কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে – পাহাড়ের উল্টো পিঠে : শেষ পর্ব

গাইড আলম আমাদেরকে নতুন ঝরণা সানথিয়াম সাইতার দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা এখন তাদের জুমঘরে, এখানেই রাত কাটানোর ইচ্ছা আমাদের। দলনেতা আবু বকর দ্রুত খাবার চড়াতে বললেন। জুমঘরে চুলাও আছে। চুলা ধরাতে সহায়তা করলো আলম। আবু বকর ওনার মোবাইলটা সেই চুলার ওপরে একটা খোঁপে রাখলেন যাতে তাপে ভিতরের পানি শুকিয়ে সুস্থ হয়ে যায় ওটা। চটপট আবু বকর আর মোহন মিলে একটু নুডল্‌স রেঁধে আলমসহ সবাই খেয়ে নিলাম। আলমকে খুশিমনে তাঁর সম্মানী দিয়ে বিদেয় দেয়া হলো। অন্ধকার নামছে… আজ, এই নিজঝুম নিরালায় আমরা চার শহুরে শ্বাপদ!

স্মার্টফোনের দিকদর্শন দেখে তানভির জানালো কোনদিকে পশ্চিম। সবাই জামাতে মাগরিবের নামায আদায় করলাম এই প্রথম। আমার জীবনে এটাই প্রথম কোনো জুমঘরে থাকা। যদিও জুমঘরটা আবু বকরের পছন্দ হয়নি – পাহাড়ের উপর হলে বাতাস যেমন পাওয়া যেত, তেমনি দৃশ্যও উপভোগ করা যেত। কিন্তু এটাতেও আমার আপত্তি নেই – ক্যাম্প করতে এসে ক্যাম্প করা হয়নি, তাতে কী। এই ক্যাম্পটাওতো কম যায় না।

জুম ঘরটা সাধারণ পাহাড়ি ঘরের মতোই দোচালা ঘরের। দুদিকে বেড়া দেয়া, আর দুদিক খোলা রেখেছে এঁরা। একদিকে উঠার পথ, আর অন্যদিকে বড় বারান্দা, যেখানে ফসল শুকাতে দেয়া হয়। জুম ঘরটাতে বড় বড় বেতের ঝুড়িতে ধান জমিয়ে রাখা। এছাড়া আছে শুকনো ভুট্টা। একটা মশারি দিয়ে ধান রাখা হয়েছে – আসলে এটা চাদরের কাজ করছে।

নিজেদের পরনের কাপড়গুলো পাল্টে ফ্রি হয়ে গেলাম সবাই। আমার সাথে নেয়া একটা চার্জ দেয়া এলইডি বাতি জ্বালিয়ে রেখেছি আলোর ব্যবস্থা করতে। আবু বকরকে দিয়ে কিনিয়ে আনা টর্চটাও বের করেছি। বলতে গেলে পুরো ক্যাম্পিং মুডে আমরা। এবং আমাদেরকে সম্মান করে মশাবাহিনী নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কোথায় যেন চলে গেছে ওরা… খুব নিশ্চিন্ত হলাম। কারণ এই উন্মুক্ত ঘরে কোনোভাবেই এদেরকে পরাস্ত করতে পারতাম না আমরা… উল্টো ম্যালেরিয়া বাঁধিয়ে দিতো… যদিও ওডোমোস মাখতে কার্পণ্য করিনি। সুসংবাদ আরেকটাও আছে, আবু বকরের মোবাইলটা জীবিত হয়েছে। বেচারা আবার হাসিখুশি মুডে ফিরে এসেছেন।

আকাশে কৃষ্ণপক্কের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ আর নিশুতি রাতের ডাক
আকাশে কৃষ্ণপক্কের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ আর নিশুতি রাতের ডাক

ক্যাম্পিং ম্যাটটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে আবু বকর, আর তানভির বসেছে তাঁর পাশে। তানভির নোট নিচ্ছে, আবু বকর একে একে বলে যাচ্ছেন – নিজেদের ট্যুরের এযাবৎ খরচটা হিসাব-নিকাশ করে ফেলা উচিত। তানভির কষ্ট করে, কাছেরই ঝিড়ি থেকে এক বালতি পানি নিয়ে এসেছিল। মোহন সেখান থেকে খানিকটা নিয়ে চুলাতে গরম করতে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে – আকাশে য়্যাব্বড় একখানা চাঁদ তখন তাকিয়ে আছে ওরই দিকে যেন। কৃষ্ণপক্কের খানিকটা ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ – তাতে কী? ঐ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ঘরটার বাইরের ঐ কালো জঙ্গল। আশেপাশে সন্ধ্যে হতেই সরব হয়ে উঠেছে ঝিঁঝি পোকাসহ আরো কত নাম-না-জানা পোকা-মাকড় – তাদের সরব উপস্থিতিতে এই পরিবেশ হয়ে উঠেছে আরো প্রাকৃতিক, আরো আদিম।

ঘরটার মেঝের বাঁশের পাটাতন (সিলেটি ভাষায় তর্জা) খুব পাতলা, পুরোন আর ভঙ্গুর। প্রায়ই মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মেঝে ভেঙে ঝুলে যাবো আমরা। নিজেদের হিসাব-নিকাশ শেষ করে আবু বকর আর তানভিরও সামিল হয়েছেন চন্দ্রদর্শনে। আবু বকর এই চন্দ্রসৌন্দর্য্যে বাকরুদ্ধ হয়ে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না – এটা কি চন্দ্রাঘাত, চন্দ্রগ্রস্থ, নাকি চন্দ্রাহত হবে, নাকি আহত, নিহত কিছু একটা হয়ে যাবে সেই অভিধানে ঘুরাঘুরি করে অনেকক্ষণ লাগিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠ ঘুরে এলেন তিনি। দারুণ লাগছিল এই আদিমতায় আমাদের চার চন্দ্রাহতের বুঁদ হয়ে যাবার ক্ষণটি।

কী মনে করে তানভির টর্চের আলো ফেললো শুকোতে দেয়া আমাদের কাপড়গুলোর উপর – দেখে তো আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। সবগুলো কাপড় সাদায় সাদাময় করে বসে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট্ট ছোট্ট প্রজাপতি। ওগুলোকে বিরক্ত না করারই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। লাগুক না একটু প্রকৃতির ছোঁয়া…

আমাদের করিতকর্মা ব্যাচেলর ডাক্তার মোহনের নের্তৃত্বে আমরা এঁটো বাসন-কোসনগুলো ধুয়ে ফেলার প্রয়োজনবোধ করলাম। বাসন বলতে, নুডল্‌সের সাথে একটা করে বাটি বিনামূল্যে দিয়েছিল, আর আমি আসার সময় একটা বাটিতে খাবার এনেছিলাম, এই জুমঘরে চ্যাঁপা একটা বাটি ছিল, আর আমাদের ডেকচি, চামচ ইত্যাদি। বাসনগুলো ধুয়ে ফেলে আমার আর আবু বকরের মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেলো…

চিংড়ি ধরা যাক…

এই ঝিড়িতে চিংড়ি আছে, টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিয়ার গ্রিল্‌সের কাছে শিখেছি, যে পানিতে চিংড়ি থাকে, সে পানি যথেষ্ট ভালো। কারণ নোংরা পানিতে চিংড়ি থাকতে পছন্দ করে না। আমরা এই পানি খাবো এতে কোনো সন্দেহ নেই, এবং এখন এই পানির চিংড়িতে ভাগ বসাবো ইনশাল্লাহ।

