জ্বিন-ভূত! সত্যি?
ঘটনা # ১
মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নিজের গ্রামে গিয়েছি ঈদের ছুটিতে, ঈদ পালন করতে। ক্বোরবানির আগে বসেছে গরুর হাট। গরুর হাট পেরিয়ে আমরা আরো সামনে চলে গেলাম, কারণ আমাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ‘আমরা’ মানে, আমি; [চাচাতো ভাই] আউয়াল, আকবর, আমযাদ; [ফুফাতো ভাই] শাকির, নাসিম- এদের মধ্যে আমিই বয়সে সবার বড়; সবারই ‘বড় ভাই’, তাই অঘোষিত নেতৃত্ব আমিই দিচ্ছি; আমার পরে ‘বড় ভাই’ হলো শাকির। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যবশত আমরা কাযিনরা সবাইই ঐ এক রাতের জন্য একসাথে হতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য স্থানীয় হাই স্কুল: সিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলের পাশেই [সরকারি] প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জীর্ণপ্রায় পুরোন, আর নতুন ভবন। প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে আমি যখন পড়তাম, তখন প্রায়ই শুনতাম, দেখতাম, হাই স্কুলের কোনো না কোনো মেয়েকে ধরাশায়ী অবস্থায় রিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। …কী হয়েছে? …জ্বিনে ধরেছে।
এটা ছিল এই হাই স্কুলের নৈমিত্তিক ঘটনা। স্কুলের পিছনের একটা গাছে স্থায়ী আবাস জ্বিনদের। মাঝে মাঝেই তারা মেয়েদের সাথে জুড়ে যায়, মেয়েরা অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকমুখে শোনা যায়, স্থানীয় মাদ্রাসার প্রধান পণ্ডিত, নাজিম সাহেব নিজেই এই জ্বিনগুলোকে পুষতেন। কেননা, মেয়েগুলোর জ্বিন একমাত্র তিনিই ছাড়াতে পারতেন। এর পিছনে নাকি তাঁর গভীর একটা ষড়যন্ত্র ছিল, তিনি মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন থাকতে চান। তবে এই কথার কোনো সত্যতার প্রমাণ যেমন আমি খুঁজে পাইনি, তেমনি কথাটা উড়িয়েও দিতে পারিনি।
যেহেতু হাই স্কুলটি জ্বিনের আবাস হিসেবে এখনও বিখ্যাত বা কুখ্যাত, তাই আমরা একসাথে হয়ে প্রথমেই সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের সাথে সুইস আর্মি নাইফ, টর্চ- এগুলোর সংগ্রহ ছাড়া আর রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত গবেষক মন, আগ্রহী চেতনা। আর আমাদের সাথে এসেছে আউয়ালের এক বন্ধু, আশফাক। দলটা ভারি, সত্যি; তবুও আমরা (বিশেষ করে শাকির আর আমি) কিছু একটার প্রত্যাশা করছিলাম। অবশ্য আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ আমাদের পথে খানিকটা কাঁটা হয়ে আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পুরোন জীর্ণশীর্ণ ভবনের পাশ কাটালাম, কিছুই নেই। সামনে অগ্রসর হচ্ছি হাই স্কুল লক্ষ করে। লোহার গেটে ধাক্কা দিলাম, গেটটা মরিচাজনিত ক্যাচক্যাচ শব্দে খুললো। গেট পেরিয়ে স্কুলের মাঠে গেলাম। সেখান থেকে দোতলা স্কুল ভবনে। সবগুলো কক্ষই খালি- বেঞ্চ, বোর্ড, চেয়ার ছাড়া বাড়তি কিছুই নেই। টর্চের আলোয় চোখে পড়লো না অস্বাভাবিক কোনো সাদা কাপড়। স্কুলের পেছনে গেলাম। সেখানে পেশাব করার বেষ্টনি দেয়া জায়গা। টর্চের আলো ফেললাম গাছে; না, কিছুই নেই। কোথাও কিছুই নেই।
আমরা চললাম স্কুলের অন্যপাশে। আউয়াল হাঁটছে তার বন্ধুর সাথে, আমি হাঁটছি শাকির আর আমযাদের সাথে। আকবর হাঁটছে নাসিমের সাথে। ওপাশে গিয়েও কিছুই মিললো না, শুধু আরেকটা ভাঙা [বদ্ধ প্রস্রাবখানা ছাড়া। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে চললাম সবাই। কিছুটা রাগ ঝাড়লাম চাঁদের উপরও। নতুন ভয়ঙ্কর স্থান খোঁজার অভিপ্রায়ে আপাত ক্ষান্ত দিলাম এই অভিযানে। বাড়ি ফিরে চললাম।
ঘটনা # ২
সেদিন রাতে আউয়ালের প্রচণ্ড মাথাব্যাথা। মাথাব্যাথার জন্য সে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। আমরা কাযিনরা সবাই যেখানে ক্যারাম, মনোপলি খেলছি, হা হা হু হু ডাকিয়ে চিৎকার করছি, সে সেখানে নীরবে বসে আছে, মলিন হাসি হাসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আউয়াল আমাদের থেকে সরে পড়লো, গিয়ে শুয়ে থাকলো নির্জন একটা কক্ষে। আমরা সারা রাত ধরেই ‘ধনী হবার মজার খেলা’ খেললাম। কিন্তু আউয়ালকে আর পেলাম না।
সারা রাত জেগেও সকালে আমরাই আগে উঠলাম। গিয়ে তুললাম আউয়ালকে, তার গায়ে জ্বর এসেছে। সে নাকি সারারাত প্রচণ্ড মাথাব্যাথায় ছটফট করেছে। সারারাতই নাকি সেও সজাগ ছিল- অর্ধ্বঘুমন্ত। নাস্তা সেরে আমরা বাকি কাযিনরা আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ক্রিকেট খেলায়। তার কিছুক্ষণ পর এসে হাজির হলো আউয়াল, জানালো, সে গিয়েছিল স্থানীয় হুজুর, সুফিয়ান সাহেবের কাছে মাথাব্যথা সারাতে ফু দেয়াতে। তিনি তাকে ফু দেয়ার সময় জানিয়েছেন, কাল রাতে হাই স্কুল থেকে আউয়ালের ‘বাতাস’ লেগেছিল, তা-ই আউয়ালের এই প্রচণ্ড মাথাব্যথার কারণ। গ্রামে ‘বাতাস লাগা’ মানে বুঝানো হয় খারাপ, অস্পৃশ্য কিছুর প্রভাব লাগা- যা এখানে বদ জ্বীনের অতিন্দ্রীয় ছোঁয়া বোঝাচ্ছে। …আমি শুনলাম। মুসলমান হিসেবে আমি জ্বিনের অস্তিত্বে অস্বীকার করিনা। কিন্তু সব ঘটনাকে জ্বিনের কাজ বলেও স্বীকার করিনা। আমি খুঁজে দেখতে চাই; বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হলে হুট করে তা জ্বিনের কাজ বলতে নারাজ।
