প্রথমেই আমার আপত্তি ঐ “দূর্নীতি” শব্দটাতে। শব্দটার বহুল ব্যবহার, এই নেতিবাচক শব্দটিকে শ্রেফ আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছে না। এক্ষেত্রে আমরা একটু euphemism বা সুভাষণ কাজে লাগিয়ে শব্দটাকে যদি বদলে লিখি “নীতিভ্রষ্টতা”, তাহলে সেটা জোরালোভাবে মাথায় গিয়ে টোকা দেয় না, অথচ মূল কথা ঠিকই বলে।
তাই এই নিবন্ধের শিরোনাম হওয়া উচিত “ছেঁড়া টিকেটের নীতিভ্রষ্টতা, দারিদ্র ও অকৃতজ্ঞ বাঙালি”।
———————–
স্থান: কুর্মিটোলা (এয়ারপোর্ট বাসস্টেশন)
সময়: কোনো একদিন
বিআরটিসি’র আধুনিক বাসে চড়ার জন্য আধুনিক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে ফার্মগেটের টিকেট চাইলাম। টপাটপ সামনের যন্ত্রের বোতামে চাপ পড়লো কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা লোকের, বেরিয়ে এলো ছাপা করা চকচকে টিকিট।
———————–
সময়: অন্য আরেকদিন
১৫ টাকা বাড়িয়ে দিলে হাত পড়লো না যন্ত্রে। বরং ড্রয়ার থেকে বেরিয়ে এলো একটা ছাপা করা টিকিট, যার গায়ে যথাযথভাবেই সেদিনের তারিখ লেখা। সবই ঠিক আছে, কিন্তু টিকিটটা ছেঁড়া। “ছেঁড়া কেন? বদলে দেন।” কথাটা জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, “ভাই, আরেকজন ফেরত দিয়ে গেছে।” বারবার পিড়াপিড়ি করলেও কাউন্টারের ভিতরে থাকা দুজন একজোট হয়ে ঐ ছেঁড়া টিকিটের সাফাই গাইতে লাগলো, “ভাই, টিকিট তো আবারো ছিড়্বোই, সমস্যা কই?” তাদের পিড়াপিড়িতে ছেঁড়া টিকিটখানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনে হলো, আমি ছেঁড়া টিকিট নেবার প্রশ্নই আসে না। টাকা দিয়েছি যথাযথ, টিকিট সে প্রিন্ট করে দিবে, দিতে হবে- এটাই নিয়ম।
মনে মনে নিজেকে বোঝাতে চাইলাম, থাক না, একটা ছেঁড়া টিকিট নিলে কী এমন হবে। তাতে যদি এই গরীব বেচারার কিছুটা লাভ হয়, ক্ষতি কী? কিন্তু, পরক্ষণে মনে হলো, না এভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দয়া হয়। আমি এবারে জোর কণ্ঠে তার থেকে নতুন একটা আস্ত টিকিট বাগিয়ে নিলাম।
———————–
ঘটনা হলো, ছেঁড়া টিকিটগুলো এরা যেকোনোভাবেই হোক সংগ্রহ করে। আমি তার হাতে একগাদা টিকেট দেখেছি, একদিনে, ৩ ঘন্টার মধ্যে ২০ জন মানুষ টিকেট করেছে, অথচ বাস পাল্টাতে হওয়ায় টিকেট ফেরত দিতে হয়েছে– এরকম এতো লোক এয়ারপোর্ট থেকে উঠেন না। সুতরাং এরকম একটা ছেঁড়া টিকিট বিক্রি করতে পারা মানে, অতিরিক্ত ১৫ টাকা হাতে পাওয়া; কেননা টিকেটটা ইতোমধ্যেই একবার বিক্রি হয়ে গেছে এবং যন্ত্রের মধ্যে এর মূল্য ১৫ টাকা উঠে গেছে। সেই একই টিকেটই দ্বিতীয়বার/তৃতীয়বার বিক্রি হলে ঐ যন্ত্রের তা জানার কথা না। দিন শেষে টাকার হিসাব নিতে গেলে যন্ত্র বলবে ১৫ টাকার টিকেট বিক্রি করেছো, অথচ দিনে আপনি ৩০/৪৫ টাকার টিকেট বিক্রি করে ফেলেছেন- সেটা কেউ বুঝবে না। মাঝখান থেকে আপনার ঐ ১৫/৩০ টাকা ফাও লাভ। আর এমনিতে যেই টাকা আপনার কমিশন পাওয়ার কথা বা বেতন পাওয়ার কথা, সেটা তো পাচ্ছেনই।
এরকম ঘটনায় যারা একটু উদারনৈতিক কথাবার্তা বলেন, তাদের বক্তব্য হলো: “কতো খাইছে? ১৫টাকা, ২০টাকা… এইটা কোনো টাকা হইলো? লাখ লাখ টাকা খাইয়া বইসা আছে, সেইটার কিছু…” বলে বিশাল একটা বক্তৃতা ঝেড়ে দিবেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলবেন, “শোনো, গরীবে খাইছে, খাক না। তোমার-আমার মতো মানুষের কাছ থেকেইতো খাবে। দুচার পয়সা খাইতাছে, খাইতে দেও। লাখ টাকা তো আর খাইতেছে না।”
এই যুক্তির মূল বিষয়বস্তু হলো “দারিদ্র”।
তারা দরিদ্র বলে তাদের জন্য এই অন্যায়টুকু জায়েয হয়ে যাবে? আর তারা দরিদ্র কিসের বিচারে?
