ধারাবাহিক: মন্দের ভালোয় নরম গরম সিলেট ভ্রমণ ২০০৭ —এর একটি পর্ব
…চাকাটা সম্পূর্ণ ভচকে দিয়েছে গাড়িটা। …আইসক্রিমওয়ালাকে ওভাবে রেখেই দ্রুত গাড়ি নিয়ে কেটে পড়তে চাচ্ছিলো বাদল, কিন্তু সামনের রাউন্ড এ্যাবাউটেই দাঁড়ানো সার্জেন্ট ঘটনাটা দেখে ফেলায় হাত নাড়লো গাড়ি থামানোর জন্য। যাও, ঠ্যালা সামলাও!!
১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭; রবিবার
হঠাৎই আমার এক দূ-র সম্পর্কের চাচা বাসায় এসে হাজির। তাঁকে নিয়ে যেতে হবে তাঁর বাড়িতে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা আছেন বিধায় দেশের অলিগলি সব তাঁর অচেনা। তিনি বাসায় এসে শান্ত ধীর হয়ে যদি বলতেন যে, বাড়ি যাবো– তা, নাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তিনি যেন সেরকম বান্দাই নন। এসে বাসায় ঢুকে সোফায় বসতে পর্যন্ত রাজি নন। তাঁকে নিয়ে এক্ষুণি পারলে বেরিয়ে পড়তে হবে তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে। অগত্যা আমরা তথাস্থ প্রস্তুতি নিলাম।
‘আমরা’ বলতে আমি আর আমার দুজন চাচা (যথাক্রমে সেজ চাচা আর ছোট চাচা)। চাচা দুজনই বয়সে যুবক, আমারই মতো; পার্থক্য এতটুকু, আমি উঠতি যুবক, আর তাঁরা পরিপক্ক (“চাচা” শব্দটার স্বভাবসুলভ বয়স আর ভারিক্কির খাতায় এঁদেরকে ফেলা যাবে না)। ছোট চাচা আর আমি চললাম রেন্ট-এ-কারে গাড়ি ভাড়া করার জন্য। সেখানে গিয়ে আমরা জানালাম, ‘একটা গাড়ি লাগবে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত।’ রেন্ট-এ-কারের লোকটা চিনতেই পারলো না এই ‘বিয়ানীবাজার’ কোথায়। তার এই অজ্ঞতার কারণে সে তার পরিচিত শব্দ দিয়ে ‘বিয়ানীবাজার’কে প্রতিস্থাপিত করলো ‘বিরানি বাজার’ বলে। আমরা দুজনে বারবার তাকে শুধরে দেবার চেষ্টা করা সত্ত্বেয় সে তার সেই ‘বিরানি বাজার’ই আউড়ে যাচ্ছিল। অগত্যা আমরা তার ঐ ‘বিরানি বাজার’ই মেনে নিলাম।
তাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝালাম, তার এই বিরানি বাজার (!) যেতে হলে সিলেট শহর অবধি যেতে হয় না; তার আগেই পড়ে; আমরা কেন উল্টো সিলেট পর্যন্ত যাব? সে তার অজ্ঞতার কারণে ঢাকা-সিলেট দূরত্ব দেখে নিলো। ক্যালকুলেটর বের করে মাইলেজ হিসাব করে গ্যাস-তেলের হিসাব কষে নিলো। জানালো, ‘ঢাকা থেকে গ্যাসে করে যাওয়া যাবে, কিন্তু পথে আর কোথাও গ্যাস ফিলিং স্টেশন নেই; তাই আসতে হবে তেলে চালিয়ে।’
সমস্যা হলো অন্য জায়গায়, তাদের নিজস্ব গাড়ি, ভাড়ায় গেছে; এখন তারা অন্যখান থেকে ব্যবস্থা করে দিবে। আমরা অপেক্ষা করছি। ওদিকে দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব রওয়ানা করতে চাই। কিছুক্ষণ পরে আমরা বসলাম অন্য একজন মানুষের সাথে কথা বলতে। তার মাথার সামনের দিকে টাক পড়েছে, ঠোঁটের উপর কালো গোঁফ, সাদা একটা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা। তার কথাবার্তা থেকে জানা গেল, সিলেট শহরে সে গাড়ির ব্যবসা করে। সেজন্য সোহাগ পরিবহনের বাসে সপ্তাহে কখনও দু-তিনবারও সিলেট যায়। বুঝলাম, সে যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটা হবে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তার সিদ্ধান্ত; সুতরাং তার উপর ভরসা করা যায়।
