এক ছিল বাদশাহ, আর তাঁর এক ছেলে ছিল। সে ছিল মুসলমান, আর ‘গোলাপ রাজা’ নামে তার এক হিন্দু বন্ধু ছিল। তারা দুজনে সারাক্ষণ পাশা খেলায় মেতে থাকতো। খেলার সময় একদিন হঠাৎ গোলাপ রাজা প্রস্তাব দিয়ে বসলো, “যে জিতবে, মানে আমি যদি জিতি, তাহলে তোমার বোন আমার কাছে বিয়ে দিবে।” বাদশাহের ছেলেও তাতে রাজি হয়ে পাল্টা প্রস্তাব করলো, “আর যদি আমি জিতে যাই তাহলে তোমার বোন আমার কাছে…।”
হলো কি, বাজির খেলায় জিতে গেলো গোলাপ রাজা। শর্তমতে তো বাদশাহের ছেলের তার বোনকে বিয়ে দিতে হবে গোলাপ রাজার সাথে। খেলাচ্ছলে একটা কথা বলে বসেছে বলে ফেঁসে গেছে; কিন্তু ভাই কোনোভাবেই রাজি না এই বিয়েতে। প্রথম সমস্যা, তারা মুসলমান আর গোলাপ রাজা হিন্দু। আর দ্বিতীয় সমস্যা, তারা বাদশাহী জীবনযাপনে অভ্যস্থ, সে হিসাবে গোলাপ রাজার সাথে তার বোনের কোনোও তুলনাই হতে পারে না।
বাদশাহের একমাত্র মেয়ের নাম ‘নুযি’। সবারই অতি আদুরে। এখন সমস্যা হলো, নুযিকে অন্যত্র বিয়েও দেয়া যাচ্ছে না গোলাপ রাজার কারণে। সে বাদশাহ’র বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করছে নুযি কইন্নাকে পেলেই তুলে নিয়ে যাবার জন্য। ওদিকে বাদশাহ’র ছেলে তার বন্ধু গোলাপ রাজার কাছে হেরে গিয়ে তার সাথে আর মেলামেশাই বন্ধ করে দিয়েছে, পাছে দেখা হলে বোনকে বিয়ে দেবার প্রসঙ্গটা নিয়ে চাপ দিবে গোলাপ রাজা।
কিন্তু ভাইয়ের সামান্য একটি প্রস্তাবকে প্রাধান্য দিয়ে বোন নুযির জীবন তো আর আটকে থাকতে পারে না। একদিন নুযি কইন্নার শখ জাগলো, সাগর দিঘিতে গোসলে যাবে। সাগর দিঘি হলো নুযির বাবার আমলের পুকুর। এখন সে কী করে গোসলে যায়? সেজন্য দাদীর কাছে গেলো—
লাল ।খড়ম ।পায়ে ।কইন্না সুনার আশা ।ভররে
।ধীরে ।ভরে যাওনি ।কইন্না দাদীরও মন্দিরে
“শুনো শুনো দাদীগো, ।খুশে বিদায় দেও মোরে
আমি যাইতাম্ সাগর দিঘিত্ গুশোলে।”“আমি তো না ।জানি গো, ।জানোইন তুমার মায়েরে”
লাল ।খড়ম ।পায়ে নুযি সুনার আশা ।ভররে
ধীরে।ভরে যাওনি নুযি মাই।জীরও মন্দিরে
“শুনো শুনো মাই।জিগো, ।খুশে বিদায় দেও মোরে
আমার মনে লইছে আমি যাইতাম সাগর দি।ঘিত্ গুশোলে।”“আমি তো না ।জানি নুযি, ।জানোইন তুমার ।চা।চীয়ে রে”
তো নুযি গেলো চাচীর ঘরে-
লাল ।খড়ম ।পায়ে নুযি সুনার আশা ।ভররে
ধীরে ভরে যাওনি নুযি ।চা।চীরও মন্দিরে
“শুনো শুনো চা।চীগো, ।খুশে বিদায় দেও মোরে
আমার মনে লই।ছে আমি যাইতাম সাগর দিঘিত্ গুশোলে।”“আমি তো না ।জানি বু।জি, ।জানোইন তুমার ।ভাবীয়ে রে”
লাল ।খড়ম ।পায়ে নুযি সুনার আশা ভররে
।ধীরে।ভরে যাওনি নুযি ।ভাবীরও মন্দিরে
“শুনো শুনো ।ভাবীগো,
আমার মনে লই।ছে আমি সাগর দি।ঘিত্ যাইতাম গুশোলে।”“যাও যাও নুযি গো, গুশোলে।
।পাঞ্চ দাসী আগে ।করে নুযি কইন্না মা।ঝে
অদ্য এ দুই।ফর অইতে চলিয়া আসিও মন্দিরে।”
ভাবির থেকে অনুমতি পেয়ে নুযি গোসলে গেল। কবি বলছেন-
।পাঞ্চ দাসী আগে-পরে, নুযি কইন্না মাঝে।
আ-টু ।পানিত নামিয়া নুযি দাতো মাইনজোইন ।করোইন রে
।কোমর ।পানিত নামিয়া নুযি গাও মাইনজোইন ।করোইন রে।
বাবা।জীর ঘাটে ডুবো দি-য়া ।চা।চা-জীর ।ঘাটে ।বাসো রে।
