ধারাবাহিক: তরল স্বর্ণের দেশে ২০০১ —এর একটি পর্ব
আগের পর্বে ছিল: চুঙ্গিঘর থেকে চুঙ্গিঘরে… যেভাবে আটকে দিল ব্যাটা চুঙ্গিওয়ালা… আর সীট নিয়ে নিল ব্যাটা খাটাশ!
সংযুক্ত আরব আমিরাত
মধ্যপ্রাচ্য, অর্থাৎ প্রাচ্যের মাঝখান, অর্থাৎ পূর্বদিকের রাজ্যগুলোর (প্রাচ্য) মাঝখানটায় (এশিয়া আর আফ্রিকার মাঝখানে) যেসকল দেশ আছে, সৌদি আরব, ওমান, ইযরায়েল, ফিলিস্তিন, ইরান- এসব দেশের মতোই একটি দেশ আরব আমিরাত। অন্যান্য আরব দেশের মতোই তেলের খনির উপরে যার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। সৌদি আরব, আর ওমানের সাথে দেশটার স্থলসীমান্ত, আর কাতার আর ইরানের সাথে দেশটার জলসীমান্ত (প্রায় ৭৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ)। United States of America (যুক্তরাষ্ট্র) যেমন অনেকগুলো অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত, ঠিক তেমনি United Arab Emirates (UAE) সাতটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত, এজন্যই বলা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত:
- আবু ধাবি (Abu Dhabi) – أبو ظبي (আরবিতে আবূ দোবী) – রাজধানী শহর
- দুবাই (Dubai) – دبي
- শারজাহ (Sharjah) – الشارقة (আরবিতে আশ্শারক্বাহ)
- আজমান (Ajman) – عجمان (আরবিতে ‘আজমা-ন)
- ফুজিরাহ (Fujairah) – الفجيرة (আরবিতে আলফুজীরাহ)
- রা’স-আল খাইমাহ (Ras Al Khaymah) – رأس الخيمة, এবং
- উম্ম আল কোয়াইন (Umm Al Quain) – أمّ القيوين (আরবিতে উম্মুলক্বুয়া-ইন)
ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে শারজাহকে সবাই চিনেন, আর দুবাই পরিচিত আমাদের প্রবাসীদের কারণে আর ভ্রমণপিপাসু মানুষের ভ্রমণবিলাসের কারণে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সবগুলো অঙ্গরাজ্য ঘুরে দেখার, তাই সেগুলোর বর্ণনা সেখানেই উঠে আসবে ইনশাল্লাহ।
দেশটার স্বাধীনতা দিবস ২ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি। বেশিরভাগই মুসলমান, তখন প্রায় ৭৫%। আর মুদ্রার নাম দিরহাম, ১০০ ফুলূসে ১ দিরহাম হয় (পয়সার নাম ফিল্স, যার বহুবচন ফুলূস, ফালাসান)। (মূদ্রার মান – গুগল^)
আগুন আর পানি
মরুভূমির আবহাওয়া কেমন থাকে সে আমরা সবাই জানি। আসলে ‘জানি’ বলে ভাব করলেও আসলে জানি না — এতটুকু শুনেছি যে, মরুভূমি হয় প্রচন্ড উত্তপ্ত। হুম সেটা ঠিকই আছে — মরুর এই দেশে তাই গরম মাত্রাতিরিক্ত চরম্। আমি যখন আমিরাতে যাই অর্থাৎ এপ্রিলে, তখনই গরম উর্ধ্বমুখী হওয়া শুরু করে। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আমাদের দেশে গরমের সময় আমরা ঘামে নেয়ে যাই। কিন্তু ওদেশে গরমে ঘাম হয়না, কারণ ওদেশে বাতাসে আর্দ্রতা কম।
বাংলাদেশে গরমের সময় ধুলোবালি উড়ে একাকার হয়ে যায়। অথচ আমিরাতের বালুর কণাগুলো মোটা আর ভারি বিধায় এই ধুলোবালি জিনিসটা ওদের ভোগায় না। এছাড়া এই অসহ্য গরম থেকে বাঁচতে তাঁরা সর্বত্র শীতাতপ যন্ত্র লাগিয়ে নিয়েছে, নাহলে বাঁচা দায় হয়ে দাঁড়াবে। এতো গরম যে, ওই রোদে যে না দাঁড়াবে তাকে বোঝানো যাবে না। মনে হয় যেন শরীরের পানি শুঁষে শুঁষে একসময় পুরো শরীরটাকেই বাষ্প করে দিবে প্রখর রৌদ্র।
