ধারাবাহিক: তেঁতুলিয়া ভ্রমণ —এর একটি পর্ব
আমরা সাড়ে চারশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যে বাংলোয় থাকার নিশ্চিত অভিপ্রায়ে এসেছি এই সর্বদক্ষিণের উপজেলা তেঁতুলিয়ায়, সেই বাংলোর গেটে দাঁড়িয়ে নির্বিকারভাবে কেয়ারটেকার বলছে: ‘আমাকে তো কিছু জানাননি ইউএনও সাহেব।’ আরেফিনের কপাল কুঁচকে গেল, কোঁচকালো আমাদেরও। সাথে সাথে আরেফিন ফোন করলো ইউএনও-কে। নেতা বলে কথা, পরিচয় দিয়ে ফোনটা ধরিয়ে দিলো কেয়ারটেকারের কানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুলে গেল গেট: ভিআইপি মর্যাদায় আমরা ঢুকে পড়লাম সরকারি সুবিধার ছায়াতলে। তা-ইতো হবার কথা: আরেফিন, বাস ছাড়ার সাথে সাথে আরেকবার কথা বলে নিয়েছিল রাতে, ইউএনও’র সাথে। মনে মনে হাফ ছাড়লাম আমি, আরেকটু হলেই ভেস্তে যেত সাধের বাংলো-বাস।
‘ডাকবাংলো’ নামে কেন যেন সরকারি এসব রেস্টহাউজগুলোকে ডাকা হয় সেটা জানা যাক: আমি লক্ষ করেছি, কোনো জায়গারই স্থানীয়দের মুখে এই শব্দটি শোনা যায় না, বরং যেটা শোনা যায়, সেটা হলো ‘ডাকবাংলা’, সিলেটেও যেমন সত্যি, এই তেঁতুলিয়ায়ও এর ব্যতিক্রম দেখিনি। ‘বাংলো’ (bungalow) যদিও অবশ্য ইংরেজি শব্দ; অর্থ: ছোট্ট বাড়ি, যার সাধারণত বড় একটা বারান্দা থাকে আর হয় একতলাবিশিষ্ট। তবে জেনে রাখা ভালো, এই ভারতবর্ষে এসেই হিন্দী ভাষার ‘বাংলা’ বাড়ি থেকে ব্রিটিশরা এই ‘বাংলো’ শব্দটি বানিয়ে নিয়েছে। খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম: ‘ডাক’বাহী ঘোড়া আর আরোহীর বিশ্রাম আর রাত্রীযাপনের জন্য বানানো হতো এসব বাংলো, যা পরে সরকারি বিশ্রামাগার হিসেবে বেশি বানানো হতো।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো কিন্তু বহু আগের, প্রায় তিনশ’ বছরের পুরোন। এর অবস্থানটা আকর্ষণীয়: ঐ যে দেখা যাচ্ছে ভারত-সীমান্ত, মাঝখানে ভারতের কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নেমে আসা মহানন্দা নদী, আর এই টিলায় ডাকবাংলোটা। এই সমতল এলাকায় টিলা পাওয়াও দুষ্কর, তবু ডাকবাংলোটা একটা টিলায়। ডাকবাংলোর একদিকে নদী, আরেক দিকে বাংলাবান্ধা-তেঁতুলিয়া প্রধান সড়ক। আর অন্য পাশে পিকনিক কর্ণার, তাও ১৯৮৬’র সময়কার। অপূর্ব এই ডাকবাংলো দেখেই মনটা জুড়িয়ে যায় আমাদের। তখনই মনে হয়, এই ট্যুরটা সফল হয়েছে।
