তরল স্বর্ণের দেশে ২০০১: কিস্তি ৩

আগের পর্বে ছিল: আগুনে পুড়ে যাওয়া! | এই পথ আমার ঠিকানা | যেভাবে বৃষ্টি ডেকে আনলো ওরা…

দুবাই দেশে?

আমার আব্বা থাকেন দুবাইতে (২০০১)। সেখানেই ব্যবসা করেন। তাই আমি আমিরাতের দুবাইতেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি। দুবাই শহরটার এতো নাম-ডাক যে, আমরা অনেকেই এই দেশটার নামই ‘দুবাই’ বলে থাকি। অথচ দেশটা হলো ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত’। আমিইতো আসার আগে বন্ধুদের বলে এসেছি, ‘দোয়া করিস, দুবাই যাচ্ছি’।

আরব আমিরাত দেশটা একটা বহুজাতিক দেশ। সেই সুবাদে দুবাই শহরটাও এর ব্যতিক্রম নয়। সাধারণত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত- এসকল দেশের কথা বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে লম্বা আলখাল্লা পরা, মাথায় লাল রুমাল আর কালো দুটো বেল্ট বাঁধা দাঁড়িসর্বস্ব কিছু মানুষের চেহারা, যাদের আমরা ‘আরব জাতি’ বলে চিনি। কিন্তু দুবাই মোটেও সেরকম শহর নয়। এখানে বরং আরবদেরই হারিকেন জ্বেলে খুঁজতে হয়, অর্থাৎ তাঁদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। বরং এই জায়গা দখল করে নিয়েছে বহিরাগতরা। আমেরিকা, আফ্রিকা, সুদান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকংসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের লোকই এ শহরে দেখা যায়। আমাদের উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ তো রীতিমতো এ শহরের প্রাণ।

আসলে বেশিরভাগ বহিরাগতই আসেন দুবাইতে বেড়াতে। দুবাই বিশ্বের অন্যতম একটি পর্যটন শহরও বটে। এই শহরের রূপের মাধুর্যে মধুময় সময় কাটাতে সারা বিশ্ব থেকেই লোক আসে দুবাইতে। তাঁদেরই কেউ কেউ (বিশেষত অনুন্নত দেশের) থেকে যান দুবাই শহরে কোনো ভাল কাজের আশায়। এভাবেই আমাদের বাংলাদেশ থেকেও অনেক লোক আসেন শুধু জীবিকার আশায়, যেন দুবাইতে টাকা উড়ে বেড়ায় আর বাংলাদেশে ধুলো।

দুবাই শহরটা দুইভাগে বিভক্ত: আমি যেই অংশে থাকতাম (দুবাই শহরের পূর্বাংশ), সেই অংশের নাম হলো দে’রা দুবাই (Deira Dubai)। আর অপর অংশটির নাম হলো বার দুবাই (Bur Dubai)। দুবাই শহরের মাঝখান দিয়ে সমুদ্রের পানি প্রবাহিত করে একটা খালের মতো সৃষ্টি করা হয়েছে, তার ওপর পাশ হলো বার দুবাই -অনেকটা নদীর ‘এপার’ আর ‘ওপারের মতন’। আমি অবশ্য ব্যাপারটাকে অন্যভাবে বুঝেছিলাম, ‘বার’ শব্দটিকে আমি ‘বাহির’ শব্দটির সাথে মিল করে ভাবলাম, দুবাইয়ের বাহিরের শহর। অর্থাৎ, বার দুবাই হলো বাহিরের দুবাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তা নয়। বার দুবাই-এর আক্ষরিক অর্থ বলে, ওটাই প্রকৃত দুবাই ছিল – মূল দুবাই। আর দে’রা দুবাই হচ্ছে আধুনিক দুবাই।

মসজিদের শহর (!)

