কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে - পাহাড়ের উল্টো পিঠে - নিশাচর

কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে – পাহাড়ের উল্টো পিঠে : পর্ব ৬

চান্দা হেডম্যান পাড়ায় স্কুলঘরে থাকা আর গাছ-কামলাদের সাথে খেয়ে, পাহাড়ে প্রবারণা পূর্ণিমার প্রস্তুতি হিসেবে ফানুস বানিয়ে, চাক্কুম চাক্কুম গান শুনে রাত্রিযাপন শেষে ভোরবেলা উঠে টনির (ছদ্মনাম) অপেক্ষা করছিলাম। টনি আসতেই দল বোঁচকাবুচকি রেখে তার সাথে বেরিয়ে পড়লো। আমরা যাচ্ছি ঝরণা দেখতে।

বেরোবার আগে নাস্তা করা দরকার। এই পাড়ায় দুটো দোকান আছে। পাহাড়ের উপরের দোকানটায় গিয়ে বসতে বললো টনি। ও’ গেলো প্রস্তুতি নিতে। আমরা খাবারের অর্ডার দিলাম। জানলাম, এখানকার আর্মিক্যাম্প থেকে ‘প্যাটিস’ আসে পাড়ায়। আর কিছু নেই দেখে আমরা অনিচ্ছাসত্ত্বেয় চারটা প্যাটিস নিলাম। কিন্তু মুখে দিয়ে খুব ভালো লাগলো। সুস্বাদু, এবং ভিতরে পূরযুক্ত প্যাটিস। ভালো জিনিস। গোগ্রাসে গিলে ফেলার পরে আবার খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আর মাত্র একটাই আছে। আবু বকর ওটাও দিতে বললেন। কিন্তু ওটা আর আমাদের খাওয়া হলো না। টনি চলে এসেছে, ওকে দেয়া হলো। পানি, এক প্যাকেট বিস্কুট আর চা দিয়ে নাস্তার সমাপ্তি করে আমরা পথ ধরলাম…

…ঝরণার।

পাইন্দু পাড়া থেকেই সামনে ঝরণার আভাস শুনে আসছিলাম। একেকজন একেক নাম বলে, তবে চান্দা পাড়ার কাছে একটা ঝরণা আছে, এটা নিশ্চিত করা গেছে। এই পাড়ায় এসে কালকে টনির সাথে আলাপ করে জানা গেল, আগেরবার মেয়েসহ যে দলটা এসেছিল, তাদেরকে সে-ই নিয়ে এসেছিল, এবং তারা এসে ঐ ঝরণা দেখে গেছে। পাইন্দু খাল খুব অপরিচিত কোনো খাল নয়, তাই শীত মৌসুমে কেউ যে এসে এখানকার ঝরণাগুলো দেখে যেতে পারে এটা আমরা জানি। অর্থাৎ কোনো ভার্জিন ঝরণা দেখার সৌভাগ্য যে হবে না, এটা আমরা জানতাম। তবু একটা ঝরণা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না। টনি আমাদেরকে জানিয়েছে দুটো ঝরণা আছে। ওর কথাবার্তা থেকে আবুবকর যেটা বুঝলেন, যদি একটা ইংরেজি ভি (v) আঁকা যায়, তাহলে আমরা এখন আছি ভি’র নিচের মাথায়, আর দুটো ঝরণা উপরের দুই মাথায়। তাই ব্যাগ স্কুলঘরেই রেখে এসেছি আমরা। সুতরাং এখন টিমের চলার গতি অপূর্ব।

গতকালকেই আমি একটা পরীক্ষা করে ফেলেছিলাম, আমার মোবাইল ফোনের জিপিএস চালু করে ভিউর‍্যাঞ্জার জিপিএস অ্যাপটা (6.4.34 [3] সংস্করণ) সক্রীয় করে ট্রেইল ট্র্যাক করতে দিয়েছিলাম। পরে দেখেছি, সেখানে একটা পিন এসেছে। আমি তাই পরম আশান্বিত: আজকের এই ট্রেইলটার জিপিএস ট্র্যাক করতে চাই আমার স্যামসাং GT-S7582 মডেলের মোবাইল ফোনটা দিয়ে। ফোন করা যাচ্ছে না দেখে বন্ধ রেখে যা চার্জ সঞ্চয় করেছি, তাতে এই কাজে লাগলে তা মহা কাজের হবে। তাই ট্রেইল রেকর্ড শুরু করলাম, মোড বাছাই করলাম: ট্রেইল রানিং; কারণ আমরা এখন পায়দল চলছি। জিপিএসের সাথে সে সেই অনুযায়ী যোগাযোগ করবে।

যারা মোবাইল ফোনে জিপিএস ট্র্যাক করা সম্বন্ধে জানতে চান, তাঁরা দেখুন:

স্মার্টফোনকে বানিয়ে ফেলুন জিপিএস ডিভাইস

আমরা যখন রওয়ানা করেছি, পাড়া থেকে উত্তর দিকে পাহাড়ের উপরে উঠে যাচ্ছিলাম, ঠিক সামনেই, এক পাহাড়ি দম্পতি কাজে যাচ্ছেন পিছে ঝুড়ি ঝুলিয়ে নিয়ে। পাহাড়ি পুরুষটির হাতে একখানা দা, চোখের নিমিষে, পাহাড়ের উঠতি ঢালে দুয়েকটা কোপ দিয়ে মাটি কেটে নামিয়ে সিঁড়ি তৈরি করে ফেললেন। বুঝলাম, এভাবেই পাহাড়িরা চলতে চলতেই পাহাড়ে খাঁজ কাটা সিঁড়ি বানিয়ে ফেলেন।