তানভির কখনও এভাবে মাছ ধরেনি, মোহন ধরেছে কিনা বোঝা গেল না, আবু বকর আর আমি বহুবার ধরেছি। সুতরাং আমরা দুজন কাজে নেমে গেলাম। আমার টর্চটার তীব্র সাদা আলো নিয়ে আবু বকর গেলেন একদিকে, আর আমারই ঘর থেকে নিয়ে যাওয়া এলইডি বাতিটা নিয়ে আমি একদিকে। টেকনিক হচ্ছে, নিজেরা ধীরে ধীরে উজানের দিকে যাবো, তাতে আমাদের নড়াচড়া ঢালের উপরের দিকে থাকা মাছেদের সতর্ক করবে না। তাছাড়া যেখানেই সম্ভব, শুকনা জায়গায় দাঁড়িয়ে চিংড়ির দিকে হাত বাড়াবো, তাহলে পানিতে নড়াচড়াও হবে না, মাছেরা টেরও পাবে না। অবশ্য চিংড়িরা মাছই নয়। 🙂 এরা আর্থ্রোপোডা পর্বের, অর্থাৎ অমেরুদণ্ডী প্রাণী – এদের মেরুদণ্ড নেই, তাই এরা মাছেদের গোত্রে পড়ে না।

কোনো কোনো ছোঁ বৃথা যাচ্ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ছোঁতেই আমরা সফল হচ্ছিলাম। কিন্তু চিংড়ি ধরে দেখি কি, রাখার কিছু নেই। পরে একটা খাবার বাটিতে সামান্য পানি নিয়ে সেখানে ওগুলোকে রাখা হলো। সমস্যা হচ্ছে একটা চিংড়ি ধরে কিছুদূর পিছনে এসে বাটির পানিতে ওটাকে ছেড়ে আবার আগের জায়গায় যেতে যেতে পানিতে অনেক আলোড়ন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তাই ঠিক করলাম, অনেকগুলো একত্রে ধরে হাতের মুঠের মধ্যেই ধরে রাখবো। তারপর কয়েকটা ধরে একসাথে গিয়ে রেখে আসবো। মাছ ধরবার সময় পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি না করে চলার একটা টেকনিক আছে, যারা মাছ ধরতে খুব পটু, তারা জানেন। আমি অতটা পটু নই, তবে শেখার চেষ্টা করেছি। পায়ের পাতা কাত করে সুড়ুৎ করে পানিতে ঢুকিয়ে দিতে হয়, তাতে পানির সার্ফেস টেনশন নষ্ট হয় না আর আওয়াজও হয় না। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: তরু-কুটিরে আমরা ক’জন সৌখিন সার্ভাইভার)

মোটামুটি মিনিট বিশেক কি আধাঘন্টায় কয়েকটা বড় আর মাঝারি চিংড়ি ধরে ফেললাম আমরা। সবগুলো চিংড়ি ঐ বাটিতে রাখা পানিতে জিইয়ে রাখলাম আমরা। সার্ভাইভাল পরিস্থিতিতে একটা ব্যাপার আমাদের ঘরে যাপিত দৈনন্দিন জীবন থেকে খুব বেশি আলাদা – সেটা হলো ফ্রিজ। পচনশীল খাবার দীর্ঘসময় ধরে সংরক্ষণ করবার পদ্ধতি খুব সহজ না আবার সব পদ্ধতি খুব দ্রুত করাও সম্ভব হয় না, কোনো কোনো পদ্ধতি আবার বিশেষ রসদপ্রাপ্তিসাপেক্ষ। তাই খাবার পাবার পরে সেটা খুব বেশি সময় ধরে যে খাবার উপযোগী রাখা যাবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। পানিতে জিইয়ে রাখার বুদ্ধিটা আবু বকরের। কালকে সকালের নাস্তাটা তাহলে জম্পেশ হবে।

রাতের মতো শেফ মোহন খুব যত্ন করে নুডল্‌স রান্না করলো। নুডল্‌স খাওয়া শেষে গরম পানিতে সীরিয়্যাল গুলিয়ে খেয়ে পেট পুরে খেয়ে আমরা ঘুমোবার প্রস্তুতি নিলাম। দেয়ালেই একটা মশারি পাওয়া গেল। এটা ধান গুছিয়ে রাখা মশারিটা না, ভালো একটা। ওটা টাঙানোর উদ্যোগ নিলো তানভির। কিছুক্ষণের মধ্যে মশারিটা দাঁড়িয়ে গেলো। নিচের দিকটা ছড়িয়ে গুঁজে নিলাম ক্যাম্পিং ম্যাটের নিচে। জম্পেশ একটা বিছানা হয়ে গেলো। আগের দিনগুলোর মতোই একটা স্লিপিং ব্যাগ নিচে আর আরেকটা কম্বলের মতো উপরে দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা।

শুয়ে যাবার পরে আমার মনে হলো, আমার পেশাবের বেগ পেয়েছে। বাবারা তোমরা ঘুমাও, আমি প্রকৃতির সাথে কথা বলে আসি। টর্চ নিয়ে নেমে গেলাম জুমঘরের নিচে, একপাশে সরে গেলাম রাস্তা থেকে। তারপর এক জায়গায় বসে কাজটা যেই সারছি, অমনি গা জ্বলে উঠলো… আমি একেবারে পিঁপড়ার মহাসড়কের মধ্যে এসে বসে পড়েছি। অর্ধেক কাজ সেরে ইচিং বিচিং করে স্থান ত্যাগ করবার তিক্ত অভিজ্ঞতা যাদের মনে পড়ছে, কিংবা মনে ভাসছে, তারা বুঝবেন এই জ্বালা কাকে বলে। কোনো রকমে স্থান পরিবর্তন করে কাজ শেষ করে পা থেকে ঝেড়ে পিঁপড়াগুলো ফেললাম। কিন্তু যে দুয়েকটা হুল ওরা ফুটিয়েছে ওগুলোর ক্যামিক্যালই আমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। আমার ভাগ্য ভালো যে, আমার দলের সবগুলো হয় বুইড়া, নয়তো বেশি ভদ্র – নাহলে বাকি সারাটা রাত আমার ঐ ইচিং-বিচিং-এর কল্পিত চিত্র কল্পনা করেই হেসে পার করে দেয়ার মতো যথেষ্ট খোরাক ওঁদের ছিল। ব্যাটারা মিস করেছে। :p

কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, খেয়ালই নেই। ফযর মিস হয়ে গেলো। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙলো, তখনও আশপাশে পোকাদের চিৎকার চলছে। তবে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ভোরের পাখিরা। দূরের পাহাড়ের চূড়ায় এখনও খানিকটা কুয়াশা কিংবা মেঘ ঝুলে আছে, আর তার গায়ে সূর্যের আলো ঠিকরে অপূর্ব হলুদ আভা ছড়াচ্ছে। দলের সবাই এখনও ঘুমিয়ে। বেরিয়ে এলাম মশারি থেকে। প্রাকৃতিক বড় কর্মটি প্রকৃতির কোলেই সেরে নিলাম সবার আগেই। না, এবারে আর আমাদের জন্য ল্যাট্রিন জুটলো না, উন্মুক্ত বিশ্বেই সারতে হলো কাজ।

আড়ম্বরহীন জুমঘরে মোহন চুলার ধারে, আমি আর আবু বকর চিংড়ি পরিষ্কার করছি (ছবি: তানভির)
আড়ম্বরহীন জুমঘরে মোহন চুলার ধারে, আমি আর আবু বকর চিংড়ি পরিষ্কার করছি (ছবি: তানভির)

