটা দেখে নিয়ে খাতায় লিখে দিতেন, আর সেই গণনা অনুযায়ী টিফিন পিরিয়ডে নাস্তা দেয়া হতো ছাত্রদের। নাস্তার মেনু চারটা: ১. লুচি আর ডাল; কিংবা ২. লুচি আর ভাজি; কিংবা ৩. লুচি আর সুজি; কিংবা ৪. সিঙ্গাড়া। এই চারটা মেনুই ঘুরেফিরে আসতো আমাদের পাতে। সিঙ্গাড়ায় ছোট্ট একটুকরা মাংস যে পেত, সে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করতো। টিফিন পিরিয়ডের আগের ক্লাসের শেষ পর্যায়ে ক্যাপ্টেন, শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে টিফিন আনতে যেত, ডেকচি বয়ে আনার সুবিধার্থে কখনও সাথে কাউকে নিয়ে যেত। উপরের ক্লাসে উঠে বদমাশ ক্যাপ্টেনগুলো অবশ্য একটা/দুটা বেশি পাওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই বোর্ডের ডান কোণায় উপস্থিত ছাত্রসংখ্যাটা ১/২ জন বাড়িয়ে দিতো, যাতে বাড়তিটা তাদের পাতে জুটে।

ক্লাস সিক্সটা পার করে ক্লাস সেভেনে উঠলাম। “রেজাল্ট কার্ড” বলে একটা ব্যাপার আছে এই স্কুলে। হলুদ রঙের একটা আয়তাকৃতির কাগজ এক ভাঁজ করলে বর্গাকার দেখায়। এই কার্ডে বিষয় ধরে ধরে প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক আর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল লেখা থাকতো। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, ঢাকার স্কুলগুলোতে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। জানলাম, সরকারি স্কুলে প্রথম ১০জনের মধ্যে থাকতে পারাটা একটা বিরাট বিষয়। ক্লাসে চৌষট্টি/পয়ষট্টি জন ছাত্রের মধ্যে আমার অবস্থান ৩০-এর দিকে। আরো প্রতিযোগিতার বোঝা যেন চেপে বসলো।

আমার ঠিক এক ক্লাস উপরেই পড়তেন, রনি ভাইয়া (বকুল মামার ছেলে)। বড় ভাই হিসেবে তিনি মাথার উপর আছেন – এটা একটা স্বস্থিদায়ক বিষয় ছিল আমার জন্য। স্কুলের এক্কেবারে প্রথম দিন আমি তাঁদের সাথেই খেলেছিলাম। খেলার প্রসঙ্গে এই স্কুলের কথা না বললেই নয়, কিন্তু তার আগে আরেকটু এগিয়ে নিই আমার গল্প।

👣

ক্লাস সেভেনে একটা ছেলের সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়, ওর নাম ‘ওমি’। আমি নিজেই মানুষটা ছোটখাটো, সেখানে ওমি আরেকটু বেশি ছোটখাটো। ওর গোলগাল শিশুসুলভ চেহারাটা দেখলেই কেমন জানি মায়া মায়া লাগতো। ওর মাথায় চুল ছিল খুব পাতলা, একটু লালচে। পরে বুঝেছিলাম, ছেলেটা নিম্ন মধ্যবিত্ব ঘরের। ক্লাসের অন্যদের চোখে, আমরা দুই পিচ্চি, জিগরি দোস্ত! ☺️

স্কুলে ব্যতিক্রম বাদে, প্রতিদিনই অ্যাসেম্ব্‌লি হতো, মানে ক্লাস শুরুর আগে স্কুলের ভিতরের মাঠে সব ছাত্ররা জড়ো হতে হতো, প্রতিটা ক্লাসের প্রতিটা শাখার একটা করে সারি। মাথার উপরে ঠাঠা রোদ, তাতে কি, অমরেশ স্যার (আমাদের ড্রিল টিচার) বাঁশি বাজানো মানে হলো, সবাই সটান উপস্থিত। কোনো কোনো দিন ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে বেত দিয়ে পিটিয়ে পালিয়ে থাকা গরুগুলোকেও বেঞ্চের তলা থেকে বের করে অ্যাসেম্বলিতে পাঠাতেন এই রাখাল স্যার। অমরেশ স্যার সুন্দর মানুষ, কালো একটা বড় গোফ রয়েছে। খুঁতের মধ্যে শুধু উনার ঠোঁটের এককোণ একটু বাঁকা। কথা বলার সময় এমনভাবে শুরু করতেন, মনে হতো যেন কথাটা জাবর কেটে নিচ্ছেন। স্যারের প্রতীক হলো বেত — জালি বেত। হাতে সব সময়ই একটা থাকবে, মনে হয় স্যারের নীতি হলো, “মাইরের মইদ্দে ভাইটামিন আছে”