পাহাড়িরা সবাই কাজে যাচ্ছে, আমরা চলেছি আমাদের গন্তব্যে। ডানদিকে চোখ পড়তেই বুক ভরে একটা গভীর প্রশ্বাস নিলাম – কী অপূর্ব দৃশ্য – মেঘেরা আমাদের সমতলে, পাহাড়গুলোর গায়ে লেপ্টে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বুঝি ধোঁয়া উড়ছে। পেছনে তাকিয়ে চান্দা পাড়ার দিকে তাকালাম – যতটুকু দেখা যাচ্ছে, অপূর্ব লাগছে! আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন; তবে এতটুকু শান্তি যে, বৃষ্টি পড়ছে না।

সরু, পাহাড়ি হাইওয়ে ধরে পথ চলছি আমরা। টনি, আবু বকরের সাথে কী সব কথাবার্তা বলছে। একটু সামনে যেতেই দেখি কালকে রাত্রে আমরা যে গাছ-কামলাদের সাথে খেয়েছি, তাঁরাও কাজে চলে এসেছেন। গাছের গায়ে দা হাতে কোপ বসাচ্ছেন। আমাদের রাস্তা কোথাও উঠছে, আবার সামান্য একটু নামছে, আবার উঠছে, নামছে – এগিয়েই চলেছে। পথ, সোজাই বলা যায়। আর, ব্যাগ সাথে নেই দেখে আমরা চলছিও বেশ স্বচ্ছন্দে।

আধাঘন্টামতো হেঁটে চলে এসেছি আমরা পাইন্দু খালের কাছে। বুঝলাম, এতক্ষণ আমরা পাহাড়ের উপর দিয়ে পাইন্দু খালের উজানেই চলছিলাম। খাল ধরে যাইনি, ঢল ঠেলে নৌকা উল্টানোর ভয়ে, আর বাঙালি-পাহাড়ি কেউই আমাদেরকে এই ঢলে ঠিক আশ্বাসও দিচ্ছিলো না, তাই। এবার নিচে, পাইন্দু খালে নামতে হবে। কিন্তু…

হঠাৎ দেখি আবু বকর থমকে দাঁড়িয়েছেন! কী হলো!

ব্যাটা টনি বলেছিল দুটো ঝরণা থেকে চান্দা পাড়াটা একটা ভি’র নিচের মাথা। প্রথম ঝরণা দেখে আবার আমরা চান্দা পাড়ায় ফিরে যাবো, তারপর দ্বিতীয় ঝরণায় যাবো। এখানে এসে বলে কি, না, দ্বিতীয় ঝরণাটা আরো উজানে। লাও ঠ্যালা! আবুবকর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মনে হয় আমাদের, ফিরে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসা উচিত।

শুনে আমি আর দ্বিমত করলাম না, বললাম, এক্ষুণি চলেন। গতকালকের মতো ভুল আবার করতে চাই না।

কিন্তু এই মাত্র আধাঘন্টা’র তুমুল ট্রেক করে তানভিরের চেহারা যা হয়েছে, মনে হচ্ছে, আহা বেচারা! …এরকম তানভিরকে আমরা প্রত্যাশা করিনি। আবু বকর, আমার মতোই চেহারা পড়তে পারেন, বুঝে নিলেন ব্যাপারটা ইশারায়। বললেন, তানভির থাক। আমরা তানভিরের ব্যাগ নিয়ে আসবো। তানভির মোটেই উচ্চবাচ্য করলো না, কিংবা যাবার আগ্রহও দেখালো না। মনে হলো, এটা যেনবা টীম লিডারের সিদ্ধান্ত, সে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এটা টীম লিডারের সিদ্ধান্ত না, এটা টীম লিডারের, ঠ্যাকায় পড়ে দেয়া প্রস্তাবমাত্র, যা হা-জয়যুক্ত হয়ে গেছে। ট্রেকে কখনোই আমার বোঝা তোমার ঘাঢ়ে থাকা সুন্দর না। আর, এটা আল্পাইনিযম-এর প্রস্তুতিও না।

তানভির আর টনিকে ওখানে বসিয়ে রেখেই আমরা আবার ফিরতি পথে চান্দা পাড়ায় চললাম। তিনজনের মধ্যে কোনো কথা নেই। কথা বলারও কিছু নেই, এক ভুল দুবার করার কোনো মানেই হয়না। কালকে যেমন একবার আধা পথ থেকে ফিরে গিয়েছিলাম, আজকে, যদি আরো দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়, তবে সেটা মোটেই সুখকর কিছু হবে না। তাছাড়া এখনতো নিশ্চিত, দুটো ঝরণাই উজানে, তো, ব্যাগ পিছনে ফেলে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। অল্প সময়েই আমরা পাড়ায় ফিরে এলাম। একেবারে তুখোড় ট্রেক। পাড়ায় এসে মনে হলো যেন ১০০ মিটার স্প্রিন্ট চলছে। আবু বকরও, তাঁর ভারি দেহ নিয়ে লাফ-ঝাঁপ দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।