দুবাইকে ‘মসজিদের শহর’ বললে ঢাকাবাসীরা আমার মুণ্ডুপাত করবেন, কারণ মসজিদের শহর হলো ঢাকা। অথচ আমি দুবাইতে প্রতিটা অলিতে গলিতে মসজিদ দেখেছি। পাঞ্জেগানা মসজিদ থেকে জামে মসজিদ পর্যন্ত সব ধরণের মসজিদে অলিগলি ভর্তি। দু’পা যেতে না যেতেই চোখে পড়বে ইয়া বড় একেকটা গুম্বুজ — মসজিদের।

একেকটা মসজিদ আবার একেকটি স্বর্গীয় ভবন যেন। ভেতরে যাবার মূল দরজা থেকেই ভারী কার্পেট। ‘কার্পেট’ বললেই যদিও ইরানের কথা মনে পড়ে, তবে এদের কার্পেট এ দেশেই তৈরি হয়। কার্পেটে নানা ফুলের কারুকাজ। নরম কার্পেটের উপর দিয়ে আরামের পরশে আপনি মসজিদের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখবেন দরজায় ঝুলছে ভারি পলিথিনের পর্দা। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগবে, কাপড়ের পর্দার বদলে পলিথিনের পর্দা কেন? তাছাড়া পর্দার দরকারইবা কেন? আমাদের দেশে তো মসজিদের দরজায় পর্দা লাগানো থাকে না!

আরব আমিরাতে গরমের সময় প্রচণ্ড গরম পড়ে। সে গরম যে অসহনীয় সে কথা গত কিস্তিতে বলেছি। এই গরমের কারণে সেদেশের সর্বত্র এ/সি লাগানো থাকে, মসজিদে তো অবশ্যই। ঘরের ভেতর তো দরজা বন্ধ করে এ/সি ছাড়া যায়। কিন্তু মসজিদে প্রতিনিয়ত লোকজনের যাতায়াত। তাই এই ভারি পলিথিন লাগিয়ে বাতাসকে যথাসম্ভব ভেতরে আটকে রাখা হয়। ভারি পলিথিনের সুবিধা, এটি ভারি হওয়ায় লোকজন দরজা পার হতেই এটা আবার স্বস্থানে ফিরে গিয়ে বাতাসের বহির্গমন বন্ধ করে দেয়। আর পলিথিন ব্যবহার করার তো অনেক রকম সুবিধা: দরজা লাগানো লাগলো না, লোকজনের যাতায়াত বন্ধ হলো না, আবার স্বচ্ছ হওয়ায় যাতায়াতকারীরাও স্বচ্ছন্দে ভেতরে-বাহিরে দেখে যাতায়াত করতে পারলেন ইত্যাদি।

আবার মসজিদের ভেতরে মিম্বরের (minber) রূপটা আপনাকে ভাবাবে। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধাপের মিম্বর দেখা যায়। অথচ আরব আমিরাতের প্রায় সর্বত্রই মিম্বর হলো প্রায় বুক সমান উচ্চতার একটা মঞ্চ। যাতে উঠার সিঁড়ি থাকে পেছন দিক দিয়ে কিংবা পাশ দিয়ে। সেই মঞ্চের গায়ে থাকে কাঠে খোদাই করা নানা রকম কারুকার্য। খুবই সুন্দর। (আপনি গুগলে minber লিখে অনুসন্ধান করলে এই বিচিত্র (?) মানে অপরিচিত চেহারার মিম্বরগুলো দেখতে পাবেন)

মসজিদের ভেতরে আলোকসজ্জাও চমৎকার। নানা নকশার, নানা রঙের, নানা কারুকার্যের ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি দিয়ে সুসজ্জিত প্রতিটি মসজিদ। আবার প্রতিটি বাতির আলোর বন্যায় মসজিদ আলোকিত, সুশোভিত, অলঙ্কৃত। ভাল না লেগে যায়ই না। মসজিদের ভেতরে গেলেই মনের মাঝে একটা প্রশান্তি এসে ভর করে।

মসজিদের ভেতরকার কার্পেটের কারুকার্য আর বাইরের কার্পেটের কারুকার্য আবার এক না। ভেতরের কার্পেটে অলঙ্করণ কম, আর জায়নামাজের মতো কারুকাজ করে দেয়া রয়েছে। ফলে, অনেকগুলো জায়নামাজ পাশাপাশি বিছিয়ে দিলে যে চেহারা ধারণ করে সেরকম দেখায় পুরো মসজিদকে।

স্থাপত্যিক বিষয়াদি আমি বুঝি না। নাহলে হয়তো বলতে পারতাম কোনটা আরব্য স্থাপত্য নকশার, কোনটা গ্রীক। তবে, আমার সাধারণ চোখে এমনও একটি মসজিদ পড়েছে, যার আকৃতি গোল। অর্থাৎ উপর থেকে মসজিদটি দেখলে গোল দেখাবে। সেই মসজিদের ভেতরটা আরও সুন্দর; মসজিদটা বার দুবাইতে অবস্থিত। মসজিদের মিম্বরটা দেখে আমি ভেবেছিলাম স্বর্ণ দিয়ে তৈরি বোধহয়। আসলে ওটা স্বর্ণালী রঙের কারুকার্যময়।

