ধারাবাহিক: বাংলা উইকিপিডিয়ায় লেখালেখি —এর একটি পর্ব
বাংলা উইকিপিডিয়ায় লেখালেখি’র প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম কেন লিখব? দ্বিতীয় পর্বে দেখেছিলাম কিভাবে লিখব? আর আজকে দেখব, কিভাবে লিখতে গিয়ে কী শিক্ষাটাই না পেয়েছিলাম… মূল লেখাটি সচলায়তনে প্রকাশিত^ হলেও আবার উদ্ধৃত করা দ্বিরুক্তি হবে না বলে মনে করছি।
কিছুদিন আগে, এই ১২ জুলাই ২০১০, নিউইয়র্ক টাইম্সে বাংলা উইকিপিডিয়ার নীতিগত দৃঢ়তা বেশ পোক্তভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে^। তার পরই গতকাল, ১৩ জুলাই, কলকাতার দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে^। তাই বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসকদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েই শুরু করছি।
উইকিপিডিয়ায় যখন লেখালেখি শুরু করলাম, বেশ ভালোই এগোচ্ছিল। হঠাৎ করে একদিন দেখলাম আমার তৈরি করা একটা নিবন্ধ “দ্রুত অপসারণের নীতি” (উইকিপিডিয়া:দ্রুত অপসারণের বিচারধারা^) অনুযায়ী মুছে ফেলা হয়েছে, আর-একটা লেখায় “উল্লেখযোগ্যতা” নামে একটা বাক্স দেখা যাচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে: যে ব্যক্তিকে আমি তুলে ধরেছি, উইকিপিডিয়ার হিসাবে তিনি ঠিক [উল্লেখ]যোগ্য নন।
আমার তো মাথা ঘুরে গেলো। এতো নামি-দামি একজন ব্যক্তি, অথচ এরা বলে কিনা, এখানে স্থান হবার নয়? ব্যস, শুরু হলো তর্কালোচনা।
তবে যারা আমার সাথে তর্কে লিপ্ত হলেন, দেখা গেলো, তারা তাদের দাবির পক্ষে যেসব নিয়ম-কানুন এনে হাজির করছেন, সেগুলো ঠিক ফেলে দেবার নয়। কারণ, তারা উইকিপিডিয়ার “উল্লেখযোগ্যতার নীতি^” নামক একটা নীতি এনে হাজির করলেন। পড়ে দেখলাম, সত্যিইতো। উইকিপিডিয়া কিছু নিয়ম-কানুন বানিয়েছে, যার সুবাদে আপনি যে-কারো সম্বন্ধে নিবন্ধ সেখানে বসিয়ে দিতে পারবেন না। আপনাকে উপযুক্ত তথ্যসূত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, আপনার বিষয়বস্তু উইকিপিডিয়ার ঐসব নিয়মকানুন মানছে, এবং নিবন্ধের বিষয়বস্তু উইকিপিডিয়ার উল্লেখযোগ্যতার নীতি অনুযায়ী উল্লেখ করার মতো যোগ্য বা উল্লেখযোগ্য।
পড়লাম মহা ঝামেলায়। গুগল ঘেঁটে ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে যা পারলাম, যোগ করতে থাকলাম। কিন্তু তবু তাদের তৃপ্তি মিটে না। এবারে তারা হাজির করলেন “উল্লেখযোগ্যতার নীতি (ব্যক্তি)^“। পড়ে দেখলাম আসলেও তো, এগুলো দিয়েও ঐ ব্যক্তিকে ঠিক উল্লেখযোগ্য বলে প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
এছাড়া আরো কিছু নিয়ম-কানুন এসে হাজির হলো যেগুলো পড়ে জানলাম, উইকিপিডিয়াতে তথ্যসূত্র হিসেবে কোনো ব্লগ, ফোরাম ইত্যাদির লিংক দেয়া যাবে না। এমনিতেই বাংলা ভাষায় ভালো ওয়েবসাইট নেই, যা আছে, সেগুলো ফোরাম আর ব্লগ- এতো এতো তথ্য তাহলে আমি কোথা থেকে এনে হাজির করবো?
তারা তখন এককথায় বলে দিলেন: এর দায় উইকিপিডিয়ার নয়। কড়া কথা তো!
