প্রেক্ষাপট: ডিসেম্বর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ
নিঝুম দ্বীপ গিয়েছিলাম আমরা চারজন: আমি, [বন্ধু] নাকিব, [নাকিবের মামাতো ভাই] শাকিল ভাই, আর [শাকিল ভাইয়ের বন্ধু] আফজাল ভাই। এই চারজন মিলে মোটামুটি অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ যে ট্যুরটা দিয়ে এলাম, সেটা রীতিমতো সবার সাথে শেয়ার করার মতো। তবে সেই বিরাট কাহিনী এখানে না ফেঁদে কিছু জরুরি তথ্য এখানে দিয়ে রাখি, পরবর্তিতে যারা যাবেন, তাদের জন্য সুবিধা হবে তাহলে:
১. ‘নিঝুম দ্বীপ’ আসলে ‘চর ওসমান’
এই কথাটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তার কারণ নিঝুম দ্বীপ ঘুরে আসেননি আমাদের মতো করে। দ্বীপের চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত থাকে, নিঝুম দ্বীপের তিনপাশে নদী, একপাশে সমুদ্রের ছোঁয়ামাত্র। তাছাড়া দ্বীপের সৈকতে বালু কিংবা পাথর থাকে, কিন্তু চরের সৈকতে থাকবে শ্রেফ কাদা আর কাদা (আই মীন কর্দম)।
২. খরচ
নিঝুম দ্বীপে যাবার সবচেয়ে বড় বিষয়টা হলো খরচ অনেক বেশি, কারণ জায়গাটা অনেকটা দুর্গম। রাস্তাঘাট ভালো করেও রাখা যায় না আইলা-সিডরের মতো তান্ডবের যন্ত্রণায়। দ্রুতগামী যান বলতে আছে টেম্পু (নাকিবের ভাষায় ‘ডাইনোসর’, কারণ সেগুলো ঢাকা থেকে ডাইনোসরের মতোই বিলুপ্ত)। ঢাকা থেকে একমাত্র নৌপথেই যা একটু কম ভাড়া। তারপরও হাতিয়া পার হতেই অনেক খরচ হয়ে যায়।
৩. থাকা-খাওয়া-মালপত্র
থাকা-খাওয়া কথাটার সাথে যারা বিলাশ যুক্ত করছেন, তারা নিঝুম দ্বীপ যাবেন না, আর গেলেও সরকারি বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে যাবেন, দয়া করে। কারণ জায়গাটা খুব দুর্গম, স্থানীয় মানুষের ভালো অবকাঠামো নেই। মনে রাখতে হবে, আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় (ইংরেজিতে সাইক্লোন বা টাইফুন) দ্বীপটাকে লবণ পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়ে যায়, ধুয়ে দিয়ে যায়। সেই ধোয়া শুধু ধোয়াই না, ঘষেমেজে ধুয়ে দিয়ে যায়।
থাকার জন্য কম ভাড়ায় সাইক্লোন শেল্টারেই ৳১৫০ [টাকা] জনপ্রতি ভাড়ায় মাথা গোঁজা যাবে, তবে সেটা কোনো হোটেল নয়, বোর্ডিং। হোটেল আর বোর্ডিংয়ের মাঝে পার্থক্য হলো হোটেলে নিজেদের জন্য রুমটা ভাড়া করে নেয়া যায়, আর বোর্ডিংয়ে নিজে শুধু মাথা রাখার জায়গা পাবেন অনেকগুলো বিছানার মাঝে একটার একজনের জায়গায়। সেখানে সিঙ্গল খাট আগে বরাদ্দ হয়ে গেলে ডাবল খাটে অপরিচিত মানুষের সাথেও শুতে হতে পারে। তাই দামী জিনিসপত্তর সাথে না নেয়াই ভালো, কারণ এতো লোকের কাছে যে ঘরের চাবি থাকবে, সেখানে দামী জিনিস না রাখাই উত্তম। …তবে “নামারপাড়া” নামক জায়গাতে হোটেল আছে। দামদর মনে হয় ৳১৫০-ই, তবে যাতায়াত খরচ বাবদ আরো হিসেব করে রাখতে হবে।