একে একে ডেকে তুললাম সবাইকে, যাবার প্রস্তুতি শুরু করা দরকার। উঠে ব্যক্তিগত কার্যাকার্য শেষ করে, নাস্তার প্রস্তুতিতে লাগলাম। গত রাতে সংগ্রহ করে জিইয়ে রাখা চিংড়িগুলো ঢাকনা সরিয়ে দেখি, এখনও পানিতে জ্যান্ত আছে। আমি আর আবু বকর বসলাম সেগুলোর খোসা ছাড়াতে। মোহন ওদিকে চুলা ধরানো শুরু করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেল, কালকের মতো ফট করে আগুন ধরছে না। কালকে আগুন ধরাতে সহায়তা করেছিল গাইড আলম। আবু বকর এগিয়ে গেলেন আগুন ধরাতে। কিন্তু তাদেরকে জ্ঞান দেয়ার খাইসলতটা আমার গেল না। অগত্যা আমার উপর দায়িত্ব পড়লো আগুন ধরানোর। আমি তরু-কুটিরে শেখা আগুন ধরানোর কৌশলগুলো স্মরণ করলাম। হাত লাগালাম।

শুকনো ভুট্টার ছাল আর তার ভিতরে থাকা সেমাইয়ের মতো কিন্ডলগুলো (স্ফুলিঙ্গ ছোঁয়ামাত্র জ্বলে উঠার মতো দাহ্যবস্তু) কাজটা সহজ করে দিলো। একটু বেগ পেতে হলো বাতাসের আর্দ্রতা এখনও কাটেনি বলে। তবে আগুনটা ধরিয়েই ফেললাম। আগুন ধরানোর মতো দুরূহ কাজ এত সহজে করে ফেলাতে বাহবা দেয়ার কিছুই নাই, কারণ আমি একটা লাইটার নিয়ে গিয়েছিলাম, ওটা দিয়েই আগুন ধরাচ্ছিলাম। যন্তর ছাড়া স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে আগুন ধরাতে হয়নি – ঈশ্বরের অশেষ কৃপা।

আগুন ধরতেই শেফ মোহন পানি চড়িয়ে দিলো। আমি আর আবু বকর চিংড়িগুলো পরিষ্কার করে দিলাম। এবং অল্প সময়েই পাহাড়ি ঝাল মরিচ আর টাটকা চিংড়ির নুডল্‌স, আর গরম পানিতে সীরিয়্যাল প্রস্তুত হয়ে গেল। তার সাথে আছে পাহাড়ের পাকা কলা। আমরা সবাই গোল হয়ে বসলাম অমৃত এই নাস্তার রসাস্বাদনে। নাস্তার অমৃত আস্বাদনে আমরা দেরি করলাম না। রিফিল নিয়ে নিয়ে অল্প সময়েই খালি হয়ে গেল ডেকচি। এমন সময় মনে হলো, আহা, এই অমৃত নাস্তার ছবিইতো তোলা হলো না। তানভির তখন ঝটপট ছবি তুলে দিলো।

আমরা যখন নাস্তা শেষ করেছি, তখন এক পাহাড়ি বয়স্ক দম্পতি এসে থামলেন জুমঘরে। শুনে থ’ হয়ে গেলাম, এঁরা নাকি রোয়াংছড়ি থেকে এসেছেন। এই সাতসকালে এঁরা যে চলে এলেন, তা থেকেই বুঝতে পারছেন, এরা কি অমানষিক দ্রুতগতিতে হাঁটতে পারেন। প্রায় ১১/১২ কিলোমিটার পথ এঁরা, ভোরের আলো ফোটার পরে হেঁটে পার করে চলেও এসেছে। তাঁরা, জুমঘরে থাকা পাকা কলা আর পানি খেয়ে বিশ্রাম নিলেন কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেলেন।

পুষ্টিকর আর টাটকা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ক্যাম্প গোছাতে থাকলাম। পরিষ্কার আবহাওয়া। মোহন ওর ব্যাগে লাগানো পলিথিনটা খুলে ফেললো। আমারটা যেহেতু গিঁট দিয়ে লাগিয়েছি, তাই খুললাম না। অ্যাংকলেট, নীক্যাপ সব পরে নিলাম। মোহন মোজা পরে নিলো। ও, বলতে ভুলে গেছি, বাকিরাও এর মধ্যে যার যার প্রাকৃতিক কৃতকর্ম সেরে নিয়েছে এদিকে/ওদিকে। …যাহোক, ওই পাহাড়ি দম্পতি যে ১১/১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছেন, আমাদেরকে এবারে সেই পথটুকু পাড়ি দিতে হবে। পথটা আমি চিনি না। পাহাড়ে, পথ সব সময়ই নতুন।

সকাল ৯:১৫’র দিকে, আমরা জুমঘরে থেকে বেরিয়ে রোদের মধ্যে নেমে পড়লাম ট্রেইলে। কোনদিকে যাবো? বুঝতে পারছি না। পথটা দুই দিকে চলে গেছে। একটা বাম দিকে, একটা সোজা। সোজাটা ধরলাম আমরা। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সন্দিঘ্ন আমরা, ঠিক পথে আছি তো? কিন্তু টেস্টিফাই করার জন্য কাউকে পাচ্ছিও না। অগত্যা এগোতেই থাকলাম আমরা। মোটামুটি ৪০০ মিটার পার হবার পরে, দূরে, একটা পাহাড়ে একটা জুমঘর নজরে এলো। জুমঘরটাতে অনেক ভুট্টা শুকাতে দেয়া হয়েছে। ঘরটাতে একজন পাহাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দলনেতা হাঁক ছেড়ে জানতে চাইলেন, রোয়াংছড়ি যাবার পথ কোনটা। এবং জানা গেল, আমরা ভুল পথে আছি। পিছনে, বামদিকের পথটাই ঠিক পথ ছিল। অগত্যা ফিরতি পথ ধরলাম। মিনিট পনেরো, অযথাই পরিশ্রম করলাম। কিন্তু, এপথে যাওয়াতে গাছে একটা বড় আকারের কালো পোকা দেখতে পেলাম। আর কাছেই গাছের পাতায় এক প্রকারের ক্ষত দেখতে পেলাম। জানি না এ দুয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তবে পাতাটা কাটার পদ্ধতিটা বিচিত্র।

যাহোক, পথ পাওয়া গেছে, এটা আশার কথা। আমরা ট্রেইল ধরে চলতেই থাকলাম। আমাদের অবস্থান তখন ৩৭৫ ফুট-এ। পথটা ক্রমশ বেশ খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠে চলেছে। তখনও বুঝিনি, সামনে কী অপেক্ষা করছে…

বেশ খানিকক্ষণ চড়াই চড়ে আমরা একটা গাছের গুড়িতে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। ক্রমশ উপরে উঠা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে খুব। কার একটা বোতল যেন, আমি নিয়েছি আমার ব্যাগে বহন করতে। একটু পানি খেয়ে নিলাম। মনে হচ্ছে এক গ্যালন খেয়ে ফেলা উচিত। কিন্তু, এখন চড়াই উঠছি, পানি আর পাবো না। যত্ন করে খেতে হবে পানি। গতকালকের মতো প্রয়োজনের সময় পানির আকালে পড়তে আর চাই না।

