ভ্রমণ ২০১২ : শস্য-শ্যামলা উত্তর বাংলার টিউবওয়েলের মুখে (১)

“ধুত্তোর [গালি], এতো কম টাকায় ট্যুর, ক্যামনে কী?” – আরেফিনের উষ্মা শুনে বিশ্বাস হতে চাইছিল না, এটা সম্ভব হয়েছে! বাংলাদেশের ভিতরে দীর্ঘতম দূরত্ব অতিক্রম করলাম আমরা এপর্যন্ত সবচেয়ে কম খরচে।

 

পরিকল্পনাটার শুরু হয়েছিল ফেসবুকের একটা ফ্যানপেজ দেখে, দেখে নাকিব পাগল হয়ে যায়। তথ্যসূত্র হিসেবে জুটলো সামহোয়্যারইনব্লগের একটা ব্লগপোস্ট^। গুগল করতেই বেরিয়ে এলো আরো বেশ কিছু তথ্যক্ষেত্র। ইট-কাঠের শহরে দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে ঐ তথ্যক্ষেত্রে হালচাষটা সে-ই করলো আদ্যোপান্ত, যে কাজটা বরাবরই আমি করে থাকি। এই ট্যুরের কোনো পরিকল্পনাতেই ছিলাম না আমি।

ভ্রমণের পরিকল্পনা হলো: ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়া, বাংলাবান্ধা যাওয়া, সেখান থেকেই নাকি অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিমালয়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চূঁড়া দেখা যায়। বাংলাদেশের ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার দূর্লভ স্মৃতি পূঁজি করতে নাকিবের খুব সাধ। ব্লগ মারফত জানা গেল, ওখানে থাকার জন্য আদর্শ ব্যবস্থা হলো ‘জেলা পরিষদ ডাক বাংলো’। ভিতরে ভিতরে খোঁজখবর লাগিয়ে এর-ওর মাধ্যমে কিভাবে যেন আরেফিন ইউএনও’র সাথে যোগাযোগ করতে পারলো। লিংক কাজে লাগিয়ে নিশ্চিত করে ফেললো ডাক বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা।

ভ্রমণের দুদিন আগেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, যাবো কি যাবো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিভাবে যেন সব কিছু হয়ে গেল। নাকিব নিজ উদ্যোগে টিকেট করলো (ঢাকা-পঞ্চগড় : হানিফ এন্টারপ্রাইজ : জনপ্রতি ৳৫৫০)। ট্যুর-যাত্রী হলাম আমরা সাতজন:

  • নাকিব আহমেদ, রিসার্চ ফার্মের অ্যাকাউন্ট্যান্ট (ভ্রমণ-উদ্যোক্তা, টিকেট ম্যানেজার, এবং এ্যাইমার্স ব্যান্ডের লীড গিটারিস্ট)
  • শামসুল আরেফিন, ঢাকা ব্যাংকের ব্যাংকার (এই ভ্রমণের নেতা)
  • সাজ্জাদ হোসেন, নতুন কাজের সন্ধানে উন্মুখ (গিটারিস্ট, গাতক)
  • রাকিবুস সালেহীন, ঢাকা ব্যাংকের ব্যাংকার (অমাবশ্যার চাঁদ, ট্যুরে ওকে সহজে পাওয়া যায় না, শখের গিটারিস্ট)
  • নূরুল আলম মিথুন, জনতা ব্যাংকের ব্যাংকার (লম্বু, অনেকটাই গোঁটানো)
  • ইমদাদ শাকিল, একটা ফ্যাক্ট্রি’র অপারেশন ম্যানেজার (গাতক, খুবই আমুদে); আর
  • আমি নয়ন, আইটি ফার্মে গ্রাফিক্স ডিযাইনার-ওয়েব ডেভলপার হিসেবে কর্মরত (শখের আলোকচিত্রী, অভিযাত্রী)

কর্মক্ষেত্রের আগে যে পরিচয়টা মুখ্য, তা হলো- আমরা সবাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিজেদের আয়-রোজগারের থেকে সামান্য একটু খরচ করে সুখ খোঁজার অভিপ্রায়েই ভ্রমণের এই উদ্যোগ।

এবারের ট্যুরের মূল আকর্ষণ আমার নতুন কেনা ক্যামেরা: Nikon CoolPix P510, পৃথিবীর সর্বোচ্চ 42x অপটিক্যাল যুম ক্যামেরা। আলোকচিত্রী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার একটা উদ্যোগ বলা যেতে পারে এই অভিযাত্রা। তাছাড়া এই অতিরিক্ত যুম দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও আরো বেশি সুন্দর করে ধারণ করা যাবে বলে সবাই-ই বেশ খুশি।

নভেম্বর ৮, ২০১২ (বৃহঃস্পতিবার)

রাত এগারোটায় হানিফ-বাস ছাড়বে শ্যামলী, কল্যাণপুর থেকে। একটু দেরির বাসটাই ভাড়া করা হয়েছে, যাতে সবাই যার যার কর্মক্ষেত্র থেকে গা ঝেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। যাহোক, সময়মতো সবাই এক হয়ে বাসে উঠলাম। বাস যাবে পঞ্চগড় পর্যন্ত। একটু জেনে নেয়া যাক:

পঞ্চগড় হলো বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা, যার তিন দিকেই ভারতের প্রায় ২৮৮ কিলোমিটার সীমানা-প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এর উত্তর দিকেই ভারতের দার্জিলিং জেলা। পঞ্চগড় জেলার মাটি বালিপ্রধান বলে বালিতে নূড়ি পাথরের ছড়াছড়ি। গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩০.২° সেন্টিগ্রেড, সর্বনিম্ন ১০.১° সেন্টিগ্রেড। রাজনগড়, মিরগড়, ভিতরগড়, দেবেনগড় ও হোসেনগড় নামক পাঁচটি গড়ের (দূর্গ) সমন্বয়ে গঠিত বলে এই জেলার নাম ‘পঞ্চগড়’।

নেপালে অবস্থিত হিমালয় পর্বত থেকে ঠান্ডা বাতাস নিয়মিত আসে বলে ভারতের পাহাড়চূঁড়ার দার্জিলিং যেমন সব সময় ঠান্ডা থাকে, তেমনি শীতকালে উত্তরীয় বাতাসের প্রভাবে ঠান্ডা থাকে পঞ্চগড়, ঠিক করে বললে, পঞ্চগড়ের সর্বউত্তরের থানা তেঁতুলিয়া। আমাদের ভ্রমণের সময়টা এসময় বাছাই করার কারণ হলো শীতের প্রারম্ভে কুয়াশামুক্ত, মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। তবু শীতের প্রচন্ড প্রকোপ থেকে বাঁচার পরামর্শ দিয়ে সব বন্ধুদেরই শীত-পোষাক নিয়ে নিতে পরামর্শ দিলাম।

এগারোটার বাস ছাড়লো সাড়ে এগারোটায়। আধা ঘন্টা দেরি করাসত্ত্বেয় নাকিব পেশাবে গেল শেষ মুহূর্তে। বাস, এমনিতেই দেরি করে ফেলেছে, তাই সময় নষ্ট করতে চাইছে না, কিন্তু আমাদের ‘বাস থামান, লোক আছে’ চিল্লাচিল্লিতে ড্রাইভার যেমন বিরক্ত, যাত্রীরাও সমান বিরক্ত: এতক্ষণ কোথায় ছিল? যাহোক, নাকিবের চেহারা দেখা গেল, কিন্তু সাথে সাথে আবিষ্কার হলো সাজ্জাদও নেমে গেছে। শেষে দুজনকে বগলদাবা করে যখন বাস রওয়ানা করলো, তখন আমরা সবাই বিরক্ত হওয়াতো দূরে থাক, হেসে বাঁচিনে।

সেই হাসির দমক শেষ হলো গাবতলির হাটের গরুর দুর্গন্ধে। তারপর চলাই চলা। জানালা বন্ধ করে দেয়া হলো, বাইরে থেকে লু হাওয়ার প্রকোপ কমাতে। আমি আর মিথুন, আরেফিন আর সাজ্জাদ, নাকিব আর শাকিল, রিফাত একাই বসবে বেছে নিয়েছে। আমাদের ডিজিটাল বয়রারা গাড়িতে বসেই কানে গানের মেশিন লাগিয়ে ‘কালা’ হয়ে গেছে। কেউবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিচ্ছে। আমি আর মিথুন দুজনই অন্তর্মুখি, তাই আমাদের আলোচনা চলছে চলতি বিষয়ে, যে যার পর্যবেক্ষণ শেয়ার করছি।

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় সড়ক-দূরত্ব প্রায় ৪৪৪ কিলোমিটার। সেখান থেকে তেঁতুলিয়া আরো ৩৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে বাংলাবান্ধা বর্ডার আরো প্রায় ১৮ কিলোমিটার। তাহলে সর্ব উত্তরের সীমান্তে পৌঁছতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে ৪৯৭ কিলোমিটার, রাউন্ড করলে ৫০০ কিলোমিটার। এই বিপুল যাত্রাপথের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্তু বন্ধুদের অনেক ধন্যবাদ, ক্লান্তিটা টের পেতে দেয়নি তারা।

অন্ধকার কোচের ভিতরে একটু ঘুমিয়ে নিতে চাইছি। কিছুটা ঘুমিয়েও গেছি, এমন সময় শাকিল পিছন থেকে ডাকলো: যমুনা সেতু। বাংলাদেশের খুবই নামকরা সেতু, নাম নিয়ে অবশ্য দুই সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন আছে, আরেক নাম: বঙ্গবন্ধু সেতু। একজন মানুষের নাম নয়, উপাধি দিয়ে একটা সেতুর নাম বেশ হাস্যকর শোনায়।

বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু, এপর্যন্ত (২০১২) বাংলাদেশের বৃহত্তম বহুমূখী সেতু, উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৯৮-এর জুনে। লম্বায় ৪.৮ কিলোমিটার, আড়াআড়ি ১৮.৫ মিটার। ৪ লেনবিশিষ্ট এই সেতুর পিলার সংখ্যা ৫০ আর স্প্যান ৪৯টি। ১২০ বছরের মেয়াদ দেখিয়ে তৈরি হলেও ইতোমধ্যেই এতে আবার বড় ধরণের মেরামতের কাজ চলছে। এই সেতুর উপর দিয়ে সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। বাস্তবায়ন এযুগে হলেও এই সেতুর স্বপ্ন, পর্যবেক্ষণ, সমীক্ষা ইত্যাদি শুরু হয়ে যায় সেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ভাষানির আমল থেকেই।

এই সেতু হবার আগে লোকজন কিভাবে এতো বিশাল যমুনা নদী পাড়ি দিত তা ভেবে আশ্চর্য হতে হয়— সে যে এক মহা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ, তা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। শাকিল আর নাকিব একবার মোটর সাইকেলযোগে এসেছিল যমুনা সেতুতে, তাই সে ভালো করেই চেনে। যমুনা সেতু কিন্তু সেতু থেকেই শুরু হয়নি। পুরো প্রজেক্টটি অনেক বিশালায়তন। সেতু শুরুর অনেক আগে থেকেই রাস্তা আর অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। তারপর সেতুর টোল প্লাজা। সাধারণত সেতুতে টোল-বুথ থাকে একটি, এখানে আছে একাধিক। তাই দ্রুততার সাথে টোল দিয়ে গাড়িগুলো সাঁই সাঁই করে উঠে যাচ্ছে সেতুতে।

অন্ধকারে সেতুর সৌন্দর্য্য কিছুই বুঝলাম না, শুধু দেখলাম রেইলিং। তবে বাতি জ্বালিয়ে পুরো সেতুই আলোকিত করে রাখা আছে। উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকালে যা একটু দেখা যায়, তবে সেটা আমার অবস্থান থেকে সুবিধাজনক ছিল না। নিচে তাকিয়ে দেখি বিশাল চর জেগেছে, সেখানে আবার এক-দু ঘর বসতিও হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে বাস চললো যমুনা সেতু হয়ে। একসময় সেতু থেকে নামলাম আমরা, কিন্তু কখন নামলাম, ঠিক বুঝলাম না। কারণ সেতু থেকে নামলেও সেতুর আবহ ঠিকই আছে রাস্তায়। অপূর্ব অপূর্ব কার্পেটিং করা রাস্তা। মনে হচ্ছিলো বিদেশে আছি। কী এক মোহে তাকিয়ে থাকলাম বাইরের দিকে, যেন এখনও যমুনা সেতু দেখছি।

মোহ ভাঙলো, যখন বাস ডানদিকে মোড় নিয়ে আমাদেরকে প্রথম বিরতি দিল। রাত তখন ৩টা ৪০। থেমেছে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের চান্দাইকোনার ষোল মাইল নামক স্থানের ‘অভি হাইওয়ে ভিলা’য়। লগো দেখে বোঝা গেল, এটাও হানিফের একটা এন্টারপ্রাইজ। নেমেই শাকিল দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ‘চায়ের পুকুর’-এর দিকে।

মানে?

ঘটনা কী? আমিও উন্মুখ হয়ে তাকালাম। একটা ছাউনির নিচে চারদিকে উঁচু করে দেয়া কাউন্টার। লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐ কাউন্টারের উপর চায়ের কাপ রেখে চা খাচ্ছেন। দেখে মনে হয় কাউন্টারের ভিতরটা হলো চায়ের পুকুর, আর সবাই ওখান থেকে কাপ ডুবিয়ে চা তুলে খাচ্ছে: কল্পনার ভেলাটা মন্দ ছোটায়নি শাকিল। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। বন্ধুরা একসাথে থাকলে বোধহয় এটাই হয়, হাসির হোক আর নাহোক, সংক্রামক হাসিতে আক্রান্ত হয়ে এক ফালি হেসে নেয়া যায়।

যাহোক, টানা ৪ ঘন্টা পরে ওখানে নেমে প্রাকৃতিক কর্মটি সেরে সবাই একটু হাত-পা ঝাড়তে চাচ্ছিল। তাই আমরা চা-পরোটা খেলাম (সাকুল্যে ৳১০৫)। আর বরাবরের মতোই আমাদের বিড়ি-খোররা ধরিয়ে গেল একের পর এক সিগারেট। রিফাত তো সিগারেট ছাড়া কিছুই খেল না। প্রাকৃতিক পরিবেশে এই দূষণকারীদের আমি জীবনেও ক্ষমা করতে পারবো না। এই ট্যুরের বিড়ি-খোররা (আমি ডাকি গাইঞ্জাখোর) হলো: চেইন-স্মোকার আরেফিন, তার চ্যালা সাজ্জাদ, এবং উদাসী রিফাত।

খাওয়া-দাওয়া শেষে বাইরে এসে আবিষ্কার করলাম, আমি নিজেও বিড়ি ধরিয়েছি। হ্যা, সত্যি, হা করতেই মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে… কুয়াশার চাদরে দাঁড়িয়ে বোধহয় সবাই-ই ‘গাইঞ্জাখোর’ হয়ে যায়… 🙂

সিরাজগঞ্জের প্রথম এবং একমাত্র যাত্রাবিরতিকালে আকাশে আধফালি চাঁদ, রাত সাড়ে তিনটায় (ছবি: শাকিল)
সিরাজগঞ্জের প্রথম এবং একমাত্র যাত্রাবিরতিকালে আকাশে আধফালি চাঁদ, রাত সাড়ে তিনটায় (ছবি: শাকিল)

আবার যাত্রা শুরু… যা পাড়ি দিয়েছি, তার দুই-তৃতীয়াংশ পথ এখনও বাকি। এবারে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোর হই-হই করছে, এমন সময় ঘুম ভাঙলো। আলো ফুটতে বাকি এখনও। তায়াম্মুম করে সীটে বসে ইশারায় ফযরের নামাজটা সেরে নিলাম পশ্চিম আন্দাজ করে নিয়ে। এরপর ভোর হওয়া দেখা।

অপূর্ব এক সমতল-ভূমি দেখতে দেখতে পথচলা। সমতল… সমতলের পর আরো সমতল, সেই সমতলে ধানক্ষেতও সমতল, তারপর একটু খাদে এক চিলতে ছোট্ট নদী কিংবা খাল, তারপর আবার সমতল। ধানক্ষেতের মধ্যে বিদ্যুতের তারে বসে থাকা পাখি, নীলাকাশে যেনবা কালো একেকটা বিন্দু। আমি হাওড়-পাড়ের মানুষ, তবু কেন জানি এই সমতল ভূমি আমায় নতুন করে ছুঁলো।

পার করতে থাকলাম রংপুর। সেই কখন থেকে চলেছি রংপুরের ভিতর দিয়ে, রংপুর যেন শেষই হতে চায় না। একসময় রংপুর থেকে নিলফামারী হয়ে ঢুকলাম দিনাজপুরে। ভোর তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। রাস্তার পাশে ‘কান্তজীর মন্দির’ সাইনবোর্ডটা যার-পর-নাই টানলো আমাদেরকে। তবু সেই টান উপেক্ষা করে সামনে পথ চলা। এদিকে বড্ড পেশাবের বেগ পেয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে চেপে রেখেছি, কিন্তু এই ব্যাটা ড্রাইভারের কি পেশাব পায় না? রোবটের মতো গাড়ি চালাচ্ছেই, চালাচ্ছে।

একসময় না পেরে কন্ডাক্টরকে ডেকে বলেই ফেললাম, সামনে কোথাও বিরতি দেবে কিনা। ও ব্যাটা অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে ফেললো, ‘ক্যান, পেশাব পাইছে?’ … ‘আচ্ছা, দেখতাছি।’ কিন্তু এ ব্যাটার তো থামানোর কোনো লক্ষণ দেখি না। এদিকে বেশ কষ্ট হচ্ছে। শীতের দিন পেশাব আটকে রাখা ভীষণ বিপদের কথা।

যাক, একসময় বাবা ঠাকুরের দয়া হলো, বাসটা একটা পেট্রোল পাম্পে থামিয়ে ‘মুত্র বিসর্জনের’ আহ্বান জানালো। আমি বেরিয়ে যাবার সময় সাজ্জাদকে বললাম, পেশাব করবি নাকি, চলে আয়, অনেকক্ষণ কিন্তু আর সুযোগ পাবি না। কিন্তু সে রাজি হলো না।

পাম্পে প্রাকৃতিক কর্মটি সারার বেশ ভালোই ব্যবস্থা আছে। শেষ করে আমি যখন বাসে ফিরছি, তখন দেখি যুবতী, বৃদ্ধা, বয়স্ক লোক অনেকেই আমার মতো ভিড় জমিয়েছে। আমার উছিলায় অনেকেরই বোধহয় উপকার হলো। বাসে যখন ফিরলাম, তখন দেখি সাজ্জাদ উঠে দাঁড়িয়েছে, এতক্ষণে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেও যাবে। মনে মনে আমি হাসি। ওর সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হয় সবসময়ই।

যারা গিয়েছিল, সবাই-ই চলে এসেছে, বাস যাত্রা শুরু করবে, কিন্তু আবার সাজ্জাদ মিসিং। ওর কথা সুপারিশ করবো কী, হাসতে হাসতে বাঁচিনে। শেষ পর্যন্ত দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এলো বেচারা। এসে নিজেই স্বীকার করলো, আমি কি খালি ঝামেলা সৃষ্টি করছি নাকি? সংক্রামক হাসি ছড়ালো আমাদের সবার মধ্যে।

আবার বাস চলা। এতো দূরের পথ পাড়ি দিতে ক্লান্তি লাগছে কিছুটা, তবে ঘুমটা ভালো হওয়ায় কিছুটা চাঙাও লাগছে। হঠাৎ আমাদের পাশে কোথাও থেকে গান গেয়ে উঠলো শিল্পী হৃদয় খান। কান পাতলাম। শুনি:

আঁড়োল থে-কে, কেজ্জে ডে-ক্কে জ্জায়,

আঁড়োলে সে ডে-ক্কে জ্জা–য়,

নিড়োলে সে ডেক্কে জ্জা-য়,

আমি তার রূপেড় মায়া—-য়

কো’থায়; সে হায়; কো’থায়; সে হায়…

যখন বুঝতে পারলাম, হাসি আর ঠেকায় কে? ওদিকে আরেফিন পড়ছে সাজ্জাদের গায়ে, আমি পড়ছি মিথুনের গায়ে, নাকিব হাসছে ঠাঠাঠাঠা করে, আর রিফাত কাউকে না পেয়ে জানালার গায়ে… আমাদের শাকিল বাবাজি মন ভরে নাঁকি গলায় হৃদয় খানকে কপি করছে। ব্যস, সেই ছিল শুরু। এই গান শেষ পর্যন্ত এই ট্যুরের থীম সং হয়ে উঠেছিল।

হাসির দমক থামিয়ে আমরা কিছুটা স্থিতু হয়েছি। আবার দৃশ্য উপভোগ। দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে পারি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো, ‘পঞ্চগড়, শেষ স্টপেজ। এখানে নামতে হবে ভাই, বাস আর যাবে না।’ প্রথম অনুভূতি: পঞ্চগড় চলে এলাম! যাহোক, ঘুমবাবাকে বিদায় জানালাম সারা দিনের জন্য। কর্মব্যস্ত একটা দিন কাটাতে হবে এবারে… নেমে পড়লাম আমরা।

ক্ষিধেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। ‘পেট চোঁ চোঁ’ বিষয়টা আসলে কী, সেটা একটা গবেষণা করা দরকার। পৃথিবীতে এতো শব্দ থাকতে ‘চোঁ চোঁ’ দিয়ে কী বুঝিয়েছেন সাহিত্যিকরা, আল্লা’ মালুম। কিন্তু, পেটপূঁজোর আগে নিশ্চিত করতে হবে ঘরে ফেরা। ফিরতি পথের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিলো দলপতি। নাকিব, আমি আর শাকিল চললাম খবর নিতে। বাস থেমেছে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন মোড়ে। অনেকগুলো কাউন্টার এখানে, কিন্তু হানিফ ছাড়া আর কোনোটাতে লোক নেই।

আমরা সবাই শনিবার পর্যন্ত ছুটি নিয়ে এসেছি। এর ভিতরে ঢাকা পৌঁছতে হবে, আজকে শুক্রবার, রবিবার থেকে অফিস। আজকের দিন আর রাতটাই সম্বল। তাই যত দেরির গাড়িতে চড়া যায়, তত লাভ, আবার খুব বেশি দেরি করা যাবে না, তাহলে মাঝরাতে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিবে, কোথাও যাওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের চাহিদামতো কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে দেখা পেলাম শ্যামলী’র। শ্যামলীতে খবর নিয়ে জানা গেল, বাস ওদের তেঁতুলিয়া থেকেই ছাড়বে, তবে সেটা সকাল আটটায়। কালকে আমরা তাহলে খুব বেশি সময় পাবো না।

অনেক দরকষাকষি করেও সেটা নড়ানো গেলো না। অবশেষে স্থির হলো, আমরা শ্যামলীতে করেই ঢাকায় ফিরবো, তবে বাস তেঁতুলিয়া থেকে সাড়ে আটটায় ছাড়বে। ওরা রাজি। সাতজন যাত্রী তেঁতুলিয়া থেকে বুক পাওয়া বেশ বড় দাও, ওরা হাতছাড়া করতে চাইলো না। আমরা অগ্রিম কিছু দিয়ে সীট বুক করলাম।

আমরা তেঁতুলিয়া যাবো শুনে আস্ত একটা বাস আমাদের দিয়ে দিল হানিফ, আন্দাজ করলাম, বাসটার এমনিতেই ওখানে যাবার কথা, মাঝখানে আমাদেরকে পেয়ে কিছু বাড়তি আয়…। জনপ্রতি ৳৫০ করে দিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। (আন্দাজ করলাম, হয়তো আমাদের থেকে একটু বেশিই নিয়েছে)

গাড়ি এক্ষুণি ছাড়বে বলে আমরা, নাস্তা করবো তেঁতুলিয়াতে, ঠিক করে বাসে ঝটপট উঠে পড়লাম। বাস চললো উত্তরবঙ্গের কার্পেট বিছানো পাকা সড়কে। আমি আমার সিলেটের রাস্তা নিয়ে গর্ব করতাম, এখন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলি, শ্রেষ্ঠ রাস্তা আমি পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে দেখেছি। যেমন সুন্দর কার্পেটিং, তেমনি সুন্দর রাস্তার দাগ টানা, বেরিকেড, সাইন পোস্ট ইত্যাদি। (এর রহস্য হলো পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা সর্বমোট ৫৩.১০ কিলোমিটার সড়কের কাজ ২০০৮-এ শুরু হয়ে এই এবছর ২৪ জুন শেষ হয়েছে)

এতো বড় গাড়িতে আমরা সাতজনই মাত্র যাত্রী— নিজেদেরকে ভিআইপি লাগছে, আমাদের জন্য পুরো একটা বাস! তাই গা এলিয়ে বসে যাওয়ার কথা, কিন্তু কেন জানি না, আমরা পিঠ টান করে আশপাশটা দেখার চেষ্টা করছি। যেদিকে তাকাই, সমতল। সমতল আর ধানক্ষেত। কার্ত্তিক মাসের পাকা সোনালী ধানের ক্ষেতে মনটা জুড়িয়ে যায়।

বিশাল বপু ট্রাক, পাক্কা দ্বিগুণ লোড, চলছে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে (ছবি: লেখক)
বিশাল বপু ট্রাক, পাক্কা দ্বিগুণ লোড, চলছে পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে (ছবি: লেখক)

এর মাঝে সামনে চোখে পড়লো বিশাল বপু এক ট্রাক, উচ্চতায় স্বাভাবিক ট্রাকের দ্বিগুণ। আশ্চর্যের বিষয় সেটা নয়, আশ্চর্যজনক হলো ট্রাকের বডি যেখানে শেষ, সেখান থেকে আরো দ্বিগুণ করে মাল বোঝাই করা হয়েছে। পুরোটা তেরপল দিয়ে ঢাকা বলে বোঝা গেল না ভিতরে কী।

সামনে যত যাচ্ছি, তত আশ্চর্য হচ্ছি, আমি কি ভুল করে সিলেটের জাফলং-এ চলে এলাম নাকি? এরকম কেন দেখছি তাহলে? রাস্তার দুপাশে এখানে ওখানে স্তুপ করে রাখা হয়েছে পাথর আর পাথর। একটু যেতে না যেতেই দেখি স্টোন-ক্রাশার! এতো এতো পাথর দেখে আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার জাফলংকে তেঁতুলিয়ার কাছে তুচ্ছ মনে করলাম। এদিকে এতো পাথর আছে জানা ছিল না।

রাস্তার পাশে পাথর আর পাথর, জাফলং ফেল (ছবি: লেখক)
রাস্তার পাশে পাথর আর পাথর, জাফলং ফেল (ছবি: লেখক)

ছোটবেলা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকাটা, আঁকাআঁকির সুবাদে আমি আলহ্বামদুলিল্লাহ বেশ ভালোই পারতাম। আর মানচিত্র আঁকাটা শুরু করতাম ‘টিউবওয়েলের মাথা’ দিয়ে। হ্যা, টিউবওয়েলে যে জায়গা দিয়ে পানি পড়ে, তার ঠিক মাথায় বালতি আটকানোর জন্য যে চুটটা দেয়া থাকে, বাংলাদেশের সর্বউত্তরের চূঁড়ার অংশটা আমার কাছে সবসময়ই সেরকম লাগতো। আজকে আমরা সেই টিউবওয়েলের মাথায়ই ঢুকছি এখন: স্বাগত জানালো একটা তোরণ, লেখা: ১৯৭১-এর মুক্তাঞ্চল।

বাসের রাজা আমরাই: মিথুন-আরেফিন-সাজ্জাদ-নাকিব (ছবি: লেখক)
বাসের রাজা আমরাই: মিথুন-আরেফিন-সাজ্জাদ-নাকিব (ছবি: লেখক)

এদিকটার সাথে সিলেটের অনেক মিল, শুধু পাহাড় ছাড়া। পাথরের কথা তো বললামই, এদিকে সিলেটের মতো চা বাগানও আছে। বাংলাদেশ সীমান্তে যেমন, ভারতের অংশেও তেমন। চাবাগান বিষয়ে বিস্তারিত এখন নাহয় না বলি…।

মানচিত্রটা মনে করলে দেখতে পাবেন: উপরের ঐ কোণাটাতে যতই উত্তরের দিকে যাচ্ছেন, দুদিক থেকে কিভাবে ভারত-সীমান্ত চেপে আসছে। আমাদের অবস্থাটাও হচ্ছে তাই। শাকিল তার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে জিপিএস চালু করে বসে আছে, যেখানেই রাস্তাটা বাঁক নিয়ে ভারতের সীমান্তের মধ্যে ঢুকে যাই যাই করছে, তখনই চিৎকার দিয়ে উঠছে: এটা ইন্ডিয়া, ঐ যে ইন্ডিয়া, এদিকে ইন্ডিয়া, ঐ চা বাগানটা ইন্ডিয়ায়, এই পাশটা ইন্ডিয়ায়… ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়াহ্‌, ইন্ডিয়াহ্। ওর ইন্ডিয়া বলতে বলতে হাঁপানি এসে যাবার জোগাড় দেখে আমরা হেসে বাঁচিনে। এব্যাটা একটা রিয়্যাললাইফ জোকার, শ্রেফ মজা করার জন্যই এইরকম চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কিন্তু ড্রাইভার আবার বিষয়টাতে বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল, সে নিশ্চয়ই ভাবছে, ‘ঢাকার আবুল’ এসেছে, জীবনে ইন্ডিয়ার বর্ডার দেখেনি; তাই সে মাঝেমাঝেই গাড়ি ধীর করে কিংবা কখনও গাড়ি থামিয়ে ভারতের সীমান্ত পিলারের ছবি তুলতে সহায়তা করছিল আমাদেরকে।

ঐ যে, চা বাগানের মধ্যে দিয়েই ভারতের কাঁটা তারের বেড়া দেখা যাচ্ছে (ছবি: লেখক)
ঐ যে, চা বাগানের মধ্যে দিয়েই ভারতের কাঁটা তারের বেড়া দেখা যাচ্ছে (ছবি: লেখক)

আসলেই, রাস্তাটা এখানে, এইতো একশো-দেড়শো গজ দূরেই ভারতের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। তারমানে এই রাস্তাটা নো-ম্যান্‌স-ল্যান্ডে!! …রাস্তাটা সামনে আরো অপূর্ব! দুপাশ থেকে গাছ নেমে এসে যেন কুর্নিশ করে বলতে চাইছে: স্বাগতম!

একসময় একটা বাজারে বাসটা থামিয়ে হঠাৎ ড্রাইভার বললো, ‘মামা, তেঁতুলিয়া।’

গন্তব্যে পৌঁছে প্রথমেই চোখে পড়লো বাজারের কেন্দ্রে একটা বড়সড় তেঁতুল গাছ। যারাই তেঁতুলিয়া

দুপাশ থেকে গাছগুলো কুর্ণিশ করে জানায়: স্বাগতম! (ছবি: লেখক)
দুপাশ থেকে গাছগুলো কুর্ণিশ করে জানায়: স্বাগতম! (ছবি: লেখক)

যান এই গাছটার ছবি তুলে নিয়ে আসেন, এবং অকপটে বলার চেষ্টা করেন: এই গাছ থেকেই তেঁতুলিয়ার নামকরণ। তবে অন্যান্য প্রকাশিত উৎস থেকে জানা যায়: অতীতে নাকি অনেক তেঁতুল গাছ ছিল এই জনপদে। তৎকালীন বর্ধমানের রাণী প্রজাদের থেকে কর হিসেবে তাই তেঁতুলের বীজ নিতেন (সম্ভবত কড়ির মতো তেঁতুলের বীজ অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো)। সেই তেঁতুল থেকে এর নাম হয় তেঁতুলিয়া। যাহোক, গাছের নিচে এরকম কোনো বিবরণ কিংবা নামকরণ কিছুই পাওয়া যায় না। শ্রেফ এতটুকু দেখা যায়, গাছটা শান বাঁধানো এবং একটা সাইনবোর্ড ঝোলানো: ঐতিহাসিক তেঁতুলতলা। কেন ঐতিহাসিক? কোনো ব্যাখ্যা নেই। গাছে সাইনবোর্ড ঝোলানো নিষেধসত্ত্বেয় খোদ সরকারি ক্যাম্পেইনেরই ব্যানার ঝুলছে।

তেঁতুলিয়া বাজারের মহীরূহ: তেঁতুল তলা (ছবি: লেখক)
তেঁতুলিয়া বাজারের মহীরূহ: তেঁতুল তলা (ছবি: লেখক)

তেঁতুলিয়ায় রিকশা নেই: কেন নেই, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, আমি জানি না। উত্তরবঙ্গের বাহন হলো খোলা ভ্যান। তেঁতুলিয়ার বাহন হলো ঢাকায় চলা মালবাহী ত্রিচক্রযান ভ্যান, ওতেই পা ঝুলিয়ে বসতে হয়। আমরা দুটো ভ্যান নিয়ে প্রথমে বাংলোয় যাওয়া স্থির করলাম এবং দুদলে ভাগ হয়ে চললাম। একটা ভ্যান না চিনেই ঘুরপথে চললো (৳৪০), আমাদেরটা চললো শর্টকাটে (৳৩০); বাজার থেকে সোজা গেলে রাস্তাটা তিন দিকে ভাগ হয়ে গেছে: ডানের পথ ধরে গেলে বাংলোর পথ সহজ, সোজা পথেও যাওয়া যায় (ঘুরপথ), বাম দিকেরটা বাংলোর পথ নয়।

বাংলোর গাড়ি-চলা পথটা অপূর্ব (ছবি: লেখক)
বাংলোর গাড়ি-চলা পথটা অপূর্ব (ছবি: লেখক)

যাহোক, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যখন বাংলোর গেটে গেলাম, কেয়ারটেকার তখন গেটের উপর থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

…না, আমাদেরকে স্বাগত জানাতে নয়, ফিরিয়ে দিতে।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো: আমাদের নামে বাংলোয় কোনো বুকিং দেয়া নেই।

বাংলোয় গিয়ে বিধিবাম, সবার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি আরেফিনের দিকে (ছবি: লেখক)
বাংলোয় গিয়ে বিধিবাম, সবার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি আরেফিনের দিকে (ছবি: লেখক)

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

তথ্যসূত্র:

১. নিবন্ধ: পঞ্চগড় জেলা, বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু; বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

২. পঞ্চগড় জেলা তথ্য বাতায়ন, http://www.dcpanchagarh.gov.bd/।

৩. যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গণমাধ্যম, ডাক্তারের রোজনামচা, http://niazmowla.com/বাংলাদেশ/সংক্ষিপ্ত-পরিচিতি/যোগাযোগ-ব্যবস্থা-ও-গণমাধ/।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (শেষ কিস্তি)

আমরা আছি কেওকারাডং পর্বতেই, পাসিং পাড়ায়। রাসেল ইস্যুতে কামরুল আর আবুবকর একটু দ্বিমত পোষণ করায় কামরুল রাগ করে বেরিয়ে গেছে পথে। উদ্দেশ্য জানা আছে, কিন্তু একা… কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তাই আমি নিয়েছি পিছু। যেহেতু পথটা একটাই, সামনে এগিয়েছে, ধরে নিলাম কামরুল সামনেই কোথাও আছে। এবারে আমরা কেওকারাডং-এর পথ ধরেছি। আমি খুব দ্রুত চলছি। নাকিবের ক্যামেরাটা আমার কাছে, কিন্তু ছবি তোলার চেয়ে হাঁটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে, কামরুলকে ধরতে হবে। ক্যামেরাটা দিয়ে ছবি তুলছি, হাঁটছি— দ্রুত হাঁটছি। পাশে কেওকারাডং চূঁড়া, একটা বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে অনেক সৌখিন পর্যটক হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উঠে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাচ্ছেন। ওখানে এখন সিমেন্টে বাঁধানো ঘর রয়েছে, পর্যটকরা সেখানে দাঁড়িয়ে মার্কো-পলো টাইপের একটা হাসি দিয়ে ছবি তুলতে খুব গর্ববোধ করেন। অনেক যুবক-যবতী-কিশোর-কিশোরী পর্যটকের ভিড়। কিন্তু আমার মাথায় কেন জানিনা কেওকারাডং চূঁড়ার জায়গা হলো না। কেওকারাডংকে ডানে ফেলে রেখে আমি দ্রুতগতিতে সোজা ঢালু পথটা ধরে নামা শুরু করলাম। পেছন ফিরে একবার দেখলাম, আবুবকর উঠে যাচ্ছেন সিঁড়ি বেয়ে, কেওকারাডং চূড়ার বাঁধানো ঘরটায়, জিপিএস ট্র্যাক নিতে।

কিওক্রাডাং চূড়ায় বাঁধানো ঘর, আর সামনে দেখা যাচ্ছে কামরুলের (!) ল্যাট্রিন (ছবি: লেখক)
কিওক্রাডাং চূড়ায় বাঁধানো ঘর, আর সামনে দেখা যাচ্ছে কামরুলের (!) ল্যাট্রিন (ছবি: লেখক)

কেওকারাডং, বইয়ে-পত্রে, সিআইএ ফ্যাক্টবুকে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, কিন্তু অভিযাত্রীদের হিসাবে তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। মারমা ভাষায় কিও মানে পাথর, ক্রো মানে পাহাড় আর ডং মানে সবচেয়ে উঁচু— তিনে মিলিয়ে এর মূল নাম কিওক্রাডং, বা কিওক্রাডাং বা কেওক্রাডাং। সিআইএ ফ্যাক্টবুকে এর উচ্চতা লেখা ৪,০৩৫.৪৩ ফুট (১,২৩০ মিটার)। কিন্তু রাশিয়া পরিচালিত এসআরটিএম উপাত্ত অনুসারে এর উচ্চতা ৩,১৯৬ ফুট (৯৭৪ মিটার) পরিমাপ করা হয়েছে। চূড়ায় সেনাবাহিনীর লাগানো ফলকে এর উচ্চতা এসেছে ৩,১৭২ ফুট (৯৬৬.৮৩ মিটার)। আর আবুবকরের নেয়া সাম্প্রতিক রীডিং-এ এসেছে উচ্চতা ৩,১৬৯ ফুট (৯৬৫.৯১ মিটার)। “তাজিং ডং” বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত হিসেবে স্বীকৃত হলেও, অনানুষ্ঠানিকভাবে সাজ্জাদদের ন্যাচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব পরিচালিত সমীক্ষায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে দাবি করা হয় “সাকা হাফং” (বা “ত্লাংময়”)-কে (৩,৪৮৮ ফুট)।

পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম। দৌঁড়ে নামতে থাকলাম পথ। কামরুলকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঢালু রাস্তায় দৌঁড় দেয়াটা যে কী বিপদের তা আর বলা লাগে না। যদি কোনো রকমে পা প্যাঁচ খায়, তাহলে আর টাল সামলানো যাবে না, গড়িয়ে হাড়গোড় সব এক হয়ে যাবে। ঢালু পথে দৌঁড় দেয়াতে গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল। অনেকদূর পথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম। কিন্তু কামরুলকে কোত্থাও চোখে পড়ছে না। বিপদে পড়লো না তো!

এদিকে নাকিব যে কিওক্রাডাং-এর পাদদেশ থেকে আমাকে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকছে, সেটা তো আমি জানিনা। ওর ক্যামেরাটা নিয়ে চলে এসেছি। আমার নাহয় মার্কো-পলো হবার শখ জাগেনি, কিন্তু এত কাছে এসে কিওক্রাডাং চূড়া থেকে একটা ছবি না নিয়ে যাওয়াটাও রাম-বোকামী। কিন্তু নাকিবের কিছুই করার ছিল না। এতটাই দূরে ছিলাম আমি, কিছুই শুনছিলাম না। ওর মেজাজ খুব খিচড়ে গেল আমার উপর। মেজাজ খারাপের কাজই একটা করেছি বটে, তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের স্বার্থে বলি, ইচ্ছে করে করিনি, নাকিব। এই লেখার মাধ্যমে আমি নাকিবকে বলছি, ভাই, ক্ষমা করে দিস!