যে, একটা mp3, radio, bluetooth-ওয়ালা মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরতে পারে, সে কি দরিদ্র?
যে, ঘরে গেলে ডিভিডি প্লেয়ারে বাংলা ছিঃনেমা দেখতে পারে, সোলেমান খানের ফিলিম দেখতে পারে, সে কি দরিদ্র?
সেই ডিভিডি’র ডিসপ্লে হিসেবে একটা টিভির ব্যবস্থাও তার আছে, সে কি দরিদ্র?
যেখানে কিছু মানুষের, শ্রেফ একটা ওজন-মাপার-মেশিনের আয় দিয়ে দিন চলে, সেখানে টিকিট কাউন্টারের বেতন পেয়েও কি সে দরিদ্র?
আমরা আসলে দারিদ্রের সংজ্ঞাকে আটকে রেখেছি কতগুলো বিষয়ে:
- যারা ছাপড়া ঘরে থাকে, তারা দরিদ্রশ্রেণীর!
- যারা লোকাল বাসে চড়ে, তারা দরিদ্রশ্রেণীর!
- যারা ফুটপাতে কেনাকাটা করে, তারা দরিদ্রশ্রেণীর!
- যারা ইটালিয়ান হোটেলে ভাত খায়, তারা দরিদ্রশ্রেণীর!
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে [ব্যতিক্রম বাদে] এইশ্রেণীর লোক যে এই কাজগুলো অভ্যাসবশত করে, সেটা কি আপনি জানেন? আমি স্বীকার করছি, ছাপড়া ঘরের ভাড়া, দুই কক্ষের ফ্ল্যাটের সমান কখনোই নয়; কিন্তু যাদের টিভি কেনার, ডিভিডি কেনার, চোলাই মদ-গাঁজা কেনার, মোবাইল ফোনে রিংটোন ডাউনলোড করে ফুটানি করে বেড়ানোর অর্থ আছে, তারা ছাপড়া ঘরে থাকে অভ্যাসবশত। আমি এই জীবনে বেশ কয়েকজন বুয়াকে দেখেছি, যারা প্রতিবছর ১০খানা শাড়ি পায় যাকাত হিসেবে, সেই শাড়ির ১টাও তারা পরে না পরবর্তি বছরে, তারা সেই পুরোনো শাড়ি পরেই কাজ করে, কারণ তারা করুণা পেতে চায়। আর করুণা পাবার জন্য দূর্বল সেজে থাকার মতো মোক্ষম হাতিয়ার আর কী হতে পারে?
এবারে আমি আর কথা না বাড়িয়ে একটু অতীতে চলে যাই। যদি প্রশ্ন করি: মসলিন কেন বিলুপ্ত হয়েছিল? আপনি সবজান্তার ভাব করে জানাবেন: মসলিন বিলুপ্তির কারণ ছিল ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ঐসব শোষক ইংরেজরা; তারা, নীলচাষ না করলে আঙ্গুল কেটে দিতো। …ঠিক। তবে আপনি সম্পূর্ণটুকু জানেন না। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ইংরেজদের শোষণ, মসলিন বিলুপ্তির একটা কারণ হলেও আরেকটা কারণও এর সাথে যু্ক্ত হয়েছিল:
দিনে দিনে যখন মসলিনের চাহিদা ও উৎপাদন বেড়ে গেলো, তখন ইংরেজ শাসকরা সংগ্রহের সুবিধার্থে বিভিন্ন মসলিন উৎপাদনকারী এলাকাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে সেসব এলাকার মসলিন সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন কিছু বাঙালিকে। তাদেরকে বেতন দেয়া হবে এই সংগ্রহ-কাজের জন্য। কিছুদিন এভাবেই চলছিল। একসময় এইসব দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা চিন্তা করলো, ইংরেজ সরকারতো আমাদেরকে বেতন দিবেই, সেটা তো নিশ্চিত। তাহলে মাঝখান থেকে কিছু টু-পাইস কামিয়ে নিলে ক্ষতি কী? ব্যস, যে মসলিন দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে ২টাকায় বিক্রি করতো মসলিন চাষি, সেটা তারা জোরজবরদস্তি করে ১টাকায় সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করলো। তাদের দাপটে মসলিন চাষিরা একঘরে হয়ে পড়লো। মসলিন চাষিরা মহাবিপাকে পড়লো, এতো