গরমের তীব্রতা বুঝেছিলাম আমি সেদিন, যেদিন শারজা’তে আব্বার দোকানের গোডাউনে যাই। আমার সঙ্গে ছিলেন আব্বার দোকানে কর্মরত আমাদের এক দূরসম্পর্কের চাচা: মুস্তাক চাচা। আমি আর চাচা রওয়ানা করি বাসে করে। সেদিন তাপমাত্রা চরম। বাসের ভেতর এ/সি পুরোদমে চলছে। তারপরও মনে হচ্ছে গায়ে গরম লাগছে। বেশিক্ষণ লাগলো না, গোডাউনের এলাকায় পৌঁছে গেলাম। এলাকাটা বিরান মরুভূমি (মরুভূমির দেশে বিরান স্থান নিশ্চই ঘাস-আচ্ছাদিত থাকার কথা নয়, তাই আছে শুধু বালি আর বালি), মাঝ দিয়ে পাকা সড়ক চলে গেছে। বাস থামলে আমরা দুজন নেমে গেলাম।
আর…
…সাক্ষাৎ দোযখে উপস্থিত হলাম। যারা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এ/সি থেকে বাইরে বের হবার অনুভুতিটা স্মরণ করতে পারছেন, তাদের কিছুটা বোঝার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো এক ডিগ্রি চরম। বালি এতো তাড়াতাড়ি গরম আর ঠান্ডা হতে পারে যে, গরম হলে তা চরম রূপ ধারণ করে। এই বালিও আমাদের আযাব দেয়া শুরু করলো। একে তো উপরের সরাসরি রোদ, তার উপর গরম বালিতে প্রতিফলিত গরম ভাপ, তার সাথে যোগ হয়েছে তীব্র গরম বাতাস। এই বাতাস যে কতটা গরম, তা বলে বোঝানো যাবে না। কাপড় দিয়ে আমাদের শরীরের যতটুকু ঢাকা ছিল, ততটুকুতে এই বাতাস কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারছে না। তবে মুখমন্ডল আর হাতে কোনো আবরণ নেই (হাফ হাতা টিশার্ট পরনে ছিল)। উন্মুক্ত অংশে যখন গরম বাতাসটা লাগে, তখন মনে হয় আগুনের মাঝে ফেলে দেয়া হয়েছে আমাদেরকে। প্রথমবার গরম বাতাস গায়ে লাগার পর আমি হাতের দিকে সন্দিঘ্ন হয়ে তাকালাম পর্যন্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমার গায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। পরে চাক্ষুষ করে আশ্বস্থ হলাম। তবে এই তিন দিকের আক্রমণ (রোদ, গরম বালির ভাঁপ আর গরম বাতাস) ঠেকিয়ে হেঁটে গোডাউন পর্যন্ত যেতে যেতে আমাদের প্রাণবায়ু বের হবার উপক্রম। গোডাউনে গিয়ে একটা পানির কল থেকে পানি দিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে একটু পানি খাবার পর তবে যেন দেহে প্রাণ ফিরে এলো। মরুভূমিতে নির্মিত ছায়াছবিগুলোতে দেখতাম, প্রচণ্ড গরম মরুভূমিতে তারা পুরো গা, মাথা, এমনকি মুখ পর্যন্ত (চোখ বাদে) কাপড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে আবৃত করে রেখেছেন। তখন মনে হতো, এতো গরমের মধ্যে এরা এভাবে শীতকালের মতো গায়ে কাপড় জড়িয়ে রেখেছে কেন? এদের গরম লাগে না? কিন্তু এই মরুর গরম বাতাসের অভিজ্ঞতার পর আমার আর কোনো প্রশ্ন থাকলো না। আর তাপমাত্রা বেশি হলেই যে উষ্ণতা হবে ব্যাপারটা যে তা না, সেটাও প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম আমিরাতে। কারণ তাপমাত্রা বেশি হলেও শুধু গরম বাতাসটাই সেখানে সমস্যা – আর্দ্রতা না থাকায় আমরা যে গরমকালে গরমে হাসফাঁস করি – এই ব্যাপারটা ওখানে নেই। যাহোক, সেবার আমি যেন হাবিয়া দোযখ থেকে বেঁচে ফিরেছি।