অ্যাসেম্বলি চলাকালীন স্কুলের সব শিক্ষক, এমনকি প্রধান শিক্ষকও সেখানে উপস্থিত থাকতেন। স্যার-ম্যাডামরা অবশ্য বারান্দায়, ছায়ার মধ্যে আরামে দাঁড়াতেন — ছোটবেলা এই শ্রেণীভেদটা ভালো চোখে দেখতাম না — উনারা আরামে দাঁড়াবেন কেন? আমরা কত কষ্ট করছি, আর উনারা শান্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন! যাহোক, অ্যাসেম্বলির সারিগুলোতে, যারা খাটো, তারা সামনে দাঁড়াতো। আমি দাঁড়াতাম সবার আগে, আর আমারও আগে দাঁড়াতো ওমি। প্রত্যেকে একজন থেকে অন্যজন কমপক্ষে একহাত ব্যবধানে দাঁড়াতাম। সারি থেকে সারির মাঝখানেও দুই হাত দূরত্ব থাকতো। লাইনে দাঁড়ানোর সময়ই ডানে-বামে হাত প্রসারিত করে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতো প্রত্যেকটা সারি। এই সারির কারো সাথে ঐ সারির কারো হাতের ছোঁয়া লাগলে খবর আছে – বদমাশগুলো ঠাশ ঠাশ করে হাত দিয়ে ওর হাতে চাপড় মারতো। প্রত্যেকটা ক্লাসের প্রত্যেকটা শাখার আলাদা লাইন থাকতো। ছাত্রদের মধ্য থেকেই একজন সামনের বেদিতে গিয়ে মাইকে আর্মিদের মতো জোর গলায় কমান্ড দিতো, “সমাবেশ, আআরামে দাঁড়াবে… আআরা-মেএএ দাঁড়াও!” সবাই দুই পা একটু ছড়িয়ে হাতদুটো পিছনে নিয়ে দাঁড়াতো। “সমাবেশ, সাবধান হবে… সাআআব-ধান্‌!” শেষ শব্দটায় জোর দিতো। সব ছাত্র দুই পা একত্র করে সটান সোজা দাঁড়াতো। মজার ব্যাপার হলো, এই যে কাজগুলো আমরা করতাম, কিংবা বেদিতে উঠে যারা কমান্ড দিতো, এগুলো কেউ কাউকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়নি। অথচ এগুলো আমরা সবাই-ই কম-বেশি পারতাম, কারণ আমরা দেখে দেখে শিখেছি। সমাজ থেকে দেখে দেখে শেখার, সামাজিক শিক্ষার এটা একটা উজ্জল উদাহরণ।

তারপর ছাত্রদের মধ্য থেকেই একজন গিয়ে সূরা ফাতেহা পড়তো। ধর্মনির্বিশেষে সবাই তখন দুই হাত নাভিতে, নামাজের মতো করে বেঁধে তেলাওয়াত শুনতো। তারপর শপথবাক্য পাঠ, মাইকে একজন মুখস্থ বলতো, শুনে শুনে বাকিরা ডান হাত সামনে মুষ্টিবদ্ধ করে বাড়িয়ে ধরে আওড়াতো। শপথ বলার ভাবটা আবার বিদ্রোহী বিদ্রোহী – জোরে জোরে পড়তো সবাই। শপথ আবার সাধু ভাষায়।

আমি শপথ করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব…

শপথ শেষ হলে আরো দুয়েকবার সোজা হও-আরামে দাঁড়াও। তারপর সোজা দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। ছাত্রদের মধ্য থেকেই কেউ কিংবা একাধিক গিয়ে মাইকে জাতীয় সঙ্গীত পুরোটা গাইতো, সবাই সাথে সাথে গাইতো। মাইকে যারা গাইতো বেশিরভাগই বেশ সুরেলা ছিল, ভালোই লাগতো। জাতীয় সঙ্গীতের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটা ছিল, যখন স্কেলটা নিচে নেমে যেত:

কী শোভা, কী ছায়াগো
কী স্নেহ, কী মায়াগোওওও
কী আঁচল বিছায়েছো বটের মূলে, নদীর কূলে কূলেএএ

আবার, চড়া হয়ে যেত:

মা তোর মুখে-র বাণী, আমা-র কা-নে লাগে…
সুধার মতোওওও

স্মরণ করে এখনই আমার গা শিউরে উঠছে।

ছেলেগুলো নিচের স্কেলটা বেশিরভাগ সময়ই অপূর্ব করে গাইতো, আমার অ্যাসেম্বলি’র কষ্ট উবে যেত। এই স্কুলে গাইতে গাইতেই জাতীয় সংগীতটা ঝাঝা মুখস্থ হয়ে গেছে। তবে ‘ভাব’ তো আর সব সময় থাকতো না, রোদের মধ্যে অ্যাসেম্বলি করা বেশিরভাগ সময়ই জানটা বের করে ছাড়তো। মনে আছে, একদিন গরুর মাংস খেয়ে গিয়েছিলাম, আর খাড়া রোদ্রের মধ্যে জানটা আরেকটু হলে বেরিয়ে যেতে বসেছিল, কিন্তু পাছে স্যারকে ব্যাপারটা বোঝাতে ব্যর্থ হই, তাই এগিয়ে গিয়ে ছায়ায় দাঁড়ানোর প্রার্থণা জানাতে পারিনি অন্তর্মুখী আমি। যাদের খুব খারাপ লাগতো, কিংবা শরীর খারাপ থাকতো, তারা অনেক সময় স্যারের অনুমতি নিয়ে স্কুলের বারান্দায়, ছায়ায় দাঁড়িয়ে অ্যাসেম্বলিতে অংশ নিতে পারতো। আর দুষ্টগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অ্যাসেম্বলি শুরু হতেই গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়তো। অমরেশ স্যারের নজর গেলে তিনি লম্বা জালিবেত দিয়ে পিটিয়ে সুস্থ, অসুস্থ সবগুলোকে মাঠে পাঠাতেন। দুষ্টগুলোর জন্য কষ্টভোগ করতো সবাই।

জাতীয় সঙ্গীত চলতে চলতেই কেউ একজন পতাকার স্ট্যান্ডে কপিকলে আটকানো পতাকাটা টেনে টেনে তুলছে — এমন গতিতে, যেন জাতীয় সংগীত শেষ হতেই পুরো পতাকাটা উঠে যায়। পতাকা উঠে গেলে এবারে “সমাবেশ, জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানাবে। এক। (দুই সেকেন্ড বিরতি) দুই।” “এক” বলার সাথে সাথে ডান হাত সেনা কায়দায় কপালে ঠেকানো, আর “দুই” বললেই হাত নামিয়ে নেয়া।