কিন্তু পথটা পানিশিং লাগছে। পাহাড়ে চড়া কষ্টের, কিন্তু এতোটা কষ্ট আগে কখনও লাগেনি। বুড়া হয়ে গেলাম নাকি? দলের সবার থেকে পিছিয়ে পড়লাম আমি। মোহন তো রোবটের মতো চলছে চলছেই। আবু বকর আর তানভির সামনে। আমি চিন্তা করলাম, পিছনে যখন পড়েছিই, তাহলে এই পানিশিং পথের ছবি তুলে তুলে এগোই। কিন্তু ক্যামেরা বের করে হাতে রাখার স্ট্যামিনা নেই, তাছাড়া পথটা খাড়া, আর ঝুঁকিপূর্ণ। যদি পড়ে যাই, বিপদে পড়ে যাবো। আবু বকর তখন ওনার মোবাইলটা আবারও ধার দিলেন। ওটাতে ছবি তুললাম এই পথের, যথাসম্ভব। কিন্তু এতোটাই খাড়া পথ, আর আমার এতোটাই কষ্ট হচ্ছে যে, মোবাইল দিয়েও ছবি তুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রতিটা ধাপ উঠছি, আর প্রচণ্ড কষ্টে মনে মনে কোঁকাচ্ছি। একটা একেবারে ১৭০ ডিগ্রি খাড়া পথ – ছবি তোলার প্রশ্নই উঠে না।ওই জায়গার কোনো ছবি নেই। ওখানে গিয়ে মোবাইলটা কোমরে লাগানো ক্যামেরার ব্যাগে রাখতে গিয়ে পেনসিলটা ফসকে পড়ে গেলো। কিন্তু ওটা তুলতে গেলে নির্ঘাত আমি পিছন দিকে পড়ে যাবো। পা দুটোকে আর কথা শোনাতে পারছি না। দলের কাউকে সামনে (মানে, মাথার উপরে) কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু জানি ওঁরা সামনে (উপরে) আছে কোথাও। এগিয়ে গেছে আমাকে ফেলে আরো সামনে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ব্রেইন গেইম অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল, ব্যাথা পাবার পরে যদি কেউ জোরে জোরে চিৎকার করে গালিগালাজ করতে পারে, তাহলে তার কষ্টটা প্রায় আশি শতাংশ কমে যায়। আসলে ব্যাপারটা গালিগালাজে না, ওরা তো অসভ্য জাতি, তাই গালিগালাজ দেখায়। আসল ঘটনা হলো মগজটাকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখার মধ্যে, সেটা গালিগালাজ না করেও অনায়াসে করা যায়। ঠিক একই কাজটাই আমাদের দেশের মানুষ হাজার বছর ধরে করে আসছেন, বড় গলায় বলেন: আরো জোরে, হেইয়ো। ঘটনা এটাই, মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রেখে প্রণোদনা দেয়া। কিন্তু, আমি যদি এখন চিৎকার করে বলি হেইয়ো, কিংবা অসভ্যের মতো দেই গালিগালাজ, তাহলে দলের সবাই মনে করবে, আমি হয়তো বিপদে পড়ে চিৎকার করছি। হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে সহ্য করাই শ্রেয়। নিজের চেতনাকে জাগ্রত করে শরীরের সমস্ত কষ্টকে অগ্রাহ্য করতে তীব্র প্রেষণা দিতে থাকলাম। এক ধাপ, এক ধাপ করে উঠে যেতে থাকলাম আশি বছরের বুড়ার মতো।

অবশেষে সামনে একটা দীর্ঘ, সমতল পথ দেখে মনে হলো আমি বোধহয় উপরে উঠে এসেছি। কিন্তু সামনে যতদূর পথটা দেখা যাচ্ছে, দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অনেক পিছিয়ে পড়েছি আমি। বোতল বের করে একটু পানি না খেলেই নয়। এখন এসে জিপিএস এলিভেশন প্রোফাইল দেখে বুঝতে পারছি ৩৭৫ ফুট থেকে ৭২২ ফুট উচ্চতায় উঠে এসেছি এই আধাঘন্টায়। কেন জানি মনে হচ্ছে, পাহাড় আমার জন্য নয়। পাহাড় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি পাহাড়ের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছি।

খামতাং পাড়ায় মায়ের পিঠে শিশু - নিশাচর
খামতাং পাড়ায় মায়ের পিঠে শিশু

পথটা সমতল আর হালকা ঢালু। কিন্তু ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। সামনে দলকে দেখলাম, একটা বেঞ্চে বসে পানি খাচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার একযোগে পথ চললাম। আরো আধা ঘন্টা হাঁটার পর একটা পাড়ার চিহ্ন পেলাম। রাস্তায় বেড়া দেয়া, ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম পাড়ার ঘরগুলো মেঝে থেকে খুঁটি দিয়ে উঁচু হয়ে আছে, কোনো কোনো ঘর থেকে বল্টু-বাল্টু উঁকিঝুকি মারছে।

আমরা এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকলাম, জানলাম, এটা ঘর কাম দোকান। দোকান চালাচ্ছেন ঘরের নারী, পিঠে একটা বল্টু ঝোলানো। মোহন চায়ের ফরমাশ করলো। মোহন আর তানভির চা খাবে। আমি কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখলাম। শরীরের ঘাম একটু শুকাবে। জগ থেকে পানি নিয়ে ঢক ঢক করে খেতে থাকলাম। যাবতীয় তৃষ্ণা মিটিয়ে পানি পান করলাম। পাশেই বিছানায় একজন ব্যক্তিকে শুয়ে থাকতে দেখে আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, অসুস্থ নাকি দাদা। জানা গেল দুই সপ্তাহ ধরে জ্বরে আক্রান্ত তিনি। আবু বকর ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করিয়ে নেবার পরামর্শ দিলেন। ঘরের নারীর থেকে জানা গেল, পাড়ায় পুকুর আছে। আবু বকর সেটা দেখতে চাইলেন। আমিও সঙ্গী হলাম।

খামতাং পাড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার অন্তর্গত একটি খিয়াং পাড়া। ভৌগোলিক স্থানাংক: 22° 7’29.37″N 92°22’54.25″E। পাড়াটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ৬৮৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পাড়াটা বেশ বিস্তৃত, ছড়ানো-ছিটানো – একারণে দেখে মনে হয় যেন সমতলের কোনো গ্রামে এসেছি। এ পাড়ার লোকজন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। পাড়ার গির্জাগুলো হলো: খামতাং পাড়া ইসিসি (Evangelical Christian Church) চার্চ, খামতাং পাড়া বিবিএস (বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি) চার্চ, এবং প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ। রয়েছে এলজিইডি’র তৈরি করা সরকারি প্রাথমিক স্কুলও। স্কুলের সামনে, পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে বিশাল সমতল মাঠ। এই পাড়ায় শুকনো মৌসুমে রোয়াংছড়ি থেকে সরাসরি ট্রাক যাতায়াত আছে।

খামতাং পাড়া
খামতাং পাড়া

কিছুদূর এগিয়ে ডানদিকে একটা ঘর দেখে আশ্চর্য হলাম দুজনই – এই পাহাড়ে এধরণের ঘর আমি অন্তত কখনও দেখিনি – দেখার চিন্তাও করিনি। ইট-সিমেন্ট-রড দিয়ে বানানো হয়েছে পিলার, উঠছে দেয়াল। পাহাড়ে, এই এতো দূরে এগুলো আনলো কিভাবে! জানা গেল, এগুলো ট্রাকে করে আনা হয়েছে রোয়াংছড়ি হয়ে। ঐ ঘরের মালিক, মালকিনের সাথে কথা হলো – সন্তানদের জন্য কষ্ট করে ঘর বানিয়ে রেখে যাচ্ছেন – যাতে তাদেরকে আর কিছুদিন পর পর কাচাঘর মেরামতের কষ্ট করা না লাগে।