সে জানালো, তার বন্ধুর নিজস্ব গাড়ি আছে, সেই গাড়ি সে নিজেই চালায়, সেটা দিয়েই যাবার ব্যবস্থা করে দিবে; সে যেতে পারছে না, তার আজকে কী যেন কাজ আছে। সে টাকা চাইলো সব মিলিয়ে আট হাজার। দরদাম করে সেটা ঠিক করা হলো সাড়ে পাঁচ হাজার। যখন শুনলো বিদেশি যাত্রী নিয়ে যেতে হবে, তখন জানালো নতুন তথ্য: টাকা বাড়াতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ জানালো, ‘বিদেশির ব্যাগেজ দেখলে পথে বিট দিতে হয়’। “বিট” হলো পুলিশ সার্জেন্টকে চাঁদা দেয়ার অশিষ্ট নাম। যাই হোক, সে দায়িত্ব আমরা আমাদের ঘাড়েই রাখলাম, সময় হলে দেখা যাবে। তারপর অপেক্ষা, গাড়ির আর খবর নেই। শেষ পর্যন্ত গাড়ি এলো, তখন বাজে দুপুর একটা-পাঁচ। গাড়ি এসে পৌঁছতেই বোঝা গেল আমাদের সেই সাদা শার্ট পরিহিত ব্যক্তি একটু আগে ‘যেতে পারছে না’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছিল, তা মিথ্যা প্রমাণ করে কাজ (?) ফেলে আমাদের সাথে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর কী হলো, হঠাৎ করে আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যাবো চাচাদের সাথে, কেননা আমরা গাড়িটা ভাড়া করেছি ‘রাত্রে আবার এই গাড়িতে করেই ফিরে আসবো’ এমন শর্তে। সুতরাং একদিনের এমন ট্যুর মিস করা যায় না। দ্রুত বাসায় এসে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। পকেটে পকেট-নোটবুক, কলম, পেনসিল ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চাচাদের সাথে। সিলেট-বিয়ানীবাজারে প্রচন্ড ঠান্ডা, তাই শীতের কাপড় নিয়ে নিলাম সাথে।
নয় সীটের মাইক্রোবাসে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে সাদা শার্ট পরিহিত ব্যক্তি, তার পাশে বামদিকের দরজার কাছে আমি। মাঝের তিন সিটে বিদেশ ফেরত দূ-র সম্পর্কের চাচা আর আমার দুই চাচা। পেছনের সিট ভর্তি চারটা বিশাল বিশাল লাগেজ। গাড়ি ছাড়তেই ‘সাদা শার্ট’ আর ‘ড্রাইভার’ কথা বলতে লাগলো পরস্পরের সাথে। আমি তাদের দুজনের মাঝখানে বসা। আগেই বলেছি ‘ড্রাইভার’ হলো ‘সাদা শার্ট’-এর বন্ধু।
পথ চলছি; দুজনের গল্প চলছে। ড্রাইভারের কথা থেকে বুঝতে পারলাম, সে তার বন্ধুর উপর খুব নারাজ। এই টাকায় সে বিয়ানীবাজার যেতে রাজি নয়। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ড্রাইভার বিয়ানীবাজার যায়ইনি কখনও। ড্রাইভারের নাম মনে নেই। ধরা যাক আমাদের ড্রাইভারের নাম দিলাম ‘মনির’, আর সাদা শার্ট পরিহিত বন্ধুর নাম ‘বাদল’। বাদল নামটা দেয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে, কারণ বাদল নামটাকে একটু পরিবর্তন করে নিলেই হয় ‘বাদর’। আগেই বলে রাখছি, এই [কাল্পনিক] বাদল নামের লোকটি সত্যিই একটি বাদর শ্রেণীর লোক।