যাহোক, ঘটনা এপর্যন্তই। আউয়াল আপাত সুস্থ হলো, তবে দুর্বল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আউয়ালের সাথে সিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এরও আগে একবার একটা জ্বিন এসেছিল, সে অনেকদিন কষ্ট দিয়েছে তাকে, আর তার নাম ছিল ‘ছনু মিয়া’ (উচ্চারণ: সনু মিয়া)। তাই আমি আর শাকির, এমনকি আউয়ালও পরদিন থেকে যেকোনো ভৌতিক গল্পে বারবার এই সনু মিয়ার উল্লেখ করে মজা পাচ্ছিলাম। জ্বিন (কিংবা ভূত) আমাদের জন্য মজাদার বিষয় হয়ে গিয়েছিল। …সেদিনই শাকির আর নাসিম চলে গেলো ওদের বাড়িতে ঈদ করতে। আমরা আমাদের বাড়িতে ক্বোরবানির ঈদ পালন করতে রয়ে গেলাম।
ঘটনা # ৩
ঐদিনই দুপুর পৌনে ১টার দিকে আউয়াল জানালো, আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকের হাকালুকি হাওড়ের একটা গাতের (গর্তের) পানি সেচা হচ্ছে, মাছ ধরা হবে। আমি, আউয়াল আর আমযাদ ছাতা মাথায় দিয়ে খালি পায়ে চললাম বাড়ির কাজের লোক ফয়ায ভাইয়ের সাথে সেখানেই, মাছ ধরা দেখতে। প্রথমে মাথার উপরের ছাতাটাকে অবাঞ্চিত মনে হলেও কিছুক্ষণ হাঁটার পরই টের পেলাম, এই শীতেও [নিম্নচাপের কারণে] তীব্র হয়ে আছে রোদ। পথে পরিচিত এক বাড়িতে উঠে পানি খেয়ে নিলাম সবাই, বাড়ির সবাই আমাকে অনেকদিন পর দেখতে পেয়ে আনন্দিত। পানি পান করে আবার হাঁটা। হাঁটছি তো হাঁটছিই, পথ আর ফুরোতে চায় না। ‘হাওর’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সাগর’ শব্দ থেকে। বর্ষকালে পুরো হাওরাঞ্চলই পানির নিচে তলিয়ে থাকে, তখন সাগরেরই মতো এই হাওরেরও কোনো কুল দেখা যায় না; সেই থেকেই এই নাম। কিন্তু আমি এই শুষ্ক শীতকালেও হাওরের কোনো কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
সেই কিনারাহীন হাওরের মাঝে লোকালয়হীন এলাকায় পথে পড়লো দুটো গাছ। একটা বেশ ঝাপড়া, আম গাছের মতো, গোঁড়ার দিকটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা; অন্যটা বেশ খাড়া, ঋজু, ছড়ানো, উঁচু। এই দ্বিতীয় গাছটার স্থানীয় নাম ঢিপি গাছ (উচ্চারণ: ।ঢী।পি গাস্)। এই ঢিপি গাছটা বেশ ছিমছাম, আমার খুব ভালো লাগলো। আমি আর আউয়াল দুজনেই মোবাইল ফোন বের করে গাছটার ছবি তুললাম। ওটার নিচ দিয়েই আমাদের যেতে হলো গাতের দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম সেই গাতের কাছে। সেখানে পানি সেচা হচ্ছে মোটর দিয়ে, আর কাদার মধ্যে মাছেরা অনবরত লাফাচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে কাদা খুঁড়ে মাছ ধরা দেখতে থাকলাম আমরা তিন ভাই। এমন সময় আকবরও এলো চাচার সাথে। রোদের মধ্যে ছাতার নিচে বসে বসে চালতার আচার খাচ্ছি আমি, আমযাদ আর আকবর মিলে। কিন্তু আউয়ালের আচার খাবার কোনো ইচ্ছে নেই, তার আবার মাথাব্যথা করছে। কী এক মহাযন্ত্রণা!
এরপর ওরই কারণে উঠে পড়তে হলো আমাদের। এক ব্যাগ ভর্তি ছোট মাছ নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আমি আর আউয়াল। ওর শারীরিক অসুস্থতাহেতু আমি কিছুক্ষণ মাছের ব্যাগ বহন করলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারলাম না ওজন। তাই আউয়ালকে বহন করতে হলো ব্যাগটা। আবারও ঢিপি গাছের নিচ দিয়ে চলতে থাকলাম। পায়ের নিচে ধান কেটে নেয়া নাড়া পথ চলতে কিছুটা কষ্টই দিচ্ছে। তার উপর উঁচু-নিচু জমিতে খালি পায়ে হাঁটতে যতটুকু কষ্ট হবার কথা, তা-তো আছেই। কিন্তু তারপরও আউয়ালের খুব খারাপ লাগতে থাকে। বারবার ঐ এক গ্লাস পানির প্রতি দোষারোপ করছে – ঐ একগ্লাস পানিই নাকি সব নষ্টের মূল – সে বেশ ক্লান্ত। অথচ ঐ একগ্লাস পানি না খেলে এতক্ষণে আমার বেশ খানিকটা তৃষ্ণা লেগে যেত। এক পর্যায়ে একটা ট্রাকটর পেয়ে তার পিছনে বসে বিশ্রাম নিল সে। আবারও পথ চলা।
বাড়িতে ফিরে দাদুর কাছে মাছ দিয়ে আউয়াল গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার গোসল করতেও ইচ্ছে করছে না। পুরোটা বিকেলই সে পড়ে থাকলো মাথায় ব্যথা নিয়ে। রাতে মাছের তরকারি খেতে খেতে শুনলাম নতুন কথা, ‘বড় চাচা’ (আউয়ালের বাবা) জানালেন, ঐ গাছ দুটোই ‘দুষি’ (দোষি)। গ্রামে এই ‘দোষি’ শব্দটা দ্বারা বুঝানো হয় ‘জ্বিন-ভুতের আসর’। ওগুলো নাকি জ্বিনের আড্ডাখানা। তিনি আরো জানালেন, ঐ গাছ দুটোতে নাকি এই সন্ধ্যা-রাতে গেলেও আলোর নাচন দেখতে পাওয়া যাবে খালি চোখে। সেখানে বহু দিনের আস্তানা তাদের।
তার একদিন পরে সকালে ঈদ পালন করলাম আমরা। গরু ক্বোরবানি দেয়া হলো, আমি হাত লাগালাম, কিন্তু আউয়ালের তাতে হাত লাগাবার ইচ্ছে নেই। সকাল থেকেই তার পেটে ব্যাথা করছে, পায়খানা ভালো হচ্ছে না; ইতোমধ্যেই ফার্মেসী চালান যে চাচা, তাঁর পরামর্শে ইমোটিল ঔষধও খেয়েছে। আমরা যখন গরু, ছাগল ক্বোরবানি নিয়ে মহাব্যস্ত, বাড়ির এই এত্তোটুকুন চাচাতো ভাইগুলোও হাত লাগাতে উদগ্রীব, তখন অনার্স পড়ুয়া আউয়াল তার বিছানায় মশারি টাঙিয়ে শুয়ে আছে নির্জন ঘরে।
