বই পর্যালোচনা: পার্বত‍্য চট্টগ্রামের প্রাণবৈচিত্র‍্যের সন্ধানে

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন যে সুন্দরবন – সেটা সবাই জানেন। লেখক লিখেছেন “কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনের নাম কী? তবে খুব বেশি মানুষ তা বলতে পারবে না।” আসলেই তাই। আমি নিজেও সেটা জানতাম না। লেখক তাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন “কাসালং রিজার্ভড ফরেস্ট” নিয়েই তাঁর লেখা শুরু করেছেন: “কাসালংয়ের অজানা অরণ‍্যে”। শুধু এই একটা লেখা পড়ার জন‍্যই এই বইটা অব‍শ‍্যপাঠ‍্য বলবো আমি।

আমি অনেকদিন থেকে সাজেক নিয়ে কাজ করছিলাম। সেই সুবাদে কাসালং, মাচালং-এগুলো নিয়ে আমার আগ্রহ ছিলো। সেকারণে দৈনিক প্রথম আলোতে লেখকের কাসালং অভিযানের গল্প আমি আগেও পড়েছিলাম। কিন্তু তা যে এতোটা মহিরূহ আকারে বেরিয়ে আসবে, তা বুঝতে পারিনি। এর পিছনে লেখক মনিরুল খান যে কতোটা লেগে ছিলেন তা প্রশংসা পাবার যোগ‍্য।

বইটিতে কাসালং ছাড়াও আরো ৯টি আলাদা নিবন্ধ আছে: দেউ হাঁসের সন্ধানে; বন‍্য হাতির মুখোমুখি; ফ্রান্সিস বুকানানের পথ ধরে; ওই দেখা যায় রাইংক্ষিয়ং; সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া; বাদুড়ের গুহা; তিনমাথা; কিরস তং যেন হারানো পৃথিবী; এবং সাঙ্গু-মাতামুহুরীর দুর্গম প্রান্তে। প্রতিটা নিবন্ধেই লেখক তাঁর পেশাগত দায়িত্বের ছাপ রেখে বইয়ের নামকরণের সার্থকতা রেখেছেন যত্ন করে – অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকার বন‍্যপ্রাণী কিংবা বন‍্যপ্রাণ নিয়ে তিনি তাঁর আগ্রহ, ভালোবাসা, পর্যবেক্ষণ যত্নসহকারে করার চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব।

মনিরুল খানের লেখালেখির হাত ভালো – শিক্ষক হিসেবে এই জায়গায় ঘাটতি নেই, অনুভূতির সত‍্য বহিঃপ্রকাশে দ্বিধা নেই। কোনো একটা জায়গা সম্বন্ধে সম‍্যক ধারণা নিতে উনি বারবার সেই জায়গায় ছুটে গেছেন। তাঁর সঙ্গী হিসেবে তাঁর ছাত্ররা তাঁকে যোগ‍্য সঙ্গ দিয়েছেন। এই যাত্রাপথে শিক্ষক হিসেবে সম্মানিতও হয়েছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর জন‍্য সেটা সুবিধাও তৈরি করেছিলো – দুর্গম পথও কখনও সুগম হয়ে গিয়েছিলো। লেখক শুধু নিজের অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেননি, তিনি ঐ একই জায়গায় অন‍্যান‍্য অভিযাত্রীর অতীতের যেসব তথ‍্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোও তুলে ধরতে কার্পণ‍্য করেননি। এমনকি পুরোনো দুয়েকটা ছবিও তিনি তাঁর ব‍্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বইটিতে যোগ করে বইটির মূল‍্য আরো অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছেন। …লেখকের বর্ণনায় যেমন উঠে এসেছে গহীন জঙ্গলে দুবৃত্তদের দৌরাত্মের কথা, তেমনি উঠে এসেছে বৃক্ষপূজার কথা, এসেছে শিকারের কথা, এসেছে অন‍্যান‍্য প্রতিবেশিক আর নৃতাত্ত্বিক বর্ণনাও। যেহেতু লেখক একই জায়গায় বারবার গিয়ে কালক্রমে সেখানকার পরিবর্তনটাও তুলে এনেছেন, তাই সবচেয়ে মোটা দাগে যেটা দেখা যায়, তা হলো দীর্ঘশ্বাস: চোখের সামনে সমৃদ্ধ একটা বনকে জীবিকার জন‍্য পুড়ে যেতে দেখলে কী বলবেন আপনি?