তাদের কথাবার্তায় দুতিন মিনিটে অনেক কিছুই আঁচ করে নিলাম আমি। যেমন: আমাদের বাদল মিয়া সবসময়ই নিজেকে সবজান্তা টাইপের একজন মনে করে, নিজের কথাগুলোকে অনেকটা মতবাদ টাইপের ধরে নেয়, নিজের ব্যবসাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ কাজ বলে ধারণা পোষণ করে। বাদল মিয়া ড্রাইভিং জানে, তার রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা তার হাত ধরেই উঠলো বলে, আর বলাই বাহুল্য সে তার ড্রাইভিং ক্ষমতাকেও জগৎশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। ওদিকে ড্রাইভার মনির মিয়া একটু অন্তর্মুখি কিসিমের, ঈষৎ ভদ্র, আর তার ঢাকাতে নিজস্ব বাড়ি আছে। আগেই বলেছি যে গাড়িতে করে আমরা চলেছি, সেটা ড্রাইভার মনিরের নিজস্ব গাড়ি। ড্রাইভার মনির কিছুটা মেজাজ দেখাচ্ছে তার বন্ধুর সাথে, কেননা তার হিসাবমতে এই যাত্রা পুরোটাই লস হবে; কারণ যাবার মতো করে যদি আসার সময়ও গ্যাস দিয়ে আসা যেতো, তবে লাভ হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। কারণ গ্যাস ফিলিং স্টেশন, পথে আর কোথাও নেই, শুধু সিলেট শহরে আছে। উল্লেখ প্রয়োজন, সেখান থেকে গ্যাস নিতে হলে কমপক্ষে চব্বিশ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, আমরা সিলেট শহরে যাচ্ছিই না। সিলেট শহরের আগেই বিয়ানীবাজার; অযথা কেন সিলেট যাব?
যতবারই ড্রাইভার মনির আপত্তি জানাচ্ছে, ততবারই পণ্ডিত বাদল তার বন্ধুকে বোঝাচ্ছে, বন্ধুর যাতে লাভ হয় সেজন্যই সে তার কাজ (?) ফেলে আমাদের সাথে চলে এসেছে। পাঠকের সুবিধার জন্য জানাচ্ছি, পণ্ডিত বাদল সত্যিই ঢাকা-সিলেট যাতায়াত করে আর সে বাসে যাতায়াত করে ঢাকা-সিলেট বাইপাস সড়ক দিয়ে। বাইপাস সড়ক হলো সংক্ষিপ্ত পথ, সরাসরি চলে গেছে সিলেটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই সড়ক হবার আগে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে হতো মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার র্যুট ধরে। যেহেতু আমাদের গন্তব্য বিয়ানীবাজার, তাই আমরা সেই পুরোন পথই ধরতে চাই। তবে ড্রাইভার মনির এপথে একেবারে নতুন। আর পণ্ডিত বাদল তো পণ্ডিতই, সে তার পাণ্ডিত্য জাহির করতে জানাচ্ছে সে কুলাউড়া চিনে, এই পথও চিনে, এপথে তার বন্ধুর ক্ষতি হবে না ইত্যকার নানা মন্তব্য।
যাহোক, দুজনের মধ্যকার ইত্যকার বক্তব্য কিছুটা থিতিয়ে এলো। দুজনে হয়তো মনে মনে পরামর্শ করলো, যে টাকা তারা এই যাত্রায় পাবে, তাতে আর কারো ভাগ বসাতে দেয়া যাবে না। সুতরাং কোনো ট্রাফিক সার্জেন্টকে এই গাড়ির খবর দেয়া যাবে না। ড্রাইভার মনির ঠিক করলো মূল সড়ক ধরে না গিয়ে আমেরিকান এ্যম্বেসির সামনে দিয়ে বারিধারার ভিতর দিয়ে নিউ ডিওএইচএস ধরে এয়ারপোর্ট রোডে গিয়ে উঠবে। ড্রাইভার মনির ঢাকার অলিগলি চিনেও ভালো। বারিধারার এ-গলি ও-গলি করে চললো সে গাড়ি চালিয়ে। কিছুটা বিষ্মিত হয়েই হোক কিংবা বন্ধুর অসন্তোষকে চাপা দিতেই হোক পণ্ডিত বাদল বন্ধুর প্রশংসা করলো, ‘তুই তো দেখি গলিটলি ভালোই চিনোস!’
