ধারাবাহিক: নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ ২০০৯ —এর একটি পর্ব
নিঝুম দ্বীপে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে প্রকৃতির থাপ্পড় থেকে কোনো রকমে বেঁচে গিয়ে, প্রায় সারাটা দিন খুইয়ে বিশাল হাতিয়া দ্বীপ পার করে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে দলটা আশ্রয় নিলো একটা ডাহা মিথ্যা কথার – যার কোনোই দরকার ছিল না। এখন সেই মিথ্যা কথারই জালে জড়িয়ে চালতে হচ্ছে একের পর এক চাল। যাচ্ছি আমরা নিঝুম দ্বীপের ফরেস্টারের বাড়িতে। গিয়ে বলতে হবে ঝা-চকচকে একটা কিংবা অনেকগুলো বিশাল বিশাল ডাহা মিথ্যা কথা। প্রকৃতির থাপ্পড়ের পরে এখানে বোধহয় অপেক্ষা করছে পরের থাপ্পড়।
রিকশা এগিয়ে চলেছে। একটা বাজার-মতো পার করে গেলাম। মাথার উপর দুপুরের রোদ। কিন্তু সারা দ্বীপজুড়ে প্রচুর বাতাস। আশপাশে ধানী জমি – সমতল আর সমতল। এখানে-ওখানে হাঁস চরে বেড়াচ্ছে। সাদা, মাটির এক রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে রিকশা। আমরা যাচ্ছি ফরেস্টারের কাছে।
এক জায়গায়, রিকশাওয়ালা আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে বলে, এইটা ফরেস্টারের বাড়ি। ডানদিকে তাকিয়ে দেখি, রাস্তার পাশেই একটা পুকুরমতো, পুকুর না বলে ডোবা বলাই বেশি প্রযোজ্য মনে হয়, পাশেই মাটির দেয়াল আর খড়ের চালা দেয়া একটা কুড়েঘর, যার উপরে লাউজাতীয় গাছের লতা বেয়ে উঠেছে। গ্রামের, নিতান্ত গরীবের ঘর।
ধাক্কাটা সামলাতে কিছুটা সময় লাগলো আমাদের প্রত্যেকেরই। নাকিব এতক্ষণ ফরেস্টার ফরেস্টার বলতে বলতে মুখের ফেনা তুলে ফেলার পিছনে নিশ্চয়ই একটা লোভ কাজ করছিল – আলিশান বাংলো, ফ্রি খাবার-দাবার – আর এই হলো লোভের পাপের প্রতিদান। রিকশাওয়ালার ডাকে বেরিয়ে এলেন লুঙ্গি, সাদা শার্ট আর বুক খোলা হাফহাতা সোয়েটার পরা, গলায় মাফলার প্যাঁচানো, সাদা দাড়ি আর কাঁচা-পাকা মাথাভর্তি চুলে ভরা সুদর্শন এক বয়স্ক ব্যক্তি। রিকশাওয়ালা পরিচয় করিয়ে দিলো, এই যে ফরেস্টার। ঘটনার আকষ্মিকতায় নাকিবের চেহারা দেখা হয়নি, কিন্তু নিশ্চয়ই তখন চেহারায় বোঝা না গেলেও মনের ভিতরে সব বাংলার ‘দ’ হয়ে গিয়েছিল।
ফরেস্টারের সাথে যে লোকটা বেরিয়ে এলেন, তিনি প্যান্ট পরা, ফুলহাতা শার্ট, তার উপর বুক খোলা হাফহাতা সোয়েটার, গলায় মাফলার প্যাঁচানো, একটা চিকন গোঁফ – লোকটাকে দেখেই বাংলা নাটকের ভিলেন “আব্দুল আজিজ”-এর কথা মনে পড়ে গেলো আমার। ফরেস্টারকে ফ্র্যান্ডলি এনটিটি ভাবলেও লোকটাকে মোটেও ফ্র্যান্ডলি মনে হলো না আমার। মিথ্যের ভয়ে যতটা সেঁধিয়ে ছিলাম, তারও চেয়ে ম্রীয়মান হয়ে গেলাম আমি।
কিন্তু নাকিব, আকষ্মিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো। “আঙ্কেল, সিতু আঙ্কেল আপনার কথা বলে পাঠিয়েছেন। আমরা সজীবের বন্ধু।” পাঠক, নামধাম একটাও মনে নেই এখন আর। ১০ বছর আগের ঘটনা লিখছি, তাই দুটো নামই লেখার জন্য বানিয়ে নিয়েছি বলতে পারেন।