তাকে জিজ্ঞাসা করে সত্যিকার শারীরিক অবস্থা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই পেলাম না। সে গ্রাম্য বক্তব্যে জানালো, ক্যামন ক্যামন জানি করছে। এই ‘ক্যামন ক্যামন’ শব্দটা কোনো রোগেরই ইশারা করে না। তার এই বক্তব্য বাড়ির আর কেউ শুনলে ঠিকই ভাববে, ওর উপর জ্বিনের আসর হয়েছে। আর আমার মতো প্রতিটা ঘটনার সাক্ষী দুয়ে দুয়ে চার মিলাবে: নিশ্চয়ই ঐ গাছ দুটোর পাশ দিয়ে আসার সময়, আমাদের সাথে মাছ আছে দেখে আমাদের সাথে এসে পড়েছে কোনো দুষ্ট জ্বিন। কারণ জ্বিনেরা নাকি মাছ খায়। সামান্য কয়টা ছোট মাছের এতো ওজন লাগছিল কেন? …তারপর সে আউয়ালের সাথে লেগেছে। আউয়ালের এই শারীরিক অসুস্থতা (ক্যামন ক্যামন ভাব) সেই দুষ্ট জ্বিনের জন্যই, আর কিছু না।
ঘটনা # ৪
ঈদের রাতেই আউয়াল সুস্থ হয়ে গেল, ওর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে এসে দেখা করলো আমার সাথে। পুরোদমে সুস্থ। আমি হেসে হেসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কীরে, তোর সনু মিয়া চলে গেছে? সেও হাসলো। …আউয়াল সুস্থ হয়ে গেছে।
ঈদের চারদিন পরে শাকির আবার এলো বাড়িতে। আবারও আমাদের জ্বিন সন্ধানী আগ্রহ চাঙ্গা হয়ে উঠলো। সেও যেন সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের হাতে মাত্র দুদিন সময় আছে, এরপর দুজনেই যে যার পথ ধরতে হবে, আমাকে ঢাকার, আর ওকে সিলেট শহরের। তাই এরই মধ্যে সারতে হবে আমাদের কাজ। ঠিক করলাম, জ্বিন দেখতে হলে অভিযান হতে হবে রাতে, গভীর রাতে। আগেই আলোচনা করে ঠিক করে নিলাম, আউয়ালকে নেয়া ঠিক হবে না, কারণ ওর সাথে সনু মিয়া-বাহিনীর যে হারে যোগাযোগ, তাতে ফেরার পর আবারো যদি সে অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে সব দোষ গিয়ে পড়বে আমাদের ঘাঢ়ে। তাই শুধু দুজনেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কাউকে নেয়া যাবে না।
এখন ক্বোরআন যদি সত্যি হয়, তবে জ্বিন জাতি আছে। আর চাচার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে ঐ দুই গাছে জ্বিনদের আবাস রয়েছে। এই অনুপাতে যখন পৌঁছলাম, তখন আমাদের দুজনেরই কিছু প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন পড়লো। আমরা মস্তিষ্কের পাতা উল্টে বের করলাম জ্বিনদের অতীত কাহিনীগুলো কীরকম ছিল। সেখানে জ্বিনদের কাছে যারা গেছে, তারা নিজেরাই জ্বিনদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে, সাথে জ্বলন্ত আগুন থাকার কারণে বেঁচে গেছে। কাজের লোক ফয়ায ভাই থেকে জেনে নিলাম গাছ দুটো যেখানে, সেখানে কীরকম ঘটনা ঘটেছে। ফয়ায ভাই জানালেন, ওখানে গেলে জ্বিনেরা মানুষকে ‘আউরি লাগিয়ে দেয়’ (পথ ভুলিয়ে দেয়); বন্যার সময়ও একই কাজ করে ওরা। বিশেষ করে যারা ঐ গাছগুলোর নিচে পায়খানা-প্রস্রাব করে, তাদের বিশেষ ক্ষতি করে।
আমরা তো আর পায়খানা-প্রস্রাব করছি না, যাচ্ছি ওদের সাথে দেখা করতে। এখন সমস্যা একটা রয়ে যাচ্ছে- ‘আউরি লাগিয়ে দেয়া’। এটা থেকে বাঁচার উপায় কী? আমাদের কাছে কম্পাসও নেই। শাকির তার শোনা একটা কাহিনী বললো, ভারতের কামরূপ-কামাক্ষায় এক লোক আটকা পড়েছিল যাদুকরের হাতে। সেখানে তাকে বাড়ির পেছনে বেঁধে রাখা হয়েছিল। রাতে কোনো রকমে যখন সে ছুটতে পেরেছে, তখন সে পালাতে উদ্যত হলো। সারা রাত ধরেই সে দৌঁড়ে চললো, যত দূরে পারা যায় সরে পড়তে হবে। এক সময় দিনের আলো ফুটলে সে আবিষ্কার করলো, সারা রাত ধরেই সে ঐ বাড়ির চারপাশে চক্কর দিয়েছে। ‘আউরি লাগা’র এই মোক্ষম উদাহরণটা আমাদের পরিকল্পনাটাকে আরেকটু জটিল করে দিলো। ঠিক করলাম, বাড়ির কাউকে জানিয়ে যেতে হবে, সারা রাত ধরেই আমরা ওখানে ‘আউরি লেগে’ ঘুরতে ফিরতে থাকলেও কেউ একজন যেয়ে আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে তাহলে।
পরিকল্পনামতো শুধু আউয়ালকে জানানো হলো। কিন্তু আমরা দুজন রাতে শু’বো [ছোট চাচা] সাজু চাচার ঘরে। তাঁকেওতো তাহলে জানিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তিনি যদি বাধ সাধেন? তারপরেও, তাঁকে না জানিয়ে উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত তাঁকে আর আউয়ালকে জানাবো, ঠিক করলাম। আউয়ালকে জানিয়ে গেলাম, যদি আমরা চার ঘণ্টা পার হবার পরেও না ফিরি, তাহলে যেন সে সাজু চাচার সাথে পরামর্শ করে পরবর্তি ব্যবস্থা নেয়। এতো কিছুর পরেও আমরা ছোটখাটো কিছু সাবধানতা নিলাম: যেমন, আমরা কেউই সিগারেট না খাওয়াসত্ত্বেয় বাজার থেকে একটা গ্যাস-লাইটার কিনে নিলাম; কিনে নিলাম দুটো মোমবাতি, যাতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে রাখা যাবে। বাড়িতে ফিরে টর্চগুলো চার্জ করে নিলাম।
রাতে যখন সবাই ঘুমাতে যাবে, তখন আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত। বাড়িতে আমাদের উপস্থিতি [চাচাতো ভাই] আকবরের কাছে বেশ আনন্দের, তাই সে সুযোগ পেলেই রাতে আমাদের দুজনের (আমার আর শাকিরের) সাথে থাকে, ঘুমায়। সেদিনও সে আমাদের সাথে ঘুমাবে বলে আমাদের সাথেই আছে। শাকির হয়তো দল ভারি করতেই তাকেও সঙ্গী করতে চাইলো। আমি মানা করলাম। কারণ, আকবর যদিও হাফেযে ক্বোরআন, তবুও ভীতু মানুষ। টয়লেটে গিয়ে রাতের বেলা জানালা খুলে দিলে একমাত্র মানুষ সে-ই যে, টয়লেটে ঢোকার আগ-মুহূর্তে শাকিরকে অনুরোধ করে জানালাটা লাগিয়ে টয়লেটে যায়। সুতরাং যে ভয় পায়, তাকে সাথে নেয়া মানে সাক্ষাৎ বিপদ ডেকে আনা।
কারণ সূরা (৭২) জ্বিনের ৬ নম্বর আয়াতে পড়েছি,
কতক মানুষ কতক জ্বিনের আশ্রয় চাইতো, ফলে তারা জ্বিনদের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিত।