অনেক অনেক দূর পাড়ি দিয়ে এলাম, কামরুলের দেখা আমি কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছি কয়েকগুণ। কিওক্রাডাং পর্বত থেকে এই পথটা গিয়ে নেমেছে সোজা বগালেকে। পথ আশা করি ভুল করিনি আমি। সামনেই কোথাও আছে কামরুল। সামনের বাঁকটা ঘুরতেই ঐ যে দূরে কামরুলকে দেখা গেল। মাথাটা গামছা দিয়ে রোদ থেকে ঢেকে চরম গতিতে চলছে সে। পা চালিয়ে গিয়ে ধরলাম ওকে।

বললাম, ভাই, এতো রাগ করলে তো চলে না। টীমমেটদের সাথে ভুল বুঝাবুঝি হতেই পারে। রাগ করলে কি সমাধান হবে?

কামরুল অনুযোগ করলো, না নয়ন, আবুবকর যা বলছে এটা বেশি বেশি। রাসেলের যে অবস্থা, ও যেকোনো বিপদেও পড়তে পারতো। বিপদে পড়লে কে উদ্ধার করবে? তাছাড়া তুমিইতো দেখেছো, কোথাও কোথাও ওকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিতে হচ্ছে বেশি খাড়া ঢাল। ওর সাপোর্টেরও দরকার।

আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কামরুল অসত্য বলছে না। কামরুলের অবস্থানে কামরুল ঠিক, আবুবকরের অবস্থানে আবুবকর ঠিক। মাঝখানে, যে রাসেলকে নিয়ে এতোকিছু, সে এসবের কিছুই কি বুঝছে না? নাকি বুঝতে চাইছে না? কামরুলের রাগ হয়েছে, কিন্তু সে তা বেশিক্ষণ ধরে রাখার কোনো মানে খুঁজে পেলো না। আমরা আবার পথে ফিরে এলাম।

কিওক্রাডাং থেকে বগায় নামার পথটা এভাবেই ঢালু (ছবি: লেখক)
কিওক্রাডাং থেকে বগায় নামার পথটা এভাবেই ঢালু (ছবি: লেখক)

কামরুল এপথে আগেও গিয়েছে বগালেক। তাই ঠিক পথেই আছি আমরা। পথের ডান পাশে দূ-রে একটা পাড়া দেখা যাচ্ছে। কোন পাড়া, জানি না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং পাড়ায়। ‘দার্জিলিং’ শুনলেই ভারতের যে স্থানটার কথা মনে আসে, সেখানকার সাথে এর হয়তো কোনো মিল নেই, তবে দার্জিলিং পাড়াও কম সুন্দর নয়। বায়ে একটা স্কুলঘর রেখে যাচ্ছি, স্কুলের সাইনবোর্ডে লেখা: দার্জিলিং পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্থাপিত ৬-৭-২০১০; ৩ নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়ন, রুমা উপজেলা। সামনে গিয়ে পড়লো ২০০৬-এ প্রতিষ্ঠিত দার্জিলিং পাড়া ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, নাম: Independent Baptist Church, Darzeling। এখানেই একটা ঘরে (পান্থশালায়) ঢুকে কামরুল আর আমি নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। ঠান্ডা পানিতে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।

যারা শেঁকড়ের সাথে এখন আর যোগাযোগ রাখেন না, তাঁদের অবগতির জন্য বলি, মাটির কলসিতে রাখা পানি যথেষ্ট ঠান্ডা থাকে। তাই যারা দাপিয়ে ফ্রিজ কিনছেন, তাদেরকে পানি খাবার জন্য দুটো মাটির কলসি কেনার পরামর্শ দিব। লাভ দুটো— এক: কুমারের নব-জীবনদান; দুই: প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব হওয়া।

একসময় নাকিব এগিয়ে এলে আপেল গিয়ে জুড়লো কামরুলের সাথে। নাকিব আর আমি গল্প করে করে হাঁটছি, পিছিয়ে পড়েছি, এমন সময় পড়লাম গিয়ে দ্বিমুখী এক রাস্তায়। ডানদিকের পথটা গেছে, দেখে মনে হচ্ছে গাড়িপথ, আর বাম দিকের পথটা গেছে কাঁশবনের ভিতর দিয়ে, হাঁটাপথ। হাঁটাপথ ধরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সামনে দেখা গেল আপেল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আবার আমরা এগোতে থাকলাম। চড়াই-উৎরাই, চড়াই-উৎরাই, … পথ আর শেষ হবার নয়। একসময় আমরা গিয়ে পড়লাম এক ভাঙা ব্রিজে। সাঁকোটা কাঠের তৈরি। জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। ঝুলে আছে ভাঙা কাঠগুলো। গর্ত তৈরি করে আমাদেরকে ভূত্বক দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে যেন।

কামরুল ব্যাগ নিয়ে পার হতে ইতস্তত করলো। পরে আপেল সাঁই সাঁই করে পার হয়ে যাচ্ছে দেখে সাহস হলো। ধীরে ধীরে প্রথমে কামরুল, তারপর নাকিব, হলিউডের চলচ্চিত্রের মতো এই ভাঙা সাঁকো দিয়ে পার হলো। আমি মানুষটা একটা পাখি, সাঁই সাঁই করে পার হয়ে গেলাম বাধা ছাড়াই। তারপর আবার হাঁটা।

ঝরণার স্বচ্ছ পানিতে নাকিব অনেক কিছু দেখে, আপনিও কি? (ছবি: লেখক)
ঝরণার স্বচ্ছ পানিতে নাকিব অনেক কিছু দেখে, আপনিও কি? (ছবি: লেখক)

একপর্যায়ে কামরুল অনেকদূর একা একাই এগিয়ে গেল। নাকিব, আমি, আপেল একসাথে চলতে থাকলাম। মাঝখানে পড়লো একটা শুকনো ঝরণা। পরে কামরুলের থেকে শুনেছি, এটা চিংড়ি ঝরণা ছিল। অপূর্ব স্বচ্ছ পানিতে ভাসতে থাকা পোকাগুলোর ছবি না তুলে পারলাম না। যে ছবিটা উঠলো, সেটা নাকিবের খুব পছন্দ। ছবিটার ডান কোণে প্রথমে সে যুম করে সবাইকে দেখায়, দেখো কী স্বচ্ছ পানি! তারপর ছবির বাঁ পাশে নিয়ে গিয়ে দেখায়, দেখো, চারটা ফোঁটা দেখা যায়, এটা হলো এই পোকাটার পায়ের ছাপ। তখন সবাই খুব মজা পায়, আর তা দেখে সেও মজা পায়। পানির পৃষ্ঠটানের কারণে এসব পোকা পানিতে হেঁটে বেড়াতে পারে, একটু সাবান দিয়ে দিলেই পৃষ্ঠটান কমে আসে, তখন বিপদে পড়ে যায় পোকাগুলো। কিন্তু সে পরীক্ষার কোনোই ইচ্ছা আমার এখন নেই। আরো সামনে এগোলাম আমরা। ক্লান্ত নাকিব এবার সিরিয়াস একটা বিশ্রাম চায়। তাকে মোটিভেট করেও আর উঠানো গেলো না। …আর তখনই, পিছন থেকে আপেল বাবাজি নিয়ে এলো একটা পেঁপে। আমি জানি, যারা এর স্বাদ জানেন, তাদের জিবে জল এসে যাচ্ছে। স্বাদ নামক জিনিসটা আপেলের মুখে আছে বোঝা গেল, কচকচে পাঁকা পেঁপে এক বাগানের গাছ থেকে (চুরি করে!) কেটে নিয়ে এসেছে। আমি এতো নীতিবান, কিন্তু ঐ সময় নীতির কথা মনে ছিল না, রাস্তা সংলগ্ন সেই সম্পদ যেনবা সব পথিকেরই সম্পদ— এমন একটা ভাব নিয়ে সঙ্গী হলাম পেঁপে ভক্ষণে। আপেলও যেনবা বুঝলো আমাদের মতো শহুরে ফরমালিনদের প্রকৃতি-ক্ষুধা। নিজে খুব অল্প খেয়ে বেশিরভাগই আমাদেরকে খেতে দিল সে। ঐ স্বাদ যে কী, তা আর বলতে চাই না আমি। তবে এতটুকু বলি, এটা ‘দিল্লি কা লাড্ডু’ না যে, খেলে পস্তাবেন!!

পাগলু পাঁকা পেঁপে খায়— আপেলকে ওর টিশার্টের লেখা দেখে নাকিব ডাকে ‘পাগলু’ (ছবি: লেখক)
পাগলু পাঁকা পেঁপে খায়— আপেলকে ওর টিশার্টের লেখা দেখে নাকিব ডাকে ‘পাগলু’ (ছবি: লেখক)

কামরুলের জন্য নিতে চাইলে আপেল বাধা দিল, বললো বগা লেকে পাবে উনি। কচকচে পাঁকা পেঁপে সাবাড় করে আমরা আবার ঢাল ধরে নামতে থাকলাম। আর তখনই… তখনই দূর থেকে চোখে এলো লেকটা— দ্যা মাঈটি বগা লেক। কক্সবাজারের কলাতলি ঢোকার মুখ থেকে প্রথম যখন সমুদ্র দেখেছিলাম, সেদিনকার অনুভূতির মতোই একটা অনুভূতি হলো আমার। অপূর্ব নীল হ্রদটা যেন কী এক অমোঘ আকর্ষণে আমাদের ডাকছে কাছে। কিভাবে উপেক্ষা করি বলুন?

কিওক্রাডাং থেকে বগায় নামার পথে দূর থেকে বগা (ছবি: লেখক)
কিওক্রাডাং থেকে বগায় নামার পথে দূর থেকে বগা (ছবি: লেখক)

এগিয়ে গেলাম ছোট্ট বগালেক পাড়ায়। এই নামটা আনঅফিশিয়ালি সবাই বলে আরকি। রাসেল, আবুবকর আর বিকাশ রয়ে গেছে পিছনে। তারা আসা অবধি আমরা বগার সৌন্দর্য্য দেখলাম খানিকক্ষণ, আপেল নিয়ে গেল আমাদেরকে একটা রেস্টুরেন্টে। এটা ওদের ট্যুর গাইড এসোসিয়েশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ একটা রেস্টুরেন্ট। বেলা তখন প্রায় দেড়টা। কামরুল, রেস্টুরেন্টের লোককে পাঁকা পেঁপে কেটে দিতে বলে সময়ের হিসাব করতে বসলো। এই মুহূর্তে রওয়ানা দিয়ে এখান থেকে রুমা বাজারে যেতে লাগবে কমপক্ষে আরো দুই-আড়াই ঘন্টা, মানে সাড়ে তিনটা। অথচ শেষ নৌকা, রুমা থেকে ছাড়েই সাড়ে তিনটায়। আবুবকররা এখনও পৌঁছেনি বগায়। কোনোভাবেই আজকে রুমা ছাড়া সম্ভব না। গিয়ে শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে রুমা বাজারের হোটেলে। কাটাতে হবে নিরস একটা সময়। আর পরদিন ঐ বাস ধরতে ধরতে হবে বিকেল। তাহলে অযথা তাড়াহুড়া না করে থেকে যাইনা আজ রাত বগাতেই?

কামরুলের কথা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিল নাকিব। সেও রুমায় রাত কাটাতে চায় না। বগায় থাকলে দিনটা যাবেও ভালো। কী লাভ আগে গিয়ে? আমিও সম্মত হলাম। আমাদের সামনে ফুলের মতো করে কেটে পেঁপে সার্ভ করা হলো। কিন্তু আপেল তা খেতে অস্বীকৃতি জানালো, কেননা এগুলো কচকচে পাঁকা না, মজে যাওয়া পাঁকা। নরম পেঁপে সে পছন্দ করে না। মুখে দিয়ে মধুর স্বাদ পেয়েও আমাদেরও মুখে লেগে থাকলো ঐ কচকচে পাঁকা পেঁপেটাই।

এমন সময় একটা চান্দের গাড়ির পিছনে ঝুলে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন আবুবকর আর রাসেল। ওদিকে বিকাশ বেচারা এই খবর জানে না, মাঝখানে পঁচে মরছে। পরে সিয়ামদি’র কটেজে ফোন করে আবুবকরের পৌঁছার খবর পেয়ে সে রওয়ানা করেছে মাঝপথ থেকে। আবুবকর নেমে গিয়ে রাসেলকে ঐ গাড়িতেই পাঠিয়ে দিলেন রুমা বাজার। আমরা থেকে যেতে চাইলে আবুবকর তাঁর ব্যাগটাও পাঠিয়ে দিলেন গাড়িতে করে। তারপর বসলো আমাদের বৈঠক। আমাদের থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে এবং কামরুলের দেয়া সময়ের হিসাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না আবুবকর। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত জানালেন, ঠিক আছে, আপনারা থাকেন, আমি রুমায় চলে যাবো, যাতে কালকে ভোরেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারি। আবুবকরের মেজাজ দুটো কারণে খারাপ: এক, সম্পূর্ণ ট্র্যাক শেষ করা হয়নি; দুই, এখানে এসে দলটা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি সেই রাগ ঠিক ঝাড়লেন না, তবে ইঙ্গিতে বলে ফেললেন, আমাদের জন্যই ট্র্যাকটা সম্পূর্ণ করা গেল না। কথাটা সত্যি, আমরা যদি না জুড়তাম, তাহলে আবুবকর আর কামরুল ট্র্যাকটা সম্পূর্ণ করেই ফিরতেন। কিন্তু আমাদের জুড়ে যাওয়াটাও আসলে দৈবাৎ নয়। উভয়পক্ষেরই কিছু দোষ ছিল, হয়তো এখনও আছে— সেটা আমাদের শ্রদ্ধা ভরে মেনে নেয়াই উচিত। কিন্তু যেখানে ট্র্যাক শেষ হলো না, সেখানে কেনইবা আজকের রাতটাকে রুমায় গিয়ে পানশে করতে হবে, তা আসলে আমাদের মাথায় ঠিক কাজ করছে না। তবু আমরা বন্ধু, পাহাড়ে-জঙ্গলে, বাংলাদেশে, বিশ্বের মানচিত্রে সর্বত্র, সর্বাবস্থায় আমরা বন্ধুই, আমরা ট্রেকার। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে দেশের জন্য তো দূরের কথা, নিজেদের জন্যও কিছু করা যায় না। জড়িয়ে ধরে আবুবকরকে বিদায় জানালাম। সবাই আমরা হাসিমুখ।

শেষ বেলায় আমরা আমাদের হিসাব-নিকাশগুলো চুকিয়ে নিলাম। আবুবকর ভাই একটা কাগজে হিসাব লিখে ভাগাভাগি করে দিলে, আমরা সবাই যার যার হিসাব মিটিয়ে নিলাম। রাসেলের সাথে যেহেতু রুমায় গিয়ে দেখা হবে, তাই ওরটা ওখানেই ক্লিয়ার করবেন তিনি। …আমি, নাকিব, কামরুল যেখানে ভেবেছিলাম আপেল আমাদের সাথে হয়তো থেকে যাবে, সেখানে দেখা গেল, বিকাশ থাকবে আমাদের সাথে, আর আপেল এখন আবুবকরের সাথে ঝিরিপথে হেঁটে রুমায় চলে যাবে। বিদায় নিলাম আপেলের থেকে।

বগা লেক নামের এই হ্রদটির প্রকৃত নাম বগাকাইন হ্রদ, শুধু একটা মিঠা পানির হ্রদই না, বরং অনেক উঁচুতে অবস্থিত বলেই এর এত নামডাক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২,০০০ ফুট (৬০৯.৬ মিটার)। আবুবকর ভাইয়ের রিডিং-এ এসেছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,২২৭ ফুট উঁচু। বগার সামনে একটা ফলক লাগানো, তাতে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটাই নেই। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুসারে এখানে এক বগা (ড্রাগন) থাকতো গুহার ভিতর, সেখানে কেউ যেত না। একবার সেই নিষেধ অমান্য করলে বগা রেগে গিয়ে প্রচন্ড অগ্নি-গর্জন করে আর তা থেকেই উৎপত্তি হয় এই হ্রদের (এই গল্পের অনেক ভ্যারিয়েশন পাওয়া যায়)। গবেষকগণ ধারণা করেন, এটি হয় কোনো আগ্নেয়গিরির মৃত জ্বালামুখ, অথবা মহাকাশ থেকে পড়া উল্কা-সৃষ্ঠ গর্ত। বছরের অধিকাংশ সময় এর পানি প্রায় একই রকম থাকে। সাকিব-সাজ্জাদরা বছর-দশেক আগে বগা ঘুরে এসে তাদের ধারণা জানিয়েছিল, সম্ভবত এর তলাটা বাটি বা বোল আকৃতির, এবং পাথুরে। যে বিষয়টা রহস্যমন্ডিত, তা হলো বছরের এপ্রিল-মে মাসে এর পানির রঙ বদলে যায়।

আমরা আর দেরি করতে চাইলাম না, বগায় আছি, আর গোসল করবো না, তা কী করে হয়? সেই লাবাখুম-এ সাঁতার কেটেছিলাম, ঐ পর্যন্তই। বিকাশ দেখলাম, যে রেস্টুরেন্টে বসেছি, তার ঠিক উল্টো দিকের একটা বাঁশের ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলো। ভিতরে গিয়ে দেখলাম, অনেকগুলো খাট, এটা একটা বোর্ডিং। মানে, অনেকের সাথে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভালো, এখানে নেই আর-কেউ, আর কেউ আসার সম্ভাবনাও নেই আজকে, তাই পুরোটা জুড়ে আমরা-আমরাই। এক্কেবারে বগার গা ঘেঁষে বোর্ডিংটা। জানালা দিয়ে লাফ দিলেই বগার পানিতে পড়া যাবে আরকি। এগুলো হলো এখন প্যাকেজ সিস্টেমের একটা অংশ— অন্তত সেরকমটাই মনে হলো। ওদের ইয়াং বম এসোসিয়েশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ এরা, আর এটা তাদেরই একটা বোর্ডিং। (আপনাদের হয়তো বলতে ভুলে গেছি, আপেল আর বিকাশ দুজনেই এই সংগঠনের গাইড)

ব্যাগ-ট্যাগ সব রেখে গোসলের জিনিসপত্র নিয়ে চললাম বগার ঘাটে। বগায় গোসল করতে নেমে আবিষ্কার করলাম, শীতের সময় বলে পানির মধ্যে প্রচুর শ্যাওলা। গোসলটা আর মনমতো করা হলো না। কারণ বেশিক্ষণ পানির মধ্যে থাকলে এই দ্রবীভূত শ্যাওলা শরীরে, কাপড়ে লেগে আরো ময়লা করে দিবে আমাদেরকে। তাছাড়া বেশিদূর সাঁতারও কাটা গেল না, পানি তুলনামূলক কম থাকায় নিচের জলজ-আগাছার বাগান লাগে গায়ে। ওগুলোতে প্যাঁচিয়ে গেলে আবার মহাবিপদ হয়ে যাবে।

গোসল শেষে নামায-পর্ব শেষ করে খাবার খেলাম আমরা ঐ রেস্টুরেন্টে। মেনু কী ছিল, ভুলে গেছি; কত খরচ হয়েছিল, তাও ভুলে গেছি— ক্ষিধার ঠ্যালায়ই কিনা, কে জানে। খাওয়া-দাওয়া শেষে চললাম বগা লেক আর্মি ক্যাম্পে। আমরা যে আজকে থাকবো, তার রিপোর্ট করতে হবে। যাবার পথে একটা মহৎ কাজ করতে গেলাম। বগায় আসার আগে ফিনল্যান্ড থেকে সাজ্জাদ ফোন করে বলেছিল রবার্টের নতুন কটেজের ছবিটা যেন ওর জন্য হলেও তুলে নিয়ে যাই। বিকাশের দেখিয়ে দেয়া একটা কড়ি কাঠ বর্গা কাঠওয়ালা নির্মানাধীন ঘরের ছবি খুব ঘটা করে তুললাম। ঢাকায় এনে ফেসবুকের মাধ্যমে সাজ্জাদকে পাঠিয়ে যখন পরম তৃপ্তি অনুভব করছিলাম, তখন সাজ্জাদ একটা টাশকি খাওয়া কমেন্ট করলো, তোমাদের গাইড কচু চেনে! দেখে তো আমিও টাশকি। এটা নাকি সিয়াম-লারাম-এর আত্মীয় রবার্টের কটেজ, যে থাকে দার্জিলিং পাড়ায়। আসল রবার্টের কটেজটার ছবি আমরা তুলিইনি। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে বিকাশকে হত্যা করতে মনে চায় পরে আমার।

বগা সেনা ক্যাম্পে একটা টেবিলের ওপাশে একজন সেনা সদস্য বসা, সামনে একটা মোটা টালি খাতা। কামরুল এ্যাপ্রোচ করলো। বললো, আমরা এখানে থেকে গেছি, আর একজন সদস্যের পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, তাই ওকে নিয়ে বাকিরা চলে গেছে রুমায়। অনুমতিপত্রের কাগজটা ওদের সাথে রয়ে গেছে, ওদের ব্যাগে। ঐ সেনা, বিকাশকে একটু জেরা করলেন, কিন্তু কামরুল ট্যাকল দিয়ে দিল। শেষে উনি বললেন, বাদ দেন, আপনাদের আর নাম এন্ট্রি করার দরকার নেই (কারণ রুমাতে তো ওরা এন্ট্রি করবেই, আমাদের ব্যাপারটা মাথায় থাকলো আরকি)। কামরুল আবার গল্প জমাতে ওস্তাদ। ওর পরনের প্যান্টটা সেনা পোষাকের সাথে যথেষ্টই মিলে যায়, ক্যামোফ্লেজের জন্য দরকার। সেটা দেখিয়ে বেশ গল্প জমিয়ে ফেললো, আর নিজের পরিচয় দিল পাখির আলোকচিত্রী হিসেবে। (অফ দ্যা রেকর্ড বলছি, কামরুল আসলেই পাখির ছবি তুলে, মন্দ তুলে না।)

বগাকাইন হ্রদের সামনে দুই সাধু! (ছবি: লেখক)
বগাকাইন হ্রদের সামনে দুই সাধু! (ছবি: লেখক)

ব্যস, এবার আমাদের নিজস্ব সময়। সেনা ক্যাম্পের সামনে একটা বেঞ্চ পাতা। ওটাতে গিয়ে বসলাম আমরা। ক্যামেরা চলছে পটাপট। তখনই পুরোন বুদ্ধিটা চাগিয়ে উঠলো মাথায়। কামরুলকে বললাম, এক স্ন্যাপে পুরো বগাকে ধরা না গেলে এক কাজ করা যায়, অনেকগুলো ছবি তুলে জোড়া লাগিয়ে একটা প্যানোরামা বানিয়ে ফেলা যায়। কামরুল কিছুটা সন্দিঘ্ন হলেও আমি সেই উদ্যোগটা দৃঢ়ভাবে নিলাম আর ফলাফল? —সে আপনারাই বিচার করুন (ছবিটা উইকিপিডিয়ার জন্য ক্রিয়েটিভ কমন্স শেয়ার এ্যালাইক লাইসেন্সের অধীনে আপলোড করা হয়েছে^)।

পড়ন্ত বিকেলের রোদে বগাকাইন হ্রদের প্যনোরামা (ছবি ও এডিটিং: লেখক)
পড়ন্ত বিকেলের রোদে বগাকাইন হ্রদের প্যনোরামা (ছবি ও এডিটিং: লেখক)

রাতটা ভালোই কাটলো বগার সামনে। আকাশে লক্ষ তারার মেলা। উরসা মেজর দেখে দিক নির্ণয় আমার প্রিয় একটা শখ। আকাশে তাকিয়ে আমি যখন উল্কাপাত (তারা খসা) দেখছি, নাকিব তখন তার সদ্যপ্রয়াত বাবার স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়ে উপলব্ধি করে বাবা’র কোনো বিকল্প নেই এই পৃথিবীতে। …এদিকে বিকাশ কোত্থেকে একটা দুই তার ছেঁড়া গিটার নিয়ে এসেছে, আর বিডিগিটার ওয়েবসাইটের কর্ণধার নাকিব তার গিটারবাদনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটাতেই সুর তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কামরুল কোথায়?

কামরুল ওদিকে রেস্টুরেন্টের পিছন-ঘরে পেয়ে গেছে গাইড সুমন দত্তকে (বিকাশের বড় ভাই, যে বিকাশকে ঠিক করে দিয়েছিল: ২য় কিস্তি দ্রষ্টব্য)। ব্যস, পাহাড়ে-পর্বতে-ঝরণায়-ঝিরিতে কোথায় কী আছে, তার খোঁজ-খবর নিতে লেগেছে। তারপর বেরিয়ে এসে বাইরে পেয়েছে কয়েকজন যুবককে, তাদেরকে বেশ রসিয়ে গল্প করলো কিভাবে কঠোর পরিশ্রম করে একটা অফ-ট্র্যাকে ট্যুর দিয়েছে সে এবং তার দল… সেই বর্ণনা শুনে বাকিরা তখন কামরুলকে মহান অভিযাত্রী ভাবছে হয়তো —কামরুল কি তবে গল্পবাজ? বানোয়াট গল্প ফাঁদে?

না, বরং কামরুল গাল্পিক। সত্যটাকেই মধুর করে বলতে জানে। রসিয়ে আকর্ষণ আনতে জানে। এটা তার গল্পবাজি না, বরং তার ট্রেকিং-এর প্রতি আকর্ষণ আর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।

রাতে ঐ রেস্টুরেন্টে খেয়ে-দেয়ে নিজেদের হিসাব-নিকাশ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম এগারোটা নাগাদ। দেরি হয়ে গেছে। তবু বগার ঠান্ডা মিষ্টি হাওয়া এসে জানালা গলে ভিতরে ঢুকছে, বোর্ডিং-এর সবগুলো কম্বল আমাদের জন্য বরাদ্দ। বেশ জম্পেশ ঘুম হলো একখান। তবে পেইনকিলার ঠিকই খেয়ে নিয়েছি, কালকেও পথ চলতে হবে, ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২; ভোর ৫টা

অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভাঙলো মোবাইলের অ্যালার্মে। উঠে গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লাম। রাতেই বোর্ডিং-এর পাওনা মিটিয়ে দিয়েছি। আর্মি ক্যাম্পের সামনের রাস্তা ধরে একটু চড়াই উঠেই শেষবারের মতো উপর থেকে দেখে নিলাম বগাকে। তারপর আবার ঢালু পথে নামার পালা। তাকিয়ে দেখি, আকাশের মাঝে তিনটা মূর্তি, অপূর্ব সে দৃশ্য।

আকাশে হেলান দেয়া তিন রকস্টার, বাঁ থেকে বিকাশ, কামরুল, নাকিব (ছবি: লেখক)
আকাশে হেলান দেয়া তিন রকস্টার, বাঁ থেকে বিকাশ, কামরুল, নাকিব (ছবি: লেখক)

তারপর ধপধপ করে নামা। বেশ দৃঢ়তার সাথেই নামছি আমরা। নাকিবও দেখলাম বেশ শক্তিমত্তার সাথে নামছে। দ্রুতই আমরা উৎরাই পেরিয়ে বগাকাইন হ্রদের উচ্চতা থেকে নিচে নেমে এলাম। এটা কিন্তু সমতল না, এটাও সমতল থেকে উঁচুতে। এখানে তিন রাস্তার সমাহার, আর এখানেই আসে রুমার চান্দের গাড়ি। আজকে বাজার দিন, তাই গাড়ি আসবে অনেক ভোরেই। কিন্তু তখনও পৌঁছেনি গাড়ি। আমরা ঠিক করলাম নাস্তাটা সেরে নেয়া যায়।

সেখানেই এক পাহাড়ী পরিবার চুলায় কী যেন রান্না করছিলেন, আমরা অনুমতি নিয়ে তাদের থেকে একটা ডেকচি নিলাম। তারপর নিজেদের সাথে থাকা অব্যবহৃত নুডল্‌সগুলো একত্র করে অব্যবহৃত পেঁয়াজগুলো বের করলাম। কামরুলের আনা ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটা হলো, তারপর নুডল্‌স রান্না করা হলো। কিন্তু কিসে রেখে খাওয়া হবে? পরামর্শ দিলাম: প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক হওয়াই সবচেয়ে সুন্দর— কলাপাতা। বিকাশ গিয়ে কলাপাতা কেটে নিয়ে এলো। তা কয়েক ভাগ করে তাতে নুডল্‌স ভাগ করা হলো, আর ডেকচিতে ঐ পরিবারের জন্যও কিছু রেখে দেয়া হলো। …পেঁয়াজ, নুডল্‌স আর টেস্টিং সল্ট— কিন্তু আহামরি স্বাদ!

কলাপাতায় সকালের নাস্তা - কী আর, ম্যাগি নুরুল! (ছবি: নাকিব)
কলাপাতায় সকালের নাস্তা – কী আর, ম্যাগি নুরুল! (ছবি: নাকিব)

একটা চান্দের গাড়ি এলো। ইতোমধ্যে বগায় থাকা আরো দুটো দল নেমে এসেছে নিচে। গাড়ি আসতেই জুৎসই জায়গার জন্য যখন তাড়াহুড়া করছিলাম সব্বাই, তখন কে যেন জোরে বললো, আগে পাহাড়িদের অধিকার।

ব্যস, সেই নিয়ম মেনে আমরাও জায়গা নিলাম। কামরুল আর নাকিব চলে গেলো ড্রাইভারের পাশে সামনে। বিকাশ উঠলো উপরে আর আমি এক্কেবারে পিছনে, সীটে। চান্দের গাড়ি— আমি সবসময়ই বলি, নাম শুনে অনেক আকর্ষণীয় কিছু মনে হলেও পৃথিবীর নিকৃষ্টতম একটা গাড়ি এই চান্দের গাড়ি। ঠাসাঠাসি করে মানুষ নেয়। উপরে বসে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন এক কলিগ, কিন্তু ধুলার কারণে আর একটা হাত ভাঙা বলে ঝুঁকিটা নিলাম না।

গাড়ি এঁকে-বেঁকে চলছে। কখনও রাস্তার পাশের ঝোঁপ ঘাঢ়ের মধ্যে ঠাশ করে থাপ্পড় দেয়। আরো কয়েকজনকেও দিয়েছে। তাই জ্যাকেটের ক্যাপটা মাথায় পরে নিলাম। এরপর শুরু হলো ধুলার অত্যাচার। চোখ বন্ধ না করলে নিশ্চিত অন্ধ হয়ে যেতে হবে। একবার ধুলার জগৎ পার হবার পর শরীরটা হলুদ হয়ে যায় ধুলায়। এভাবে এলাম আমরা চরম স্থানে, এক্কেবারে খাড়া ঢাল, গাড়িকে চারটা চাকা চালিয়ে একটানে উপরে উঠে যেতে হবে। গুম্‌মমমমমম করে ইঞ্জিনের উপর অত্যাচার করে গাড়িটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে, আমি শ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, ফিঙ্গার ক্রস্‌ড। মাঝপথে যদি স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হ্যান্ডব্রেক দিয়েও রক্ষা হবে না, শ্রেফ পেছন দিকে উল্টে যাবে। কে যেন বললো, এরকম একটা দুর্ঘটনা নাকি এদিকে ঘটেওছিল, উঠার মুহূর্তে কার্বুরেটরের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, আর…

যাক, অবশেষে চড়াই উঠতে পারলো। উঠেই ব্রেক কষে বনেট খুলে কার্বুরেটরে পানি ঢালা। অতঃপর আবার যাত্রা। রাস্তার যা অবস্থা, আর যে গাড়িখানাও যে আহামরি— তা নাহলে যেসব দৃশ্য ফেলে যাচ্ছিলাম, এগুলো পয়সা দিলেও পাওয়া যাবে না।

এভাবে একসময় যখন আমরা রুমা বাজারের ব্রিজে গিয়ে থামলাম (জনপ্রতি ৳৮০), তখন কালো পোষাকগুলো সব হলুদ হয়ে গেছে। নেমে পোষাক ঝাড়তে ঝাড়তে একসময় পৌঁছলাম হোটেল হিলটনে। সেখানে, আমরা ভেবেছিলাম, রাসেলকে তৈরিই পাবো, কিন্তু রাসেল… বেশ বিরক্ত হলাম আমরা। প্রতিটা মুহূর্তে যেখানে হিসাবের সেখানে এভাবে সময়ানুগ না চললে খুব খারাপ অবস্থা হয়। ওকে সময় দিয়ে আমরা চলে গেলাম মামুন ভাইয়ের হোটেলে। সেখান থেকে নিজেদের ব্যাগ বুঝে নিলাম। তারপর ব্যাগ গোছাতে গোছাতে গরম এক কাপ চা দিতে বললাম। বিকাশ গিয়ে সেনা ক্যাম্পে রিপোর্ট করবে।

চা খেয়ে বিকাশ আর আপেলের থেকে আবার বিদায় নিয়ে ফের রওয়ানা ঘাটে। ফিরতি পথ ধরতে হবে। সবাই যখন ঘাটে নামছে, আমি তখন মোবাইলে আরেকটা জোড়াতালি দেয়া প্যানোরামার প্রস্তুতি নিচ্ছি; ফলাফল কী, সেটা দেখা যাক—

রুমা বাজার ঘাটের প্যানোরামা (ছবি ও এডিটিং: লেখক)
রুমা বাজার ঘাটের প্যানোরামা (ছবি ও এডিটিং: লেখক)

ঘাটের নৌকার সময়-সূচী অনুযায়ী এই মুহূর্তে কোনো নৌকা নেই। তাই অপেক্ষা। একটা নৌকায় উঠে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমরা। আমাদের সাথে বগা থেকে আসা একটা দল নৌকায় যোগ দিল। সেই নৌকা ছাড়লে আমি গিয়ে বসলাম দুপাশে পা ছড়িয়ে, গলুইতে। পানিতে পা ভিজিয়ে হাওরের ছেলে হাওরের স্বাদ পেতে লাগলাম (যদিও আমি নিজেও এখনও হাওরে যাইনি)।

অপূর্ব সব দৃশ্য, কামরুল, রাসেল, টপাটপ ক্লিক করে চলেছে। আপনাদের হয়তো একটা কথা বলা হয়নি, রাসেলের আব্বা সরকারি একজন কর্মকর্তা ছিলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সেকারণে রাসেলের ছোটবেলা কেটেছে এই বান্দরবানে। আর তাই রাসেল, বান্দরবানে এসে বেশ নস্টালজিক হয়ে গেছে। সাঙ্গুর যৌবনের বর্ণনা দেয়, লুক্কায়িত ঝরণার বর্ণনা দেয়, পাহাড়িদের সাথে বিবাদের বর্ণনা দেয়, পাহাড়িদের সহায়তার বর্ণনা দেয়। তাই এখন যখন হঠাৎ দূর থেকে ধ্রিম ধ্রিম কিসের আওয়াজ আসছিল, তখন আমি বললাম, গ্যারিসনে সম্ভবত আর্মিরা বোমবার্ড করছে; রাসেল বললো, হুহুঁ এতো কাছে বোমবার্ডমেন্ট হলে আরো জোরে আওয়াজ আসতো।

গ্যারিসন ব্রিজের নিচে নৌকায় আমি, তাকিয়ে কোনো দূর গহীনে (ছবি: রাসেল)
গ্যারিসন ব্রিজের নিচে নৌকায় আমি, তাকিয়ে কোনো দূর গহীনে (ছবি: রাসেল)

আমাদের নৌকা গ্যারিসনের নির্মীয়মান ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হলো, রাসেল আরেকটা স্ন্যাপ নিল। এদিকে দেখা গেল নদীতে সারি বেঁধে গাছের লগ-এর বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। এগুলো এভাবে একসাথে জোড়া দিয়ে সপ্তাহ খানেক ধরে এভাবে পানির মধ্যে দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বান্দরবান। অবশ্য যারাই দেখেছেন তারা বলেছেন, বাঁশের বার্জগুলো হয় আরো দীর্ঘ।

আমাদের নৌকা কাইক্ষ্যংঝিরি ঘাটে গিয়ে লাগলে (জনপ্রতি ৳৪০) পটাপট আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। তারপর কামরুল দ্রুত গিয়ে বাসের টিকেট করলো (জনপ্রতি ৳৮০)। টিকিট কাউন্টার আমাদের সাথে একটু বাটপারি করে ভালো কিছু সীট থাকাসত্ত্বেয় রোদের মধ্যে ড্রাইভারের পাশের কিছু সীট দিলো। কিছু খেয়েদেয়ে বাসে চড়লাম। আর দীর্ঘ আড়াই ঘন্টার এই বাসযাত্রার অর্ধেকটাই কাটলো ঢলে ঢলে পড়ে যাওয়ার মধ্যে। আর তার সাথে চরম বিরক্তি তৈরি করলো সামনের এক পাহাড়ী মহিলার মুহূর্মুহূ বমির ওয়াক্‌ ওয়াক্‌

অবশেষে দুপুর আড়াইটা নাগাদ রুমা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছলাম আর তারপর ইযিবাইক নিয়ে চললাম বাসস্ট্যান্ডে। সৌদিয়ার টিকিট কেটে অবশেষে শান্তি (জনপ্রতি ৳৫৫০)। বাস ছাড়বে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায়। ততক্ষণ বান্দরবান সদরে থাকতে হবে।

আমাদের যাত্রার আকর্ষণ হয়তো এখানে শেষ, কিন্তু কিভাবে আমাদের, ব্রুস লী’র সাথে দেখা হয়ে গেল, সেটা না বলে তো লেখা শেষ করা যায় না! …নামায শেষ করে কামরুল নিয়ে গেলো ওর পেট্রোল-পাম্প মালিক এক বন্ধুর সাথে দেখা করাতে। সেখান থেকে বান্দরবানের একটা হোটেলে পেটপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে বেশ তৃপ্ত হলাম (চারজনে ৳৩০০)। এদিকে একটা দোকান থেকে মোবাইলটা চার্জ করে নিয়ে যেই অন করেছি, ওমনি অফিস থেকে ম্যাসেজ এসে হাজির। ম্যাসেজ পড়তে না পড়তেই ফোন। কানে তুলে সত্য কথাই বললাম, রাসেল ভাইয়ের পায়ে জখম হয়েছে, আমরা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম, যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। অফিস সমবেদনা জানালো। বাসাকেও শান্ত করে দিলাম ফোন করে।

কিভাবে বাকি সময়টা কাটানো যায়? রাসেল কখনও বৌদ্ধ ধাতু জাদি যায়নি, কামরুলও যায়নি। তাই ওখানে যাওয়া মনস্থ করলাম। একটা মারুতি ইযিবাইক ঠিক করে চললাম সেখানে। ওখানে গিয়ে দেখি টিকিটের ব্যবস্থা (জনপ্রতি ৳১০) করায় অনেকেই অনুযোগ করছে। তার উপর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি পরে ঢোকা যাবে না— ইত্যাদি বিধিনিষেধে অনেকেরই মনোরথ ব্যর্থ হতে দেখলাম। আমি যেহেতু দুবার দেখেছি, তাই ভিতরে গেলাম না, ওরা তিনজন টিকেট কেটে ভিতরে গেল।

এদিকে আমি তাকিয়ে থাকলাম একজনের দিকে, অবাক বিষ্ময়ে, অপলক চোখে… ধুত্তরি! শুধু কি নারীর দিকেই তাকানো যায়? …আমি তাকিয়ে ছিলাম ব্রুস লী’র দিকে। ব্রুস লী কী সুন্দর করে হাসছে, সঙ্গীদের সাথে কথা বলছে, টিকেট বিক্রী করছে…

কামরুলরা যখন বেরিয়ে এলো, আমি ঐ কিশোরকে দেখিয়ে বললাম, কামরুল বলতো কার মতো দেখতে? কামরুল কোনো ইনটেনসিভ ছাড়াই এককথায় বললো, ব্রুস লী। …বললাম, ভাই, নাকিবের ক্যামেরায় একটা ছবির জায়গাও নাই, তুই ওর ছবি তোল। কামরুল তখন দূর থেকেই অপূর্ব একটা ছবি তুললো তার।