বারিধারায় উচ্চবিত্তের লোকজনের বাস। তার সাথে রয়েছেন ভিনদেশী কূটনীতিকগণ। বলাই বাহুল্য যে, তাদের সংস্কৃতি অবশ্যই আলাদা। রাস্তায় দেখা গেলো এক চীনা কিশোরী, অবশ্যই যথেষ্ট উগ্র পোষাক পরে (বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে সেটা উগ্র হলেও সে-দেশি সংস্কৃতিতে এটা অতি স্বাভাবিক পোষাক)। আর এই প্রথম আমি পণ্ডিত বাদলের নতুন রূপ জানতে পারলাম- সে যে একজন কামুক বাদল, সেটা বুঝলাম। বাদল সাথে সাথে বন্ধুর কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো, ‘ওহ্, শালির বুকটা ফাইট্টা বাইর অইতাছে!’
ড্রাইভার মনির বিবাহিত, তাকে দৃঢ় চরিত্রের মানুষ বলেও মনে হলো। সে কোনো উত্তর না দিয়ে বন্ধুকে সরিয়ে দিলো নিজের কানের কাছ থেকে। এরকম কৈশরসুলভ যৌনবাকচারিতা তার পছন্দ হচ্ছে না। ওদিকে কামুক বাদল বন্ধুর এই লাজুক অনীহার মাঝেও যেন কোনো বিশেষ যৌনসুখ পেলো, সে খিকখিকিয়ে হেসে উঠলো। ড্রাইভার মনির এসবে গা করছে না, বোধহয় তার বন্ধুটির এহেন কামুক রূপ তার আগে থেকেই জানা।
আমাদের গাড়ি বারিধারা থেকে ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে উঠলো। দুজনেই মনে মনে যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করলো, যাক অন্তত কয়েকজন সার্জেন্টকে ফাঁকি দেয়া গেলো। গাড়ি এয়ারপোর্ট রোড ধরে টঙ্গীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। তাদের দুজনের কথাবার্তা থেকে জানতে পারলাম সিএনজি নেবার সময় বেশি প্রেশারে নিলে তা দিয়ে অনেক দূ-র অবধি চলা সম্ভব হয়।
এমন সময়, সামনেই এক লোক রাস্তা পার হচ্ছে। আমাদের গাড়ির গতি এমনই ছিল, থামা সম্ভব নয়। ওদিকে গাড়িটা তার দিকে ধেয়ে আসছে দেখেও সে দৌঁড়ালো না বা দৌঁড় দেয়া বোঝা মাথায় নেয়া লোকটার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর গাড়িটা গিয়ে…
লোকটার উপর আছড়ে পড়লো… মানে ঠিক লোকটার পায়ের কাছে গিয়ে ব্রেক কষলো। লোকটা ভয়ে বস্তাটা গাড়ির গায়ে ফেলে কোনোরকমে সরে বাঁচলো এ যাত্রা। দমটা আমার বেরিয়ে আসছিল উত্তেজনায়। যাক, লোকটা প্রাণে বেঁচে আছে, আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি দেখে হাফ ছাড়লাম। এযাত্রা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আবার চলা শুরু করলাম।
গ্যাস ফিলিং স্টেশন পথের মাঝে কয়েকটা থাকাসত্ত্বেয় ড্রাইভার মনির পণ্ডিতি করে আরো সামনে গিয়ে নেবার জন্য শেষ পর্যন্ত এমন একটা ফিলিং স্টেশনে এলো, যেখানে গ্যাসের মজুদই খুব কম। তাই কম প্রেশারে গ্যাস ভরতে হলো তাকে। গাড়িতে যা গ্যাস ভরা হয়েছে, তা দিয়ে বড়জোর কুলাউড়া পর্যন্ত যাবার এস্টিমেশন করলো আমাদের ড্রাইভার মনির।