অর্থাৎ প্রথমদিকে জ্বিনেরা মানুষকে ভয় পেত। কিন্তু পরে যখন তারা দেখলো, মানুষই তাদেরকে ভয় পায়, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কাছে আশ্রয় চায়, তাদের সহায়তা চায়, তখন তারা মানুষকে ভয় দেখাতে শুরু করলো। আর যারা ভয় পায়, তারাই তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাদের উপরই তারা প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আকবরকে নেয়া নিরাপদ না।
কিন্তু শাকিরই আকবরকে বগলদাবা করে নিল। বাড়ির কাউকে জানতে দিতে চাইনা বলে সবার শুয়ে পড়ার অপেক্ষা করলাম। তারপর তিনজনেই দুই রাকাত নফল নামায পড়ে নিলাম। পাঠক হয়ত ভাববেন, ভয় পাচ্ছি বলে- আসলে ভয় ব্যাপারটা সবার মধ্যেই আছে। কিন্তু ভয়কে জয় করতে হয়। আর মুসলমানদের কর্তব্য, সব কাজে যাবার আগে দু’রাকাত নফল নামায পড়ে যাওয়া, যাতে আল্লাহ’র দয়ায় কাজটা সহজ হয়ে যায়। আমি সবসময়ই তা পালন করার চেষ্টা করি, তাই এবারও করলাম- ভয় কমাতে নয়, ভয়কে জয় করতে।
তারপর আমাদের প্রস্তুতি। রাত তখন ১২টা ৩০মিনিট। ঘরে যেমন, বাইরে তার চেয়েও বেশি শীতের প্রকোপ। জ্যাকেট পরে নিয়ে, কুয়াশা ঠেকাতে মাথায় দিলাম জ্যাকেটের খসখসে ক্যাপটা, হাতে পরে নিলাম হাতমোজা। শাকির পরে নিলো জিন্সের জ্যাকেট, মাথায় আলাদা শীত-ঠেকানো টুপি। আকবরকে দিলাম আমার মাফলার, তা দিয়ে কান-মাথা প্যাঁচিয়ে নিলো। সাজু চাচার ঘরে রাখা হকি-স্টিকটা তুলে নিলাম- সাপ-বিচ্ছু থেকে বাঁচা দরকার; জ্বিন আক্রমণ না করলেও এরা আক্রমণ করতে দ্বিধা করবে না, কারণ এরা ভিতু খুঁজে না। শাকির ওর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিলো, তাতে নিলো এক বোতল খাবার পানি, ফার্স্ট এইড, ওর নিজস্ব সুইস আর্মি নাইফ (বিভিন্ন প্রকারের চাকু-জাতীয় সরঞ্জাম সম্বলিত সেট), প্যান্টের পকেটে নিজের মোবাইল ফোন সেট। শাকির বিভিন্ন অপারেটরের সীমও নিয়ে নিলো সাথে। আমি প্যান্টের পকেটে নিলাম কিনে নেয়া মোমবাতি দুটো, গ্যাস-লাইটার, ক্যামেরা ও ভিডিও সুবিধা সম্বলিত নিজের মোবাইল ফোন সেট, কলম, প্যাড, আমার সুইস আর্মি নাইফ, আর হাস্যকর হলেও একটা আতশী কাচ; আতশী কাচ কেন নিলাম, জানি না; তবুও নিয়ে নিলাম সাথে। তিনজনের হাতে তিনটা টর্চলাইট।
জুতাগুলো খুলে রাখতে গিয়েও রাখলাম না কী মনে করে। ওগুলো পায়ে নিয়ে উঁচু-নিচু জমিতে চলা কষ্টকর হবে জেনেও পরে নিলাম। তারপর মোবাইল ফোনে আমাদের একটা দলীয় ছবি তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাজু চাচা দেখিয়ে দিলেন কী করে বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরের ছিটকিনিটা ফেলে দিয়ে তারপর ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। আমরা রওয়ানা করলাম। রাত তখন পৌনে ১টা। নিশ্চুপে বেরোলাম, বাড়ির আর কেউ টের পেলে চোর ধরতে উঠে যাবে। চললাম বাড়ির পিছন দিকে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে। ছোটবেলায় বাড়ির এই বাঁশঝাড়কেও ভয় পেতাম আমি, এখন মনে হচ্ছে নস্যি। বাইরে থেকে ওরা দুজন দুটো বাঁশ তুলে নিলো হাতে। মোটামুটি বাড়ির সীমানা পেরোতেই আকবর আটকালো আমাদের। বললো, চার ক্বুল (সূরা কাফিরূন, ইখলাস, ফালাক্ব, নাস) পড়ে নিতে, আর ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ে নিতে। ওর কথামতো দোয়া পড়ে নিয়ে বেরোলাম, আকবরকে সাহস দিতে বললাম, ভয় পাওয়ার কিছুই নাই; যদি মনের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক হয়, তাহলে স্মরণ করবি আল্লাহকে, কারণ তাঁর কাছে সব ভয় ম্লান। আকবর হয়তো ভীতি কাটিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো। তাছাড়া দোয়াগুলো যে ওকে চাঙ্গা করলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা চললাম কুয়াশার চাদর ভেদ করে, শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে।
আমাদের সবকিছুই ঠিকঠাক, এপর্যন্ত একেবারে সোনায় সোহাগা, একটা জিনিস ছাড়া- আর সেটা হচ্ছে চাঁদ। আকাশের পূর্ণিমার ঐ জ্বলজ্বলে চাঁদটাই যেন ভয়গুলোকে যতটা হবার কথা ছিল, ততটা চাঙ্গা হতে দিচ্ছে না। আর ভয় চাঙ্গা না হলে জ্বিন দেখার মজা থাকলো কোথায়? শুক্লপক্কের ঐ চাঁদটাকে না পারা যাচ্ছে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে, না পারা যাচ্ছে অভিযান রোহিত করতে, কারণ শাকির আর আমার হাতে সময় বড় কম। এটা অবশ্যই বোকামি যে, আমরা পূর্ণিমার রাতে ভূত খুঁজতে বেরোচ্ছি; এর অবশ্য একটা যুক্তি থাকতে পারে, আমরা পূর্ণিমার অশুভত্ব সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল, তাই পূর্ণিমার অশুভত্বের দেখা পাওয়ার জন্যও বেরিয়ে পড়েছি বলা যায়।
‘মাউন্টেন ডিউ’ ড্রিঙ্কসের একটা বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘ভয় সবারই লাগে, কিন্তু ভয়ের সামনেই জয় রয়েছে’। এই কথাটিকে সামনে রেখেই আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম। ভয় আমার মধ্যে তেমন একটা কাজ করছিলো না, সত্যি; তবে আমার সহযোগী অভিযাত্রীদ্বয়ের মধ্যে ভয় কিছুটা ছিলো, কেউই অস্বীকার করেনি। আমরা জ্বীনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছিলাম না, কারণ আমরা মুসলমান; তারপরও আমরা যথেষ্ট বিজ্ঞানমনষ্কতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, এই এলাকার বিখ্যাত (কুখ্যাত) ভূতের/জ্বীনের আড্ডাখানা, দুটো গাছকে লক্ষ্য করে। দুই সঙ্গীকে বলে দিলাম, আমাদেরকে পেছন থেকে কেউ অনুসরণ করছে মনে হতে পারে, কারণ আমাদের কানে বাঁধা মাফলার, ক্যাপ- এগুলোর খসখস আওয়াজ সবসময়ই আমাদের সাথে প্রতারণা করবে। তাই এতে বিব্রত হবার কিছু নেই।