এবারে আমি প্রশ্নের সম্মুখিন হলাম, “উপযুক্ত তথ্যসূত্র” কথাটা আসলে কী বোঝাচ্ছে? তর্কের মাধ্যমে যা জানলাম, সেটা একটু অন্যভাবে বলি: ধরা যাক, আজকে জনাব হযবরল, আইনস্টাইনের সূত্রকে ভুল প্রমাণ করলেন। সেই খবর দিলেন একটা পত্রিকাকে। পত্রিকাওয়ালার দরকার খবর, তাই সে খুব আগ্রহের সাথে হযবরল’র যাবতীয় কথাবার্তা পরদিনের পত্রিকায় ছাপিয়ে দিলো। এখন একজন সাধারণ উইকিপিডিয়ান লেখাটা পড়ে দেখলেন, আরে, বাংলাদেশের এমনও মাথা আছে! একে তো সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। সাথে সাথে উনি “হযবরল”র নামে একটা নিবন্ধ তৈরি করে ফেললেন। এখন গুগলে হযবরল নামে সার্চ করলে উইকিপিডিয়ার ঐ নিবন্ধ দেখা যায়।
ওদিকে, বিজ্ঞানীরা সেটা পড়ে দেখলেন, আরে, এ-তো গাজাখুরি গল্প ফেঁদেছে। এই ব্যক্তি যে সূত্রের ভিত্তিতে থিওরি অফ রিলেটিভিটির সূত্রকে ভুল প্রমাণ করেছে, সেটা বহু আগেই আইনস্টাইন নিজেই ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। ঐ সূত্র দিয়ে কখনোই থিওরি অফ রিলেটিভিটিকে ভুল প্রমাণ করা যায় না। পরদিনের পত্রিকায় এব্যাপারে একটা ছোট্ট প্রেস রিলিয বেরোল যে, ব্যাপারটা ভুল। হযবরল তার হিসাবে ভুল করেছেন।
এক খবরে হিট, পরের খবরেই সুপার-ডুপার ফ্লপ।
এখন আপনিই বলুন, ঐ “হযবরল” নামের ব্যক্তি সম্বন্ধে নিবন্ধ রাখা কি ঠিক হবে? …তাই এই এতো ঝামেলা না করে, আগেভাগেই যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঐ ব্যক্তি এই-এই সূত্রের ভিত্তিতে সত্যিই উল্লেখযোগ্য, তাহলে আর ঝামেলা থাকে না। সেক্ষেত্রে আমরা ১টা সূত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নিবন্ধ শুরু করবো না। আমরা চেষ্টা করবো অনেকগুলো তথ্য-উৎস হাজির করে ঐ ব্যাপারটাকে বা ঐ ব্যক্তিকে সঠিক ও উল্লেখযোগ্য প্রমাণ করতে। নিবন্ধ শুরু করার আগে নিজেই যাচাই করে নিব সেটি উল্লেখযোগ্য কিনা।
আমাদের এই পুরো আলোচনাটি পাওয়া যাবে এখানে^। আলোচনাটি আমার জন্য ছিল ধাক্কা, কিন্তু আপনাদের জন্য হবে শুরুতেই শিক্ষা।
আপনারা যারা সচলায়তনে “মুসা ইব্রাহীম”-এর এভারেস্ট জয় বিষয়ে সত্য-উদ্ঘাটনের টানাপোড়েন দেখেছেন এবং দেখছেন, তারা ব্যাপারটা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। মুসা ইব্রাহীম সম্বন্ধে উইকিপিডিয়ায় একটা নিবন্ধ^ খোলা হয়েছে, কিন্তু… সেখানে নানা প্রশ্নের কারণে সেটা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। নিবন্ধটির আলাপ পাতায় গেলে আলাপটাও দেখতে পারবেন। সেখান থেকে সচলায়তনের লিংকটা নিয়ে এসে যখন মন্তব্যগুলো পড়বেন, তখন বুঝে যাবেন, কিভাবে একজন ব্যক্তিকে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ করতে হয়। আর এতে তৃতীয় পক্ষের দেয়া সূত্র কতটা জরুরি।
এতো এতো ঝামেলা যারা বুঝতে চান না, তারা শ্রেফ যে কাজটা করতে পারেন, সেটা হলো আগে থেকে যেসব নিবন্ধ আছে, সেগুলোতে তথ্য যোগ করতে পারেন। কাজটা খুব সোজা: তথ্যসূত্র দিবেন, তথ্য যোগ করবেন। এতটুকুও যাদের করতে ইচ্ছে হয়না, তারা আরো সহজ একটা কাজ করতে পারেন: ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো ধরে ধরে বাংলায় অনুবাদ করতে পারেন। খুব সোজা।
এবারে কয়েকটা টিপ্স দেই, আপনাদের কাজে লাগবে:
- যেকোনো নিবন্ধ লিখতে থাকার সময় নতুন করে যেগুলো লিখছেন, সেগুলো একটু পরপর নিজের কম্পিউটারে একটা ওয়ার্ড ফাইল খুলে সেভ করে রাখতে পারেন। এতে, বিদ্যুৎ চলে গেলেও আপনার পরিশ্রম বৃথা যাবে না।
- উইকিপিডিয়া একটা অফলাইন মিডিয়া। যেমন: ফেসবুকে এইমাত্র যে মন্তব্যটা হয়েছে, সেটার নোটিফিকেশন বা সংবাদ আপনি সাথে সাথে দেখতে পারেন, উইকিপিডিয়ায় তেমনটা হয় না। তাই আপনার জন্য কোনো বার্তা কেউ রাখলে, সেটা সম্পর্কে খবর পাবেন তখনই, যখন আপনি ঐ পাতাটি রিফ্রেশ করবেন, কিংবা নতুন পাতা খুলবেন।