৬০০ বৎসরের পুরোন মসজিদও আমি দেখেছি। সেকথা পরের কোনো কিস্তিতে শুনবো আমরা ইনশাল্লাহ।

স্বর্ণের বাজার

হ্যা, স্বর্ণেরই বাজার। সেই স্বর্ণ, যে স্বর্ণ পৃথিবীর অত্যন্ত মূল্যবান খনিজ দ্রব্য আর অলঙ্কার। এই স্বর্ণের বাজার দুবাইতে আছে, আছে শারজা’তেও। স্বর্ণের বাজারকে ওখানে আরবী আর ইংরেজি মিলিয়ে বলা হয় ‘গোল্ড সৌক’ (Gold Souq বা Gold Souk)। পুরো বাজারটাই স্বর্ণে স্বর্ণে ঠাশা।

বাজারটার সঠিক ডিজাইনটা আমি বুঝতে পারিনি। কেমন যেন একটা গোলকধাঁধা। মনে হয় যেন একটা ইংরেজি ‘T’ অক্ষর। আর কাঠামোটা দেখলে রেল স্টেশনগুলোর কথা মনে পড়ে, যেখানে উঁচু উঁচু পিলার দিয়ে প্লাটফর্মের উপরের ছাদকে আটকে রাখা হয়। আর কিছুটা যেন বাংলাদেশের কমলাপুর স্টেশনের মতো ডিজাইন। আবার পিলারগুলোতে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে দুপাশে দুটো করে লম্বা চেয়ার বা বেঞ্চি একটু পর পর।

দে’রা দুবাই’র গোল্ড সৌক বা স্বর্ণের বাজারের একটি দোকান – নিশাচর

এই গোল্ড সৌকে আছে প্রচুর দোকান। সবই স্বর্ণ-ব্যবসায়ের। প্রতিটা দোকানেই খাঁটি স্বর্ণের সমারোহ। দুবাই শহরের-দে’রা দুবাই’র প্রাণকেন্দ্র এই গোল্ড সৌক। প্রচুর লোকের আনাগোনা সব সময়। মানুষের হিড়িক যেন। কেউ কিনছে। কেউ দেখছে। কোনো কোনোও পর্যটক দল এই গোল্ড সৌকেই এসে নামেন প্রথমে। তারপর সেখান থেকে তাঁদের ভ্রমণের ছক এঁকে নেন। কেউ কেউ এই জনারণ্যের মাঝে ঐসব বেঞ্চিতে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউবা খানিকটা চিবিয়ে নিচ্ছেন। আর এক দল হকার হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠাণ্ডা পানীয়, কোনও খাবার।

স্বর্ণের বাজারকে সিলেটিরা বলেন: সোনা বাজার। স্বর্ণের এই বাজারে ঘুরতে ঘুরতে আমি এখন মানুষ চিনতে শুরু করেছি। এই মানুষ চেনা বলতে খারাপ-ভালো নয়, চেহারা দেখে কোন দেশের মানুষ তা বলে দেয়া। সব সময় সঠিক হয়না, তবে বেশ আন্দাজ হয়েছে, এ কথা সত্য। সবচেয়ে ভালো চিনতে পারি বাংলাদেশী-ভারতীয়-পাকিস্তানীদের। এছাড়াও রাশা’ন, আফ্রিকান, সুদানিজদেরও চিনতে পারি মোটামুটি। তবে চীন, হংকং, জাপান আর কোরিয়াকে আমি এক করে ফেলি। এদের চেনা আমার কম্ম নয়। তাই এদেরকে আমি এক গোত্রে ‘চীনা’ হিসেবে ভাগ করে নিয়েছি। একটা বললেই হলো, তাই না? 😜

