সালাহ: ধ্যানের জগত

দ্রুততার সাথে নামায পড়া, মুসলমান এভাবে পড়েন না (সংগ্রহ: dailymail.co.uk)
দ্রুততার সাথে নামায পড়া, মুসলমান এভাবে পড়েন না (সংগ্রহ: dailymail.co.uk)

না, কক্ষণো না। এতো দ্রুত নামায পড়া (সালাহ আদায় করা) যাবে না। নামাযকে ধীরে ধীরে পড়া নামাযের উদ্দেশ্য পূরণের একটি শর্ত। আমরা অনেক সময় অভিযোগ, অনুযোগ করি: আমি নামায পড়িনা, কারণ আমি দেখেছি ওমুক ব্যক্তি মসজিদের খতিব হওয়াসত্ত্বেয় মসজিদ থেকে বের হয়ে মদ খায়, মসজিদ কমিটির প্রধান হওয়াসত্ত্বেয় ঘুষ খায়, সুদী ব্যবসায় চালায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়াসত্ত্বেয় মিথ্যা কথা বলে… ইত্যাদি ইত্যাদি। …এইসব বাস্তবতা দেখার পর স্বভাবতই আমাদের কোরআনের এই আয়াতের প্রতিও সন্দেহ জাগে, যেখানে বলা হয়েছে:

নিশ্চয়ই সালাহ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। …
[২৯ সূরা আনকাবূত: ৪৫]

কই? রাখলো তো না এদেরকে? এরাতো নামায পড়ে শয়তান, আমি নামায না পড়েই শয়তান থাকলাম, এটাইতো বেশি ভালো। ওদের মতো প্রহসন করলাম না।

স-ব যুক্তিই ঠিক। এরা সবাই নামায পড়ছে, আবার খারাপ কাজও করছে, কিন্তু তারপরও কোরআনের ঐ আয়াত সঠিক এবং নির্ভুল। কারণ নামায যথার্থভাবে আদায় করার বহু শর্ত আছে। যদি সেসব শর্ত আদায় না করে নামায পড়া হয়, তবে সে নামায ‘নামায’ই না। আল্লাহ’র ওয়াদা তো প্রকৃত নামাযের সাথে, মনগড়া, মাথা ঠেকানো, ঠেকায় পড়ে নামায পড়া নামাযের সাথে না। তাহলে কী করে এরা সংশোধন হবে নামাযের দ্বারা?

নামাযের অনেকগুলো শর্তের মধ্যে এটাও একটা শর্ত যে, নামাযকে ধীরতা (steadiness) এবং স্থিরতার (calmness) সাথে পড়তে হবে। ধীরতা কী? রুকুতে যেতে হবে ধীরে ধীরে, আস্তে আস্তে…রুকু থেকে উঠতে হবে ধীরে, সিযদায় যেতে হবে ধীরে… পুরো নামায জুড়েই ধীরে, ধীরে চলতে হবে। স্থিরতা কী? স্থিরতা হলো দাঁড়ানোর সময় স্থির, শান্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে; বসার সময় স্থির শান্ত হয়ে বসতে হবে; রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে, (অনেকে তা না করেই সিযদায় চলে যান, এতে নামাযের ওয়াজিব ছুটে যায়, আর সিযদা সাহু না করলে নামায শুদ্ধ হবে না); তেমনি দুই সিযদার মাঝখানে স্থির হয়ে বসতে হবে। ধীর…স্থির…ধীর…স্থির…শান্ত…পরিশীলিত…এক অনুভুতি অনুভব করতে হবে।

এনিমেটেড আলোকচিত্রে, জাপানী সামুরাইয়ের ধ্যান (সংগ্রহ: brianluk.com)
এনিমেটেড আলোকচিত্রে, জাপানী সামুরাইয়ের ধ্যান (সংগ্রহ: brianluk.com)