কেয়ারটেকার আমাদেরকে বাংলোর ভিআইপি রুমটা দিতে চায়নি, কিন্তু পাশের রুমটাতে আজকে দুপুরে এক সাংবাদিক সস্ত্রীক বেড়াতে আসবেন, দুপুরে খাবেন। তাই আপাতত আমাদেরকে ভিআইপি রুমটাতে থাকতে দেয়া হলো, রাতে দুটো রুমই আমরা পাবো। পরে জানলাম, ভিআইপি রুমটা ঐতিহাসিক, কারণ এই রুমে বাংলাদেশের সব প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপ্রধানরা একরাত হলেও থেকে গেছেন (কে জানে কতটুকু সত্যি!)।
তিনশ’ বছরের পুরোন ডাকবাংলোর নকশায়ও সেরকম ছাপ আছে: রুমগুলো যতটা বড়, তার প্রায় দ্বিগুণ বেশি উঁচু। দুটো কক্ষেই দুটো ডাবল খাট, খাট অবশ্য মেসের মতো। ভিআইপি রুমে আছে এসি, টাইল্স করা বিশাল টয়লেটে আছে উষ্ণজলের গিযারও। পুরো ডাকবাংলোর নকশাটা এরকম: একটা গাড়ি বারান্দা, তার ডান দিকে গেট দিয়ে ঢুকে একটা করিডোর, করিডোর ধরে বাম দিকে প্রথম কক্ষটা হলো ডায়নিং, তারপর একটা কক্ষ, তারপর ভিআইপি কক্ষ। ডান দিকে একটা বাড়তি বাংলো-বারান্দা, সেখানে সোফা পাতা। এখানে দাঁড়ালে সামনেই মহানন্দা নদী, আর ঐ তো ভারতের চা বাগান দেখা যাচ্ছে। বাংলোর সীমানার ভিতরে আছে ফুলের বাগান। আছে বিশাল গাছ, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি সৌধ, যাতে শামসুর রাহমানের “স্বাধীনতা তুমি” কবিতাটি মর্মরে গাঁথা।
আমরা দ্রুতই ব্যাগ রেখে মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ার তাগাদা অনুভব করলাম, কারণ শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য খুবই কম, দিনের আলো না থাকলে দৃশ্য দেখে শান্তি পাওয়া যাবে না। তাছাড়া নাস্তাও করা হয়নি। যে ভ্যানওয়ালারা আমাদেরকে নিয়ে এসেছিল, তারা অর্থের উৎস আছে বলে তখনও দাঁড়িয়েছিল ওখানে। আমাদেরকে নিয়ে চললো আবার তেঁতুলিয়া বাজারে।
বাজারে গিয়ে এ রেস্তোরাঁ ও রেস্তোরাঁ ঘুরে যখন জানা গেল নাস্তা নেই, তখন ঘড়ি দেখার হুঁশ হলো, তাকিয়ে দেখি এগারোটা বেজে গেছে। নাস্তা থাকবে কোত্থেকে? কে যেন প্রস্তাব করলো, তাহলে এক কাজ করি ভাতই খাই। তাই দামদর জেনে নিয়ে ভাতের অর্ডার দেয়া হলো। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সাতজনের বিশাল গ্রুপকে স্থান দেয়ার মতো টেবিল খালি নেই দেখে আমাদের স্থান হলো “মহিলা কেবিন”-এ। মহিলা কেবিনের ছবি তুলছি দেখে নাকিব আবার দাঁতে রুমাল আটকে ছাইয়্যাঁ মার্কা একটা পোযও দিয়ে দিলো। যাহোক এবার খাবার পালা …কেউ মাছ খাবে, কেউ খাবে খাসি। খাওয়া শেষে সবাই দিল তৃপ্তির একটা হাসি। আমি লজিক দিয়ে বুঝালাম এগুলো নয় বাসি। এবার তাহলে একটু চা খেতে বসি।