আরেকটা উদাহরণ দিই, পাঠক হয়তো হাসবেন। প্রতিদিন ভোরে উঠে আমি গোসল করতাম। কারণ যাদের সাথে থাকতাম, তারা সবাই-ই ব্যস্ত মানুষ। সকালে গোসল করে কাজে যান। আমিইবা ব্যতিক্রম হই কী করে? তবে আমার ভোর হতো দুপুরের কাছাকাছি সময়ে। রোদ তখন পানিকে বাষ্প করার পর্যায়ে। ছাদের ট্যাঙ্কের পানি তখন এতো গরম যে, চুলায় দেয়া গরম পানির সমপর্যায়ের বা তার চেয়েও বেশি গরম। এমতাবস্থায় গোসল করি কী করে? ফ্রিজের মাঝে রাখা হতো বোতলভর্তি পানি। সেই ঠান্ডা পানি এনে ঢালা লাগে কলের গরম পানিতে। তারপর সেই পানি হয় স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, নয়তো হালকা গরম থাকে। তাই দিয়েই গোসল করা লাগে। একবার ভাবুন তো, শীতের সময় আমরা গরম পানি দিয়ে গোসল করি আর আমিরাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হয়। সত্যিই বিচিত্র খোদার লীলা! …যে ঘরে আমি থাকতাম সে ঘরের দরজার নিচের ফাঁকটা একটা কাপড় দিয়ে বন্ধ করতে হতো, যাতে বাইরের গরম বাতাস ঘরের ভেতর আসতে না পারে। যে কাজটা আমাদের দেশে করতে হয় শীতের সময় ঠান্ডা বাতাস ঠেকাতে।
ওদেশে বৃষ্টিপাতের মাত্রা শূণ্য। এই কথার মানে আবার ‘কোনো বৃষ্টি হয়না’ ধরে নিলে ভুল হবে। বৃষ্টি হয় কদাচিৎ, কিংবা যা হয়, তা মোটেই চাহিদার সাপেক্ষে যথেষ্ট না। আমরা বইপত্রে পড়ি, গাছ যত বেশি থাকবে আবহাওয়া তত ভালো হবে, হবে বৃষ্টিপাত। এই পূঁথিগত বিদ্যাকে ওঁরা (আরবরা) বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাঁরা দেশের প্রতিটি মরুময় এলাকাকে সবুজে সবুজে ভরে তুলতে শুরু করেছে। আল-আইন অঙ্গরাজ্য তো রীতিমতো সবুজ অরণ্য। তাই সেখানকার এক বাসিন্দা জানিয়েছিলেন, ওখানে নাকি বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। এটা আল-আইন রাজ্য সরকারের একটা বিশাল অর্জন। (২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর বিটিভির খবর থেকে জানতে পারলাম, আমিরাতের দুবাইতে প্রথমবারের মতো শিলাবৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় জলজটে নাকি গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। তবে বৃষ্টি নাকি আগেও হয়েছিল, প্রায় পাঁচ বৎসর আগে। আর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে এসে প্রায়ই আমিরাতে বৃষ্টির খবর শুনি)
বৃক্ষায়ন আর নগরায়ন
‘বৃক্ষায়ন’ আর ‘নগরায়ন’ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুটি পরস্পরবিরোধী শব্দ। অর্থাৎ যেখানে বৃক্ষায়ন হবে সেখানে নগর হবে না, আর যেখানে নগরায়ন হবে সেখানে গাছ থাকবে না। অথচ আরব আমিরাতের নীতি নির্ধারকরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছেন, গাছের চেয়ে বড় বন্ধু আর নেই। আবার অপরদিকে বাড়তি জনগণের জন্য দেশকে গড়ে তুলতে হবে আগামী দিনের জন্য, সুতরাং সহজ সমাধান হলো: নগরায়ন করতে হবে বৃক্ষায়নকে বজায় রেখে।