আবু বকরের সাথে আমার প্রথম ট্রেক অফ-ট্র্যাক বান্দরবানে, ৪ বছর আগে। ওনার হাতেই আমার পাহাড় শিক্ষার শুরু। তারপর দ্বিতীয় ট্রেক জলপ্রপাতের খোঁজে, মিরসরাইয়ে। আর তৃতীয় ট্রেক এই ৪ বছর পরে আবার বান্দরবানে। এর মাঝে তিনি দীর্ঘদিন ট্রেকে নামেননি। নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। মাঝখানে, ডি-ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স-এর মাসব্যাপী জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে’র শেষাংশে (২০১৫’র শুরুতে) পাহাড়কে নিজের একটু চেহারা দেখিয়েছিলেন। এই দীর্ঘদিনের অনভ্যস্থতায় শহুরে জীবন আবুবকরকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি কালকে ট্রেকে নামার পর থেকে আগের সেই আবু বকরকে পাচ্ছিলাম না। আমি সে কথা চলতে চলতেই তাঁকে বারবারই বলছিলাম, আবু বকর, কী জানি মিসিং, কী জানি মিসিং! এই সেই আবু বকর না। …আবু বকর বুঝলেন, বললেন, হুম, পেটটা বড় হয়ে গেছে। ঢাকায় গিয়ে এটার একটা বিহিত করা লাগবেই। মনে মনে বললাম, অবশ্যই করতে হবে। আবু বকরকে বিয়ে দিতে হবে, দ্রুতই। পাত্রী খোঁজা শুরু করা হয়নি, এটা খুবই অন্যায়। ট্রেকার ভাই-বেরাদাররা সব কই?

পাড়ায় ঢোকার মুখেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। ব্যাগ গোছানোই ছিল, আর ব্যাগের জলনিরোধকও খুলিনি; দ্রুত ঝুলিয়ে নিলাম গায়ে। ক্যামেরার ব্যাগটা কোমরেই রাখলাম, দেখি, বৃষ্টি খুব বেশি না বাড়লে ক্যামেরাটা বাইরেই রাখবো। ছবি তোলা ছাড়া ক্যামেরা বহন করার কোনো মানেই হয় না। বৃষ্টিতে নষ্ট হলে হোক। গামছাটা তাই গতদিনের মতো মাথায় প্যাঁচালাম না, হাতেই রাখলাম। পানি নেয়া দরকার। কিন্তু আবু বকর, তাড়াহুড়া করার একটা মেশিন। পানি নেয়ার কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই। এক ঘন্টা হলো ট্রেকে আছি, পানিটা নেয়া উচিত ছিল। আমার বোতলগুলো থাকলে অবশ্যই নিয়ে নিতাম।

পানি না নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আবুবকর, তানভিরের ব্যাগটা বুকে পরে নিলেন, আর নিজেরটা পিঠে। আমরা পাড়ায় ফিরে আসছিলাম দেখে দোকান থেকে এ’ ও’ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছিল, আবার ফিরে এলাম যে…। যখন বললাম, ব্যাগ নিতে এসেছি, এরা যেন মহা খুশি। আপদ বিদেয় হলেই বাঁচে। আপদ বিদেয় হলাম। আসার পথে, যেখানে যেখানে পথ ভুল হবার সম্ভাবনা ছিল, সেখানেই পা দিয়ে মাটিতে চিহ্ন এঁকে এসেছি আমরা। আশা করি পথ ভুল হবে না। বৃষ্টি বাড়ছে না, তবে ফোঁটাগুলো বড় হয়েছে, পুরোপুরি ভিজিয়ে না দিলেও ভিজবো কোনো সন্দেহ নেই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর আই ডিডন্ট নো’ দ্যাট অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল, যদি বৃষ্টির মধ্যে কেউ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে সে বেশি ভিজে। আর কেউ যদি চলতে থাকে, তাহলে তুলনামূলক কম ভিজে। তাই এতটুকু শান্তি, আমাদের কম ভেজার কথা।

আগেরবার তুখোড় গতিতে যে জায়গাগুলো পেরিয়ে গিয়েছিলাম এবার ব্যাগ টেনে এগোচ্ছি, কিন্তু খুব যে কষ্ট হচ্ছে, তা না। আবু বকর একটু পিছিয়ে। এদিকে আমার ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে গেছে। পানি খাওয়া দরকার, ঘন্টা, সোয়া ঘন্টা পানি না খেয়ে পরিশ্রমই করে যাচ্ছি। কিন্তু পানি কোথায় পাবো? আবু বকর শুনলে রাগই করতেন হয়তো, বেয়ার গ্রিল্‌সের কথা মনে হলো আমার – পানির অভাব নেই। বৃষ্টি পড়ছে, আর আশেপাশে কলাগাছ আছে প্রচুর। কলাগাছের পাতা একটু ভাঁজ হয়ে গেলেই সেখানে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমা পড়ছে। আমি পাতার নিচে জিহ্বা পেতে ভাঁজটা আলতো করে খুলে দিই, এক ফোঁটা পানি জিভে পড়ে, সেটাই মনে হয় স্বর্গ থেকে এসেছে। এভাবে একটু পর পরই দশ সেকেন্ডের জন্য থেমে পান পান করছিলাম – না না, ফোঁটা পান করছিলাম। কোনো কোনো ভাঁজে একাধিক ফোঁটাও পেয়ে যেতাম। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো, জলটুকু মন্দ হয়নি। মোটামুটি ১ আউন্স কি হবে? হয়তো… যতটুকুই হোক, মোর‍্যাল বুস্টটা ১ লিটারের সমান পেলাম যে, শরীরটা জল পেয়েছে

