ধারাবাহিক: ইংরেজিভীতি থেকে ইংরেজিপ্রীতি —এর একটি পর্ব
আমরা দেখেছিলাম, ভাষাশিক্ষায় লুবাব সাহেবের অন্তর্দৃষ্টি অনুসারে ভাষা শিক্ষার শেষ ধাপ হচ্ছে “ভাষার ব্যাকরণ শেখা”। আজ আমরা শেষ এই ধাপটি নিয়েই আলোচনা করছি:
ভাষার পরে তার ব্যাকরণ
যারা বুঝেন, তারা একটা কথা যত্ন সহকারে বলেন যে, “আগে ভাষা, পরে তার ব্যাকরণ”। ভাষার আগে ব্যাকরণের স্থান না। ব্যাপারটা কেমন?
একসময় সংস্কৃত ছিল বিদ্যজনদের ভাষা। তখন লেখায়-পড়ায় মানুষ “মাটি” লিখতো না, লিখতো “মৃত্তিকা”। তো মৃত্তিকার মতো এত কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে কিভাবে বাক্য লিখতে হবে, সেগুলোর হিসাব-নিকাশ করে তৈরি করা হয়েছিল সংস্কৃত ব্যাকরণ – পাণিনি’র লেখা “অষ্টাধ্যায়ী” ছিল তখনকার সেকরমই একটা জনপ্রিয় ব্যাকরণ। সেখানে শব্দের বচন, লিঙ্গ, পদ প্রকরণ, সংস্কৃত স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ ইত্যাদি সবই ছিল। মানুষ বেশিদিন অতো কঠিন ভাষায় কথা বলেনি। ভাষা ঐ ব্যাকরণ মেনে বসে থাকেনি। মানুষ, সংস্কৃত ভাষার কঠিন রূপ ধীরে ধীরে বাদ দিয়ে মুখের ভাষাকে সহজ করে ফেললো। জ্ঞানী-গুণিজন তখন বদলে যাওয়া এই ভাষাকে অমার্জিত, ইতর ভাষা বলতেন হয়তো। যত যা-ই বলুন না কেন, ভাষার বদলে যাওয়া আটকাতে পারেননি তাঁরা। ব্যাকরণ ধরে যদি বসে থাকতো, তাহলে ভাষার বদল হতো না। পরিবর্তনের ধারায় সেই ভাষা পরিবর্তন হতে হতে আজকের বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। সংস্কৃত থেকে যে বাংলা ভাষা বদলেছে, সেই বাংলার জন্য কিন্তু আর সংস্কৃতের জন্য লেখা ব্যাকরণ কাজে লাগে না। ব্যাকরণই গেলো বদলে — পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দ্য আসসুম্পসাঁউ, বাংলা ভাষার জন্য প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন।
পৃথিবীতে এমন বহু ভাষা আছে, যাদের কোনো ব্যাকরণই নেই।
যতদিন ব্যাকরণ রচিত হয়নি, মানুষ কি ততদিন বাংলা জানতো না? জানতো তো বটেই, ব্যবহার করতো, লিখতো, বইও ছাপাতো – ব্যাকরণের জন্য ভাষা কখনও বসে থাকেনি, থাকবেও না। পৃথিবীতে এমন বহু ভাষা আছে, যাদের কোনো ব্যাকরণই নেই।
শুধু আপনিই ইংরেজি (পড়ুন: ভাষা) শিখবার জন্য ব্যাকরণের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবেন – এবং সত্যি বলছি, বসে থাকবেন আজীবন, যদিনা এই ধারাবাহিকটি বুঝে থাকেন।
ব্যাকরণ = Grammar
ছোটবেলা আমরা “গ্রামার” বলতে বুঝতাম English Grammar, আর “ব্যাকরণ” বলতে বুঝতাম বাংলা ব্যাকরণ। কিন্তু এই দুটো যে গোড়ায় একই জিনিস সেটা বুঝেছি অনেক বড় হয়ে। হ্যা, গ্রামার শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে ব্যাকরণ। অর্থাৎ, মানোএল দ্য আসসুম্পসাঁউ যে ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন বাংলার জন্য, সেটাকে আপনি অনায়াসে Bengali Grammar বলতেই পারেন, আবার ওমুক শিক্ষকের লেখা ইংলিশ গ্রামার বইটিকে আপনি অনায়াসে বলতে পারেন ইংরেজির ব্যাকরণ।
না, আমার উদ্দেশ্য শব্দার্থ মুখস্ত করানো নয়, বরং আপনাদেরকে একটা স্মৃতির আংটা (memory hook)-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া… ছোটবেলা parts of speech পড়েছিলাম। সেখানে ছিল noun, pronoun, adjective, verb ইত্যাদি। আবার বাংলা ব্যাকরণে পড়েছিলাম বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া ইত্যাদি। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি, আসলে একই জিনিসই পড়ছি, শ্রেফ দুটো ভাষায়। মিলিয়ে দেখতে পারেন: noun = বিশেষ্য; pronoun = সর্বনাম; adjective = বিশেষণ; verb = ক্রিয়া। এবং মজার ব্যাপার হলো, বাংলা আর ইংরেজিতে এই পদ প্রকরণগুলোর আচরণের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তাই বলে বাংলার সব নিয়ম হয়তো ইংরেজির সাথে মিলবে না কিংবা ইংরেজিরটা বাংলার সাথে – তবে অনেক অনেক মিল যে থাকবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
আরো দেখুন তো: শব্দের বচন ~ numbers, লিঙ্গ ~ gender, পদ প্রকরণ ~ parts of speech, স্বরবর্ণ ~ vowels, ব্যাঞ্জনবর্ণ ~ consonants, বাগধারা ~ idiom, essay ~ রচনা, compound noun ~ সমাস, suffix ~ প্রত্যয়, বিভক্তি, অনুসর্গ, prefix ~ উপসর্গ, synonyms ~ সমার্থক শব্দ, antonyms ~ বিপরীতার্থক শব্দ, punctuation ~ বিরাম চিহ্ন ইত্যাদি আরো কত বলবো?