আমি তো ভয়ে আছি, নাকিবের এই কথার প্রতিক্রিয়া কী হয় কে জানে। কিন্তু আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ঘটনা খাপে খাপে মিলে গেলো। ফরেস্টার সুন্দর করে হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন আন্তরিকতার সাথে। “সিতু আমারে ফোন দিছিলো। ও বলছে আপনারা আসতেছেন। আসেন, আসেন।”
জমে থাকা সব বরফ পানি হয়ে গেলো। আমরা রিকশাওয়ালাদের ভাড়া চুকিয়ে এগিয়ে গেলাম। কাঁচা ঘরে আর কীইবা আশা করতে পারেন আপনি। তেমনটাই ভিতরটা। দুজন পুরুষের কোনো রকম সংসার আরকি। এরই মাঝে তাঁরা আমাদের জন্য রান্নাও করে রেখেছেন দেখে আমাদের প্রত্যেকেরই মনের ভিতরে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। এই সাধারণ মানুষগুলোর সাথে এত বড় মিথ্যাচার করার কীইবা যুক্তি থাকতে পারে? কিন্তু মিথ্যা এমনই এক জিনিস, একবার তা শুরু করলে এই জালে জড়িয়ে পড়তেই হয়। আমরা ব্যাগ রাখছি ঘরের ভিতর, এমন সময় ফরেস্টার প্রশ্ন করলেন, “সজীব কেমন আছে?”
আমার তো মনে করতেই একযুগ কেটে গেলো, “সজীব”টা জানি কে? কিন্তু, নাকিবের চটপট উত্তর, “জ্বী ভালো আছে।” এই ব্যাটা আবার কথার মেশিন। হুদাই প্যাঁচায়। কথা বাড়ানোর কী দরকার, উত্তর শেষ, চুপ যা, তা না, ব্যাটা বলে কি, “সিতু আঙ্কেলই আসলে, আসার আগে আপনাদের কথা বলে দিছেন।” আমি তখন মনে মনে প্রমাদ গুনছি।
ফরেস্টার বললেন, “ভালো করছে। আমরা তো আছিই এখানে।”
আমি তখন খাবার আগে নামাযটা পড়ে নিতে চাইলাম। বাকিরাও সায় দিলো। মিথ্যাবাদী শয়তানের আবার নামায! শয়তানগুলো এভাবেই বোধহয় ভালো মানুষের বেশে থাকে। সামনের ডোবাসদৃশ পুকুরে নেমে ভালো করে ওযু করে নিলাম। পুকুরের পানি মুখে নিয়ে দেখি নোনতা নোনতা লাগে। যাহোক, মুখ-হাত-পা ধোয়ায় এবার ফ্রেশ লাগছে।
জায়নামায আমার সাথেই ছিল। নামায শেষ করে আমরা খেতে বসলাম। ভালো আয়োজন। পাতে বসে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রশ্নের উদয় যাতে না হয়, নাকিব তাই ফ্লোর নিলো। জিজ্ঞেস করলো, আশে পাশে দেখার কী আছে। এবং আলোচনা সেদিকে মোড় নিলো দেখে স্বস্থি পেলাম, যাক, থলের বেড়াল বেরোবে না। একদিনের জন্য যথেষ্ট মিথ্যাচার হয়েছে। আর না হলেই ভালো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফরেস্টার আমাদেরকে নিয়ে চললেন থাকার জায়গায়। এটা যেই ছাপড়া ঘর, দুজনের জন্যই যথেষ্ট। এখানে আমাদের থাকার চিন্তাও করা যায় না। রিকশা ডেকে তাই আমরা চললাম আবার পিছন দিকে, ঐ যে বাজার ফেলে এসেছিলাম, সেখানে। বাজারের নাম “বন্দর টিলা বাজার”।
এই বাজারের সাথেই একটা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন আমাদেরকে ফরেস্টার আর তাঁর সহযোগী। জীবনে এই প্রথম আমি কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র দেখছি। দোতলা দালান, যার নিচতলা পুরোটা দেয়াল ছাড়া, শুধু পিলার দেয়া, আর দ্বিতীয় তলায় একটু বারান্দা আছে, আর আছে দেয়াল দেয়া ঘর — দেখে মনে হবে নিচে খোলা গ্যারেজওয়ালা একটা দ্বিতল পাকা দালান আরকি। নিচে একটা ফলক লাগানো:
সিডিএসপি-২-এর আওতায় নির্মিত
বন্দর টিলা বাজার বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র
৯ নভেম্বর ২০০৪