খাওয়ার জন্য স্থানীয় নিম্নমানের হোটেল আছে, যদিও আমাদের মতো ট্র্যাভেলারের কাছে ওগুলো সোনায় সোহাগা। আমরা তিনদিন শুধু হাঁস খেয়েছি। স্থানীয় এক হোটেলের বয়ের সাথে খাতির জমিয়ে দুই হাসেঁর চার রান নিশ্চিত করেছি আমাদের পাতে। এরকম কিছু খাবার আপনি আনন্দেই পেতে পারেন সেখানে। তবে কোনোক্রমেই আগে থেকে দরদাম না জেনে খেতে বসবেন না, একেবারে আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবে। কারণ এরা অভাবী মানুষ, সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না (অবশ্য সবাই এই দলের অন্তর্ভুক্ত না, বেশিরভাগ মানুষই ভালো)।
মালপত্তর যত কম হবে তত ভালো। কারণ রাস্তাঘাটে প্রচুর সমস্যা। আর রিকশায় যাতায়াত খরচ অনেক বেশি।
৪. যাবার পথ
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে হাতিয়ার লঞ্চে চড়তে হবে, সাধারণত বিকেল পাঁচটায় ছাড়ে, সারারাতে গিয়ে হাতিয়ায় পৌঁছে। হাতিয়া একটা বিশাল চর, এটাকে বরং দ্বীপ বললে কিছুটা মানায়। বেবিটেক্সি করে ওছখালি যেতে হবে। সেখান থেকে আবার বেবিটেক্সিযোগে মোক্তারাঘাট। সেখান থেকে নৌকায় খাল-নদী পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ।
নোয়াখালি হয়ে সড়ক পথে যাওয়া যায়। তবে সেপথে খরচ অনেক বেশি।
৫. সময়
উত্তম সময় হলো শীতকাল। বর্ষাকালে একেবারে কাদায় গোসল করবেন, আর একটু পরপর পিছলা খাওয়া ফ্রি। বর্ষাকালে নিঝুম দ্বীপে গেলে আছাড় খাওয়ার অভ্যাস হয় :)। গ্রীষ্মকালে রোদ আর হঠাৎ বৃষ্টির দেখা ভ্রমণ মাটি করে দিতে পারে। আর জুন-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে সবচেয়ে ঝামেলার জিনিসটা হলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাস।
৬. বিপদাপদ
এই এলাকাটা জলদস্যুদের আস্তানা। তাই যথাসম্ভব সাবধান থাকাই শ্রেয়। জলদস্যুদের কেউ কেউ স্থানীয় পুলিশের সাথে হাতও করে রেখেছে। তাদের নেতা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় রিকশা-গাড়ি সব রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়- এরকম প্রভাবশালী তারা।
৭. অন্যান্য
হরিণ দেখার সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো নামারপাড়া। সেখানে থাকাই শ্রেয়। তবে আরেকটু এ্যাডভেঞ্চার করে হরিণ দেখতে পারেন সরাসরি কেওড়া বনে ঢুকে। তবে সাথে কম্পাস না থাকলে বিপদে পড়তে পারেন। আর [স্থানীয়দের মতে] দস্যুদের কবলে পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু দল বেঁধে হৈচৈ করে হরিণদের শান্তি নষ্ট করার মধ্যে নিশ্চয়ই আনন্দ নেই। নীরবে, দূর থেকে দেখুন, নীরবেই চলে আসুন। “আমি”ও খুশি, প্রকৃতিও খুশি।