গোল্ড সৌকের সাথে এসে মিশেছে বিপুল পরিমাণ গলি। আমি এর পরিমাণের আধিক্য বোঝাতে বলি “শ’য়ে শ’য়ে গলি”। এই সকল গলির মোড়ের দোকানগুলোও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সেসব দোকান তাই পর্যটকদের জন্য শোভিত হয় প্রচুর এনটিক্‌সে আর ভিউকার্ডে। সেসকল উপকরণের দামও চড়া। আমার মনে হয়, সব পর্যটন আকর্ষণেই জিনিসপত্রের দাম একটু অতিরিক্ত রকম বেশি। খোদ বাংলাদেশেও পর্যটন আকর্ষণগুলোতে আপনাকে আস্ত গিলে ফেলবে আপনি শত হুশিয়ার হওয়াসত্ত্বেও। আর এ-তো বিদেশ। অবশ্য বেশিরভাগ দোকানীই ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশী। সুতরাং কথাই নেই।

স্বর্ণের বাজার বলে কথা, নিরাপত্তা থাকা চাই যথাযথ। সেজন্য বেশিরভাগ সময় টহল পুলিশ দেখা যায় ওখানে। তাছাড়া প্রতিটি দোকানের শার্টারের উপরে তাকালে দেখা যাবে একটি করে সিকিউরিটি এলার্ম। আমি তো আর ছুঁয়ে দেখিনি, তবে লোকমুখে শুনেছি বন্ধ অবস্থায় ওসব শার্টারে (দোকানের পাটগুলোতে) হাত দিলেই নাকি ওই সিকিউরিটি অ্যালার্ম বিকট শব্দে বেজে উঠবে। আর পুলিশ এসে ‘শ্রীঘরে’ নিয়ে ঢুকিয়ে দিবে। এছাড়াও আছে ক্লোয সার্কিট মুভিং ক্যামেরা। যেগুলো বিভিন্ন অবস্থান থেকে সর্বক্ষণ স্বর্ণের বাজারের অবস্থা জানান দিচ্ছে।

এই হলো স্বর্ণের বাজার। ক্রিকেটাররা শারজা’ কাপ ক্রিকেটে নাকি বেশিরভাগ সময় সঙ্গে স্ত্রীদের নিয়ে যান। অনেকে বলেন দুবাই থেকে খাঁটি স্বর্ণ কেনার জন্যই নাকি তাঁদের এ গমন। আমি সত্য মিথ্যা জানিনা। তবে যেকোনো নারীই ওখানে গেলে যে তার স্বর্ণের দোকানে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করবে, এতে আমার সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। একটা প্রবাদ আছে: টাকা দেখলে পাথরও হা করে। আর এখানে-গোল্ড সৌকে সোনালী আলোর বন্যায় স্বর্ণ দেখলে আমার মনে হয় সবচেয়ে শক্ত পদার্থ হীরাও হা করবে।

আব্‌রা’র বিড়ম্বনা

দুবাই ক্রীক (২০১৮) - সমুদ্রকে টেনে আনা হয়েছে স্থলভাগে - মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের তোলা ছবি (গুগলের সৌজন্যে)
দুবাই ক্রীক (২০১৮) – সমুদ্রকে টেনে আনা হয়েছে স্থলভাগে – মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের তোলা ছবি (গুগলের সৌজন্যে)

সিলেটে ‘আব্‌রা’ যাদের বলা হয়, তারা বোবা কিন্তু তারা মুখের মাঝে ‘ঊঁ’, ‘কূঁ’-এজাতীয় শব্দোচ্চারণ করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। তাই আমি যখন প্রথম আব্বার মুখে ‘আব্‌রা’ শব্দটা শুনলাম, তখনতো হেসে কুটি কুটি। আব্বাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমায় বুঝিয়ে বললেন – এই ‘আবরা’, সেই ‘আবরা’ নয়।

আরব আমিরাতে কোনোও স্থায়ী নদী নেই  নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঠিক বিপরীত। যেগুলো আছে, সেগুলো ওয়াদি – অর্থাৎ শুকনো নদীতট, প্রচণ্ড বৃষ্টি না হলে ওগুলোতে পানি হয় না। তাই তারা দুবাইতে নদীর অভাব পূরণ করতে হোক কিংবা জলক্ষেত্রের সৌন্দর্য্য দিয়ে মরুকে উজ্জীবিত করতেই হোক, সমুদ্রকে খনন করে করে দেশের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যাকে ইংরেজিতে creek বলে, যার অর্থ ষাঁড়ি বা ছোট নদী। এর ফলে বিপুল পরিমাণ পানি দেশের ঐ সকল কৃত্রিম খালে ঢুকে পড়ে। কিন্তু নদী বলতে যে মিঠা পানির উৎস বোঝায়, এটা তা না, কারণ এগুলো সমুদ্রের লোনাপানি দিয়ে ভর্তি। দে’রা দুবাই আর বার দুবাইয়ের মাঝখানে যে ক্রিক, তার নাম Dubai Creek।