।চা।চা-জীর ।ঘাটো ডু-বো দিয়া ।চাইরো ।ঘাটে ।ভাসোইন রে
।পরে ডুবো দিয়া নুযি ।কইন্যায় উটিয়া দে।খোইন
গুলা।ফ রা।জায় হুইয়া বইয়া ।চায়।
।পাঞ্চ দাসী আগে ।করে নুযি কইন্না মা।ঝে
অদ্য দুই।ফর অইতে ।চলিয়া আসোইন মন্দিরে
গোসলে গোলাপ রাজাকে দেখেই নুযি দুপুর বেলায়ই ঘরে চলে এলো। এসেই ঘরের কপাট লগিয়ে দিলো। তখন চাচী ডাকেন তাকে, “উঠো, উঠো, নুযি কইন্না উঠো, গোসল করে সেই যে ঢুকলে এসে ঘরে, ভাত তো খেয়ে যাও…”
নুযি ।কইন্নায় ডা-কিলে না উটে নুযি কইন্না রে
।চা-।চী।জিয়ে গিয়া ডা।কোইন, “নুযি নুযি উটো গো
ভাতো যে ।খাইলাও আইয়া”
তবু নুযি কইন্না উঠে না। দরজাও খোলে না। এদিকে বিয়ের পয়গামস্বরূপ ‘পান-বাটা’ পাঠিয়েছে গোলাপ রাজা। তাই ভাইয়ের বউ গিয়ে ডাকেন এবারে,
“উটো উটো নুযি কইন্না গো
গুলা।ফ রা।জার বাটার ।পান ।খাও আইয়া।”
তো দরজা খুললো নুযি, খুলে বাইরে বের হলো। হীরার কাটা দিয়ে খোঁপা করে বেরিয়ে এলো সে। বেরিয়ে, গোলাপ রাজার পাঠানো বাটা থেকে একটু পান মুখে দিলো। গোলাপ রাজা পালকিও পাঠিয়ে দিয়েছে, নুযি কইন্না তার চাইই চাই।
“বিসমিল্লা” ।কইয়া নুযি ।কইন্নায় মুকো দিলো ।পান
।ঘর তোনে বারোইয়া নুযি কইন্না মা।ফায় ।চলিয়া যাইন
আ-।দা ।পতো গিয়া মালি গুষ্টিয়ে বলোইন,
“হ।খলোর বিবি নিলে মা।ফার ভিত্রে ।করি ।ফিকো বাইয়া যায়।
গুলা।ফ রা।জার বিবি, নুযি কইন্নার যেন রক্ত বাইয়া যায়।”
স্বামীর বাড়িতে নিয়ে পালকি রাখা হলো। পর্দা (।ঘিরুয়ান) উঠালেন শ্বাশুড়ি। তিনি দেখলেন, পালকির (মা।ফা) ভিতর রক্তারক্তি অবস্থা- নুযি কইন্না পালকির ভিতরেই মরে পড়ে আছে। উনি বাপ-ব্যাটাকে ডেকে বললেন-
“।ছইলেনা ধইলেনারে বাবা অ।ফ্রাদোর ।ভাগি অইলে।
নুযি ।কইন্যা মা।ফার ।ভিত্রে ।প।চিয়া যে রই।ছে।”
নুযি বুঝেছিল, যত ভেদই থাকুক না কেন, তার ভাইয়ের নির্বুদ্ধিতার খেসারত তাকে দিতেই হবে, অন্য কোথাও তার আর বিয়ে হবার নয়। তাই নুযি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেয়। পালকিতেই খোপায় লাগানো হীরার কাটা দিয়ে নিজেই নিজের গলা চিরে আত্মাহুতি দেয় সে।
নুযিকে যে পালকি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই পালকি করেই ফের তার বাপের বাড়িতে ফিরত পাঠানো হলো – তবে তরতাজা নুযি কইন্নার বদলে রক্তে লাল হয়ে ভেসে যাওয়া নুযিকে।
~ সমাপ্ত ~
আমার নানীর (আমি ডাকতাম ‘নানু’) সাথে এটাই ছিল আমার শেষ দেখা। তাঁর মুখেই আমার এই কিচ্চা শোনা। প্রথমে তা টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করে পরে কম্পিউটারে নিয়েছি, তাই মান কিঞ্চিত খারাপ মনে হতে পারে। এই কিচ্চায় সিলেটি ফোকলোর-এর একটা ছোঁয়া পাওয়া যাবে বলে আমি তা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। এখানে ব্যবহৃত কিছু শব্দ বর্তমান সিলেটিরা ব্যবহার করেনই না, যেমন: পালকিকে ‘মা।ফা’।
আল্লাহ আমার নানুকে ক্ষমা করে দিন, জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। (আমিন)
-মঈনুল ইসলাম
প্রচ্ছদের ছবি: Saatchi (http://s3.amazonaws.com/saatchi-print-preview/399288-1501545-canvas-white.png)