খামতাং পাড়ার পুকুর - নিশাচর
খামতাং পাড়ার পুকুর

এই দম্পতিই পাড়ার শেষ মাথায় পুকুর দেখাতে নিয়ে গেলেন। পুকুরের পানি ঘোলা, কাদাময়। এই একটা পুকুর, মাঝখানে একটু পাড় আবার ঐ আরেকটা পুকুর। পরে, আবুবকরের কথা থেকে বুঝতে পারলাম, এগুলো মাটি কেটে তৈরি করা পুকুর না, বরং ঝিড়িতে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা পুকুর। ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। পরে ফিরে এসে ম্যাপে যখন ট্র্যাকটা বসালাম, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখি: আমরা তখন ছিলাম গতকালকে দেখে আসা সানথিয়াম সাইতার (সানথিয়াম ঝরণা)-এর উপরে। উপগ্রহচিত্রে ঝিড়িটার তেমন হদিস দেখা যাচ্ছে না, তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার: ঝিড়ির একটা বড় পথ আটকে পুকুর বানানো হলে, বাকি পথটুকু থেকে যা একটু পানি নিংড়ে যায়, তাতে ঝরণার পানি কমই হবার কথা।

খামতাং পাড়ার বেড়া পার হচ্ছেন আবু বকর - নিশাচর
খামতাং পাড়ার বেড়া পার হচ্ছেন আবু বকর

খামতাং পাড়া থেকে চা খেয়ে মোহন আর তানভির প্রস্তুত। আমিও বোতলটা ভরে নিলাম পানি দিয়ে। এবার আবার যাত্রা শুরু। পাড়া থেকে বেরিয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রশস্থ রাস্তা। সেদিক দিয়েই রোয়াংছড়ি যেতে হয়। আমরা সেদিকে চললাম। পথে একটা কবর ফলক দেখলাম, সিমেন্ট খসে গেছে তাই লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না একটা লেখা ছাড়া: [t]hey has six son[s]। একটা বাড়িতে দেখলাম এনজিও’র করে দেয়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখার আধার। সামনে উঁচু বেড়া দেয়া, অন্যান্য পাড়ার মতো গাছের গুড়িতে ভর দিয়ে উঠে ওপাশে আবার গাছের গুড়িতে ভর দিয়ে নামা…। রাস্তাটা ইট স’লিং করা – এটা পাহাড়ি হাইওয়ে’র বাপ।

তারপর বামে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ পাহাড়ের সারি, আর মাঝখান দিয়ে ইট স’লিং রাস্তা। কোথাও ফসলের মাঝখানে একটা ছোট্ট জুমঘর যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আরেকটু আশ্রয় দেবার জন্য। পাহাড়ের কাচা সড়ক ধরে হেঁটে পাকা রাস্তায় হাঁটার পর নিশ্চয়ই আমাদের কষ্টই হওয়ার কথা না। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার ডান পায়ের হাঁটুতে কেন জানি ব্যাথা করছে। এবং প্রতি পদক্ষেপে মনে হচ্ছে যেন হাঁটুর বাটিতে ঘষা লাগছে। কিন্তু দল চলছে, আমিও চলছি। কোথাও আবার কষ্টটা বেড়ে যায়, যখন উঁচুতে উঠতে হয়। আবার নামার সময় যে শান্তিতে নামি, তাও না, নামার সময় মনে হয় যেন উরুর হাঁড়টা (ফিমার) হাঁটুর নিচের হাঁড়ের (টিবিয়া-ফিবুলার) উপরে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। একটু কষ্টই হচ্ছে।

কোথাও একটা বড়সড় গাছ পথের পাশে দাঁড়িয়ে পথিককে ছায়া দিচ্ছে। কোথাও পাকা রাস্তা ভেঙে গড়িয়ে পড়েছে নিচের খাদে – পাহাড়ের নিত্য রূপ। বাংলাদেশের পাহাড়গুলো ভঙ্গুর। আবু বকর তো একটা বড়সড় গাছ দেখে প্রেম করার আগ্রহ আর ধরে রাখতে পারলেন না। পরম মমতায় গাছকেই জড়িয়ে ধরলেন। গাছকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে কোনো ইয়ে নেই, বরং এটা দিয়ে গাছের আকারটা বোঝানো যায় খুব সহজেই।

আমরা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই পড়লাম একটা তিন রাস্তার সমাহারে। আয়হায়! এখন কোনদিকে যাবো? একটা বিশাল সাইনবোর্ড লাগানো: রোয়াংছড়ি খামতাং পাড়া হতে পাইক্ষ্যং পাড়া হয়ে রুমা। রনিন পাড়া পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ। অর্থসাল ২০১৪-২০১৬ খ্রি.। বাস্তবায়নে: পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

রোয়াংছড়ির অবস্থান আন্দাজ করা যাচ্ছে কি? কোনদিকে হবে? মনে হচ্ছে ওদিকে। কিন্তু আসলে কি ওদিকে? না, ঐ যে ওদিকটায় হবে। নাহ্‌, শিওর না। কী করা যায়? কোন রাস্তাটা আসল? আমরা দোনমনা (ত্রিনমনা?) করছি… এমন সময় সমাধানটা বেরিয়ে এলো আবু বকরের মাথা থেকে। আমাকে বললেন, ওর এঁকে দেয়া ম্যাপটা বের করেন। কাগজে পেনসিলের দাগ টেনে জুরভারং পাড়ার ছেলেটার আঁকা মানচিত্র (পথচিত্র) চোখের সামনে ধরতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো: বামদিকের পথটা নেমে গেছে রুমার দিকে। নিচের দিকের পথটা নেমে গেছে পাইক্ষ্যং পাড়ার দিকে। আর সোজা বামদিকের পথ, যেটা একটু উপরের দিকে উঠে গেছে, ওটা হলো রোয়াংছড়ির পথ। আহ্‌! জীবনটা বাঁচাইলা।

আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ডটার সামনে একটা ছবি তুললাম। কিন্তু মোহনের ছবি-টবির প্রতি কোনো মোহ নেই। হয়তো ওর মনের মাঝে কাজ করে, দেখানোর কী আছে। কিন্তু আমরা তো সবাই দেখানোর জন্য ছবি তুলি না, ছবিটা হলো স্মৃতি। সময় পার হয়ে গেলে আমাদেরকে স্মৃতিগুলো অনুপুঙ্খ মনে করিয়ে দেয় এই ছবি। মোহন চলছে রোবটের মতো.. চলছে, চলছেই…। ওর এই বদভ্যাসের (?) কারণে আমাদের পুরো টিমের একত্র কোনো ছবি নেই এযাত্রার। তানভির আর মোহনের অবশ্য আরেকটা নীতি আছে: যন্ত্রে নয়, নিজের চোখে স্মৃতিকে ধরে রাখা তাদের পছন্দ।

তথাস্থু পথ ধরা হলো। এবারের রাস্তাটা আবার মাটির রাস্তা। পথটা কোথাও পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে, কোথাও আবার নামছে। তবে এখন নামার পরিমাণই বেশি। শেষ উঁচু জায়গাটায় যখন বিশ্রাম করতে বসেছি আমরা একটা গাছের গুড়িতে, তখন আমাদের সাথে আরেকজন পাহাড়িও বসেছেন। কথা বলে জানা গেল, উনি খামতাং পাড়ার স্কুল শিক্ষক। যাচ্ছেন রোয়াংছড়িতে। পানির খুব প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। কড়া রোদে এতক্ষণ ট্রেক করেছি। কিন্তু ছোট্ট বোতলগুলো আমাদের চারজনের জন্য অপর্যাপ্ত ছিল। আমার বোতল দুটো তো প্রথম দুদিনেই খুইয়েছি। অল্প একটু যা পানি আছে, তা দিয়ে বিস্কুট সেবন করে কোনো রকমে গলা ভেজালাম আমরা। খুব মুখিয়ে আছি ঝিড়ি পাবার জন্য। আমাদের প্রাণ বাঁচাবে এখন একটা ঝিড়ি।