নদী থাকলে নদী পার হবার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তাই দেশটিতে এই সকল কৃত্রিম লোনা নদী পার হবার জন্য নদীর উপর দিয়ে, নদীর নিচ দিয়ে টানেল তৈরি করা হয়েছে। আর একটি পুরোন পদ্ধতি যা আছে, তা হলো খেয়া পারাপার — ঠিক বাংলাদেশের মতো। আর খেয়া পারাপারের জন্য দরকার খেয়াঘাট। আরবিতে নৌকাকে ‘আবরা’ (Abra – عبرة) বলে, তাই নৌকা নির্ভরও খেয়াঘাটও হয়ে গেছে ‘আবরা’।

আব্‌রা’র খেয়াতরীগুলোও বেশ বড় বড় আর ইঞ্জিনচালিত। ওগুলো দেখতে কেমন জানতে হলে আপনাকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ‘সাম্পান নৌকা’ দেখতে হবে, প্রায় একই রকম। তবে একটু ব্যতিক্রম। খেয়াপারের সুবিধার্থে এগুলোর মাঝখানে দুদিকে মুখ করে বসার মতো বেঞ্চ পাতা রয়েছে। আর ছাউনি হিসেবে রয়েছে চারটি খুঁটি দিয়ে আটকানো তেরপলসদৃশ কাপড়, যার চারদিকে কাপড়কে কুঁচকে ঝালরের মতো লাগিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। কোনো কোনোটা মোটেই সাম্পানের মতো না, বরং সমতল। শ্রেফ দুপাশের দুটো গলুই হালকা একটু উঠে আছে, বাকি পুরো নৌকাই সমতল কাঠের মেঝের মতো। মাঝখানে লোক বসার বেঞ্চ আর উপরে ছাউনি – মিনিমাল সেটআপ আরকি।

এতোসব অত্যাধুনিক সুব্যবস্থা থাকাসত্ত্বেয় কেন স্পীডবোট না রেখে এই ইঞ্জিনচালিত ‘সাম্পানের’ ব্যবস্থা করা হলো? প্রশ্নটা আমাকে বেশ খোঁচাখুঁচি করেছে। অবশেষে আমি নিজে এর একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর বের করলাম। উত্তরটা হলো, শহরে যারা বড় হয়, তারা গ্রামের সামান্য ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় উঠে মনে করে কলম্বাস হয়ে গেছে। আর তাই ওখানকার উচ্চবিত্তের মানুষের কাছে স্পীডবোটের তুলনায় এই সাম্পানের কদর অনেকটা এন্টিকের মতো। আর অর্থ আয়ের জন্য এই সামান্য কৌশলটা কেন আরবরা অবলম্বন করবে না? অবশ্য এই সাম্পানের মতো নৌকার ডিজাইন হবার কারণ কী, তা আমি জানিনা। আন্দাজ করতে পারি, সমুদ্রতীরবর্তী দুবাইয়ের সমুদ্রযান এই সাম্পানসদৃশ নৌকাগুলো তাঁদের অতীত ঐতিহ্যও। আর, তাহলে এটা কিন্তু এন্টিকই।

বার দুবাই

বার দুবাইতে যাবার দুটো পথ; সড়কপথে অথবা নৌপথে আব্‌রা হয়ে। সড়কপথে যাওয়া যায় বাসে, টেক্সিতে অথবা পায়ে হেঁটে। যেভাবেই যান, ও’ জায়গাটা খুব সুন্দর। ঢাকার রামপুরা বা উত্তরা এলাকায় যেমন বসতি বাড়ছে, তেমনি বার দুবাই’র জুমেরাতে (Jummeirah) গেলে মনে হবে, নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে। যদিও ওটা ওদের পুরোন শহর, কিন্তু আমাদের পুরান ঢাকা যেমন, ঐ জায়গা মোটেই সেরকম না। বরং উল্টো – দে’রা যতটা ব্যস্ত আর ঘিঞ্জি, বার দুবাই ততটাই খোলামেলা, ফাঁকাফাঁকা।