যাহোক, আমরা ধান কাটা নাড়াময় জমি ধরে চলেছি তিন অভিযাত্রী। আকবরকে আনায় একটা সুবিধা ঠিকই হয়েছে, আর তা হলো, পথ-ঘাট চেনা। আমি এই পথ ধরে দিনের বেলা গিয়েছিলাম, তাই আমি চিনলেও আকবরই মূলত পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। যখনই পথটা কোনো বাড়ির আশপাশ দিয়ে যাচ্ছে, তখনই আমরা নিশ্চুপে হাঁটছি, শুধু আমাদের জুতার আওয়াজ, আর আমার খসখসা প্যান্টের খসখস আওয়াজ হচ্ছে। আমাদের বড় রকম একটা সমস্যা সৃষ্টি করলো এই হকিস্টিকটা। কারণ এখন যদি কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে এই হকিস্টিকটা আমাদের পরিচয় দিবে, আমরা গুন্ডা। তাই আমি হকিস্টিকটার মাথাটা বগলে ঢুকিয়ে নিয়ে হাতলটা বাইরের দিকে রাখলাম। কারো সাথে দেখা হলে সরাসরি বলবো, আমরা ওমুক বাড়ির ছেলেরা, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। লোকজনকে পরিচয় দিলে আমাকে চিনতে পরবে, কিন্তু আমি বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকি, তাই না চেনার সম্ভাবনা বেশি। তবে আকবরকে এলাকার সবাইই চিনতে পারবে। আমরা এগিয়ে চললাম। গ্রামের পাশেই খোলা মাঠে খেকশিয়ালরা ডেকে উঠলো দলে দলে। মনে মনে হাতে লাঠি থাকায় সাহসই পেলাম, শিয়ালতো অন্তত তাড়ানো যাবে।
আমি তীব্র ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে মাথা থেকে ক্যাপটা নামিয়ে নিলাম। কারণ একটা খসখসে ক্যাপের দোহাই দিয়ে বিজ্ঞানকে অপমাণ করতে পারিনে। এবারে আমার কানে সব আওয়াজ স্পষ্ট আসতে লাগলো, যেগুলো বাকিদের কানে আসতে গেলে টুপি আর মাফলারে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। চাঁদনি রাতে পাতাঝরা গাছগুলোর চিকন চিকন ডালপালা আকাশে যেন কেউ কালো কালি দিয়ে এঁকে দিয়েছে। তারই মাঝে একটা দুটো পাতা যেগুলো ঝুলে আছে, সেগুলোর কোনো কেনোটা হাওরের মুক্ত বাতাসের তাড়নে নির্দিষ্ট তালে দুলছে। শহুরে কেউ এগুলোকে নিশ্চিত ভূতের হাতছানি ভেবে ভুল করতে পারে। আমরা গ্রাম্য মেঠো পথ পেরিয়ে এবারে পুরো হাওরে নেমে গেলাম। চারিদিকে সুনসান নীরবতা, শুধু আমাদের পথ চলার শব্দ। শিয়ালগুলোকেও দেখতে পাচ্ছি না আশেপাশে, ডাকছেও না ওরা। নীরব মধ্যরাত, হাওরের মাঝখানে আমরা তিনজন।
শিশির আমাদের পা ভিজিয়ে দেয়ায় পা থেকে জুতাগুলো পিছলে খুলে যেতে চাইছে; তবুও চলছি। একটা ব্যাপার লক্ষ করছি, আমরা নাড়া মাড়িয়ে সামনে চললেও বারবারই মনে হচ্ছে ঠিক পিছনেই কেউ একজন আমাদেরকে অনুসরণ করছে। এর কারণ আবিষ্কার করলাম, আমরা যে নাড়া মাড়িয়ে চলেছি, আমরা পা তুলে নিলেই সেগুলো আবার খসখস করে আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। ফলে আওয়াজটা আমাদের ঠিক পিছনে হচ্ছে। পিছন ফিরে দেখলাম, কিছুই নেই। মাঝে মাঝে টর্চের আলো ফেলছি গোবর শনাক্ত করতে। হঠাৎ সামনে পেলাম কালো বিশাল এক স্থান, টর্চের আলো ফেলে দেখি পুরো জমির নাড়া আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ছাই করে রাখা হয়েছে (জমির উর্বরতা বাড়াতে এমনটা করা হয়ে থাকে); ওগুলো মাড়ালাম না, ভেজা পায়ে সব ছাই লেগে যাবে বলে। জমিটা পাশ কাটিয়ে চললাম আরো সামনে। আইল ধরে হাঁটলে নাড়া মাড়াতে হয় না, তাই ঐ অনুসরণ-জাতীয় আওয়াজটাও পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ।
নাড়ায় নেমে এলে শাকির হঠাৎ বলে উঠলো, ভাইয়া, একটা কিছু হচ্ছে; আমি বুঝতে পারছি। তবে এখন বলবো না, পরে বলবো। ব্যাপারটা ঠিক সুবিধার না। শাকিরের কথাকে আমি তেমন আমল দিলাম না। বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তি যুক্তি (logic) আর প্রমাণ (evidence) ছাড়া কোনো কিছুতে কান দেয় না। আমি যতক্ষণ সেরকম কিছু পাচ্ছি না, ততক্ষণ সেগুলোতে আমল দিব না।
দূরে দেখা গেলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত গাছ দুটো। কিন্তু ‘বড় চাচা’র কথামতো কোনো আলোর নাচন দেখলাম না। অথচ তিনি বলেছিলেন, সন্ধ্যারাতেও আলোর নাচন দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমরা মধ্যরাতেও তা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা জুতা হাতে নিয়ে একটা ছোট্ট খাল পেরোলাম, পায়ে খানিকটা কাদা-পানি লাগলো; তোয়াক্কা করলাম না। এগিয়ে চললাম প্রথম গাছটা লক্ষ করে, আমগাছের মতো গাছটা, দেয়াল দিয়ে ঘেরা যেটা- সেটার দিকে। ধীরে ধীরে ওটার কাছে যাচ্ছি। আমি উপলব্ধি করলাম, যতই ‘ভয় লাগছে না’ বলছি, তবুও কিছুটা ভয় মনের খুব ভিতরের কোথাও শক্ত হতে চাইছে; এটা খারাপ লক্ষণ। দুর্বল হওয়া চলবে না, তাহলে জ্বিনেরা সাহস সঞ্চয় করবে। আমরা গাছটার একেবারে নিচে চলে গেলাম।
টর্চের আলো ফেললাম গাছের নিচের দেয়ালটাতে। মোটামুটি ছয় ইঞ্চি উঁচু বর্গাকৃতি দেয়াল দিয়ে ঘেরা গাছটা। দেয়ালের গায়ে টর্চের আলো ফেলতেই দেয়ালে এমবুশ করা একটা লেখা চোখে পড়লো:
কালাচাঁদবাড়ী
সন- ১৪০১ বাং