আমরা জেনেছি, খুব বেশিদূর না, কাছেই ঝিড়ি। এই ঝিড়িপথেই রোয়াংছড়ি যায় সবাই। পা চালালাম। এখন শুধুই নামা। আমার পায়ের ব্যাথাটা আছে, কিন্তু একটু গা সওয়া হয়ে গেছে আরকি। আবু বকর পথে, কারো কারো সাথে কথা বলেন, কারো কারো সাথে কথা বলেন না। এক যুবকের সাথে কথা হলো, আবু বকর একটু মজাও করলেন ওর সাথে। সেই ছেলে খুব আক্ষেপ করলো, আজকে ফুটবল খেলা আছে বিকেলে, রোয়াংছড়িতে। অথচ আমরা চলে যাচ্ছি – এটা খুব আক্ষেপের। বুঝলাম, একসময় আমাদের গ্রামে যেমন কয়েক গ্রাম থেকে খেলা দেখতে আসতো মানুষ, তেমনি অবস্থা এখনও পাহাড়ে আছে। মানুষের এখনও শারীরবৃত্তীয় ক্রীড়াতে বিনোদনের খোরাক জিইয়ে আছে এখানে।

একটা ঢাল নামার সময় দেখলাম একজন গাইডের নেতৃত্বে একটা শহুরে ট্রেকারের দল উঠে আসছে পাহাড়ের দিকে। পাহাড় বাইতে গিয়ে একেকজনের নাভিশ্বাস বেরিয়ে যাবার যোগাড়। বোঝাই যাচ্ছে, উদ্দেশ্য রনিন পাড়া হয়ে তিনাপ সাইতার যাওয়া। আমার কেন জানিনা এই ট্রেকার দলকে দেখে খুব ভালো লাগলো। কেন? জানি না। অবশ্য আজকাল ট্রেকারদের দেখলে অগ্রজ ট্রেকাররা কেউ খুশি হন না, সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু কেন আমার ভালো লাগলো, আমি নিজেও জানি না। সালাম দিলাম, একজন উত্তরও দিলো। নবীর সুন্নতের আদব – উপর থেকে যে নামছে, সে সালাম দিবে। আবু বকর জানালেন, আজকেই বান্দরবান নেমে এপর্যন্ত চলে এসেছে, ভালোই প্রোগ্রেস ওদের। …আমরা নামতে থাকলাম।

রোয়াংছড়ির ঝিড়িতে নেমেছে মোহন (ছবি: তানভির)
রোয়াংছড়ির ঝিড়িতে নেমেছে মোহন (ছবি: তানভির)

অবশেষে আমরা ঝিড়িতে এসে পৌঁছলাম। পথে একটা সমতল বাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম, খুব ভালো লেগেছিল। যাহোক, ঝিড়িতে নেমে জানে পানি পেলাম। তিয়াশ মিটিয়ে পানি খেয়ে নিলাম। এবার ঝিড়ি ধরে হাঁটা। পানিতে পা ছপাৎছপাৎ, কোথাও বালুতে কচকচ, কোথাও পাথরে থপথপ। সহজ পথ, শান্তির পথ। ঝিড়িতে পানি অনেক কম। নিম্নচাপের প্রভাবমুক্ত হয়ে ঝিড়ির পানিতে তোড় নেই।

আবু বকর আমার কাছে সময় জানতে চাইলেন, কটা বাজে। আমি বললাম বারোটা বাজে। হাঁটছি তো হাঁটছি। পথে কোথাও ছোট ছোট ঝরণা নেমে এসে মিশছে ঝিড়ির সাথে। কোথাও পাহাড়িরা গোসল করছেন। এক জায়গায় দেখলাম এক পাহাড়ি দম্পতি ঝিড়ি থেকে কুড়িয়ে নেয়া এক প্রকারের শাক কলা পাতা দিয়ে মুড়িয়ে নিচ্ছেন। জানতে চাইলাম স্বাদ কেমন। তিতা নাকি। জানালেন, না, স্বাদ মিষ্টি। তাঁদের ঝুড়ির মধ্যে আরেকটা কলা পাতায় মোড়ানো রয়েছে লাউশাক। পথে এক জায়গায় দেখি পাইপ দিয়ে পানি নেয়া হয়েছে কোথাও।

এভাবে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম রোয়াংছড়িতে। একটা উঁচু পাকা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। কিন্তু মোহন কোথায়? ও’ এদিকে আসেনি। ও’ হেঁটে চলে গেছে ঝিড়ি ধরে। আবু বকর জানালেন, সমস্যা নেই, ওদিক দিয়েও উঠা যাবে রোয়াংছড়িতে। কিন্তু মোহনের এই কাজটা পছন্দ হয়নি আমার। এতো রোবটের মতো হলে তো বিপদ। হাঁটছে তো হাঁটছেই। কিন্তু ও’ব্যাটা সম্ভবত আগেও একবার রোয়াংছড়ি এসেছিল।

উপরে উঠে আসার পরে আরো হাঁটতে হচ্ছে সামনে। রোয়াংছড়ি ভালো বড় – এটা রোয়াংছড়ি সদর পাড়া। পাড়ার ভিতরে পাকা রাস্তা করা হয়েছে ৫৮৭ মিটার। শহরটা দেখে আমি থ’ – এতো অ্যাডভান্সড! আশা করিনি। দুতিন তলা পাকা দালান। ডানদিকে একটা জাদি – বান্দরবানে এই জাদিই স্বর্ণমন্দির খ্যাতি পেয়ে বিখ্যাত।

আমাদের লক্ষ্য ছিল রোয়াংছড়ি পৌঁছানো, আমরা পৌঁছেছি। আর এই গন্তব্যে পৌঁছে যাবার নিশ্চয়তা পেয়েই আমার পুরো শরীর অসাঢ় হয়ে আসছে। আমার টিবিয়া-ফিবুলাটা মনে হচ্ছে ফিমার থেকে আলাদা হয়ে গেছে, দুটোর মধ্যে কোনো প্যাটেলা (বাটি) মনে হচ্ছে যেন নেই-ই। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে যখন কোথাও কোথাও আবার চড়াই-উৎরাই করতে হচ্ছে, মনে হচ্ছে মারা যাচ্ছি।

শহরের ভিতরে ঢোকার পর আরো এগিয়ে চলেছি, চলেছি। হঠাৎই দেখি আবু বকর বেশ তাড়া দিচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলে বললেন, আপনে না তখন বললেন বারোটা বাজে। আপনে ভুল দেখছেন। তাড়াতাড়ি চলেন। জুম’আ এখনও আছে। আমি তো ভুলেই গেছিলাম আজকে শুক্রবার, জুম’আর নামাজের সময় এখন। আমি সময়টা আসলেই ভুল দেখেছি তখন। দ্রুতই বোচকা-বাচকি নিয়ে মসজিদে হাজির আমরা। ঠান্ডা পানিতে ওযু করে, অ্যাংকলেট খুলে পা ধুয়ে ময়লা ছাড়াতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেলো। তিনজনে জুম’আর নামায আদায় করলাম। মোহনের কোনো দেখা নেই।

আবু বকর শুধু নামাযের জন্যই তাড়া দিচ্ছিলেন যে তা নয়, তার মাথায় নতুন পোকা ঢুকেছে – সেই পোকা, যা, অফ-ট্র্যাক বান্দরবানের শেষে এসে তার মাথায় ঢুকেছিল – আজকেই ঢাকা চলে যেতে পারবো। পথে ঐ অভিযাত্রী দলটার প্রোগ্রেস দেখে হয়তো মাথাটা তার আরো খারাপ হয়ে গেছে। সম্ভবই। দৌঁড়ের চোটে রোয়াংছড়ি পাকা ব্রিজটা পার হলাম। আগে গিয়ে বাসের টিকেট কাটতে হবে। ট্রেকার আবু বকর আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন। তার টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। তিনি এগিয়ে গিয়ে টিকেট কেটে এক রেস্টুরেন্টে খাবারের অর্ডারও দিয়ে দিয়েছেন। মোহনকে পাওয়া গেল এখানে। গাড়ি ছাড়তে এখনও আধা ঘন্টা বাকি, সুতরাং দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়ার মোক্ষম সময়।