নামাযটা মুসলমানদের জন্য যেমন একটা প্রোগ্রামিং, মুসলমানদের জন্য শরীরচর্চা, তেমনিই নামায মুসলমানদের জন্য ধ্যান বা মেডিটেশন (meditation)। খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, মার্শাল আর্ট (কারাতে, কুংফু, সামুরাই…) ওস্তাদরা সবসময় ধ্যানের সময় চূড়ান্ত রকমের শান্ত, ধীর, যেন তাঁদের ভিতরের আত্মার কথা শুনতে চাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু যখন প্রতিরক্ষার কৌশল শিখাচ্ছেন, তখন বলেন, fast, faster: দ্রুত, আরো দ্রুত, আরো আরো দ্রুত হাত চালাও, পা চালাও, সরে যাও, উড়ে যাও। এই সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি অবস্থা তাঁরা অর্জন করেন।

কারাতের দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন (karatesecrets.org থেকে সংগ্রহ করে অলঙ্কৃত)
কারাতের দ্রুত অঙ্গ সঞ্চালন (karatesecrets.org থেকে সংগ্রহ করে অলঙ্কৃত)

সেজন্যই মার্শাল আর্টের ওস্তাদরা দূর্দান্ত রকমের মানুষ হোন; না, তাঁরা যুদ্ধের জন্য এসব শিখেন না, এসব শিখান না; কারাতে, কুংফুসহ সব রকমের মার্শাল আর্ট হলো শ্রেফ আত্মরক্ষার জন্য। আর এই দূর্দান্ত রকমের শক্তি তাঁরা অর্জন করে নেন নিজের মাঝে দ্রুততা আর স্থিরতার মতো দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়কে সযত্নে লালন করে।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, মার্শাল আর্টের ওস্তাদরা সারাক্ষণই ফাই ফাই-শাঁই শাঁই করেন না, তাই সারাক্ষণই তাঁদের দ্রুত, দ্রুততর হতে হয় না। প্রয়োজনে তাঁরা তা হতে পারেন। কারণ যখন ধ্যানের সময়, তখন তাঁরা সম্পূর্ণ শান্ত, নির্জীব একেকটি মাংসপিণ্ড হয়ে যান। যাদের বিটিভি-তে প্রচার হওয়া আমেরিকান টিভি সিরিয ‘র‌্যাভেন’-এর কথা মনে আছে, তাদের মনে থাকার কথা জোনাথন র‌্যাভেন কী করে ধ্যানের জগতে ডুবে যেতেন, কী করে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাকেই তিনি চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতেন।

নামায হলো মুসলমানদের ধ্যানের জায়গা, আত্মার খাদ্য (সংগ্রহ: gettyimages.com)
নামায হলো মুসলমানদের ধ্যানের জায়গা, আত্মার খাদ্য (সংগ্রহ: gettyimages.com)

এ-ই কথাগুলোই বুদ্ধবাদের কথা। এই স্থিরতাই যোগশাস্ত্রের কথা। এই স্থিরতাই বুদ্ধবাদী মার্শাল আর্ট ওস্তাদদের দর্শন। এই স্থিরতাই কোয়ান্টাম মেথডের আত্মোপলব্ধি। মুসলমানদের সেই ধ্যান, সেই আত্মোপলব্ধির জায়গা হলো তাঁর নামায। সে নামাযে ধীর আর স্থির হয়ে সেই আত্মোপলব্ধি অনুভব করবে। আর নামাযের বাইরে জীবনে চলার পথে একজন পারফেকশনিস্ট হয়ে যাবে। …আর তখনই সে তাঁর নামাযের গুণে বেরিয়ে আসতে পারবে অশ্লীল আর গর্হিত কাজ থেকে।

মনে রাখতে হবে, দেহের খাদ্য দৈনিক তিন কি চারবার ঠিকই দিই, মনকে না খাওয়ালে মন মরে যাবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মনের খাদ্য যোগায়।

-মঈনুল ইসলাম

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

One thought on “সালাহ: ধ্যানের জগত”

মন্তব্য করুন