একসময় আমরা আবিষ্কার করলাম, পুকুর কিয়াং আর জাদি বৃক্ষ দেখে ফিরে কিভাবে যেন আমরা ব্রুস লী’র সাথে কথা বলছি। ব্রুস লী আদো বাংলায় খুব নম্র গলায় বুঝিয়ে বলছে কেন এই টিকেটের ব্যবস্থা, কেননা তাদেরকে এর দেখভাল করতে হয় আর তার একটা খরচ আছে। নাকিবের মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা বৌদ্ধদের কিভাবে সৎকার করা হয়? সে শুনেছে খাড়া গর্ত করে লাশ খাড়া ঢুকিয়ে দেয়া হয়। (এই প্রশ্নটা আমাদের মনে সাড়া জাগিয়েছিল সেই ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের অতর্কিত বান্দরবান ভ্রমণে)

শুনে তো আমাদের ব্রুস লী’র সে কী হাসি! আদো বাংলায় বললো, এটা সোত্‌তি নয়। বৌদ্ধদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাউকে পোড়ানো হয়, কাউকে কবর দেয়া হয়। আর কেউ যদি মৃত্যুর আগে সৎকার পদ্ধতির কথা বলে যেতে না পারেন, তখন ভিক্ষু সেটা ঠিক করে দেন কিভাবে সৎকার হবে। আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন দোতলা দিয়ে গেরুয়া চীবর পরে একজন ভিক্ষু হেঁটে গিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। ব্রুস লী আমাদেরকে তাঁর পরিচয় মুখ ভরে দিলো, ইনি এই জাদি’র প্রতিষ্ঠাতা উপঞা জোত মহাথের (পূর্বনাম: উপহ্লা মং)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাশ করে জ্যেষ্ঠ সহকারি জজ ছিলেন, কিন্তু ধর্মের টানে সংসার-ত্যাগী হয়েছেন। তিনি খুবই ভালো একজন মানুষ— বারবার এমন কথাই বলছিল আমাদের ব্রুস লী। ব্রুস লী-কে আমি বৌদ্ধধর্মের হীনজানি আর মহাজানী মতবাদের ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম, সে তার উত্তর জানেনা বলে বুঝলাম।

কিন্তু কে এই ব্রুস লী? ব্রুস লী এখানকার একজন ছাত্র, স্থানীয় ছেলে, মারমা উপজাতির একজন। আসলে ওর নাম লা-হাই সিং মারমা। তার নামটা আমি ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারলাম বলে সে যে কী খুশি! তাকে তবু বলিনি তার সাথে ব্রুস লী’র এই সাযুজ্যের কথা। দেখুন তো আমি মিথ্যা বলছি কিনা…

বৌদ্ধ ধাতু জাদি’র ব্রুস লী (ছবি: কামরুল)
বৌদ্ধ ধাতু জাদি’র ব্রুস লী (ছবি: কামরুল)

লা-হাই সিং মারমা-কে হাসতে রেখে আমরা ফিরে এলাম বান্দরবান সদর। এখানে রাসেল তার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা অনুসারে আমাদেরকে প্রস্তাব করলো বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের উন্মুক্ত রেস্টুরেন্টে বসার জন্য— নাম: অনির্বাণ তিরিশ ক্যান্টিন। ওখানে বসলাম। এবং সস্তা কিন্তু মুখরোচক খাবারগুলো একটার পর একটা সাবাড় করতে থাকলাম। আসর, মাগরিব পড়লাম ওখানেই। আসর-মাগরিব পেরিয়ে গেলেও আমরা বিভিন্ন ধরণের খাবার খাচ্ছি সেখানে। শেষটায় আমরা অত্যন্ত তুলতুলে এবং মুখরোচক বসনিয়া রুটি পার্সেল করে নিয়ে নিলাম। এবং অবশেষে উঠলাম। ৳২৭০ [টাকা] দিয়ে তিনজনে রীতিমতো আহামরি খাবার খেয়ে ফেলেছি।

ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলাম বাসের দিকে। যাবার সময় দৃষ্টি গেল বামদিকের বান্দরবান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে। কাল ভাষা শহীদ দিবস। তাই আলোকসজ্জাসহ ফুলেল প্রস্তুতি সেখানে। কিন্তু সে দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হবে না। এগোলাম সৌদিয়া’র কাউন্টারে। ব্যাগ রেখে গিয়েছিলাম। সৌদিয়া’র বাস চড়ে যখন আমরা চট্টগ্রাম ছাড়ছি, তখন রাত বারোটা এক মিনিটে শত শত মানুষ ঢাকায় শ্রদ্ধা জানাতে জড়ো হয়েছে শহীদ বেদীতে।

আর, আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেই সব পরিশ্রমী পাহাড়ীদের, যাদের সরলতা আজও পাহাড়ে আছে বলেই পাহাড় আছে, আছে জঙ্গল। মানুষ যেন তাদের মতোই সরল হয়, তাদের মতোই হয় নির্মল— এই আমাদের কামনা।

শেষটায় একটা কথা না বললেই নয়, আমরা যে পথে ট্রেক করেছিলাম, সেটা কোনো অধুনা ট্র্যাক নয়, সেপথে আগেই বড়ভাই, আপুরা ট্রেক করে এসেছেন। সুতরাং এটা বোধহয় শেষ পর্যন্ত কোনো অফ-ট্র্যাক রইলো না। তাই ভ্রমণ বাংলাদেশ, আমাদের ট্যুরের বিভিন্ন নিখুঁত ডিটেইল প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছে। আবুবকর ভাই আমাকে তা সরবরাহ করেছেন। আমি আগের পোস্টগুলোতে তা যোগও করে দিয়েছি। …আর যেহেতু এটা আমার জীবনে প্রথম অফ-অ্যাডভেঞ্চার, তাই এটা আমার জন্য অফ-ট্র্যাকই। এই মোহ আমার রক্তে মিশে গেছে। হয়তো শিগগিরই আবার বেরিয়ে পড়বো কোনো অফ-ট্র্যাকে… আল্লাহ জানেন এবং আমি জানি না।

-মঈনুল ইসলাম

________________________________

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাবতীয় ভৌগোলিক কো-অর্ডিনেট “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সদস্য আবুবকর-এর থেকে প্রাপ্ত।

পুরো ট্যুরের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাজ-সরঞ্জাম সম্বন্ধে জানতে হলে যেতে হবে এই লেখায়

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (ভিডিও সাক্ষাৎকার)

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ধারাবাহিকটি চলছে অনেকদিন হলো। পাঠকদের আন্তরিক অভিনন্দন। এর ৯ম কিস্তির লেখা এখনও চলছে। সময় লাগছে, কারণ ব্যক্তিগত, পেশাগত, আর উইকিপিডিয়ার ব্যস্ততা। তবে খুব শিঘ্রই ইনশাল্লাহ আপনাদেরকে ৯ম কিস্তি উপহার দিতে পারবো বলে মনে হয়। সামনের কিস্তিগুলোতে থাকবে দুটো প্যানোরামা ছবি, আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

আপনাদের সাথে কথা ছিল, আমি রুমানা পাড়া বা রুমনা পাড়া’র কারবারির সাক্ষাৎকারের ভিডিওটা এডিট করে আপলোড করবো। নিজের অনভিজ্ঞতা আর ইন্টারনেট সংযোগের চরম দুর্বলতার দরুণ ভিডিওটা তিন দিনে অবশেষে আপলোড করেছি। একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি, কারবারি হলেন, পাহাড়ে, গ্রাম বা পাড়া-প্রধান।

-মঈনুল ইসলাম

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৮)

আমরা প্রচন্ড উচ্চতায় দীর্ঘ পথ বেয়ে রুমানা পাড়ায় উঠে যখন প্রচন্ড ক্লান্ত, তখন আবুবকর ঘোষণা করলেন তাঁরা দুটো ঝরণা দেখতে যাবেন, কে কে যাবে? “আমরা” বলতে যে, কামরুলকেও যোগ করা হচ্ছে, এটা নিশ্চিত; কারণ আমরা তিনজন ছাড়া কামরুলকে নিয়েই এই পথে ট্রেক করার পরিকল্পনা ছিল আবুবকরের। আর আমি তখন নিজের চিত্তের উপর বাজি ধরে রাজি হয়ে গেলাম চ্যালেঞ্জটা নেবার জন্য।

আবুবকর বললেন, ঝরণার ছবি তুলতে ক্যামেরা নিতে হবে। কিন্তু কামরুল প্রথমেই তার এসএলআরকে সরিয়ে রাখলো, না বাবা, আমি এই রিস্ক নিবো না। নাকিব কিংবা রাসেলও নিজেদের ক্যামেরা এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে নষ্ট করতে দিতে চাইলো না। আমি তখন সাহস করে বললাম, ঠিক আছে, আমি আমার আইফোন নিচ্ছি। (কারণ ওটা পকেটেই পুরে রাখা যায়)

ব্যস, আসন্ন অন্ধকারের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সবাই-ই টর্চ নিয়ে নিলাম, ব্যাগ রাখলাম কারবারির ঘরে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এবারে আমি পুরাই পাঙ্খা হয়ে গেলাম। শুধু একটা পানির ছোট্ট বোতল নিয়ে নিলাম অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে। আমাদের দুই গাইডও চললো আমাদের সাথে, আপেলের হাতে আছে আমাদের আনা দা। কারবারির ছোট ভাই আমাদেরকে ঝরণা দেখাতে নিয়ে যাবে, তাই তাকে অনুসরণ করে আমরা চললাম দুটো ঝরণা দেখতে, যে-পথে উঠে এসেছিলাম এই চরম উচ্চতায়, সে-পথে আবার নিচের দিকে।

অন্ধকার হয়ে আসছে পথ, কিন্তু তাতে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই বিন্দুমাত্রও। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— ঝরণা দেখতে হবে অন্ধকার নামার আগেই। পাহাড়ের চড়াই উঠা যতটা কঠিন, উৎরাই পেরোন তার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সেরকমটা হলো না, আমাদের শরীরের ওজন হালকা করায়। দ্রুতই নেমে গেল আমাদের ছয়জনের দলটা।

যে-পথে এসেছিলাম, সে-পথে নেমে নেমে সাঁকোর আগেই ডানদিকে একটা পাতাঝরা পথে আমাদের নিয়ে চললো কারবারির ভাই ‘লালহিম’। পথটা কিছুটা এগিয়ে নিচে নেমে গেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সামনে একটা ছোট্ট ঝিরি পার হবার জন্য একটা গাছ ফেলা, ধরার কোনো জায়গা নাই ওটাতে, ওটা ধরে দলটা খুব দ্রুতই পার হয়ে গেল।

এরপর হঠাৎ মনে পড়লো আমরা আসরের নামায পড়িনি। তাই দ্রুত ঝিরির পানিতে ওযু করে গামছা বিছিয়ে তিনজন আসর সেরে নিলাম। চললাম সামনে। এবারে কোমর পানি দিয়ে ঝিরি পেরোতে হলো। তারপর ঝিরি ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে শুনতে পেলাম ঝরণার শোঁ শোঁ আওয়াজ।

এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো একটা অল্প-উচ্চতার ঝরণা। ওটা নামতে তেমন কষ্ট হলো না। ওটা পেরিয়ে সামনে যেতেই হঠাৎ করে সামনে দেখা গেল কয়েক ফুট সামনে পায়ের নিচের পাথুরে জমিন উধাও।

বুঝতে কষ্ট হলো না, ওখানটাতেই ঝিরির পানি গিয়ে সবেগে আছড়ে পড়েছে নিচে। আবুবকর ভাই তাঁর কাজে ব্যস্ত, জিপিএস ট্র্যাক করছেন। আমি আমার ফোনখানা বের করে ছবি তুলতে চাইলাম। কিন্তু পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে মরতে চাইলাম না। কারণ ইতোমধ্যেই আবুবকর আমাদের জানিয়েছেন, স্থানীয়রা তাঁকে কী বলেছে: এখানে নাকি এক পাহাড়ি মেয়ে মারা গেছে ঝরণা থেকে পড়ে তারপরও গাইড বিকাশের হাত ধরে কোনো রকমে যথাসম্ভব সামনে ঝুঁকে, উপর থেকে ঝরণার ছবি নিতে চাইলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে, ফ্ল্যাশ ছাড়া প্রায়ান্ধকার ছবিগুলো কোনো মানেই রাখে না, তবুও, ছবি তো! (লালহিম পরে আমাদের নিশ্চিত করেছে, মারা যাওয়া সেই কিশোরি কিছুটা মানসিক বৈকল্যের শিকার ছিল।) (বিস্তারিত: পরিশিষ্ট ২-এ দেখুন)

উপর থেকে তোলা ঝরণার ছবি। (ছবি: লেখক)
উপর থেকে তোলা ঝরণার ছবি। (ছবি: লেখক)

এবার আবুবকর ডাকলেন আমায়। লালহিম আমাদেরকে ঝরণার পাশের একটা পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেল। পাহাড়ে উঠলাম। এরপর শুরু হলো নিচে নামা। খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামা। এই ব্যাপারটা এখন আমাদের যেনবা অভ্যাস হয়ে গেছে। তবুও সব সময়ই পাহাড়ে পাহাড়ে নতুন নতুন অবস্থা, নতুন নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন অনুষঙ্গের সাথে উঠতে-নামতে হয়, তাই থ্রিলটা সবসময়ই সমান প্রায়। লালহিম পথ তৈরি করা ছাড়াই নামছে। তাকে অনুসরণ করছে আমাদের গাইড বিকাশ আর আপেল। তাদের পিছনে আমরা।

গাছের শিকড়, ঝুলে থাকা ডাল, উপড়ে পড়া মোটা গাছ, মুখ-বের-করা পাথর, পাহাড়ি বাঁশের ঝোঁপ ধরে ধরে আমরা নামছি। আমাদের আপেল বাবাজি তার দা-খানা দিয়ে কোপ দিয়ে পথ পরিষ্কার করে করে নামছে। একসময় আবুবকর তার খুব কাছাকাছি চলে গেলেন। আর অমনি ও-ব্যাটা উপর থেকে মাটির দিকে দায়ের কোপ দিল, আর…

…সেই কোপ গিয়ে পড়লো আবুবকরের পায়ের আঙ্গুলে। রক্ত বেরোতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। কিন্তু অত্যন্ত মনের জোর দিয়ে আবুবকর যখন বললেন, আরে, কিছু হয় নাই, তুমি এগোও —তখন সত্যিই মনে হলো এ ব্যাটা রোবট। আবুবকর প্রমাণ করলেন, তিনি আসলেই একজন অভিযাত্রী। এই পথ কিংবা জঞ্জাল পেরিয়ে আমরা অল্প সময়েই নেমে এলাম সেই ঝরণাটারই পাদদেশে।

অপূর্ব অনুভূতি। এই কিছুক্ষণ আগে যে ঝরণার উপরে দাঁড়িয়ে অসাধ্য কিছু বলে মনে হচ্ছিল, এখন সেই ঝরণার মালভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি তার সম্পূর্ণ দেহ। লালহিম জানালো, এটাই সেই তিন-ধাপ-ঝরণা। উপরে আমরা একটা ছোট্ট ধাপ রেখে এসেছি, এইমাত্র আমরা দ্বিতীয় ধাপটা উপর-নিচ থেকে দেখা সম্পন্ন করলাম আর তারও নিচে আছে তৃতীয় ধাপটা। ডানদিকে দ্বিতীয় ধাপটা রেখে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি আবারো পাথুরে জমিন কয়েক ফুট সামনে থেকে উধাও, তবে এখানে বেশ খাড়া ঝরণা।

দ্বিতীয় ধাপের পাদদেশ থেকে তোলা ছবি। (ছবি: লেখক)
দ্বিতীয় ধাপের পাদদেশ থেকে তোলা ছবি। (ছবি: লেখক)

আবুবকর জানালেন, খুব বেশি উঁচু না ঝরণার দ্বিতীয় ধাপটা: জিপিএস-এ দেখাচ্ছে ১৩২ ফুট। আমরা এগিয়ে গিয়ে তৃপ্তি ভরে পানি খেয়ে নিলাম। সেখানে দেখতে পেলাম দারুণ এক পাখি। কামরুল খুব মিস করলো পাখির ছবিগুলো। খুব ইচ্ছা করছিল, গোসল করে ফেলি। কিন্তু কেন জানিনা, সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে এখানে সময় নষ্ট না করার তাগিদ অনুভব করলো সবাই।

আমাদের খুব ইচ্ছা হলো নিচের ঝরণাটার ছবিও তোলা। লালহিম এবং পাহাড়িদের মতে ওটা আরো বেশি উঁচু। কিন্তু একেতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তার উপর আরো বেশি খাড়া পথ নামতে হবে। তাই আবুবকর একটা অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি শুধু লালহিমকে পাঠাবেন। লালহিম এই সিদ্ধান্তে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না বোধহয়। কিন্তু তাকে যেভাবে বুঝিয়ে দিলেন, সেভাবেই সে জিপিএস ডিভাইসটা নিয়ে চলে গেলো আবার পাহাড়ের ঢালে। সেখান ধরে সে যাবে নিচে, তৃতীয় ঝরণার পাদদেশে।

সে, ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই জিপিএস আপনা-আপনি ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড (ভৌগোলিক স্থানমান) আর এলেভেশন বা উচ্চতা ট্র্যাক করে নিবে। আমরা যখন দ্বিতীয় ঝরণার পাদদেশে দাঁড়িয়ে গুগল আর্থের মাহাত্ম-কীর্তন করছি, ততক্ষণে, এই মাত্র দেড় মিনিটের মাথায় লালহিম হাপাতে হাপাতে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। ওর অবস্থা দেখে আমরা সবাই-ই একটু বিচলিত হলাম, কী হয়েছে!

আবুবকর বুঝে গেলেন, তুমি ভয় পাইছো? লালহিম অস্বীকার না করলেও স্বীকার করলো না ঠিক, তবু তাকে দেখে বোঝা গেল, পাহাড়ে থাকলেও অন্ধকার পাহাড়কে সে ভয় করে, যখন একা থাকে। জিপিএস ডিভাইসটা হাতে নিয়ে এলেভেশন দেখলেন আবুবকর, দেখাচ্ছে ১৩০ ফুট। তাহলে কি পাহাড়িরা ভুল বলে? হিসাবে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপটাই বেশি উঁচু। (আমার আর কামরুলের এখন যথেষ্ট সন্দেহ হয়, ও ব্যাটা লালহিম হয়তো ভয়ে পুরোটা পথ নামেইনি, তাই হিসাবটা ভুল হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।) (পরিশিষ্ট ৩ দ্রষ্টব্য)

যাইহোক, আসন্ন অন্ধকারকে সমীহ করে আমরা উঠবার চিন্তা করলাম। আবারো সেই পথে উপরে উঠে আসতে লাগলাম আমরা। একটু আগে মোটামুটি আলোতে অনেক কিছু দেখা যাচ্ছিল, এখন গাছের ছায়ায় তা অনেক বেশি অন্ধকার লাগছে। তাই পায়ের নিচের মাটিটা কোথাও কোথাও আন্দাজ করেই পা ফেলতে হচ্ছে। উপরে উঠে এসে আমরা আর দেরি করলাম না। মাগরিবের নামায ওখানেই পড়ে নিয়ে পাড়ার দিকে চললাম। পথে নিজেদের জুতাটুতা ভালোমতো পরিষ্কার করে নিলাম। আরেকটা ঝরণা না দেখেই আমরা পাড়ার পথ ধরলাম।

আপেল চলেছে সামনে, আমি আর আপেল গল্প করতে করতে সবার সামনে এগোচ্ছি। বাকিরা আসছে পিছনে, বেশ কিছুটা পিছনে পড়ে গেছে গল্প করতে করতে। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয় — আমি এত কষ্টের পরও এখন আর শরীরে তেমন কষ্ট অনুভব করছি না। আর আপেলের সাথে তাড়াতাড়ি ওঠার প্র্যাক্টিসটা করতে করতে বেশ ভালোই উঠতে পারছি পাহাড়ি ছাগলের মতো। আমি নিজেকে একটা ছাগল ভেবে কি তৃপ্তি পেলাম?!!!

উঠে এলাম রুমানা পাড়ায়। অন্ধকার পাড়ায় তখন ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে, অবশ্যই কুপির আলো। এপর্যায়ে রুমানা পাড়া আর বমদের সম্পর্কে একটু বলি:

রুমানা পাড়া, একটা বম পাড়া। আগে নাম ছিল সানকুপ পাড়া, সেটা ছিল ‘সানকুপ’ নামক কারবারির নামে। রুমা খালের শেষে পাড়াটার অবস্থান বলে এর নাম রুমানা পাড়া হয়েছে পরে। অন্যান্য বম পাড়ার মতোই রুমানা পাড়াও যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাড়া-প্রধানকে বলা হয় ‘কারবারি’। পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও আছে একটা গির্জা। বমরা পিতৃতান্ত্রিক এবং মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় স্বর্ণালঙ্কার এবং গৃহস্থালি অনেক কিছু দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। এটা যৌতুক-প্রথার মতো হলেও ঠিক যৌতুক হিসেবে গণ্য হয় না, প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার ঘরগুলো বাঁশের তৈরি, চাল দেয়া শন বা খড় দিয়ে। জানালাগুলো থাই-জানালার মতো স্লাইডিং, তবে স্লাইডিং প্যানেলটা তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে, এবং বেশ সাবলীল (smooth)। রুমানা পাড়ার লোকজন বাজার করতে যায় রুমা বাজারে, সেটা মোটামুটি দুই দিনের কাজ। একদিন লাগে গিয়ে বাজার করতে, সেখানে একরাত থাকে, তার পরদিন বাজার নিয়ে ফিরে আসে তারা। কারবারিরা বংশপরম্পরায় কারবারি হয়ে থাকেন। তাঁরা সরকার থেকে রেশন পান, এবং সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে সেই রেশন পাড়ায় পৌঁছে দেয়।

পাড়াটার নাম “রুমানা” নাকি “রুমনা” —এই বিষয়ে কামরুল আর আমার মধ্যে মতভেদ আছে। আমি বলছি “রুমনা” কামরুল বলছে “রুমানা”, অবশ্য এব্যাপারে কামরুলের যুক্তিটা শক্তিশালী। আমি ‘রুমনা’ বলছি, কারণ কোনো এলাকার স্থানীয়রা যে নামে এলাকাটাকে ডাকে, তা-ই নাম হিসেবে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যখনই তাদেরকে কোনো প্রভাবমুক্তভাবে নামটা বলতে দেয়া হয়, তখন তারা উচ্চারণ করে ‘রুমনা’। কামরুল ‘রুমানা’ বলছে, কারণ পাড়ার কারবারির মুখে সে শুনেছে ‘রুমানা’।

কারবারি আমাদেরকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে “রুমানা” নামটা না বম, না বাংলা, বরং এটা মারমা ভাষা। মারমা ভাষায় “রুঃ” মানে হলো “পাগল” আর “মা” মানে হলো “মেয়ে”। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই ‘রুমা খাল’ থেকে ‘রুমানা পাড়া’ নামকরণ হয়। এই ‘পাগল মেয়ে’ নামকরণে আছে দারুণ এক রোমান্টিকতা, নৃতাত্ত্বিক ঐকতান— য়িন-য়িয়াঙ, বৈপরিত্বের মিলন: একসময় রুমা খালে, বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ মারা যেত। যারা মারা যেত, তাদের মধ্যে নারী ছিল না, শুধু পুরুষরা মারা যেত। তাই রুমাকে, প্রকৃতিদেবী গণ্য করে আদিবাসীরা একে এক মেয়ে কল্পনা করে নেয়, আর সেই মেয়েই যেনবা ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছে এভাবে। তাই সেই মেয়ে হয়ে যায় ‘পাগল মেয়ে’, মানে ‘রুঃমা’, যা থেকে হয় ‘রুমা’।

এই যাবতীয় আলোচনা থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, কামরুলের দাবি ঠিক, অর্থাৎ মারমা ভাষা অনুযায়ী পাড়াটার নাম ‘রুমানা’ই ঠিক। কিন্তু বম ভাষার উচ্চারণশৈলীতে সম্ভবত ‘রুমানা’ উচ্চারিত হয় না, তাই তারা বলে ‘রুমনা’। এখন যেহেতু পাড়াটায় মারমা-রা নয়, বরং বমরা থাকে, তাই আমি এর ‘রুমনা’ নামকে অগ্রগণ্য ধরবো; কোন খাতায় কী লেখা আছে, সেসবের বিচার করতে আমি রাজি না।

যাহোক, আমরা ঝরণা দেখে অন্ধকার রাতে পরিশ্রান্ত হয়ে যখন কারবারির ঘরে ফিরে আসি, রাসেল তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে, আর নাকিব গল্প করছে কারবারির সাথে। কারবারি, আর-সব পাহাড়িদের মতো ছিপছিপে শরীরের একজন ক্লিন-শেভ্‌ড মানুষ, লুঙ্গি আর শার্ট পরে বসে আছেন নাকিবের পাশে। কুপির আলোয় পরিবেশটা বেশ সুন্দর।

কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, আমাদের গাইড বিকাশ বেশ রেগে আছে। কী হলো? শুনলাম, আমরা ঝরণায় যাবার আগেই কারবারির থেকে একটা মুরগি কিনে রেখে গেছেন আবুবকর। নাকিব আর রাসেলকে ওটার ওজন কত হয় দেখতে বলা হয়েছিল, নাকিব সেটা দেখে রেখেছে। কিন্তু এতক্ষণ আমরা আসিনি, ওরা কেন সেটা জবাই করে রাখলো না? ক্ষিধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। অথচ রান্নার সিকি ভাগও প্রস্তুত করা হয়নি।

রাগটা অযৌক্তিক না। ক্ষিধের ঠ্যালায় নাড়িভুড়ি হজম হবার জোগাড়। পা থেকে অ্যাংকলেট আর নী-ক্যাপ খুলে আমি আর আবুবকর গেলাম মুরগিটা, থুক্কু মোরগটা জবাই করতে। ওটাকে ঝুড়ির নিচ থেকে বের করে যতবারই আমি একহাতে ডানা আর পা আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে গলা ধরতে যাই, অমনি ডানা হাত থেকে ফসকে যায়। এভাবে তিনবার হবার পর, আবুবকর বেশ বিরক্ত হলেন। আমিও নিজের উপর বিরক্ত হলাম, [শ্লীল গালি] হাতের গ্রিপটা কি এতোটাই ছোট হলো যে, মোরগটা ধরতে পারছি না। …এবারে আবুবকর নিয়ে যখন ধরতে চাইলেন, তখনই আবিষ্কার করলাম আমরা, এরা, মোরগটার উড়ে যাওয়া রোধ করতে ডানাদুটো একসাথে করে পাটের রশি দিয়ে আটকে রেখেছে। তাই ডানা ছোট হয়ে যাওয়ায় আমার হাত থেকে ফসকাচ্ছিল। হয়তো এভাবেই এই পাহাড়ের চূঁড়ায় মোরগ পালে এরা। বাঁধন কাটার পরে বেশ সহজেই জবাই করা হলো ওটা। জবাই করার পর হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়লো, এরা থাকে অনেক উঁচু পাহাড়ে, তাই পানির ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী হতে হবে। আমরা খুব অল্প পানি খরচ করে হাত ধুয়ে নিলাম।

পরে শুনলাম, নাকিবেরও সময়টা ঠিক ব্যস্ততাহীন কাটেনি। রাসেলকে রীতিমতো নার্সের মতো পরিচর্যা করেছে সে। মূভ দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে। মালিশ করে দিয়েছে পা। ও বেচারাকে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুইয়ে দিয়েছে আরামের জন্য, যদিও নিজেও বেচারা ব্যথায় কাতর ছিল। কিন্তু মোরগটা জবাই না করার অপরাধ থেকে তবু তাকে অব্যহতি দেয়া গেল না।

হঠাৎ শোনা গেল ঢোলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। পাহাড়িরা জংলি গান ধরে বসলো নাকি —এমন প্রশ্নে যখন কপালটা কুঁচকে উঠতে যাচ্ছিল, তখন আবুবকর জানালেন গির্জা থেকে আসছে আওয়াজ। কান পেতে শুনলাম, সুরে সুরে লয়ে লয় মিলিয়ে গানের কথা ভেসে আসছে গির্জা থেকে, সাথে পড়ছে ঢোলের তাল। বুঝতে কষ্ট হলো না, শাস্ত্রীয় খ্রিস্টধর্ম এখানে এসে শাস্ত্র ধরে বেশ জুত করতে পারেনি, তাই পৌত্তলিক বমদের ধর্মান্তরিত করতে তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বাদ না দিয়ে ‘ধর্ম’ বানিয়ে জুড়ে নিয়েছে— এজন্য একে আমি বলি লৌকিক খ্রিস্টধর্ম।

গির্জার সার্মন শেষে ঘরে ঢুকলেন এক পুরুষ, হাতে একটা বই। জানতে পারলাম ওটা বাইবেল। তিনি আমাদের সাথে পরিপূর্ণ ইংরেজিতে কথা বললেন। তাঁর শুদ্ধ ইংরেজি বোলে জানা গেল, তিনি ভারতের ত্রিপুরাতে লেখাপড়া করেন। সেখানে যাবার বর্ণনা দিলেন, কী করে তাঁরা পাহাড়ের পর পাহাড়, উঁচু উঁচু পাহাড় পায়ে হেঁটে কয়েকদিন পরে গিয়ে ত্রিপুরার বর্ডার পার হোন। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা যাবার এই বর্ণনা যতটা না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় এক সাধারণ বম যুবকের শিক্ষা-স্পৃহা। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না, কারবারি নিজেই অসন্তুষ্ট চিত্তে তাঁর ছোট ভাই লালহিমের বদনাম করলেন, ফাইভ পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে সে।

একদিকে বিকাশ আর আপেল মিলে মোরগ কেটে ধুতে লাগলো, তাদেরকে সহায়তা করলো লালহিম আর কামরুল, আমিও পরে গিয়ে সঙ্গী হলাম। মোরগ ধোয়া শেষ করে কারবারির রান্নাঘরেই রান্না করতে বসলো বিকাশ। আরেকটা কুমড়া কাটা হয়েছে, আপেল আর লালহিম কেটে-কুটে একটা পাত্রে রাখছে। কামরুল আর আমি যখন পরে ওদের সাথে যোগ দিলাম, তখন কামরুল আবিষ্কার করলো, ক্ষিধে পেটে ঐ কাচা কাচা কুমড়া বেশ দারুণ উপাদেয় খাবার হয়ে উঠতে পারে। কামরুলকে দেখে আমিও এক টুকরা নিয়ে মুখে পুরে তাজ্জব বনে গেলাম, বেশ মিষ্টি, কুমড়াটা। কাচা কাচাই কামড়ে খাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। আমি আর কামরুল অনেকক্ষণ ধরেই খেয়ে গেলাম ঐ কাচা কুমড়া। বিষয়টা আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল।

আমরা যখন রান্নাবাটি খেলছিলাম, থুক্কু, করছিলাম, তখন ওদিকে আবুবকর আর রাসেল মিলে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন কারবারির। আর নাকিব তুলছিল স্থিরচিত্র। কুপির আলোয় ক্যামেরার ভিডিওতে চেহারা দেখার প্রশ্নই উঠে না, তাই নাকিব ওর এলইডি-চার্জলাইটটা জ্বালিয়ে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করলো। কিন্তু ভিডিওটা দেখার পরে বোঝা গেলো স্টুডিওর আলো কেন এতো উজ্জ্বল কিসিমের হয়। রাসেল তার বয়ে আনা ক্যামেরাটাকে ট্রাইপডের উপর বসিয়ে ভিডিও করার দায়িত্ব নিল। আবুবকর আর রাসেল প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে থাকলেন কারবারির থেকে।

আবুবকর আর রাসেল সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন কারবারির। উৎসুক লালহিম দেখছে ক্যামেরার ফ্রেমে বড় ভাইয়ের ফ্যান্টম চেহারা। (ছবি: নাকিব)
আবুবকর আর রাসেল সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন কারবারির। উৎসুক লালহিম দেখছে ক্যামেরার ফ্রেমে বড় ভাইয়ের ফ্যান্টম চেহারা। (ছবি: নাকিব)

এদিকে যখন এই ডকুমেন্টারি নির্মাণ চলছিল, তখন আমরা রান্নাঘরে বসে গল্প করছিলাম। বিকাশ রান্না করছে, আমরা প্রয়োজনীয় সহায়তা করছিলাম। কারবারির ঘর থেকে একটা ডেকচি ধার করা হয়েছে। যে হাতাটা দিয়ে নাড়ছে বিকাশ, ওটা একটা বাঁশের টুকরা, একটা ছোট্ট কঞ্চিসহ কাটা হয়েছে টুকরাটা। এরকম প্রাকৃতিক জিনিসই পাহাড়িদের নিত্যসঙ্গী। চুলাটা তৈরি করা হয়েছে কাঠের মেঝের উপর মাটি জমা করে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে তার উপর। চুলার তিনটা পায়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শিল-পাটার শিলের মতো দেখতে তিনটা লম্বাটে পাথর। চুলার কয়লা নেড়ে দেয়ার জন্য এক টুকরা বাঁশকে গরম করে বাঁকিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক চিমটা। একটা কুপি সাধারণ বাঙালি ঘরাণার হলেও আরেকটা কুপি ছিল আকর্ষণীয়: একটা টিনের পটের মধ্যে ভরা হয়েছে মাটি। তার মধ্যে গেঁথে একটা টিনের ফানেল দাঁড় করানো হয়েছে। ফানেলটাই আসল কুপির আঁধার, ওটার উপরটা বন্ধ করে কুপির সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়েছে। এসব ছাড়াও এদের নিজস্ব নিচ-চারকোণা-উপর-ছড়ানো-গোলাকৃতি ঝুড়ি, লম্বাটে কিরিচ-আকৃতির দা, বাঁশের ঘুটনি ইত্যাদি তো আছেই।

রান্নাবাটি: বিকাশ শেফ, আপেল আর লালহিম কুমড়া জবাই করছে, কামরুল আর আমি সহায়তা করছিলাম, কিন্তু নাকিবকে ক্যামেরা হাতে দেখে কুমড়া খেয়ে দেখালাম, কিভাবে একটু আগেই আমরা কাচা কুমড়া-খোর ছিলাম। (ছবি: নাকিব)
রান্নাবাটি: বিকাশ শেফ, আপেল আর লালহিম কুমড়া জবাই করছে, কামরুল আর আমি সহায়তা করছিলাম, কিন্তু নাকিবকে ক্যামেরা হাতে দেখে কুমড়া খেয়ে দেখালাম, কিভাবে একটু আগেই আমরা কাচা কুমড়া-খোর ছিলাম। (ছবি: নাকিব)

আমাদের বিকাশ বাবাজি, রান্না করতে করতে গল্প করছিল, যেকোনো পাহাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হলো বম মেয়েরাই। ও বেচারা বম মেয়েদের খুব ভক্ত। কিছুক্ষণ পরেই তার কারণ এবং যৌক্তিকতা পাওয়া গেল, কেননা এই বেচারা ইতোমধ্যেই এক বম পাড়ার একজন বম মেয়ের কাছে নিজের হৃদয়টাকে বন্ধক রেখেছে। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ আর কিছুটা গাল-লাল-করা ভালোবাসার আহ্লাদে মোবাইল বের করে নায়িকার ছবিখানাও কামরুলকে দেখিয়ে দিল।

যাহোক, রান্না হয়ে গেলে আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে ওদের সবাইকে ডেকে আমরা খেতে বসে গেলাম। লালহিমও আমাদের সাথে খাবে। খেতে বসে আর দেরি করলাম না। ক্ষিধায় যে পেট জ্বলে যাবার জোগাড়। খাবার মুখে দিতেই স্বাদ ছাপিয়ে যে জিনিসটা মুখে লাগলো, তা হলো গরম আর ঝাল। প্রচন্ড ঝাল করে রেঁধেছে বিকাশ। আমি ঝাল প্রায় খাই-ই না, কিন্তু এত্ত ঝাল, তবু ক্ষিধার ঠ্যালায় পটাপট গিলছি। বাকিদেরও একই দশা— বিকাশ, আপেল আর লালহীম অবশ্য ব্যতিক্রম।

এই ঝালের কারণ জানতে চাইলে বিকাশ জানালো, পাহাড়িদের নাকি এই ঝালের কারণেই ম্যালেরিয়া হয় না। সত্য-মিথ্যা কিংবা ডাক্তারি বিদ্যার প্রমাণ আমার কাছে নেই, তবে এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধকের কথা আমায় বেশ আকর্ষণ করলো। কারণ সোয়াইন ফ্লু যখন দেখা দিয়েছিল, তখন একদল জাপানি বিশেষজ্ঞ জানালেন, যেসকল দেশে মশলাদার খাবার বেশি খাওয়া হয়, সেসকল দেশে সোয়াইন ফ্লু খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। সোয়াইন ফ্লু, মশার কারণে না হলেও দুটোর মধ্যে একটা সূত্র মিল পড়ায় বিষয়টা আমার কাছে যৌক্তিকই মনে হলো।

খেয়ে-দেয়ে আমরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। সামনের ঘরটায়, মানে, কারবারির একমাত্র ঘরটায়ই আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা। এই ঘরটার পাশেই শ্রেফ একটা রান্নাঘর ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। ঘরটার একপাশে কারবারির পরিবার, আরেক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে আমাদের শোবার ব্যবস্থা। “শোবার ব্যবস্থা” শুনে মনে করার দরকার নেই, একেবারে খাট-পালং দিয়ে শোবার ব্যবস্থা। একইভাবে, কয়েক প্রস্থ কম্বল দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিচে আর উপরে দিয়ে বাঁশের চাটাইয়ের মেঝেতেই ঘুমানোর বন্দোবস্ত করা হলো। শোবার আগে সেদিনও পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। মশা এখানেও নেই দেখে, ওডোমস মাখলাম না। (ওডোমস হলো মশা নিরোধক মলমবিশেষ)

ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ফযরের নামায পড়ে আরেকটা দিন শুরু করার প্রস্তুতি নিলাম। নাকিব, খুব ভোরেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা সেরে ফেলেছে। ঠিক নাস্তা করার আগ-মুহূর্তে রাসেলের আবারো যখন কাজটায় যাবার প্রয়োজন হলো, তখন সবাই যার-পর-নাই বিরক্ত হলো। কামরুল ওকে সঙ্গ দিল। আমিও যে মহাপুরুষ, সব বন্ধ করে বসে আছি, ব্যাপারটা তা না। গত রাতে, শান্ত পরিবেশে, আমার টর্চ নিয়ে একটা ল্যাট্রিনে বসে কাজ সেরে নিয়েছিলাম। ল্যাট্রিনটা পাহাড়ের খাঁজে বসানো, নিচে কিছু বাঁশ দিয়ে একটা পাটাতন বানিয়ে, তার মাঝখানে গর্ত রাখা হয়েছে। চট দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটাকে ‘চেষ্টা’ বলাটাই সমিচীন হবে। রাতে উপদ্রব না থাকলেও, সকালে নাকিব এবং রাসেলের অভিজ্ঞতা হয়েছে, ওরা যখন কাজ সারছে, ঠিক নিচে গপাগপ তা সাবাড় করায় ব্যস্ত ছিল বম পাড়ার পালিত বরাহরা।

নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকার সময় হঠাৎ রাসেলের চোখ পড়লো রান্নাঘরের মেঝেতে কারবারির ছোট্ট বল্টুটা হাতে, পাহাড়িদের বড় দা নিয়ে বসে বসে জুম থেকে তুলে আনা আদার টুকরায় কোপ বসাচ্ছে। নাকিব ক্যামেরা বের করতে করতে দৃশ্যটা মিস হয়ে গেল। তবে দৃশ্যটা যতটা না উপভোগ্য ছিল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কজনক ছিল আমাদের জন্য।

কারবারির পিচ্চিটা সুযোগ বুঝে দা বের করে আদা কাটতে বসেছে, আতঙ্কজনক দৃশ্য! (ছবি: নাকিব)
কারবারির পিচ্চিটা সুযোগ বুঝে দা বের করে আদা কাটতে বসেছে, আতঙ্কজনক দৃশ্য! (ছবি: নাকিব)

যাহোক, রাতের খাবারের রেখে দেয়া অংশটুকু খেয়ে উফ্‌-আফ্‌ করতে করতে অবশেষে বেরোলাম আমরা কারবারির ঘর থেকে। যাবার আগে কারবারিকে তাঁর বিল পরিশোধ করলেন আবুবকর, মোরগের দাম শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ হলেও আবুবকর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব শান্ত কন্ঠেই বিষয়টার ইস্তফা দিয়ে (পরিশিষ্ট ১ দ্রষ্টব্য) ইতি টানলেন রুমানা পাড়ার। সাকুল্যে কারবারিকে দেয়া হলো ৳১,২০০ (মোরগের দামই ছয়শো-সাতশো’র উপরে ছিল)।

রুমানা পাড়া খুবই ছিমছাম, পরিষ্কার পাড়া। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলোয় চোখ যা বোলানো যায়, ততটুকু বোলালাম আমরা। এখানকার ঘরগুলো এক কিংবা বড়জোর দুই কক্ষের, পেছন দিকে থাকে বারান্দার মতো বড় একটা বাড়তি অংশ: যেখানে পানি ফেলা, হাত-পা ধোয়া, বাচ্চাদের পেশাব করানো থেকে শুরু করে বাঁশের ফাঁক গলে নিজেদের মুত্র বিসর্জনের কাজও তারা সেরে থাকে।

বিদায়ের প্রাক্কালে, রুমানা পাড়ার এক ঘরের সামনে কামরুল আর নাকিব। (ছবি: লেখক)
বিদায়ের প্রাক্কালে, রুমানা পাড়ার এক ঘরের সামনে কামরুল আর নাকিব। (ছবি: লেখক)

একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, বম পাড়ায় নারকেল গাছ। বেশ কিছু ঘরের পাশে বেড়া দিয়ে নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, তা ওরা না জেনেই হয়তো কাজটা করে। কারণটা হলো, বজ্রপাত। নারকেল গাছ, বজ্রপাত আকর্ষণ করে। ফলে, কোনো ঘর কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ে, তা নারকেল গাছের উপর পড়ে, মানুষের জীবন বাঁচে। আর, রুমানা পাড়ার মতো উঁচু বম পাড়াগুলোর জন্য এগুলোর গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ মেঘের স্তরের খুব কাছাকাছি, এমনকি মেঘের স্তরেই থাকে পাড়াগুলো।

আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে লালহিম। সে আমাদেরকে গতকালকের অবশিষ্ট ঝরণাটা দেখিয়ে দিয়ে চলে আসবে। আমাদের পথটা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নিচে নামছে। আজকের গন্তব্য? অবশ্যই সামনের ঝরণাটি। কিন্তু তারপর?