বার দুবাইতে রাস্তার পাশে দেখতে পাবেন কলোনির মতো একই ডিজাইনের বিল্ডিং। ওগুলো কলনিই। অথচ ওগুলোকে বাংলাদেশে দেখলে বলতেন রাজপ্রাসাদ। একেকটার সামনে গাছগাছালির সমারোহ। ধবধবে সাদার শুভ্রতায় ঐ বাড়িগুলো যেন মানুষের জন্য হাহাকার করছে। কোনো মানুষ থাকে না ওগুলোয়। খালিই পড়ে আছে। এই বাড়িগুলো আরব শেখরা তৈরি করেছেন তাঁদের অবকাশ যাপনকেন্দ্র হিসেবে। ছুটিছাটা ছাড়া ও’ বাড়িগুলো অব্যবহৃতই থাকে।

বাড়িগুলোর পেছনেই সমুদ্র — পারস্য উপসাগর (Persian Gulf)। কী নীল সে সমুদ্রের পানি! যেন সাঁতার কাটতে ডাকছে। এই সমুদ্রকে ঘিরে বার দুবাইতে গড়ে উঠেছে ‘জুমেইরা’ সৈকত উদ্যান’ (Jumeirrah Beach Park)। সেখানে বিরাট নৈস্বর্গিক পার্ক আর সমুদ্রকে একই সীমানায় এনে একটা আনন্দময় স্থান করার সফল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সেখানে সৈকতের নোনা পানিতে গোসল করার ব্যবস্থা রয়েছে, গোসল শেষে লবণমুক্ত পানি থেকে পরিষ্কার হবার জন্য সৈকতের পাশেই রয়েছে শাওয়ার, আছে কাপড় পাল্টানোর জন্য আলাদা স্থান। সৈকতে সাঁতারুদের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, একটু পরপর। সৈকতে একটা সাইনবোর্ড লাগানো আছে, সমুদ্রের পানিতে নামা সংক্রান্ত নির্দেশাবলীসমেত। সেখানকার একটি পয়েন্ট হলো, লাল পতাকা ওড়াকালীন পানিতে নামা নিষেধ। আমি জানি কোন সময় লাল পতাকা ওড়ানো হয়। কারণ ‘তিন গোয়েন্দা’র বইতে পড়েছি, ভাটার সময় সমুদ্রের পানিতে নামা উচিত না। এসময় নামলে পানির টানে সমুদ্রের গহ্বরে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

জুমেরাহ মসজিদ (ছবি: Susanne Nilsson)
জুমেরাহ মসজিদ (ছবি: Susanne Nilsson)

জুমেইরা’তে আরও আছে একটি অত্যন্ত সুদর্শন মসজিদ, রাস্তার পাশেই — জুমেরাহ মসজিদ। উইকিপিডিয়া পড়ে যা জানা যায়, এটি ঐতিহ্যবাহী ফাতিমীয় ঢঙে বানানো মসজিদগুলোর একটি, যা ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে বানানো শুরু হয়েছিল। খুবই সুন্দর, আর বিশালায়তন এই মসজিদেও নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

লিটিল ইন্ডিয়া

আরব আমিরাতে এই এলাকাটা কী নামে পরিচিত আমি জানি না। তবে আমি নাম দিয়েছি ‘লিটিল ইন্ডিয়া’ (Little India)। দুবাই ক্রীক-এর ওপাড়েই, একটু ভিতরে গেলেই পুরো একটি ভারত যেন ওটা। আমি আমার গ্রামের এক পরিচিতজনের (ফারুক চাচা) সাথে ঐ এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তিনি সম্পর্কে আমার চাচা হোন বলে তার সাথে ঘুরতে বিরক্ত কিংবা বিব্রত হলাম না (দুবাইতে অধিকাংশ লোকই আমার ‘চাচা’ ☺️)। তাছাড়া তিনি খুবই আন্তরিক। আমি আর চাচা যখন এই ‘লিটিল ইন্ডিয়া’তে গিয়ে হাজির হই, তখন এশার নামাযের আরও ঘণ্টা দেড়েক বাকি।