তাঁরা ইতোমধ্যে ঠিক করে ফেলেছেন, পুরো মরুভুমিকে সবুজ করে ফেলতে হবে। এজন্য দরকার পানি। তার ব্যবস্থাও তাঁরা কোথা থেকে যেন করে ফেলেছেন। আসলে ইচ্ছা থাকলে কী না হয়? মরুভূমিতে কিভাবে তাঁরা এই বৃক্ষায়ন করছেন, তা খুব কাছাকাছি থেকে দেখবার সুযোগ আমার হয়নি। তবে মোটামুটি-দূরত্ব থেকে দেখার আর ওখানে যারা কাজ করেন বা করেছেন, তাঁদের সাথে কথা বলার ভাগ্য আমার হয়েছে।
আমি কোনো দূর অঙ্গরাজ্যে আসা-যাওয়ার পথে যা দেখলাম, তা হলো: বিশা-ল এলাকা জুড়ে করা হয়েছে ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে থাকেন কর্মীবাহিনী। বিশাল এলাকায় বীজতলা তৈরি করে তাতে গাছ লাগিয়ে তার পরিচর্যা করা হয়, যতদিন না ওগুলো স্বাবলম্বি হয়, মানে নিজে নিজে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জন করে। এভাবে একের পর এক স্থান নির্বাচন করা হয় আর গাছকে বেড়ে উঠতে যথেষ্ট পরিচর্যা করা হয়। গাছের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ছায়ার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে সবুজ বিপ্লব চলছে পুরো আমিরাত জুড়ে।
আমি তো মরুভূমির দেশে গিয়েছি, তাহলে আমার মরুভূমির ছবি তুলতে তো নিশ্চয় কোনো সমস্যা হবার কথা নয়? যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশে এসে কারো নদীর ছবি তুলতে কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু আমিরাতে মরুভূমির ছবি তুলতে আমাকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাও যা তুলেছি, তাতে মরুভূমির ছবি হিসেবে তৃপ্তি আসবে না কোনো দর্শকের (হয়তো আরো গ্রামাঞ্চলে যাইনি বলে সেটা পাইনি)।
আমিরাতে নগরায়ন হচ্ছে গভীর পরিকল্পিত আর পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়িত। নতুন নতুন স্কাইক্র্যাপার (উঁচু উঁচু আকাশ ছোঁয়া দালান) যেন গোটা আমিরাত ছেয়ে গেছে। কিন্তু তারও একটা পরিমাণ আছে। বেশিও না আবার কমও না: একটা মাত্রার ভেতরে। পরিসংখ্যান বলছে, আমিরাতে বনায়নধ্বংসী (deforestation) কার্যকলাপের মাত্রা ০ (শূণ্য)।১
এই পথ আমার ঠিকানা
আরব আমিরাতে গিয়ে আমি জীবনে প্রথমবার আবিষ্কার করলাম রাস্তার সৌন্দর্য্য বলে একটা ব্যাপার আছে। আমি কোনটা রেখে কোনটা বলি বুঝতে পারছি না। আগেই বলে রাখি, আমিরাতে সব গাড়ি বামহস্তচালিত (left hand drive)। তাই রাস্তায় যেতে হয় ডানদিক ধরে। যেখানে বাংলাদেশে ডানহস্তচালিত আর যেতে হয় বামদিক ধরে। পুরো আমিরাত জুড়েই এই নিয়ম, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসিত দেশগুলোর মতো না, বরং আমেরিকা, ইউরোপের মতো ওখানকার গাড়ি চালকগণ বামহাতে (?) গাড়ি চালান (মানে গাড়ির বাম দিকে স্টিয়ারিং থাকে)।
আপনারা হয়তো খেয়াল করবেন, রাস্তার মাঝে কিছু সাদা সাদা দাগ থাকে। এই সাদা সাদা দাগগুলো যখন মানুষ পারাপারের জন্যে দেয়া হয়, তখন সেটা হয়ে যায় যেব্রা ক্রসিং (zebra crossing)। কিন্তু এই দাগগুলো যখন রাস্তার মাঝখানে থাকে লম্বালম্বি, তখন এগুলোর মানে কী? আমি জানতাম না। না জানার কারণ আমাদের দেশে এই দাগ টানার প্রচলন থাকলেও ব্যবহার নেই। এই দাগগুলোর মাঝে, [রোড আইল্যান্ড থেকে] সবচেয়ে কাছাকাছি দাগের ভেতরে যেসকল গাড়ি