অনাকাঙ্ক্ষিত ক’টি উৎসের পথে আমাদের পথ যে চলবে, সেটা জানা ছিল না তখনও আমার। আবুবকর যেন গভীর এক ষড়যন্ত্র করলেন!

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

___________________________________________________________________

পরিশিষ্ট ১:

কিছুদিন আগে রুমানা পাড়ার কারবারি নাকিবকে ফোন করেছিলেন, মানে মি’ছা কল দিলে নাকিব ফোন করে। তিনি রুমা বাজারে বাজার করতে এসেছিলেন (দুই দিনের ফাঁড়ি)। আমাদেরকে আবারো আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর পাড়ায়। …এখানে একটু বলে রাখি, ওখানে মোরগের এতো দাম হওয়ার কারণ হলো তাদেরকে ওখানে অনেক কষ্ট করে পালন করতে হয় ওগুলো।

পুনশ্চ, যাদের কাছে মনে হচ্ছে এই ভ্রমণ-বৃত্তান্তটা খুব বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, তাদের অবগতির জন্য জানাতে চাচ্ছি, এটা একজন ভ্রমণকারীর বৃত্তান্তের চেয়ে একটু বেশিই একজন ভবিষ্যত ভ্রমণকারীর তথ্য-ভাণ্ডার। তাই এতে তথ্য যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কোনো কার্পণ্য না করেই।

পরিশিষ্ট ২ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫):

ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স-এর শ্রদ্ধেয় আকাশ ভাই বলছেন, ঝরণার নাম “জিংসিয়াম সাইতার”, যার মূল নামকরণ করা হয়েছিল “জিংসিয়াম (যুবতির নাম – Zingsiam) ত্লাকনাক (তিন ধাপ – Tlaknak) সাইতার (ঝরণা – Saitar)”- নামকরণে জড়িত ছিলেন ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স দল, নতুন রুমনা পাড়ার কারবারি কাপ্রিং ব্যোম, এবং জিংসিয়ামের আপন ভাই ন্যল ব্যোম । ঝরণাটিতে যে মেয়ে মারা গিয়েছিল, সে কিশোরী নয়, বরং ২৪/২৫ বছরের যুবতি ছিল। এই মৃত্যু নিয়ে উদ্ভট এবং বিকৃত বিভিন্ন তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। এজন্য প্রকৃত ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো:

মেয়েটি মারা গেছে ঝরণার পাশের পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে। যেখানে মারা গিয়েছিল, তার ভৌগোলিক স্থানাংক হলো 21°57’42.61″N 92°32’30.37″E। স্থানটা ঝরণার দ্বিতীয় ধাপের কাছে আর রুমনা পাড়ার সীমানার মধ্যে। রুমনা পাড়ার কারবারি আর গির্জার সার্মনদাতার ভাষ্য শুনে এবং মেয়েটির ভাই নল-এর দেয়া তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, মেয়েটির এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগ ছিল। একদিন সকালে সে ঐ পাহাড়ে কাজে যায় এবং রাত পর্যন্ত পাড়ায় ফিরেনি। তাই রাতে পাড়ার লোকজন তাকে খুজতে বের হন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে পাহাড়ের ঢালে তার ঝুড়ি আর দা দেখতে পান এবং ওখান থেকে কিছু পাতা ঝর্ণার দিকে সরানো ছিল (মানুষ পড়ে গেলে যেমনটা হয়)। লোকজন ঝর্ণার নিচে নেমে তাকে মাথা ফাটা আর হাত ভাঙ্গা অবস্থায় মৃত দেখতে পান (ঐ স্থান থেকে ঝর্ণার উচ্চতা ১২৮ ফুট)। এ থেকে ধারণা করা হয় সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। পাড়ার লোকজন লাশ না তুলে আর্মি ক্যাম্প-এ খবর দেয় এবং আর্মির অনুমতি নিয়ে লাশ, পাড়ায় আনতে আনতে রাত আনুমানিক ২টা বাজে। ঐদিন পাড়ায় কোনো পর্যটক ছিলেন না বা আসেনওনি। এবং এটা এখনকার পর্যটনস্বর্গ বান্দরবানের ঘটনা না, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। – তথ্যগুলো আবুবকর ভাই এবং সম্ভ্রান্ত ট্রেকিং ও গবেষক দল ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স থেকে নিশ্চিত হয়ে লিখছি।

পরিশিষ্ট ৩ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫):

ঝরণাটির ধাপের বর্ণনায় আমার একটা ভুল আছে: যেটাকে এখানে প্রথম ধাপ বলা হয়েছে, সেটা আসলে ধাপ হিসেবে গণ্য হবেই না। যেটাকে এখানে দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে বর্ণনা করা আছে, সেটা আসলে প্রথম ধাপ। আর এরও নিচে আরো দুটো ধাপ আছে।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৬)

অন্ধকারের পথ ধরে আমরা চলছি কোনো এক অজানা পাড়ার সন্ধানে, কেউ জানিনা, আদৌ আছে কি নেই। পাড়া না পেলে অনেকটা পথ আবার ফিরে গিয়ে আস্তানা গাড়তে হবে নদীর বাঁকে। এমন সময়…

আবুবকর চিৎকার করে বললেন,পাড়া, পাড়া। পাড়া আছে এখানে।

সাথে সাথে মরুভূমির মধ্যে পানির কূপ পাবার মতো সবার মনে কী যে অনাবিল আনন্দ ছেয়ে গেল, বলে বোঝাবার নয়। সবার চলার গতি বেড়ে গেল দ্বিগুণ। ডানদিকের পাহাড়টা ধরে উপরে উঠতে লাগলাম আমরা। একসময় উপরে উঠে এলাম এক লোকালয়ে— হ্যা, এটা একটা পাড়া।

লোকজনের সাথে কথা বলতেই বেরিয়ে এলো, এটা “এনেঙ পাড়া”। আপেল নাকি নিচ থেকে বাচ্চাদের চিৎকার শুনে পাড়াটার সন্ধান পেয়েছে। ব্যস, আমাদের খুশি আর ধরে না। আবুবকর আর কামরুল আনন্দে উদ্বেলিত হলো, ওদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল না— দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো খুশিতে। আবুবকর, পরিচিত একটা ঘর পেয়ে গেলেন, তাদের বাড়িতেই থাকার পরিকল্পনা করলেন। কামরুল ততক্ষণে আমাদেরকে একটা ব্রিফ দিয়ে দিল এই পাড়া সম্বন্ধে:

এনেঙ পাড়া, কেউ কেউ বলেন এনঙ পাড়া। এটা একটা ত্রিপুরা পাড়া। এই পাড়াটার অবস্থান ভৌগোলিকভাবে বেশ আকর্ষণীয়, কারণ চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এমন পাড়া আর সচরাচর নাকি দেখা যায় না। আরেকবার এসে কামরুল এখানেই ওদিকটার এক পাহাড়ের উপর দিয়ে য়্যাব্বড় একখানা রুটি, থুক্কু, চাঁদ দেখে একেবারে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। আজ অবশ্য চাঁদ দেখার কথা না, কৃষ্ণপক্কের রাত। আমরা ঘরে গেলাম।

সকালের এনেঙ পাড়া (ছবি: নাকিব)
সকালের এনেঙ পাড়া (ছবি: নাকিব)

জীবনে এই প্রথম কোনো পাহাড়িদের ঘরে থাকা। তাই প্রশ্নগুলো করে নিতে ভুলছিলাম না আবুবকরকে। জানলাম, প্রয়োজনীয় কিছু যদি এঁদের থেকে নিয়ে ব্যবহার করা হয়, এরা সেটা খুশিমনে দিবে, খুব সহায়তাপরায়ণ। যাবার সময় একটা গড়পড়তা হিসেব করে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেলেই এরা খুশি। কিছু না দিলেও এদের কোনো অভিযোগ থাকবে না, খুশিমনে বিদায় দিবে। জানলাম, এরা কিছুই করে না— না লেখাপড়া, না আড্ডাবাজি (তাই বলে সামাজিক গল্প-গুজব করে না বললে ভুল হবে, এদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে এবং দ্বন্দ্ব-কোন্দলও আছে), শ্রেফ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে, সন্ধ্যা হলেই এরা খেয়ে-দেয়ে শ্রেফ ঘুমায়। আবুবকর বললেন, এই তো একটু পরেই দেখবেন, সবার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসবে। আরো জানালেন, আমাদের জন্য তাদের ঘুমের ব্যাঘাতই ঘটছে, সবাই ঘুম বাদ দিয়ে আমাদের দেখছে বসে বসে।

এনেঙ পাড়ার ঘরের এক কোণে পরিবারের সবাই জড়ো হয়ে আমাদের গিলছে (ছবি: রাসেল)
এনেঙ পাড়ার ঘরের এক কোণে পরিবারের সবাই জড়ো হয়ে আমাদের গিলছে (ছবি: রাসেল)

ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে, হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে এটা-ওটা মুখে নিচ্ছে। ওটাকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু যদি পেশাব করে দেয়, তাহলে মহা-ফ্যাসাদে পড়ে যাবো। তাই দূর থেকেই ঈশ্বরের ঐ আজব সৃষ্টিকে উপভোগ করলাম মন ভরে। শিশু, এই পৃথিবীর একটা অপূর্ব দৃশ্য।

শরীরটা বেশ ধরে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের পেশীগুলো ব্যথা করছে প্রচন্ড। যদিও যতটা মনে করেছিলাম, তার তুলনায় কম। কারণ হলো, অ্যাংকলেট, পায়ের গোড়ালিকে অধিক ব্যবহার-সত্ত্বেয় নড়তে দেয়নি জায়গা থেকে, নী-ক্যাপ, হাঁটুর বাটিকে ধরে রেখেছিল, তাই হাঁটার তুলনায় পেশিগুলো নড়াচড়া করেছে কম, ফলে তাদের পরিশ্রম কিছুটা হলেও শুষে নিয়েছে এই দুই বস্তু। তবু আমাদের দুই গাইড মাংসপেশীর ব্যথানাশক ওষুধ “মূভ” মাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। মূভ আমরা কেউই নেইনি, জানা গেল নাকিব নিয়েছে। দুই গাইড ওটা দিয়ে রীতিমতো গোসল করলো। রাসেল তার পায়ে মাখিয়ে নিল। আমার কেন জানিনা বাম কাঁধে খুব ব্যথা করছে। বুঝতে পারলাম, ব্যাগ বহনের কারণে। কিন্তু দুই কাঁধে ব্যথা না করে এক কাঁধে ব্যথা করছে কেন? আমি, কাঁধে একটু মূভ মাখলাম; আর পেইনকিলার খেয়ে নেয়া জরুরি মনে করলাম, কারণ সামনের দিনগুলোও আমাদের হাঁটতে হবে।

তারও আগে আমরা সবাই পাহাড় থেকে নেমে ঝিরির পানিতে মুখ-হাত ধুয়ে নিয়েছিলাম। খুশির ঠ্যালায় যে মাগরিবের নামাযটা ছুটে গেছে, সেটা খেয়ালই ছিল না। খুব আফসোস হলো। যাহোক, মুখ-হাত ধুতে গিয়ে আবার বুঝলাম, আমার টর্চটা অসাধারণ কাজ করছে। এদিকে কামরুলের আনা ছুরি দিয়ে আমাদের দুই গাইড বিকাশ আর আপেল, কিনে আনা মাছগুলো কেটে-কুটে পরিষ্কার করতে লেগে গেল। এদিকে কামরুল জানালো, এখানে প্রাকৃতিক কৃতকর্মটি সারতে হবে এই খোলা জায়গায়, কোনো এক পাথরের আড়ালে। আশ্চর্য হলাম না। তবে সমস্যা হলো নাকিব। ওর আবার কোথাও গেলে এই জিনিসটা বেশ ভোগায়। অনেক সময়ই সে পায়খানা না হবার ঔষধ খেয়ে যায়। তাছাড়া ওর আবার এরাকনোফোবিয়া (arachnophobia) আছে, মানে মাকড়সাভীতি। মাকড়সা দেখলে খাওয়াতো দূরে থাক, পায়খানা-প্রস্রাবও বন্ধ হয়ে যায়। আমি ওকে তাই ‘ল্যাডিস’ বলে ক্ষেপাই।

যাহোক হাত-মুখ ধুয়ে যখন আকাশে তাকিয়েছি, আমি যেন হারিয়ে গেলাম মহাশূণ্যে…। সবগুলো তারা যেন কোনো এক জ্বলজ্বলে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল আমায়। পাহাড়ের উপরে এত্তো এত্তো তারার ভিড়ে উরসা মেজর খুঁজতে মনে ছিল না।

ঘরে ফিরে আমরা বাসিন্দাদের থেকে একটা বড় কুমড়া নিলাম। তারপর সেটা কাটার পালা। পাহাড়িদের দা’র গঠনটা হলো কিরিচের মতো, ধারালো দিকটা লম্বাটে। তাই আমাদের দা দিয়ে তেমন একটা সুবিধা করা গেলো না কুমড়া কাটায়। কুমড়া কাটা শেষে পাহাড়ি ছোট্ট, এই এত্তটুকুন, কিন্তু ঝা–ল, মরিচ গুড়া করা হলো অন্যান্য মসলার সাথে (ছোট মরিচের ঝাল বেশি)। গুড়া করার জন্য এরা শিল-পাটা ব্যবহার না করে ব্যবহার করে ঘুটনি। বাঁশের ঘুটনির ভিতরে গাছের ডালের ছেচনি। ঘুটনি নামটা সিলেটে ব্যবহৃত হয়, ছেচনি নামটা আমি এখন দিলাম।

রান্না করছে আমাদের শেফ বিকাশ। সহায়তা করছে আপেল আর ঘরের একজন বাসিন্দা। রান্না করতে করতে আমরা ঘরের বাঁশের চাটাইয়ের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে নামায পড়ে নিলাম। বিশ্রাম পেয়ে শরীরটা যেন ব্যথা একটু বেশি করছে। এর মধ্যে খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল। আমরা সবাই পাহাড়ীদের প্লেটে খাবার নিয়ে বসলাম। তাদের প্লাস্টিকের বোতলে জমিয়ে রাখা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। এদের পানি রাখার জন্য, বোতল ছাড়াও আরেকটা পাত্র আছে: একটা ফল থেকে এটা বানায় এরা। ফলটা ঠিক কলসের ছোট্ট আকৃতি। লাউয়ের ভিতর থেকে শাঁস বের করে চুলার উপর শুকিয়ে যেভাবে ডুগডুগি কিংবা পাত্র বানানো হয়, ঠিক এভাবেই এটাকেও পানি রাখার পাত্র বানানো হয়। তবে সত্যি বলছি, ওটাতে রাখা পানির মধ্যে একটা গন্ধ হয়, গন্ধটা আমার ঠিক ভালো লাগেনি। যাহোক, মেনু হলো মাছ দিয়ে এক তরকারি, আর কুমড়া দিয়ে এক তরকারি। বাড়তি তরকারি রেখে দেয়া হলো, যাতে সকালে নাস্তা করা যায়।

রাত্রে ঘুমানোর সময় ওরা আমাদেরকে দুটো ছোট কম্বল দিল; আমাদেরকে ভাগ করে নিয়ে ঘুমাতে হবে। মশা মোটেই নেই, তাই ওডোমস মাখার প্রয়োজন মনে করলাম না। কামরুল আর আবুবকর একটা স্লিপিং ব্যাগে থাকবে, বিকাশ আর আপেল একটা কম্বলের নিচে, নাকিব নিজের আনা ফুলানো বালিশ আর শীত-চাদরের নিচে, আমি আমার কাপড়গুলো দিয়ে বালিশ আর নিজের আনা চাদরটার নিচে, রাসেল নিজের ফিতা-ব্যাগ দিয়ে বালিশ আর এদের দেয়া কম্বলের নিচে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। খুব একটা ঠান্ডা কিন্তু না। …কিন্তু রাত যত গভীর হলো, ঠান্ডা আমাদেরকে জেঁকে ধরলো। পাতলা চাদরটা ঠিক তাল মেলাতে পারলো না। রাসেলেরও খুব কষ্ট হচ্ছে, নাকিবও স্বস্তি পাচ্ছে না। এর মধ্যে রাত তিনটার দিকে জেগে উঠলো প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টিটা, ত্রাহী চিৎকার করে জানাতে থাকলো তার কোনো অবরুদ্ধ আবদার। সবার ঘুমেরই বারোটা।

পাহাড়ে ভোরের উজ্জ্বল চ্ছটা, এনেঙ পাড়া থেকে তোলা (ছবি: নাকিব)
পাহাড়ে ভোরের উজ্জ্বল চ্ছটা, এনেঙ পাড়া থেকে তোলা (ছবি: নাকিব)

সূর্য ওঠার আগে দেখি কামরুল আর আবুবকর উঠে পড়লো। পরে জেনেছি, এই আধো-অন্ধকারে ওরা কোথায় গেছিল। ওরা যাবার সময় রাতের ঠান্ডার কথা শুনে ওদের স্লিপিং ব্যাগটা আমাদের উপর দিয়ে গেল, ওটার উষ্ণতায় বেশ ভালো ঘুম হলো বাকি সময়টুকুতে। ভোর আটটায় বেরোবার কথা থাকলেও আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেল। উঠে, নাকিব চলে গেল নিজের কৃতকর্মটি সেরে পরিষ্কার হতে। গিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে বসলো। কাজ প্রায় শেষ, এমন সময় নাকি দুজন লোক ওপাশ থেকে হেঁটে আসছিল। নাকিব, দ্রুত পরিষ্কার হয়ে লুঙ্গি তুলে অ্যাটেএএনশন্! ভাবটা এমন— আমি আসলে প্রকৃতি দেখতে বেরিয়েছি!!

বুঝে গেছেন নিশ্চয়, কামরুল আর আবুবকর কেন ভোরে উঠেছে?

রাতের বাড়তি খাবারটুকু গরম করে প্রস্তুত করলো বিকাশ। সবাই যখন খাবার খেতে বসবে, তখন রাসেলের দরকার পড়লো কৃতকর্মটি সারার। …আর সময় পেলো না। সবাই-ই একটু বিরক্ত হলো, ব্যাটা এতক্ষণ কী করেছিস!! সে আবার একা যাবে না, সঙ্গে নিলো আমাকে। কেন আমাকে? আমি নাকি ওকে পাহারা দিব, যাতে নাকিবের মতো কেউ এসে ওকে বিরক্ত না করে। যাহোক, আমি শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত-ল্যাট্রিনের পাহারাদার হলাম। কিছুক্ষণ হলো কাজ সারছে রাসেল, এর মধ্যে রাসেলকে দেখার লোভ সামলাতে পারলো না ‘একজন’!!!

এমন ‘একজন’, যার ব্যাপারে রাসেলকে আসলে ওয়ার্নিং দেয়ার ঠিক প্রয়োজন মনে করলাম না। সে গিয়ে পাথরের ওপারে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রাসেল পাথর ছুঁড়েও ওটাকে দূরে সরাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত অস্বস্তিতে বেচারা দ্রুত কৃতকর্ম সমাধা করে উঠে এলো। আর উঠতেই… উঠে আসতেই, ঐ ব্যাটা ধাড়ি শুকর দৌঁড়ে গিয়ে মুখ দিল ঐ…।

রাসেল, এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারলো না। রাতে যদি উষ্ণ একটা ঘুম হতো, তাহলে এতক্ষণে বেচারা সুস্থ থাকতো, কিন্তু রাতের ঠান্ডায় পা তার স্বাভাবিক হয়নি পুরোপুরি, ব্যথা নাকি যেমন ছিল তেমনই আছে। তার উপর এই দৃশ্য দেখে বমির উদ্রেক হলো তার। কিন্তু পেটে দানাপানি নেই এই ভোরে, কোনো রকমে রক্ষা পেলো।

উপরে উঠে এসে দেখি সবার খাওয়া শেষ, শুধু আমাদের দুজনের জন্য দুটো প্লেটে খাবার রাখা। খাবারটাও দেখে খুব একটা সুবিধার লাগছিল না, হয়তো এইমাত্র ঘটে যাওয়া বিষয়টা আমাদের দুজনকেই একটু মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মনের জোর আমার সবসময়ই আছে, এসব ঘেন্না একটু কম। দ্রুত খেয়ে নিলাম। রাসেল তেমন খেতে পারলো না। হাত ধুয়ে বেরিয়ে এলাম, দলের সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে। আবুবকর ভাই এর মধ্যে হিসাব নিকাশ করে গড়পড়তায় ৳৫০০ ধরিয়ে দিয়েছেন ঘরের বাসিন্দাদের। তারা মহা খুশি!

বাইরে বেরিয়ে তাকালাম ঘরটার দিকে, রাতের অন্ধকারে কিছুই বুঝিনি এটার। ঘরটা অবশ্যই বাঁশের উপরে, সব পাহাড়ীরাই যেভাবে বানায়। বেড়াগুলো বাঁশের চাটাইয়ের। আর শন বা খড়ের চাল। ঘরকে যতটুকু উঁচু করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে, নিচে ততখানি জায়গা জুড়ে জ্বালানি কাঠ রাখা। নাকিব ওর ক্যামেরায় ধারণ করলো দূরের পাহাড়ের উপর সূর্যোদয়ের আগমনী আলোর চ্ছটা, আর এনেঙ পাড়ার কিছু ছবি। সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। একটাতে আমি নেই, একটাতে নেই কামরুল।

এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’, মেঝের খুব কাছাকাছি, তবু কলকল আওয়াজ তুলে মাতিয়ে রাখে (ছবি: লেখক)
এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’, মেঝের খুব কাছাকাছি, তবু কলকল আওয়াজ তুলে মাতিয়ে রাখে (ছবি: লেখক)

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবার নেমে গেলাম আমরা ঝিরিতে, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে: সকাল ৯টা। রাসেলকে নাকিব খাইয়ে দিয়েছে একটা পেইনকিলার। গত রাতের এই শীতে আমরা এই ঘরের ভিতর কাবু হয়ে বুঝেছি, যদি পাড়া না পেতাম, শ্রেফ একটা পলিথিনের শেল্টারে কী বিপদই না ডেকে আনতাম নিজেদের। একটা পাড়া আমাদের কিছু টাকা খসিয়েছে হয়তো, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছে আগের মতো উদ্যম। তাই আজ এই সকালের মিষ্টি আলোয় হাঁটছি আমরা। এখনো সূর্য অতোটা উপরে উঠেনি বলে চলার পথে এখনও রোদ পড়েনি অতোটা। বেশিদূরে নয়, ছোট্ট একটা পাথুরে ঢালের দুপাশে ছোট্ট অনুচ্চ ঝরণা, এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’। দেখে মন ভরবে না, মনে হবে ইশ! বর্ষায় কী যে দারুণ লাগবে জায়গাটা! আরো সামনে ডানদিকে দেখলাম একটা মৃত ঝরণা। বর্ষায় হয়তো এটা জেগে উঠবে। হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা ছোট স্বর্গে চলে এলাম আমরা।

দ্বিতীয় স্বর্গে ভোরের আলোকচ্ছটা। এখানে কামরুলের ছবিগুলো আশা করি ভালো এসেছে। (ছবি: লেখক)
দ্বিতীয় স্বর্গে ভোরের আলোকচ্ছটা। এখানে কামরুলের ছবিগুলো আশা করি ভালো এসেছে। (ছবি: লেখক)

স্বর্গটায় একটু অপেক্ষা করলাম। খুব ভালো লাগলো জায়গাটা। সকালের সূর্য গাছের ফাঁক দিয়ে চ্ছটা দিয়ে পথটাকে পুরো স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে। যাহোক, স্বর্গও ছাড়তে হলো সামনের স্বর্গ ধরার জন্য। কারণ সামনে অপেক্ষা করছে আরো আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গ।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা পাড়া এলাকায় পৌঁছলাম। সেখানে একটা বরই গাছ পেয়ে ওটা থেকে বরই খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। ঢিল ছুঁড়ে তেমন একটা বরই পেলাম না, স্থানীয়রা সাবাড় করে দিয়েছে। তবু যে ক’টা পেলাম, ভালো মিষ্টি। বরই খেয়ে আবার চললাম। সামনের পাড়াটি হলো মেনদ্রুই পাড়া। প্রথমেই একটা স্কুল পেলাম, ওটার সাইনবোর্ডে লেখা অবশ্য “মেনডক পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” (২নং রুমা সদর ইউনিয়ন)। এই পাড়াটাও ত্রিপুরা পাড়া। বেশ সমতলেই (ঝিরি সমতল) থাকে এরা।

মেনদ্রুই পাড়ার অধিবাসী, পিঠে ঝোলানো বল্টু (ছবি: লেখক)
মেনদ্রুই পাড়ার অধিবাসী, পিঠে ঝোলানো বল্টু, সামনে আবুবকর জিপিএস রিডিং নিচ্ছেন (ছবি: লেখক)

রাসেলের অবস্থা আমাদেরকে একটু চিন্তিতই করলো। আমাদের এখনও আজকের দিনসহ আরো তিনদিনের পরিকল্পনা। সেখানে রাসেলকে এভাবে টেনে নেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তাই রাসেলকে যদি এখান থেকে রুমাতে পাঠিয়ে দেয়া যায় কোনোভাবে, তাহলে আমাদের সামনে চিন্তা করা সহজ হয়। দুজন বাসিন্দাকে পাওয়া গেল স্কুলের সামনে। একজন পুরোপুরি স্থানীয়, পিঠে একটা বল্টু ঝোলানো। বল্টু মানে ঐ যে, বিধাতার আশ্চর্য সৃষ্টি! পিঠে ঝুলে ঝুলেই অতটুকু মিনি মিনি চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আমাদেরকে। কী বুঝলো কে জানে, নিস্পৃহ চেহারা নিয়ে ঝুলেই থাকলো পিঠে।

পাড়ায় অপূর্ব আলোকচ্ছটা, আইফোন না হয়ে এসএলআর হলে... ওফ্‌!
পাড়ায় অপূর্ব আলোকচ্ছটা, আইফোন না হয়ে এসএলআর হলে… ওফ্‌! (ছবি: লেখক)

স্থানীয় ব্যক্তি আমাদেরকে একটা পথ বাতলে দিলেন, সামনের পাহাড়ের ওপাশের একটা পাড়ার সন্ধান দিলেন, ওখানে নাকি ট্রাক আসে মাল নামিয়ে দিতে, নিয়মিত না অবশ্য; ওখানে গেলে ট্রাকে করে যাওয়া যাবে রুমা। কিন্তু হিসাব-নিকাশ করে যে বিষয়টা উদ্ধার হলো, ওখানে যেতে পাড়ি দিতে হবে বড় বড় পাহাড় আর ও’পাড়ায় গিয়েও যে গাড়ি পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। রাসেল যদিও বেশ উৎসাহী ছিল চলে যাবার জন্য, কিন্তু টীমলিডার আবুবকরের সিদ্ধান্ত হলো এরকম অনিশ্চয়তায় ওকে ঠেলে দেয়া যায় না। তাছাড়া বড় বড় পাহাড় ডিঙানো চাট্টিখানি কথা না, তাও পা ভাঙা অবস্থায়। তাছাড়া এই পাড়ায়ও কোনো স্থানীয় গাইড পাওয়া গেল না, কারণ সবাই-ই এই জুম-মৌসুমে ব্যস্ত। অগত্যা, রাসেলকে নিয়েই সামনে চলার চিন্তা করলাম আমরা। আজকের লক্ষ্য: সন্ধ্যার আগে রুমানা পাড়া খুঁজে বের করা।

আবারো ঝিরিতে নামলাম আমরা। চলার পথে আগের মতোই বড় বড় পাথর, পাহাড় থেকে পড়া গাছ, ভেজা পাথরে শ্যাওলা, উঁচু উঁচু পাহাড়ে তীর্যক সূর্যের অপূর্ব খেলা —একই দৃশ্য, তবু মায়াময়! চলতে চলতে এক জায়গায় আমরা পেলাম দুটো গয়াল, গতকাল যেমনটি পেয়েছিলাম। গয়াল (Bos frontalis) হলো গরুর জাতভাই, কেউ ডাকে বনগরু বলে। নিরীহ প্রাণী, কিন্তু ইদানিং তেমন আর দেখা যায় না এদের। গৌর আর গয়ালে সামান্য পার্থক্য আছে।

ছবিটাতে একসাথে দেখা যাবে উঁচু পাহাড়ে গাছ, জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া ঝিরি, আর মেটে-ঝরণা। ছবিটা দুটো ছবি জোড়া দিয়ে বানানো। (ছবি: লেখক)
ছবিটাতে একসাথে দেখা যাবে উঁচু পাহাড়ে গাছ, জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া ঝিরি, আর মেটে-ঝরণা। ছবিটা দুটো ছবি জোড়া দিয়ে বানানো। (ছবি: লেখক)

যা হোক এগিয়ে চললাম। গভীরে, আরো গভীরে। কোথাও ঝিরির পানিতে পথচলা, কোথাও পাথুরে পাহাড়ে বেয়ে উঠা, কোথাও গাছে ঢাকা পথে শুকনো পাতা মাড়ানো তো কোথাও গাছের মগডাল মাড়ানো… ‘মগডাল মাড়ানো’ পড়ে আশ্চর্য হবেন না, কারণ সত্যিই মগডাল মাড়ানো লাগতে পারে আপনার। কারণ জুম চাষের কারণে একটা পাহাড়ের সব গাছ কেটে সাফ করে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ঝিরিতে। গাছের কাটা, চিকন মগডালে সবকিছু ছেয়ে আছে পথটার। ওপথ দিয়ে খুব কষ্টে পাড়ি দিল দলটা, কিন্তু সবার শেষে থাকা আমি আর কামরুল জিতলাম। পরে দেখি বাম দিকে বনের ভিতর দিয়ে কন্টকবিহীন সুন্দর পথ আছে। অযথাই বেচারারা কষ্ট করলো!

কোথাও ঝিরির কাছেই এভাবে খানিক উঁচু পাথর ডিঙাতে হয়। (বাম থেকে: বিকাশ, আবুবকর, কামরুল, নাকিব) (ছবি: লেখক)
কোথাও ঝিরির কাছেই এভাবে খানিক উঁচু পাথর ডিঙাতে হয়। (বাম থেকে: বিকাশ, আবুবকর, কামরুল, নাকিব) (ছবি: লেখক)

সামনে পেলাম একদল পাহাড়ি কিশোর-কিশোরী, ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা কাছাকাছি হতেই ওরা একটা মাছ পেয়ে গেল। আবুবকর চাক্ষুস করে আমাকে বললেন, ওরা মাছ দেখেই দা দিয়ে দিয়েছে কোপ, ব্যস, লেজে পড়ে আটকে গেছে বেচারা। ওটা দেখে আমার কাছে মনে হলো ‘কুইচ্চা’ (অনেকে ডাকে ‘কুচিয়া’), সাপ আর বাইন মাছের গোত্রের। আবুবকর কিনে নিতে চাইলেও ওরা বিক্রী করলো না।

মেনদ্রুই পাড়ার পথে অপূর্ব সূর্যের আলোকচ্ছটা (ছবি: কামরুল)
মেনদ্রুই পাড়ার পথে অপূর্ব সূর্যের আলোকচ্ছটা (ছবি: কামরুল)

সামনে এগিয়ে চললাম। এবারে বালুময় ঝিরির বদলে পাথুরে ঝিরির পরিমাণ একটু বাড়লো। এতে আমাদের আরো একটু সাবধান হতে হলো। কারণ ঝিরির পানিতে ভিজে থাকা প্রত্যেকটা পাথর শ্যাওলা জমে মৃত্যুকূপ হয়ে আছে। এর মাঝে কোনো কোনো পাথর আবার নড়বড়ে। সামনের পা শ্যাওলা-ধরা পাথরে রেখে, ভালোমতো স্থির করে, তারপর পিছনের পা তুলতে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আবারো সামনে পেয়ে গেলাম গতকালকের মতো একটা পাথুরে বিছানা। কেন যে এটা বর্ষাকাল না, মনে করে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে, গতকালকেরটা ছিল আরো ভাটিতে, তাই ওখানে শ্যাওলা ছিল না, কিন্তু এটাতে পিচ্ছিল পাথরের অভাব নেই।

আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। খুব মজা করে কী যেন খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বিকাশ একটা কাচা চালতা হাতে নিয়ে চামড়া ছিলছে আর সবাই সঙ্গে আনা লবণ বের করে তা মাখিয়ে খাচ্ছে। ক্ষুধার মধ্যে এই টকটুকুও যে স্বাদ হতে পারে বোঝা যাচ্ছিল এই ক্ষুধার্ত লোকগুলোকে দেখে। কষ থাকলেও খারাপ লাগেনি। তবে বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। আবার পথ ধরলাম।

দেখে মনে হতে পারে জমজমের কূপ; বাম দিকে শুষ্ক-ঝরণা, ডান দিকে ঝরণার পানি যেখানে পড়ে (ছবি: লেখক)
দেখে মনে হতে পারে জমজমের কূপ; বাম দিকে শুষ্ক-ঝরণা, ডান দিকে ঝরণার পানি যেখানে পড়ে (ছবি: লেখক)

ডানদিকে চোখে পড়লো একটা পাথুরে ঝরণা, তবে সম্পূর্ণ শুষ্ক। কিন্তু এই ঝরণাটা যে বেশ আগের, সেটা খুব আন্দাজ করা যায়, কারণ পানির প্রবাহ পাথরে স্থায়ী খাঁজ বানিয়ে ফেলেছে। খাঁজটাও বেশ খানদানী খাঁজ। আবার যেখানে পানি পড়ে, সেখানখার খাঁজটাও বেশ কারুকাজমণ্ডিত। গাছের চিপায় কসরত করে ঢুকে ওটার ছবি তুলতে হলো।

কামরুল যেভাবে পার হচ্ছে, এভাবেই তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে পার হতে হয় এখানটায় (ছবি: লেখক)
কামরুল যেভাবে পার হচ্ছে, এভাবেই তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে পার হতে হয় এখানটায় (ছবি: লেখক)

সামনের পথটা পেরোতে হয় তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে। আরো সামনে এগিয়ে চললাম। পাথরগুলো বিশ্রীভাবে ঝিরিপথে শুয়ে আছে। টপকাতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। একেতো একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বেশি, তার উপর একেকটার পুরুত্ব অনেক। তাই একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়েই যেতে হচ্ছে, আবার ভয়ে থাকতে হচ্ছে, ভেজা স্যান্ডেল না আবার পিছলে যায়।

আমাদের পথটা এগিয়ে গেল সামনে। সামনে গিয়ে দেখি একটা ঝরণা। অনুচ্চ, তবে বেশ বেগ আছে পানিতে। ঝরণার নিচে দুজন পাহাড়ি মাছ ধরছেন। তাদের ভেলাটা বাঁশের। পানির তীব্র তোড় ভেলাটাকে যেন সরিয়ে না নেয়, সেজন্য বিশেষ কৌশল নিয়েছেন: অশ্বক্ষুরাকৃতি অঞ্চলটার তিন দিকে তিনটা বাঁশ আটকেছেন এরা পাথরের খাঁজে। যখন যেদিকে যেতে হয়, সেদিককার বাঁশ ধরে টান দিয়ে এগোন তারা। আর মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করছেন কারেন্ট জাল। জাল পেতে রেখেছেন পানির নিচে। আর আরেকটা বাঁশ দিয়ে পানির নিচে, পাহাড়ের গভীর খাঁজগুলোতে গুতো দেন। এতে ওখানে আশ্রয় নেয়া মাছগুলো দ্রুত বেরিয়ে এসে আটকা পড়ে জালে। এদের মাছধরা দেখার চেয়ে ছায়াময় এই জায়গাটা, পানির সংস্পর্শ, বাতাস আর ঝরণার আওয়াজে আরো বেশি স্বর্গীয় আবেগে জড়িয়ে ফেলে।

স্বর্গীয় ঝরণায় মাছ ধরছেন দুই পাহাড়ি (ছবি: কামরুল)
স্বর্গীয় ঝরণায় মাছ ধরছেন দুই পাহাড়ি (ছবি: কামরুল)

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আমাদের পথটা এসে মিশেছে এই ঝরণায়। সামনে যেতে হলে ঝরণা পেরোতে হবে। কিন্তু ঝরণা পেরোন কি চাট্টিখানি কথা? পিচ্ছিল পাথর সোজাসাপ্টা বলে দিচ্ছে, উঠো আর পিছলে পড়ে মরো। এদের জিজ্ঞাসা করা হলো এরা কি জানে কিনা, উপরে উঠলে রুমানা পাড়া পাওয়া যাবে কিনা। এরা বললো জানে না, এরা অন্য পাড়া থেকে এসেছে।

আমি তখন তাকিয়ে আছি ডান দিকের একটা পাহাড়ের দিকে। একটা হালকা পায়ে-চলা-পথের মত রেখা মনে হচ্ছে। দেখলাম আপেল ওদিক দিয়েই পথ বের করেছে উপরে ওঠার। আমাদের আবারো খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা। কিন্তু কেন জানি এবার বুক কাঁপলো না। বুঝতে পারলাম, বেশ মনোবল আসছে নিজের উপর, এটা ভালো লক্ষণ। তবে ওভার-কনফিডেন্ট না হয়ে যাই, সচেতন ছিলাম।

খাড়া পাহাড় বেয়ে ঝরণা পাড়ি দেয়া এবার যেন কষ্ট দেয়নি তেমন (ছবি: লেখক)
খাড়া পাহাড় বেয়ে ঝরণা পাড়ি দেয়া এবার যেন কষ্ট দেয়নি তেমন (ছবি: লেখক)

নাকিব খুব বিরক্ত। এতো পথ পাড়ি দিয়ে এসে এভাবে আবার পাহাড়ে চড়া মোটেই আকর্ষণীয় নয়। আমি, ওর পিছনে থেকে প্রতি মুহূর্তে বলে দিতে থাকলাম, না, ওটা না, বড় ডালটা ধর। না না, চিকন বাঁশ ধরিস না। হুঁ হুঁ, কক্ষণও গাছের উপরের দিকে না, গোড়ার কাছাকাছি জায়গায় ধর্। হুঁ হুঁহ, আরেকটু সামনে পা ফেল, ওখানে পাথর আছে। তবে আগের চেয়েও বেশ সহজেই পার পেয়ে গেলাম পাহাড়টা। উঠে এলাম ঝরণাটার উপরে।

'ধাপ-ঝরণা'র উপরের দুটো (ছবি: নাকিব)
‘ধাপ-ঝরণা’র উপরের দুটো (ছবি: নাকিব)

এখানে এসে তো আরো অবাক, উপরে আরো দুটো ঝরণা। এগুলোকে বোধহয় বলে ‘ধাপ-ঝরণা’, কে জানে? উপরেরগুলো তুলনামূলক ছোট ধাপের, ঐ-যে আমার ‘মেটে-ঝরণা’র মতো আরকি। নিচে থাকতে যদি খেয়াল করতাম, তাহলে দূর থেকে তিনটার একত্র ছবি তোলা যেত নাকিবের ১২এক্স অপটিক্যাল দিয়ে। যাহোক, আমরা ঝরণাটার কোনো নাম পেলাম না পাহাড়িদের থেকে। আন্দাজ করলাম, এটা এখনও কোনো ভ্রমণকারী আবিষ্কার করেননি, আমরাই প্রথম। তবে নাম আমরাও দিলাম না, ভ্রমণ বাংলাদেশ, এই দায়িত্ব তাদের কাছে রেখেছে। (তাদের স্বার্থে কোঅর্ডিনেটও শেয়ার করলাম না)

অনুভূতিটা এবার বেশ ভালো: যাক, অভিযানটা শুধু প্রথমবারেরই না, অভিযানটা সফলও। ফুরফুরে মন নিয়ে আরো সামনে এগোলাম আমরা। ঝিরি তার সৌর্যবীর্য দেখিয়েই যাচ্ছে। চলতে চলতে বেশি দূর যেতে হলো না, পথটা গিয়ে ঠেকেছে আরেকটা উঁচু ঝরণার পাদদেশে। একেবারে সাক্ষাৎ ডেড এন্ড

৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়, পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে উঁচু থেকে পানি পড়ছে, নিচে জলপতনে সৃষ্ট গভীর কূপে ভরাট পানি, উঠার কোনো পথ নেই: শুধু এই ঝরণা। আগের ঝরণাটার মতো পাশের পাহাড়টাও ডাকছে না, বরং এই পাহাড়ের গাছগুলো ৮৫ ডিগ্রির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের বলছে: যাও, বাছাধন, ফিরে যাও, এদিকে তাকিও না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব

এই প্রথম…, হ্যা, এই প্রথমবারের মতো আমি খুব হতাশ হলাম। কারণ ১: ফেরার পথ হলো যতটুকু পেরিয়েছি, ততটুকু ফিরে গিয়ে মেনদ্রুই পাড়ায় যাওয়া। কারণ ২: ফিরে না গেলে এখানে পঁচে মরা। কারণ ৩: না-মরতে-চাইলে ঐ খাড়া ঝরণাটা বইতে না পারলেও বাইতে যাওয়া, এবং অবধারিত মৃত্যু কিংবা গুরুতর জখম। এতোটা হতাশ এই অভিযানে আমি আর একবারও হইনি।

দলনেতা গাইডদের নির্দেশ দিলেন, সে নির্দেশ অনুযায়ী আমরা আবার পিছিয়ে এসে একটা কম ঢালু পাহাড় বেছে নিলাম। গাইডরা ওটা বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমরাও তাদের অনুসরণ করে উঠতে গিয়ে আটকে গেলাম মহা-ফ্যাসাদে: বেত কাঁটায় সবার হাত-পা-শরীর-ঘাঢ় ছড়তে থাকলো। পথটা মোটেই স্বাগত জানানোর নয়। সবারই রাগ পড়লো গিয়ে দুই গাইডের উপর, উঠার সময় বেতকাঁটাগুলো কেটে কেন উঠলো না!

