যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমি সিম্বল্স বা প্রতীক নিয়ে প্রচণ্ড ফ্যানাটিক ছিলাম। বাংলা একাডেমী বইমেলায় গিয়ে তাই ইতিউতি এই বিষয়ে যা পাই সবই বগলদাবা করে নিয়ে আসি। তখন বাংলা একাডেমী’র পুরোন বইয়ের গোডাউনে ডিসকাউন্ট অফারের হিড়িকে এই বইটা পেয়ে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছিলাম।
ঠিক আমারই মতো হঠাৎই কৌতুহলী হয়ে লেখক আতোয়ার রহমানও সূর্য পূজারীদের সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন বলেই বইটির সূত্রপাত হয়েছিলো। তিনি আরো আগ্রহী হয়ে উঠেন যখন জানতে পারেন সূর্যবাদ ৩টি দেশের রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা পেয়েছে।
সূচীটা একটু উল্লেখ করতে চাই:
- প্রণতোহস্মি দিবাকরম্;
- ইউরোপে সূর্যপূজো;
- উত্তর আমেরিকা: নরভুক সূর্যদেব;
- মধ্য আমেরিকার ইন্টিপূজো;
- রাজধর্ম সূর্যবাদ: মিশর;
- এশিয়ার নানা সূর্য;
- ছদ্মবেশী সূর্যবাদ;
- অভিজাত ধর্মে অনুপ্রবেশ;
- সূর্যবাদের দান-অপদান;
- একালের সূর্যবাদ।
সেই যুগে বাংলা একাডেমীর বইয়ের মধ্যে অনেক নির্যাস ছিলো। সেকারণেই বইটির পরতে পরতে তথ্যের বুনট বইটিকে করেছে সমৃদ্ধ। সূর্যদেবতা যে প্রকারান্তরে কৃষির দেবতা – সেটা উঠে এসেছে বইটিতে। সূর্য যে কেবল সূর্যই ছিলেন না, হয়ে গেছিলেন প্রতীক, পাথরের স্তম্ভ (স্টোনহেঞ্জ), মানবাকৃতির দেবতা – সবই উঠে এসেছে বইটিতে।
কী নেই বইটিতে: মেক্সিকো, মিশর, ভারত, ব্যাবিলন, ইরান, জাপান, সিরিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, দ্বীপদেশ সামোয়া, মহাচীন, … এমনকি বাংলাদেশও। এই বইয়ের মাধ্যমে আমি আশ্চর্য হয়ে জানতে পারি, বাংলাদেশের কুমিল্লায় “ঈমানউদ্দিন ক্বারী” নামক একজন গুরুর দেখানো পথে একদল মুসলমান সূর্যপূজারি রয়েছেন – তারা সংখ্যায় খুব কম হলেও তারা আছেন বা ছিলেন। মুসলমান নিরাকার, এক, অদ্বিতীয় ঈশ্বর আল্লাহ’র উপাসনা করবে, কিন্তু সেখানে সূর্য কিভাবে চলে এলো – সেই তথ্য জানলে চমৎকৃত হবেন। তিনি অবশ্য টিকতে পারেননি সেখানে, তাই আশ্রয় নিয়েছেন চাঁদপুরে। এই সূর্যবাদে ইহুদিদের যাত্রাপুস্তক (Exodus), হিন্দুদের পূণর্জন্ম ইত্যাদির মিশেলও আছে। জানার কোনো শেষ নেই। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরেও সূর্যদেবের ৪টি মূর্তি সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায় বইটি থেকে।
আদি মানবধর্মের সেই সূর্যপ্রেম তো আর হুট করে বিদায় নিবে না, সেই ধর্ম যে বড় ধর্মগুলোতে কিভাবে চুপিসারে ঢুকে গেছে – তারও উল্লেখ করতে ছাড়েননি লেখক। সেটা দেখানোর জন্য তিনি বৌদ্ধধর্ম, ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্মের উদাহরণ টেনেছেন।
সূর্য ছাড়েনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেও — লেখক লিখেছেন:
সূর্য প্রতীক হয়েছে এ-যুগে স্বাধীনতারও। তার এক উদাহরণ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। যার বুকে স্থান পেয়েছে উদীয়মান সূর্যের মণ্ডল (disk)। এটি আমাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক।
আতোয়ার রহমান (বই: সূর্যবাদ)
বাংলা একাডেমীর মূল সংস্করণটি এখন পুরোন বইয়ের দোকান ছাড়া পাবেন না। তবে বইটি “দিব্য প্রকাশ” থেকে পূণর্মুদ্রিত হয়েছে। অনলাইনে কিনতেও পাওয়া যায়। সংগ্রহ করে পড়বার মতোই একটা বই।
দুটো তথ্য দিয়ে বিমোহিত করে রাখি:
- গোলাকার যে-কোনো কিছুই যে সূর্য-পূজারীদের প্রতীক – তা জানার পরে আশপাশের সবকিছু সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে
- রাজবাড়িগুলোর প্রধান ফটকে দুটো সিংহ দেখলে জানবেন, এটাও সূর্যপূজার ছায়াবিশেষ
📕 সূর্যবাদ
আতোয়ার রহমান
বাংলা একাডেমী, ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ | ৳৫০
ISBN: 984-07-2587-4