উপর থেকে পাইন্দু খাল - নিশাচর
উপর থেকে পাইন্দু খাল

আধা ঘন্টা ট্রেক করে আমরা আবার মিলিত হলাম তানভিরদের সাথে। তানভির নিজের ব্যাগ বুঝে নিতেই আমরা পাইন্দু খালে নামা শুরু করলাম। পাহাড়টা খাড়া নেমে গেছে, আর বৃষ্টি বাবাজি পুটুর পুটুর করে পড়ে আমাদের সেই খাড়া পথটা ভিজিয়ে দিয়েছেন। খুব সাবধানে পা ফেলে নামতে হচ্ছে একেকজনকে। আমি ক্যামেরা বের করছি না বৃষ্টি দেখে, কিন্তু হাতের মোবাইল ফোনটা দিয়ে ছবি, ভিডিও তুলে যাচ্ছি। নামতে গিয়ে টের পেলাম, নাহ, ঝুঁকিটা বেশি হয়ে যাবে। তাই একটু নেমে আবার পকেটস্থ করলাম ফোনটা।

খাড়া পাড় ধরে নামছেন আবু বকর - নিশাচর
খাড়া পাড় ধরে নামছেন আবু বকর

যাহোক, পিচ্ছিল পথ বেয়ে ধীরে ধীরে আমরা নেমে এলাম পাইন্দু খালের কিনারে। টনি জানালো খাল পার হতে হবে। বিন্দুমাত্র বিচলিত হলাম না আমরা, খাল পার হলে হতে হবে – কোনো কথা নাই। ঠিক করলাম আমরা, পার হওয়ার ছবি তোলা দরকার। তাই টনির হাতে ক্যামেরার ব্যাগটা দিতে বললেন আবু বকর। আর ব্যাগটা মাথার উপর তুলে পাইন্দু খালের ঢল ঠেলে পরশু’র মতো দ্বিতীয়বার পার হবার উদ্যোগ নিলাম। রাতে চান্দা পাড়ায় বৃষ্টি না হলেও উজানে বৃষ্টি হয়েছে কিনা কে জানে। নাভি পর্যন্ত পানি। ঢলের চাপ আছে। নিচ থেকে বালু সরে যাবার ব্যাপারও আছে পরশু’র মতোই। তবু নির্বিঘ্নেই পার হয়ে গেলাম আমি। ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ওপার থেকে বাকি তিনজন খালে নামবে।

নাভি সমান পানিতে পাইন্দু খাল পার হওয়া - নিশাচর
কোমর পানিতে পাইন্দু খাল পার হওয়া

ভিডিও শুরু করলাম। ওরা আসছে… আবু বকর সামনে। তিনজনেরই মাথায় নিজেদের ব্যাগ। পানির ঢল সামলে নিজেকে সামলাচ্ছে, আবার ব্যাগের ওজনও সামলাচ্ছে। আসছে… আসছে… শ্যুটও চলছে… হঠাৎই…

মোহন ঝুপ করে পড়ে গেলো। পুরোপুরি ডুবে গেল। ব্যাগও পানি ছুঁয়ে ফেললো। তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই উঠে দাঁড়াতে পারল ও’। বেঁচে গেলো। নাহলে ঢলে ব্যাগের সব ভিজে যেত। ওর ব্যাগটা ভারি, ব্যালেন্স রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলো। যাক, অন্তত সমস্যা কিছু হয়নি। সবাই এপাড়ে চলে এলো।

ডলু ঝিড়ির মুখে আমরা - নিশাচর
ডলু ঝিড়ির মুখ ধরে ঝরণায় এগোচ্ছি আমরা (ছবি: আবু বকর)

এবারে দল পাইন্দু খালের এপাড় ধরে উজানে আরো একটু হাঁটলো। তারপরই বামদিক থেকে একটা ঝিড়ি এসে মিলেছে খালে। দল ওদিকেই ঢুকে গেলো। আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য পথ হারিয়ে একটু পিছিয়ে পড়লেও ধরে ফেললাম ওদেরকে। ঝিড়িপথটা বালুতে ভরা, পা দেবে যাচ্ছে। তাই সবাই-ই জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম, জুতা ছেঁড়ার মানে হয় না। ঝিড়িটা আরো এগিয়ে গিয়ে বেশ গভীর হয়ে গেলো। টনি, আর সামনে তানভির আর মোহনকে দেখে একহাতে পিছনের ব্যাগটাকে উঁচিয়ে ধরলাম, তবু কিছুটা পানি লেগে গেলো নিচে। এবারে একজায়গায় ঝরণার আওয়াজ স্পষ্ট। কিন্তু সামনে টনি নেই, কারণ সামনের পানি অনেক বেশি গভীর। টনি, আমাদেরকে ব্যাগ এখানে রেখে যেতে বলছে। আমরা ব্যাগ ওখানে রেখেই ওকে অনুসরণ করলাম। ডানদিকে পাহাড়ের উপর উঠে গেলো টনি।