জাতীয় সংগীত আর পতাকাকে সম্মান জানানো শেষ হলে কখনও প্রধান শিক্ষক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতেন, তারপর দুয়েকবার আরামে দাঁড়াও, সোজা হও। তারপর ড্রামের তালে তালে পা ফেলে ট্রেন লাইনের মতো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে ক্লাসের দিকে দে দৌঁড়। ক্লাসে ঢুকে পানি পান… অতঃপর ক্লাস শুরু। স্যার-ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকতেন, সবাই দাঁড়াতো, শিক্ষক বসতে বলতেন, সবাই বসতো। এবারে রোলকল। খাতা বের করে রোল নম্বর ধরে ধরে ডাক দিতেন, ছাত্ররা কেউ “উপস্থিত”, কেউ “প্রেযেন্ট স্যার/ম্যাডাম”, কেউ “ইয়েস স্যার/ম্যাডাম” বলে বলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে দুয়েকটা ধাড়ি বানর থাকতো, যারা আস্তে করে বলতো, “লাব্বাইক”। পুরো ক্লাস হাসতো। স্যারের মেজাজ খারাপ থাকলে চোখ রাঙ্গাতেন, নয়তো ছাড় দিতেন। একজনের জায়গায় আরেকজন ‘উপস্থিত’ বলে ফেলাটাও জা-নি দোস্তদের মধ্যে কারো কারো মধ্যে ছিল। তখন স্যার/ম্যাডামও সচেতন হয়ে যেতেন, অ্যাই, ক্যা রে?

👣

ক্লাস সেভেনে একদিন ক্লাস চলাকালীন কালো একটা ছেলে এলো। সাদা স্কুল ড্রেসের মধ্যে কালো একটা ছেলেকে আরো বেশি কালো লাগছিল। সেই কালো ছেলেটাও বেঁটেখাটো। ধীরে ধীরে এই সাইজের কাছাকাছি বানরগুলো আমরা কিভাবে যেন বন্ধু হয়ে গেলাম। ‘বন্ধু হয়ে গেলাম’ কথাটার মানে হলো, আমরা পাশাপাশি বসতাম, কখনও একজন বসে আরেকজনের জন্য জায়গা রাখতাম, টিফিন পিরিয়ডে একসাথে খেলতাম, পরীক্ষার সময় একজন আরেকজনের সহমর্মী হতাম – এটার নাম যদি বন্ধুত্ব হয়, তবে সেটাই। যাহোক, সেই কালোমানিকের নাম হলো ‘নাকিব’ – দীর্ঘদিন ওকে আমরা নকিব ডেকেছিলাম। পরবর্তি জীবনে এই কালোমানিক তো ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো’! আমরা দুজনে গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়ে গেলাম। ব্যাটালিয়নে এরকম আরো কয়েকজন হলো:

  • শাকিল [পটকা]: কালো গায়ের বরণ। শুকনা, হ্যাংলা পাটকাঠি একটা। এতোটাই শুকনা যে, মনে হতো টোকা দিলেই পড়ে যাবে ও’।
  • তন্ময়: সুন্দর চেহারা। নিপাট আইনস্টাইন। এতো শান্ত, ধীর ঐ বয়সে আমি আর কাউকে দেখিনি। পড়ালেখায় ওতোটা ভালো ছিল না, কিন্তু ওর ভিতরে যে প্রোফেশনাল ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিল, সেটা অনেক পরে বুঝেছি। কিন্তু, জানি বলে লোক দেখিয়ে বেড়ানোর অভ্যাস ওর কখনও ছিল না।
  • নিঝু [পাগলা]: স্কুলে এলে ও’ কী করছে, না করছে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই – সারাক্ষণই তিড়িংবিড়িং করতো। কারো সাথে ঝগড়া লাগলেই দিত খামচি। পরবর্তিতে ওকে একটা নাম দেয়া হয়েছে – খামচি বাবা।
  • আবির: ভালো ব্যাট্‌সম্যান, আর উইকেটকীপার ছিল। প্রেমিক পুরুষ। সেই নার্সারি থেকেই বোধহয় শুরু – ব্যাটা সেই স্কুলজীবনের বাচ্চা বয়সেই বহু মেয়ের প্রেমে পড়েছে। একবারতো ওকে প্রেমপত্রও লিখে দিলাম আমি। 😉
  • শরীফ [লেট বয়]: ক্লাসে সব সময় সে দেরিতে আসতো – দরজায় দাঁড়িয়ে সামনে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বাড়িয়ে দিয়ে বলতো: মে আই কাম ইন স্যার
  • সাজ্জাদ [ওরফে ম্যাগি নুডল্‌স]: ওর মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো ছিল বলে এই নাম। সব সময় টিয়া রঙের একটা ক্যাপ পরতো সেটা আবার Milo’র সাথে ফ্রি দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই ওর ক্রিকেট ব্যাটটা আনতো সে।
  • গাজী [নবায়নযোগ্য শক্তি]: ৬ ফুটি সাবু — এই একজনই আমাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। ও’ শ্রেফ পানি খেয়ে খেয়ে অনর্গল কাজ করতে পারবে, এই খেলা তো এই আবার খেলা – কোনো ক্লান্তি নেই। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির ফাস্ট বোলার ছিল সে।
  • আরেফিন: ক্লাস সেভেনে/এইটে হঠাৎই একদিন এই ছেলেটা ঢুকলো। তারপর থেকে এই ছেলেটা নিজেকে প্রমাণ করেছিল, সে প্রথম সারির একজন। সে অলরাউন্ডার — যেমন পড়ালেখায় ছিল ফার্স্ট, তেমনি ভালো ক্রিকেটও খেলতো।
  • সানী [মাতাল]: কেমন যেন মাতালদের মতো কথা বলার স্টাইল ওর। সেও লম্বা ছিল, স্কুলে ক্রিকেট ব্যাট আনতো সব সময়।
  • ডন: লম্বু। জন্মগত কারণেই মনে হয় কানে কম শুনতো বলে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতো। ওর কাছে জীবনে প্রথম এই জিনিস দেখেছিলাম।
  • ইমন: গায়ক ছেলে – মেয়েদের মতো কিন্নর কণ্ঠের অধিকারী এই ছেলেটা আবার মিচকে ফাযিল। আমি কোথায় সিলেটি উচ্চারণের প্রভাবে ‘চোর’-কে ‘চুর’ বলে ফেললাম, সেটা কখনোই ওর কান ফসকাতো না, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেত। কিংবা হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে বলতো: কুকুরের বাচ্চা, [বিরতি] শুয়োরের বাচ্চা, [বিরতি] – পাশেরজনের তখন মেজাজ খারাপ, ইমন তাকে গালি দিয়েছে – তখনই সে বাকিটা বলতো: যদি কামোড় দেয়, মোলম লাগিয়ে নেবেন। বলেই ফিচলা হাসি।