মাঝপথে, পাহাড়ের ঢালে দলনেতা আবুবকর আটকে গেলেন। তাঁকে আটকাতে দেখে সবাই-ই নিজ নিজ জায়গায় আটকে থামলাম। মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে উপর থেকে দুই গাইড, বিকাশ আর আপেল যেন গর্ব করে জানালো: উপরে কোনো পথ নেই।

আমি একটা ঝরণা-পথের মতো দেখে, দলনেতার অনুমতি নিয়ে ওদিকটা দেখার চেষ্টা করলাম। জানালাম, কষ্ট করে উঠা যাবে, কিন্তু উপরে উঠে যে পথের দিশা পাব, তার কী গ্যারান্টি? এর মাঝে চেহারা দেখালো দুই গাইড, উপর থেকে নিশ্চিত করলো: কোনো পথ নেই!!!

আমার হতাশা আমাকে ঘিরে ধরছে। সার্ভাইভাল সিচুয়েশনে হতাশা… শ্রেফ, হতাশাই পারে একজন সার্ভাইভারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে। এক্কেবারে ডেড এন্ডে দাঁড়িয়ে সামনে কি আর ভাবা যায়?

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

আমার বন্ধু রাশেদ এবং গেরিলা!

অপচয়!

হুহুঁ, সময়ের অপচয় করো না। এরকম আপ্ত বাক্য নিয়েই সব সময় চলচ্চিত্র দেখতে বসতে হয় নাকি আমাদের? নাকি কেউ চলচ্চিত্র দেখতে বসেছে বলে আমরা মনে করি, সে জীবনে একটা মহা কিছু অর্জন করতে যাচ্ছে?

দুটোর মধ্যেই দুটোই খুব এক্সট্রিম, মানে চরম ভাবনা। এতো কাটাকাটাভাবে বিনোদনকে ভাবতে নেই। বিনোদনকে নিছক বিনোদন হিসেবেই দেখতে শেখা উচিত –অন্তত আমাদের গুরুজনরা এমনটাই আমাদের শিখিয়েছেন।

কিন্তু তারাই আসলে কথা রাখেননি। যখন প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র তৈরি হয়, তখন বিনোদন আর বিনোদন থাকে না, তখন সেটা একটা এক্সট্রিম ম্যাসেজ নিয়ে আসে দর্শক-শ্রোতার কাছে: দর্শক-শ্রোতাকে বলে তোমাকে কিছু অর্জন করেই চলচ্চিত্রটা শেষ করতে হবে। সেখানে সময়ের অপচয় বলে কোনো কথা নেই।

আর সেজন্য প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রকে হতে হয় যথেষ্ট সুনির্মিত, কাঠামোবদ্ধ; কাহিনী হতে হয় আকর্ষণীয়। সেখানে থাকতে হয় শব্দ আর ছবির অপূর্ব সম্মিলন, যেন দর্শক খামখেয়ালিভাবে দেখতে দেখতে একসময় ডুবে যায় কাহিনীর ভিতরে, এবং ছবি দেখা শেষে তারা আবিষ্কার করে, তারা ছবির কোনো না কোনো একটা ভালো লাগা চরিত্র। তখনই প্রোপাগান্ডা ছবি সার্থক হয়।

 

দেখা শুরু করলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “আমার বন্ধু রাশেদ”। কয়েকটা কারণে ছবির প্রতি আমার এক্সপেকটেশান একটু বেশি। কারণ ১: কাহিনীটা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের। কারণ ২: ছবির পরিচালনায় ছিলেন “দিপু নাম্বার টু”খ্যাত পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। কারণ ৩: আমার ফুফাতো ভাই শাকির বলেছে, ছবিটা সুন্দর!

ছবির শুরুতে একটা ট্রেন আসছে। ক্যামেরা সেই ট্রেনটাতে উঠে গেলো এবং শেষ বগির দরজা দিয়ে বেরিয়ে রেললাইনটা ধরলো। অপূর্ব দৃশ্য! কিন্তু কানে কেমন জানি বেখাপ্পা লাগছিল ট্রেনের শব্দটা। আমরা জানি ট্রেনের শব্দ কিছুটা একঘেয়ে, ঝক্কর ঝক্কর, কিন্তু আসলে তা কিন্তু না, সেখানেও আছে একটা ছন্দ এবং ছন্দপাতের খেলা, সেকারণেই একেবারে একঘেয়ে লাগে না। কিন্তু আলোচ্য দৃশ্যে ট্রেনের শব্দটা ছিল ছোট্ট, কেবল একটা মাত্র ট্র্যাক (track), আর তা রিপিট করা হচ্ছিল বলে শব্দটা মেকি, ধরা যাচ্ছিল। কিন্তু যখন ট্রেনের ভিতরে দুটো চরিত্র কথা বলা শুরু করলো, তখন সেই কাঙ্ক্ষিত ছন্দপাতটা কাজ করলো বলে ফাঁকটা আর ধরা পড়লো না।

কিন্তু এ কী? খটকা লাগলো, যখন ছবির প্রথম ডায়লগটা কানে এলো, “আচ্ছা বাবা? এখন যদি তোমার কোনো বন্ধুর সাথে দে-খা হয়ে যায়? তুমি কি বলবে? কীরে দোস্ত, কেমন আছিস। বলবে বাবাহ্‌?” –এই বাক্যের ভুল বিরামচিহ্ন দেখে যেমন থমকে যাবেন, ঠিক এমনটাই থমকে গেছিলাম আমি ঐ বালকের অভিনয় দেখে, এ যেন বইয়ের পাতা থেকে কোনো স্কুলবালক সুরে সুরে মুখস্ত পড়া আওড়াচ্ছে!

প্রত্যেকটা কিশোর-চরিত্রের চোখে পড়ার মতো কিছু মুদ্রাদোষ ছিল: তারা যখন সোজা হয়ে কোথাও দাঁড়ায়, তো তাদের দুই হাত শরীর ঘেষে দুপাশে এমনভাবে গায়ের সাথে সেঁটে থাকে, মনে হয় কেউ তাদেরকে এ্যাটেনশান করে রেখেছে; তারা যখন শুয়ে থাকে, তখন সটান হয়ে আকাশের দিকে মাথা দিয়ে শোয়, আর একটা হাত থাকে পেটের উপর; তারা বিছানা থেকে যখন উঠে, তখন বোঝাই যায়, তারা আরামের জন্য বিছানায় ঘুমায়নি, সোজা-সটান উঠে বসে, অথচ তাড়া না থাকলে আমরা কেউই ঘুম থেকে সোজা-সটান উঠে বসি না, কনুই দিয়ে ঠেলা দিয়ে শরীরটাকে তুলতে চেষ্টা করি।

কিশোর চরিত্রগুলো যেখানে মুখ্য ছিল, তাদের অভিনয়শৈলী হওয়ার দরকার ছিল দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়। কিন্তু কোথায় কী? ক্যামেরা যখন “রোল” বলে, তার এক সেকেন্ড পরে তাদের মুভমেন্ট শুরু হয়। দেয়াল থেকে দুই বালক একসাথে নামবে এমনই নির্দেশ ছিল। তো একজন নামতে উদ্যত হয়ে আরেকজনের মধ্যে নামার লক্ষণ না দেখে থমকে দাঁড়ায়, তারপর দুজন একসঙ্গে নামে কোনো সমস্যাই হয়তো নয়, কিন্তু বড্ড দৃষ্টিকটু। কিশোর অভিনেতাদের চোখের, ভ্রু’র এক্সপ্রেশনের বালাই নেই। …এতটুকু বাচ্চা অভিনেতাদের প্রতি আমার হয়তো এতোটা কঠোর হওয়া উচিত হচ্ছে না। কিন্তু সত্যি বলতে কি, নায়ক রাশেদ চরিত্রের (চৌধুরী জাওয়াতা আফনান) অভিনয়টা যেখানে ফুটে উঠছিল, সেখানে বাকি চরিত্রগুলো বড় বেশি ম্লান লাগছিল। কিন্তু মুদ্রাদোষগুলো ছিল প্রতিটি কিশোর চরিত্রেই।

বয়স্ক অভিনেতাদের কাছে একটু বেশি আশা করা দোষের কিছুই নয়। কিন্তু দিপু নাম্বার টু-তে যেখানে আবুল খায়ের-এর (তাঁর বিদেহী আত্মার ক্ষমা কামনা করি) মায়াময়ী শিক্ষকের ভূমিকাটা বড় দাগ কেটেছিল, সেখানে ইনামুল হকের অভিনয়টা শ্রেফ ভাড়ামি মনে হচ্ছিল। [ইবুর বাবা চরিত্রে] পিযুষ বন্দোপাধ্যায়ের অভিনয়, পিযুষের মতো উচ্চতা ছুঁতে পারছিল না। তাছাড়া দেশের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে পিযুষকে যখন ক্লিন শেভ্‌ড দেখা যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, এতোদিনের অভিনয় জীবন কস্ট্যুম সম্বন্ধে আমাদের অভিনেতাদের কিছু দেয়নি বোধহয়।

প্রায় পুরোটা ছবি জুড়ে অভিনয় দেখেছি আমি হুমায়রা হিমুর চরিত্রে (অরু আপা)। যদিও প্রথম দিককার ডায়লগগুলো তার ক্ষেত্রেও মেকি লাগছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মেয়েটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তারপরও, প্রেমিকের গুলি খাবার খবরে আহত হয়ে হিমুকে যখন নিজের টালমাটাল শরীরটাকে ধরে রাখার জন্য বেশ কয়েক পা পিছাতে পিছাতে পিছাতে পিছাতে গিয়ে টেবিলে ঠেস দিতে হলো, তখন পরিচালকের অদূরদর্শিতা বড় বেশি স্পষ্ট লাগছিল।

ভালো অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের জোলি ওয়াহিদা মল্লিক জোলি (ইবুর মা)। অভিনয় খুব ভালো লেগেছে ডাক্তার চরিত্রে খলিলুর রহমান কাদেরীর। [বড় ইবুর চরিত্রে] রাইসুল ইসলাম আসাদ খারাপ করেননি, কিন্তু তাঁর ঐ আলগা চুলটা বড় বেশি চোখে লাগছিল। অভিনয় খুব খারাপ করেননি মুরাদ পারভেজও। আবার স্বভাবসুলভ ভালো অভিনয় দিয়ে মন জয় করেছেন [রাজাকার চরিত্রে] গাজী রাকায়েত।

বাস্তবের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ বড় বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে এমন কিছু মুহূর্ত তৈরি করতে হয়, যখন মানুষ সংকটাপন্ন। আর সেই আবহ এনে দেবার জন্য দরকার একটা ধীরস্থির প্লট, যেখানে ক্যামেরা চলবে ধীরে, কাহিনী চলবে ধীরে, প্রত্যেকটা চরিত্র যার যার জায়গায় বড় বেশি একা, ছন্নছাড়া। কিন্তু এই ছবির কাহিনীতে ঘটনার পর ঘটনা আসতেই থাকে। যখন দর্শক কোনো দুঃখের দৃশ্যে চোখ নিবদ্ধ করতে যায়, তখনই দৃশ্যপট পাল্টে গিয়ে গতিশীল দৃশ্য এসে মনকে চঞ্চল করে তোলে।

চরিত্রগুলো চিত্রণ যতটা অসুন্দর হবে বলে মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুন্দর চরিত্রগুলোর অভিনেতা-অভিনত্রীরা। নতুনদের দিয়ে কাজ করিয়ে তারেক মাসুদ অভিনেতা তৈরি করেননি, বরং তৈরি অভিনেতা তুলে এনেছিলেন। আর এখানে মনে হয়েছে, ছবিটা আসলে অভিনেতা তৈরি করার একটা মাধ্যম। হিন্দু বন্ধুটি যেখানে বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ করেই পিছনে হাজির হলেন মুসলমান বেশভুষায় হিন্দু মা, আর বোন। মায়ের কপালের সিঁদুরটা মুছে ফেলাসত্ত্বেয় দেখা যাচ্ছিল তার রেশ না এখানে ভুল ছিল না, ছিল দর্শককে বিষয়টা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা। কিন্তু ছেলে যেখানে ভ্যা ভ্যা করে কাদছিল, মা আর বোন সেখানে শ্রেফ ভাবলেশহীন রোবট। অপূর্ব কৃষ্টিসম্পন্ন অতীতকে পেছনে ঠেলে মুসলমান বেশ ধরতে তাদের যেন বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছিল না।

যখন মিলিটারি প্রথম এসে নামে শহরে, তখন রাজাকার হবার আহ্লাদে এগিয়ে আসেন জনৈক মৌলভি। কিন্তু তাদেরকে বিশ্বাস না করে হানাদাররা গুলি চালায়। কিন্তু বন্দুকটা যখন দক্ষিণ দিকে মুখ করা, তখন পূর্ব দিকে দৌঁড়াতে থাকা রাজাকারের চ্যালা কিভাবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, সেই প্রশ্ন আমি রাখছি পরিচালকের কাছে।

জাফর ইকবাল স্যারের লেখা পড়তে পড়তেই বড় হয়েছি। কিন্তু এখন সেই ধারও বোধহয় কমতে শুরু করেছে। কোথায় যেন বড্ড বেশি রাজনীতি জায়গা করে নিয়েছে সেখানে। “আমি অনিক” বইটির গাজাখুরি গল্পেও যেখানে ছেলেটার সেরা গণিতবিদ হবার বর্ণনা পড়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল, সেখানে আমার বন্ধু রাশেদ-এর মতো ভালো গল্পের বর্ণনা তিনি বড্ড দায়সারাভাবে দিয়ে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ রেখে দিয়েছেন। …একজন কিশোরকে দিয়ে অস্ত্রের কাহিনী বলানোটা অবাঞ্চিত ছিল না, কিন্তু ছিল সেই অস্ত্রটা কিভাবে চালাতে হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়াটা। কিভাবে পিন খুলে হাত ঘুরিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, তা দেখিয়ে কিশোর মনকে মুক্তিযুদ্ধ-সচেতন আর পাকিস্তানবিদ্বেষী করা হয় না, বরং কিভাবে গ্রেনেড ছুঁড়ে কৈশোরেই বোমাবাজ হওয়া যায় –তাও শিখানো হয় – শিশু মনোস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম বিষয়টি কি জাফর ইকবাল স্যারের মতো বিজ্ঞানী এড়িয়ে যাননি?

 

পরদিনই দেখতে বসলাম আংশিক সরকারি অর্থায়নে তৈরি দ্বিতীয় চলচ্চিত্র “গেরিলা”। উইকিপিডিয়ায় পানাম নগর নিবন্ধটার পরিবর্ধন করতে গিয়ে প্রথম জানতে পারি গেরিলা চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হচ্ছে ওখানে। তারপর অপেক্ষা করে ছিলাম ওটা দেখার জন্য।

যখন দেখা শুরু করলাম, স্বভাবতই আমার ক্রিটিক মন সন্দেহবাতিকগ্রস্থভাবে খুঁটতে থাকলো ভিতরে। এবং শুরুতেই দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো না, ২৫ মার্চ রাতের প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ব্যস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকের নল থেকে পটকার বারুদ পুরপুর করে বেরোচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল, ওখানে মেশিনগানের গুলিটা ভাওতা। আবার নজরে এলো ভাষার গানের রচয়িতা আলতাফ হোসেনের স্ত্রীর চরিত্রের অভিনেত্রী নিজের বাম হাতটাকে হাস্যকরভাবে পেটের কাছে বাঁকা করে ধরে রাখেন। শ্রুতিকটু লাগছিল প্রধান চরিত্রের ভাষার রদবদলগুলো- কখনও ঢাকায় প্রচলিত মিশ্র ভাষায় বাকচারিতা, কখনও গ্রাম্যটানে কথা বলা, কখনও খাঁটি শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার; অথচ সর্বত্র এই ভাষার বদলগুলো দৃশ্যের প্রয়োজনে হয়েছে বলে মনে হয়নি। বিলকিসের মা/বাবা যখন মারা যান, তখন ভাই খোকনের ডায়লগও বড্ড মেকি লাগছিল। মামা আলেফ মোক্তার যেখানে খাঁটি গ্রাম্য ভাষায় শিশু বিলকিস আর তার ভাই খোকনের সাথে গল্প করছিলেন, পরের দৃশ্যেই ছোট্ট ঐ দুই গ্রাম্য শিশুর মুখে, “খোকন, সাবধানে, পাখিটা যাতে ব্যথা না পায়” এরকম খাঁটি শুদ্ধ ভাষাও বড্ড মেকি লাগছিল।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ঘটনার বুনন, নির্মাণশৈলী, কাহিনীর ধারাবাহিকতা এবং যৌক্তিক পরিবর্তনগুলো আমার সন্দেহবাতিক মনকে কখন যে টেনে নিয়ে যায় গভীরে, বুঝতে পারিনি। জয়া আহসান সব সময়েরই ভালো অভিনেত্রী। সব ধরণের চরিত্র করতে তাঁর জুড়ি নেই। আবারও তিনি প্রমাণ করেছেন, তাঁর অভিনয়ের প্রতিভা। খুব টেনেছে, যখন একমাত্র ভাই খোকনকে হারানোর পরে মাটিতে পড়ে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেসে যায় বিলকিস বুঁদ হয়ে দেখছিলাম। …অভিনয়ে আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে আসা এটিএম শামসুজ্জামান তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয় দিয়ে বরাবরের মতোই মাত করেছেন এখানেও। অপূর্ব অভিনয় দিয়ে পুরোটা ছবি ধরে রেখেছেন পাকিস্তানী মেজর সারফারাজ ও ক্যাপ্টেন শামসাদ খান দুটো চরিত্রে অভিনয় করা শতাব্দি ওয়াদুদ। আলতাফ মাহমুদকে সঠিকভাবে চিত্রায়ন করতে পেরেছেন কিনা আহমেদ রুবেল, সে তাঁরাই ধরতে পারবেন, যাঁরা তাঁকে বাস্তবে দেখেছেন; তবে আমি বলবো, রুবেল তাঁর চরিত্রের অবমুল্যায়ন করেননি। হিন্দু দুধওয়ালার অভিনয়, অল্পবয়স্ক নারীলিপ্সু রাজাকার যুবকের তীব্র লিপ্সা, বিলকিসের কাজের মেয়ের উর্দু-বাংলায় বাকচারিতা এরকম ছোট ছোট চরিত্রগুলোও মুগ্ধ করে যাচ্ছিল আমাকে। সোজা কথা, চরিত্রগুলোর অভিনয়, যার যার অবস্থান থেকে মুগ্ধ করেই যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে, আমাকে গ্রাস করে নিয়েছিল কাহিনীর গভীরে।

সব শেষে যখন লোবান জ্বালানো ধূপ দিয়ে কালীপূঁজার মতো করে মুসলমান বিলকিস গ্রেনেডের ধূপে সাঙ্গ করে দিলো ক্যাপ্টেন শামসাদের আস্তানা, তার মাঝেই ফুটে উঠেছিল বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ আর সব খোয়ানো বাঙালির দেশ-অর্জনের মহৎ প্রাপ্তিটুকু। আমার শ্রদ্ধা উপচে পড়ে সৈয়দ শামসুল হকের প্রতি, কারণ তাঁর “নিষিদ্ধ লোবান”ই এই চলচ্চিত্রের মূল কাহিনী করা হয়েছে।

আংশিক সরকারি অনুদানসত্ত্বেয় গেরিলার তীব্র আকর্ষণ আর পূর্ণ অনুদানে নির্মিত আমার বন্ধু রাশেদের চুম্বকীয় বিপরীত প্রতিক্রিয়াই আমাকে একপক্ষ নিতে বাধ্য করেছে। তখনই বোধকরি আলাদা করতে পেরেছি, কোনটা অপচয়, আর কোনটা চয়ন। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না, গেরিলা’র নির্মাণে ভারতের বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে ফলাও করে, আমার বন্ধু রাশেদ-এর প্রসেসিং আর প্রিন্টিং হয়েছে ভারতে। তবে একথাও মনে হয়েছে, মোরশেদুল ইসলাম বোধহয় তাঁর সমালোচকদের না শুনলেই ভালো করতেন, কারণ তিনি নাকি ধীরগতির ছবি বানান বলে অনেকেই সমালোচনা করায় তাঁর এই ছবিটাতে গতি এনেছেন। …অপচয় করেছেন। অপচয়।

-মঈনুল ইসলাম

বান্দরবান ভ্রমণ ২০১১ : পর্ব ৪

যে দুজন আমাদের গাড়িতে লিফ্‌ট চাচ্ছিল, তাদের একজন বয়স্ক মানুষ, সাথে একটা ছোট্ট ছেলে। তাদেরকে নেয়ার প্রশ্নই উঠে না, কারণ এরা স্থানীয়। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হলো এরা আসলেই বিপদগ্রস্থ। কারণ, আমাদের গাড়ি যখন নীলাচলে, ঢাল বেয়ে উঠছিল, তখনও এরা আমাদের গাড়ি থামাতে চাচ্ছিল, লোকটার গলায় একটা ঢোল ছিল, আর ছেলেটা নিয়ন্ত্রণ করছিল লোকটিকে। আমার তখনই মনে হচ্ছিল লোকটা অন্ধ। যদিও অন্ধ কেউ ডাকাতদের সোর্স হতে পারবে না এমন কথা নেই, তবু কেন জানি আমি সুপারিশ করলাম এদের জন্য। শাকিল ভাই তাই এদের কারণে কোনো সম্ভাব্য অঘটনের দায়ও আমার ঘাঢ়ে চাপিয়ে দিলেন। শাকিল ভাইয়ের বিন্দুমাত্র দোষ নেই। কারণ আমার একার মায়া দেখানোতে বিপদ হতে পারে নয়জনেরই।

কিন্তু সিনেমার কাহিনীর মতোই জয় হয়ে গেলো মানবতারই: এরা ডাকাততো নয়ই, বরং গায়ক। ঢোল কাঁধে অন্ধ লোকটি ঢোল বাজিয়ে যখন গান ধরলেন, তখন পুরো গাড়ি ঐ ঘুটঘুটে অন্ধকারে নাচছে। গান শেষ হতে না হতেই কখন যে আমরা মূল সড়কে চলে এলাম টেরই পেলাম না, নামিয়ে দিলাম ঐ অন্ধ ঢোলবাদক আর তার সঙ্গী ছেলেটিকে। বড় দরদ ছিল ঐ কণ্ঠে, প্রাকৃতিক পরিবেশে বুদ করে দিয়েছিল আমাকে। মন জুড়িয়ে গেছে আমার। আমার একটা থিওরি হলো, প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতির সন্তান হয়ে যাও, ছুড়ে ফেলো সব ইয়ারফোন, ওয়াকম্যান, এমপিথ্রি। গাছের পাতার নড়াচড়া শোনো, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনো, পাখির মৃদু কুজন শোনো…। তাই ঐ বাদক একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ করে দিয়ে গেছে আমার।

ঢোলবাদক নেমে যেতেই আমি আর-সবার কানাঘুষা শুনতে থাকলাম। জিজ্ঞেস করে তো আক্কেল গুড়ুম: সবাই মিলে আজ রাতেই কক্সবাজার যাবার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে। যেহেতু কালকে হরতাল, বান্দরবান সদরে আমাদেরকে সারাদিন ঝিমোতে হবে, তাই বোচকা-বাচকি তো সাথেই আছে, কক্সবাজার চলে গেলে তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কিভাবে যাওয়া হবে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, বাসের টিকেট কাটা নেই, …বললেই হলো?

বান্দরবান সদরে গিয়ে ভাবলাম গাড়িতেই ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করবো, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার আর গাইড ব্যর্থ হয়েছে আমাদেরকে নীলাচলে রাখতে, টাকা চুষে নিতে, তাই আমাদের প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়েছে। নতুন টিব নিতে হবে অজুহাত দেখিয়ে নামিয়ে দিল দ্রুতই। দ্রুত করতে গিয়ে হারিয়ে ফেললাম আমার ক্যাপটা। ভালোই হয়েছে, এই ক্যাপের জন্য পুরো ট্যুরে আমার ছবিগুলো বিশ্রী এসেছে: যে দেখেছে, সে বলেছে ফারুকীর মতো লাগছে- ওয়াক থুহ!

এদিকে আমি টের পাচ্ছি, আমার জ্বর আসছে, চোখ জ্বলছে, মাথা গরম। শাকিল ভাই, নাকিব, আর ইফতি দৌঁড়ে গেলো বাসের টিকেট করতে। কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন, বাসের টিকেট পাওয়া গেলো না। কিন্তু নাছোড়বান্দারা কি আর প্ল্যান মাটি হতে দেয়? আরেকটা লোকাল বাসের টিকেট করে ফেললো ‘অমুক’ পর্যন্ত (এই জায়গাটার নাম এখন আর কেউই মনে করতে পারছি না, আমিও । সেখান থেকে নাকি কক্সবাজার যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। ব্যস, আঁটোসাটো সীটে ব্যাগগুলো কোলে নিয়ে চাপাচাপি করে বসলাম। অন্য সময় হলে চলে যেত, কিন্তু একে প্রচন্ড গরম, তার উপর আমার গায়ে জ্বর, মনে হচ্ছিল মারাই যাবো। ওদিকে সব পানি শেষ করে ফেলেছে ওরা। আমি আগেই আমার ব্যাগের ছোট্ট বোতলটাতে পানি পুরে নিয়েছিলাম। কারণ, মোবাইলে নামানো একটা সার্ভাইভাল গাইডে পড়েছি সার্ভাইভাল মেডিসিনের মধ্যে সবার আগে হলো পানি। একসাথে অনেক না খেয়ে অল্প করে নিয়মিত বিরতিতে খেয়ে যেতে হবে। আমি জ্বরের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। পা থেকে জুতা খুলে পায়ে ঠান্ডা লাগাতে চাইলাম, কিন্তু গরম গাড়ি থেকে কি আর ঠান্ডা লাগবে? তবে অল্প অল্প করে পানি চালিয়ে যেতে থাকলাম।

গাড়ি চলতেই থাকলো অন্ধকারে। ক্লান্তিতে চোখ লেগে এলো সবার। আমাদের গন্তব্য পর্যন্তই যায় বাসটি, গন্তব্যে গিয়ে নামলাম আমরা সবাই। ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। জ্বর এখনও আছে। ওখানে নেমে পড়লাম মহাসমুদ্রে। কোনো বাসেই সিট নেই। ইফতি, নাকিব আর শাকিল ভাই প্রয়োজনে সবচেয়ে দামি গাড়িতে করে হলেও টিকেট করে ফেলতে রাজি, কিন্তু বাস আমাদের নিতে রাজি হলে তো! দলে দলে ভাগ হয়ে কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলাম সবাই-ই। এখানে মাঝপথে পড়ে থাকলে বিপদে পড়ে যাবো।

কোনো উপায় না করতে পেরে ঠিক করা হলো একটা পিকআপ ভাড়া করে তাতে মালপত্র তুলে চলে যাবো সবাই মিলে। একটা পিকআপকে কথায় নিয়ে আসা গেল, কিন্তু কোনোভাবেই সে ভাড়া কমাতে চাচ্ছে না। আমরা ক’জন ভাড়া প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি, ড্রাইভার প্রস্তুত, এমন সময় শাকিল ভাই এলেন কোথা থেকে, তিনি একটা গাড়ি পেয়েছেন। আমাদের একদল গেলো ঐ গাড়িটা দেখতে।

ঐ গাড়িটা দেখে আমাদের সবারই পছন্দ হয়ে গেলো, যদিও ভাড়া একটু বেশি, কিন্তু নিরাপত্তা আছে এটাতে। কিন্তু ওটা থেকে বিদায় নেয়া যায় কিভাবে, ওখানেও তো কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। শেষমেষ মেঝেতে তেরপলের উপর বসে যেতে হবে- এরকম একটা খোড়া অজুহাত দেখিয়ে মানে মানে কেটে পড়লাম আমরা। গিয়ে সবাই হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম গু-কালার খাঁচার ভিতর।

খাঁচার ভিতর বন্দী সব বাঁদরের দল… (ছবি: আরেক বাঁদর)

হ্যা, এটা একটা স্কুল ভ্যান, হলুদ রঙের। গায়ের লেখা পড়ে বোঝা যায় এটা “লোহাগড়া মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের” বাহন। পুরোটাই একটা বানরের খাঁচা যেন। ভিতরে তিন দিকে সিট, দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। ভিতরে ঢুকেই ড্রাইভারকে রওয়ানা করতে বলা হলো, কোনো রকমে ঝামেলা থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই আমরা। অবশেষে আমরা রওয়ানা করলাম। উচ্ছাসের শেষ নেই সবার মাঝে। হঠাৎ করেই প্ল্যান আর তার বাস্তবায়নে আমরা এখন কক্সবাজার অভিমুখে- ব্যাপারটা সবাইকে আনন্দিত করছে। আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। কয়েকটা কারণ: এক, নাকিব আর শাকিল আজ সকালে এলেও আমি একদিন আগে থেকে খরচ করছি, বাজেটে টানাপোড়েন; বাজেট গড়মিল করা কোনো ব্যাপার না, আলহ্বামদুলিল্লাহ, কারণ এখন চাকরি করছি; কিন্তু তবু ট্যুরে বাজেট ফেল করা আমার ধর্ম না। দুই, আমি আগে একবার কক্সবাজার গিয়েছি; দেখা জায়গা বারবার দেখার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তিন, আমার গায়ে জ্বর- ভালো লাগার জিনিসও ভালো লাগছে না, মুখটা পানসে হয়ে আছে। নাকিব আমাকে কানে কানে বললো, টাকা-পয়সার জন্য ভাবিস না, আনন্দ কর; জীবনে আনন্দের চেয়ে টাকা বড় না। কিন্তু নাকিব যদি বুঝতো, আমার আনন্দ হৈচৈ-এর মধ্যে না, আমার আনন্দ দল বেঁধে ঘোরাঘুরির মধ্যে না, আমার আনন্দ হট্টগোলের মধ্যে না: আমার আনন্দ নির্জনতায়, ছায়ায়, সুবাতাসে, ঝিঁঝিঁ পোকার চিরচির ডাকাডাকিতে…।

গাড়িতে চড়ে বুঝলাম নাকিব কেন এই প্ল্যান করেছে। কক্সবাজারে ওর এক কাযিন আজকে রাতে চেক-আউট করছে ‘হোটেল জিয়া’ থেকে। ফোন করলো তাকে, যাতে তার রুমটা রেখে দেয় আমাদের জন্য। কোনো ব্যবস্থা না হলে সেখানেই থাকা যাবে। কিন্তু হোটেলের ম্যানেজার রাজি হলেন না: একজনের নামে বুক করা রুম আরেকজনকে তিনি দিতে পারেন না। ম্যানেজারতো ঠিকই বলেছেন, এতে আইনী জটিলতাও আছে। তবে হোটেল আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো, আমরা গেলে আমাদেরকে রুমের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।

গাড়িটার গতি কম। খুব একটা দ্রুত এগোচ্ছি না আমরা। পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা-বারোটা বেজে যাবে। এদিকে গাড়ি চলছে নির্জন ঝাউবনের ভিতরকার রাস্তায়, ঘুটঘুটে অন্ধকার দিয়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা-দুটা গাড়ি পাশ কাটায়। নয়-নয়জন মানুষ একত্রে, তবু একটা ভয়, ডাকাতের ভয়, ডাকাত ঘিরে ধরলে জখম করে ফেলবে, মেরেও ফেলতে পারে। তাই ভেতরে কোনো প্রকার আলো জ্বালানো হলো না, অন্ধকারে মৃদু আলোর রেখায় সবাই চেহারা আঁচ করছি। আর পেছন থেকে কোনো গাড়ি, মোটরসাইকেল এলে তার হেডলাইটের আলোয় ভিতরটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমরা তখন ওটাকে পাত্তা না দেয়ার ভান করি, গল্প করার অভিনয় করি, যাতে কেউ ডাকাতি করতে চাইলেও বোঝে এখানে সবাই আলাদা, একত্রে কোনো দল না। আবার ড্রাইভারকেও সন্দেহ করছি আমরা, কিন্তু কিছু করতে পারবে না বলে মনে করছি, কারণ সামনে, ড্রাইভারের সাথে বসেছে আমাদের একজন: ফরহাদ।

এদিকে শাকির করেছে আরেক বুদ্ধি: ইফতির কেনা আনারসগুলো নিয়ে রেখেছে দরজার একেবারে সামনে, যাতে বাইরে থেকে পাতাগুলো দেখা যায়, আর ডাকাত ভাবে, দূউর! খ্যাত! আনারস নিয়া গেয়ো কোনো লোক যাচ্ছে। কিন্তু তাসত্ত্বেয় হঠাৎই গতি কমতে থাকলো আমাদের গাড়ির। সবাই-ই সচকিত হয়ে উঠলাম। গাড়ি একসময় থেমে গেলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে, জঙ্গলের মধ্যে। আমি ফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে…। শিওর, ডাকাতের হাতে তুলে দেবার পায়তারা…।

রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি আমি, অনুভব করছি: গাড়ির প্রত্যেকেই..। ড্রাইভার, গাড়ি থেকে নেমে গেলো রাস্তার ডান দিকে। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম, অন্ধকারে কোনো মানুষের অবয়ব চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু না, কোনো মানুষ নেই। ড্রাইভার এগিয়ে গিয়ে একটা বড় দানবাক্সে কিছু টাকা ফেলে দিলো। তবুও আমি সন্দিহান, আশেপাশে নজর রাখছি, কোনো দিক থেকে যদি আক্রমণ আসে…। শাকিল ভাই আশ্চর্য হলেন, পুরান ঢাকার মানুষ তিনি, পুরান ঢাকায় পীর-ফকির বিশ্বাসী লোকের অভাব নেই, জানেন, ড্রাইভাররাও এগুলো মেনে চলে। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে টাকা দেয়ার ব্যাপারটা ঠিক মেলানো গেলো না।

ড্রাইভার আমাদের প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। তারপর আবার চলা শুরু করলো গাড়ি। সবার মধ্যে আবার প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা দিলো নতুন আপদ- একটা মোটর সাইকেল আমাদের ঠিক পিছে পিছে ধীর গতিতে অনুসরণ করে চলেছে। আমরা যথারীতি ভাব দেখাচ্ছি, আমরা সাধারণ মানুষ। শাকির ঘোষণা করলো, যদি বুঝি ডাকাত, তাহলে একটা একটা করে আনারস গিয়ে পড়বে চান্দিতে। আনারসের মালিক ইফতিরও দেখি একই অভিপ্রায়। কিন্তু আনারসের জুস না খেয়ে কিছুক্ষণ অনুসরণ করে গতি বাড়িয়ে মোটর সাইকেলটা পাশ কাটালো আমাদের।

আমি কিছুক্ষণ এর-ওর গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে-বসে বিশ্রাম করে করে চলছি। মাঝে মাঝেই খুব অল্প একটু পানি গলায় দিচ্ছি। আমাদের সাথে আর কোনো পানি নেই, আমার বোতলটা স্বার্থপরায়ন হয়ে আমিই গলাধঃকরণ করছি। ধীর গতির যাত্রায় বিরক্তি লাগছে সবারই। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার টেনশনে কেউই ঠিক শান্তি পাচ্ছি না।

অবশেষে রাত ১২টার সময় গিয়ে পৌঁছালাম হোটেল জিয়ায়। সংক্ষেপে বলি: সেখানে গিয়ে আমাদের ভালো রুম মিললো না। রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হলো দুটো বড় রুমে: একটাতে পাঁচজন, আরেকটাতে চারজন। শর্ত হলো কালকেই ভালো রুম দেয়া হবে, আপাতত এদুটোতে থাকতে হবে আমাদের। নিচতলার রুম দুটা স্যাঁতস্যাতে। তার উপর বোঝা গেলো একটা হলো তাদের ভাড়ার: নষ্ট টিভিগুলো স্টোর করে রেখেছে ঐ রুমে। মশার ঔষধ আর এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করিয়ে আমরা বেরোলাম খাবারের সন্ধানে। কিন্তু হায়, সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে; রাত তখন বাজে ১টা। একটা হোটেল আমাদের গলাটা কেটে খাওয়ালো। খেয়ে-দেয়ে ঘুম দিয়ে উঠতে উঠতে পরদিন বেলা এগারোটা।

এগারোটা বাজে সব হোটেলে নাস্তা শেষ। শেষমেষ একটাতে নাস্তার ব্যবস্থা করা গেলো। নাস্তা করে হোটেলে ফেরত। হোটেলে এসে শুনি আজম খান মারা গেছেন। শাকিল ভাই টিভি দেখতে লেগে গেলেন ম্যানেজার রুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিত ফিরে পেয়ে আমাদের নতুন রুমের দাবি জানালেন ম্যানেজারের কাছে। মোটাসোটা ম্যানেজার গা করলো না, ‘রুম খালি নাই।’ শাকিল ভাই তর্ক শুরু করলেন, আমি নিরপেক্ষ থাকলাম। কারণ আমার ওস্তাদের শিক্ষা “অচেনা জায়গায় প্রয়োজনে ঝগড়া করতে একজোট হয়ো না, একজন হলেও নিরপেক্ষ থেকো।” কিন্তু টলাতে পারলেন না শাকিল ভাই। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘তাহলেতো আপনারা চিটিং করছেন। আমাদেরকে বলা হলো রুম দেয়া হবে, এখন দেয়া হচ্ছে না। তাহলেতো চিটিং।’ আমাদেরকে যে চীট করা হচ্ছে, ব্যাপারটা কোনোভাবে আবার মানতে রাজি নয় ম্যানেজার।

ইত্যবসরে রুমে ঢুকলেন মোটাসোটা আরেকজন মানুষ, দাঁড়িওয়ালা। শাকিল ভাই তাকে দেখেই খুশি হয়ে গেলেন, ইশারায় বোঝালেন: মালিক। ব্যস, আর যায় কই? মালিকের কাছে সরাসরি ম্যানেজারের ব্যাপারে নালিশ। মালিক জানালেন, উপরে দুটো কাপল-বেড খালি আছে, কাপল বেডে তো আর পাঁচজনের ব্যবস্থা করতে পারেন না? কিন্তু শাকিল ভাইয়ের মুখে বারবার ‘চিটিং’ ‘চিটিং’ শুনে মালিক আমাদের পাঁচজনের জন্য দুটো কাপল-বেড বরাদ্দ করে দিলেন। পাঁচজন, কারণ, শাকির আর ওর বন্ধুরা আজকেই রওয়ানা করতে চায়।

দুপুরে আমরা সবাই একসাথে আনারস খেলাম খুব মজা করে। বান্দরবানের আনারস যে এতো স্বাদের, কল্পনায়ও ছিল না। রেস্টুরেন্টের বয়গুলোকেও ভাগ দিলো ইফতি। আর ইফতির প্রশংসায় সবাই অষ্টমুখ; তবে সত্যিই, ইফতি না কিনলে আমাদের খাওয়া হতো না বান্দরবানের এতো স্বাদের আনারস।

আনারস খেয়ে সরাসরি বীচে। বীচে যাবার সময় আমি তো থ’। কক্সবাজার বেড়াতে যাবার কথা যদি এই জীবনে আর কেউ আমাকে বলেছে, আমি শিওর কষে একটা থাপ্পড় দিব। এ-কী দেখছি আমি কক্সবাজারকে? এখানে দালান, ওখানে দালান, দালানের চিপায় চিপায় পথ। দুটো ঘনবসতিপূর্ণ দালানের মাঝখানের পথ জুড়ে গড়ে উঠেছে ছালাদিয়া বস্তি। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র ময়লা-আবর্জনা-গোবর। আবার কোথাও ময়লা পানির ডোবা, ভাসছে কচুরিপানা। আশ্চর্য হলাম- এটা কি কক্সবাজার, নাকি ঢাকার কোনো বস্তি!