জলপ্রপাতের খোঁজে’র মতোই এবারও আমি ঝুঁকি নিয়ে আমার ক্যামেরাকে সঙ্গী করলাম। এই ক্যামেরাটা অনেক ধকল সয়েছে। অনেক কাদা, বালি, ময়লা খেয়েছে। এখনও যে কাজ করছে – এই বেশি। অন্যের ক্যামেরা ধার করে যদি এইরকম গো-প্রো কাজকারবার করতাম, নির্ঘাত লোকে বলতো, তার ক্যামেরার যত্ন নিইনি আমি। আসলে পরিস্থিতিটাই এমন। ক্যামেরাকে আগলে রাখলে ছবি উঠবে না, স্মৃতি থাকবে না, ডকুমেন্টেশন হবে না, আর ক্যামেরা ব্যবহার করতে গেলে হয় ক্যামেরার ক্ষতি হবে, নয়তো নিজের।

একে হয়েছে বৃষ্টি, তার উপর ডালপালার ভিতর দিয়ে ৭০-৮০ ডিগ্রী ঢালু পথে কসরত করে এগোতে হচ্ছে। ট্রেকের পথে ক্যামেরা চালানোর বদখাসলত আছে বলেই এবারো ভিডিও চালু করলাম। টনি বলে, “শক্ত বাঁশ ধইরেন।” আমার খেয়াল ক্যামেরার দিকে, অবচেতনভাবেই ওকে উত্তর দিচ্ছি। ক্যামেরায় একবার চোখ, রাস্তায়… থুক্কু ঢালে একবার চোখ, বাঁশ ধরতে হচ্ছে, ডাল ধরতে হচ্ছে, বৃষ্টি ভেঁজা ঢালু পথে পা রাখতে হচ্ছে, আবার ভিডিও হচ্ছে কিনা দেখতে হচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সিমন রে (ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড-এর ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি) হতে পারলাম না। আমার তো আর ওর মতো সাপোর্ট নাই, প্রপাতধরণীতল হওয়া রোধ করতে ক্যামেরা থেকে হাত সরাতে বাধ্য হলাম। ডাল ধরে নিজের ব্যালেন্স রেখে নামতে হচ্ছে। ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে রাখলাম। নিচে পড়লে, গভীর খাদে পড়বো – কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু পানিতে পড়লে ক্যামেরাটা মারা যাবে।

ডলু ঝরণার পথে - নিশাচর
ডলু ঝরণার পথে – সামনে গাইড, মোহন, আবু বকর, তানভির

মোটামুটি একটা প্লাটফর্মে নেমে এসে ক্যামেরা হাতে নিলাম আবার। কিন্তু সামনে এগিয়ে পাথরটা শেষ। টনির কথায় যা বুঝলাম, ও’ ক্যামেরা ধরবে, পাথরে ধরে ধরে পরের পাথরে যেতে হবে। বললাম, দাদা, আগে পথ দেখাও। ও ব্যাটা পথ দেখাতে গিয়ে দেখি পাখির মতো উড়ার ভাবভঙ্গি ধরছে। ওমা, কথা নাই বার্তা নাই বুক চেতিয়ে পানির মধ্যে ঝুপ্পুস করে পড়ে গেলো। দেখে মনে হতে পারে, গভীর জলে নেমেছে। কিন্তু পরক্ষণের দৃশ্য দেখে আমি মনে মনে হেসে বাঁচিনে। হাঁটুপানি! 🙂

লাফ দিয়ে যখন দাঁড়িয়ে গেলো, ব্যাটা নিজেই বেকুব হয়ে গেলো। আমি আমার হাসি লুকিয়ে ফেলেছি। ক্যামেরাটা বন্ধ করে ওর হাতে দিয়ে পিচ্ছিল পাথর ধরে ধীরে ধীরে নামলাম পানিতে। একে একে মোহন আর আবু বকর নেমে এলেন। তানভির নামার সময় আমি বাতলে দিচ্ছিলাম কিভাবে পা বসাতে হবে। আবু বকর চকিতে এমন শ্যান দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে, যা বোঝার বুঝে ফেললাম, সাথে সাথে মুখে কুলুপ। অবশ্যই কোনো একটা ভুল করে ফেলেছি।

অবশেষে মোড় ঘুরতেই সেই কাঙ্ক্ষিত ঝরণা: বিশাল ঝরণা, বিপুল তার জলধারা! মাঝখানে বুক চেতিয়ে থাকা পাথরের কারণে দুই দিকে ভাগ হয়ে নামছে। ঝরণা দেখে তৃপ্তি হলো – যাক, আসাটা ব্যর্থ হয়নি। জিপিএস লগ বন্ধ করলাম। পরে দেখলাম, অপূর্ব ট্র্যাক তৈরি হয়েছে। আমার মোবাইলে জিপিএস ট্র্যাক, নেটওয়ার্ক ছাড়াও সম্পূর্ণ সফল হয়েছে – যেমনটা আমি আমার ব্লগে দাবি করেছিলাম।