চলে, তাদের গতি থাকে সর্বোচ্চ [বা বেশি], তারপরের দাগগুলোতে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে গাড়ির গতি। আরেকটু পরিষ্কার করা যাক ব্যাপারটা: ধরুন একটি গাড়ি চলছে স্বাভাবিক গতিতে, সে আইল্যান্ডের কাছ থেকে সবচেয়ে দূরের দাগের ভেতর দিয়ে চলবে। তার গতি বাড়ানোর দরকার পড়লো, সিগনাল বাতি জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে গতি বাড়াতে বাড়াতে, আইল্যান্ডের দিকে, পরবর্তি দাগের মাঝে ঢুকবে গাড়ি। এরপর আরেকটু বাড়াতে গেলে আবার এর পরের দাগের ভেতরে ঢুকবে গাড়ি। এভাবে বিভিন্ন গতিতে গাড়ি রাস্তায় চলে। তাই দুর্ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। দাগের ভিতরটাকে বলা হয় ‘লেন’ (lane)। এভাবে লেন মেনে গাড়ি চালানোর নিয়মটা উন্নত যেকোনো দেশেই অনুসৃত হয়। তবে এই পদ্ধতি হাইওয়েতে বেশি মানা হয়; শহরের ভিতরে তেমন কঠোরতা দেখিনি।
পুরো আমিরাতে গাড়ির হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ। খুব সমস্যা না হলে অযথা হর্ণ বাজালে উল্টো জরিমানা দিতে হয়। তাই শব্দদূষণ হয়না। আমিরাতে রাস্তার প্রচুরতা আর প্রাচুর্য্য যে-কারো চোখে লাগার মতো। প্রাচুর্য্য হলো রাস্তার সৌন্দর্য্য। আমি তো রীতিমতো উচ্ছসিত (যদিও ২০০৫ সালের পরের ঢাকার বাসিন্দার কাছে ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। কারণ ঢাকাতেও এখন সৌন্দর্য্যবর্ধন করা হয়েছে)। আমিরাতে প্রতিটি রাস্তাই কমপক্ষে ৭০ফুট চওড়া (অলিগলি বাদে)। রাস্তার মাঝখানে আবার সড়ক দ্বীপ (road island); সেগুলোও ২৫ফুট মতো চওড়া। আইল্যান্ডগুলোতে ফুলগাছ থেকে শুরু করে ঘাস, আবার খেজুর গাছ পর্যন্ত আছে। কোথাও কোথাও ফুল আর গাছ দিয়ে তৈরি হয়েছে কোনো লেখা বা কোনো মোটিফ। সেখানেও খাটছে হাজার হাজার মানুষ। সৌখিন জাতি বললে ওদেরকেই বলা যায়, সৌখিনতা জানেও ওরা।
আমাদের দেশে ‘চার রাস্তার সমাহার’ মানেই রাস্তার মাঝখানে একটি ট্রাফিক পোস্ট, যেখানে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করেন (প্রেক্ষিত ২০০১)। কিন্তু আমিরাতে চার রাস্তার সমাহার মানেই শিল্পীদের মহিমাক্ষেত্র। মোহনায় তৈরি হয় বিরাট গোল-চক্কর, যাকে ইংরেজিতে বলে রাউন্ডঅ্যাবাউট (roundabout)। আমি ওখানকার বাংলাদেশীদের মুখে শব্দদ্বয়কে শুনলাম ‘রান্দাবাট’! মনে মনে অনেক যুদ্ধ করেও এর অর্থ করতে পারিনি তখন। পরে আব্বাকে জিজ্ঞেস করে সঠিক শব্দটা জানলাম। রাউন্ডঅ্যাবাউট মানেই সিমেন্টে বাঁধানো বিরাট একটুকরো গোল দ্বীপ। কোথাও শুধু গাছ আর গাছ। আমিরাতে এই দ্বীপের মাঝে তৈরি হয় কোথাও আমিরাতের ঐতিহ্যপূর্ণ কোনো স্থাপত্যিক কাঠামো, কোথাও ক্বোরআন শরীফের মডেল, কোথাও বন্য প্রাণীদের মূর্তি, কোথাও বিশাল ঘড়িঘর, অথবা কোথাও শুধুই গাছগাছালির বাগান। এ যেন সত্যিই এক দ্বীপ। (২০০৫-এর পরবর্তি বাংলাদেশের বাসিন্দারা এখন আর এসব শুনে আশ্চর্য হবেন না, জানি)