শাকিল আর তন্ময় কোনো এক ক্লাসের পর থেকে আর আসতো না। কেন আসতো না খোঁজ করার বয়স ছিল না। তবে ওদেরকে খুব মিস করি।

👣

স্কুলে যেতাম খেলার জন্য – হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, শ্রেফ খেলার জন্য। স্কুলে বিশাল বিশাল, একটা নয়, দুটো মাঠ ছিল। ভিতরের মাঠটা স্কুলের বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা, আর বাইরের মাঠটা স্কুলের বাউন্ডারির ভিতরে, ওটা বড় মাঠ। বেশিরভাগ সময়ই আমরা ক্রিকেট খেলতাম। বৃষ্টি হলে ক্লাসের ভিতর ক্রিকেট খেলতাম। এইজন্য ক্লাসের সবাই আমাদের সার্কেলটাকে নাম দিয়েছিল “অলটাইম ক্রিকেট টীম”। যত বড় হতে থাকলাম, খেলার মাত্রা তত বাড়তে থাকলো। টিফিন পিরিয়ড আধা ঘন্টা, এই আধা ঘন্টার পূর্ণ ব্যবহার করা চাই, একটা বিন্দু সময়ও নষ্ট করা চলবে না। তাই টিফিন যা দিত, সেটা ক্লাস চলাকালীন সময়ই সাবাড় করে ফেলতে হবে। এবারে ঠিক দরজার সামনের বেঞ্চে, এক পা বেঞ্চের বাইরে বের করে একজন বসে আছে। স্যার কী পড়াচ্ছেন, কে তা খেয়াল করছে? সবাই কান খাড়া করে আছে ঘন্টা কখন বাজবে। কেউ বল হাতে বের করে নিয়েছে, কেউ ব্যাট মেঝে থেকে তুলে নিয়েছে হাতে, কেউ ক্যাপ হাতে নিয়েছে, সবাই রেডি।

ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই দরজার কাছের জন স্যারকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেত। তারপর ঝা দৌঁড়, জানপ্রাণ নিয়ে দৌঁড়। সোজা কেচি গেট (কলাপ্সিবল গেট) পার হয়ে বড় মাঠের দিকে দৌঁড়। কে কার আগে যেতে পারে। পুরো ৫০০ মিটার স্প্রিন্ট। গিয়ে সবচেয়ে ভালো পিচ দেখে একটা গাছ কষে জড়িয়ে ধরে থাকতে হবে। এত কিছু থাকতে গাছের সাথে এতো পিরিতি কেন! কারণ, লম্বা লম্বা ওজনদার তিনটা স্ট্যাম্প বহন করা কষ্টসাধ্য ছিল, আমাদের স্ট্যাম্প হচ্ছে এই গাছ, আর গাছের সামনের পিচটা আমাদের। যেদিন গাছ জোটে না, সেদিন ইট দিয়ে বানানো কুতুব মিনার হয় স্ট্যাম্প। পিচ আর স্ট্যাম্প জোড়া হয়ে গেলেই হলো, বাকিরা গিয়ে খেলা শুরু করতে পারবে। দল কখনও আগে থেকেই বানানো থাকে, কখনও উপস্থিতদের মধ্য থেকে বানিয়ে নিতে হয়। তারপর খেলা শুরু…

নবায়নযোগ্য শক্তি (গাজী) যখন বল করতে আসতো, সবাই-ই একটু ভয়ে ভয়ে থাকতো… শরীরের যেখানে লাগবে, সেটা মোটামুটি অবশ হয়ে যাবে নিশ্চিত। তবু ওর বল সানি, নাকিব, আবির, আরেফিন – ওরা যতটা খেলতে পারতো, আমি তার তুলনায় অনেক ভয় পেতাম।

খেলায় সবাই মত্ত। কখন যে আধা ঘন্টা পেরিয়ে যায়, আল্লা’ মালুম। ঘন্টা বেজে উঠতো। এটা হলো সতর্কতামূলক ঘন্টা, আর পাঁচ মিনিট আছে। কিন্তু ঐ পাঁচ মিনিটও মহা মূল্যবান, কে ছাড়তে চায়? খেলা চলতেই থাকে। তারপর হঠাৎই বেজে উঠে ঘন্টা, আবার। সময় শেষ। সবাই পড়িমড়ি করে ক্লাসে দে দৌঁড়। কোনো কোনো সময় দেখা যেত, স্যার শাস্তি দেয়ার জন্যই অন-টাইমে ক্লাসে উপস্থিত। সেদিন একটু বকা-ঝকা খেতে হয় আরকি। কিন্তু স্যাররাও বুঝেন, দুরন্তপনাটাই এই বয়সের সৌন্দর্য্য।