ফাঁকা সমতল দুনিয়ায় এগুলোই একমাত্র উঁচু স্থাপনা। এখানকার মানুষের জীবনযাপন, তার সাথে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র – এগুলো কোনোটাই আমার মনে তখনও ছাপ রাখেনি। আমরা তখনও ঘুরতে বের হওয়া একঝাঁক তরুণ, শ্রেফ পর্যটনে আছি বলতে পারেন।
থাকার জন্য সাইক্লোন শেল্টারে আসার ব্যাপারটা একটু কেমন জানি। কিন্তু যখন শুনলাম এই দ্বীপে থাকার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাদে এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোই বোর্ডিং হিসেবে ব্যবহার হয়, তখন একটু আশ্চর্যই হলাম বলা যায়। “বোর্ডিং” জিনিসটা কী, নাম শুনেছি, কিন্তু জীবনে কখনও চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা হয়নি। এবার দেখলাম। ফরেস্টার, ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনকে ডেকে আমাদের জন্য জায়গা দিতে বললে তিনি আমাদেরকে একটা রুম খুলে দিলেন। আমরা একটা হাসপাতালে ঢুকলাম যেন।
বিছানার পরে বিছানা একটার সাথে আরেকটা প্রায় লেগে আছে, ঘরভর্তি শুধু বিছানাই। হাসপাতালের সাথে এতটুকু পার্থক্য – হাসপাতালের বেডে বেডশীট আর বালিশের কভার থাকে সাদা, এখানে সবই রঙীন। হাসপাতালের বেড ছাড়াও কয়েকটা কাঠের বিছানা আছে, মশারির স্ট্যান্ডসহ, যেগুলোতে মশারি লাগানোই আছে, ভাঁজ করে উপরে তুলে রাখা আছে। এখানে হিসাব “রুমপ্রতি” না; “বিছানাপ্রতি”ও না; বরং “মানুষপ্রতি”। জনপ্রতি দৈনিক ৳১৫০ (প্রেক্ষিত ২০০৯)।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, যখন জানতে পারলাম, শুধু রুমগুলোই না, বরং বোর্ডিং-এ আপনার বিছানাও শেয়ার্ড। অর্থাৎ, এই রুমে এমনকি আপনার বালিশের নিচে রেখে যাওয়া কোনো জিনিসই আপনার না, জনগণের। জিনিসের নিরাপত্তার জন্য আপনার কিছুই করার নেই – শ্রেফ তাওক্কালাল্লাহ। শাকিল ভাই তো চরম খুঁতখুঁতে মানুষ। কোনোকিছু পছন্দ হচ্ছে না বেচারার। কিন্তু ‘পড়েছি মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে’ অবস্থা। এই আখরার দুনিয়ায় পিঠ ফেলার যে জায়গা পাওয়া গেছে – এ-ইতো বেশি। অবশেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বলে যখন রুমের চাবিটা পাওয়া গেল, তখন দলে যা একটু স্বস্থি ফিরে এলো। চাবিও পাওয়া যেত না, যদি আরো বোর্ডার থাকতেন। আমাদের ভাগ্য ভালো ঐসময় ওখানে আর কোনো বোর্ডার ছিলেন না। (সম্ভবত আরেক রুমে আরেকজন বা দুজন বোর্ডার ছিলেন, সম্ভবত সাংবাদিক, এখন আর ঠিক মনে করতে পারছি না)
আবার রিকশাযোগে আমরা ফরেস্টারের বাড়ি ছেড়ে এগিয়ে গেলাম। এবার বোঁচকা-বাচকি রেখে আসায় সবাই একটু হালকা। ততক্ষণে ৪টা বেজে গেছে। আমরা বেরিয়েছি দ্বীপ ঘুরে দেখতে। আমাদেরকে এস্কর্ট করছেন স্বয়ং ফরেস্টার আর তাঁর সহযোগী। রিকশা থেকে নেমে গ্রামের ভিতর দিয়ে, হাঁটা পথে চললাম আমরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে।