গাড়ির পেছনে আমার দুই চাচা আর দূর সম্পর্কের চাচা বসে গল্প করছেন। বিদেশি চাচার বক্তব্য যা কানে আসছে, তিনি ঐ [সম্ভাব্য] দুর্ঘটনার রেশ টেনে দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আমেরিকার নিয়ম-কানুন কিংবা সচেতনতার কথা বলে যাচ্ছেন [এদেশি] দুই চাচাকে। তাঁরাও তাঁদের মতো গল্পে যোগ দিচ্ছেন। গাড়ি ওদিকে টঙ্গীর অলিগলি ধরে সিলেট রোডে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টঙ্গীর এক গ্রামের পাশ দিয়ে যাবার সময় ড্রাইভার মনির তার বন্ধুকে জানালো, ‘ঐ সামনের তিন জমি পরে আমার একটা প্লট আছে।’ বুঝতে পারলাম, ড্রাইভার মনির সঞ্চয়ী মানুষ; নিজের সঞ্চয় দিয়ে সম্পত্তি গড়তে জানে। আর বলাই বাহুল্য সঞ্চয়ী হওয়ার প্রথম শর্ত কিপটে হওয়া, হিসেবী হওয়া।
পণ্ডিত বাদল তার বন্ধুকে বললো, ‘তোর ঘুম আইলে আমারে দিস। আমি আবার পান খাইয়া সারা রাইতও গাড়ি চালাইতে পারি।’ তারপর সে বর্ণনা করলো কোনো একদিন সারা রাত ধরে কোনো এক হাইওয়েতে কিভাবে সে গাড়ি চালিয়েছিল, সেই বীরত্বগাথা। আমি শুধুই শুনলাম। হয়তো বিশ্বাসও করলাম, কারণ অবিশ্বাস করলে সবই অবিশ্বাস করতে হয়। ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’
যে এলাকায় এলাম, এখানে দেখা গেলো নতুন ধরণের গাড়ি; যেগুলোয় সাইকেলের মতো হাতলের সাথে, পানির শ্যালো মেশিন জুড়ে তিন চাকার যান বানানো হয়েছে। যতটুকু পত্র-পত্রিকার খবর হাতড়ে পেলাম, এগুলোকেই বোধহয় বলে “নসিমন-করিমন”। ড্রাইভার মনির বাহনগুলো দেখে অসন্তোষ জানালো, ‘এইগুলান হইলো মানুষ মারার যন্ত্র।’
তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে পণ্ডিত বাদল খিস্তি আউড়ালো, ‘হ, এক গাধায় বানাইছে, আরেক গাধায় এইটা রাস্তায় ছাড়ছে।’ তার কথাবার্তার ধরণই যে নিকৃষ্টশ্রেণীয়, তা আমার এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে।
গাড়ি, সিলেট রোডে উঠলো।
সিলেট রোডে একটু সামনে গেলে রাস্তার ডানদিকে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। তাতে লেখা ‘উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থল’। তীর চিহ্ন এঁকে পথ নির্দেশ করা রয়েছে। এই উয়ারি-বটেশ্বর সম্বন্ধে যতটুকু জানি আমি, এই প্রত্নস্থলটিতে খননকাজ চালাচ্ছে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্বেচ্ছাসেবক দল। সেখানকার ইতিহাস বেশ পুরোন। রেডিও টুডে’র একটা লাইভ প্রোগ্রামে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধানকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁরা এখানকার খনন কাজ নিয়ে কোনো ডকুমেন্টারি তৈরি করছেন কিনা। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, সেরকম প্রযুক্তিগত সাপোর্ট তাঁদের কাছে নেই। তবে খনন কাজের পৃষ্ঠপোষক গ্রামীণফোন আশ্বাস দিয়েছে যে, এরকম সুযোগ দিতে তারা আগ্রহী। শেষ পর্যন্ত হলো কিনা কিছু, কে জানে?