আমিরাতের রাস্তায় সাইনবোর্ডগুলোর কথায় আসা যাক। রাস্তা যেমন আছে, তেমন আছে সাইনবোর্ড। আমার মনে হয় এতো এতো সাইনবোর্ড আর নির্দেশনা পেলে যে-কেউ হাঁটতেও শান্তি পাবেন। কোথাও গতি কমানো দরকার, সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘এখন গতি কমান’ (Reduce speed now); সামনে গতিরোধক, এর জন্য সতর্কতা থাকবে দুইশো গজ আগে ‘গতি কমান, সামনে গতিরোধক’ (Reduce speed Humps ahead)। সামনে রাস্তা বাঁকা হয়ে চলে গেছে, রাস্তার পীচের মধ্যে দুই/তিন গজ অন্তর অন্তর তীরচিহ্ন এঁকে প্রায় দেড়শো গজ আগে থেকে নির্দেশ দেয়া থাকে। সামনে ফুয়েল পাম্প (যেখানে গাড়িতে তেল বা গ্যাস ভরা হয়) তার জন্য কমপক্ষে দুইশো গজ আগেই দু’তিনটে ছোট ছোট সাইনবোর্ডে ফুয়েলের আইকন আঁকা আছে। যাতে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় ফুয়েল নিতে আগে থেকেই ফুয়েল পাম্পে প্রবেশের জন্য গাড়িকে ঘোরাতে প্রস্তুত থাকেন। এর চেয়ে আর ভাল কী আশা করা যায়!
রাস্তাগুলোর মসৃণতা এতো ভালো যে, গাড়িতে বসে আপনি অনায়াসে লেখালেখি করতে পারেন, চা-কফি খেতে পারেন। এতো এতো রাস্তা, সে অনুপাতে গাড়ি কম, আর নিয়ম মেনে চলায় রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই চলে। রাস্তায় যেকোনো গাড়িতে চড়তে গেলে আপনাকে বাধ্যতামূলকভাবে সীটবেল্ট বাঁধতে হবে। এ নিয়ম সামনের সারির দুসীটের যাত্রীর জন্য প্রযোজ্য। বাসে এই নিয়ম শুধুই ড্রাইভারের জন্য।
আমিরাতের বাস সার্ভিস বেশ উন্নত। আমি দুবাই শহরেই শুধু বাস চড়েছি। ওখানে বাসে উঠতে হয় ড্রাইভারের ডানদিকের একটি দরজা দিয়ে (যেহেতু ড্রাইভার বামদিকে বসে ড্রাইভ করেন)। দরজার স্যুইচ থাকে ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণে। বাসে উঠে নির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা বলতে হয় ড্রাইভারকে। ড্রাইভার তখন আপনার কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে একটি ছোট্ট মেশিনে প্রয়োজনীয় তথ্য দিবেন। তখনই ঐ মেশিন থেকে ছোট্ট একটি কাগজ প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসবে, যা হবে আপনার যাত্রাপথের টিকেট। টিকেটের একেবারে নিচে কাস্টমার সার্ভিসের জন্য টোল ফ্রি একটি টেলিফোন নাম্বার দেয়া। সেবা আমার কাছে ভালোই লেগেছে, সুতরাং টোল ফ্রি নম্বরের প্রয়োজনই পড়েনি।
বাসে উঠে একটি সীট বেছে নিয়ে বসে পড়তে হয়। সীট না থাকলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে বাসের ড্রাইভার ১০জনের বেশি একজন লোকও দাঁড়িয়ে নেন না। বাসে দাঁড়ানো যাত্রী থাকলে স্টপেজে বাস থামিয়ে রিয়ার-ভিউ মিররে আগে দাঁড়ানো যাত্রীসংখ্যা গুণে নেন ড্রাইভার। তারপর দরজা খুলে, ১০ জন হতে ঠিক যতজন দরকার, অতজন তুলে আবার দরজা বন্ধ করে দেন। বাসের ভিতর দুই সারি সীট, মাঝখানে বেশ প্রশস্থ প্যাসেজওয়ে। প্রতি সারিতে দুজনের বসার ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে আপনাকে চাপ দিতে হবে একটি নির্দিষ্ট বোতামে, যা বাসের বিভিন্ন স্থানে লাগানো আছে। বোতামটির নাম ‘কল বাটন’ (call button)। বোতামটিতে চাপ দিলে কলিং বেলের মতো একটা হালকা শব্দ হবে আর বাসের কতকগুলো ছোট ছোট মনিটরে ভেসে