অবসরে কী করো?
কোনো কিশোর, যুবার সাথে দেখা হলেই এই প্রশ্নটা আমি সুযোগ পেলেই করি।
একটা মানুষ পড়ালেখা করে, খেলাধুলা করে, বেড়াতে যায় – এর মধ্যে হয়তো এক প্রকারের বাধ্যবাধকতা কাজ করে। বাবা-মা জোর করে বলেই সে বেড়াতে বের হয়। স্কুল, পরিবার থেকে প্রেশার থাকে বলে সে পড়তে বসে।
কিন্তু অবসর সময়ে সে যা করে তা একান্ত তার আত্মতুষ্টিতে করে। তার ভালোলাগা থেকে করে। তার ঐ কাজের প্রতি আন্তরিকতা, মনোযোগ থাকে বলেই করে।কেউ অবসরে ডাকটিকেট জমায়। আজকাল অবশ্য ডাকটিকেটের রীতি উঠে গেছে। কেউ কয়েন-কারেন্সি জমায়। কেউ বই পড়ে। কেউ টিভি দেখে। কেউ কম্পিউটারে গেম্স খেলে। কেউ খাতা-কলম নিয়ে গল্প লিখে। কেউ রান্না করে। কেউ সুঁই-সুতা দিয়ে সুন্দর কোনো মোটিফ তোলে কাপড়ে, কুশন কভারে। বিচিত্র সব কাজ করে কেউ কেউ… যেমন: হ্যাম রেডিও নিয়ে পড়ে থাকে। কিংবা সার্কিট বানানো, চিপের সাথে চিপ জুড়ে দিয়ে একটা মাইক্রোকন্ট্রোলার বানিয়ে ফেলা – কত যে বিচিত্র বিচিত্র শখ আছে মানুষের!
কিন্তু আজকাল, ছেলে-মেয়েরা অবসরে কী করে সেটা সহজে বলতে চায় না। তার কারণ তারা অবসরে facebook চালায় অথবা মোবাইলে/প্লেস্টেশনে গেম্স খেলে। এবং ফেসবুক চালানো কিংবা ভার্চুয়্যাল গেম্স খেলা তাদের গুরুজনরা কেউই ভালো নজরে দেখেন না, তাই তারা ব্যাপারটা চেপে যেতে গা বাঁচাতে হয়তো অন্য কোনো উল্টাপাল্টা কিছু বলে, পালায়।
আমি আমার নিজের কথা বলতে পারি: আমি ছোটবেলা ডাকটিকিট জমাতাম, টেলিফোন কার্ড জমাতাম, কয়েন জমাতাম, ছবি আঁকতাম, গল্প-কবিতা লিখতাম, গল্পের বই পড়তাম, কমিক পড়তাম, ফটোশপ দিয়ে ছবি এডিট করতাম, নিজের হাতে বই বাইন্ড করতাম, কলেজ জীবনে মাইক্রোসফ্ট অ্যাক্সেস শিখে ফেলার পর আমার লাইব্রেরীর (জ্ঞানসুধা গ্রন্থাগার (Gyanoshudha Gronthagar)) জন্য ডাটাবেয বানিয়ে সেটা ম্যানেজ করতাম, সিলেটি ভাষার অভিধান তৈরি করতাম, বাংলা উইকিপিডিয়ায় সময় দিতাম, ডায়রি লিখতাম, …
এবং, আজ বলছি, আমি পাঠ্যবই পড়ে যা শিখতে পারিনি, তার অনেক কিছু আমি শিখেছি আমার অবসরে করা এইসব আপাত বেহুদা কাজ থেকে। ডাকটিকিট থেকে আমি রাজধনেশ পাখি চিনেছিলাম। টেলিফোন কার্ড থেকে ৩০০ বছর পুরোন এক মসজিদকে চিনেছিলাম, মালয়েশিয়ার এক অদেখা ফল চিনেছিলাম। শুধু তিন গোয়েন্দা পড়ে দুনিয়ার অনেক অদেখা ভুবন ঘুরে এসেছিলাম। কয়েন-কারেন্সি জমাতাম বলে ওয়ান-ডলার-বিল-এ ফ্রিম্যাসনরি’র প্রতীক চিনেছিলাম। নিজের লাইব্রেরী ম্যানেজ করতে গিয়ে ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্টের হাতেখড়ি পেয়েছিলাম। …এবং আমার প্রথম চাকরিটা পেয়েছিলাম অবসরে তৈরি করা ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট দেখিয়ে।
আরো অনেককে চিনি, জানি, যারা আজকে যা হয়েছেন, তা তাঁদের অবসরে কাটানো সময়টুকুর জন্য হয়েছেন। হাসিন ভাইয়ের গল্প শুনেছিলাম, তিনি আজকের ‘হাসিন হায়দার’ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অন্যের অ্যাসাইনমেন্ট করে দিতে দিতে। বন্ধু আরেফিন অবসরে ক্যামেরা নাড়াচাড়া করে এখন Occaxions নামক ফটোগ্রাফি ব্যবসা চালাচ্ছে। বন্ধু নাকিব অবসরে Playit! নামক সফ্টওয়্যার চালিয়ে কীবোর্ড আর গিটার বাজানো শিখে ফেলে আর তা কাজে লাগিয়ে একটা মুভির জন্য গানও তৈরি করে। আবার এমনও ছেলে আছে, অবসরে বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশী জামাতে ট্রান্সলেটরের কাজ করতে করতে আজ তারা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে জব করছে, কারণ তাদের কমিউনিকেশন স্কিল তৈরি হয়ে গেছে…
সুতরাং, সময়কে হারিয়ো না। অবসরে কিছু একটা করো, যা তোমাকে আলাদা করবে… তোমাকে ‘তুমি’ করে তুলবে…
– মঈনুল ইসলাম