গ্লাসের মধ্যে ধুমায়িত চা যখন এলো তখন দেখতে তেমন একটা ভালো না লাগলেও মুখে দিয়ে বেশ তৃপ্তিসহকারেই চা খেয়ে পুরো চাঙা হয়ে গেলাম। হোটেলে মিষ্টি সাজানো দেখে কারো কারো লোভ জাগলো মিষ্টি খাবে। একজন খেলো তো খাবার জোয়ার উঠলো। এর মধ্যে বিল বাড়িয়ে দিল কেউ একজন দুটো চমচম খেয়ে। কী আর করা, খাবার বিল এলো সাকুল্যে ৳৬০০ (জনপ্রতি পড়লো ৳৮৬ করে)। খাওয়া-দাওয়া শেষ, এবারে “মাহিলা”দের উঠে পড়ার পালা।
কিন্তু শাকিলকে দেখা গেল পিচ্চি বেয়ারাটার সাথে কী যেন কথা চলছে। কান পাততে শোনা গেল, এই তুই কি যাবি ঢাকায় ফ্যাক্ট্রিতে কাজ করতে? আমার ২০ জন লোক দরকার। পিচ্চিও লোভে পড়েছে, দেনা-পাওনার হিসাব না করেই তৎক্ষণাৎ রাজি। শুধু রাজিই না, দেখা গেল বাকি বেয়ারাগুলোকেও বাগাতে চলে গেল। এদিকে আমরা তো হা করে তাকিয়ে আছি, এই ব্যাটা শাকিল আদমব্যাপারি হলো কবে?
আরেফিন তো হেসে বাঁচে না, ব্যাটা তুই তেঁতুলিয়া থেকে লোক নিয়ে যাবি পুরান ঢাকায় কাজ করাতে? শাকিল কিন্তু সিরিয়াস। সে বেশ ঘটা করেই পিচ্চির সাথে দেনদরবার করছে। শেষে জোর করেই আদমব্যাপারিকে নিবৃত্ত করতে হলো: তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? শাকিলের এই কান্ড দেখে বাকিরা তো হেসে বাঁচে না। এযাত্রা শাকিলকে নিবৃত্ত করা গেলেও বেচারার নাম আর ‘শাকিল’ রইলো না, হয়ে গেলো ‘আদমব্যাপারি’।
রেস্তোরাঁ থেকে যখন সবাই বেরোলাম, তখন ভ্যানওয়ালাদের একজন এগিয়ে এসে জানালো, রেন্ট-এ-কারে কোনো গাড়ি নেই। একটা আছে, কিন্তু ওটার ট্রিপ আছে। সন্দেহ হলো আমার, ভাড়া হাতানোর ভালো ফন্দি হয়েছে। নেতাকে বলতেই নেতা নির্দেশ দিলো সার্চপার্টির। নাকিব আমি আর শাকিল গিয়ে একটা গা এলিয়ে দেয়া মাইক্রোবাস পেয়ে গেলাম বাজারেই। তাকে আমাদের উদ্দেশ্য জানালাম: বাংলাবান্ধা বর্ডার, চা বাগান, কমলা বাগান এগুলো দেখিয়ে নিয়ে আসবে, কত নিবে। সে জানালো ৳৪০০০।
শাকিলকে ড্রাইভারের সাথে আলাপ চালিয়ে যেতে বলে নাকিব আমায় ডাকলো নেতার কাছে। নেতা আরেফিন বললো, বেশি মনে হচ্ছে। আমাদের বিকল্পটা খতিয়ে দেখা দরকার। ফিরে এসে শাকিলকে যখন নিতে চাইলাম, তখন ড্রাইভার, ঢাকায় আমাদের বাসা কোথায় জানতে চাইলো। মনে মনে হাসলাম, ব্যাটা আশা করছে সব গুলশান-বনানীর ধনীর দুলালেরা এসেছে, তাই এক দাও মারা যাবে। তাকে নিরাশ করে ফিরে এলাম আমরা।
ফিরে এলাম ভ্যানের কাছে। সেখানে তারা পরামর্শ দিলো ‘অটো’ আছে বাজারের মাথায়, অটো মানে ঈযিবাইক (কেউ ডাকে টমটম, কেউ ডাকে ব্যাটারি)। অটো নিয়ে চলে যান, তারপর ফিরে এসে বিকালে তারা আমাদেরকে বাকি স্পটগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। তাদের লাভ, এই পরামর্শের বদলে আমাদের আস্থা ক্রয় করা, যাতে বিকালে তাদেরকে আমরা আবার ভাড়া করি। তাই, আমাদেরকে দেখলে অটো, ভাড়া বেশি চাইবে বলে তাদেরই একজন গেলো অটো ভাড়া করে দিতে।