উপরের চিহ্নটা হলো [বাংলা লিপিতে] ‘অউম’ বা ‘ওম’, হিন্দু ত্রিত্ববাদীয় উচ্চারণ, ওঙ্কার। কিন্তু ‘কালাচাঁদবাড়ী’? …কোনো বাড়ির তো চিহ্ন পর্যন্ত নেই, তাহলে বাড়ি এলো কোত্থেকে? বুঝলাম না। হয়তো কোনো হিন্দু বাড়ির নিজস্ব সম্পত্তি, তাই নিজের বাড়ির দখলদারিত্বের নিদর্শন রেখেছে এভাবে। এখন ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, তাহলে মোটামুটি ১৪ বছর আগে দেয়ালটা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে গাছটা আরো পুরোন আর বয়স্ক মনে হচ্ছে। টর্চের আলোতেই আমার কম রেযোল্যুশনের মোবাইল দিয়ে ছবি তুললাম লেখাটার; আমরা একবার করে বসে লেখাটার পাশে নিজেদের ছবি তুললাম।
গাছের দিকে তাকালাম আমি। কোনো অশুভত্ব নেই, কোনো ডাল নুয়ে নেই, সবই স্বাভাবিক, অতি স্বাভাবিকও না; যথেচ্ছ স্বাভাবিক। এখানে আমাদের কাজ শেষ, তাই আমরা দ্বিতীয় গাছের দিকে যাবো এবারে। শেষবারের মতো আমরা দেয়ালের ফোকর দিয়ে ভিতরে টর্চের আলো ফেললাম, যাতে ভিতরে কিছু থাকলে দেখতে পারি। টর্চের আলো ফেলতেই আমার বুকটা ধক্ করে উঠলো … কিছু একটা দেখেছি … তাতেই আমার মনের গহীন থেকে ভয়টা বেরিয়ে এসে পুরো শরীরটা কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এক সেকেন্ড লাগলো সয়ে আসতে, পরক্ষণেই চিনতে পারলাম, ওটা একটা হাতে বানানো ছোট্ট হিন্দু মূর্তি। ভয়ের রেশটা কিছুক্ষণ থাকলো আমার ভিতরে। বাকিদের অবস্থা জানি না। ভয় পাইনা আমি এটা ঠিক, কিন্তু এইতো পেলাম, যদিও সেটা সাময়িক। কিন্তু অভিযাত্রী হিসেবে এই ভয় পাওয়াও চলবে না। আমি আবার নিজের সাহসটুকু চাঙ্গা করে নিতে চাইলাম। তবে ভায়ের আপাত রেশে মূর্তিটা কোন দেবতার, তা আর শনাক্ত করতে গেলাম না; তবে এতটুকু বলতে পারি, ওটা ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব) কোনো একজন। শুধু সমাধানে পৌঁছলাম, এই মূর্তিগুলো রেখে হিন্দুরা এসে গাছটির পূজা করে।
দেয়ালঘেরা গাছটিকে পেছনে রেখে এগিয়ে চললাম ঢিপি গাছটা লক্ষ করে। চাঁদের আলোয় পাতাশূণ্য গাছটা কেমন রূপময়ী লাগছে, গল্পের বইতে এই রূপকে বোধহয় ভয়ঙ্কর ভূতুড়ে রূপ বলা হয়। আমরা এগিয়ে চললাম গাছটাকে লক্ষ্য করে। গাছটার কাছাকাছি গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, আমার মোটেও ভয় করছে না। হয়তো দেয়ালঘেরা গাছটার নিচে ভয়টা পাওয়ায় প্রাথমিক ভীতিটা কেটে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়েই আকাশের চাঁদটার একটা ছবি নিলাম মোবাইল দিয়ে। মনে সামান্য ইচ্ছে, যদি ছবিতে ‘গাছে শুয়ে থাকা’ কোনো জ্বিনের ছবিও উঠে যেতো। কিন্তু নিরেট কালো গাছের ডাল, আর আকাশের জ্বলজ্বলে চাঁদটা ছাড়া ছবিটা ধুসর।
আর কিছুই দেখার নেই। আমরা ফিরতি পথ ধরতে চাই। গাছটাকে পিছনে ফেলে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। কিছুই দেখতে না পাওয়ায় শাকিরের বোধহয় ভীতিটা সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সে আবারো এ্যাডভেঞ্চারের মজায় চলে এলো, বললো, হাওড়ের মাঝখানে মাঝরাতে পানি খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা দারুণ হবে। গোল হয়ে হাঁটুর উপর বসে সে পানি পান করলো, সাথে আমরা দুজনও। তারপর সে গল্প বলতে থাকলো, সেবা প্রকাশনীর অনুবাদকৃত ‘শী’ আর ‘রিটার্ণ অফ শী’র কাহিনী। সেখানে এরকম জঙ্গুলে অভিযানের গল্প আছে। টর্চের আলো ফেলে মুহূর্তটা ভিডিও করলাম আমি, সাথে ঐ ঢিপি গাছটাও। তারপর ফিরতি পথ ধরলাম।
আবারও শাকির একই কথার পুণরাবৃত্তি করলো, ভাইয়া, আবারও ওটা হয়েছে; এটা অস্বাভাবিক। ও যদিও বলছে, কিন্তু আমি কোনো আলামতই পেলাম না। আমরা ফিরতি পথে হাঁটছি। দূর থেকে আধো অন্ধকারে আমরা বুঝতেই পারছি না, কোন পথে এসেছিলাম। আগেই বলেছি, হাওড়ের কোনো কিনারা পাওয়া যায় না এই জায়গায়। শাকির ইশারা করলো চাঁদের আলোয় দূরে দেখা যাওয়া ছোট্ট কাঁশ ঝোপটার, ওটার পাশ কাটিয়ে খাল পার হয়েছিলাম। ওদিকে চললাম। এক সময় আমরা খালটা পার হলাম। তারপর আবার গ্রামের মেঠো পথ ধরলাম। নীরব রয়েছি তিনজনে। ইতোমধ্যে শাকির পা থেকে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। শিশির সিক্ত ঠাণ্ডা নরম মাটিতে পা ফেলতে নাকি ভালোই লাগছে। আমার হাতের হাতমোজা নোংরা হয়ে যাবে বলে জুতা আর হাতে নিলাম না।
ছোট্ট গ্রামটা পার হয়ে আবারও খোলা ধানী জমি। চাঁদের আলোয় অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে গাছগাছালি। আমি সেরকম একদিকে হাত উঁচিয়ে বললাম, ওটাই বোধহয় আমাদের বাড়িটা। শাকির আর আকবর বললো, না ওটা না, বরং ওদিকে- অন্যদিকে দেখালো ওরা। পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো আকবর। হাঁটতে হাঁটতে চলেছি বাড়ির পথে। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়। শাকির জানালো কী হয়েছিল ওখানে, দুইবার কি তিনবার ওর পায়ে আঘাত করেছে কিছু একটা, বাধা দিতে চেয়েছে। আমি যুক্তি দেখাতে চাইলাম, ওটা নাড়ার কাজ; পা যখন সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন উঁচু হয়ে থাকা নাড়ায় আটকেছে, তাই এমনটা মনে হয়েছে। কিন্তু যুক্তিবিদ শাকির বললো অন্যকথা, না, আঘাতগুলো সামনে থেকে আসেনি, এসেছে পেছন থেকে, ঠিক গোড়ালির উপরের অংশে। এর কী ব্যাখ্যা?