আমি আমিরাতে পৌঁছার পর থেকেই এ-গলি ও-গলিতে শুধুই মসজিদ দেখতে দেখতে পরমভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করি: আরব আমিরাতের লোকজন একশতভাগ মুসলমান। কিন্তু লিটিল ইন্ডিয়াতে গিয়ে আমার ধারণা বেমালুম পাল্টে গেলো। এই দেশে একটা মন্দির দেখতে পাবো আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। রাস্তাঘাটে শুধুই ভারতীয় চেহারার লোকজন। কারো কারো ভাষাও কানে আসছে: হিন্দি।

এখানকার দোকানপাটগুলোতে যে পুতুলগুলো (ম্যানিকুইন) মডেল হিসেবে রাখা হয়েছে, সেগুলোও যেন ভারতের কথা বলছে। ওগুলোর চুল উঁচু করে ফুলিয়ে আচড়ানো, মাঝখানে সিঁতি (সিঁদুর ছিলো কিনা খেয়াল নেই), মাথার পেছনে আগের আমলের নায়িকাদের মতো ইয়া বড় খোপা, কপালে বড় একটা লাল টিপ আর ওগুলোর গায়ে জড়ানো শাড়ি। আমি শাড়ির রকম সকম চিনিনা, তবে কেমন যেন কাতান শাড়ির মতো লাগলো। …এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোও ভারতের কথা বলছে। রেস্টুরেন্টের নামগুলোও ভারতীয়, খাবারও ভারতীয়। হয়তো এখানেও অনেক বাংলাদেশি আছেন।

একটা ইউনিভার্সিটি বা কলেজের সামনে দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলাম ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তবে তাদের চেহারা ছাড়া আর কিছুই তাদেরকে ভারতীয় বলে পরিচয় দিচ্ছে না। কারণ মিশ্র সংস্কৃতিতে বড় হয়ে তাদের সাজ-পোশাকে যেমন এসেছে পশ্চিমা আবেশ, তেমনি এসেছে উগ্রতা আর চলন-বলনে এসেছে পাশ্চাত্য ঢঙ। সে অনেকটা ‘ককটেল জুসের’ মতো ‘ককটেল সংস্কৃতি’; সংস্কৃতির দুই ধারা মিলে এরা অন্য রকম হয়ে গেছে।

আগেই বলেছি, এশার নামাযের দেড় ঘণ্টাখানেক বাকি ছিলো। ঘুরতে ঘুরতে সে সময়টাও ঘনিয়ে এলো। এবার পড়লো মসজিদ খোঁজার কাজ। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, একশত ভাগ মুসলমান বলে যাঁদের মনে করেছিলাম, তাঁদের একটা এলাকায় মসজিদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে খুঁজে লিটিল ইন্ডিয়ার প্রায় বাইরে এসে পেলাম একটি মসজিদ। দ্রুত এশার নামায পড়ে নিলাম চাচা আর ভাতিজা। আর আমার ভুলও বুঝতে পারলাম, ‘মসজিদের শহর’ শুধু ঢাকাই হবে, কারণ ঢাকাতেই হিন্দুপাড়া মুসলমান পাড়া ভেদাভেদ না করে মসজিদ রয়েছে।

-মঈনুল ইসলাম

___________________

ইনশাল্লাহ আগামী পর্বে থাকছে…

শারজাতে চিত্রকর্মের বিশ্বমেলা | জাদুঘর | আবু ধাবি | আজমান…

_____________________

ক. পাঞ্জেগানা মসজিদ: যে মসজিদে জুমার নামায পড়া হয় না, শুধু অন্যান্য ওয়াক্তের নামায পড়া হয়

খ. জামে মসজিদ: যে মসজিদে জুমার খুৎবাসহ জামাতে নামায আদায় করা হয়, এবং অন্যান্য সকল ওয়াক্তের জামাতে নামায অনুষ্ঠিত হয়

গ. মিম্বর: যে বেদিতে দাঁড়িয়ে মসজিদের ইমাম সাহেব বক্তব্য রাখেন (বয়ান করেন), আর খুৎবা পাঠ করেন

ঘ. antique [অ্যান্‌।টীক্‌]: অতীতের নিদর্শন (বিশেষত কোনো আসবাব, শিল্পকর্ম বা সৌখিন উপকরণ)

ঙ. শেখ: আরব লাটদের বা আরব ধনীদের বলা হয় শেখ (Sheikh)। সাধারণত কোনো গোত্রের নেতাদেরকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হতো। নারীদের ক্ষেত্রে ‘শেখা’ (Sheikha) বলা হয়

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*