বস্তি শহর থেকে যখন বীচে গেলাম, দেখি বীচে যাবার আগের পথটুকু জুড়ে নিয়েছে বার্মিজ মার্কেট নামক ক্লোন মার্কেটগুলো। মনে হচ্ছে কক্সবাজারটা আসলেই একটা বাজার, বীচ না। বীচে গিয়ে অবশ্য বরাবরের মতোই প্রাণ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু প্রথমবারকার অনুভূতি এবারে আর হলো না, অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। নেমে পড়লাম নোনা জলে। বড় একটা বোর্ডে মোচনপ্রায় চকের আঁচড়ে দেখেছি একদিন আগের হিসাব: এখন ভাটার সময়। ভাটার সময় সমুদ্রে নামতে হয় না- তিন গোয়েন্দা থেকে শেখা। তবু আমরা নামলাম, সময়টা হলো গোসল করার, এখনই যদি না নামি বিকেলে নেমে হবেটা কী?

যা হবার তাই হয়, পানি টেনে নিয়ে যেতে চায় সমুদ্রগর্ভে। আমরা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখি যথাস্থানে, যথাসম্ভব। পানির তোড় সে কী তোড়! অসম্ভব শক্তিশালী। আগের অভিজ্ঞতাটা পড়লেই আপনারা মোক্ষম ধারণা পাবেন। ওদিকে শাকিররা কোথায় জানি চলে গেছে, হয়তো ওদিকটাতে, মেয়েদেরকে নিজেদের সাঁতার-কীর্তি দেখানোর জন্য!! আর শাকিল আর নাকিব শুরু করেছে বালি দিয়ে কিছু একটা বানানোর। যা-ই বানায়, অশ্লীল কিছু একটা হয়ে যায় –হাসতে হাসতে গড়াগড়ি ওরা।

আমি আর ইফতি তখন জলযুদ্ধের যোদ্ধা। এদিকে প্রিয়মের জীবনের প্রথম সমুদ্রস্নান, বেচারা ভয়ে কাবু হয়ে আছে, সামনে এগোতেই চায় না। গোসল শেষ করে নোনাবালুজলে স্নান শেষে হোটেলে ফিরে গোসল করে নোনাজল সাফ করলাম সবাই। শাকিরদের কোনো খবরই নেই। অনেক পরে এলো ওরা; ওরা নাকি অনেক দূরে চলে গিয়েছিল গোসল করতে।

সেদিন বিকেলেই শাকির, ফয়সাল আর আব্দুল্লাহ রওয়ানা করলো সিলেটের উদ্দেশ্যে। তখনও হরতাল শেষ হয়নি, ওরা চায় তখনই চট্টগ্রাম চলে যেতে। ওখান থেকে ট্রেনে যাবে সিলেটে। ফরহাদ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওয়ানা করবে সরাসরি বাসযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার থেকে পরদিনের টিকেট করেছি আমরা বাকি পাঁচজন। তাই বিকেলে হেঁটে বেড়ানোর অভিপ্রায়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে সার্কিট হাউজে, তারপর আবার বীচে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা…।

সার্কিট হাউজ থেকে দূরে চোখ পড়লে দেখি এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য: পাহাড় কেটে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে একঝাঁক লোক; খুব কষ্ট হলো। মানুষ যদি বুঝতো এই পাহাড়ের মর্ম, তাহলে এটা ভুলেও করতে পারতো না। এবার কক্সবাজারে এসে মন ভালো হওয়াতো দূরের কথা, মন খারাপ হওয়ার অনেকগুলো বিষয়ই ভিড় করেছে আশেপাশে। নির্মীয়মান বিল্ডিং, ময়লা-আবর্জনা, ফ্ল্যাট-হোটেলের ছড়াছড়ি আর খাবার হোটেলগুলোতে গলা-কাটা-দাম আপনাকে স্বাগত জানানোর বদলে ঘাঢ়-ধাক্কা দিতে চাচ্ছে।

যাহোক সার্কিট হাউজে ঝোলানো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করেও ছবি তুললাম আমরা কিছু। তারপর ওপাহাড় থেকে নেমে চললাম বীচে। সেখানে গিয়ে দেখি সূর্য ডুবে গেছে মাত্র। প্রায়ান্ধকারে কিছু ছবি তুলে আমরা চললাম কক্সবাজার শহরে, বার্মিজ মার্কেট থেকে বাসার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। একটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে শহরে চললাম। সেখানে বার্মিজ মার্কেটে যে-যার মতো পছন্দের কিছু খুঁজতে থাকলাম। বার্মিজ আচার, পোশাক আর মুলতানি মাটি ইত্যাদি কমন বিষয়ের বাইরেও কিছু খুঁজতে থাকলাম। দোকানের রাখাইন মেয়েগুলো তাদের চেহারা বিকিয়ে পণ্য বিক্রয়ে ব্রতী, কোনো কোনো দোকানে পুরুষ দোকানদারও আছেন। কোনো কোনো দোকানে গিয়ে বাঙালি মেয়েও দেখা যায়, তবে পোশাকে-আশাকে তাদেরকেও রাখাইনই মনে হয়। নাকিব আর শাকিল ভাই সুযোগ পেলেই তাদের রাখাইন ভাষার স্বল্প পুঁজি দিয়ে অভিবাদন জানায় রাখাইনদের:

মানামি যালে :: তোমার/আপনার নাম কী?

শিকো বাঁয়া :: বিদায়

একটা দোকানে ঢুকলাম আমরা, এক যুবতি আর ছোট্ট একটি মেয়ে বসে আছে। আমি সে দোকান থেকে বোনের জন্য চুলের একটা ছোট্ট ব্যান্ড কিনলাম। শাকিল ভাই ছোট্ট মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানামি যালে’। প্রশ্ন শুনে সাথের যুবতি তো আশ্চর্য, বাংলায় বললো, ‘আপনি আমাদের ভাষা কিভাবে জানেন?’ শাকিল ভাই জানালেন, অল্পস্বল্প শিখেছিলেন এক রাখাইন দোকানীর কাছে। ওদিকে পিচ্চি মেয়েটা কিন্তু তার নাম বলে ফেলেছে। মনে নেই নামটা কী ছিল। যুবতি জানালো পিচ্চি মেয়েটি তার ছোট বোন। পিচ্চির চেহারাটা খুব সুন্দর! এবারে পিচ্চি তার বোনকে রাখাইন ভাষায় কিছু বললো, আমরা কিছুই বুঝলাম না। যুবতি, শাকিল ভাইয়ের অনুরোধে অনুবাদ করে দিলে, শুনে, লজ্জায় লাল হলাম আমরাই, শাকিল ভাই বোধহয় আরেকটু বেশি লজ্জা পেলেন। মেয়েটি নাকি জানতে চেয়েছে, ‘আপনার মেয়ের নাম কী?’ শাকিল ভাই হাসতে হাসতে জানালেন, তিনি বিয়েই করেননি। প্রশ্নটা কি আদৌ ঐ মেয়েটা করেছিল, নাকি যুবতির কোনো ট্রিক্‌স ছিল, সেটা অবশ্য রহস্যই রয়ে গেলো।

এদিকে আমি আমার বোনের জন্য জুতা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। সুন্দর, আকর্ষণীয় জুতা চোখেই লাগে না, সব গৎবাঁধা নকশার। অবশেষে একটা দোকানে গিয়ে পছন্দ হয়ে গেলো, কিন্তু নাছোড়বান্দা রাখাইনরূপী বাঙালি মেয়েটি কোনোভাবেই দাম কমাতে চাইছে না। শেষ পর্যন্ত চলে আসতে বাধ্য হলাম। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে আর ওরকম জুতা কিছুতেই পাচ্ছিলাম না, তাই ঐ দোকানে গিয়ে আবার শেষ একটা দাম বলে এলাম, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই আর নামতে রাজি না। শেষে সে বলেই ফেললো, ‘আমি আর কমাতে পারবো না, আপনাকে পছন্দ হয়ে গেলো বলে এতোটুকু কমালাম’। বয়স কম হয়নি, এটা যে পটানি কথা -তা বুঝতে পিএইচডি করা লাগে না। চলে এলাম দোকান ছেড়ে। কিন্তু জুতার জন্য এতো ঘুরাঘুরি করেছি, আর শরীরে কুলাচ্ছে না, একটু বেশি দিয়েও ঐ জোড়া কিনে নেবার জন্য যখন ঐ দোকানের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন মেয়েটা পাশের দোকানের রাখাইন মেয়েটির গায়ে ঢলে পড়ছে, আর আস্তে করে বলছে, ‘আমি জানি, তুমি আসবা।’ তারা যে অর্থে বলছে, আমি যে সে অর্থে যাচ্ছিনা, সেটা আর ভাঙানো হলো না। মেয়েটাকে হাস্যোজ্জল রেখে আমরা এবারে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরোলাম।

পেট পুরে খেয়ে দেয়ে আরেকটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে হোটেলে ফিরলাম। সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করেছে ইফতি, দুহাত উপচে পড়ছে তার: বোন, দুলাভাই, ভাগ্নে, ভাগ্নি সবার জন্য কিনেছে উদারভাবে। হোটেলে ফিরে রাত একটার দিকে আবার বেরোলাম আমরা। এতো রাতেই একবার সৈকতে যাবো আমরা। দুটো রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা। সৈকতে গিয়ে দেখি, দিনের বেলা ভাড়া দেয়া ঈযি চেয়ারগুলো খালিই পড়ে আছে। জোয়ার এসেছে সমুদ্রে, প্রচন্ড আওয়াজ করে পানি আছড়ে পড়ছে সৈকতে। বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দূরে কোথায় মেঘ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টির আশা করলেও বৃষ্টি এলো না। তবে এই নির্জনতাটুকু খুব উপভোগ করলাম সবাই।

হোটেলে ফিরে ঘুম। ভোরে উঠে নাস্তা। তারপর শ্যামলী পরিবহনের বাসে চড়ে ঢাকা রওয়ানা। পথ ফুরোতেই চায় না। পথে বিভিন্ন স্থানে দেখছিলাম বিভিন্ন সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের বন্দর সংলগ্ন এলাকায় জাহাজের বিশালাকার সব লোহার যন্ত্রপাতি; কুমিল্লায় দেখলাম ভোটের সাজে সেজেছে এলাকা, কারণ তখন চলছিল পৌরসভা নির্বাচন; আবার কুমিল্লা পার হতেই রাস্তার পাশে সবুজ কিসের ক্ষেত যেন: পরে বুঝলাম ভুট্টার ক্ষেত, হলুদ রঙে উদ্বেল কোনো কোনো কৃষাণের উঠান। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার-লেনের মহাসড়কের কাজ কিছুই হচ্ছেনা, মাটি ফেলে দেখানো হয়েছে- ‘এতোবড় হবে’ রাস্তা, কিন্তু কোনো যন্ত্রপাতিও নেই আশেপাশে।

ঢাকার কাছাকাছি এসে দেখি নদী থেকে ড্রেজ করে বালু রাখা হয়েছে স্তুপ করে, কিন্তু সেখানে আসলে দেখার মতো কিংবা শেখার মতো কিছু আছে। ড্রেজ করার মুহূর্তে বালু থাকে পানিপূর্ণ, মানে পিচ্ছিল। এই বালি যতই পাম্প করা হোক, তা পিছলে সরে যাবে, স্তুপ তৈরি হবে না, স্থান জুড়বে বেশি, অনেক বালির অপচয় হবে। তাই কিছুক্ষণ বালি পাম্প করে তার উপর বিছিয়ে দেয়া হয় একটা বিশাল পলিথিন। তারপর আবার পাম্প করা হয় বালি। তারপর আবার পলিথিন। তারপর আবার গলিত বালি। এভাবে অল্প অল্প বালির স্তুপ মিলে তৈরি হয় বিশাল টিলার মতো স্তুপ। পদ্ধতিটা আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। অবশ্য পুরো প্রক্রিয়া দেখার সৌভাগ্য হয়নি। চলন্ত পথে মোবাইল দিয়ে তুলে নেয়া ছবি ঘেঁটে এই তথ্য আবিষ্কার করলাম।

7 maynamati war cemetery (shakir)
ময়নামতি ও’আর সিমেট্রিতে নীরবে, নিভৃতে শায়িত সব ধর্মের মৃত যোদ্ধারা (ছবি: শাকির আহমেদ)

আমরা যখন ঢাকার পথে, ওদিকে আগের দিন রওয়ানা করা শাকিররা তখন যার যার বাড়িতে পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও তারা তখন কুমিল্লায়। আগের দিন রওয়ানা করেও চট্টগ্রাম শহর থেকে পায়নি ট্রেনের টিকেট, পায়নি বাসেরও। অগত্যা রাত কাটিয়েছে চট্টগ্রাম শহরে, হোটেলে। পরদিনও কোনো টিকেট না পেয়ে এসেছে কুমিল্লায়। সেখান থেকে ধরেছে সিলেটের বাস। তবে বাড়তি হিসেবে ওরা দেখেছে কুমিল্লার ময়নামতি ওআর সিমেট্রিতে। শাকিরের জন্য ভালোই হয়েছে, এই জায়গাটা ওর দেখা ছিল না। আমি অবশ্য নটর ডেম কলেজ আউটওয়ার্ড বাউন্ড এ্যাডভেঞ্চার ক্লাব থেকে ২০০৩-এ একবার ঘুরে গিয়েছিলাম। তবে শাকিরের ডিজিটাল ক্যামেরায় আমার কাঙ্ক্ষিত কিছু মূল্যবান ছবি এসেছে বলে শাকিরকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় ছিল না।

একসময় ফিরে এলাম ঢাকায়। জ্যাম দিয়ে স্বাগত জানালো যাত্রাবাড়ি মোড়। ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে যেতে রোমন্থন করছিলাম নীলগিরির সেই আকাশনীলা অনুভব আর জীপের উপর মাথা বের করে দেয়া উচ্ছল তারুণ্যের মাঝে নত হয়ে যাওয়া বিশাল পাহাড়সারিকে। বড় অসহ্য লাগছিল এই শহরটাকে। কিন্তু জীবিকার জন্য আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনো বিকল্পই ছিল না। অগত্যা, শিঘ্রই আবার বেদুঈন হয়ে যাবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হারিয়ে গেলাম ভিড়ের মধ্যে…।

(সমাপ্ত)

-মঈনুল ইসলাম

আবহমান বাংলার গ্রাম: পরিচিতি

ভারতের দিল্লী থেকে বন্ধুবর অমিত রায় বাংলাদেশের গ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে যদি সেখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে, তাহলে বাংলাদেশী হওয়াসত্ত্বেয় আমার এবিষয়ে না লেখায় আশ্চর্যের সীমা থাকে না। তাই দেরিতে হলেও বাংলাদেশের তথাকথিত ৬৫,০০০ গ্রামের-খুব-অল্পটাই-দেখা-এই-আমি এই লেখায় ব্রতী হলাম। এজন্য যাবতীয় কৃতিত্ব অবশ্যই অমিত রায়ের। কিন্তু আমি আসলে হাবুডুবু খাচ্ছি, কী রেখে কী লিখব। তবু কিছু লেখার প্রয়াস। যেহেতু লেখার আছে অনেক কিছু, তাই কখনও কখনও লেখা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আবর্তিত হতে পারে -আগে থেকেই ক্ষমা চাচ্ছি।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জাতিটির জন্ম কোথা থেকে হয়েছে? উত্তরটা খুব সহজ: কোনো এক নদীর তীর থেকে। এমনকি আধুনিক বস্তুবাদী বিজ্ঞান [বাইবেলের বর্ণনাকে প্রামাণ্য ধরে] পৃথিবীর আদি মানব-মানবীর (আদম-হাওয়া:Adam-Eve) বাসস্থানকে স্বর্গে নয়, বরং এই পৃথিবীতেই আবিষ্কার করছে। এবং মজার ব্যাপার বিজ্ঞান বলতে চাইছে Garden of Eden (স্বর্গোদ্যান) আসলে মধ্যপ্রাচ্যের চারটি প্রাচীন প্রধান নদী পিশ’ন (Pishon), গিহন (Gihon), তাইগ্রিস (Hidekel) ও ইউফ্রেতিস (Phrath)-এর তীরেই অবস্থিত (পিশ’ন আর গিহন বাইবেল বর্ণিত দুটি নদী, তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিসের বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণিত)। যাহোক, সেই নদীর তীর থেকে উদ্ভূত মানুষগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো গুহায়, পাহাড়ে, পর্বতে, বনে। সুতরাং উন্মুক্ত, নদীবিধৌত প্লাবন সমভূমির মানুষগুলো যখন গাছপালা আচ্ছাদিত পাহাড়, বনে গেলো, তখন স্বভাবতই তারা সেগুলোকে জংলা, জঙ্গল ইত্যাদি উপধায় ব্যাখ্যা করে ফেললো। তারা জঙ্গল পরিষ্কার করা, গাছ কেটে সাফ করাকেই নিজেদের কাজ মনে করলো। সেকারণে বনে বাস করলেও সভ্যতার কিংবা সভ্য জাতির একটা নিদর্শন হলো “জঙ্গল সাফ করা”, মানে লতা-গুল্মজাতীয় গাছ-গাছড়াসহ বাড়ির উঠান থেকে গাছ কেটে সাফ করা, পাহাড় কেটে সমান করা।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ, কথাটার মানে হলো নদী এই দেশের সব জায়গায়ই আছে। এমনকি সবচেয়ে শহুরে অঞ্চল রাজধানী ঢাকাও বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। প্যাঁচিয়ে থাকা নদীর এই দেশে মানুষ তাই নদীকে ঘিরেই নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছে। আর নদী থেকে যারা দূরে আছে, তারা আছে পাহাড়ে, বনে, বিস্তীর্ণ মরুময় এলাকায়ও (তবে সেগুলো মরুভূমি নয়)।

এই দেশের গ্রামই এই দেশের মূল ক্ষেত্র, সেখান থেকেই উত্থান ঘটেছে আজকের বিবর্তিত জাতির, যারা আজ গর্ব করে নিজেদেরকে “শহুরে” বলে। সেই গ্রামের সংস্কৃতি আবর্তিত হয়েছে এই দেশের ইতিহাসের সাথে সাথে। আর্য জাতির পরে এই দেশে বৌদ্ধদের আগমন ঘটেছিল। বৌদ্ধ ধর্মের দাপটকে দমিয়ে দিয়ে একসময় আসে হিন্দু রাজত্ব, বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত না হয়ে বিবর্তিত হয়ে স্থান করে নিল হিন্দুত্বের ছত্রছায়ায়। তারপর সেই হিন্দুধর্মের দাপট চললো দীর্ঘদিন। এরপর এলো মুসলমান শাসন, আবারো হিন্দু ধর্ম বিলুপ্ত না হয়ে বিবর্তিত হয়ে স্থান করে নিল [আরবীয় মৌলিক ইসলাম নয় বরং] ইরান-ইরাক থেকে আসা সুফিবাদী ইসলামের ভিতর। এমনকি ধর্মের দোহাই দিয়ে পরবর্তিতে ইংরেজরা এদেশকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট পাকিস্তানের ভিতরে রেখে দিয়েছিল। ইংরেজ আমলে আবার খ্রিস্টান ধর্ম প্রসার পেতে থাকে গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশনের মাধ্যমে। কিন্তু তাসত্ত্বেয় হিন্দুধর্ম আর ইসলামই এখানে বেশি দাপট দেখিয়ে গেছে। হিন্দুধর্ম আর ইসলামের দাপটসত্ত্বেয় কিছু বৌদ্ধ, কিছু হিন্দু, কিছু খ্রিস্টান এখানে টিকে থাকলো সব সময়ই। তাই এই দেশে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান আর মুসলমানদের এক অপূর্ব সম্মিলন দেখা যায়। যদিও মুসলমানই (ধর্মকর্মে না হলেও নামে অন্তত) এদেশে সংখ্যাগরিষ্ট। এর পাশাপাশি সুর্যবাদ, শিখ ধর্ম, জৈন ধর্ম, কিংবা আদীবাসীদের স্ব স্ব ধর্মও সমানভাবে ছিল, আজও কিছু মরে গেছে, কিছু আছে। ধর্মের এই টানাপোড়েনে এই দেশের আবহমান কালের গ্রামের সংস্কৃতির অনেকটাই আবর্তিত হয়েছে, আজও হচ্ছে।

শহরের মানুষগুলো যেখানে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে অভ্যস্ত, সেখানে গ্রামের মানুষগুলো আজও বাংলা পঞ্জিকা মেনে চলে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এগুলো স্বীয় আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেলেও সেগুলো বাংলা পঞ্জিকাই। এই দেশে এখন যে ছয়টি ম্রীয়মান ঋতু আছে, সেই ছয়টি ঋতু আবহমান কাল থেকে এই দেশটাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। এদেশের পাঠ্যবইতে ছয়ঋতুর যে ছবিগুলো আঁকা থাকে সেগুলো একসময় ঠিক এমনটাই বাস্তব ছিল:

গ্রীষ্মকাল (বাংলা বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস জুড়ে): প্রচন্ড রোদ, পানির স্তর অনেক নিচে, নদীর পানি শুকিয়ে কাঠ, মাটি ফেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, কিন্তু তখনই গাছে গাছে পাকে মৌসুমী ফল আম-জাম-কাঁঠাল, কাঁঠাল এই দেশের জাতীয় ফলও বটে। গ্রীষ্মের শেষ ভাগে মাঝে মাঝেই বিকেল বেলা উত্তপ্ত ভূমি বায়ুর তীব্র ছোটাছুটির কারণে ধেয়ে আসে এক প্রচন্ড ঝড়: কালবোশেখী বা কালবৈশাখী।

বর্ষাকাল (বাংলা আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস জুড়ে): কালবৈশাখী ছোটাছুটি করতে করতেই আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে যেতে থাকে। প্রচন্ড আওয়াজে বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশ ভেঙে নামে ঝুম বৃষ্টি। ফেটে যাওয়া মাটি আবার জোড়া লাগে, নদীর পানি বাড়ে, গাছের প্রাণ ফিরে আসে, জমিতে জমিতে লাগে চাঞ্চল্য। আবার কখনও দেশের ভিতরে কিংবা ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে নদীগুলো বিপুল পানি নিয়ে যেতে পারেনা, উপচে পড়ে পানি, দেখা দেয় বন্যা। বন্যা একদিকে যেমন রোগব্যাধী আর পানির কষ্টে মানুষকে ভোগায়, ফসল নষ্ট করে ভোগায়, তেমনি আরেক দিকে উজাড় করে দিয়ে যায় উজান থেকে বয়ে নিয়ে আসা পলি মাটি। এই পলি মাটির উর্বরতা বাকি ঋতুগুলোতে ফসলের বাধভাঙা উৎপাদন দিয়ে সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

শরৎকাল (বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন মাস জুড়ে): পরিষ্কার আকাশ। সেই নী–ল আকাশে সাদা সাদা মেঘগুলোতে সূর্যের আলো ঠিকরে তৈরি করে অপূর্ব এক আলোকচ্ছটা, উজ্জ্বল আলোয় ভরিয়ে থাকা দিনে তখন থাকে মৃদু বাতাস, প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়া সেই বাতাসে কখনও গান গেয়ে ওঠে আবহমান বাংলার চাষীরা।

হেমন্তকাল (বাংলা কার্ত্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে): প্রচন্ড গরমে বাংলার প্রধান ফসল ধান পেকে গেছে মাঠে মাঠে। সোনালী-হলুদ সেই রঙে তখন পুরো গ্রামটাই যেন স্বর্ণভাণ্ডার হয়ে যায়। বাতাসে ধানে ধানে ঘষা লেগে অপূর্ব এক সুর বাজে, যা আজ এই যান্ত্রিক [কানে ইয়ারফোন লাগানো] জীবনে কেউ আর শোনে না। ঘরে ঘরে তখন ফসল তোলার ধুম। সেখানেও বিচিত্র সব আয়োজন।

শীতকাল (বাংলা পৌষ ও মাঘ মাস জুড়ে): গরমের এই দেশে কোথা থেকে যেন ধোয়ার মতো কুয়াশা ধেয়ে আসে। দেখতে না দেখতেই ঠান্ডা লাগতে থাকে, মাঘ মাসে সেই ঠান্ডা তীব্র হয়ে পড়ে। শীতপ্রধান দেশের মতোই গাছগুলো ন্যাড়া মাথা হয়ে যায় পাতাশূণ্য হয়ে, কিন্তু তুষারপাত হয় না। তখন চাদর মুড়ি দিয়ে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে শুরু হয় আরেক উৎসব: খেজুর গাছ থেকে রস তুলে নিয়ে ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠা, সে আরেক মহা উৎসব: পিঠা উৎসব।

বসন্তকাল (বাংলা ফাল্গুন ও চৈত্র্য মাস জুড়ে): শীত যখন জেঁকে বসতে চায়, ঝিমিয়ে দেয় গ্রাম্য জীবন, তখন আবার সূর্য বেরিয়ে আসে আপন মহিমায়, কিন্তু পৃথিবীতে তখনও ঠান্ডার আমেজ থাকে, পাক্কা নাতিশীতোষ্ণ, মানে না-শীত-না-উষ্ণ অবস্থা বিরাজ করে সর্বত্র। তাই এই সুযোগে শীতে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া গাছে গজায় নতুন কুঁড়ি, গাছে গাছে ফোটে নতুন ফুল, পাখিরা-প্রজাপতিরা পেতে শুরু করে খাদ্য। প্রকৃতি যেন তার রূপ মেলে ধরে।

…তারপর একসময় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে ঠান্ডা বাতাসটুকু, আবার ঘুরে আসে প্রচন্ড তাপময় গ্রীষ্মকাল।

গ্রাম মানেই কাচা ঘর। কাচা ঘর মানে হলো: মাটি, বাঁশ, কাঠ, ছন, খড় ইত্যাদি দিয়ে  তৈরি ঘর। তারপর সেখানে জায়গা করে নিতে থাকে টিনের ঘর। এখন গ্রাম যেখানে মফস্বল হবার পথে, সেখানে সিমেন্টের ঘর দেখা দিচ্ছে, সিমেন্টের ঘর-দালান জায়গা করে নিচ্ছে গ্রামে-গ্রামে। গ্রামে-গ্রামে সবজি চাষ, গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগি-তিতির-কবুতর পালন, মাছ চাষ গ্রাম-বাংলার স্বাভাবিক চিত্র।

কত আর বলবো? পরিচিতি দিতে গিয়েও দেখি একটা বই হয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছুই লেখা হয়নি। আর কথা না বাড়িয়ে আজকের মতো বাদই দেই বরং। অনেক পরিচিতি হয়েছে। বাকি পরিচিতিটা আমরা সামনের দিনগুলোতে দেখবো, ইনশাল্লাহ।

চলবে…

-মঈনুল ইসলাম

wz.islam@gmail.com

ট্যুর টু বান্দরবান (মার্চ ২০০৮)

ভ্রমণ: বান্দরবান ও কক্সবাজার

:: উদারতার মহাতটে ত্রয়ীর পদচিহ্ন ::

আমার ঘরকুনো স্বভাবটাকে বেদুঈন স্বভাবে পাল্টে নিতেই কিছুটা জিদের বশবর্তী হয়ে উদ্যত হয়েছিলাম রাঙামাটি আর বান্দরবান ঘুরে দেখবো বলে। বন্ধুদের একেকজনের নানা কাজ, কেউই গেলো না। একমাত্র নাকিব রাজি: সে যে যাবে সেকথা বলাই বাহুল্য। আমার এই বন্ধুটি আনন্দে থাকাটাই জীবনের ব্রত করে নিয়েছে। ওদিকে আমাদের পরিচিত এক বড় ভাই (এক বছরের সিনিয়র) হাসান ভাইয়ের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কোথাও যাবার জন্য উদগ্রীব। আরো ক’জনের মৌন সম্মতিসত্ত্বেয় শেষ পর্যন্ত সবাই পিছলে গেল। যাত্রাকালে আমরা তিনজনই: আমি, [বন্ধু] নাকিব, আর হাসান ভাই।

অভিযাত্রী দল ছোট হবার কষ্টে মন ব্যথিত হওয়াসত্ত্বেয় পত্র-পত্রিকা আর ওয়েবসাইটের তথ্য, অমুক-তমুকের অভিজ্ঞতার গল্প, নিজেদের গ্রাম আর শহরের অভিজ্ঞতা আর প্রচণ্ড উৎসাহ পূঁজি করে আমরা রওয়ানা করলাম ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ রাতে। আমাদের জনপ্রতি বাজেট মাত্র পনেরশ টাকা; আর পাঁচশ টাকা বিপদাপদ সামলাতে রিযার্ভ। চট্টগ্রামমুখী তূর্ণা এক্সপ্রেসে (জনপ্রতি ১৫০/-) রওয়ানা করলাম। তিনজনের সিট, তাই ছন্নছাড়া ছিল।

ট্রেনে বসেই আমাদের পূর্ণাঙ্গ প্ল্যান ঠিক করে নিলাম। বান্দরবানে বাড়ি এরকম এক ব্যক্তির (একরাম সাহেব) সাথে যোগাযোগ করে তাঁর ফোন নাম্বার নেয়া হয়েছে, তিনি জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি দূরে, বান্দরবান কাছে। তাই আমরা বান্দরবান যাবো ঠিক করলাম, সেখান থেকে পরে রাঙামাটি হয়ে সরাসরি ঢাকা ফিরবো। যদিও কক্সবাজার যেতে পারলে ট্যুরটা সম্পূর্ণ হতো, কিন্তু অর্থস্বল্পতায় সে পরিকল্পনা বাদ দিলাম সচেতনভাবে। ট্রেনে খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার পরিকল্পনা করলাম, যাতে পরদিন পূর্ণোদ্যমে বান্দরবান আস্বাদন করা যায়। ঘুম থেকে উঠে ট্রেনেই জীবনে এই প্রথম চাঁদ দেখে দিক নির্ণয় করে ফযরের নামায পড়লাম। মনে মনে আদিম মানুষের সমকক্ষ হতে পেরে অভিযাত্রী হিসেবে খানিকটা আন্দোলিতও হলাম।

পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়ও দেখলাম, আর পাহাড়ের রূপে নতুন করে মুগ্ধ হলাম। আমি সিলেটের মানুষ হিসেবে প্রচুর পাহাড় সারা জীবনই দেখেছি, তবে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম: অনেক উঁচু। এমন সময় হাসান ভাই বের করলেন তাঁর ‘রেড আই’। সামনের দিকে লাল উত্তল কাচসমৃদ্ধ একটা দারুণ দূরবীণকে হাসান ভাই এই নাম দিয়েছেন। ওটা আমাদের দৃষ্টিকে আরো প্রসারিত করে দিলো অপূর্ব ক্ষমতায়। এছাড়াও নাকিবের Sony-DSC-H2মডেলের একটা ডিযিটাল অপটিক্যাল 12xযুম ক্যামেরাও আমাদের সাথে রয়েছে; সেটার ঝকঝকে ছবির অপেক্ষায় আছি আমরা।

চট্টগ্রাম স্টেশনে নামলাম। এই স্টেশন হয়ে এতো এতো পর্যটক আসেন, অথচ এই স্টেশনটার এই পুরোন জীর্ণ চেহারার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। খরচ কমিয়ে আনতে ছাপড়া হোটেলে নাস্তা সারলাম। তারপর একটা বেবিটেক্সীযোগে (৪০/-) চললাম বহদ্দারহাট বাসস্টেশনে, সব বাসস্ট্যান্ড শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে পূর্বাণী, পূরবী যায় বান্দরবানে; আমরা পূর্বাণীর টিকেট কেটে (জনপ্রতি ৬০/-) বাসে চড়লাম। আমাদের বাক্স-পেটরা অনেক: আমার একটা পিঠে ঝোলানোর ব্যাগ, ছোট্ট একটা বহনযোগ্য বিছানা, হাতে বড় একটা পলিব্যাগে পানির বোতল ইত্যাদি; নাকিবের বড় স্যুটকেস, গীটার; হাসান ভাইয়ের একটাই ছোট পিঠ-ব্যাগ (মোবাইল মানুষ!)। বাসেই এক ব্যক্তি আমাদের জানালেন, আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বান্দরবান আসছেন, তিনি আর্মি’র পরিচালিত ‘নীলগিরি’ মোটেলে উঠবেন। তারপর ইনি রূপকথার গল্পের মতো করে প্রাসাদোপম নীলগিরির সৌন্দর্যের গল্প করলেন; রূপকথায় আমি বিশেষ মজা পেলাম।

বাস চলছে, তবে টিকেট-বাস হিসেবে নন-স্টপ নয়, পথে পথেই মানুষ তুলে নিচ্ছে। কর্ণফুলী সেতু পার হয়ে চান্দগাঁও, বাকলিয়া হয়ে তৈলারদ্বীপ সেতু ডানে রেখে বায়ের রাস্তা ধরে শান্তির হাট ছুঁয়ে কক্সবাজার রোড ধরে, পটিয়া পৌরসভা পার হয়ে কেরাণিহাট (রাস্তার মাথা) পার হয়ে বিডিআর-এর প্রশিক্ষণ এলাকা কাম ক্যাম্পে (RTC&S) এসে বাস থামলো; বিডিআর-এর চেকআপ হলে আবার চলা শুরু। আঁকা-বাঁকা রাস্তা সিলেটেও আছে, তবে এতো উঁচু-নিচু রাস্তা সত্যিই নতুন। নাকিব ব্যাপারটার মধ্যে রোলার কোস্টারের আনন্দ খুঁজে পেলো; তার উদ্যমে আমরাও উৎরাই পেরোতে গিয়ে মুখ দিয়ে আআআ… বলে মৃদু চিৎকার করে মজা লুটলাম: যেন রোলার কোস্টারে চড়ে নিচে নামছি, আর আমাদের আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছে…। বাজালিয়া, সূয়ালক, মেঘলা হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পরে বিশাল বিশাল পাহাড়ি ইউ-টার্ন দিয়ে বাস গিয়ে থামলো পাহাড়ের বুক কেটে তৈরি করা বাসস্ট্যান্ডে। একরাম সাহেবের নির্দেশানুযায়ী বাস থেকে নেমে রিকশাযোগে (১০/-) চললাম প্রেস ক্লাবে। প্রেস ক্লাবের উপরের ‘গ্রীণহিল’ হোটেল নাকি বেশ স্বস্তা, দেড়শ টাকা করে ডাবল বেড পাওয়া যাবে।

গুঁটি গেলো উল্টে, ফকরুদ্দিন সাহেব বান্দরবান গিয়ে আমাদের বাজেট ঘাঁটতির সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেন। তাঁকে কভার করতে সব সাংবাদিক গিয়ে উঠেছেন বান্দরবান শহরে, হোটেলের রুম খালি নেই। একরাম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তিনি ওয়ারিদ নাম্বার দিয়েছেন, বান্দরবানে র‌্যাঙ্কসটেল আর টেলিটক সচল। অবশেষে আমরাই খোঁজ-খবর নিয়ে অনন্যোপায় হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় (৩০০/-) গ্রীণহিলে উঠলাম: অফপিক সীযনে পিক সীযনের ভাড়া গুণতে হলো। রুমের অবস্থা যাচ্ছেতাই, তবে রাত কাটানোর জায়গা যে পাওয়া গেছে, তাতেই খুশি আমরা।

যোহরের নামায শেষে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া সারলাম আমরা, হোটেল খুঁজতে গিয়ে ওটা চোখে পড়েছিলো। খাওয়া বেশ ভালো হলো। হাসান ভাই ছোট্ট একটা পিঠে ঝোলানোর উপযোগী ব্যাগ এনেছেন, তাতে ‘রেড আই’ আর এক বোতল পানির সাথে ছোটখাটো ছুরিজাতীয় অস্ত্র আর ক্ষমতাধর কালো লম্বা টর্চলাইটটা পুরে নিয়েছি। নাকিবের সাথে আলাদা ব্যাগে ক্যামেরা। আমাদের ভয় হলো ডাকাত। তবে আমরা আগেভাগেই ঠিক করে নিলাম যে, ডাকাতরা আক্রমণ করলে আমরা লড়াই করবো; তবে ডাকাতদের একজন সদস্যও যদি আমাদের আওতা থেকে দূরে থাকে, তাহলে লড়াই না করেই সব দিয়ে দিবো। এই প্রথম ছোট দলের সুবিধাটা উপভোগ করলাম: দ্রুত মতৈক্য।

