ইদানিং একসাথে দুটো বই পড়া হচ্ছে। রাস্তায় বাসে পথচলতি পড়ি এক বইয়ের পিডিএফ, আর বাসায় ফিরে আঙ্গুল ঘষে খস খস করে পাতা-ওল্টানো অন্য কোনো বই। এই বইটা ঈদের সময় পড়ে শেষ করলাম।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়া হয়নি কখনও – এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমি বই পড়ি, তবে সবাই পড়ে বলে কোনো বই পড়েছি – এমনটা কম হয়েছে। কিন্তু চাঁদের পাহাড় বইটা দেরিতে হলেও পড়ার আগ্রহ তৈরি হবার পিছনে পাহাড়চারীদের ভূমিকা আছে। মূলত পাহাড় নিয়ে আগ্রহ আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থেকেই বইটা পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়।
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, বইটা অনেক আগের, সেই ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বেরিয়েছিলো। সুতরাং আজকের যুগের ঝা চকচকে অভিযান, লেখার গাঁথুনি তখনকার লেখায় থাকবে না – এটা মনে রাখতে হবে। তখনকার লেখা তখনকার মতো করে গাঁথুনি নিয়েই লেখা।
এক বাঙালি ছেলে কিভাবে আফ্রিকার শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে চাকরি করতে চলে গেলো, আর পরে এক পর্তুগিজ স্বর্ণসন্ধানীর সাহচর্যে পাহাড়ের মোহে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ে – তা-ই বইটার উপজীব্য। আমার ছোট খালাকে পড়তে দিয়েছিলাম, উনার বক্তব্য: “এই বই পড়ে তো ভয়েই ছিলাম। একটু পর পর এমন একেক জঙ্গুলে জানোয়ার আক্রমণ করে যে, আতঙ্কে থাকি”।
যে সংস্করণটা আমি পড়েছি, তাতে আবার বাংলাদেশী প্রকাশনী গল্পসংশ্লিষ্ট আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান, প্রাণীর ছবি জুড়ে দিয়েছে শুরুতে – যদিও এগুলো আমি আগেও দেখেছি, তবে নতুন পাঠকদের জন্য হয়তো সেগুলো কিছুটা হলেও কাজে লাগবে। কিন্তু যত যাই হোক, মূল বইয়ের প্রচ্ছদ কিংবা ইন্টারনেটে বইটার যত প্রচ্ছদ পাওয়া যায় তার তুলনায় প্রপা প্রকাশনের প্রচ্ছদটা আমার কাছে বিশ্রী লেগেছে – না আছে কোনো অ্যাডভেঞ্চারের ছাপ, উল্টো একটা পাহাড়ের তুলনায় অভিযাত্রীর প্রাধান্য বেশি হয়ে গেছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বইটা লিখতে গিয়ে পরিশ্রম করেছেন ভালোই। তিনি সেই আমলে বেতারের যুগে, ইন্টারনেট ছাড়াই আফ্রিকা, আফ্রিকার প্রেইরী, Richtersveld পর্বতমালা, বন্য জীবজন্তু, কালাহারি মরুভূমি, বুনিপ ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে যথাসম্ভব সত্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছেন। একজন লেখক হিসেবে সম্পূর্ণ কল্পনার আশ্রয় নেয়াতে যেখানে বাধা নেই, সেখানে সত্যাশ্রয়ী থাকার চেষ্টা করাটা একজন লেখকের জন্য সাধুবাদ পাবারই বিষয়।
অভিযান সব সময়ই রোমাঞ্চকর, বাঙালি ছেলের বহির্বিশ্বে অভিযান আরো বেশি রোমাঞ্চকর। এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদও বেরিয়েছিলো। তাছাড়া বইটির গল্প নিয়ে $1.83 billion [ডলার] খরচ করে কলকাতার দেবসহ ভারতীয় আর ভিনদেশী কাস্ট নিয়ে একটা মুভিও বেরিয়েছে ২০১৩তে। সেই মুভি রিভিউ আজকে দিচ্ছি না। তবে যাদের বই পড়ার ধৈর্য নাই তারা মুভিটা কানা মামা হিসেবে দেখতে পারেন।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা বইটা পড়লে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাবেন। পাহাড়প্রিয়রা বইটা পড়লে রিখটার্সভেল্ড পর্বতমালা আর সেখানকার আদিবাসী মিথ সম্পর্কে জানতে পারবেন, জানতে পারবেন সেখানকার ভূতত্ত্ব আর খনিজ সম্পদ সম্পর্কেও।
সংগ্রহে রাখুন চাই না রাখুন, কিন্তু পড়ে ফেলুন।
– মঈনুল ইসলাম