টিভিতে ঢাকাই সিনেমার ডায়লগ শুনতে শুনতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে বাস ছাড়ার সময় এসে গেলো। দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠলাম আমরা। আজ পর্যন্ত কখনও ডানদিকে সীট পাইনি। সম্ভবত পাহাড়িদের জন্য এরা বুক করেই রাখে ডানদিকের সীটগুলো। বামদিকে বসা মানে সারা পথ রোদ মেখে মেখে যেতে হবে। যাহোক, বাস ছাড়ার পরে বাতাস থাকায় কষ্ট তেমন হচ্ছিলো না।

বাস এসে বান্দরবান পৌঁছালো – কত সময় লেগেছিল, দেখিনি। খুব ক্লান্ত – কিন্তু বাসে ঘুম লাগেনি। বান্দরবান এসে বাসের সীট থেকে যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, আমি আর পা ফেলতেই পারছি না। একটা সীট ধরে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। ওদিকে আবুবকর বাতাসের বেগে নেমে গেছেন বাস থেকে। আজকেই ঢাকা পৌঁছনো সম্ভব। আমি নিশ্চিত আমার ডান পায়ের উপর-নিচ আলাদা হয়ে গেছে। মেঝেতে ডান পা রাখতেই পারছি না। কোনোরকমে ব্যাগটা নিয়ে এক পায়ে ভর দিয়ে বাস থেকে নামলাম। এবারে হেঁটে ঢাকার বাস কাউন্টার অবধি যাওয়া। কারো তোয়াক্কা না করে আবু বকর আগেই চলে গেছেন ওদিকে। আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললাম। বাম পায়ের উপরই বেশি ভর দিলাম।

বাস কাউন্টারে এসে দেখি, শহরটা পর্যটকে পর্যটকে ভরপুর। পুরো শহর মানুষে গিজগিজ করছে। পরিবার, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মানুষ বান্দরবান দেখতে এসেছে। ট্রেক থেকে ফিরে গাইডেড ট্যুর দেখলে সবারই হাসি পায়। কিন্তু হাসার মতো ফুরসৎ আমাদের নেই। দলের বাকিরা উদ্বিগ্ন, আবু বকরের মিশন কি সফল হবে? আর আমি উদ্বিগ্ন আমার পা নিয়ে।

নেটওয়ার্কের মধ্যে এসে সবার আগে মনে পড়লো বাসার কথা। ঘুমিয়ে নেই তো সবাই… ফোনটা যেই তুলেছি, মনের টানেই হোক কিংবা ঘটনাক্রমেই হোক, আমার গিন্নির কল এসে ঢুকলো। বেঁচে ফিরে যেতে পারবো কিনা — এমন দোদুল্যমানতায় যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই যাত্রায় চারদিন পরে আজ ফোনের এপাশ থেকে কণ্ঠস্বরটা শুনতে পাওয়াও তার জন্য পরম খুশির। ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে। জানালাম, ফেরার চেষ্টা করছি। পরে শান্ত সময়ে কথা বলবো।

এমন সময় খবর এলো, পর্যটকে ভরপুর শহর। একটা বাসেও টিকেট নেই। তবে কি আমাদের ফেরা হবে না? টানা বন্ধে সবাই-ই ঘুরতে এসেছে বান্দরবানে। লোকে লোকারণ্য পর্যটন স্পটে টিকেট না পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দলনেতা হচ্ছেন আবু বকর। তার মাথায় একটা আজব কম্পিউটার বসানো। একটা তুড়ি বাজালেন, আর, রাত তিনটা বাজে আমি বাসার দরজায় কড়া নাড়লাম। কিভাবে এলাম, শুরুতেই বলেছিলাম, এই ট্যুরে আবু বকরের কিছু কেরামতি আছে, সেগুলো আমরা ফাঁস করছি না।

আবু বকর যে পাগলের মতো দৌঁড়াচ্ছিলেন, তার ফলে আমরা ঐ দিনেই ঢাকায় ফিরতে পেরেছি। কিন্তু এই তাড়াহুড়ার একটা বড্ড বড় খেসারত তাকে দিতে হয়েছে। তানভিরের হাতে দিয়েছিলেন একটা তাবু। চট্টগ্রাম শহরে সিএনজি থেকে নেমে দৌঁড়ে বাসস্ট্যান্ডে যাবার সময় তানভির সিএনজি থেকে নেমে গেছে, কিন্তু তাবুটা সীটের পিছনে রয়ে গেছে। এই তাবুটা তার জন্য উপহার হিসেবে বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন কে যেন। এই ট্যুরে পাইন্দু খালের ঢলে ব্যাগ হারিয়ে গেলেও এতো কষ্ট লাগতো কিনা আমার, জানি না, শহরের একটা সিএনজিতে তাবুটা খুইয়ে আমার যতটা লেগেছে

ভ্রমণ তো শেষ। কিন্তু কী নিয়ে এলাম? কর্মক্লান্তি থেকে পালাতে আমরাই বোধহয় একমাত্র পাগল প্রাণী, যারা বিশ্রাম তো দূরের কথা, উল্টো, আরো পরিশ্রম করার জন্য পাহাড়ে চলে যাই। কারণ, পাহাড়ে গিয়ে আমরা আদি অকৃত্রিম বাংলাদেশটাকে এখনও দেখতে পাই। যদিও এবারের যাত্রায় পাহাড় যে ক্ষণে ক্ষণে আমাদেরকে তার উল্টো পিঠটাই দেখিয়েছে – সেটা আমরা দেখেছি। শিখেছি।

কিন্তু আমি শিখেছি অনেক কিছু। ফেরার পথে বাসে আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলাম, বলেন, আমার মধ্যে কী কী ভুল দেখেছেন। আমি জানি, অনেক দেখেছেন, কিন্তু চক্ষুলজ্জায় হলেও বলতে পারছেন না বেচারা। যেমন: অতি পণ্ডিতি করা; নেতা যেখানে ডীল করছেন, সেখানে আগ বাড়িয়ে কথা বলা; আগ বাড়িয়ে কাজ জানি বোঝানো… এরকম হাজারটা দোষ। অবশেষে আবু বকর আমার চাপাচাপিতে একটা কথা অন্তত বললেন:

আপনার একটা জিনিস ঠিক না। কখনও কাউকে অনবরত ডিরেকশন দিতে নেই। আপনি হয়তো ভালো হবে চিন্তা করেই দেন। প্রত্যেকটা মানুষের সমস্যা সমাধানের নিজস্ব মত-পথ থাকে। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। নিজস্ব ক্যাপাবিলিটি থাকে। তাকে তার মতো সমস্যা সমাধান করতে দিতে হয়। সে যদি খুব বড় ভুল করতে যায়, তখন সংশোধন করে দিতে হয়। কিন্তু তা না করে অনবরত ডিরেকশন দিতে থাকলে সে খেই হারিয়ে ফেলে। ডিরেকশন ফলো করতে গিয়ে, রবোটের মতো আচরণ করতে গিয়ে, আরোও ভজকট করে ফেলে কাজটাতে। আমি সব সময় দেখছি, আর বড় ভাইদেরকেও দেখছি, তারা সবাইকে তার মতো আচরণ করতে উৎসাহ দেন।