বাসে করে আসার সময় জলপ্রপাত/বনপ্রপাত আর মেঘলা দেখে এসেছি, ওখানেই যাবো। বাসস্ট্যান্ড হয়ে হাঁটাপথে চললাম আমরা। কড়া রোদ, তার উপর মাত্র খেয়েছি; পাকা রাস্তা ধরে হাঁটছি, তারপরও এই প্রথম উপলব্ধি করলাম খাড়া চড়াই পার হওয়া কতটা কষ্টকর। নিজেকে লিফ্‌ট করতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। এখানে এসে সবার আগে বানান শুদ্ধ করে নিয়েছি আমি, এই জায়গাটার নাম ‘বান্দরবন’ নয়, ‘বান্দরবান’। অপূর্ব বান্দরবানের উঁচু উঁচু পাহাড় দেখে তর সইছে না কখন উঠবো ওগুলোর চূঁড়ায়; হাঁটছি তো হাঁটছিই, ত্রয়ীর উদ্যমে ভাটা নেই। পাহাড়গুলো দেখে হাসান ভাইয়ের আক্ষেপ, ‘পাহাড়গুলো এরকম গাছ-গাছড়াহীন মরু কেন!’ হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে জলপ্রপাত/বনপ্রপাত পেলাম; সাইনবোর্ডের একপাশে ‘বনপ্রপাত’ লেখা, আরেক পাশে ‘জলপ্রপাত’। রাস্তার পাশেই খাঁদে সামান্য ঢালু হয়ে যাওয়া স্রোত-পথমাত্র: প্রপাত বলতে মাধবকুণ্ড-শ্রেণীয় বিশাল প্রপাত ভাবছিলাম, হতাশ হলাম। তার উপর পানিও নেই।

পাশেই একটা সাইনবোর্ডে ‘বনায়ন’ শব্দটা দেখে হাসান ভাই আগ্রহী হয়ে পাশের টিলায় উঠলেন। ওখানে পরিচয় হলো গোলাম কবির চৌধুরি নামে আনুমানিক ৩৪ বছর বয়সী একজনের সাথে, আমাদের সাথে প্রথম বাতচিত যার বিশুদ্ধ ইংরেজিতে। স্থানীয় মানুষ, এখানে বসতি করেছেন, রোহিঙ্গাদের কয়েকটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগান, প্রপাতের পানি তিনিই আটকে রেখে সেচকাজ চালান, তাঁর ছাপড়া ঘরে ফ্রিযও আছে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, এখানে স্থানীয় এনজিও’র সাথে যুক্ত আছেন; রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে নেতিবাচক: ‘They are very inferior to the wild beast’। [আমার ধারণা] রোহিঙ্গাদের সাথে যুঝতে হচ্ছে বলে স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় সব প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ; ফকরুদ্দিন আহমদ যে টেলিযোগাযোগ উন্নয়নে আসছেন এই খবর তিনিই দিলেন; সেনা প্রধান, নৌ প্রধান, ডিসি, র‌্যাব, পুলিশ সবার সাথেই উঠবস; এমনকি সিলেটের মৌলভীবাজারের জনৈক জেলা প্রশাসককেও চিনতে পারলেন তিনি। সত্যিকার অর্থেই পাহাড়ের মাঝে পাহাড়ি ফুল হয়ে আছেন তিনি। (এসংক্রান্ত সঠিক দৃষ্টিকোণ পেতে দেখুন এই নিবন্ধটি) তাঁর ওখান থেকে পানি খেয়ে নামলাম আমরা।

আবারো হাঁটা, এবারে অনেক দূর হেঁটে এলাম মেঘলায়। এখানে টিকেট কেটে (জনপ্রতি ১০/-) ভিতরে ঢুকলাম অন্যান্য আরো পর্যটক আর শিক্ষা সফরকারীদের সাথে। ঢালু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবিষ্কার করলাম অপূর্ব দুই দুইটা ঝুলন্ত সেতু। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু ছাড়াও যে বাংলাদেশে আর কোথাও ঝুলন্ত সেতু আছে এটা এই প্রথম জানলাম, দেখলাম। দুপুর সাড়ে তিনটার সূর্যের তপ্ততা বাতাসের তীব্রতায় ম্লান হওয়ায় অস্বস্তি লাগছে না, কিন্তু চারপাশ বেশ উজ্জ্বল সবুজ। আশেপাশে মিশ্র ফলের বাগান করা হয়েছে। ক্যামেরা চলছে সেই প্রথম থেকেই, ডিযিটাল ক্যামেরা, মেমোরীর বালাই নেই।

আলোকচিত্র ০১: ঝুলন্ত সেতু শুধু রাঙামাটি নয়, মেঘলায়ও আছে [ছবি: নাকিব আহমেদ]
আলোকচিত্র ০১: ঝুলন্ত সেতু শুধু রাঙামাটি নয়, মেঘলায়ও আছে [ছবি: নাকিব আহমেদ]
সেতু পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে ওঠা যায়, আমরা এগোলাম। উদ্দেশ্য সামনের ঐ উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় চড়ে বিখ্যাত(!) হয়ে যাওয়া। কিন্তু বিধি বাম: উপরে যে পথটা পাহাড় চূঁড়ায় উঠে গেছে, সেই পথের মুখেই লেখা “প্রবেশ নিষেধ”। অগত্যা সামনের ছাউনি দেয়া দোকানগুলো লক্ষ্য করে চললাম। ওখানে গিয়ে এক পাহাড়ি ছেলের দোকানে বসে স্বস্তায় কলা খেলাম। গাছ পাকা ঐ কলার স্বাদ যে একবার খেয়েছে, ভুলবে না। স্বস্তায় নাকি মানুষ পস্তায়: আমরাও পস্তাই, তবে আবার না খেতে পারার পস্তানো। এবারে সামনের পথ ধরে চললাম।

পথের বাম পাশেই পাহাড়ের বুক কেটে এই রাস্তা করা হয়েছে। আলগা মাটি বেরিয়ে আছে। কোথাও তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি পাহাড়ের গায়ে তক্তা কিংবা ইট ঢুকিয়ে ধ্বস বন্ধ করা হয়েছে; তবে পরক্ষণেই ভেদ ভাঙান হাসান ভাই। ওগুলো পাথুরে মাটি, রঙে রূপে এরকম ইট আর তক্তা মনে হচ্ছে। ওখানে কয়েকটা ছবি তুলে পাথুরে মাটির কিছু স্যাম্পল হাতে করে সামনে গিয়ে দেখি মিনি চিড়িয়াখানা: পশু-পাখিদের কষ্ট দেয়ার অপ্রশস্ত আবাস। হরিণ, বানর, কালো ভালুক আর বিভিন্ন জাতের কিছু নাম না জানা পাখি। মিনি চিড়িয়াখানা পার হয়ে পথটা দ্বিতীয় ঝুলন্ত সেতু হয়ে সেই আগের জায়গায় গিয়ে মিশেছে; ঢোকবার পথটাই বেরিয়ে যাবার পথ।

আলোকচিত্র ০২: বান্দরবানে স্তরিভূত মাটিতে তৈরি পাহাড় [ছবি: লেখক]
আলোকচিত্র ০২: বান্দরবানে স্তরিভূত মাটিতে তৈরি পাহাড় [ছবি: লেখক]
বেরিয়ে সামনের পাহাড়ের উপরের মসজিদে আসরের নামায পড়ে আশপাশটা একটু দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এটা বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের এলাকা। চক্কর দিতে গিয়ে সেখানেই লেকের উপর পরিত্যক্ত একটা ঘর আবিষ্কার করলাম। ঘরটা ক্যাম্পিং করার মতোই, বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় পানির উপর দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে অস্তমিত সূর্যের আলোয় লেক এলাকা দেখে বাসে চড়ে আবার বান্দরবান শহরে ফিরে মাগরিব সারলাম। প্রতি পদক্ষেপেই আমরা পরবর্তি গন্তব্য সম্পর্কে এর-ওর থেকে যতটুকু সম্ভব জেনে নিচ্ছি: কোন বাস যায়, কত ভাড়া, কোনটার ভাড়া কম, ভালো হোটেল কী আছে; সবচেয়ে বেশি তথ্য পেলাম রেস্টুরেন্টের বয়দের থেকে।

গোসল করে বিশ্রাম নিয়ে এশার নামায পড়ে বেরোলাম আবার; উদ্দেশ্য স্বস্তা একটা হোটেল খোঁজা, যাতে কালকেই সরে পড়া যায়; কালকের দিনটা বান্দরবান থেকে চিম্বুক পাহাড় ঘুরে এসে পরশু রাঙ্গামাটি গিয়ে একদিন থেকে পরদিনই বাসযোগে ঢাকা ফেরত। মূল বান্দরবান শহরটা ছোট, হাঁটলে এমাথা-ওমাথা দশ মিনিটও লাগবে না। ভিতরের দিকে একটা হোটেল পেয়েও গেলাম, ‘কালকেই সেখানে পাড়ি দেবো’ এমন প্ল্যান করে রাতের খাওয়া সারলাম। তারপর সাঙ্গু নদীর ব্রীজের উপর বসে নাকিব গীটার হাতে নিলো: সে গীটার নিজে নিজে শিখেছে, কিন্তু ওর মতো ভালো গীটার-বাদক আমি আর দেখিনি। গীটারের সুরে পরিবেশ বদলে দিলো সে, হাসান ভাই তাল দিয়ে চলেছেন। আমি ব্যাগ থেকে [মার্চ মাসের আকাশের] ‘তারা-চিত্র’ বের করে নিলাম। যাবার সময় ডিসকভারি চ্যানেলের বই ঘেঁটে ওটা এঁকে নিয়েছিলাম, ওটার সাথে মিলিয়ে আকাশের তারা চিনবো। তারা চেনার প্রথম ধাপ হলো উত্তর-পূবাকাশের সপ্তর্ষী (উরসা মেজর) চেনা: সাঁতটা তারা একত্রে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন-মতো তৈরি করেছে। সপ্তর্ষীর মজার বিষয়টি আমি আবার বাবার থেকে শিখেছি: প্রশ্নবোধকের লেজের সোজাসুজি তিনটা তারা ধরে আকাশের আরেক প্রানে- তাকালে আরেকটা উজ্জ্বল তারা দেখা যায়, যা উত্তর দিক নির্দেশ করে (এবিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে দেখুন এই নিবন্ধ)। তবে ব্রীজের আলোয় আমার তারা দেখা গোল্লায় গেলো। রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে ফিরে নিচের ডেস্কেই জানলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান আগামীকাল চিম্বুক যাবেন, তাই ও-পথ বন্ধ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তটা নাকিবই নিলো, কক্সবাজার যাবার ইচ্ছাটা সে-ই ব্যক্ত করলো। ঠিক হলো কালকেই বান্দরবান ছেড়ে কক্সবাজার যাওয়া হবে, সেখানে একদিন থেকে পরেরদিন রাঙ্গামাটি: আবারো দ্রুত মতৈক্য।

পরিকল্পনামতো পরদিন সকালের নাস্তা সেরে চললাম দ্বিতীয় আকর্ষণ বৌদ্ধমন্দির দেখবো বলে। বালাঘাটার বৌদ্ধমন্দিরে যাবার পথ বাতলে দিলো হোটেল বেয়ারা, যাবার আগেই জেনে নিলাম কোন বাস ক’টায় ছাড়বে, এগারোটার আগেই মন্দির দেখে ফিরতে হবে। বান্দরবান থেকে বেবীটেক্সিতে করে (জনপ্রতি ৮/-) বালাঘাটা চললাম। বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট, কৃষি ইন্সটিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরী পার হয়ে বালাঘাটা গিয়ে সেখান থেকে রিকশায় (১৫/-) করে বৌদ্ধমন্দিরের পাদদেশে। উঁচু পাহাড় চূঁড়ায় স্বর্ণালী মন্দিরটি পরিষ্কার আকাশের গায়ে যেন কেউ তুলিতে এঁকে রেখেছে। নিচেই প্লেকার্ডে লেখা রয়েছে “বুদ্ধ ধাতু জাদি: পুলপাড়া, বান্দরবান”। এই ‘জাদি’ শব্দটা পালি ভাষা থেকে এসেছে, বাংলা অভিধানে উল্লেখ নেই। জাদি-পাহাড়ে সিঁড়ি বানানো আছে, ওপথেই উপরে উঠতে থাকলাম। উপরে উঠে আমরা ঘোড়ার ডিম খেলাম। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে “পূজারি ব্যাতীত দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ” “দর্শনার্থী প্রবেশের সময় বিকাল ৩টা থেকে ৫টা”। পাশেই বৌদ্ধ ভিক্ষু শিক্ষাক্ষেত্র। আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়মকে শ্রদ্ধা করে ভিতরে যেতে নিবৃত্ত হলাম। বাইরে থেকেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটালাম; কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নেমে এলাম উপর থেকে।

আলোকচিত্র ০৩: বুদ্ধ ধাতু জাদির অলঙ্করণ মুগ্ধ না করে পারে না [ছবি: লেখক]
আলোকচিত্র ০৩: বুদ্ধ ধাতু জাদির অলঙ্করণ মুগ্ধ না করে পারে না [ছবি: লেখক]
কিন্তু ফিরে গেলাম না, পাশের পাহাড়ে গিয়ে চড়লাম। সেই পাহাড়ের পেটে দাঁড়িয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটা বাঁশ দিয়ে একটা মাচা-মতো তৈরি করা হয়েছে, মাচা অবশ্য বেশ ফাঁক-ফোকরওয়ালা, মাঝখানে চোখা একটা বাঁশ উঠে গেছে; নিচে পুরো সমতল অংশ জুড়েই এখানে ওখানে ছাই পড়ে থাকতে দেখে সব মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এটা একটা শ্মশান- বৌদ্ধ শ্মশান। কিন্তু পাহাড়ের ঢালেও পোড়া ছাই দেখে শ্মশান হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলাম, ঢালে শবদাহ হবার সম্ভাবনা নেই। সমতলের সোজা ওপাশে একটা দোচালা ছোট্ট ঘরে একটি বৌদ্ধমূর্তি: কমলা রঙের বস্ত্রাচ্ছাদিত গৌতম বুদ্ধ পদ্মাসনে বসা, হাত দুটি [আমার ভুল না হলে] ‘বিতর্ক’ মুদ্রায় বিধৃত, পরস্পর লাগানো। পাশেই একটা ফলক পড়ে জানলাম যে, এখানকার বোধি বৃক্ষ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী লাগিয়েছেন। এই সমতলে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজন প্রথম বারের মতো আবিষ্কার করলাম, আমরা কেউই জানিনা বৌদ্ধদের শেষকৃত্য কিভাবে হয়?

এই সমতল থেকে জাদিটি দেখা গেলো, আমরা রেড আই আর ক্যামেরা দিয়ে জাদি আস্বাদন করলাম। তারপর এই সমতল থেকে আরো উপরে উঠে যেতে থাকলাম, আরো উপরে, আরো উপরে, আর ভয়ে থাকলাম কারো বাড়িতে না ঢুকে পড়ি। অবশেষে অনেক উঁচুতে উঠে পাহাড় চড়ার স্বাদ মেটালাম ওখানে। উপরের গাছগুলো কেটে ফেলেছে কে যেন, আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে জাদি চূঁড়ারও অনেক উপর থেকে জাদিকে পূর্ণ উপভোগ করলাম। ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেয়ে যে যার বাড়িতে ফোন করে নিজেদের আকাশ ছোঁয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে মহান হয়ে গেলাম। তারপর কক্সবাজার যাবার তাড়নায় দ্রুত নিচে নামতে থাকলাম। নামার সময় পায়ের হিসেবে ফুট বিবেচনায় আন্দাজ করলাম, আমরা মোটামুটি সাড়ে তিনশ ফুট উপরে উঠেছিলাম; এ যদিও এমন কিছু না, তবুও চিম্বুকের সাধ তো মিটলো।

আলোকচিত্র ০৪: পাহাড় চূঁড়ায় বুদ্ধ ধাতু জাদি [ছবি: নাকিব আহমেদ]
আলোকচিত্র ০৪: পাহাড় চূঁড়ায় বুদ্ধ ধাতু জাদি [ছবি: নাকিব আহমেদ]

ফিরলাম গ্রীণহিল হোটেলে, বাক্সপেটরা গোছগাছ করাই ছিল, ম্যানেজারকে বলে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা পূরবী’র টিকেট কাটলাম (জনপ্রতি ৮৫/-), বাস ছাড়লো সোয়া এগারোটায়। হাসান ভাই আর নাকিব একত্রে বসেছেন, আমার পাশে উপজাতি এক ব্যক্তি এসে বসলেন। হাসান ভাই আমাকে ইশারায় লোকটার হাতের দিকে তাকাতে বললেন, তাঁর চোখে ভীতি। লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে উল্কি দিয়ে বেশ কিছু চিহ্ন আঁকা। ভালো করে তাকিয়ে সেখানকার স্বস্তিক প্রতীকটি সনাক্ত করতে পারলাম; কারণ আমি কয়েকদিন থেকে ধর্মীয় প্রতীক বিদ্যা নিয়ে কিছু গবেষণা করছি। হাসান ভাইকে বললাম, ‘ভয়ের কিছু নেই, ভালো জিনিস’। হাসান ভাই’র ভীতি হলো এই লোক রোহিঙ্গা ডাকাত-টাকাত কেউ। আর যাই হোক, একজন ডাকাত স্বস্তিক প্রতীকের উল্কি নিয়ে ঘুরবে না। কারণ স্বস্তিক হলো ‘শুভ’ বা ‘কল্যাণ’-এর প্রতীক; অবশ্য নাৎসিবাদের স্বস্তিক বিবর্তিত; আমি সেটা গোণায় ধরছি না।

আলোকচিত্র ০৫: সাঙ্গু নদী: বান্দরবানের আইকন [ছবি: নাকিব আহমেদ]
আলোকচিত্র ০৫: সাঙ্গু নদী: বান্দরবানের আইকন [ছবি: নাকিব আহমেদ]

সারাটা পথ আমি লোকটার হাতের দিকে অসংখ্যবার তাকিয়েছি। স্বস্তিকতো চিনলাম, বাকিগুলো অপরিচিত কেন? অনেকক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে তাঁকে প্রশ্নটা করলাম। তিনি খুব সুন্দর অমায়িক নিষ্পাপ হাসি উপহার দিয়ে অনেক কষ্টে শুদ্ধ ভাষায় বললেন। হাতে উল্কি দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিয়েছেন ধর্মমতে কোন খাবারগুলো তাঁর জন্য নিষিদ্ধ; ওগুলো পালি ভাষা’র হরফ বোধহয়। আমি নিশ্চিত হলাম, ইনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী: বৌদ্ধধর্মে বামদিকে-বাঁকা-মাথা স্বস্তিক ভালোবাসা, ক্ষমা আর দয়া প্রতীকায়ন করে। আমার ফিযিওগনমি’র ক্ষমতায় নিশ্চিত হলাম, এই হাসি কোনো ডাকাতের হতেই পারে না।

বাস লোহাগাড়া, বানিয়ারছড়া, চকরিয়ার মালুমঘাট পার হয়ে চলেছে। এমন সময় মসজিদের দান সংগ্রহে এক ব্যক্তি বাসে উঠলে আমি নিজেকে নিবৃত্ত রাখলাম আমাদের অর্থ সীমিত বলে। অথচ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমার পাশের বৌদ্ধ ব্যক্তিটি কিছু টাকা দান করলেন, আর হাত আকাশের দিকে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন; বুঝলাম ইনি খুবই ধার্মিক একজন। আমি মনে মনে লজ্জিত হলাম, আমার মসজিদে আমিই দিলাম না, আর একজন বৌদ্ধ দান করলো! আমার মনে পড়লো ইসলামের বাণী: দান করলে আল্লাহ বর্ধিত করে দেন; আমি তো বাড়তি পেতাম। খুব লজ্জিত হলাম, শিক্ষা নিলাম। একজন পরধর্মীর কাছেও স্বধর্মশিক্ষা বাকি ছিলো। তবে ঐ ব্যক্তি আমার শিক্ষক হয়ে গেলেন, নিঃসন্দেহে।

আমাদের জুম‘আ মিস হলো; বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেকটা চাঁদের গাড়িতে চড়ে (জনপ্রতি ৫/-) কলতলী মোড়ে চললাম। মোড়ে পৌঁছার আগ মুহূর্তেই জীবনে দ্বিতীয়বার, কিন্তু বাংলাদেশে প্রথমবার সমুদ্রের দেখা পেলাম: অপূর্ব! মোড়ে নেমে বায়ের পথ ধরে নাকিব আমাদেরকে নিয়ে গেলো ওর পরিচিত ‘হোটেল লজ্‌’-এ; ও এ-নিয়ে চারবার এসেছে। হোটেল ভাড়া শুনে মহাশূণ্য থেকে পড়ার জোগাড়, সাড়ে তিনশ-চারশ টাকার ডাবল বেড এখন ৮০০/- টাকা! এবারে দ্বিতীয়বার গুঁটি উল্টে-পাল্টে গেলো। জানলাম, ছাব্বিশে মার্চ সরকারি ছুটি, সাতাশ তারিখ বৃহস্পতিবার, আটাশ-উনত্রিশ সাধারণ ছুটি: সবাই সাতাশ তারিখ ছুটি নিয়ে প্রথম পর্যটন স্থান হিসেবে কক্সবাজারে এসে উঠেছে। আবারো অফপিকে, পিক সীযনের ভাড়া গুণতে হবে। পরিচিতিও কাজ দিলো না বলে নাকিব মর্মাহত হলো। আমরা বাক্স-পেটরা নিয়ে রাস্তায় নামলাম। রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে হোটেল সন্ধান করতে লাগলাম, আর সবখানেই ভাড়ার ১১০০-১২০০ টাকার ত্রাহী চিৎকার দেখে গলাধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়তে থাকলাম।

ওদিকে রিকশাওয়ালারা করছে মহাযন্ত্রণা, এরা আবার হোটেলগুলোর দালাল। এদিকে আমরাও হোটেল খুঁজছি, আমাদেরই মতো ছন্নছাড়া আরেকটা ত্রয়ী দলও যেন হোটেল খুঁজছে। সংক্ষেপে বলি, ওরা তিনজন: সাইফ [ভাই], ফাহাদ আর মামুন। সাইফ আর ফাহাদ ঢাকা থেকে, মামুন চট্টগ্রাম থেকে; বাসে বিদায় দিতে এলে বাকি দুজন মামুনকে বাসে টেনে তুলে নিয়ে এসেছে পরনের এক কাপড়েই। ওদেরও একই দশা। আমরা একজোট হলাম, ওরা আরো হোটেল দেখেছে। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হলো নাকিবের পরিচিত হোটেলেই স্বস্তা+ভালো রুম পাওয়া যাবে নিশ্চিত, তাই আমরা ‘হোটেল লজ’-এর ৪০৮ নম্বর রুমটা নিলাম। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি কক্সবাজার থেকে রাঙামাটি সরাসরি কোনো বাস নেই। তাই আমরা ওদের সাথে আলাপ করে দুদিনের জন্য দুই দলই একত্রে ১৬০০/- টাকা দিয়ে রুম বুক করলাম: এটা নতুন নিয়ম, অগ্রিম জমা করতে হবে; অনেকে নাকি বকেয়া রেখে পালিয়ে যায়। রুমে ঢুকে মন ভরে গেল: ইয়া বড় বড় দুটো বিছানা, এক বিছানায় আমরা তিনজন, অন্যটায় ওরা তিনজন, আড়াআড়িতে বেশ হয়ে যাবে। আমাদের বারান্দা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়, গর্জনও শোনা যাচ্ছে। আমরা জামাতে যোহরের নামায পড়লাম। ফাহাদের আর তর সইছে না, সে এক্ষুণি নামবে সমুদ্রে।

আমাদের কক্সবাজারের কোনো প্রস্তুতিই ছিলো না। তবুও সব কেমন করে হয়ে গেল। আমরা মোবাইল, ঘড়ি, ক্যামেরা সবকিছু ঘরে রেখে বেরোলাম; আমরা বোধহয় ওদেরকে বিশ্বাস করলাম, কিংবা ওরা আমাদেরকে। বিপদে আমরা দুদলই নিরুপায়। সমুদ্রে নামার আগে তিন গোয়েন্দার বইতে পড়া সাবধান বাণী মনে পড়লো: ‘সমুদ্রে ভাটার সময় নামতে হয় না।’ এখন কি জোয়ার? …নাকিব আশ্বস্ত করলো। এই প্রথম সমুদ্রে নামলাম আমি। প্রথম অনুভূতি: বিধাতার কী অপূর্ব সৃষ্টি! দ্বিতীয় অনুভূতি: পায়ের নিচ থেকে বালু সরে যাচ্ছে ঢেউয়ের টানে। নাকিব শিখিয়ে দিয়েছে, ঢেউ এলেই ঢেউয়ের দিকে পিঠ করে লাফ দিতে হবে, তৃতীয় অনুভূতি: ঢেউ এসে আমার ঘাড়ে ঠাস করে চড় বসিয়েছে; আমি ব্যথা পেয়েছি। চতুর্থ অনুভূতি: লবণের ভাণ্ডার! চোখে লবণ-পানি ঢুকলেই জ্বালা করছে। তারপর আমরা সৈকত ধরে হেঁটে আরো জনারণ্যে গেলাম। ওখানে সামনে কয়েকজন সাহসী আছেন, আমরা তাদের সাথে গিয়ে মিশলাম। এখানকার ঢেউগুলো রীতিমতো পর্বতসম। যে ঢেউটা এসে ঠিক সামনে ভেঙে পড়ছে, সেটা খুব ভয়াবহ। পঞ্চম অনুভূতি: ভেঙে পড়া বড় ঢেউগুলো পানির নিচে আমাকে রীতিমতো নাকানি চুবানি খাইয়েছে; ‘নাকানি-চুবানি’ কী জিনিস আমি উপলব্ধি করলাম। সাঁতার জানি বলে পানির শক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতাম, কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার পানির, ঈশ্বর-প্রদত্ত অসীম ক্ষমতাকে স্বীকার করেছি। তবুও আমরা পিছু হটিনি, বোধহয় মানুষ বলেই। ঢেউয়ের সাথে লড়াই করার সময় ঢেউয়ের চুঁড়ায় মাছের ঝাঁক দেখেছি, কিন্তু ওগুলো যথেষ্ট চালাক, ঢেউয়ের মধ্যেও নিজেদেরকে এক জায়গায় আটকে রাখতে পারে।

অনেকক্ষণ ভিজলাম। অবশেষে আমরা সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়ে হোটেলে ফিরে সাপ্লাইয়ের পানি দিয়ে নোনা জল ছাড়ালাম; নোনা জল চুলকে রুক্ষ্ম করে দেয়। আমরা আসরের নামায শেষ করে নাস্তা করলাম, সারাদিনে পেটে দানাপানি সকালের নাস্তা ছাড়া কিছুই পড়েনি। তারপর মাগরিব পড়ে বেরোলাম বার্মিয মার্কেটে কক্সবাজার শহরে। রিকশায় গিয়ে (১৫/-) বার্মিয মার্কেট চষে ফিরলাম রাতে। হাসান ভাই স্বীকার করলেন, ‘আমি আগে মনে করতাম, উপজাতিরা সুন্দরী হয় না। আজকে আমার ভুল ভাঙলো।’ ফেরার পথে এস. আলম বাসের টিকিট করলাম, সেখানেও চল্লিশ টাকা বেশি (জনপ্রতি ৩৯০/-)। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে সবকিছু রেখে নাকিব গীটার নিলো। দ্বিতীয় দলের তিনজন ঘরে বসে আছে, বেড়াবার জায়গা নেই। আমরা আবার হোটেলের কাছেই সৈকতে গেলাম। ডাকাতির ভয় করলেও সাথে তেমন কিছু নেই, আর বিশাল টর্চলাইটটা সাথে থাকায় কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে।

চাঁদ এখনও ওঠেনি, তারার চাদর ঢাকা আকাশের নিচে বালুতে বসে পড়লাম জুতার উপর। নাকিবের গীটারের ব্যাগটা বিছিয়ে হাসান ভাই শুয়ে পড়লেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। নাকিব গীটার নিয়ে ভাটায় নেমে যাওয়া সমুদ্রের জলের কাছে গিয়ে বাজাচ্ছে, নিজেই নিজেকে শোনাচ্ছে যেন। অপূর্ব সরব নীরবতা, অন্ধকার। উত্তাল বাতাস। শোঁ শোঁ একটানা গর্জন। কাব্যিক করে তুললো তিনজনকেই। হাসান ভাই নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। জীবনে এই প্রথম আমরা বোধহয় তিনজনই একান্ত নিজের কাউকে কাছে পেতে চাচ্ছি; সমুদ্র বোধহয় এমনই তিয়াস জাগায়। রাত আড়াইটার দিকে সৈকত ছেড়ে উঠলাম। নীরব কলাতলী মোড় হয়ে হোটেলে গিয়ে উঠলাম; দারোয়ানও আমাদেরকে বুঝলেন, গেট খুলে দেয়াকে নিজের দায়িত্বই মনে করলেন।

পরদিন সকালের নাস্তা সেরে সৈকত ধরে হাঁটতে থাকলাম আমরা ত্রয়ীতে। নাকিব আজকে ওর ক্যামেরা হাতে নিয়েছে, একের পর এক শার্টার পড়ছে। সৈকতের একটু ভেজা বালু আর শুকনা বালুতে কাঁকড়ার বাচ্চাদের শিল্পকর্ম দেখে আমি মুগ্ধ হলাম; সৈকতে ছড়ানো শামুক-ঝিনুকের ছড়াছড়ি দেখে মুগ্ধ হলাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় আর না পেরে জুতা খুলে পানিতে পা ভিজালাম। তারপর শুকনো বালু মাড়িয়ে ঝাউবনে ঢুকতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সূর্যের তেজ, যা এতক্ষণ সমুদ্রের বাতাসের কারণে বুঝাই যাচ্ছিলো না। ঝাউবন পেরিয়ে রিকশা নিয়ে আমরা সার্কিট হাউয চললাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে ডানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের [জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী] রাডার স্টেশন।

রাডার স্টেশন ডানে রেখে বায়ের পথে এগোলে সামনে ছোট একটা জাদি, ঢোকার কোনো পথ নেই, পরিত্যাক্তই বলা যায়। জাদির পিছনেই কক্সবাজার সার্কিট হাউয। এই পাহাড় চূঁড়া থেকে ঝাউবনের উপর দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা রিকশাযোগে হোটেলে ফিরে যোহর পড়েই চললাম সমুদ্রে। আজকে ক্যামেরায় ছবি তোলা হবে। পালা করে ভিজলাম; ছবি তুললাম। তারপর হাসান ভাইকে কবর দিলাম বালুর নিচে: মমির মতো লাগলো দেখতে। হাসান ভাইয়ের অভিমত, ভেজা বালুর প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে হয়েছে তাকে। দূর থেকে সবাই এ দৃশ্য দেখে হাসছে। তারপর ক্যামেরা রেখে এসে আবার ভেজা। দী-র্ঘ-ক্ষ-ণ ভিজলাম। যেন নোনা পানির পাহাড়ের সাথে মানব জাতির যুদ্ধ: হয় হার, নয় জিত।

আলোকচিত্র ০৬: সৈকতের মমি হাসান ভাই [ছবি: লেখক]
আলোকচিত্র ০৬: সৈকতের মমি হাসান ভাই [ছবি: লেখক]

ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে আসর পড়ে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর শরীরের ম্রীয়মান শক্তিটুকু পূঁজি করে হাঁটা ধরলাম সৈকতের বামদিক ধরে। নাকিব হাঁটছে আর সূর্যাস্তের ছবি তুলছে। আমি আর হাসান ভাই সামনের ঐ দূরের নৌকাগুলোর কাছে যেতে চাই। পথ আর ফুরোতেই চায় না। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা পার হলে ওখানে পৌঁছলাম, জেলে নৌকা দেখলাম। ওগুলোতে ইঞ্জিন বসানো হয়েছে, নৌকায় রাখা কুপির চারপাশে কাঁচ দিয়ে ঘেরা, যাতে সমুদ্রের বাতাস নিভিয়ে দিতে না পারে আলো। জানলাম জেলেদের কুসংস্কার: ‘জুতা দিয়ে নৌকা মাড়ালে বেশি মাছ পাওয়া যায় না’। তারপর আমরা ফিরতি পথে মাগরিব পড়লাম এক মসজিদে, হোটেলে ফিরে এসে অল্প বিশ্রামে ক্লান্তি দূর করলাম। আবার বেরোলাম অদূরে অন্য এক বার্মিয মার্কেটে। সামান্য কিছু কেনাকাটা করে ফিরলাম। রাতের খাবার খেয়ে সরাসরি সৈকতে গেলাম।

আলোকচিত্র ০৭: সৈকতে সূর্যাস্ত চিরআরাধ্য [ছবি: নাকিব আহমেদ]
আলোকচিত্র ০৭: সৈকতে সূর্যাস্ত চিরআরাধ্য [ছবি: নাকিব আহমেদ]

সৈকতে অন্ধকারের মধ্যে আরেক যজ্ঞ, কাঁকড়ারা সবাই বেরিয়ে পড়েছে খাদ্যের সন্ধানে। নাকিবের শক্তিশালী টর্চটা যতদূর গেলো পুরো সৈকত জুড়ে অগণিত লাল কাঁকড়া হাঁটাহাঁটি ছোটাছুটি করছে। আমরা কিছুক্ষণ কাঁকড়া তাড়িয়ে বেড়ালাম। সৈকতে আমরা ত্রয়ীতে বসে গল্প করলাম, তর্ক করলাম। একসময় হাসান ভাই বলে উঠলেন, ‘আমাদের তো ভাই উদার হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা তিনটা বৃহৎ জিনিস দেখলাম: পাহাড়, সমুদ্র আর আকাশ’। সত্যিই তাই, এই উদার ত্রয়ীর মহাতটে আমরা ত্রয়ী কি উদার হলাম? আমরা কি কিছু শিক্ষা নিলাম? সে বোধহয় আমাদের ভবিষ্যতই বলে দেবে।

পরদিন সকালে আমরা বাসে করে ঢাকায় ফিরলাম। বাস আমাদেরকে কলাতলী মোড় থেকেই তুলে নিলো। দীর্ঘ দশ ঘণ্টার পথ ক্লান্তিতে শ্রান্ত হলেও খুব উপভোগ করেছি এই স্বল্প বাজেটে এতো বড় ট্যুর। এই ট্যুরে আমার ব্যয় সর্বমোট ১৫১৫/-; দৈনিক গড়ে ২৫৮/-, যাতায়াত বাবদ গড়ে ৭৪০/- টাকা।

আলোকচিত্র ০৮: ত্রয়ীর পদচিহ্ন: লেখক, হাসান ভাই আর নাকিব [ছবি: স্বয়ংক্রিয়]
আলোকচিত্র ০৮: ত্রয়ীর পদচিহ্ন: লেখক, হাসান ভাই আর নাকিব [ছবি: স্বয়ংক্রিয়]

পরামর্শ: বাংলাদেশে ঘুরতে হলে সরকারি চাকুরের সাথে ঘুরতে বের হওয়া উচিত, খরচ প্রায় থাকবে না, ফ্রি থাকা-খাওয়া। অফ সীযন দেখে বের হতে হবে, যাত্রার পুরো সময়টায় কোনো ছুটির দিন না থাকাই ভালো। বিশেষ ব্যক্তিত্বের ঐ এলাকায় যাবার কথা থাকলে জেনেশুনে যাওয়াই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে গেলে সমবয়সীদের দলে কিংবা পরিবারের সাথে সবচেয়ে বেশি মজা হয়। দল যত বড়, খরচ তত কম; তবে মতানৈক্য তত বেশি। তবে পরিবার নিয়ে গেলে বাজেটে সীমাবদ্ধতা রাখা যাবেই না এবং আমার খরচের কয়েকগুণ বেশি অর্থ হিসেব করতে হবে। পাহাড়ে ক্যাম্পিং করলে মশা-নিবারক/নিরোধক আবশ্যক। সবার জন্যই পরামর্শ: ‘এই মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়ুন, কালকে বেরোলেও চলবে, কিন্তু পরশু বেরোলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে: প্রতিদিনই ব্যয় বাড়ছে’।

___ সতর্কতা ___
এই পোস্টে ২০০৮-এর মার্চের হিসাব উদ্ধৃত হয়েছে। নতুন অভিযাত্রীদের মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনাপূর্বক বাজেট পরিকল্পনা করার অনুরোধ থাকলো।
___ সতর্কতা ___

-মঈনুল ইসলাম
(পরিস্ফুটন: আগস্ট ১৪, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ)

সবকিছুর নাম বাংলায় রাখতে কোনো বাধা নেই

আচ্ছা, সবকিছুর নাম বাংলায় রাখলে কী হয়?

বাংলায় নাম!