আমরা কোনো কথা না বলে বাড়িতে গিয়ে পুকুরে পা ধুয়ে, বাইরে বাঁশগুলো ফেলে, কৌশলে দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকলাম। রাত তখন পৌনে ২টা। পুরো এক ঘণ্টার অভিযান শেষে ফিরেছি আমরা। ওরা মনে করেছিল, সাজু চাচা ঘুমিয়ে পড়েছেন; কিন্তু আমি জানতাম, তিনি ঘুমাতে পারবেন না। কারণ আপাতদৃষ্টে তিনি আমাদেরকে বিপদে ঠেলে দিয়েছেন। সত্যিই তিনি ঘুমাননি; ভিতরে ঢুকতেই কথা বলে উঠলেন। …সবকিছু ঠিকঠাকমতো রেখে রাতের মতো অভিযান রোমন্থন করতে করতে ঘুমাতে গেলাম। তবে কিছুই না দেখতে পাবার হতাশাটা কাটাতে চাইলাম স্বপ্নে। মনে মনে প্রত্যাশা করলাম, ঘুমে যেন জ্বিনেরা দেখা করে আমাদের সাবধান করে দেয়, ‘ওখানে গিয়ে ভালো করোনি’। কিন্তু স্বপ্নে কিছুই দেখলাম না।
সকালে অন্যান্য দিনের তুলনায় ঠান্ডাও পড়লো খানিকটা। নাস্তার টেবিলে বুক উঁচিয়ে সবাইকে বলে বেড়ালাম আমাদের কীর্তিগাঁথা যে, সবার মানা করাসত্ত্বেয় আমরা ঠিকই গিয়েছিলাম রাতের অন্ধকারে জ্বিনের খোঁজে। জানলাম, যে আউয়ালকে পিছনে রেখে গিয়েছিলাম আমাদের উদ্ধারের জন্য, সে সারারাত ঘুমিয়েই কাটিয়েছে; মনে করেছিল, আমরা ভয় পেয়ে শেষ পর্যন্ত যাবোই না। আর আশ্চর্য হলাম, পরিস্থিতির কারণে করা কোনো কোনো বিষয় তখন আমাদের কাছে হাস্যস্পদ হয়ে উঠছে। আমরা হাসছি প্রাণ খুলে- ‘ঐ গাছ দুটোতে কিছুই নেই’।
ঘটনা # ৫
সেদিন দুপুর থেকেই সাজু চাচার মাথাব্যথা শুরু হলো- প্রচণ্ড মাথাব্যথা যাকে বলে। আমরা বাড়িতে আসার পর থেকেই তিনি আমাদেরকে সবসময় সঙ্গ দিচ্ছিলেন, কখনও ক্রিকেটে, কখনও ক্যারাম খেলায়, কখনও মনোপলি খেলায়। কিন্তু মাথার ব্যথা এতো তীব্র হয়ে গেলো যে, তিনি নিশ্চুপে তাঁর ঘরে বিছানায় পড়ে রইলেন। এমনকি আমরা যে ক্রিকেট খেলছি, বল এসে টিনের চালে পড়ছে, তাতেও তিনি আপত্তি করছেন, কারণ আওয়াজে তারা মাথার ব্যথা আরো প্রচণ্ড হচ্ছে। দুপুরে আমরা যখন খেলা থামিয়ে চা খাচ্ছি, তখনও চায়ে আসক্ত সাজু চাচা চা ফিরিয়ে দিলেন। কম্বল গায়ে দিয়ে মাথায় ভিক্স লাগিয়ে পড়ে থাকলেন বিছানায় গা লেপ্টে নিয়ে। আমরা এসে দেখে যাচ্ছি তাকে, কিন্তু মাথাব্যথা সারিয়ে তোলার জন্য মাথা টিপে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হচ্ছেন না।
আমার মাথায় অনভিপ্রেত একটা সম্ভাবনা উঁকি দিলো, গতরাতে জ্বিনেরা আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি ঠিকই, কিন্তু তাদের কেউ নীরবে হয়তো এসে পড়েছিল আমাদের তিনজনের কারো সাথে করে। গ্রাম্য লোককথায় শোনা যায়, বাজারের ব্যাগে করে ভূতেরা বাড়িতে চলে আসে। এখানে হয়তো তারা শাকিরের ব্যাগে করে, কিংবা নিস্পৃহ হয়ে আমাদের কারো ঘাঢ়ে করেই হয়তো চলে এসেছে। আর এসে আশ্রয় নিয়েছে সাজু চাচার মধ্যে। ঠিক একই অবস্থা তাঁরও, যেমনটা আউয়ালের মধ্যে দেখেছিলাম ক’দিন আগে।
একেবারে অযৌক্তিক না হলেও, অবৈজ্ঞানিক এই সম্ভাবনার কথা শাকির আর আকবরকে বললে, দুজনেরই চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল। শাকির বললো, কাল রাতে আমরা ঘরে ঢোকার আগ মুহূর্তে আমার একবার মনে হয়েছিল যে, আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাতে হাত ছুঁইয়ে ঘরে ঢোকা উচিত। কিন্তু তোমাদেরকে আর বলিনি, পরে ভুলে গেছি। ওটা করা উচিত ছিল। মানে, আমার যুক্তিকে শাকির সমর্থন করলো।
বিকেলের দিকে আমি মশারি টাঙ্গিয়ে দিলাম সাজু চাচাকে। তাঁর মাথাব্যথার কোনো উন্নতি হচ্ছে না তখনও। আমি মনে মনে [হুজুর] সুফিয়ান সাহেবকে ডেকে আনার চিন্তা করলাম। এও ঠিক করে নিলাম, তাঁকে কিছুই জানানো যাবে না, শুধু সাজু চাচাকে মাথাব্যথা সারাতে ফু দিতে বলবো। তখন তিনি যদি জ্বিনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু বলেন, তাহলে সেটা বিজ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করা যাবে। মশারির ভিতরে অর্ধ্বেক গা ঢুকিয়ে ভিক্সলাগিয়ে মাথাটা ভালো করে টিপে দিতে থাকলাম। মনে মনে সাজু চাচার অসুস্থতার জন্য নিজেকে দোষারোপ করছি, আর তাঁর আরোগ্য কামনা করছি।
পরিশেষ
এতো কিছুর পর যারা ঘটনাগুলোর মধ্যে পরম ভৌতিক ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, তাদেরকে এবারে চরম হতাশ করতে হচ্ছে। কারণ এপর্যন্ত ঘটা প্রতিটা ঘটনার বৈজ্ঞানিক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে। একে একে বলছি:
প্রথমত, হাই স্কুল সম্পর্কে আমাদের কারো মধ্যে অতোটা ভীতি কাজ না করলেও আউয়াল এই স্কুল সম্পর্কে ভুক্তভোগী। তাই সে যে বেশ বড় ধরণের ভীতি নিয়ে ওখানে গিয়েছিল, সেটা নিশ্চিত। আর যে ভয়কে সাথে নিয়ে গেছে, সে-যে ভয়ের কারণে রাতে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। কারণ আমি মনে করি:
মানুষ ভয় পায় বলেই ‘ভয়’ পায়।
তাছাড়া সেদিনই বিকেলে সে সিলেট শহর থেকে ট্রেনে চড়ে এসেছে। বাড়িতে এসে সন্ধ্যা থেকেই সে মাথাব্যথা করছিল বলেছে, তাছাড়া অর্ধ্বেক পথই নাকি ট্রেনে কোনো এক মহিলাকে সীট দিয়ে দাঁড়িয়ে এসেছে। আর আসার পথে ঠাণ্ডা বাতাসকে খাটো করে দেখলে চলবে না। সব রকমের শারীরিক দুর্বলতা গিয়ে মিশেছে ঐ জ্বর আর মাথাব্যথায়। …সুফিয়ান সাহেব সম্পর্কে আমি এতটুকু বলতে পারি, তিনি মিথ্যে বলবেন না। তাছাড়া তিনি ইসলাম ধর্মের খুব বিজ্ঞ একজন আলেম। এখানে হয়তো তিনি একটা সহজ সূত্র কাজে লাগিয়েছেন, রোগীকে তার রোগ বাতলে দিয়েছেন। কোনো রোগী যখন দেখে, ডাক্তার তার রোগ বাতলে দিয়েছেন, তখনই সে অর্ধ্বেক সুস্থ হয়ে যায়; রোগী অসুস্থ থাকে, যখন ডাক্তার কী রোগ হয়েছে, তা-ই চিনতে পারেন না। তাই হয়তো সুফিয়ান সাহেব মাথাব্যথার প্রতি আউয়ালের মনোযোগ হটাতে সহজ সূত্রে বলেছেন ‘জ্বিনে ধরেছে’; রোগী সুস্থ করতে স্বাভাবিক একটা নিষ্পাপ মিথ্যে কথা বলেছেন। তাছাড়া আউয়াল যে গিয়ে তাঁকে গতরাতে হাই স্কুলে যাবার ঘটনা আগবাড়িয়ে বলেনি, তা-ইবা কী করে বলি?