যাহোক, ৳৩০০ দিয়ে তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা-তেঁতুলিয়া যাত্রার গতি হলো বলে সবাই লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। আমি, ড্রাইভারের ডান দিকে, আরেফিন বায়ে, পিছনে দুই সারিতে চারজনের আসনে গাদাগাদি করে বাকি পাঁচজন। অটো যে গতিতে যাত্রা শুরু করলো, তাতে বোঝাই গেল, অনেকটা সময় খেয়ে ফেলবে।
যাত্রা হলো শুরু। শ্লথ গতিতে চলছে অটো, আর তাই আমার ক্যামেরাও চলছে। পাকা ধানে হলুদ হয়ে আছে রাস্তার দুপাশ। যতদূর চোখ যায়, হলুদ পাকা ধানে মাঠ সয়লাব। সত্যিই মনে হলো আমার বাংলা সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা…। বায়ে বয়ে চলেছে মহানন্দা, ওপারে ভারত, এদিকে বাংলাদেশের ভূখন্ডে ধান আর ধান। স্থানীয় কৃষিজীবি পরিবারগুলো সদ্য সমাপ্ত রাস্তাকে ধান শুকানোর ভালো উঠান বানিয়ে নিয়েছে। মহিলারা, বাড়ির মেয়েরা ধান নেড়ে দিচ্ছে রাস্তায়। ট্রাক্টর দিয়ে ধান আনা হচ্ছে। ধান নিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ এখানে।
ধানের সাথে আরো যে জিনিসটা আছে বরাবরের মতোই, তা হলো পাথর। রাস্তার পাশে, এখানে-ওখানে পাথর আর পাথর স্তুপ করে রাখা। …পাকা রাস্তা ধরে দূরে তাকালে দেখা যাবে রাস্তায় তীব্র রোদ পড়ে তৈরি করেছে মরিচীকা। এতো রোদসত্ত্বেয় আমার গায়ে শীত ঠেকানো জ্যাকেট। কারণ নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে আমার আক্কেল হয়েছে, অটো’র সামনে বসে শীতে গলা বসিয়ে ফেলেছিলাম- এবার আর সে ভুল করতে চাইনে।
এদিকে পাখির খুব একটা বৈচিত্র্য চোখে পড়ছে না আমার। শালিক আর শালিকে ভরা। ধান যেখানে বেশি জন্মে সেখানে ধানশালিক থাকবে এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কিন্তু আর অন্যান্য জাতের পাখি থাকবে না কেন- এই প্রশ্নটা আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাই ধানশালিককে মডেল বানিয়ে প্রশান্তি নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করছি।
(মজার ব্যাপার হলো ‘ধানশালিক’ নামে শালিকের কোনো জাত খুঁজে পেলাম না। সম্ভবত এগুলো সব ‘ভাতশালিক’। যাহোক, আপাতত ধানশালিকই সই, শিঘ্রই এগুলো উইকিপিডিয়াতে আপলোড করে পাখি বিশেষজ্ঞের সহায়তায় শ্রেণীবদ্ধ করা হবে এবং এই ব্লগসহ নিশাচর-এর ফেসবুক পেজে^ আপডেট জানানো হবে, ইনশাল্লাহ)