অনেক অনেক সমস্যার কথা উঠে আসছে জানি, তবু আমি আজকে প্রমাণ করবো কেন আপনি বাংলায় সবকিছুর নাম রাখবেন, কেন তা রাখলে কোনোই অসুবিধা নেই, বরং তা সম্মানের।

আমাদের বাংলাদেশের দুই নেত্রীর নামকরণ সংস্কৃতির সাথে আমরা সবাই পরিচিত: একজনের দেয়া নাম আরেকজন এসে পাল্টে দেন, আবার পরের মেয়াদে প্রথম জন এসে সেটা পুণরুজ্জীবিত করেন। সেখানে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ যতটা আমরা দেখি, দেশের স্বার্থ ঠিক ততটাই ক্ষুন্ন হতে দেখি। অথচ আজ আমি এমন পথের কথা বলছি, যাতে ব্যক্তিস্বার্থ তো বটেই, বরং দেশ ও ভাষার স্বার্থও সমানভাবে রক্ষা পাবে।

বাংলায় নামকরণ প্রবণতা

আসুন, নামকরণের ব্যাপারে আমাদের অবস্থানগুলো একটু দেখে নেয়া যাক। নামকরণের ব্যাপারে আমাদের কিছু প্রবণতা আছে:

ক. আমরা বাংলা নামে ভাব খুঁজে পাই না:

আমরা বাংলা নামে আজকাল আর ভাব খুঁজে পাই না। তাই আমরা নামকরণের বেলায় ইংরেজি নাম পছন্দ করি খুব ভাব আছে মনে করে। এপ্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি:

খুব ছোটবেলায় আমি আর আমার মামাতো ভাই (রনি ভাই) নিজেদের বইপত্র একত্র করে একটা মিনি পাঠাগার তৈরি করলাম। আমরা দুজন মিলে সেই পাঠাগারের একটা নাম ঠিক করলাম। পাঠাগারের জন্য দান সংগ্রহের জন্য আইসক্রিমের বাটির উপরে কাগজ লাগিয়ে দানবাক্স বানালাম আর তার উপরে আমাদের পাঠাগারের নামের আদ্যক্ষর লিখলাম: TNFL। ছোটবেলায় দুজনই দাঙ্গা-হাঙ্গামামার্কা ছবি পছন্দ করতাম, তাই বলে পাঠাগারের নামের সাথে দাঙ্গা-হাঙ্গামা জুড়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি, বোধহয় ভেবেছিলাম ওটাতেই ভাব আছে। পাঠাগারের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা জুড়ে কী নাম হয়েছে জানেন? “The National Fighter Library”, সংক্ষেপে TNFL।

…নামটা মনে হলে আজও হাসি। যাহোক, নামের বেলায় আমাদের ইংরেজি-প্রীতির একটা কারণ আছে। কারণ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, ইংরেজি একটা ফোরেন ল্যাংগুয়েজ। নদীর এপার কহে ওপারে সুখ, ওপার কহে এপারে সুখ -এই কবিতাটা সবাই জানি। তাই বাংলাভাষী হয়ে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিপ্রীতি যে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তা আর বলতে হবে না আশা করি। মজার ব্যাপার হলো আমরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পেরে ঠিক যতটুকু মর্যাদাবান নিজেদেরকে ভাবি, ইংরেজ কিংবা আমেরিকানরা ইংরেজি বলতে নিজেদেরকে ঠিক ততটাই নীচ মনে করে। তাই তারাও নিজ ভাষা ইংরেজি ছেড়ে ঝুকছে অন্য কোনো বিদেশী ভাষায়- ফরাসি (French), কিংবা স্প্যানীয় (Spanish)। এজন্যই লক্ষ করবেন, আমেরিকানরা, নতুন আবিষ্কৃত সূর্য বা গ্রহের নামকরণে খুঁজে খুঁজে গ্রিক, রোমক কিংবা মিশরীয় পুরাণ থেকে নাম বের করে আনে। তারা মনে করে ঐসব নামের মধ্যে একটা ভাব আছে। আমাদের ইংরেজি-প্রীতির উদাহরণ ভুরি ভুরি, যেমন: একটা বাংলাদেশী ব্যান্ডের নাম বাংলায় “ব্যতিক্রমী ছোঁয়া” রাখার পরিবর্তে “Different Touch” রাখাটা যথেষ্ট ভাবের; “কালো” রাখার পরিবর্তে “Black” রাখাটা যথেষ্ট ভাবের; “ফাঁদ” রাখার পরিবর্তে “The Trap” রাখার মধ্যে একটা ভাব আছে… আরো কত কী! আমার বন্ধুও তার ব্যান্ডের নাম রাখতে গিয়ে শেষে ইংরেজিতে স্থিতু হয়েছে: Aimers।

খ. বাংলা রাখলে এটা শুধু বাঙালিরা বুঝবে, তাই রাখি না:

আমাদের সবারই ধারণা বাংলায় যদি কোনো কিছুর নাম রাখি, তাহলে সেটা শুধু বাঙালিরাই বুঝবে। তাই আমরা ঝুঁকি নেই না। যেমন: বাংলাদেশের বুয়েটের তিন গর্ব সাজেদুল হাসান, রাকিবুর রহমান এবং আহসানুল আদীব তাঁদের বিশ্ব-মাতানো আবিষ্কারটির নাম দেন: Design and Development of micro controller based solid state pre-payment energy meter, সংক্ষেপে Pre-paid Meter।[১] কারণ হয়তো তাঁদের মনে হয়েছে আমরা আমেরিকাতে প্রতিযোগিতায় যাচ্ছি, সেখানে বাংলা নাম নিয়ে গেলে কেউ বুঝবে না। তাই তাঁরা ইংরেজিতে নাম রেখেছেন তাঁদের আবিষ্কারের। আর এখন সেই ইংরেজি নামেই পরিচিতি পেয়েছে তাঁদের এই আবিষ্কার। সিলেটের উপশহর এলাকায় সরকার চালু করেছে এই প্রিপেইড বিদ্যুৎ মিটার। (শুনেছি ঢাকার উত্তরায়ও চালু হবে)

সমাধান সমাধান

এবারে আসুন দেখি, কিভাবে সব কিছুর নামই বাংলা রাখা যায়, কোনো ঝামেলা ছাড়াই, আর এর পিছনে যুক্তিগুলোইবা কী: বাংলা উইকিপিডিয়ান শাবাব মুস্তাফা একদিন মজার এক তথ্য জানালেন: কলকাতায় নাকি মোবাইল ফোনের বাংলা করা হয়েছে “চলভাষ” (উচ্চারণ: চলোভাষ্‌)। শুনে আমি আর তানভির [রহমান] হেসে বাঁচিনে। হ্যা, কলকাতার এই বাংলায়ন নিয়ে হয়তো একটু হাসিই পাচ্ছে আমাদের, কিন্তু সত্যি কথা হলো, কলকাতার লোকজন বাংলায় নামকরণে বেশ ওস্তাদ। আমরা যেখানে Navy Blue-কে নেভী-ব্লু লিখেই ক্ষান্ত দেই, কলকাতার সুচিত্রা ভট্টাচার্য তখন লিখছেন “নাবিক নীল”। আমার অন্তত এই বাংলায়নে হাসি পাচ্ছে না।

আসলে হাসি পাবার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। নতুন যেকোনো কিছুতেই হাসি পেতে পারে। কিন্তু প্রচলিত হয়ে যাবার পর সেটাতে আর হাসি পায় না। কখনও কি ভেবে দেখেছেন “সিংহভাগ” কথাটার মানে কী? অথচ এখন কথায় কথায় সিংহভাগ কথাটা ব্যবহার করছি আমরা দিব্যি, হাসি পাচ্ছে না। দিব্যি ব্যবহার করছি “সংরক্ষণ” শব্দটি, অথচ কখনও কি হেসেছি এই বলে যে, রক্ষণ করবো, রক্ষা করবো, এর সাথে আবার ‘সং’ ভংচং লাগানোর কী দরকার? আসলে প্রচলিত হয়ে যাবার পর অনেক কিছুই আর হাসির বিষয় থাকে না। এখন আর কেউ লাক্স কিংবা লাইফবয় নাম দুটোকে প্রশ্ন করে বলে না এসব আবার কেমন নাম? LUX-এর কোনো মানে নেই, কিংবা অর্থবোধক Sunsilk নামটিকে নিয়ে হাসে না এই বলে যে, হায়রে, সূর্যের সাথে সিল্ক কাপড়ের কী মিল, হা হা হা!

এবারে আসি বাস্তব উদাহরণে: কলকাতার সত্যজিৎ রায়^কে কে না জানে? ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মুহম্মদ জাফর ইকবাল^কেও চেনেন সবাই। এই দুজনের মধ্যেই একটা সহজ পার্থক্য টানা যাক: সত্যজিৎ রায় তাঁর অধিকাংশ বইয়ের নাম রেখেছেন বাংলা, যেখানে জাফর ইকবাল তাঁর কিছু কিছু বইয়ের নাম বাংলায় না রেখে বেছে নিয়েছেন বিদেশী নাম: যেগুলো শুনতে কিছুটা খটমটে লাগে, আর সেই তথাকথিত ভাব প্রকাশ করতে পারে। বাংলা উইকিপিডিয়ায় উল্লেখিত নিবন্ধ দুটোতে দুজনেরই লেখা বইয়ের নাম আপনারা পাবেন, মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন। এই দুজনকে নিয়ে আলোচনা করার কারণটা হলো জাফর ইকবাল বাংলাদেশের এযুগের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক, আর সত্যজিৎ রায় সেযুগে ভারতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখে গেছেন। সত্যজিৎ রায়ের “প্রফেসর শঙ্কু^” চরিত্রটি ছিল সেরকমই একটা চরিত্র। শঙ্কু আজব আজব সব যন্ত্র তৈরি করতেন আবার সেগুলোর নামকরণও করতেন। কিন্তু দেখার বিষয় হলো সত্যজিৎ রায় সেযুগে ঐসব আবিষ্কারের নামে কোথাও ইংরেজি নাম দিতেন না। হয়তো শ্রেফ একটা রোবট বানিয়েছেন শঙ্কু, কিন্তু সেটার নাম তিনি দিলেন “বিধুশেখর”। …আসলে এভাবে তুলনা করাটা সঠিক কোনো বিজ্ঞানসম্মত উপায় নয়। কারণ সত্যজিৎ রায়ও অনেক ইংরেজি শব্দ দিয়ে নামকরণ করেছেন। আমি কেবল এটা বোঝাতে চাচ্ছি যে, সাধারণ একটা রোবটের মতো বিষয়কে যেখানে ইংরেজি নামে জড়ানো যেত, সেখানে সত্যজিৎ বাংলাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তৃষ্ণা নিবারক ঔষধের নাম “থ্রাস্ট পিল” না রেখে রেখেছেন “তৃষ্ণাশক বড়ি”। …এতে লাভটা কোথায়?

লাভটা হলো: বাংলাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।

আচ্ছা, আপনার নাম কি আপনার বাবা-মা “টাইগার উড্‌স” রেখেছেন, নাকি রেখেছেন “সিদ্দিকুর রহমান^“? কিংবা “উইলিয়াম শেক্সপিয়ার” রেখেছেন, নাকি “হুমায়ুন আহমেদ”? মজার বিষয় হলো আপনার নামটি কিন্তু রাখা হয়েছে বাংলায় (বা আরবিতে)। কিন্তু আপনি যখন পরিচিতি পাচ্ছেন, তখন বলা হচ্ছে না আচ্ছা আপনার নামের ইংরেজিটা কী? কেউ কখনও হুমায়ুন আহমেদকে তাঁর নামের ইংরেজি বলতে বলেন না। অথচ তিনি বিশ্বখ্যাত হয়েছেন, তাঁর নামে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাঠাগার “লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস”-এ আলাদা একটা লেখক-ভুক্তি তৈরি করা হয়েছে। …নাম “নাম”ই। এর ভাষান্তর হয় না (যদিও ওরা “ঠাকুর”-কে Tagore করে নিয়েছে)।

আপনি যখনই একটা বাংলা নাম রাখবেন, তখনই সেটা একজন ভিনদেশী, ভিনভাষী মানুষের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করবে: এর মানে কী? হয়তো আপনি আপনার বইয়ের নাম রাখলেন “অচেতন”, তখন ঐ ভিনভাষী এর মানে জানতে চাইবেন। আপনি তখন গর্ব করে বলতে পারবেন, ইট্‌স এ্যা বাংলা টার্ম। বিদেশী তখন দাঁত-মুখ খিচড়ে বলবে, হোয়াট! আপনি তখন দ্বিগুণ আনন্দ নিয়ে বলতে পারবেন, বাংলা ইয্ এ্যা ল্যাংগুয়েজ এ্যাচিভ্‌ড বাই ব্লাড। এ্যান্ড দ্যা টার্ম আ-চেতান মিন্‌স “Unconcious”। তখন ঐ বিদেশী আপনার ভাষায় মুগ্ধ হবে, আপনার ভাষা সম্পর্কে জানবে আর দশজনকে গিয়ে বলে বেড়াবে, আইয়্যাভ লার্ন্ট আ নিউ ল্যাংগুয়েজ: ইট্‌য ব্যাংলা, সেয়িং আ-চেতান ফর আনকনশাস। সে তখন তার কোনো বইতে আনকনশাস বিষয়ে লিখতে গেলে উল্লেখ করবে এই বাংলা টার্মটিও -এব্যাপারে আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।

কারণ আজ আমি দেখছি ক্রিকেটে যেভাবে জন্টি রোড‌্‌স ফিল্ডিং করতেন, সেটা আজ জন্টি রোড্‌স’ স্টাইল নামে পরিচিতি পেয়ে গেছে, যে বাংলাদেশী ভবন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে, তা “সংসদ ভবন” নামেই হয়েছে “পার্লামেন্ট হাউজ” নামে হয়নি (পরিচয় করিয়ে দেয়ার স্বার্থে অবশ্য পার্লামেন্ট হাউজ বলা হয়)। নিজের পরিচিতির সাথে করে নিয়ে গেছে ভাষাকে।

আরেকটা ধারা আছে, রোমান হরফে বাংলা লেখা: otobi, aarong, taaga, কিংবা drik gallery সবই কিন্তু বাংলা নাম। অটবি সংস্কৃতমূল বাংলা শব্দ (বৃক্ষ, অরণ্য); আড়ং ফারসিমূল বাংলা শব্দ (হাট, বাজার); তাগা প্রাকৃতমূল বাংলা শব্দ (হাতের বাহুতে বাঁধার সুতা); দৃক সংস্কৃতমূল বাংলা শব্দ (চোখ, দৃষ্টি)। যেভাবেই লেখা হোক না কেন, বাংলা তো। এগুলো থেকে mantra (মন্ত্র), yaatri (যাত্রী) কিছুটা ব্যতিক্রম, কারণ এগুলো মূল দেবনাগরী অর্থাৎ ভারতীয় লিপির উচ্চারণ-ধারায় লেখা। তবুও এগুলো বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে।

একবার চিন্তা করুন, আপনি একটি যুগান্তকারী রকেট আবিষ্কার করলেন, তার নাম আপনি তথাকথিত রকেট না রেখে রাখলেন “ব্যোমযান”, তখন স্বভাবতই একসময় রকেটের নামটি পাল্টে গিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে পরিচিতি পাবে ব্যোমযান নামটি। নাসা সংবাদ সম্মেলন করে বলবে উইয়্যাভ্‌ মেড্‌ আওয়ার নিউ ব্যোমযান, এ্যান্ড ইট্‌য পার্ফেক্টলি ওয়েলইকুইপ্‌ড। ঠিক যেমন আজ নাসা হোয়াইট ডুয়ার্ফ বা শ্বেতবামনের (তারার জীবনচক্রের একটি পর্যায়ে একে এই নামে ডাকা হয়) নিরাপদ মৃত্যুকে বোঝাতে বুক ফুলিয়ে বলছে ইট্‌য কাল্‌ড দ্যা চান্দ্রাশেখার লিমিট। (ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখরের নামে এই গাণিতিক ফর্মুলার নাম করা হয়েছে)

আসুন, নিজের আবিষ্কার, নিজের চিন্তা-চেতনা, নিজের লেখা বই, ফর্মুলা, গবেষণা-বস্তু ইত্যাদি সবকিছুর নামকরণ করি বাংলায়। তাহলে সেগুলো সারা বিশ্বে পরিচিতি পেলে বাংলাকে জানবে মানুষ।

আর মনে রাখবেন, যে ভাব আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের ভাষাকে বাদ দিয়ে ঐসব তথাকথিত ভাবমণ্ডিত ভাষায়, তারা কিন্তু ভাব খুঁজে বেড়াচ্ছে আপনার ভাষায়।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ক্যালটেকে^ নিজের যন্ত্রের নাম “টাইম প্রজেকশন চ্যাম্বার”[২] না রেখে “সময় অভিক্ষেপ প্রকোষ্ঠ” রাখলে আজ হয়তো ক্যালটেকে বাংলা নামটি প্রচলিত হয়ে যেত। বুয়েটের বিজ্ঞানীরা “প্রি-পেইড এনার্জি মিটার” না রেখে যদি “প্রাক-পরিশোধ মিটার” রাখতেন, তাহলে আজ আমেরিকায় নামটি জনপ্রিয়তা পেত।

তাই আমার পাঠাগার (জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার^), আমার বন্ধুদের সম্মিলিত সংঘ (নোঙর), আমার মতবাদ (কৃষ্ণপথ মতবাদ), আমার অন্তর্কথা’র (অচেথন^) মতোই আপনিও আপনার যাবতীয় নামকরণে প্রাধান্য দিন বাংলাকে। চেয়ে থাকলাম সেই দিনের প্রতি, যেদিন আবারো কেউ বুক ফুলিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দিবে, কোনো বাঙালির আবিষ্কৃত মাইক্রোবায়োলজির বই বাংলা নামে পরিচিতি পাবে: ভিনভাষী শিক্ষার্থীরা বুক ফুলিয়ে বলবে আয়্যাম এ্যা স্টুডেন্ট আফ আণুজীববিদ্যা। আমার বিশ্বাস, সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়।

অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ড বাংলা নামে এখন বিশ্বজুড়ে পরিচিত: সচলায়তন, মুক্তমনা তেমনি একেকটি ব্লগ সাইট। সচলায়তন-তো www.সচলায়তন.com দিয়ে ডোমেইনও কিনেছিল। বাংলার জনপ্রিয়তা টানছে সবাইকে: বাংলায় ওয়েবসাইট খুলছে বিবিসি, ডয়চে ভেলে। আরো আসছে, একটু অপেক্ষা করুন। …আর যদি অপেক্ষা ধাতে না সয়, তাহলে দায়িত্বটা কিন্তু আপনার। নিজেই শুরু করুন।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে…!

-মঈনুল ইসলাম

________________________

তথ্যসূত্র:
১. “বাংলাদেশের সেরা বিজ্ঞানী’, হিটলার এ. হালিম; শিকড়; ফেব্রুয়ারি ২০০৪; পৃ. ১০০।
২. “একটুখানি বিজ্ঞান”, মুহম্মদ জাফর ইকবাল; কাকলী প্রকাশনী; ফেব্রুয়ারি ২০০৭ দ্বিতীয় মুদ্রণ; পৃ. ১০৩।

কবিতা: ভাষা সৈনিক নব বাংলায়

বলিয়াছি আদো বোল এ বাংলায়
রচিয়াছি কত গাঁথা
ভাবি নাই কভু উর্দু আমার
জাগাইবে মাথাব্যাথা
থাকিনি বসিয়া চুপ্‌টি করিয়া
উর্দু বোলেতে দুগাল ভরিয়া
বজ্রকণ্ঠে, জোর কদমে
হাঁকিছি বঙ্গ-বোল
আমারি ডাকেতে ওরাও জাগিলো
বাঁধিলো যে সরগোল
ঠেকায় মোদের সাধ্য যে কার
উর্দুর মাথা ভাঙিব এবার
রাজপথে নামি আমরা ক’জনা
পড়িলাম গিয়া একগাদা সেনা-
তোপের মুখেতে শেষে;
ঝরিলো রক্ত, আসিলো বাংলা
বঙ্গেতে অবশেষে

কত আরাধ্য বাংলা এ দেশে
বাঙালিরা কি তা জানে?
একুশের কথা কজনাইবা
রাখিয়াছে আজ মনে?
মনের গহীনে আসন পাতিয়া
বিদেশী বুলি সে আসনে রাখিয়া
বাঙালি সাজিয়া, রাজপথ দিয়া
ঘুরেফিরে কত জনে
বাঙালি ভোলে সে বিদেশী ছানারা
একুশেরে নাহি চেনে
একদিনেরই বাঙালি সাজি
অক্ষর গায়ে কপালে মাখি, সে
শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে, দেখি
সিক্ত যে ভাষা-বসনে
ভাষার এমন প্রেম যে বৃথা
এরা বলো কি তা জানে?
বাঙালিরা আজ ভুলিয়া গিয়াছে
একুশের গূঢ় মানে ॥

বলিতেছি কত বোল এ বাংলায়
রচিতেছি কত গাঁথা
ভাবি নাই কভু বাঙালিই মোর
জাগাইবে মাথাব্যথা ॥


কবিতাটি প্রথম লেখা শেষ করি, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল, সকাল ৯টা ৫৬মিনিটে; পরবর্তিতে আরো কিছু যোগ করি ৮ মে, সকাল ১১টা ২৫মিনিটে। অনুরোধ থাকলো, পৃথিবীর সকল ভাষাকে শ্রদ্ধা করো, জানো, সারা বছরই বাংলাকে লালন করো, নয়তো একদিনের জন্য বাঙালি সেজোনা। ভাষা আন্দোলন শুধু বুকে অক্ষর এঁকে টি-শার্ট পরার জন্য হয়নি, শুধু শহীদ মিনারে অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয় করে ফুল দিতে গিয়ে স্বীয় প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য হয়নি, শুধু একদিন বাংলা বোল আউড়ে বাঙালি হবার জন্য হয়নি, শুধু একদিন “জীবন থেকে নেয়া” ছায়াছবি দেখার জন্য হয়নি…। যদি সম্মান জানাতেই হয়, তবে এই ভাষাকে জেনে তা দেখাও।

-মঈনুল ইসলাম

কেন খুতবা বাংলায়, কেন নয়

যে কথা বুঝি না, সে কথা শোনার মানে কী থাকতে পারে? ভাষা বুঝিনা বলেই তো ’৫২-তে রক্ত দিয়ে আজ বাংলাকে মাতৃভাষা করেছি আমরা। তাই যে কথাই বলো না কেন, বলতে হবে বাংলায়- যে ভাষায় আমি সব বুঝি, বুঝি তুমি আমাকে গালি দিলে, নাকি বাহবা দিলে। ডাক্তার যাকির নায়েককে একজন প্রশ্ন করলেন: খুতবা কেন স্ব স্ব ভাষায় দেয়া হয় না। উত্তরে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন যে, খুতবা অবশ্যই স্ব স্ব ভাষায় হওয়া উচিত। তবে খুতবার অন্তর্গত ক্বোরআনের আয়াত এবং হাদিসের উদ্ধৃতি হুবহু আরবিতে বলতে হবে। ব্যস, তাতেই হয়ে যাবে। …একদিকে সমস্যাটা ঘোরতর, অথচ ওদিকে সমাধান কত সহজ! কিন্তু, এটাই কি তবে সমাধান? জানতে হলে পড়তে হবে শেষাবধি।

কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম, যদিনা সহকর্মী হাসান ভাই প্রশ্নটা আবারও তুলতেন। তিনি জোর দাবি জানালেন যেন খুতবা অবশ্য অবশ্যই বাংলায় হয় (কেননা তিনি বাঙালি)।

কী এই খুতবা?

খুতবা শব্দটা আরবি (ﺨﻂﺑﻪ), যার অর্থ ‘ভাষণ’। অর্থগত দিক দিয়ে খুতবা হলো জুমার নামাযের আগে এবং ঈদের নামাযের পরে ইমামের দেয়া ভাষণ, যাতে ধর্মের বিধিনিষেধ আলোচনা ও মুসলমান খলিফার প্রতি আনুগত্য করার কথা বলা হয়। আমরা যারা মুসলমান এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খানিকটা জানার আগ্রহ আছে, তারা জানি যে, জুমার খুতবা আসলে মুসলমানদের জন্য একপ্রকার সাপ্তাহিক আপডেট (সাম্প্রতিক তথ্য)। এই খুতবায় মুসলমানদেরকে বিগত সাতদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে জানিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোর কোনটা কতটা ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত, কতটা পরিত্যাজ্য, কেন পরিত্যাজ্য ইত্যাদি। কেন পরিত্যাজ্য, তা জানাতে গিয়ে ক্বোরআন এবং হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোনো ইযমা থেকে থাকলে, তাও উল্লেখ করা হয়। যেন ইসলামের প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে মুসলমানদের সজ্ঞানতা তৈরি হয় এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতি ইসলামসম্মত আচরণ গড়ে ওঠে। -এটাই জুমা’র খুতবার মূল উদ্দেশ্য। (দুই ঈদে মূলত ঈদ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীর উল্লেখ বেশি থাকে।)

খুতবা কেমন আরব দেশে?

আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতে জুমা’র খুতবা দিতে দেখেছি। সেখানে আমরা জুম’আর দিনে আযানের পরপর মসজিদে চলে গেলাম। গিয়ে সবাই বসে আছি। কোথাও কোনো ইমাম নেই। সবাই চুপচাপ বসে আছেন। কেউ কেউ তাক থেকে ক্বোরআন শরীফ বের করে পড়ছেন, কেউবা হাতে প্লাস্টিকের গুটিকা নেড়ে তাসবিহ পড়ছেন; আর সবাই-ই চার রাকা’আত ক্বাবলাল জুম’আ পড়ে নিচ্ছেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ইমাম সাহেব এলেন, এবং প্রায় আট-নয়টা সিঁড়ি পেরিয়ে বেস্টনি দেয়া স্টেজে উঠলেন, আসলে এই স্টেজটা হলো মিম্বর (আরব দেশের মিম্বরগুলো আমাদের দেশের মতো তিন সিঁড়ির মিম্বর নয়)। এবারে আর কাউকেই ক্বাবলাল জুম’আ পড়ার অনুমতি দেয়া হলো না। মোয়াজ্জিন সাহেব আবার আযান দিলেন (সা-নী আযান: ﺛﺎﻨﻰ ﺍﺬﺍﻦ)। আযান শেষ হলে ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আরবি ভাষায় বলা শুরু করলেন। তিনি কী বললেন, আমি বুঝলাম না, কারণ আমি আরবি পড়তে পারি, বুঝতে পারি না- আরবি ভাষা, ‘ভাষা’-অর্থে জানি না। শুধু এতোটুকু বুঝলাম বাংলাদেশে একজন ইমাম সাহেব যতক্ষণ সময় নিয়ে প্রথম খুতবাটুকু বলেন, তিনি এর চেয়ে বেশি সময় নিয়ে কথাগুলো বলছেন। দ্বিতীয় খুতবাও খানিকটা দীর্ঘ হলো- খুব একটা দীর্ঘ না। দুই খুতবার মাঝখানে তিনি যথারীতি বসেও ছিলেন।[১]

খুতবা এবং আমরা

ইসলামের প্রথম যুগে সানী আযানই ছিলো মূল আযান, এখনকার মতো দুবার আযান দেয়া হতো না। পরবর্তিতে মানুষকে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য (যেহেতু জুম’আর নামায, সারা সপ্তাহে একবার, এবং খুব তাৎপর্যপূর্ণ) আরো একটু আগ বাড়িয়ে আরেকবার আযান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যাহোক, প্রথম আযান শুনে আমরা মসজিদের দিকে রওয়ানা হয়ে যাবো- এটাই উদ্দেশ্য। তারপর চুপচাপ বসে থাকবো নেতার আগমনের অপেক্ষায়। ‘ইমাম’ শব্দের অর্থ কিন্তু নেতা। তারপর যখন নেতা আসবেন, এবারে ইসলামের সেই প্রাথমিক যুগের প্রবর্তিত মূল আযানটি দেয়া হবে এবং নেতা উঁচু একটি স্থানে দাঁড়িয়ে যাবেন। তারপর পুরো সপ্তাহের আপডেট দিবেন ইসলামের বিধিবিধান অনুসারে। তিনি যখন কথাগুলো বলবেন, তখন আমরা সবাই তাঁর কথাগুলো শুনবো খুব মন দিয়ে। তাঁর বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর কথাগুলোই আমাদের খাদ্য। তারপর তিনি বলা শেষ করে নেমে এসে আমাদের সবার সামনে নেতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবেন আমাদেরকে আল্লাহ’র দরবারে পথ দেখানোর জন্য। তিনি নামায শুরু করবেন এবং আমরা তাঁকে অনুসরণ করবো। -এটিই জুম’আর দিনের মূল কথা।

আমাদের দেশে দেখা যায়, সতর্কতামূলক আযানের পরপর আমরা মসজিদে চলে যাই ঠিকই, তারপর ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে নয়, বরং বসে বসে বেশ কিছুক্ষণ কীসব বক্তৃতা দেন, সেগুলো শোনা হয়ে গেলে তারপর আমাদেরকে চার রাকা’আত নামায পড়ার অনুমতি দেয়া হয়, তারপর আযান হয়, এবারে ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে আরবিতে কী যেন বলেন, সব মুখস্থ কথা কিংবা বই দেখে বলা বুলি।…

ব্যাপারটা আসলে ঠিক এরকম হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও কেন হয়?

তার প্রথম কারণ: সতর্কতামূলক আযান হওয়াসত্ত্বেয় আমরা আলস্য করেই হোক কিংবা অনীহা করেই হোক মসজিদে যাই না, কেননা মূল নামাযের তখনও অনেক বাকি থাকে; ফলে আগে থেকেই ক্বাবলাল জুম’আ পড়ে নিতে পারি না, অথচ তা পড়া সুন্নতে মোয়াক্কাদাহ (আবশ্যক সুন্নত)। এখন একজন ইমাম কী করে পারেন এতোগুলো মানুষকে একটা সুন্নতে মোয়াক্কাদা’র পূণ্য থেকে বঞ্চিত করতে? তাই তিনি সানী আযানের আগে একটু সুযোগ করে দেন আরকি।

দ্বিতীয় কারণ: ইমাম সাহেব যে কথাগুলো আরবিতে বলেন, সেগুলো বাঙালি বুঝবে না, তাই তাঁর সারকথাগুলো গুছিয়ে বাংলায় বলাটা খুব দরকার। তাই সতর্কতামূলক আযানের পরে তিনি একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে কথাগুলো বাংলায় ভেঙে ভেঙে বলেন, যেন কথাগুলো সবার মাথায় ঢোকে। সেখানে তিনি ক্বোরআনের উদ্ধৃতি দেন, হাদিসের উদ্ধৃতি দেন এবং নীতিকথাও বলেন।

কিন্তু হাসান ভাইয়ের বক্তব্য হলো, যে কথাগুলো একবার বাংলায় বলা হয়ে গেলোই, সে কথাগুলো আবার কেন দাঁড়িয়ে আরবিতে বলতে হবে? ঐ সময়টাতে আমরাতো কিছুই বুঝি না, তাহলে কেন বলা হয়? বলা হয়, তার কারণও কয়েকটা:

প্রথমত, সবকিছুকে বাংলা করতে চাওয়াটা অন্যায় এবং অনুচিত। কেননা ক্বোরআনের বক্তব্য এবং হাদিসের বক্তব্য শুধুমাত্র অনুবাদের কারণে ভুল অর্থ হয়ে যেতে পারে, তাই সেগুলোকে মূল আরবিতে বলতে হবে (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্টে মানুষের যথেচ্ছ অনুবাদ প্রবণতাই অর্থগত মূল থেকে মানুষকে সরিয়ে দিয়েছে বহুদূর)। তাছাড়া আরবি ভাষা হলো পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যা তার মূল থেকে খুব কম বিকৃত হয়েছে, আর তাই এই ভাষা সম্মানিতও। যদি আরবি’র চর্চাই না থাকে, তাহলে এই কথাগুলো কখনও মনে প্রশ্ন জাগাবে না, আর প্রশ্ন না জাগলে এধরণের কথাগুলো আড়ালেই থাকবে। তাছাড়া আরবিতে খুৎবা দেয়া সুন্নত। মুসলমানদের কাছে, একটা সুন্নত পালন করার অর্থ হলো একশ শহীদের সওয়াব পেয়ে যাওয়া[২] (এই শহীদ আল্লাহর পথে জেহাদ করতে গিয়ে শহীদ-অর্থে)।

দ্বিতীয়ত, যাকির নায়েক যে সমাধান দিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা আসলে একটা জগাখিচুড়ি সমাধান-প্রচেষ্টা: কিছু বলো বাংলায়, কিছু বলো আরবিতে… আদতে যেই লাউ-সেই কদু। তাই মূল সুন্নতের অনুসরণে এবং অনুকরণে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকটা প্রতীকিভাবেই খুৎবা আরবিতে দেয়া হয়।

খুৎবার প্রথম অংশে থাকে সাপ্তাহিক আপডেট এবং করণীয় সম্বন্ধে। দ্বিতীয় অংশে থাকে দোয়া। আর উভয় অংশ জুড়েই থাকে আল্লাহ’র প্রশংসা আর বাণীবাহক মুহাম্মদের [আল্লাহ তাঁর প্রতি শান্তি বর্ষণ করুন] প্রতি দুরূদ। দ্বিতীয় অংশে নিজের এবং পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের জন্য দোয়া ছাড়াও সুন্নিগণ চার খলিফা (আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী [আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন]), মুহাম্মদের বংশধর (ফাতেমা, হাসান, হোসাইন [রা.]), মুহাম্মদের সহচরগণ (সাহাবিগণ [রা.]), সাহাবাদের বংশধরগণ (তাবে’য়ী ও তাবে’-তাবে’য়ীনগণ [আল্লাহ তাঁদের প্রতি দয়াপরবশ হোন]), ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ওলি-আওলিয়াদের [আল্লাহ তাঁদের প্রতি দয়া পরবশ হোন] জন্য দোয়া করেন। তাই, প্রথমাংশে সামান্য ব্যতিক্রম থাকলেও প্রায় সকল স্থানেই দ্বিতীয় খুৎবায় অনেক মিল। যেহেতু দ্বিতীয় খুৎবায় দোয়া পাঠ করা হতে থাকে, তাই এসময় উপস্থিত শ্রোতারা মনে মনে “আমীন” (তাই হোক) বলাটা উত্তম।

কিন্তু…

কথা হলো, সাধু কথায় তো অনেক কিছু বোঝা গেলো, কিন্তু ওমুক মসজিদের ইমাম সাহেবতো দেখি বই দেখে সব অনর্গল পড়ে যান তোতাপাখির মতো। তাহলে আপডেটটা দিলেন কই? সবইতো ঐ বই-লেখকের বক্তব্য বলে দিলেন।

আপনার প্রশ্নের উত্তরটা আমি দিতে চাই আমার মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে। আমার মসজিদের ইমাম সাহেব (খতিব মাওলানা শুয়ায়েব খান) খুব গুছিয়ে বাংলায় বক্তৃতা দেন, বক্তব্যের ভিতরে ক্বোরআন ও হাদিসের যতগুলো উদ্ধৃতি থাকে সবই তিনি হয় লিখে নিয়ে আসেন, নতুবা মুখস্থ করে আসেন। যদি সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়, তবে সেবিষয়ে; যদি সেটা শিক্ষানীতি ২০১০ বিষয়ে হয়, তবে সেবিষয়ে; যদি সেটা এ’তেকাফ নিয়ে হয়, তবে সেবিষয়ে; যদি সেটা ‘আশুরা নিয়ে হয়, তবে সেবিষয়ে ক্বোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে ইসলামের দৃষ্টিকোণটা তুলে ধরার জন্য তিনি প্রযোজ্য আয়াতগুলো ও হাদিসগুলো সাথে করে নিয়ে আসেন। বাংলা বক্তৃতার ভিতরে ভিতরে যেখানে সেগুলো উল্লেখ করার দরকার, সেখানে সেগুলো বলেন। তারপর যখন প্রথম খুতবা হয়, তখন তিনি কিছু সর্বজনীন কথা বলার পর হাতে ধরা কাগজটা বের করে, কিংবা [মুখস্থ থাকলে] স্মরণ করে, “ইয়া আইয়্যুহাল ইখওয়া…” (হে ভাইগণ) বলে ক্বোরআন ও হাদিসের ঐ আয়াতগুলো পুণরাবৃত্তি করেন। বলা শেষে একটা সমাপনী বক্তব্য রাখেন, তারপর খুতবা’র মধ্যস্থলের বিরতিতে যান।

আপনি অনেক মসজিদের [দ্বিতীয়] খুতবাতেই শুনবেন ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরানের জন্য দোয়া করা হচ্ছে। আপনি যদি ইমাম সাহেবের হাত থেকে বইটা নিয়ে পড়েন, তাহলে সেখানে দেখবেন কথাগুলো লেখা নেই। আসলে ইসলাম এসকল দেশে বিপর্যস্থ মনে করে মুসলমান নেতাগণ (ইমামগণ) ঐসকল দেশের জন্য দ্বিতীয় খুতবায় দোয়া করেন, আল্লাহ যেন সেখানে শান্তি বিরাজ করেন, ইসলামকে পুণর্বহাল করেন ইত্যাদি।

তারপরও বাংলা কথার পরিমাণ হয়তো বেশি দেখবেন, আর আরবি কথাগুলো থাকবে গৎবাঁধা, তার কারণ বাংলাদেশের ইমাম সাহেবদের মাতৃভাষা আরবি নয়। তাই বাংলায় কথাগুলো যতটা বিস্তারিত বলেন, আরবিতে গিয়ে তা সংক্ষিপ্তাকারে বলেন, ক্বোরআন আর হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই কথাগুলোকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন, কারণ তাঁরা জানেন, এই আরবি খুতবাটুকু তিনি শুধুই সুন্নত পালনার্থে দিচ্ছেন, এই কথাগুলো আগেই বলা হয়ে গেছে। আর সংক্ষিপ্ত করার আরেকটা কারণ হলো, মুহাম্মদ [স.] বলেছেন:

তোমরা নামাযকে দীর্ঘ করো, আর খুতবাকে সংক্ষিপ্ত করো।[৩]

আর কেউ কেউ যে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে যেভাবে খুতবা দেয়ার দরকার ছিল সেভাবে না দিয়ে গৎবাঁধাভাবে পড়ে যাচ্ছেন না, সেটাও আমি বলবো না। তবে তাতেও দোষের তেমন কিছু নেই, কেননা তাঁরা ঐসময় যে কথাগুলো বলছেন কিংবা বই দেখে পড়ছেন, সেগুলো সর্বজনীন কথা। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, ইমাম সাহেব সাম্প্রতিক সময়ের আপডেট নিয়ে কথা বলছেন, “আপনি ইভ-টিযিং না করাসত্ত্বেয় আপনাকে যদি কেউ এখন ইভ-টিযার বলে গালি দেয়, আপনি দয়া করে উত্তেজিত হবেন না, আপনি ধৈর্য্য ধারণ করুন এবং মনে মনে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থণা করুন”। কিন্তু ইমাম সাহেব কথাগুলো এভাবে না বলে বই দেখে [খুতবা] পড়ছেন: “মুসলমানরা সব সময় ধৈর্য্য ধারণ করবে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্যপ্রার্থী হবে”। তাহলে কি তিনি কিছু ভুল বললেন? না, তিনি শুধু ব্যাপারটাকে ভেঙে না বলে একটু দায়সারাভাবে বলে গেলেন। তবুতো বললেন।

সারকথা

জুম’আর দিনে আরবিতে খুৎবা দিব আমরা মুহাম্মদের [স.] সুন্নতকে অনেকটা সেভাবে পালনের মাধ্যমে ইসলামের প্রথম সময়কে স্মরণ করার জন্য। সেই খুতবা যেন আমজনতা বুঝতে পারে, তাই নামাজের আগে কিংবা পরে সেগুলোকে বাংলা করে বুঝিয়ে দিব। যেহেতু মুহাম্মদ [স.] খুতবা চলাকালীন সময় কোনো সহচরকে তাঁর সামনে পড়ে থাকা বালি হাত দিয়ে সরাতেও নিষেধ করেছেন, কারণ সে অন্যমনষ্ক হয়ে যাবে[৪]; তাই খুৎবা চলাকালীন সময় আমরা চুপ করে মনোযোগসহকারে সেই কথাগুলো শুনবো। বাংলা কথাগুলো যেহেতু সেই আরবি কথাগুলোরই বিবর্ধন, তাই এই কথাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর আরবি কথাগুলো বুঝি আর না বুঝি, মুহাম্মদের [স.] যুগকে স্মরণ করে একটা সুন্নত পালনার্থে হলেও চুপ করে ধৈর্য্যসহকারে শোনা আর মনে মনে খুশি হয়ে যাওয়া যে, একটা সুন্নত পালন করলাম এবং একশ’ শহীদের সওয়াব নিজের করে নিলাম।
-মঈনুল ইসলাম
___________________________

কৃতজ্ঞতা

প্রচ্ছদের ছবি: Muhammad Mahdi Karim, মূল ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স^

তথ্যসূত্র

১. “তরল স্বর্ণের দেশে” (পাণ্ডুলিপি: ভ্রমণ কাহিনী), মঈনুল ইসলাম।
২. من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر مائة شهيد
“He who clings fast to my Sunnah (way of life) when my Ummah is corrupt, will receive the Reward of a hundred martyrs.”
বঙ্গানুবাদ: যখন আমার অনুসারীরা দূর্বল হয়ে পড়বে, তখন আমার একটা সুন্নত যে আমল করবে, সে একশ শহীদের সমান পূণ্য পাবে।
(“কিতাব আল যুহদ” –ইমাম বায়হ্বাকী; দেখুন “আল তারগীব” খণ্ড ১ পৃ. ৮০) সনদ বা পরম্পরা বিষয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও আবু হুরায়রা [রা.] ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস [রা.] হতে হাদিসটির বর্ণনা এসেছে বলে জানা যায়। হাদিসটি হাসান (ﺍﻠﺤﺴﻦ: ভালো) হাদিস হিসেবে গণ্য এবং পালনে কোনো বাধা নেই এবং ইসলামী শরীয়তে হাসান হাদিস অন্তর্ভুক্ত।
৩. মুসলিম শরীফ, জুমু’আ, tr. ৪৭, Encyclopaedia of Islam-এ “Ḵh̲uṭba” অংশে উল্লেখিত।
৪. রামপুরার কুঞ্জবন মসজিদের ইমাম, জনাব মাওলানা আবুল বাশার সাহেবের বক্তব্য থেকে শোনা। (সত্যতার কোনো দলিল পেশ করতে পারছি না)