মোটকথা বইটাতে ইতিবাচক বিষয়ের কমতি নেই। তাই এবিষয়ে আর না বলে এবার কমতির কথা বলা যাক…

প্রথমা থেকে প্রকাশিত বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ প্রায় থাকে না বললেই চলে। তবে প্রথমার প্রতি আমার অনেক আস্থা ছিলো, বইটিতে আমি সেই জায়গায় হতাশ হয়েছি বলতে হবে। প্রথমত, বইটিতে ছবি খুবই কম। এই বইটির একটা ঐতিহাসিক মূল‍্য আছে। সেখানে অল্প কয়েকটা রঙিন ছবি দিয়ে ছবির কাজটা দায়সারাভাবে করার চেষ্টা মোটেও ভালো লাগেনি। অথচ লেখক এক অনাবিষ্কৃত জগৎ ঘুরে এসেছেন, লেখক নিজে একজন আলোকচিত্রী, তিনি নিজে বলছেন, “…ওখানে পেয়ে গেলাম বিরল এক কাঠঠোকরা (বে উডপেকার), যেটি আগে কখনো দেখিনি। মুহূর্তের মধ‍্যে কাঠঠোকরাটির কয়েকটি ছবি নিলাম…”। …একজন বন‍্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের অদেখা একটা পাখি, যার আবার ছবিও তোলা আছে, তা তাঁর কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভে পড়ে থাকলো, অথচ লেখকের অভিযানের একটা পূর্ণাঙ্গ নথি ছাপার হরফে বেরুচ্ছে। সাদাকালো ছবি হলেও কেউ বোধহয় আপত্তি করতো না। …বিশেষ করে একই প্রকাশনী থেকে লেখকের আগের বইটির তুলনা করলে, প্রাসঙ্গিক ছবির অভাবটা খুব চোখে পড়বে। অথচ প্রিমিয়াম কোয়ালিটি কাগজে হার্ডকভারের ১৮৩ পৃষ্ঠার বইটির মূল‍্য ৳৪৫০। কাগজের গ্রাম আরেকটু কমিয়ে লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক সাদাকালো ছবি বাড়িয়ে বইটির পুণর্মুদ্রণের দাবি রাখলাম।

বইটির মূল কাজ কোনো একটা অঞ্চলের বন‍্যপ্রাণের নথি সংরক্ষণ। কিন্তু ঐ অঞ্চলে কী কী বন‍্যপ্রাণী নথিবদ্ধ হলো, কিংবা এই অভিযানগুলোতে নতুন করে আবিষ্কৃত হলো, এক হলফে সেটা আপনি বইটি থেকে বলে দিতে পারবেন না। কারণ বইটি উপন‍্যাসের মতো করে সাহিত‍্য উপস্থাপনের মতো করে শুধু লেখার পরে লেখাই ছাপা হয়েছে। অথচ বইটির শেষে নির্ঘণ্টের মতো একটা তালিকা দেয়া যেতো যে, অঞ্চলভেদে এই বন‍্যপ্রাণগুলো এই অভিযানগুলোতে দেখা গিয়েছিলো, আর তার সাথে পৃষ্ঠা নম্বরের উল্লেখ থাকলে তো পোয়াবারো হতো। যা করার চেষ্টাও করা হয়নি। কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে প্রথমা এই বইটি প্রকাশে অযথাই খুব বেশি তাড়াহুড়া করেছে – বইমেলা পার করেও এতো তাড়াহুড়ার কোনো কারণ আমি তো দেখি নাই।