ডলু ঝরণা (মারমা ভাষা), কাইদং ঝরণা (বম ভাষা)। বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু খালের সাথে মেশা ডলু ঝিড়ি/কাইদং ঝিড়ির উপরে অবস্থিত একটি দ্বিধারা ঝরণা। ভৌগোলিক স্থানাংক: 92.394330, 22.100354। মোহনের দৈহিক উচ্চতার অনুপাতে ঝরণার যে উচ্চতা আমরা পেয়েছি, তা হচ্ছে: ২৩ফুট। ঝরণার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বামদিকের ধারাটি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে পাথর চুঁইয়ে নেমে এলেও ডানদিকের ধারাটি তুলনামূলক খাড়া হয়ে পড়েছে। একারণে ডানদিকের ধারাটির ঠিক নিচেই গভীর খাঁদ তৈরি হয়েছে। ডান পাশের পাহাড়ের দেয়ালে গুহামতো একটু পাহাড়ি খাঁজ আছে। আর চারপাশটা বৃত্তাকারে, ৫২ফুটের বেশি উঁচু পাথরের পাহাড়ের বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা। সেই পাথরের এখানে-ওখানে ইতস্তত কিছু ছোট গাছ, আগাছা জন্মেছে।

ঝরণাটা খুব ভালো লাগলো। আমরা আধাঘন্টা ওখানে ছিলাম। বামদিকের ধারাটার নিচে মোহন বসেছিল। কিন্তু আমার মতো হ্যাংলা পাতলা মানুষ ওখানে বসতেই পারছিলাম না, পানির তোড়ে ঠেলে নামিয়ে দেবার উপক্রম। আবু বকর উপরে দাঁড়ালে পানির তোড় একটু কমার পরেই বসতে পারলাম। আশা করি পানির তোড়ের তীব্রতাটা বোঝাতে পেরেছি।

ঝরণার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছেন আবু বকর (ছবি: মোহন)
ঝরণার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছেন আবু বকর (ছবি: মোহন)

ঝরণার সামনে পানি দেখা যাচ্ছে, একটু সাঁতার না কাটলে কি হয়? প্রথমে আমি, তারপর আবু বকর এক ছুট সাঁতার কেটে নিলাম ঐ জলে। কিন্তু ঝরণার কাছাকাছি যাওয়াই যায় না, পানির প্রচণ্ড তোড়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। …উঠে পড়লাম – টনি ব্যাটার বড্ড তাড়াহুড়া। আরো একটা ঝরণা দেখা বাকি। এদিক-ওদিক থেকে ঝরণাটা দেখতে দেখতে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা ছিল আমার। কিন্তু ঝরণার পানিতে হা করে পানি খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না, মুখের মধ্যে থাপ্পড়, কিল, ঘুষি অনবরত পড়তে থাকে। তাই বামদিকের ধারাটার নিচে হেলান দিয়ে শুয়ে মোনাজাত করার ভঙ্গিতে হাতদুটো সামনে নিয়ে গেলাম। এবারে পানি এসে হাতে পড়তে লাগলো আর তার থেকে কিছু পানি হা করা মুখে ঢুকতে লাগলো। পানি পান শেষ করলাম। আবারও কেউ বোতল আনেনি, পানি ভরা হলো না। আমরা ফিরতি পথ ধরলাম।

ব্যাগের কাছে এসে ঝিড়ি থেকেই বোতলগুলো ভরে নেয়া হলো। এদিকে টনি ব্যাটা দেখি আবু বকরের কাছাকাছি। কথা বলছে। ঝিড়ির মুখে এসে একসময় আমার আর মোহনের কাছাকাছি হলো। বললো, আমাদেরকে নিয়ে আসছে, তার বন্ধুদের কাছে একটা ইজ্জতের ব্যাপার না? …কথাটা আমি ঠিক বুঝলাম না। অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই কথাটা বলার মানে কী? …বেশিক্ষণ লাগলো না বুঝতে। আবু বকরও প্রচণ্ড নাখোশ। ব্যাটা একপ্রকারে আমাদের কাছে ৳৫০০ [টাকা] চেয়ে বসেছে। আবার, সে দ্বিতীয় ঝরণাও দেখাতে নিয়ে যেতে পারবে না, তাকে ফিরে যেতে হবে পাড়াতে, প্রবারণা পূর্ণিমার প্রস্তুতি নিতে হবে। শুনে মেজাজ আমাদের কারোরই ভালো না। কিন্তু পাহাড়ে, আমরা অতিথি। কী দরকার তিক্ততার! আবু বকরের অবস্থা বুঝলাম, আর ভাল্লাগে না, আপদ বিদেয় কর! টাকা দিয়ে ব্যাটাকে বিদেয় করা হলো।

শিক্ষা পেলাম আমরা। আবু বকর বলছিলেন, বুঝতে হবে, একবার ঢাকার হাওয়া পাইছে, মানে ফটকামি শিখে ফেলছে। আমাদের ভুল হয়েছে। কালকে যে ছেলেটার সাথে চান্দা পাড়ার শুরুতেই পরিচয় হয়েছিল, তাকে নিয়ে আসাটাই উচিত ছিল।

এখন আমরা অরক্ষিতভাবে পাইন্দু খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আরেকটা ঝরণা দেখার কথা ছিল, সেটা তো পরের কথা, আমাদের এখন ধীরে ধীরে ফেরার পথে থাকা দরকার। এখন যাবো কী করে? কোনদিকে?