সিলেট রোডে উঠতেই নতুন কার্পেটিং করা রাস্তা দিয়ে গাড়ি সাবলিলভাবে এগিয়ে চললো ৮০ কিলোমিটার বেগে। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখে পড়লো রাস্তায় আড়াআড়ি কিছু সাদা দাগ, যেগুলো ৪-৫ গজ পর পর প্রায় ৫০-৬০ গজ জায়গা জুড়ে রয়েছে। ওগুলো ঠিক স্পীডব্রেকার না, আবার ওগুলোর উপর দিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গেলে গাড়িতে ভালোই ঝাকি লাগছে। চাকার ক্ষয় নিয়েও প্রশ্ন জাগে মনে। আমাদের পণ্ডিত বাদল জিজ্ঞেস করলো তার বন্ধুকে, ‘এগুলো কী জন্য দিছে জানোস?’ কন্ঠে ঠিক জিজ্ঞাসা নয়, বরং বন্ধুর জ্ঞানকে পরখ করার চেষ্টা।
ড্রাইভার মনির উত্তর দিলো, ‘ঘুম ভাঙানোর লাইগ্যা?’
পণ্ডিত বললো, ‘হ, যাতে হাইওয়েতে গাড়ি ছাইড়া ড্রাইভার ঘুমায়া না যায়।’
এরই মধ্যে ড্রাইভার মনির বের করলো নতুন পদ্ধতি। ওসব ‘ঘুম ভাঙানি স্পীডব্রেকার’গুলোকে যদি পাশ থেকে কেটে যাওয়া যায়, তাহলে গাড়িতে ঝাঁকুনি কম লাগে, চাকার উপর চাপও কম পড়ে। সে রাস্তার উভয় পাশ খালি থাকলেই এঁকেবেঁকে ‘ঘুম ভাঙানি স্পীডব্রেকার’ পার হয়ে চলতে লাগলো। সঞ্চয়ী মানুষেরা নিজেদের গড়া সম্পত্তির ব্যাপারে একটু বেশি যত্নবান থাকেন, ড্রাইভার মনির তাহলে নিজের গাড়ির ব্যাপারে কেন হবে না?
আমাদের গাড়ি ঘোড়াশাল ধরে চলছে। সেখানে চোখে পড়লো রাস্তার পাশে সারি বেঁধে লাগানো গাছগুলো। খুব সুন্দর মনোরম গাছগুলোর সব সৌন্দর্য্য নষ্ট করে দিয়েছে কোনো এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। তারা সবগুলো গাছের কান্ডে চুন দিয়ে সাদা করে তাতে পেইন্ট দিয়ে নিজেদের দলের প্রচারণা চালিয়েছে। তাদের এই প্রকৃতির উপর রাজনৈতিক অত্যাচার চললো মাইলের পর মাইল। সত্যিই, গাছও যে রাজনৈতিক প্রচারণার শিকার হতে পারে, আমার ধারণারও বাইরে ছিল। গাছগুলোর এমন দুর্দশা দেখে দুঃখ হলো আমার।
এমনি সময় গাড়িটা রাস্তার পাশে থামালো ড্রাইভার মনির, সিট বদলে বন্ধুকে দিল গাড়ি চালাতে। সে এসে বসলো আমার পাশে। এবার দুজনের মাঝখানে আমি। পণ্ডিত এখন ড্রাইভিং সিটে; সে গাড়ি ছাড়লো। গাড়ি চলা শুরু করতেই সে জানালো, ‘কিরে তোর গাড়ি বাম দিকে টানে কেন্?’
মনির উত্তর করলো, ‘হ, একটু বামে টানে।’
বাদল তার পাণ্ডিত্য জাহির শুরু করলো, ‘না একটু না, বউৎ। শিওর, তোর গাড়ির ব্যালেন্স ঠিক হয় নাই।’ আবার বললো, ‘কুন চাক্কা লাগাইছোস?’
