চলচ্চিত্র পর্যালোচনা: চাঁদের পাহাড়

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “চাঁদের পাহাড়” বইটা নিয়ে একদিন রিভিউ দিয়েছিলাম সেখানে ফেসবুকে অনেকে স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাবও জানিয়েছিলেন বইটির প্রতি 💖। তো, সেই পর্যালোচনায় জানিয়েছিলাম একদিন এই বইয়ের উপর ২০১৩ সালে তৈরি করা কলকাতার ১০ কোটি রূপি বাজেটের মুভিটা নিয়েও লিখবো। কিন্তু আসলে কী লিখবো…

মুভিটার শুরু হয়েছে বইয়ের মূল চরিত্র শংকরের একটি দুঃস্বপ্ন দিয়ে। কিন্তু নায়ককে হাতি 🐘 তাড়া করছে দেখে দর্শকের আতংকিত হবার বদলে ঝা চকচকে দৃশ্যপটে মনে হচ্ছিলো, এই ছেলেটা অতি-অভিনয় করছে কেন? 🤨 অযথাই “উহ” “আহ” করে যা না, তা দেখানোর তো আসলে কোনো মানে হয় না। হয় এই দেব নায়কটা অভিনয় জানে না, নয়তো পরিচালক তার অভিনয় বের করতে পারে না। এতোক্ষণ যে হাতির তাড়া খেয়ে নায়ক দৌঁড়াচ্ছিলো, কিছুক্ষণ পরেই আরো এক পাল হাতি দেখে সেই হাতির দিকেই পেছন করে নায়ক দাঁড়িয়ে আছে 🥱 – এর চেয়ে বদখৎ prologue আমি এই মুভিটাতেই দেখলাম। আতংকে উত্তেজিত হবার বদলে বিরক্তি নিয়ে যে মুভির শুরু, সেই গল্পে আবার ফিরে আসা হবে কি? তবু দেখতে হবে পুরো মুভিটাই, কারণ গল্পে বর্ণিত জায়গাগুলো কল্পনায় যেভাবে ভেবেছিলাম, মুভিতে অন্তত দৃশ্যমান হবে আশা করি…

পুরো মুভিতে অনেক বিদেশী অভিনেতা ছিলেন, মুভিটা শ্যুট করা হয়েছে ভারতের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা, কালাহারি মরুভূমিতেও। সেদিক থেকে নতুন স্থান, নতুন স্বাদ আছে মুভিটাতে। কিন্তু খটকার পরে খটকা থাকলে মুভির স্টোরিতে মনোনিবেশ না করে খটকাতেও মাথা ঘুরতে থাকে।

ভারতীয় অংশে নায়ক শংকর (দেব) আর তার বন্ধুরা খুব খুশিতে দিন কাটাচ্ছে। ধুতি-পাঞ্জাবি, শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে তারা গোসলে নামবে। ওমা ধুতি-পাঞ্জাবি/শার্ট পরে ধুপদুরস্ত হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবাই। অথচ এটা ওদের গ্রামেরই নদী। 🤨

নায়ক আফ্রিকা চলে গেলো…

…১০ কোটি রূপির মুভিতে এগুলো নাকি রাতের দৃশ্য – দেখেই বোঝা যাচ্ছে উজ্জ্বল গনগনে সূর্যের আলোয় শ্যুট করে এডিটিং প্যানেলে নীল রঙের লেয়ার লাগিয়ে (কিংবা কালার গ্রেড করে) দেয়া হয়েছে। মানে দর্শককে যে কী মনে করা হয় আল্লা’ মালুম। যেখানে আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে একটা সিংহকে দেখা লাগে, সেখানে একেবারে দূরের horizon থেকে একেবারে সামনের দৃশ্য পর্যন্ত সমান পরিমাণ আলোয় ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে – এটা নাকি “৩০ লক্ষ রূপির সিংহের সাথে শ্যুটিং”। 🤬

মুভিতে এগুলো রাতের দৃশ্য – সামনে নায়ক থেকে দূরের দিগন্ত পর্যন্ত সব ক্লিনিক ক্লিয়ার – এই দৃশ্য শ্যুট করতে খরচ করা হয়েছে ৩০ লক্ষ রূপি।

কুপি আর মোমবাতির আলো যে এতো সাদা হতে পারে আমার জানা ছিলো না। তাছাড়া আফ্রিকার গহীনে কুপি আর মোমবাতির আলোয় এতো well-lit ঘর আমি আমার জীবনে দেখিনি। সেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঘরে জ্বালানির তেরোটা বাজিয়ে শংকর তিনটে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমায় আবার ঘুম থেকে উঠে ব্ল্যাক মাম্বা সাপ দেখার জন্য তাকে টর্চ জ্বালতে হয়।