👣

স্যারদের অধিকাংশই বেত ছাড়া কথা নেই। মন্ডল স্যারতো একদিন রেগে গিয়ে টেবিলের ভাঙা পায়া টান দিয়ে ছুটিয়ে পেছন পেছন দৌঁড় দিলেন এক বদমাশের পিছনে। পরে কোন স্যার ধরে যেন নিরস্ত করলেন। মন্ডল স্যার খুব নীতিবান ছিলেন। তিনি সরকারি স্টাইপেন্ডে একবার জাপান ঘুরে এলেন। তাঁর চোখে আমরাও জীবনে প্রথম জাপান দেখেছিলাম। স্যারের সেই জাপানপ্রেম পরবর্তিতে যে আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে যাবে ভাবিনি। স্কুলে ইংরেজি বিতর্ক আয়োজন করে আমাদের ইংরেজিভীতিটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন স্যার।

সরকারি স্কুল, বড় স্কুলে থাকার সুবাদে বিভিন্ন দারুণ দারুণ সুযোগও হতো আমাদের। টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যেসকল শিক্ষকেরা বিএড করছেন, মাঝে মাঝে তাঁরা ক্লাস নিতেন। তাঁদের ক্লাসগুলো খুব ভালো লাগতো – কারণ ওগুলো প্রথাবিরুদ্ধ ছিল। স্যাররা বইয়ের ছবিই বড় করে এঁকে নিয়ে আসতেন ক্লাসে। … আবার একবার পেপসোডেন্ট থেকে স্কুলে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদেরকে দাঁতব্রাশ করা শিখাচ্ছিল। সেদিনই প্রথম সঠিক উপায়ে দাঁতব্রাশ করতে শিখেছিলাম। আবার ওরা গিফ্‌টও দিয়েছিল। ঘুষটা কাজে লেগেছে – আজও আমি পেপসোডেন্টই ব্যবহার করি। 😆

সব স্কুলেই, সব ক্লাসে ব্যাকবেঞ্চাররা থাকে, আমাদেরও ছিল। রাজন, মবিন, নোয়েল, রিয়্যাল, রিফাত, [কোঁকড়াচুলো] মিফতা, তনয়, তূর্য, তাহারাত, বাবন, আসিফ, [ফুটবল] সাব্বির, [মাঝখানে সিঁথি করা] জুয়েল – আরো কতগুলো…। এর মধ্যে রাজন আর মবিন – ক্লাসের চরম বদমাইশদের অন্যতম। এরা ক্লাসে আসতোই যেন দুষ্টামি করার জন্য। আর রাজন দুষ্টুমি করে তো করে, সোজা গিয়ে পড়ে অমরেশ স্যারের সামনে। এই দুজনে আদায়-কাচকলায় সম্পর্ক: সাথে সাথেই জালি বেতের বাড়ি – সপাং! ব্যাকবেঞ্চার বলে সবাই যে বাজে ছাত্র – ব্যাপারটা তা না। আসলে ওরা এক সাথে থাকতো দুটো কারণে — ১. ঐ দলের প্রায় সবগুলো লম্বা-চওড়া। আর ২. ঐ দলে থাকলে অনেকটা যা-ইচ্ছা-তা করা যেত। এদেরই কারো কারো প্রতিভা উপচে পড়তো; যেমন: একদিন স্যার বিজ্ঞানে, মানবশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চেনানোর জন্য একজনকে সামনে ডাকলেন, বোর্ডে একজন মানুষের ছবি এঁকে দেবার জন্য। তখন আরেক কালোমানিক মিফতা উঠে গিয়ে আউট-অফ-দ্যা-বক্স চিন্তাভাবনা থেকে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে কয়েক আঁচড়ে অপূর্ব করে “ঝাঁড়ুরত মীনা” এঁকেছিল, যা দেখে ক্লাসের সবাই-ই সেদিন বুঝেছিল, এই ছেলে বড় হয়ে আর্টিস্ট হবে। খেলাধুলার প্রশ্ন এলে ব্যাকবেঞ্চারগুলোই দেখা যেত স্কুলের বিভিন্ন খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী। যেমন বদমাইশ রাজন, মবিন – এরা ছিল আমাদের ক্লাসের সেরা ফুটবলারদের দুজন। তখন দেখা যেত আমরাই ওদের সাপোর্ট দিচ্ছি ক্লাসের হয়ে। আমাদের পিচ্চি বাহিনীর মধ্যে নিঝু ভালো দৌঁড়াতে পারতো – ও’ নাম লেখালে, দৌঁড়ের পুরস্কার ওর জন্য একটা বরাদ্দ থাকতো বলা যায়।

👣

…অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বয়েয স্কুলে পড়া মানে অর্ধাঙ্গী থাকা — আমাদের বয়েয স্কুলে অর্ধেক শরীরে তাই আমাদের খুব কষ্ট ছিল। আহারে! যাদের, আবিরের মতো প্লেবয় চেহারা ছিল, তারা ঠিকই গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে নিতো পাশেরই গার্লস স্কুলে। কেউ কেউ স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়তে গিয়ে নারীসঙ্গ পেয়ে পুলকিত হতো। আর আমরা যারা কোনো দলেই পড়তাম না, আমরা গালগল্প শুনতাম। রাস্তার পাশের ক্যানভাসার যেমন মনের মাধুরি মিশিয়ে যা ইচ্ছা তা বোঝায়, আমাদেরও কয়েকজন আছে, যারা জীবনেও গার্লস স্কুলে না গেলেও গায়েবী কেরামতিতে জানতো ভিকারুন্নেসার মেয়েরা কী করে, পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েরা কী করে। কে জানে কী সত্য – তখন আমাদের কাছে সবই ‘আহা’ টাইপের ব্যাপার। 😄

আমাদের নারীপ্রীতি গার্লস স্কুল ছাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সুন্দরী ম্যাডামে এসে পর্যবসিত হতো। ‘চাকমা ম্যাডাম’ ছিলেন তখন হার্টথ্রব – ফর্সা ছাড়া যদিও পাহাড়ি চেহারার এই ম্যাডামের আর তেমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না, তবু উল্লেখযোগ্য বিকল্প না থাকায় ম্যাডামই তখন ক্লাসগুলোর মূল আকর্ষণ ছিলেন। ম্যাডামের এই নামের কারণে আজও ম্যাডামের আসল নাম জানি না। ম্যাডামদের কথায় একজনের কথা না বললেই নয় – গীতা ম্যাডাম। কালো বরণ, চিকনচাকন এই ম্যাডাম বাতাসের গতিতে ক্লাসে ঢুকে কমান্ড দিতেন: “বসে বসে সা-বধান।” সাথে সাথে সব ছাত্র বুক টান, পিঠ টান করে দুই হাত সটান করে হাই বেঞ্চে রাখে। পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। দুই সেকেন্ড পরে তিনি আবার বলতেন “আরাম।” তখন সবাই আবার রিল্যাক্স। মনোঃপূত না হলে কিংবা ক্লাসের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ক্লাস চলাকালীন যেকোনো সময় এই ড্রিলের পুণরাবৃত্তি করতে পারেন ম্যাডাম। … ঘটনা হচ্ছে ইমন ফাযিলটা এর মধ্যেও ফিটলামি খুঁজে পেয়েছে, ম্যাডামের সাথে সাথে সে আস্তে করে বলে: “বসে বসে কষা”। তারপর মুখ দিয়ে মৃদুস্বরে আওয়াজ করবে, যেন তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর “আরাম” কমান্ডটা পেয়েই আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে গা এলিয়ে দিয়ে বলবে, “আহ্ শান্তি পাইলাম।” তারপর হাত দিয়ে বাতাস তাড়িয়ে নাক সিঁটকে বলবে, “উফ দুর্গন্ধ!” মানে এতক্ষণ সে ম্যাডামের কমান্ডের সাথে টয়লেট রেপ্লিকেট করলো। 😆

আমরা পাকনা তিন গোয়েন্দা - রয়্যাল ডিটেকটিভ টীম
আমরা পাকনা তিন গোয়েন্দা – রয়্যাল ডিটেকটিভ টীম

আশেপাশে, গার্লস স্কুল ছাড়াও মতিঝিলেই অন্যান্য স্কুলগুলোও ছিল। মডেল স্কুলের ছেলেমেয়েগুলোকে আমরা খুব বদমাশ মনে করতাম। আর ভালো স্কুল, আইডিয়াল স্কুলেরগুলোকে বলতাম ‘টুপির নিচে শয়তানী’। সবাইই ওরা আমাদের রাইভাল ছিল। তবে আমাদের স্কুলে উৎপাত ছিল আশেপাশের কলোনীর বখাটে ছেলেগুলো। ওরা লুকিয়ে মাদকসেবন করতো সরকারি স্কুলের বিশাল অরক্ষিত আনাচে-কানাচে। আর সেসব খুঁজে বের করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম আমরা “তিন গোয়েন্দা” – রয়্যাল ডিটেকটিভ টীম — সে আরেক গল্প।

👣

উপরের ক্লাসে উঠতে উঠতে আরো অনেকে বন্ধু হয়েছে সময়ে সময়ে। যেমন:

  • হৃদয়: নাকিবের চেয়েও ভটু। ভালো হার্ড হিটার ব্যাট্‌সম্যান সে।
  • তৌহিদ: ক্লাসের এমন কোনো স্যার নাই, যাঁর কাছে সে পড়তে যায়নি। উদ্দেশ্য একটাই: স্যারের সুনজরে থেকে পরীক্ষার খাতায় বেহেস্ত পাওয়া। উল্টোটাও ঘটেছে: ফটোসান চশমা পরা ইংরেজি পড়ানো গোলাম মাওলা (GM) স্যারের কাছ থেকে ছেড়ে চলে আসার পর, স্যারতো একদিন বেহুদা ছুতা খুঁজে এমন চড়ান চড়ালেন সবার সামনে, বেচারা সাক্ষাৎ দোযখ দেখে এলো।
  • রাজু (মনপুরা): মাথার চুলগুলো সজারুর মতো খাড়া এই মনিপুরি ছেলেটা গায়েগতরে বড়সড় হওয়ায় আমরা একটু দূরে থাকতাম। কিন্তু ওর খুব প্রিয় পাত্র ছিলাম আমি। আমার ‘নয়ন’ নামের নারীরূপে ‘আঁখি’ ডাকতো আমায়, টীয করতো। আমাদেরও একটা দারূণ বিনোদন ছিল ওর মাথার চুলগুলো – কাগজের ছোট্ট ছোট্ট বল বানিয়ে ক্লাস চলাকালীন পেছন থেকে ওর মাথা সই করা হতো। প্রায় শতভাগ সাফল্যের সাথে সেগুলো ওর মাথায় ল্যান্ড করতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কদম ফুল মাথাটা সাদা হয়ে যেত। ও আবার ক্লাসের তুখোড় রেড ক্রিসেন্ট ছিল।
  • সুমন: শুকনা, টিংটিঙা লম্বা। ও’ আগে ঐ গুন্ডাগুলোর সাথে চলতো। নাইন-টেনে উঠে দেখা গেল কিভাবে জানি ও’ ভালো মানুষ হয়ে গেল – আমাদের সাথে খেলতো। 😊

আমরা কি সব ভদ্দরনোক? দুষ্টামি একপাশে সরিয়ে রাখলে, তা অবশ্য কিঞ্চিৎ সত্যি। উদাহরণ দেই: আমরা কখনোই স্কুল পালাতাম না। একদিন ঠিক করলাম স্কুল পালাবো। রাজনরা অবশ্য প্রায়ই স্কুল পালাতো। একদিন দেয়াল টপকে ওপাশে ব্যাগ ফেলেছে। পরে নিজে দেয়াল পাড়ি দিয়ে দেখে ব্যাগ পড়েছে সোজা অমরেশ স্যারের ঘাঢ়ে। স্কুল পালানো বদমাইশগুলোকে ধরতে স্যার আগে থেকেই অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

আমরা তো ভদ্দরনোক, দেয়াল টপকে পালালে চলবে না। আমরা তিনজন তিনটা এপ্লিকেশন লিখলাম: একজনের জ্বর, একজনের মাথাব্যাথা, একজনের পেটব্যাথা। মজার বিষয় হলো তিনটা এপ্লিকেশনের দুটো আমার হাতেই লিখা। লেখা যাতে এক না বোঝা যায়, তাই একটা লিখেছি পুরোটাই ইটালিকে। এই হলো ভদ্দরনোকের নমুনা আরকি। 😉

এখন তিনজনই একসাথে গেলে স্যার তো সন্দেহ করবেন। তাই আলাদা আলাদা সময়ে গিয়ে নিজেদের এপ্লিকেশনের পয়েন্ট অনুযায়ী অভিনয় করে এপ্লিকেশন মঞ্জুর করিয়ে আনলাম। স্যার দুয়েকটা প্রশ্ন করে থলের বেড়াল বের করতে চাইলেও বেড়ালটা আমাদের অভিনয় দেখে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছিল, তাই বেরোয়নি। 😉 এপ্লিকেশন হাতে গেটে অমুক মামার সামনে ব্যাগসমেত হাজির – ব্যাটা এখন বেরোতে না দিয়ে যাবি কোথায়?

বাইরে বেরিয়ে গেলাম। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে তিনজনে। ইয়েস, স্কুল পালানো সফল হয়েছে। এবার কী করবো? দেখা গেলো স্কুল পালাতেও জানি না আমরা। করণীয় কিছু না পেয়ে একটা কোক কিনে তিনজনে ভাগ করে খেলাম। তারপর? কী করতে হবে জানি না। আখেরে তিনজনে তিনটা রিকশা নিয়ে যার যার বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে অন্য তোপের মুখে: এতো তাড়াতাড়ি বাসায়! স্কুল ছুটি হয়ে গেছে নাকি… সামলাও ঠ্যালা!

কৃষি মিজান স্যারকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না। মূল কারণ স্যার অসভ্যের মতো তুই-তুকারি করতেন। একদিন শেষ ক্লাস ছিল কৃষিশিক্ষা। সুমন, নাকিবসহ আমরা কয়েকজন পালালাম। পালিয়ে, এবারে থাকলাম স্কুলের ভিতরেই। এক চিপায় গিয়ে লুকিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করলাম। ক্লাস পালিয়ে কয়েকজন চিপায় ক্রিকেট খেলছে, ভিলেন রাজনের এবারে নায়ক হবার ইচ্ছে হলো। অমরেশ স্যার অকুস্থলে হাজির, সবগুলো সপাং সপাং একঝাঁক আদর খেলাম। তারপর সোজা কৃষি মিজানের কাস্টোডিতে – বাকিটা ইতিহাস।

👣

শিক্ষকদের একাংশ - বাম থেকে: মফিজ স্যার, কাশেম স্যার, মন্ডল স্যার, গোলাম মাওলা স্যার, অমরেশ স্যার, লম্বু স্যার (নাম মনে নেই), সামনে বিমল স্যার; ডানে দলছুট নজরুল স্যার আর বাবুল স্যার
শিক্ষকদের একাংশ – বাম থেকে: মফিজ স্যার, কাশেম স্যার, মন্ডল স্যার, গোলাম মাওলা স্যার, অমরেশ স্যার, লম্বু স্যার (নাম মনে নেই), সামনে বিমল স্যার; ডানে দলছুট নজরুল স্যার আর বাবুল স্যার

স্যারদেরকে সম্মান কে না করতো। স্যাররাও ছিলেন সম্মানের কাঙাল। যেমন জালাল স্যার বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটা টেনিস বল এসে লাগলো স্যারের গায়ে। অমনি, বল জব্দ। যে মেরেছে তাকে সাথে সাথে চড়-থাপ্পড় তিন-চারটা। সবশেষে গজব নাজিল: “ছুটি হবার পরে টিচার্স রুমে দেখা করবা”। ওই ছেলের জন্য আজ এবং আগামী অন্ধকার!

স্যার/ম্যাডামদেরকে সবাই-ই সালাম দিতাম: স্লামালাইকুম। দ্রুত সালাম দিয়ে কেটে পড়ো, সামনে থাকলেই কোন থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে, কে জানে। গাজী এক ডিগ্রী বাড়া: সে শুদ্ধ করে সালাম দিবে। হাতের পাতা করাতের মতো সোজা করে মুখের সামনে ধরে গাজী ধীরে ধীরে বলবে, “স্যার, আস,সালা—মু আ-লাই-কুম।” কোনো ভনিতা নয়, সাচ্চা সালাম কিন্তু। অমরেশ স্যার ঘুরে তাকালেন। হাতের বেতটা উঁচিয়ে ধরলেন, “মশকরা করোস! মশকরা করোস!” বলেই গাজীর পাছায় সপাং সপাং তিন ঘা…। গাজী ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। বুঝতে পারছে না, সে কী করেছে! সমস্যা আসলে অন্য জায়গায় – কেউই শুদ্ধ করে সালাম দেবার সৎ সাহস রাখতাম না – খা বেতের বাড়ি।