মনির উত্তর করলো, ‘বিরলা…’
‘বিরলা’ শুনেই বাদল বললো, ‘আরে এইগুলা বালা না। ব্রিজটন লাগাবি, পাক্কা সত্রো মাসের গেরান্টি। কিচ্চু হইবো না তোর চাক্কার।’
মনির শুধু শুনেই যায়, আর পণ্ডিত বাদল তার পাণ্ডিত্য জাহির করেই চলেছে, ‘…তোর গাড়ি তুইই চালা।’ বলায় কোনো জোর নেই, কিংবা সিট বদলানোর লক্ষণও নেই। বলার দরকার ছিল, বলেছে। গাড়ি চালিয়েই চলেছে আমাদের পণ্ডিত বাদল।
বাদল গাড়ির স্পীড বাড়াতে যেতেই মনির তাকে বাধা দিলো, ‘বেশি স্পীড দিস না, ৮০-তে চালা। তাইলে গ্যাসে অনেক দূর যাইবো।’ গাড়ি ৮০ কিলোমিটার গতিতেই চলতে থাকলো। ওহহো, বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম, দুই বন্ধু ঢাকায় থাকতে যখন বাকবিতণ্ডা করছিল, তখনই গাড়ির মাইলেজ মিটারটা চালু করে দিয়েছিল বাদল। সেটাতে দেখা যাচ্ছে কতদূর পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এলাম। তবে সে মাপে খাদ আছে; কেননা, ঢাকাতেই আমরা অনেকটা ঘুর-পথে চলেছি, সহজ পথ রেখে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এসেছি। সুতরাং চাকা ঘোরার মাধ্যমে পাওয়া এই মাইলেজের হিসাব যথার্থ নয়।
বাদল এই ‘বাম দিকে টানা’ গাড়ির সাথে কিছুটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে। চালিয়ে চলেছে সাবলিলভাবে। বলাই বাহুল্য, গাড়ি ঐ ৮০ কিলোমিটার গতিতেই বহমান। ঘোড়াশালের একটা গলি দেখিয়ে বন্ধুকে জানালো মনির, এই গলিতে ১ কিলোমিটার মতো ভিতরে তার শ্বশুড়বাড়ি। একজন তার শ্বশুরবাড়ি দেখিয়ে দিল, আর পণ্ডিত বাদল কিছুই বলবে না, তা কি হয়? সে জানালো, এদিকে সে এসেছে আগে।
গাড়ি কি আরো এক কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে কিনা, রাস্তার মাঝখান বরাবর উঁচু আইল্যান্ড দেখা গেল। রাস্তার বাম দিক ধরে রিকশা চলছে। আর একেবারে বামদিকে বেশ কিছু ট্রাক-বাস স্ট্যান্ড করে রাখা। তাই চলার পথটা বেশ সরু হয়ে এসেছে। আর সেই সরু পথ দিয়ে কসরত করে চালানোর বদলে পণ্ডিত বাদল হঠাৎ গাড়িটাকে নিয়ে তুললো আইসক্রিমের ছোট্ট একটা ত্রিচক্রযানের উপর…।
যখন সম্বিত ফিরে পেল, তখন কষে ব্রেক চাপলো সর্বশক্তি দিয়ে…। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। আইসক্রিম-যানের চাকাটা সম্পূর্ণ ভচকে দিয়েছে গাড়িটা। কোথায় নিজেদের দোষ স্বীকার করবে, তা না, উল্টো দুই বন্ধু মিলে আইসক্রিমওয়ালাকে রাস্তার মাঝখানে চলে আসার জন্য বকাঝকা করতে লাগলো। আইসক্রিমওয়ালাকে ওভাবে রেখেই দ্রুত গাড়ি নিয়ে কেটে পড়তে চাচ্ছিলো বাদল, কিন্তু সামনের রাউন্ড এ্যাবাউটেই দাঁড়ানো সার্জেন্ট ঘটনাটা দেখে ফেলায় হাত নাড়লো গাড়ি থামানোর জন্য। যাও, ঠ্যালা সামলাও!!
-মঈনুল ইসলাম
wz.islam@gmail.com