হাতিয়াতে চাঁদের গাড়িতে (অনেক শখ করে ডাকেন “চান্দের গাড়ি”) খরচ কম পড়বে। কিন্তু চাঁদের গাড়ি নামটায় যতটা আহামরি ভাব আছে, আসলে জিনিসটা একটা সাক্ষাৎ দমবন্ধ করিয়ে মারার হত্যাযন্ত্র ‘গিলোটিন’। যদি একান্ত যেতে হয় চাদেঁর গাড়ির উপরে অর্থাৎ ছাদে বসে যান। ঘূর্ণিঝড় যেহেতু সমুদ্রটাকে স্থলভাগের উপর নিয়ে আসে, তাই অনেক পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে আছে। শীতের সময় ঠান্ডার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা ভালো। বিদ্যুৎ নেই এখানে। স্থানীয়ভাবে জেনারেটর চালানো হয়, যা সরকার থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাতেই মোবাইল চার্জ দিতে হবে। তবে প্রায় সর্বত্র সৌরবিদ্যুৎ আছে, এটা একটা বাড়তি এবং সুন্দর পাওনা। প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র থাকা ভালো। গ্রামীণ ফোনের সীমও পুরোপুরি নেটওয়ার্ক পায় না। নামারপাড়া থেকে বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক পেতে পারেন। ওয়ারিদও দুর্বল। টর্চলাইট সাথে রাখবেন।
স্থানীয় মানুষ খুব ভালো। একেবারে সহজ-সরল। তবে আলাভোলা ভাবাটা বোকামো হবে। নাকিবের সাথে একটা গীটার ছিল, তাতেই সে একটা দর্শনীয় বস্তু হয়ে গেছে। স্থানীয়রা সেই গীটারের ব্যাগের দুই চেইন কিভাবে তালা আটকে রাখা যাবে সেবিষয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু করে দিয়েছিল। তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এরা কতটা আত্মকেন্দ্রীক।
মানচিত্রটা দেখে নিতে পারেন Google Maps-এর Satellite view থেকে। উইকিপীডিয়ার ‘নিঝুম দ্বীপ’ নিবন্ধটা দেখে নিতে পারেন, কিংবা ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধটা। এছাড়া ফেসবুকের কোনো ভ্রমণ গ্রুপের সদস্য হতে পারেন অনেকের অভিজ্ঞতা, মতামত জানতে। weatherforyou.com ওয়েবসাইটে নোয়াখালির এক সপ্তাহের আবহাওয়ার অগ্রিম ভবিষ্যদ্বাণী পাবেন। আগে থেকে আবহাওয়ার খবর কেন জানবেন? …তাহলে শ্রেফ নিচের উপগ্রহের চিত্রটি দেখুন, আর দেখে নিন নিঝুম দ্বীপের অবস্থান:
এখানকার যাবতীয় তথ্য ২০০৯-এর অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণিত। অর্থের হিসাবে মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থের সময়মূল্য মাথায় রাখার অনুরোধ রইলো। ভ্রমণে গেলে আজই যাওয়া ভালো। কাল গেলেও চলবে। পরশু… বড্ড দেরি হয়ে যাবে যে।
– মঈনুল ইসলাম
>really great helpful & enjoyable to read. do u have any FaceBook group? let us know
যে গ্রুপটার কথা উপরে লিখেছি, আমি সেই গ্রুপের কেউ না, শ্রেফ একজন সদস্যমাত্র। আর, ফেসবুকে নিশাচরের কোনো গ্রুপ নেই, একটি পেজ আছে https://www.facebook.com/nishachorblog
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আরো ভালো লাগবে, ফিরে এসে আপনার অভিজ্ঞতা এখানে শেয়ার করলে।
>darun informative!
>আপনি কোনো বিপদে পরেছেন কিনা তা বলেন..? ধন্যবাদ তথ্য দেবার জন্য
আমি বিপদে পড়িনি একথাটা বলা ঠিক হবে না। আবার এমন এক বিপদে পড়েছি যা বলে বোঝানো যাবে না এবং আমার বিশ্বাস হুবহু আমাদের মতো করে না গেলে আপনাদেরকে এজাতীয় বিপদে পড়তে হবে না। তাই সেই কথা উহ্য রেখেই পোস্টটি দিয়েছি।
>thanks for the info brother!!
আপনাকেও ধন্যবাদ।