রণচন্ডী বাজার পার হলাম আমরা। ধানের ক্ষেত ছাড়াও উত্তরবঙ্গে আরেকটা ক্ষেত নজরে এলো, তা হলো আখ (সিলেটে আমরা বলি ‘কুইয়ার’, পঞ্চগড়ে বলে ‘কুষার’)। ঢাকায় ফিরে দৈনিক প্রথম আলোতে সৌরভ মাহমুদের লেখা পড়ে জানতে পারলাম, ঐ আখ ক্ষেতে নাকি বাস করে এক বিরল প্রজাতির স্থায়ী পাখি: দাগি নাটাবটের; দেখতে অনেকটা তিতিরের মতো (ছবিতে যেমনটা দেখলাম আরকি)।গ্রামের মানুষদের কৃষিজীবি গেরস্ত জীবনকে আরো সহজে চেনা যায় এখানে-ওখানে গোবর-কাঠি দেখে। গোবর-কাঠি হলো কাঠের মধ্যে গোবর মেখে রোদে শুকিয়ে জ্বালানী উপকরণ বানানোর গ্রামীণ পন্থা। এদিকটায় এখনও খাঁটি গ্রাম-বাংলার দেখা পাওয়া যায় – এই ভ্রমণে এটা সত্যিই আমার একটা পাওয়া। এভাবেই আমরা তিরনই হাট পার হলাম।
অটো’র ড্রাইভারের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। নাম জানলাম ‘হানিফ’। হোয়াট আ কোইনসিডেন্স! আমরা কিন্তু হানিফ বাসেই এসেছি। তিনি জানালেন আর ক’দিন পরে এখানকার শীতের প্রকোপ কতটা মারাত্মক হবে। সারাদিন কুয়াশা, সারাদিন গায়ে শীত-পোষাক, হীম ঠান্ডা, গাড়ি চালানো বিশেষ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানকার আরো কয়েকটা দর্শনীয় স্থান, যেমন: বুড়াবুড়ি নামক স্থানে দূর্গের ধ্বংসাবশেষ; গ্রিক স্থাপত্যনিদর্শন ভদ্রেশ্বর মন্দির, শিব মন্দির ইত্যাদি দেখতে হলে কী করা যায়। হানিফ সাহেব জানালেন, ওটা অন্য পথ। আমি গো ধরলাম, আমরা ফেরার পথে ওদিক হয়ে তেঁতুলিয়া গেলে কি হয় না? হানিফ সাহেব ‘হ্যা’ বললেও, আমার বারবার পিড়াপিড়িসত্ত্বেয় ওমুখ হতে রাজি হলেন না। কারণ ফ্যাক্ট ১: অটো’র জন্য এই দূরত্বটা একটু বেশি রকম ‘বেশি’ হবে। আর ফ্যাক্ট ২: বেচারা ভাবছে ৩০০ টাকায় রথ-দেখা-কলা-বেঁচা হতে দিলে তো যে লাভের দাও মারতে এসেছিল, সেটা ক্ষতিতে পর্যবসিত হবে।
এমন সময় সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনাটি ঘটলো: পিছন থেকে একটা সাইকেল সাঁই সাঁই করে আমাদেরকে পাশ কাটালো। হাসতে হাসতে বাঁচি না আমরা: শালার এমন একটা মোটরচালিত গাড়িতে উঠেছি, যে সাইকেলের সাথে পারছে না। মিস্টার বিনের ঐ মুভিটার কথা মনে পড়ছে, যেখানে বিন, চুরি করা মোটরবাইক নিয়ে পালাচ্ছে, আর মালিক হেঁটে ওটার পাশ ধরে হাঁটছে। ভাবগতিক ভালো না দেখে শেষে বাইক থামাতে বাধ্য হয় বিন।