আবু বকর যখন কথাগুলো বলছিলেন, আমি তখন আর সেখানে নেই। জীবনে অসংখ্য বার এই ভুলটা করেছি। স্মৃতির পাতায় সব বায়োস্কোপের মতো ভেসে উঠতে থাকলো। জীবনে অনেকবার এই ভুলটাই করেছি – আমি মনে করতাম আমি নিখুঁতাচারী (পার্ফেকশনিস্ট) – সবাইকে তা-ই হতে হবে। একজন শিক্ষক কাছে না থাকলে, সেই ভুল কে-ইবা সংশোধন করে দিত? তাই আমি সব সময় গুরু-ধরা-শিক্ষায় বিশ্বাস করি। ফ্রিল্যান্স গুরু আর ইউটিউব গুরু আমি কখনও সত্যিকারের গুরু বলে মানি না। সক্রেটিস আর প্লেটো’র মতো গুরু-ধরা-শিক্ষাই সত্যিকার অর্থে জীবনকে কিছু দেয়।

কথা দিয়েছিলাম, আমরা এই লেখায় নায়ক আর ভিলেনের নতুন সংজ্ঞা দেখবো। কী মনে হয়, চারজন অভিযাত্রীর মধ্যে কে নায়ক আর কে ভিলেন? আমাদের অফ-ট্র্যাক বান্দরবানে ভিলেন হয়ে উঠেছিল রাসেল। এবারের ট্যুরে তানভির বারবারই অপরিপক্ক আচরণ করেছে, তাহলে তো ভিলেন সে-ই। কিন্তু…

আমরা কেউই জানতাম না, ট্রেকে নামার সময় তানভির আন্ডারওয়্যার খুলেনি, কারণ তানভির আন্ডারওয়্যার পরেই না। যে আমরা পিছনে ফিতা দেয়া জুতা নিয়েও হিমশিম খাই, সেখানে সে গোড়ালি বের করে জুতা পরে পাহাড় চড়ে এসেছে। ট্রেকে বের হয়ে তানভিরের জিহ্বা বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে কখনও থামার জন্য আকুতি জানায়নি কিংবা এ নিয়ে কোঁকায়নি। কোনো ট্রেকেই ও দেরি করেনি, বরং আগে আগে পথ চলেছে। খাবার নিয়ে কোনো অনুযোগ জানায়নি, টয়লেট নিয়ে বাছবিচার করেনি। তাহলে সে তো অন্য রকম এক নায়কই। আমার মতে, এবারের ট্যুরের নায়কই আমাদের তানভির।

মোহন, কথা কম বলে। এটা তার অভ্যাস, নাকি ডাক্তার হিসেবে রোগীর বাহুল্য প্যাঁচাল এড়ানোর কৌশল তা জানি না। রোবটের মতো দলছাড়া হয়ে এগিয়ে গিয়ে অনবরত পথ চলে, আপাতদৃষ্টিতে সে হয়তো সমাজবিচ্যুত কাজ করেছে। ক্যামেরা নিয়ে গেছে, কিন্তু মাত্র তিন কি চারটা ছবি তুলেছে। এবং আমি বহুবার খুঁচিয়েও একটা ছবিও উদ্ধার করতে পারিনি ওর থেকে। এতদসত্ত্বেয় খাঁটি ট্রেকারদের মতো কিন্তু সে দম ধরে রেখেছে। যখনই চুলা গুতানোর দরকার পড়েছে, পাক্কা শেফের মতো সে রান্নার কাজ করে গেছে নিজ আন্তরিকতায়, দলনেতা তাকে দায়িত্ব চাপাতে হয়নি। সে যে সত্যিকারের ট্রেকার, ট্যুর শেষে তার মন্তব্য হলো, এটা তো কোনো ট্রেকই হয়নি, মাঝারি মানের ট্রেক হয়েছে।

আবু বকর, সব সময়ই আমার শিক্ষক। তিনি নিজেই তার একটা দোষ বলেন, “আমি সব সময়ই আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে নেই, এটা হয়তো সব সময় ঠিক না। কেউ কেউ এতে খারাপ পান হয়তো”। এবারের ট্রেকে আমি সেই তুক্‌খোড় আবু বকরকে যদিও পাইনি, কিন্তু শেষটায় এসে আবু বকর তার স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাছাড়া সময়ে সময়ে পাহাড়ে গিয়ে পাহাড়ের কেতায় সমস্যার সমাধান খোঁজার মতো ধীশক্তিধারী একজন মানুষের আসলে নেতা হওয়াই উচিত।

আমি? আপাতদৃষ্টিতে কী মনে হয় জানি না, এবারের ট্যুরে ভুল করেছি অনেকগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, শেষদিনে আমার পা যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল, ঐদিন যদি আরো ৫-৬ কিলোমিটার ট্রেক করা লাগতো, কিংবা আরো দুয়েকদিন যদি পাহাড়ে থাকা লাগতো – কী হতো তাহলে? আমি তো বসে পড়তাম পড়তামই, পুরো দলের প্রোগ্রেস নষ্ট করে দিতাম। সুস্থ মানুষ যখন দলের বোঝা হয়ে যায়, তখন তার চেয়ে বড় ভিলেন আর কে হতে পারে? (ডাক্তার দেখাইনি, কিন্তু আমি জানি, এখনও প্রায়ই একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করলেই আমার পা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে – পাহাড় বোধহয় আমাকে আজীবনের জন্য লাথি মেরেছে)

এই ভ্রমণ শেষে আবু বকর কিছু সাবধানবাণী দিয়েছিলেন:

  1. জীবনটা কোনো ছেলেখেলা নয়।
  2. অ্যাডভেঞ্চার আর ঝুঁকির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে সেই রোমাঞ্চ, যাতে যথাযথ নিরাপত্তা (সেফ্‌টি) এনশিওর করা হয় – যেমন: বাঞ্জি জাম্পিং, স্কাই ডাইভিং, স্কুবা ডাইভিং…। কিন্তু হঠাৎ দৌঁড় দিয়ে রাস্তা পার হওয়াটা অ্যাডভেঞ্চার নয় – ঝুঁকি।
  3. গাইড না নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। গাইড নিয়ে যাওয়াই উচিত। তারপরও দলে অন্তত একজন অভিজ্ঞ কেউ থাকা চাই। দলের সবারই পাহাড়ের জ্ঞান থাকলে ভালো, না থাকলেও সেই জ্ঞান নেবার মানসিকতা যেন থাকে। অনেক রকম বিপদ আছে, যা হয়তো স্থানীয় একজন সাথে থাকার কারণেই কেবল আপনি এড়াতে পারেন।

আমার লেখা যদি পড়ে থাকেন, স্থানীয় একজনের গুরুত্ব যে কী, তা আমি পদে পদে উল্লেখ করেছি। আপনার হাজার অভিজ্ঞতা থাকলেও আপনি ‘স্থানীয়’ না। আবু বকরের এই কথাটা যদি চাক্ষুষ করতে চান, Lone Survivor প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রে এক আফগান কিশোরের পাহাড় থেকে নামাটা দেখতে পারেন।

শেষ কথাটা বলি:

ওমুক জাহান্নামে গিয়ে প্রো-পিক দিয়েছে, আমারও জাহান্নামে না গেলে ইজ্জত থাকছে না – এজাতীয় ইগোর কোনো ভ্যালু নাই। আমি যেমন ক্লাস ওয়ানে থাকতে গ্র্যাজুয়েট হতে পারবো না, বা হলেও তার দাম থাকবে না, ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বোকা হওয়ার মধ্যে কোনো সার্থকতা নাই। পাহাড়ের লাথি খাবার আগে সতর্ক হোন।

(সমাপ্ত)

– মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*