কষ্টের পর তাদের ন্যুনতম মজুরিও জুটছে না। তারা সিদ্ধান্ত নিলো এই পেশা ছেড়ে দিবে। কিন্তু টু-পাইস কামানো বেতনভোগীরা তখন চিন্তা করলো, এরা পেশা ছেঁড়ে দিলে তাদের চাকরি যাবে, তারা চাহিদামতো মসলিন দিতে পারবে না। তাই তারা, মসলিন চাষীদেরকে মসলিন বানাতে চাপ প্রয়োগ এমনকি শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত করতে শুরু করলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মসলিন চাষিরা তাই বাধ্য হয়ে নিজেরাই নিজেদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেললো। ফলে, যখন দস্যুরা এসে চাপ দিতো মসলিন বানাতে, তখন তারা কাটা আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে পারতো, তাদের পক্ষে বানানো আর সম্ভব নয়।
দেখা গেলো, পরজাতি ইংরেজরা যে কাজ হিংসা থেকে করে গেলো, আমাদের জাতি ভাইয়েরা সেই কাজই করে দিলো শ্রেফ অর্থের মোহে।
ঘটনাটা বেশি পুরোনো হয়ে গেলে সম্পূর্ণ নতুন একটা ঘটনা বলি: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ফ্রান্সের গীমে জাদুঘরে মূল্যবান প্রত্নসম্পদ পাঠানো নিয়ে আমরা কতোটাই না সোচ্চার হয়েছিলাম। কীজন্য? এই ভয় করছিলাম যে, ঐ ভিনদেশী পান্ডিত্যপূর্ণ মানুষগুলো আমাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আমাদের সম্পদগুলো চুরি করে রেখে দিবে। অথচ, সেখান থেকে ঠিকই ফেরত এলো সব প্রত্নসম্পদ। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি থেকে গাপ হয়ে গেলো দুটো। শেষ পর্যন্ত অমূল্য সেই প্রত্নসম্পদ দুটো পাওয়া গেলো ডাস্টবিনে গুড়োগুড়ো অবস্থায়।
আবারো, ঘরের শত্রু বিভীষণই, শ্রেফ অর্থের মোহেই, স্বজাতিকে ধ্বংসের পথে বাড়িয়ে তুললো। ফরাসিরা চুরি করলেও প্রত্নসম্পদগুলো বেঁচে থাকতো। হয়তো কোনো এক প্রজন্ম এসে সেগুলো সনাক্ত করে দেশে ফেরত আনতে পারতো, যেমনটা আজ মিশরে করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক মন্ত্রী জাহি হাওয়াস। কিন্তু এই অর্থলোভীরা শ্রেফ পাউডার বানিয়ে মুছে দিয়েছে ইতিহাস।
আপাত সম্পর্কহীন এই দুটো ঘটনাই আসলে আমাদের প্রকৃতিটাকে তুলে ধরছে। আমরা শ্রেফ এবং শ্রেফ অর্থের মোহে নিজের নীতিকে বিসর্জন করে চলেছি। বেতন পাওয়াসত্ত্বেয় উপরি কামাতে আমরা দ্বিধা করি না, কারণ আমাদের মোবাইল ফোন কিনতে হবে, টিভি-ফ্রিজ কিনতে হবে… কিন্তু এগুলো ছাড়াও যে এই আখরার বাজারে টিকে থাকা সম্ভব, সেটা আমরা খুঁজি না। “টাকা” “টাকা” “টাকা”র মোহ আমাদেরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দিনে দিনে জন্ম দিচ্ছি আরো কিছু পিশাচ। হয়তো আমার ঘরে সুসন্তান আছে, কিন্তু এভাবে ছেঁড়া টিকিট মুখ বুজে নিয়ে গিয়ে জন্ম দিচ্ছি আরো কয়েকশত পিশাচ। এরা ইংরেজ আমলে মসলিন খেয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক আমলে প্রত্নসম্পদ খেয়েছে, আজকে আপনার ১৫ টাকা খাচ্ছে, কাল নিজের মা-কে বিক্রি করে দিবে।
আল্লাহ’র ওয়াস্তে, দয়া করে, ঠুনকো দারিদ্রের নাম করে এইশ্রেণীর বিলাসী, দারিদ্রের মুখোশধারীদের পক্ষে সাফাই গাইবেন না।
-মঈনুল ইসলাম