নিতান্ত গরীব একটা এলাকা। ঘরগুলো খড়ের ছাউনি, আর শনের বেড়া দেয়া। খুব কম ঘরই টিন লাগাতে পেরেছে। অধিকাংশ ঘরেই খড়ের ছাউনিতে বেয়ে উঠেছে গেরস্তের সবজি – লাউ, শিম কিংবা এজাতীয় কোনো লতানো গাছ। বাড়ি বলতে অধিকাংশই একটাই মাত্র ঘর, এবং ঐ একটাই। আশেপাশে আর কিছুই নেই, এমনকি বড় কোনো গাছও কোনো কোনো বাড়ির আশেপাশে নেই। দেখে মনে হবে, বস্তিতে যেমন উদ্বাস্তু ঘর তৈরি করা হয়, কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, এই বাড়িগুলোও তেমন। খুব কম ঘরই একটু পরিকল্পনামাফিক। কোনো কোনো বাড়িতে খড়ের গাদা আছে, কোনোটায় আছে গরুর খাবার জন্য গামলা। বাড়িঘরগুলোও ইতস্থত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে – এখানে এক বাড়ি, তো ঐইই যে দূরে আরেক বাড়ি।
পথ চলতে চলতে কথা হচ্ছিলো ফরেস্টারের সাথে। নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ মানুষের তৈরি কেওড়াবন আর তার জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশ বন বিভাগের উদ্যোগে এই দ্বীপে গাছ লাগানোর উদ্যোগ শুরু হয় ‘৭০-এর দশকে। সেই উদ্যোগ যে একটা অপূর্ব দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে তা কে ভেবেছিল। দক্ষিণের এই ঘন-সবুজ ম্যানগ্রোভ বেস্টনী পুরো দ্বীপটাকেই টিকিয়ে দিয়েছে। আর এই বনই এই দ্বীপকে রক্ষা করে চলেছে সমুদ্রের সব তান্ডব থেকে। এই যে ফরেস্টার, তাঁর সহযোগী – এরা হলেন এই বনের রক্ষক – শুধু এই কাজেই এঁরা নিয়োজিত বলা চলে।
পথে এক লোক কাঁধে করে বিশাল একটা গাছ কেটে নিয়ে আসছে। ফরেস্টারকে দেখে খুব কাচুমুচু করেই সালাম দিলো। ফরেস্টারের সহযোগী হাত ইশারায় সরে পড়তে বললেন। সাক্ষাৎ অপরাধীকে হাতেনাতে ধরেও কিছুই না বলে সটকে পড়তে বলায় শাকিল ভাই চোখে-মুখে একটা বিরাট জিজ্ঞাসা-চিহ্ন নিয়ে তাঁদের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। রীতিমতো কৈফিয়তই চেয়ে বসলেন, “এটা কী হলো!” ফরেস্টারের সহযোগী বাধ্য হয়েই এই সচেতন নাগরিককে কৈফিয়ত দিলেন – সারমর্ম: ‘আমরা আসলে কড়াকড়ি করি না। কড়াকড়ি করে লাভ হবে না। তখন তারা দম্ভের সাথে নিয়ম ভাঙবে। এখনও ওরা নিয়ম ভাঙে, কিন্তু অপরাধবোধ কাজ করে। আমাদেরকে ভয় পায়। এই ভয়টা থাকুক। আসলে ওরা গাছ না কেটেও উপায় নেই। গাছ তো জীবনের প্রয়োজনেই লাগে।’
এই ম্যানগ্রোভ বেস্টনী, এই ছন্নছাড়া উদ্বাস্তুর মতো ঘর, এই নৌজীবন, এই সাইক্লোন শেল্টার, এই সমতল ভূমি, এই সাধারণ্যের গাছ চুরি – এর কোনো কিছুই তখনও ঠিক দাগ কাটেনি আমার মনে। তখনও আমি একটা ঘোরের মধ্যেই যেন আছি। ফরেস্টার আমাদেরকে নিয়ে চলেছেন, আমরাও চলেছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমি জানি না। নাকিব জানে হয়তো। আমি তখন কেবলই দেখে চলেছি। নিছক পর্যটকের মতো দেখেই যাচ্ছি। তাই ফরেস্টারের সহযোগীর এই বক্তব্য তখনও বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করিনি আমি।
হাঁটতে হাঁটতে মোটামুটি বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ একসময় আমরা ম্যানগ্রোভের কাছাকাছি চলে এলাম। কিন্তু হায়! এ-কী অবস্থা!! “একটু ছাড় দেই” বলে ফরেস্টার আর তাঁর সহযোগী যা বোঝাতে চাইলেন, তার বাস্তব চিত্র তো ভয়াবহ। বনের এদিকটা যতদূর চোখ যাচ্ছে, প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
এখানটাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল শুকনার মধ্যেই, মাত্র শুরু হয়েছে বলা যায়। সুন্দরবন কখনও যাইনি। জীবনে এই প্রথম ম্যানগ্রোভ দেখা। আজব এক জঙ্গল। ম্যানগ্রোভ বনের গাছগুলো (এখানে কেওড়া) মাটির নিচে তো শিকড় গজায়ই, মাটির উপরেও শিকড় বের করে দেয়, যেগুলোকে বলে শ্বাসমূল। “মাটির উপরের শিঁকড়” মানেই কিন্তু শ্বাসমূল না, আমরা কিন্তু বড় বড় বটগাছেও মাটির উপরের শিঁকড় দেখতে পাই, ওগুলোকে বলে Stranglers (prop roots)। সাধারণত সমুদ্রের লবণাক্ত পানির কিনারে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায় গাছেরা, তৈরি করে ম্যানগ্রোভ বন। জোয়ারের সময় যখন লবণাক্ত পানি এসে গোড়া ঢেকে দেয়, তখন এই শ্বাসমূল দিয়েই গাছেরা দেহে অক্সিজেন সরবরাহ করে বলে তাদের এই নাম। এজাতীয় শ্বাসমূল pneumetaphores-জাতীয়। যদিও এরকম “মাটির উপরের শিঁকড়”-কে Aerial Roots বলা হয়, তবে মাটি ফুঁড়ে বের হওয়া শিঁকড়গুলোকে অনেকে Aerating Roots বলতে চান। বনের এই অংশে পানি নেই, কিন্তু শুকনো জমিতেও শ্বাসমূলের কমতি নেই। ভাবুন তো একবার, একজন মানুষ মাটিতে শুয়ে আছে, আর তার শুঁড়ের মতো একশোটা নাক উঁচু হয়ে আছে, শ্বাস নেবার জন্য – অদ্ভুত শোনায় না?
যেহেতু এই বনটা মানুষের তৈরি বন, তাই গাছ জন্মানো আর বেড়ে উঠাটা এখানে নিয়ন্ত্রিত, গোছানো। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব মনে হচ্ছে হিসাব করে দেয়া, প্রাকৃতিক বনের নিচের, ভূমিসংলগ্ন গুল্মস্তরটা প্রায় নেইই – খোলামেলা, পরিষ্কার বন – ঠিক ‘জঙ্গল’ না আরকি – অনেকটা গাজীপুরের শাল বাগানের মতো।
এই জঙ্গলের মূল আকর্ষণ আবার হরিণ। গাছ গজানোর পরে বন বিভাগ এখানে ছেড়েছে হরিণও। আর সেগুলোই বংশবিস্তার করে চলেছে এই বনে। নিঝুম দ্বীপ আসার মূল আকর্ষণ বন আর হরিণ। কিন্তু এখন এই পড়ন্তবেলায় হরিণ দেখতে পারার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা এখন শুধু বনই দেখবো বলা চলে।
আমরা বন দেখছি। ফরেস্টার আর সহযোগী আরেকটু ভিতরে নিয়ে গেলেন আমাদেরকে। আমরা আমাদের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছি কেওড়ার জঙ্গলে। ম্যানগ্রোভ মানেই কিন্তু কেওড়া গাছ না, সুন্দরী, গরান, গেওয়া এসব গাছও ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে হয়। আসলে “ম্যানগ্রোভ” লবণসহিষ্ণু এক প্রকারের জঙ্গলের নাম, যেখানে এসব ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রজাতির গাছেরা থাকতে পারে।
যেমন: মেঝেতে ধনিয়া পাতার মতো একপ্রকারের গাছ দেখতে পেলাম। ছবি তুলে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী গাছ? তাঁরা জানালেন, স্থানীয়ভাবে ডাকা হয় “নইন্না ঝাউ”, মানে “নোনা ঝাউ” (salt cedar) – tamarix গোত্রের। বুঝলাম, ভুল করেছি চিনতে। আসলে ঝাউ গাছের পাতার মতো বলা উচিত ছিল। এগুলো ঝাউয়েরই জাত, তবে নোনা পানিতে জন্মায়। এসব গাছে সুন্দর গোলাপী ফুল হয়, তবে আমরা গাছগুলোতে কোনো ফুল দেখলাম না।
ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূলগুলোর মাথায় নাকি শ্বাসগ্রন্থি বা শ্বাসছিদ্র থাকে। কিন্তু এতো খুটিয়ে দেখা হয়নি আসলে। আরেকটা মজার ব্যাপারও তখন জানতাম না, আমরা সাধারণত কী করি, গাছের বীজ মাটিতে পুতে দিই, তারপর তাতে অঙ্কুর বেরোয় (অঙ্কুরের উদ্গম), আর সেই অঙ্কুর মাথা তুলে মাটির নিচ থেকে বেরোয়। কিন্তু ম্যানগ্রোভের গাছগুলোতে নাকি বীজের অঙ্কুর বের হওয়ার (অঙ্কুরোদগম) কাজটা গাছেই হয়ে যায়। মাটিতে পড়ার পর মাটিতে গেঁথে গজিয়ে উঠা শুরু হয়ে যায়। বলতে পারেন, এই গাছগুলো বেশি পাকনা। 😄
এই ফাঁকা ফাঁকা জঙ্গলকে ঠিক “জঙ্গল” বলতে ইচ্ছে হয় না। এতো ফাঁকা দুনিয়ায় কি হরিণ আসবে মরতে? হরিণ তাই আমাদের আর দেখা হলো না। তবে হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম কোথাও কোথাও – লম্বাটে দুটো ওয়াটার ড্রপলেটের আকৃতি কাছাকাছি আঁকলে যেমন, তেমন। মাটিতে বেশ গেঁথে আছে।
সূর্য ডুবতে বসেছে। সোয়া ছ’টা নাগাদ সূর্য ডোবে তখন। সেদিনকার মতো আমাদের ঘুরাঘুরির ইস্তফা দিতে হলো। ফিরতি পথ ধরলাম। পড়ন্ত বিকেলে গাছের ডালে ডালে পাখিরা বসে আছে। শালিকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ধানের আইলে। পথে সদ্য গজানো কেওড়া গাছও দেখলাম। বুঝলাম, গাছ যেমন কাটা হয়, তেমনি গজায়ও। ধানী জমির আইল ধরে, হাঁটা পথে ফিরছি আমরা। সম্পূর্ণ চকচকে টিন দিয়ে ঘেরা, টিনের চালার একটা ঘর দেখলাম। জানলাম, এটা নাকি মাদ্রাসা। পুরোন টিন আর খড়ের চালার মিশেলে একটা জীর্ণশীর্ণ ঘরও দেখলাম – দেখে যে-কেউ বলবে, গরুর গোয়ালঘর – সাইনবোর্ড দেখে মোহভঙ্গ হলো: এটা একটা স্কুল:
মুন্সিগ্রাম উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়
পরিচালনায়: দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা
সহযোগিতায়: ব্র্যাক
পথে একটা ভাঙা ঘরও দেখলাম; মাটিতে ঘরের চালা পড়ে আছে। সেই চালই এদিক-ওদিক ঠ্যাক দিয়ে কোনোরকম একটা লীন-টু আস্তানা বানিয়ে আশ্রয় বানিয়েছে ঘরের বাসিন্দারা। তখনও বিষয়গুলো শ্রেফ দেখে যাচ্ছি আমি। ঠিক মাথায় ঢুকেনি কী দেখছি।
সেদিনের মতো আমরা ফেরার পথ ধরলাম বোর্ডিং অরফে সাইক্লোন শেল্টারের দিকে। ফরেস্টার আর তাঁর সহযোগী আমাদেরকে বন্দর টিলা বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন। একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খেলেন আমাদের সাথে। জানালেন এই রেস্টুরেন্টে গরুর দুধ পাওয়া যাবে। এখানকার সবই খাঁটি, নির্ভেজাল। এখানকার মানুষ এখনও ভেজালের যুগে প্রবেশ করেনি। যারা আমাদের বিশাল পথ-পরিক্রমা পড়েছেন, তারা বুঝতে পারছেন, কতটা দুর্গম এখানে যাতায়াত আর মালামাল পরিবহন। প্যাকেটজাত খাবারের চেয়ে বরং দ্বীপের পালিত গরুর দুধের চা-ই এখানে সহজলভ্য।
আমরা চা খেলাম। তারপর ফরেস্টারের থেকে আগামীকালের রুটিন জেনে নিয়ে তাঁদেরকে বিদায় দিলাম। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার পরে আবার ঐ রেস্টুরেন্টে এলাম। রেস্টুরেন্টটা বাজারেই, মূল রাস্তার সাথেই লাগোয়া। মনের সুখে এটা-ওটা অর্ডার দিয়ে সান্ধ্যকালীন নাস্তা আর সাথে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে নাস্তা সারার পর বিল শুনে আক্কেল গুড়ুম। ব্যাটা আমাদেরকে কাবু করে ফেলেছে। বুঝে নিলাম, এখানে আর আমাদের চলবে না। অন্য জায়গা খুঁজে নিতে হবে।