এব্যাপারে আমি পরে আউয়ালের কাছে কী হয়েছিল জানতে চাইলে, আউয়াল জানায়, সে প্রথমে কিছুই তাঁকে বলেনি। শুধু মাথাব্যথার জন্য ফু দেয়াতে গিয়েছে। সুফিয়ান সাহেবই জানতে চেয়েছেন, কোথাও গিয়েছিলে নাকি? সে যখন বলেছে হাই স্কুলের কথা, তখন তিনি বলেছেন, ওখান থেকেই বাতাস লেগেছে। তথৈবচ!
দ্বিতীয়ত, দিনের বেলা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে আউয়াল গিয়েছিল হাওরে। তাছাড়া সে কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল না। প্রচণ্ড রোদ, প্রচণ্ড আলো মাথাব্যথার অন্যতম কারণ, অস্বীকার করার কিছুই নেই। তাছাড়া আমার পানির তৃষ্ণা পাচ্ছিলো। যদিও আউয়াল বলছিল, ঐ একগ্লাস পানিই তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- হয়তো ভিতরে ঠান্ডা, বাইরে উত্তপ্ত রোদ- বিপরীত পরিবেশে শরীর খাপ খাওয়াতে পারছিল না। খারাপ লাগা স্বাভাবিক। …আর ‘ছোট মাছের ব্যাগে ওজন লাগবে কেন?’ প্রশ্নটার উত্তর দেয়া যায় একটা ধাঁধাঁ দিয়ে: এক কেজি তুলা, আর এক কেজি লোহার মধ্যে কোনটা বেশি ভারি? উত্তর হলো, দুটোই সমান। এখানেও তেমনি সমস্যা থাকছে তখনই যখনই ‘ছোট মাছকে আকৃতি বা প্রকৃতিগতভাবে ওজনহীন মনে করা হচ্ছে’। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্যাগ ভর্তি ছোট মাছেরও বেশ ভালো ওজন হতে পারে। পুরো বিষয়টাই বিজ্ঞানসম্মত।
তৃতীয়ত, ঈদের দিন পেট খারাপ থেকেই ওর শারীরিক দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া আগের রাতে ঈদ উপলক্ষে বানানো তেলে ভাজা পপ, সিঙ্গাড়া খেয়েছে সে। ওগুলো যে ওর পেট খুব সানন্দে মেনে নিয়েছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। বদহজম হতেই পারে।
চতুর্থত, (এই যুক্তিটা শাকিরের দেয়া) মানুষকে ‘আউরি লাগিয়ে দেয়া’ খুব সহজ, কারণ ব্যাপারটা হয় রাতে। রাতে চাঁদের আলো থাকাসত্ত্বেয় আমি দুবার ভুল পথ ধরতে যাচ্ছিলাম, পথ চিনতে ভুল করছিলাম; সেখানে অন্ধকার রাতে কোনো বাতি সাথে না থাকলে, কিংবা দূরে আলো ফেলার উপযোগী ভালো টর্চ সাথে না থাকলে একজন লোক খুব স্বাভাবিকভাবেই কম্পাসহীন হাঁটাপথে পথ ভুল করে বসবে। তাছাড়া গ্রাম্য ‘আউরি লাগা’র ঘটনাগুলো বড়জোর আধাঘণ্টা কি একঘণ্টার, কামরূপ-কামাক্ষা’র গল্পের [কিংবা কাহিনীর] মতো সারারাতের নয়। …পথ ভুল করবে মানুষই, দোষ গিয়ে পড়বে জ্বিন-ভূতের উপর- যুক্তিটা যথেষ্ট।
পঞ্চমত, বিজ্ঞানমনষ্ক শাকির পিছন থেকে পা আঁকড়ে ধরাকে অবৈজ্ঞানিক ভূতুড়ে মনে করছে, কারণ সে নাড়ার প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না। আসলে ঘটনা ঘটছে ঠিক একটা রিঙের মতো: একটা রিঙের মধ্যে পা ঢুকিয়ে পা সামনের দিকে বাড়ালে রিঙটাও সামনের দিকে যাবে, আর যখনই পা থেমে যাবে, তখনই পায়ের সাথে চলা রিঙটার পিছনের দিকটা এসে পায়ে আঘাত করবে। এই আঘাতের মাত্রাটা লোহার রিঙে এক রকম (সমানুপাতিক) হবে, প্লাস্টিকের রিঙে এক রকম (প্রায় সমানুপাতিক) হবে, কিন্তু নাড়ার ক্ষেত্রে যে আঘাতটা হবে, তার নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। কারণ নরম নাড়ার সামনের টানটা সামান্য হলেও মাটির সাথে লেগে থাকার কারণে পিছনের টানটা একটু জোরে হওয়া স্বাভাবিক, একইভাবে পেছনের তুলনায় সামনের টানও জোরে হতে পারে। যদিও শাকির এই ব্যাখ্যা পছন্দ করছে না, সে এই আঘাতকে ‘কোনো কিছুর’ লেজ বলতেই বেশি আগ্রহী। ওটা যে জমিতে বাস করা ইঁদুরের লেজ নয়, তারও কোনো প্রমাণ সে দিতে পারছে না।
ষষ্ঠত, সাজু চাচা সুফিয়ান সাহেবের ফু ছাড়াই একটা মাথাব্যথার বড়ি খেয়ে, আর বিকেলে আমি মালিশ করে দেবার পর এক কাপ চা খেয়ে সম্পূর্ণ চাঙ্গা হয়ে উঠে বসেছেন। মাথাব্যথা সম্পূর্ণ বিদায়। তাছাড়া গ্রামের বাড়ির সবার মধ্যে আউয়াল আর সাজু চাচার মাথাব্যথার কথা প্রায়ই শোনা যায়- বাড়িতে মারাত্মক মাথাব্যথা হিসেবে তাদের দুজনেরই কিছুটা বদনাম আছে। সাজু চাচার এরকম মারাত্মক মাথাব্যথা আমার আরেকবার দেখার সুযোগ হয়েছিল, সেবার কোনো জ্বিন-সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
কিন্তু কথা সেখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানের কাছে কোনো কিছু ‘আছে’ বলতে হলে যেমন দরকার প্রমাণ, তেমনি কোনো কিছু ‘নেই’ বলতেও দরকার প্রমাণ। আমরা সেরাতে শুধু ‘আছে’র পক্ষে কোনো প্রমাণ পাইনি। কিন্তু ‘নেই’ যে, তাও প্রমাণ করে দিতে পারছি না। জ্বিনদের পাওয়া যাবে হিন্দু ধর্মে ‘ভূত’ (আত্মা, প্রেতাত্মা) শব্দটি দিয়ে। তাই জ্বিন বলুন আর ভূতই বলুন, তাদেরকে অস্বীকার করতে পারছি না, তবে তারা যে আছেই, তাও বলতে পারছি না।
তাছাড়া বিজ্ঞান কোনো পরম জ্ঞান নয়, বিজ্ঞান অসমাপ্ত। অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানের কাছে নেই। আর বিজ্ঞানের শেষ থেকে উৎপত্তি ধর্মের। তাই অব্যাখ্যাত বিষয়গুলোর পরিচিতি পাওয়া যায় ধর্মের দ্বারস্ত হয়ে। প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞান যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না, তখন প্রমাণ ছাড়াই ধর্ম যুক্তি দেখায়। অদৃশ্যে বিশ্বাস করা না করা যদিও মানুষের এখতিয়ার, তবুও অদৃশ্যে বিশ্বাস করতেই বলেছে ইসলাম। …বিশ্বাস কি করবো? সে নাহয় ব্যক্তির উপরই ছেড়ে দেয়া যাক?
-মঈনুল ইসলাম