লেখক লিখেছেন, “…গ্রামপ্রধান উখিন লার সঙ্গে কথা বলে আশপাশের বনজঙ্গলে কী কী বন‍্য প্রাণী আছে এবং ম্রো ভাষায় তাদের নাম কী – এসব আমার ডায়রীতে লিপিবদ্ধ করলাম”। এরকম একটা অপূর্ব নথির চেষ্টা লেখক শুধু একবারই করেনি, পার্ব‍ত‍্য চট্টগ্রামের যতো জায়গায় তিনি গিয়েছেন, ততো জায়গায় তিনি এই কাজটি করেছেন। অথচ এই সংগৃহীত নামের উল্লেখ [ব‍্যতিক্রমবাদে] কিংবা তালিকাটা বইয়ের কোত্থাও নেই। অথচ একটা টীকা দিয়েই বলা যেতো, “মুখের ভাষা থেকে সংগৃহীত নামগুলোতে বানানভ্রান্তি থাকতে পারে – এগুলো লোককথার প্রেক্ষিতে সংগৃহীত”। কিন্তু সেরকম কোনো প্রয়াস বইটিতে ছিলো না।

“ফ্রান্সিস বুকানানের পথ ধরে” নিবন্ধটাও দারুণ ছিলো। কিন্তু সেখানে যা হয়েছে, প্রথমে বুকানানের পথের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তারপর লেখকের ভ্রমণপথের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে পাঠক, পড়তে পড়তে দুটো জায়গাকে রিলেট করতে পারেননি বলে মনে হয়েছে অন্তত আমার। তারচেয়ে দুটো বর্ণনা পাশাপাশি দেয়া গেলে খুব দারুণ হতো বলে মনে হয়। এমনভাবে যে, বুকানান এদিকে গিয়েছেন, এটা দেখেছেন; আমি এদিকে গেলাম, ওমুক জিনিস বদলে এটা হয়েছে। কিংবা উল্টোটা: আমি এদিকে গেলাম, এটা দেখলাম; অথচ বুকানান এই জায়গায় তখন ওটা দেখেছিলেন। এটা সম্পূর্ণই আমার ব‍্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আরকি।

প্রচলিত কিছু বানানের নতুন বানান দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে উঠেছিলো, যেমন: সাইকতপাড়া-কে লেখক লিখেছেন সাইকটপাড়া। সঠিক কোনটি তা আমারও জানা নেই, তবে যেহেতু প্রথমোক্ত বানানটি অধিক প্রচলিত, লেখক ভিন্ন বানান কেন লিখেছেন, তার ব‍্যাখ‍্যা তিনি দেননি। তাই এটি মুদ্রণপ্রমাদ নাকি পাড়ার নামের ঐতিহাসিক সত‍্য – বইটি পড়ে তা ঠাওর করা যায় না।

বইটির যেসব ঘাটতির কথা বললাম, সেগুলো যদি আপনারও মত হয়, তাহলে বইটার পরবর্তী সংস্করণে সেগুলো যোগ করার জন‍্য প্রথমা প্রকাশনী কিংবা লেখককে আপনিও অনুরোধ জানাতে পারেন। অন‍্যথায়, বইটা পাহাড়প্রেমীদের, প্রকৃতিপ্রেমীদের অবশ‍্যপাঠ‍্য বলেই আমি মনে করি। কৃতজ্ঞতা এবং অভিনন্দন লেখককে, আর তাঁর অভিযানগুলো যারা সার্থক করেছেন তাদের প্রত‍্যেককে। বইটা পার্বত‍্য চট্টগ্রামের পাহাড়-জলা-জঙ্গলের সমসাময়িক এক অনন‍্য দলিল হয়ে থাকবে – এতে কোনো দ্বিধা নেই।

পার্বত‍্য চট্টগ্রামের প্রাণবৈচিত্র‍্যের সন্ধানে
মনিরুল খান
প্রথমা প্রকাশন; জুন ২০২৩ সংস্করণ; মূল‍্য: ৳৪৫০

মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*