- লেখা শেষ করে একবার প্রাকপ্রদর্শন (preview) দেখে নিতে পারেন। তবে প্রাকপ্রদর্শন বা সংরক্ষণ করুন -এই দুটো বোতামে ক্লিক করার আগ-মুহূর্তে আপনার সম্পাদনা করা পুরো লেখাটি সিলেক্ট করে (ctrl+a) দিয়ে কপি (ctrl+c) করে নিন। কারণ অনেক সময়ই ব্রাউযার উল্টা-পাল্টা করে, কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ গন্ডগোল পাকায়। তখন সেটা সেভ না হয়ে দেখায়: সার্ভার পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আপনি পেছনের পাতায় চলে আসতে পারলেও আপনার সম্পাদনা করা লেখাগুলো দেখতে পাবেন না। ঐ সময় আপনার কাজে আসবে ঐ কপি করে রাখা লেখাগুলো। আবার পেস্ট করে নিলেই আগের অবস্থা। 🙂
- আলোচনার দ্বার সব সময় খোলা। আপনি যদি একটা এ্যাকাউন্ট তৈরি করে নেন, তাহলে আপনার একটা আলাদা আলাপ পাতা তৈরি হবে। ঐ পাতায় আপনি চাইলেই যেকোনো সময় প্রয়োজনীয় বার্তা লিখে রাখতে পারবেন। কিংবা সাহায্যের দরকার হলে সাথে সাথে সেখানে {{সাহায্য করুন}} কথাটি লিখে আপনার সমস্যাটি লিখলে এক/একাধিক উইকিপিডিয়ান আপনার সহায়তায় এগিয়ে আসবেন।
- সব নিয়ম-কানুন তো আর শিখে যাচ্ছেন না, তাই trial and error পদ্ধতিটা আপনার পাথেয়। সেখানেও কাজটা আরো সহজ হয়ে যাবে, যদি আপনি একটা সহজ চোরাই বুদ্ধি কাজে লাগান। কোনো নিবন্ধে গিয়ে একটা ফিচার বা সেটার সাজানো ধরণ-ধারণ আপনার ভালো লাগলো (ইংরেজি কিংবা বাংলা), ঐ পাতাটাকে “সম্পাদনা” মোডে নিয়ে গেলেই আপনি ওটার ভিতরের সব রহস্য পেয়ে গেলেন। তখন ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে পারবেন, ঐ সম্পাদনাটা করতে হলে আপনাকে কোন কাজটা করতে হবে। ব্যস, শিখে গেলেন।
- দরকারি কিছু কিছু নতুন বিষয় আপনি কপি করে আপনার ডেস্কটপে ওয়ার্ড ফাইলে রেখে দিন, বারবার ব্যবহার করুন।
- যেকোনো বিষয়েই আলোচনা করুন। আলোচনা আপনার অনেক কাজকে সহজ করে দিবে।
উইকিপিডিয়া একটা নেশা। আপনি যেভাবে ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেন, সচলায়তনের মতো ব্লগে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেন, মজার ব্যাপার হলো, উইকিপিডিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দেয়ার মতোও অনেকে আছে। মজা না পেলে কি তারা তা করতো? উইকিপিডিয়ায় আপনি কাজ করতে করতেই বিনামূল্যে যে ব্যাপারগুলো পাবেন, সেগুলো হলো: সহায়তামূলক ও সেবামূলক মনোভাব; বিনামূল্যে জ্ঞান; পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ; লেখালেখির জ্ঞান ও দক্ষতা; অনেক মানুষের সাথে উঠ-বস করার আর অনেক রকম বিতিকিচ্ছিরি কিংবা আকর্ষণীয় জগত দেখার, যা আপনি ফেসবুক কিংবা টুইটারে দেখতে পাবেন না।
তাহলে আর দেরি কেন? ঝাঁপিয়ে পড়ুন। সেখানে, আপনাকে একা জোয়াল বইতে হবে না, কল্পনাও করতে পারবেন না, আপনাকে সহায়তা করার জন্য কতজন সেখানে অপেক্ষা করছেন। শুধু একটু “শুরু” করে দিন।
ফ্রান্সিস বেকনের “নোভাম ওরগ্যানাম” থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি:
It would be an unsound fancy and self-contradictory to expect that things which have never yet been done can be done except by means which have never yet been tried.
কথাটাকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়:
যে কাজটি কখনও করা হয়নি, সে কাজটি [আপনাআপনি] হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা অযৌক্তিক কল্পনা আর আত্ম-সাংঘর্ষিক হবে, যদিনা সেই কাজটি করার জন্য ইতোমধ্যে প্রচেষ্ঠাই না চালানো হয়।
উইকিযুদ্ধ!
যুদ্ধটা কেউ না কেউ এগিয়ে নিবেই।
না বন্ধু, যুদ্ধটা ‘আমাকে’ই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে…
-মঈনুল ইসলাম