শুদ্ধিকরণ
যেহেতু আপনি ভাষা শিখছেন ‘চর্চা’ করে, দেখে, বলে, কিংবা শুনে… তাই আপনি আসলে জানেন না আপনি যা শিখছেন তা শুদ্ধ নাকি অশুদ্ধ। কে যেন একবার বলেছিল:
এক বিদেশী আমাদের দেশে এসে কাদের সাথে যেন থেকেছিল। ফিরে গিয়ে এখন সে বাংলা ভাষার দুয়েকটা শব্দ বলতে পারে। আপনি যদি তাকে বাংলা বলতে বলেন, তাহলে সে দুয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিবে। 😟
দোষ তার না, দোষ ছিল তার শিক্ষা-পরিবেশের। পরিবেশ থেকে শেখার এই পদ্ধতিতে আপনি খুব সহজেই ভুল জিনিসটা শিখে বসতে পারেন। তাই ভুল-শুদ্ধ যাচাই করার জন্য আপনার দরকার হবে কষ্টিপাথর। কষ্টিপাথর দিয়ে যেমন স্বর্ণ খাঁটি কিনা যাচাই করা যায়, তেমনিই ব্যাকরণ দিয়ে আপনি যাচাই করতে পারেন, আপনি যা শিখলেন তা কতটা শুদ্ধ। এই একটা ক্ষেত্রে অন্তত ব্যাকরণের দরকার আছে — ব্যাকরণ আপনাকে ভুল আর শুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখাবে।
পরিশেষ
ইংরেজি জানতে হাই কোমড ব্যবহার করতে জানতে হয় না
ধারাবাহিকটি শুরু করেছিলাম (দেখুন: ইংরেজি ভীতি থেকে ইংরেজি প্রীতি – উপক্রমণিকা) বান্দরবানের গহীনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী কিভাবে উন্মুক্ত স্থানে প্রাকৃতিক কৃতকর্ম করেন। বলেছিলাম, এই ধারাবাহিকের সাথে ব্যাপারটা মিলানোর চেষ্টা করাটা ছিল আপনার বোকামি। কিন্তু এখন বলছি, ঐ অসভ্য পাহাড়ের গহীনেই আমরা একটা পাড়াতে রাত কাটানোর সময় ঘরে এক যুবক এসে ঢুকলো। সে এসে সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলো। (বিস্তারিত: অফ-ট্র্যাক বান্দরবান – রুমনা পাড়া)
খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম, এই অসভ্য (? 😶) মানুষগুলোর মাঝে ইংরেজি জানা একজনকে পেয়ে। বুঝেছিলাম, ইংরেজি (পড়ুন: ভাষা) জানতে হলে হাই কোমড ব্যবহার করতে জানতে হয় না – শ্রেফ ভাষার চর্চা করতে হয়। এই যুবক ভারতের ত্রিপুরাতে লেখাপড়া করে।
এই ধারাবাহিকের মূল উদ্দেশ্য ছিল: সবাই আপনাকে ইংরেজি (পড়ুন: ভাষা) কিভাবে শিখতে হয় তা শেখায়, আমি আপনাকে বললাম, ইংরেজি (পড়ুন: ভাষা) কিভাবে শিখবেন না। এই ধারাবাহিকের লেখাগুলো আবার পড়ুন, বারবার পড়ুন, উপলব্ধি করুন যে, ব্যাকরণ দিয়ে ভাষাশিক্ষা শুরুর যে পথ চলতে শুরু করেছেন, সে পথ বদলে নিতে হবে…।
নতুন যেকোনো ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রেই — হোক জাপানী, চীনা, রুশ, হিন্দী কিংবা মাওরি – “এতোদিনে ভাষা শিক্ষা” শিরোনামের বই না কিনে আসুন – সেই ভাষা দেখি, শুনি, বলি, লিখি, আর সব শেষে ব্যাকরণ দিয়ে তা যাচাই করে শুদ্ধ ভাষা শিক্ষা করি।
ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।
(সমাপ্ত)
– মঈনুল ইসলাম
হাহাহা, “ইংরেজি জানতে হাই কোমড ব্যবহার করতে জানতে হয় না” আপনার এই কথাটা খুব সুন্দর লাগল। আসলেই আমরা মনে করি ইংরেজি বলার জন্য গায়ে ভাল কাপড়, উচ্চ শিক্ষা হাবিজাবি আরো অনেক কিছু দরকার। সবকিছু বাদ দিয়ে যে দরকার, সেটা হল সাহস। সাহস করে গ্রামারের দিকে না থাকিয়ে গড়গড় করে ইংরেজি বলা শুরু করলেই আপনার ইংরেজি স্বাভাবিকভাবেই ভাল হয়ে যাবে।