ডলু ঝিড়ি থেকে বেরোতেই বামদিকে, খালের পাড়ে একদল লোক বিভিন্ন ফল কেনাবেচায় রত। দলনেতা সেদিকেই নিয়ে গেলেন আমাদেরকে। সেখানে গিয়ে দেখি মহাযজ্ঞ: জাম্বুরা, কলা আর আরেকটা কী যেন ফলের বিপুল সমারোহ এখানে। আবু বকর জানালেন, এই হলো ‘মার্ফা’। গত পরশু রাতে যে মার্ফা আমাদেরকে পাইন্দু পাড়ায় খাওয়ার কথা বলেছিলেন কারবারি, শসাজাতীয় কিন্তু আকারে বড় সেই মার্ফা এবার সচক্ষে দেখলাম।

কথাবার্তা থেকে যা বুঝলাম, কয়েকজন পাহাড়ি তাদের পাড়ায় কিংবা জুমে উৎপাদিত ফল নিয়ে এসেছেন খরিদ্দারের কাছে। মূল মহাজন থাকেন রুমা বাজারে, এ’ হলো তার প্রতিনিধি। কিন্তু এই ব্যাটা মহা ত্যাঁদড় – নানা রকম অকথ্য কথাবার্তা বলে পাহাড়ি ছেলেগুলোকে নাজেহাল করে ফেলেছে সে। আসল কারণ, সে, যেই পরিমাণ ফল হবার কথা সে মহাজনকে বলেছে, এখন দেখছে পরিমাণটা তার চেয়ে কম। শেষ পর্যন্ত এমন হুমকিও দিয়েছে, না বেচলে নিয়ে যা…। …আর এই কথাটায় দেখলাম খুব কাজ হলো। বেচারারা কি আবার বয়ে নিয়ে যাবে এই বিপুল খাদ্যসামগ্রী? বাধ্য হয়েই গছিয়ে দিয়ে যায় ব্যাটা বজ্জাত খদ্দেরকে।

ফলের সাম্রাজ্যে দাঁড়িয়ে ফল খাওয়া হবে না তা কি হয়? বড় দেখে একটা জাম্বুরা চেয়ে নিলেন আবু বকর। আমরা সবাই-ই সার্ভাইভাল ফুড হিসেবে হাত পেতে নিলাম। কিন্তু বেশ টক সেই জাম্বুরা খেয়ে মুখটা আসলে নষ্ট করলাম। কিন্তু সমস্যা যেখানে, সমাধানও সেখানে। পাহাড়ি গাছপাকা কলা দিয়ে সেই স্বাদ ফিরিয়ে আনতে মুহূর্তও লাগলো না। তৃপ্তি ভরে কলা খেয়ে পেট ভরে নিলাম। আবু বকর জাম্বুরা’র দাম পরিশোধ করলেন ৳২০ [টাকা]।

জাম্বুরা-কলা খাওয়া হচ্ছে কেবল ছুতা – আবু বকর তাঁর স্বভাবসুলভ কাজগুলো এর মধ্যেই করে নিচ্ছিলেন: পথ জেনে নেয়া। কিভাবে, কোনদিকে যাওয়া যাবে তার ধারণা নিয়ে নিচ্ছিলেন যথাসম্ভব। এর মধ্যেই ফল বিক্রী শেষ। ঐ পাহাড়ির দলটা ফিরতি পথ ধরবে। আবু বকরের সাথে কী সব কথা হয়ে গেলো। আমরা চললাম তাদেরকে অনুসরণ করে তাদের পিছুপিছু।

কোথায় যাচ্ছি? জানি না।

কিছুদূর উজানে গিয়েই বামদিকে পাহাড়ে উঠা শুরু হলো। আমরা ঐ চারজনকে অনুসরণ করে উপরের দিকে উঠছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না। আবু বকর নিশ্চয়ই এঁদেরকে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় দেখেননি। সমস্যা হচ্ছে, এমন সময় পাহাড়ে এসেছি, যখন পাহাড় নিরাপদ নয়। আবার রনি পাড়ার নিচে, জায়গাটা ভালো নয় বলে শুনেছি। কাকে বিশ্বাস করবো? গত বছর ঠিক এই সময় দুজনকে নিয়ে গেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। নিজেদেরকে ভাগ্যের হাতে তুলে এগিয়ে চললাম।

ডলু ঝরণা থেকে উপরের দিকে - নিশাচর
পথটা কতটা ঢাল আশা করি বোঝাতে পারছি – আমি যেখান থেকে ছবি তুলেছি, অনেকটা মোহনের মাথার উপর দাঁড়িয়ে বলা যায়

‘এগিয়ে চললাম’ বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, কারণ সমতলে আমরা যেভাবে এগোই উত্তলে সেটার টিকিটাও হয় না। পাহাড় উঠা বড়ই কঠিন ব্যাপার। আমার মতো চিকন মানুষের যদি এই অবস্থা, তো মোটাসোটা কোনো ট্রেকারের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। পথটা খুবই খাড়া। এছাড়া উঠার কাজটা আরো কঠিন করে তুলেছে বৃষ্টি ভেজা মাটি। মাটি ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে, এর মধ্যে খাড়া উঠে গেছে পথ। আর পাহাড়িরা নিয়মিত পথটা ব্যবহার করে কিনা আল্লা’ মালুম, নাহলে এতো ছোট ছোট ধাপ কেন? নিয়মিত চলাচল করলে আর প্রশস্থ আর গভীর ধাপ কেটে রাখতো তারা।

