মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আমি খোঁজখবর করা ছেড়ে দিয়েছি এখন। যেখানে প্রত্যেকটা যন্ত্র খুললেই এখন মুক্তিযুদ্ধ, সেখানে নতুন করে খোঁজখবর নেয়ার আর কী দরকার! কিন্তু ঐ যে, “সুন্দরবন” শব্দটা, ঐ শব্দটাই আমাকে খেয়েছে। সুন্দরবনকে চেনার পর থেকেই মেজর জিয়াউদ্দিনকে চেনা হয়ে গিয়েছিলো। এবারে তাঁর লেখা বইয়ে মনোযোগ দেয়া যাক…
বইটা মেজর সাহেবের নিজের হাতে লেখা নয়, বরং স্থানীয় সংবাদপত্র ‘সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র’-এর সহ-সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন-এর অনুলিখনে উপস্থাপিত। তবে এই এতোটুকু ছাড়া পুরো বইটিই অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রীক জীবনীগ্রন্থ।
জিয়াউদ্দিনের বাড়ি পিরোজপুর। বইয়ের শুরু হয়েছে তাঁর শৈশব থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শে বড় হওয়া আর সুন্দরবনে বাঘ দেখার শিশুসুলভ অভিজ্ঞতা দিয়ে। তারপর একে একে তিনি কিভাবে স্কুল থাকতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেয়ে গেলেন – তার বর্ণনা আছে। কিভাবে ইংরেজিতে দুর্বল, গ্রামের এক কিশোর সেই পাকিস্তানের লাহোরে, গোলন্দাজ বাহিনীতে প্রশিক্ষিত হয়ে মেজর পর্যন্ত হয়ে যায় – তার অনেক বর্ণনা আছে।
কিন্তু এই একমাত্র ব্যক্তি হয়তো তিনিই, যে ছোটবেলা থেকেই দুটো স্বপ্ন দেখতেন: এক, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হবে; আর দুই, যুদ্ধে সুন্দরবন হবে গেরিলাযুদ্ধের পশ্চাৎভূমি। কিশোর থেকে যুবক, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান, মায়ের আঁচল থেকে শত্রুদের ক্যাম্পে – যেখানেই ছিলেন, প্রতিনিয়ত এই একটাই জাল বুনে গেছেন: মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে।
সেই লক্ষ্যে অটুট ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভলগ্নেই ১৯৭১-এর ২০ মার্চ লাহোর থেকে সুযোগ খুঁজে দেশে আসেন। সেই সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা ছিলো না। তারপর ২৫শে মার্চের কালরাতের পরই শুরু করেন “মুক্তিফৌজ” গঠনের কাজ। আর তারপর…
তার আর পর নেই, সেই ছোটবেলার স্বপ্নের জায়গা সুন্দরবনেই ঘাঁটি গেড়ে বসেন তিনি আর তার সাথের ৪,০০০-এরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি এই সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন আক্রমণ পরিচালনা করেন আশেপাশের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আর রাজাকারদের বিভিন্ন ক্যাম্পে। তিনি বুঝতে পারেন রাজাকারদের আক্রমণ করে কোনো লাভ নেই, যুদ্ধ করতে হবে পাঞ্জাবীদের সাথে। তাঁর বাহিনীর দাপটে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলাদেশের যে পতাকা সুন্দরবনে উড়েছিলো, পুরো একাত্তর সাল জুড়ে সেই পতাকা কেউ নামাতে পারেনি।
বইটা সুখপাঠ্য। বানানভ্রান্তি নেই বললেই চলে। মূল কথক নিজে না লিখলেও বইটিতে যত্নের সাথে মূল কথকের ভাষ্য প্রথম পুরুষে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইতে যেমন তার নিজের শৈশব-কৈশোর আছে, আছে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার আর ছেলেদের কথা, আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সমাজ-বাস্তবতার চিত্র, আছে নেহরুর মৃত্যু রহস্য, আছে জেনারেল ওসমানির সাথে সাক্ষাৎ, আছে মংলা বন্দরের (মোংলা বন্দর) আক্রমণ, সফল আক্রমণের পাশাপাশি ব্যর্থতার গল্প, আছে লৌকিকের পাশাপাশি অলৌকিকের হাতছানিও… পুরোটা মুক্তিযুদ্ধকালীন সুন্দরবনের সাবসেক্টরে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার সাক্ষী বইটি।
তবে বইটির কলেবর তাঁর শৈশব থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্তই। মুক্তিযুদ্ধের পরের জীবন সম্পর্কে আর কিছুই নেই বইটিতে। তবে, পাঠকের সুবিধার্থে জানিয়ে রাখতে চাই, তিনি ছিলেন দেলোয়ার হোসেন সাঈদির মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রায়ালের একজন সাক্ষীও। তবে তিনি শুধু এতোটুকু বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সাথে ছিলেন।” কোনো এক বিচিত্র কারণে তাঁর সহযোগী কমান্ডাররা কেন সাঈদির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে অভিযোগ করেননি – এটা তাঁর বুঝে আসেনি। কিন্তু তাঁর সাঈদি সম্পর্কে সাক্ষীর ব্যাপারে ঐ অতোটুকু কথার বাইরে আর একটি কথাও সাংবাদিকরা বের করতে পারেননি তাঁর মুখ থেকে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জীবনে তিনি ছিলেন কর্ণেল তাহেরের অনুগামী। সেজন্য মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছিলেন। একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হোন, কিন্তু আবারও ফিরে আসেন দেশের মায়ায়। তিনি অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। একবার সুন্দরবনের দুস্যুদের গুলি তাঁর মাথায় আঘাত করে – অল্পের জন্য বেঁচে যান। “সুন্দরবন বাঁচাও” নামক অরাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি। সুন্দরবন আর দুবলার চরে মাছের ব্যবসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তাঁর ঘোলাটে, রাজনৈতিক টালমাটাল জীবনের কারণেই কিনা জানি না – মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তিনি পাননি।
মুক্তিযুদ্ধে, সুন্দরবনের এই বাঘ পরের জীবনে কারো কাছে ছিলেন দস্যু, কারো কাছে ছিলেন পীর। তবে, আমার কাছে তিনি একজন বীর! ২০১৭ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বইটি ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে পড়া যাবে:
📕 https://archive.org/details/sundarban-1971