শংকর আর আলভারেজ – দুজন ট্রেকার বেরিয়ে পড়েছে পাহাড় বাইতে – কোনো পোর্টার নাই। দুজনের পিঠে রাকস্যাক, বাইরে ঝোলানো কিছু বস্তু, বন্দুক, মানচিত্র ইত্যাদি। পাহাড় বেয়ে উঠে তারা ক্যাম্প করেন। সেখানে আকাশ থেকে চেয়ার-টেবিল, ফুড কার্ট, এসে হাজির হয় তাদের ক্যাম্পে। এখানেই শেষ নয় – ৭৫০০ ফুট উচ্চতায় খাড়া পাহাড় ক্লাইম্ব করে উঠে তারা পরের ক্যাম্প করেন, যেখানে নিজের শরীর নিয়ে কোনোরকমে উঠতে দেখা যায়; কিন্তু সেখানেও তাদের ক্যাম্পে আকাশ থেকে নাযিল হয় রাঁদা করা কাঠে তৈরি চেয়ার-টেবিল আরো কত কী? আমি আমার জিন্দেগিতেও কোনো সোলো ক্লাইম্বারকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে পাহাড়ে যেতে দেখিনি। 🤬 …সেখানে শুতে গেলেও রাঁদা করা কাঠের ফ্রেমের বিছানায় শুতে হয়। 🤬

VFX খুব বেশি ছিলো না। তবে প্রথমদিককার VFX-গুলো অতোটা দৃষ্টিকটু ছিলো না। কিন্তু আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের অংশটার VFX দেখে আমি মাননীয় স্পীকার হয়ে গেছিলাম। বুনীপের VFX মন্দ হয়নি, ভয়ংকরকে ভয়ংকরই দেখাতে পেরেছেন কারিগররা। 👍 …শংকর আবার খালি হাতে ঝপ করে কাঁকড়া বিছা ধরে চিবিয়ে খায়, কিন্তু কাঁকড়া বিছা আক্রান্ত হয়েও হাতের বাইরে থাকা বিষাক্ত লেজ দিয়ে শংকরকে মারে না – দূর্দান্ত VFX। 🤬

বিভূতিভূষণের মূল গল্পে শংকর অন্ধকার গুহার ভিতরে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে পকেটে ভরে, পরে বাইরে বেরিয়ে দিনের আলোয় জানতে পারে এগুলো হীরা। কিন্তু মুভিতে শংকর গুহার ভিতরেও উজ্জ্বল ঝকঝকে আলোতে হীরা দেখছে কিন্তু সেগুলোকে চিনতে পারছে না, পাথর ভাবছে। গবেটগিরির একটা সীমা আছে। 🤬

মরুভূমির গুহার ভিতরে মৃত মানুষের মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে লেখা চিরকুটে কম্পিউটারাইজ্‌ড cursive ফন্টে পরিশীলিত লেখা দেখে বুঝা হয়ে গেছে প্রপ্‌স বানানোর দায়িত্বও হাঁটুতে মগজওয়ালা কারো ঘাঢ়ে ছিলো। …শেষের অংশে মরুভূমিতে মৃতপ্রায় শংকর গুহায় পাওয়া মৃত মানুষটির সৎকার করছে, অথচ এই শরীর নিয়ে সে আশেপাশে আগুন দিয়ে সুন্দর করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দ্বীপশিখা বানিয়েছে। 🤬 শংকরের সব শেষ, গুলিও আছে মাত্র ২টা, কিন্তু শংকর এই মরুভূমির তপ্ত রোদে এখনও গুলির বেল্ট বহন করছে, সেটা পাথরের উপরে সাজিয়ে রেখেছে। 😴

কালাহারি মরুভূমিতে মৃতপ্রায় শংকর নিজে মরতে মরতে অন্য আরেকটি মৃতদেহের সৎকার করছে সুন্দর করে দিয়া জ্বালিয়ে – ও, মরুভূমিতে রাতের আলোয় সবুজ ঘাসও দেখা যায় কিন্তু।
Google Fonts থেকে একটা cursive ফন্ট মরুভূমির মৃত্যুপথযাত্রী একজন পথযাত্রীর কাগজে নাযিল হয়েছিলো

পুরো মুভি জুড়ে এত্তো এত্তো বিরক্তি নিয়ে সেই মুভিতে আর ভালোলাগা বলতে কি কিছু থাকে? আফ্রিকার লোকেশন, লকোমোটিভ, আর ভারতীয় অংশের অভিনেতা আর বিদেশী অভিনেতাদের অভিনয় ছাড়া এই মুভি থেকে ভালো কিছু নেয়ার আছে বলে আমার অন্তত মনে হয়নি।

এককথায় প্রয়াত অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বলতে হয়, “রাবিশ! নো নো নো, অল রাবিশ” 🤬

মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*