উঠবে: ‘স্টপ রিকোয়েস্টেড’ (Stop Requested)। ড্রাইভার তখন পরবর্তী বাসস্টপে বাস থামাবেন আর আপনি সেখানে নেমে যেতে পারবেন। নামার জন্য প্রতিটি বাসের মাঝখানে আছে আরেকটি দরজা, এটারও নিয়ন্ত্রণ ড্রাইভারের হাতে। প্রশ্ন আসতে পারে, পরের বাসস্টপে তো বাস এমনিতেই থামাবে, তাহলে কল বাটনের দরকার কেন? ঘটনা হচ্ছে, ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলো ছাড়া অন্যান্য সব শহরেই সব সময় বাসস্টপে লোক থাকে না, তাই বাস দাঁড়াবার দরকারও পড়ে না। তাছাড়া কখনও বাস যদি তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী লোক ভর্তি করে নেয়, তাহলে নামানোর কাজটুকু ছাড়া, পরের স্টপেজে [উঠার জন্য] লোক থাকলেও আর থামাবে না। সেক্ষেত্রে কেউ নেমে জায়গা খালি হলে কারো উঠার প্রশ্ন আসছে।
হাইওয়েতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রোড-আইল্যান্ডের মাঝখানে বসানো আছে একটা বাক্স, দেখতে আমাদের দেশের বিটিসিএল-এর ধাতব বাক্সগুলোর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এই বাক্সে বসানো আছে গোপন ক্যামেরা। যে গাড়িই যাক না কেন, যত গতিতে যাক না কেন, ক্যামেরা ঠিকই গাড়ির নাম্বারপ্লেটের, আরোহীদের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিবে কন্ট্রোল রুমে, সাথে পাঠাবে গাড়ির গতি। যদি গাড়ির গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়, তবে গাড়ির মালিক বা চালককে পোহাতে হবে আইনী জটিলতা। গুণতে হবে মোটা অঙ্কের খেসারত।
হাইওয়েতে আছে ইন্টারচেঞ্জ। হাইওয়েতে গাড়ির গতি থাকে খুব বেশি। তখন রাস্তার মাঝখানে গাড়ি ঘোরাতে গেলে দুর্ঘটনা হতে পারে। তাই রাস্তার উপর দিয়ে অনেকটা ওভারব্রিজের মতো করে একপাশ থেকে গাড়িকে অপর পাশে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে, যাকে ইন্টারচেঞ্জ (interchange) বলে — যেগুলো বামদিক থেকে উঠে গেছে, তারপর ডানদিকে গিয়ে নেমে গেছে। বাংলাদেশে (প্রেক্ষিত ২০১৮) এধরণের ইন্টারচেঞ্জ তৈরি হয়েছে, যেগুলোকে নাম দেয়া হয়েছে U-loop (ইউ লুপ)। ইন্টারচেঞ্জ ছাড়াও যেখানে যেখানে প্রযোজ্য, ফ্লাইওভার দিয়ে রাস্তা পৃথক করা হয়েছে, ফলে ট্রাফিক জ্যাম অনেক কমে এসেছে। (প্রেক্ষিত ২০০১)
পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে ফুটওভারব্রিজ আছে প্রয়োজনীয় স্থানে। ওভারব্রিজগুলো আমাদের দেশের মতো সিঁড়ি দিয়ে নয়। ওখানে ওভারব্রিজগুলোর ওঠা-নামার পথটা সমতল- মানে ঢালু সমতল। প্রতিবন্ধিদের কথা বিবেচনায় সিঁড়ির বদলে এরকম সমতল রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে দুই বাঁকে সিঁড়ি বেয়ে ওভারব্রিজে উঠতে হয়। সেখানে যাতে ঢালু বেশি না হয়ে যায়, তাই তিন বাঁকে উঠা-নামার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া কোথাও কোথাও আন্ডারপাসের ভিতর দিয়েও পথচারি পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তায় যেব্রা ক্রসিং দিয়েও পার হবার ব্যবস্থা রয়েছে তুলনামূলক কম ভিড় হয় যেসকল স্থানে। যেখানে সিগন্যাল বাতি