আমার রাবারের জুতাটা তানভিরকে দিয়েছিলাম। সে দেখলাম গোড়ালিটা বের করে পরেছে, তারমানে ওর ফুটবল খেলোয়াড়সুলভ পায়ে ঐ জোড়া আঁটোসাঁটো হয়েছে। গোড়ালি আটকানো নয়, তবু তানভির মন্দ চড়ছে না পাহাড়। আমার, বাটা থেকে কেনা জুতা জোড়ার ডান পায়ের চট (ভেলক্রো স্ট্র্যাপ বলা হয় যেগুলোকে) বোধহয় ক্ষয়ে গেছে। তার উপর ভিজে থাকার কারণে একটু পর পর খুলে যাচ্ছে। পায়ে আলগা জুতা আরেক মসিবত। একটু পর পর নিচু হয়ে আবার স্ট্র্যাপটা আটকাতে হচ্ছিলো। মুখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছিলাম, শরীরের শক্তি শরীরে ধরে রাখতে। পাহাড়ে উঠা চাট্টিখানি কথা নয়।

উপরের দিকে উঠা আর শেষ হয় না। এমন সময় আমরা একটা প্রায় সমতলে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর এগিয়ে আবার একটু নিচে নামা। এবং আমরা নামলাম একটা ঝিড়িতে। ওদের থেকে একটা বোতল আমি নিয়েছিলাম। ঝরণা থেকে নিয়ে আসা পানি খেয়ে এই ঝিড়ি থেকে আবার ভরে নিলাম পানি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ঝিড়িতো এখানে একটা না, বরং এটা একটা তিনমাথার সমাহার। দুপাশ থেকে দুটো ঝিড়ি এসে মিলিত হয়ে একদিকে নেমেছে।

তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করে ঝিড়িগুলোর যে নাম পেলাম, তা আমার ভাষায় লিখছি: বাণজিক আর খুর্বা ঝিড়ি। একটা ৩৬০° [ডিগ্রী] প্যানোরামা তুললাম জায়গাটা চিহ্নিত করার জন্য:

ডলু ঝরণার উপর - নিশাচর
প্যানোরামা: একেবারে বামে ‘বাণজিক ঝিড়ি’ নেমে আসছে, একেবারে ডানে উর্ধ্বমুখী রাস্তা, আর রাস্তার ঠিক বামে ‘খুর্বা ঝিড়ি’ নেমে আসছে, আর ঝিড়ি দুটি মিলিত হয়ে মাঝখানে দেখা যাচ্ছে ‘ডলু ঝরণা’ (কাইদং ঝরণা) হয়ে নামছে।
বাণজিক ঝিড়ি - নিশাচর
বাণজিক ঝিড়িতে তিন পাহাড়িকে দেখা যাচ্ছে।

এই দুটো ঝিড়ি একত্র হয়ে তারা এগিয়ে চলেছে ডলু ঝরণার দিকে, ছবিতে যা মাঝখানে দেখা যাচ্ছে। তবে এটাই ডলু ঝরণার উপর না, এই ঝিড়ি আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে সম্ভবত, আবার বলছি সম্ভবত আরো ঝিড়ির সাথে মিলিত হয়ে তারপর ডলু হয়ে নেমেছে। কারণ আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানকার ঝিড়িতে পানির সেরকম তীব্র স্রোত নেই, আর ডলু’র যে উচ্চতা আমরা দেখেছি, এই মুহূর্তে আমরা আরো অনেক উপরে অবস্থান করছি।

এই তিনমাথার সমাহার থেকে ‘খুর্বা ঝিড়ি’র পাশ দিয়ে উঠে গেছে পায়েচলা পথ। পাহাড়িদের একজন সেইদিকে নিয়ে গেছে আবু বকরকে। তানভির আর মোহনও অনুসরণ করছে তাঁকে। আমি ছবি তুলতে আর নোট নিতে গিয়ে একটু পিছিয়ে পড়েছি। দ্রুত বুটস্ট্র্যাপ্‌ড হয়ে আবার উর্ধ্বারোহণ শুরু করলাম।

উঠার পথ তো আর শেষ হয় না। উঠছি, উঠছি, খাড়া উঠছি। পিচ্ছিল পথে পা রেখে পেছনের পা তোলার আগে সন্ধিগ্ন – পা কি আটকাবে? কিন্তু আল্লা’র অশেষ দয়ায় জুতাটা ভালোই সাপোর্ট দিচ্ছে। একটু আধটু যে পিছলাচ্ছে না তা না, তবে মোহনের তুলনায় কম পিছলাচ্ছে। মোহন, ঐ ভারি বোঝা নিয়ে যেভাবে অমানুষের মতো পাহাড় বাইছে, এটা প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা দুজনই পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের ব্যাগও একটু বড়। (এটা হয়তো একটা অজুহাত!)

উপরে উঠতে উঠতে রীতিমতো নাভিশ্বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামলে চলবে না। আবু বকর আর তানভিরকে দেখতে পাচ্ছি না। যেভাবে এগিয়ে চলেছি, আমার মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এবং কিছুক্ষণ কথাটা মাথায় ভাজতেই আমি দৃঢ়চিত্ত হয়ে গেলাম – হ্যাঁ এটাই সত্যি

আমি যা সন্দেহ করছি, আমি জানি, সেটাই হতে চলেছে। মোহনকে ডেকে বললাম কথাটা। মোহন পিছন ফিরে তাকালো না। এগিয়ে চললো। উপরের দিকে। পাহাড়ের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে তার জন্য নতুন কিছু…

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

মন্তব্য করুন