কুসংস্কারের সংস্কার - নিশাচর

কুসংস্কারের সংস্কার

কেউ বলবেন উনি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন; কেউ বলবেন উনি কুসংস্কারে অন্ধ। কিন্তু সব কথাকে সবসময় আমল দিলে চলে না। এখন সময় এসেছে ব্যাপারগুলোকে খতিয়ে দেখার:

অধ্যাপক আজহার হোসেন তাঁর লেখায় লিখেছেন:

একটা কথা বড় আশ্চর্যজনক। উচ্চশিক্ষা এই সব সংস্কার বা কুসংস্কার দূর করতে পারে না। কারণ শিক্ষা হচ্ছে মানসিক বৃত্তির অগ্রগতি। এ সংস্কার কাল্পনিক ভয়-ভীতি থেকে জন্মায়। একটা বুদ্ধিবৃত্তির, অপরটি মনের জগতের।

নিচের সারণীটা দেখা যাক:

বই খুলে রেখো না খোলা বই শয়তান পড়ে ফেলে
জুতা উল্টে রেখো না জুতা উল্টো করে রাখলে অমঙ্গল হয়
পথের মাঝে ঝাড়ু রেখো না ঘর থেকে বের হতে ঝাড়ু দেখলে অমঙ্গল হয়
 —————
মুরগী খেয়ো না মুরগীতে ক্ষতিকর ভাইরাস পাওয়া গেছে

এই যে পরস্পর পাশাপাশি কতকটি বাক্য উল্লেখ করা হলো, এদের মাঝে একটা ব্যাপার লক্ষ করার আছে। ‘মুরগি খেয়ো না’ বললে [আমাদের চিরজীবনের অভ্যাসবশত নেতিবাচক দিকটির প্রতি ঝুঁকে] আরো বেশি মুরগি খাবো আমরা। আর যদি বলা হয়, ‘মুরগিতে ক্ষতিকারক ভাইরাস পাওয়া গেছে’ তবে আর মুরগি না খাবার জন্য উপদেশ দিতে হবে না, এমনিতেই মুরগি খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

অতীতের কুসংস্কারগুলোকে যদি এভাবে চিন্তা করি, তবে সেগুলো ছিল ‘সংস্কারেরই’ নামান্তর। যেমন: বই হলো বিদ্যার্জনের বাহন। সুতরাং বইকে অবহেলা করা মানে পরোক্ষভাবে বিদ্যাকে অবহেলা করা; তাই কি নয়? তাই অতীতে বলা হতো, “খোলা বই শয়তান পড়ে ফেলে।” এই কথা শুনে পাঠক বই পড়া শেষে বইকে খুলে রাখতেন না, বন্ধ করে বা উল্টিয়ে রাখতেন। যদ্বারা তারা অজান্তেই বইকে সম্মান করতেন (প্রকারান্তরে জ্ঞানকে সম্মান করতেন)। একইভাবে দৃষ্টিকটু ব্যাপারগুলো যাতে দৃষ্টিগোচর না হয় (কারণ সেগুলো দৃষ্টিকটু) সেজন্য প্রচলিত ছিল, “উল্টো করে জুতা রাখলে অমঙ্গল হয়” কিংবা “ঘর থেকে বের হতে ঝাড়ু দেখলে অমঙ্গল হয়” ইত্যাদি। যার ফলে মানুষ এই সকল দৃষ্টিকটু ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলতো, জীবন হতো মার্জিত, সমাজ হতো মার্জিত।

শুধু যে মার্জিত আর রুচিসম্পন্ন জীবন-যাপনের জন্যই এই সকল ‘কুসংস্কার’ নামক ‘সংস্কার’-এর প্রচলন হয়েছিল, এটাও ঠিক নয়। আমি এমন সব ব্যক্তির অভিজ্ঞতা শুনেছি, যারা মুরব্বিদের সামনে বসে খাবার সময় মাছের কাটা বা অন্য কোনো বস্তু আঙ্গুল দিয়ে প্লেটের কিনারে মুছে রাখলে মুরব্বিরা তাতে চটে যেতেন, এমনকি ব্যাপারটা নিয়ে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিতেন। খেয়াল করে দেখুন তো, বেশিরভাগ মানুষ খাবার পাত্রটির উপরের অংশই শুধু ধুয়ে থাকেন, নিচের অংশটি ধোয়ার প্রয়োজন মনে করেন না (এটা অধিকাংশ মানুষের অভ্যাস, আপনার এই কুঅভ্যাস না থাকলে খুব ভালো)। সেক্ষেত্রে মানুষকে (না ধোয়া) প্লেটের নিচের ময়লাটুকু থেকে বাঁচিয়ে রাখতে এই কুসংস্কারের প্রচলন হয়েছিল।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি থাকেনা যে, ‘কুসংস্কার’ বলে অবহেলা করা বিষয়গুলো সত্যিকার অর্থে ‘সংস্কারেরই’ নামান্তর। তবে এটাও সত্য যে, এইসব কুসংস্কার নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাও বোকামি; বরং কুসংস্কারকে সংস্কার মনে করে তা ‘বাছাই করে’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পালন করা উচিত। বাছাই করার প্রসঙ্গ আসছে, কারণ বর্তমান বিজ্ঞান কিছু কিছু কুসংস্কারকে সত্যিকার অর্থেই বাহুল্য প্রমাণ করেছে। যেমন: “জন্ডিজ হলে হলুদ বা হলুদ রঙের খাবার খাওয়া যাবে না।” অথচ বিজ্ঞান বলছে, জন্ডিজ বাড়া-কমার সাথে হলুদ বা হলুদ রঙের কোনো যোগই নেই।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’ তাই কুসংস্কার থেকে সংস্কারটুকু আমাদের মেনে নেয়াই উচিত, কারণ তা-তো আমাদের পরোক্ষভাবে ভালোই করছে। আর নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, নাকি?

-মঈনুল ইসলাম

_____________
লেখাটি ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর রামপুরার বাসায় বসে লিখেছিলাম।

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

2 thoughts on “কুসংস্কারের সংস্কার”

মন্তব্য করুন