পাশে একটা জামে মসজিদ পার করে যাচ্ছি আমরা: একটু পরেই জুমা’র নামায। হাতে সময় কম, এর ভিতরে বাংলাবান্ধা গিয়ে এসে নামায পাবো তো? আরেফিন বললো, দেরি আছে, আপনি চলেন। ব্যস, আমরা ফিরে এসে নামায পাবো- এমন হিসাবেই চললাম সীমান্তে। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা এখন টিউবওয়েলের একেবারে মাথায় এগোচ্ছি। যতই এগোচ্ছি, দুদিক থেকে ভারত সীমান্ত চেপে আসছে আমাদের দিকে। সামনে এমন হলো, মাঝখানের রাস্তাটা চলছে, ডানে-বামে ভারত সীমান্ত-পিলার।
এখানে ওখানে পাথর আর ট্রাকে পাথর বোঝাই করার দৃশ্য দেখতে দেখতে বিরক্তি এসে যাচ্ছে। তবে একটা ব্যাপার মজার: পাথরের ট্রাকগুলোর রেইলিং হয় বেশ উঁচু, তাই নিচ থেকে ওগুলোতে পাথর তোলা বেশ কষ্টসাধ্য। এজন্য পাথর তোলার পদ্ধতিটা হলো ছুঁড়ে দেয়া। বেলচার মধ্যে পাথর নিয়ে কর্মীরা আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে, তাতে পাথর গিয়ে পড়ে ট্রাকের ভিতরে। দৃশ্যটা আমার কাছে মজাই লাগলো।
এভাবেই পার করলাম সিপাইপাড়া বাজার। একটু সামনে যেতেই বিডিআর চেকপোস্ট। হানিফ সাহেব চলমান অবস্থায়ই ‘সামনে যাই?’ বলে প্রহরারত সৈনিকের অনুমতি চাইলে হাত ইশারায় সৈনিকের অনুমতি মিললো। সামনে গিয়ে একটি তোরণ, এখানেই অটো রাখলেন আমাদের হানিফ সাহেব। আমাদেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, মামা আপনারা কষ্ট করে একটু হেঁটে গিয়ে দেখে আসেন। বুঝলাম, হয়তো বেচারার সিকিউরিটি প্রবলেম, আমরা নেমে হাঁটা ধরলাম।
একটু জায়গা, এরপরই বাংলাবান্ধা-ভারত সীমান্ত। গত ফেব্রুয়ারিতে তামাবিল সীমান্তে গিয়েছিলাম, এপারে বাংলাদেশ, আর ঐতো ওপারে ভারত। এখানেও একই দৃশ্য: এটা বাংলাদেশ, আর ঐ-যে ভারত (ভারতের ফুলবাড়ী)। এখানটায় একটা টিনের দোচালা ঘরের উপর লেখা:
Govt. of the People’s Republic of Bangladesh
Banglabandha Land Customs Station
Panchagarh, Bangladesh
ভিতরে বিডিআর-এর ক্যাম্প। বাইরে চেয়ারে বসে আছেন তিনজন বিডিআর জোয়ান- অস্ত্রশস্ত্রে পুরোদস্তুর রণসাজে সজ্জিত। তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম তাঁরা স্থানীয় নাকি বিভিন্ন জায়গা থেকে পোস্টিং-এ এসেছেন। জানালেন স্থানীয় না। নিজেদের এলাকার নামও বললেন, কিন্তু এখন আর মনে নেই।
এখানেই একটা খোলা বইয়ের মতো মাইল ফলক লাগানো, যার এপ্রান্তে লেখা:
বাংলাবান্ধা ০০ কি:মি:
আর ওপ্রান্তে লেখা:
[রাজধানী] ঢাকা ৫০৩ কি:মি:
[বাংলাদেশের দক্ষিণ স্থল-প্রান্ত] টেকনাফ ৯৯২ কি:মি:
ফলকটা ঘিরে ছবি তোলা নিশ্চয়ই এখানকার বিডিআরদের দেখা একটা অতি বিরক্তিকর একঘেয়ে দৃশ্য। আমাদের মতো মৌসুমী পর্যটকরা এই একঘেয়ে কাজটাই বেশ সানন্দে করে: আমরাও করলাম। ছবি তোলার হিড়িক যেন। এই ফলক ