লাতুর ট্রেন — ছোটবেলা নানাবাড়ি যাবার বাহন ছিল এই লক্করঝক্কর মার্কা ট্রেন। এখন আমরা মেইল ট্রেন বলতে যেসব ‘খোদার গরু ধর্মের রাখাল’ ট্রেনকে বুঝি, এই ট্রেন ছিল হুবহু তাই। কিন্তু তখন, এখনকার মতো অহরহ বাস ছিল না, ছিল না জনে জনে মোটরসাইকেল কিংবা প্রাইভেট কার। তাই লাতুর ট্রেন ছিল খুব সমাদৃত। একটাই মাত্র ট্রেন, সেটাই চলতো কুলাউড়া জংশন থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী শাহবাজপুর স্টেশন পর্যন্ত, আবার ফিরতো। আরো অতীতে এই শাহবাজপুর স্টেশনই ছিল লাতু’র স্টেশন, যেখান থেকে ভারতে ট্রেন যাতায়াত করতো। সেসময়ে ট্রেন মিস, মানে সেদিন আর কোথাও যাওয়া যেত না, বাড়ি ফেরত। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে এই লাতুর ট্রেনের যবনিকাপাত হয় আর তখন থেকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ৭টি রেল স্টেশনের (কুলাউড়া, জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলি, বড়লেখা, মুড়াউল আর শাহবাজপুর (লাতু)) মধ্যে ৬টির ইতি ঘটে।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভগ্নরূপ। আগে কত কর্মমুখর ছিল, বাদামওলা, চানাচুরওলারা ঘুরাঘুরি করতো। কিছুদিন আগেও ঢাকায় প্লাটফর্ম টিকেট বলে যে হলুদ রঙের শক্ত আয়তাকৃতি কাগজ দেয়া হতো, লাতুর ট্রেনের টিকেট ছিল সেরকম। কোনো কোনো বগিতে তিন সারি সিট ছিল। এখনকার মতো মাঝখানে আইল দিয়ে সিট ছিল কিনা এখন আর মনে পড়ছে না।
আমরা দক্ষিণভাগ স্টেশন থেকে উঠতাম, আর শাহবাজপুর স্টেশনে (24.804491, 92.237896) গিয়ে নামতাম। আমার নানাবাড়ি (24.826705, 92.250564) সেখান থেকে আরো ৩ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে (যাত্রাপথ^), একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি – পূবে একটা পুকুর, পশ্চিমে বড় আরেকটা। সেখানে তখন রিকশা অলিক ব্যাপার ছিল, কদাচিৎ পাওয়া যেত। বাহন তাই ঈশ্বরপ্রদত্ত পা দুখানি। ঐ ছোট বয়সেই আমরা ৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে নানা বাড়ি যেতাম। নানাবাড়ি যাবার পথটুকুতে খুব মজা লাগতো ‘ঘটাং ঘটাং পুল’-এ। স্টিলের একটা ব্রিজ ছিল ঝলঙ্গা নামক স্থানে, সেটার উপর দিয়ে যেতে পাতগুলো আওয়াজ করতো, খুব মজা পেতাম ছোটবেলায়। অবশ্য রিকশা করে না গেলে আওয়াজটা খুব একটা বোঝা যেতো না। …খুব বেশি ছোট থাকতে হয়তো কারো কাঁধে চড়ে গিয়েছি। কিন্তু ঐ হাঁটাটাও খুব ভালো লাগতো, কারণ নানাবাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি বলে কথা – অনুচ্চ টিলার উপরে, ‘দেওয়ার’ (হিন্দী দিওয়ার থেকে এসেছে) দিয়ে ঘেরা, বিশাল উঠানের বাড়িটা – সেখানে খালামনিকে পাবো! ❤️
নানাবাড়িতে উঁচু উঁচু পাহাড়, টিলা – রাতের বেলা তো প্রশ্নই উঠে না, দিনের বেলাতেই গা ছমছম করতো। একটা চা বাগান ছিল পথিমধ্যে। পাহাড় আর টিলা যেখানে নেই, সেখানে মাঠ, ধানী জমি। আর নানাবাড়িতে গেলেই খুব আয়োজন করে যে জায়গাটায় বেড়াতে যাওয়া হতো, তা হলো, ‘ইন্ডিয়ার বর্ডার’ 😲। জনৈক আত্মীয় একবার এক বিয়েতে বেড়াতে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ভারত সীমান্তে চলে গিয়েছিলেন, টেরই পাননি। পরে বিএসএফ ধরে ফেলে তাঁকে। তারপর বিডিআর-বিএসএফ বৈঠক করে তাঁকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল। নানাবাড়িতে আমি পুলিশ দেখতাম না, সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনী ছিল বিডিআর (পাকিস্তান আমলে এরা ছিল ইপিআর)।
কখনও কখনও আবার বর্ডারে যেতে দেয়া হতো না। কারণ? ‘এখন বর্ডার গরম’ 😲। এই ‘গরম’ কথাটার মানে হলো, বর্ডারে বিএসএফ-বিডিআর সম্পর্কে একটু টান পড়েছে, যেকোনো সময় গোলাগুলি হতে পারে।
বর্ডার এলাকার কিছু মানুষের ব্যবসাই হচ্ছে ভারত থেকে বিভিন্ন জিনিস এনে বিক্রী করা। আমার মনে আছে, আম্মা ‘বরোলিন’ ক্রিম কিনতেন এদের থেকে। এই পেশাকে বলা হতো ‘বুঙ্গা মারা’। যারা বুঙ্গা মারতেন, তাদেরকে আদ্যোপান্ত নেতিবাচকভাবে দেখা হতো ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। কারণ তারা ব্যবসা করতেন, যদিও পণ্যগুলো নিয়ে আসার জন্য হয় বিএসএফকে হাত করতেন, নয়তো গোপন পথ আবিষ্কার করতেন। বুঝতেই পারছেন, পাহাড়-টিলা-জঙ্গলের মাঝে গোপন পথের অভাব হতো না। তবে যারাই বুঙ্গা মারতেন, তাদের জন্য একটা ইংরেজি বিশেষণ জুটতো, ‘ডেয়ারিং’।
…এখন আর সেই দিন নেই। ভারত সীমান্তে এখন কাটাতারের বেড়া, রাতভর সেখানে কড়া বাতি জ্বলে। এই পেশা হারিয়ে গেছে। এখন বড়লেখা থেকে গাড়িতে উঠলে সরাসরি নানাবাড়ির সামনেই শেষ স্টপেজ। হারিয়ে গেছে লাতুর ট্রেন। হারিয়ে গেছে অতীতটা। হারিয়ে গেছে সুন্দর শৈশব। সেগুলোর ছবি নেই। খুঁজে ফিরি… হাতড়ে ফিরি… সেই অতীতটাকে। অতীত, কষ্টময়, কন্টকময় হলেও, সব সময়ই সুন্দর। খুব সুন্দর!
-মঈনুল ইসলাম