👣

ক্লাস নাইনে উঠলে ছাত্রদেরকে বিষয় বাছাই করতে হয়: সাইন্স, আর্টস, কমার্স – আসলে সাইন্স, হিউমেনিটিস, বিজনেস স্টাডিজ। অষ্টম শ্রেণীতে রসায়নের সমীকরণ বুঝিয়ে দেননি কোনো শিক্ষক – তাঁরা মনে মনে এপাশের যোজনীর হিসাবগুলো করে ওপাশে বসাতেন, বুঝিয়েও দিতেন না। বুঝতে চাইবার মতো সৎ সাহসও আমার ছিল না। সেই থেকে মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে সায়েন্স বুঝবো না। কী নিবো তাহলে? হিউমেনিটিজের নাকি দাম নাই। তাছাড়া মামাতো ভাই রনি ভাইও কমার্স, থুক্কু বিজনেস স্টাডিজ নিয়েছেন, স্বভাবতই ওটাই নিবো ঠিক করলাম। কিন্তু সব সময় ‘সি’ সেকশনে থাকায়, না বুঝেই গিয়ে প্রথম ক্লাসে বসলাম সেখানে। বিশাল চওড়া রেজিস্টার খাতায় সেদিন ভর্তি করিয়ে নেয়া হচ্ছে সবাইকে ক্লাস নাইনে। আমারও নাম উঠে গেল খাতায়। পরে বুঝলাম এটা সায়েন্সের সেকশন। নিজের নাম কাটিয়ে গিয়ে ঢুকলাম ‘ডি’ সেকশনে – ভালো ছাত্র অনির সাথে বিদায় হয়ে গিয়েছিল সেই দিনই।

ক্লাস টেনে রোল ছিল ৩। তখন রোল নাম্বার ২ ছিল আরিফ। তখনই ওর সাথে যা একটু ঘনিষ্টতা হয় – বুঝতে পারি, ও ঠিক রাজনদের মতো না। কিন্তু এর আগে ও’ সব সময়ই রাজনদের দলে ছিল – বদমাশ কোম্পানী! আরিফ, আমি, আরেফিন – এসএসসি পর্যন্ত পারস্পরিক লেনদেন ছিল অপূর্ব। অন্যেরটা দেখে কেউ পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস পায় না। কিন্তু আটকে গেলে ছোট্ট একেকটা পয়েন্টে যখন আমরা পরস্পরকে ঝুঁকি নিয়ে হেল্প করতাম, তার তুলনা ছিল না।

এসএসসির আগে আগে, ২০০০ সালে, স্কুল-পিকনিকে গেলাম আমরা। তখনই প্রথমবার বুঝতে পারি স্যাররা আমাদেরকে আজকে মারবেন না। হাসিমুখে স্যাররা ছবি তুলতে পোয দিলেন। আমরাও প্রথম, সারাদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়ে বন্ধুরা বুঝতে পারি আমাদের স্কুলের সময়টা অপূর্ব ছিল। পিকনিকে গিয়েও কিন্তু আমরা একটা কাজ করতে ভুলিনি – অলটাইম ক্রিকেট টীম বলে কথা। 😜

👣

মাঝখানে অমরেশ স্যারকে নিয়ে সেলফিতে আবদ্ধ স্কুল জীবনের বদমাশ কোম্পানী জুয়েল আর রাজন (সেলফি: জুয়েল)
মাঝখানে অমরেশ স্যারকে নিয়ে সেলফিতে আবদ্ধ স্কুল জীবনের বদমাশ কোম্পানী জুয়েল আর রাজন (সেলফি: জুয়েল)

স্কুল পার করে এসেছি আজকের দিনে (২০১৮) প্রায় ২২ বছর হয়ে গেলো। এখন ছেলে বড় হচ্ছে, তাকে স্কুলে পাঠাতে হবে। ২০০১ ব্যাচের বন্ধুরা একটা ফেসবুক গ্রুপ মেনটেন করে – ধন্যবাদ বন্ধু রিফাত আর আসিফ-কে — সবগুলো বানরকে অন্তত একটা খাঁচায় আনার জন্য। সেই গ্রুপ থেকেই বন্ধুরা পুণর্মিলনী করেছে – সেখানে যখন বদমাশ কোম্পানী রাজনকে দেখলাম আদায়-কাচকলায় সম্পর্ক – অমরেশ স্যারের বোগলদাবা হয়ে হাসিমুখে সেলফি তুলতে, তখন মনে হচ্ছিল ব্যাটা তোঁদের মতো টম অ্যান্ড জেরি ছিল বলেই আমাদের স্কুলের সময়টা এতো সুন্দর ছিল!

না ফেরার দেশে রাজেশ্বর সিংহ রাজু (ছবি কৃতজ্ঞতা: কৌশিক আচার্য্য)
না ফেরার দেশে রাজেশ্বর সিংহ রাজু (ছবি কৃতজ্ঞতা: কৌশিক আচার্য্য)

কিন্তু যত পুণর্মিলনীই করি না কেন, একজনকে আর কক্ষণও দেখতে পাবো না কোনো পুণর্মিলনীতেই। দৌঁড়ে এসে ‘আঁখি’ বলে জড়িয়ে ধরবে না আর কখনও আমাকে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে আমাদের সাদা কাগজ মাখা কদম ফুল, রাজেশ্বর সিংহ রাজু ঢাকা-সিলেট সড়কে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তুখোড় এই রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দপ্তরের যুবপ্রধান হয়ে গিয়েছিল নিজের নিষ্ঠা দিয়ে। শেষজীবনে সে ইসকন-এর সাথেও জড়িত ছিল। … বন্ধু, তোকে খুব মনে পড়েরে! স্কুলজীবনটা স্মৃতি হবার আগেই তুই স্মৃতি হয়ে গেলি।

– মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*