আছে, সেখানে বাতির সাথে সাথে চলতে হয়। আর যেখানে সিগন্যাল বাতি নেই, সেখানে হলুদ দুটি বাতি ক্রসিং বরাবর রাস্তার দু’ধারে জ্বলতে-নিভতে থাকে- অর্থাৎ গাড়ির গতিকে এখানে কমিয়ে এনে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখুন। যেকোনো পথচারী যেব্রা ক্রসিংয়ে পা দেয়ার সাথে সাথে গাড়ি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি একদিন এরকম দোটানায় ভুগছিলাম, গাড়িটা আসছে, এখন যেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হবো কিনা। কী মনে করে যেব্রা ক্রসিংয়ে পা রাখলাম, সাথে সাথে গাড়িটা ব্রেক করলো। আবার ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলাম, গাড়িটা এবারে থেমে থেকে আমাকে যাবার জন্য অভয় দিলো। …এভাবেই সেদেশে আইন মানা হয়।
যেমন রাস্তাঘাট, তেমন তার গাড়িগুলোও, রঙে-রূপে-কার্যকারিতায় অপূর্ব। মার্সিডিজ, ল্যান্ড ক্রুযার, বিএমডব্লিউ, শেভরোলেট- এগুলো ওদেশে ভালোই প্রচলিত। রোলস রয়েসও রয়েছে শুনেছি (শেখদের দেশে না থাকাটাই আশ্চর্য হবে!), যদিও আমি দেখিনি। ট্যাক্সি ক্যাবের অভাব নেই, হাত তুললেই হাজির। পাঠকদের জানিয়ে রাখি ট্যাক্সি ক্যাবের মধ্যে আবার দু’ধরণের ক্যাব আছে:
- মিটার লাগানো, আর
- মিটার ছাড়া।
মিটার লাগানো ট্যাক্সিই সাধারণত আমরা দেখি। কিন্তু মিটার ছাড়া ট্যাক্সি হলো অনেকটা আমাদের দেশের [আগেকার] বেবি ট্যাক্সির মতো (যা ধীরে ধীরে আমিরাত থেকে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে)। এই মিটার ছাড়া ট্যাক্সিগুলো চলে আমিরাতের এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক অঙ্গরাজ্যে (inter state)। ওখানকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দারা জানেন কোন অঙ্গরাজ্য থেকে কোন অঙ্গরাজ্যে কত ভাড়া। তাই কোন অঙ্গরাজ্য পর্যন্ত যাবেন, তা ঠিক করে নিয়ে ড্রাইভারকে বলতে হয়। সাথে নিতে হয় আরো কিছু সঙ্গীসাথী, যেন পুরো ক্যাব ভরে যায়। গন্তব্যে পৌঁছে মাথাপিছু নির্দিষ্ট ভাড়া দিয়ে নেমে গেলেন, ব্যস। মাঝখানে আপনাকে পোহাতে হবে অসহ্য গরমে চাপাচাপির মতো বাস্তব অভিজ্ঞতা, ফ্রি – যদিও সব গাড়িতেই এসি থাকে। …মিটার লাগানো ক্যাবগুলোতে ঝামেলা নেই, ডাকলেন, উঠলেন, গন্তব্য বললেন, চলে গেলেন। মিটার দেখে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন।
এছাড়াও অবশ্য আরো নানাবিধ ট্যাক্সি আছে আমিরাতে। যেমন: স্থান বা এলাকাভিত্তিক ট্যাক্সি, জাতীয় ট্যাক্সি ইত্যাদি। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে ট্যাক্সি ক্যাবের নকশা, ক্ষেত্রবিশেষে রঙও অবশ্য ভিন্ন। আর ট্যাক্সি ক্যাবের চালকদের মধ্যে পাকিস্তানি, ইরানি এসব দেশের লোকই বেশি দেখলাম।
-মঈনুল ইসলাম
___________________
ইনশাল্লাহ আগামী পর্বে থাকছে…
ভ্রমণস্বর্গ দুবাই… | মসজিদের শহর? | স্বর্ণের বাজার!! | আবরার বিড়ম্বনা… | বাইরেরও একটা দুবাই আছে নাকি!! | লিটল ইন্ডিয়া
_____________________
তথ্যসূত্র:
১. আমিরাতের বনায়নধ্বংসী কার্যকলাপের পরিসংখ্যান^ – rainforests.mongabay.com