এই দ্বীপে বিদ্যুতের উৎস জেনারেটর – শুনেছি এটা নাকি সরকারি বরাদ্দ। তাও রাত ক’টার পর নাকি (৮টা না ১০টা মনে নেই) বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের বোর্ডিংয়ে বিদ্যুতের উৎস দ্বীপের এই জেনারেটর। আর জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে সৌরবিদ্যুৎ। রুমে বসে সারাদিনে যা হলো তার চর্বিত চর্বন চলতে থাকলো। এই মিথ্যাচার কারোর কাছেই এখন আর সুন্দর লাগছে না। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে শুরু হলে তা টেনে নিয়ে যেতেই হয়, আমাদেরকেও সেটাকে টেনে নিয়ে চলতে হবে এখন।
‘চাচা মিয়া’ যথেষ্ট কষ্ট করেছেন তাঁর ভাতিজাদের জন্য। ফরেস্টারের এই নাম দিয়েছে নাকিব। তাঁর আড়ালে তাঁকে এই নামে ডাকে এখন পুরো দলই। যদিও তাঁর কষ্ট স্বীকার করছে দল, কিন্তু তাঁদেরকে বোকা বানানোয় সারাদিনে যা কিছু হলো, তা এখন দলের কাছে হাসির বিষয়। নাকিব আর শাকিল ভাই এখন সেগুলোর কানাকাঞ্চিতে হাসি খুঁজে খুঁজে বের করছে আর পুরো রুম দমকে দমকে হাসছে।
এখানে মানুষের রাত হয় অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু শহরের বাসিন্দা আমরা, শহুরে ভূত বলা যায়, রাত শুরুই হয় রাত বারোটা বাজে। তাই খাবার রেস্টুরেন্টে ১০টা বাজে গিয়ে দেখা গেলো দেরিই করে ফেলেছি আমরা। তবে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করা গেলো।
রাতে ঘুমাতেও দেরী করলাম আমরা। গল্প আর শেষই হতে চায় না। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোলাম তৃপ্তির সাথে।
২২ ডিসেম্বর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ – মঙ্গলবার
ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটা, সাড়ে সাতটার দিকে। সক্কাল সক্কালই দেখি নাকিব ভাই গিটার নিয়ে বসেছে বোর্ডিং-এর বারান্দায়। সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম ফরেস্টারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। হেঁটেই চললাম আজকে আমরা। পথে এক বাচ্চা ছেলে লম্বা একটা লাউ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে, নাকিব তাকে ধরে একটা ছবি তুলতে ছাড়লো না।
চাচা মিয়ারা যেন আমাদেরই অপেক্ষা করছিলেন। একটা টং দোকানে বসা ছিলেন। তাঁদেরকে দেখে এগিয়ে গেলাম। সেখানে গাছ-পাকা কলা খেলাম আমরা। তারপর তাঁরাই পথ দেখালেন আমাদেরকে জঙ্গলের দিকে। আজকেই প্রথম বুঝলাম চাচা মিয়ার সহকারীকে কেন কালকে ভিলেনের মতো লাগছিল, ব্যাটা আসলে ‘গানম্যান’। আজকে বন্দুক কাঁধে নিয়ে চলেছেন জঙ্গলে। কারণ আজকে যাবো গভীরে; হরিণের ডেরায়…
মাত্র দুই/তিন হাত দূর দিয়ে হরিণের পাল দেখার এখনও বাকি…
(চলবে…)
এবারই প্রথম পর পর ৪ দিনে প্রকাশিত হচ্ছে ৪টি পর্ব। চোখ রাখুন নিশাচর-এ। প্রতিদিন রাত ১০টায়।
চমৎকার প্রকৃতি পাঠ।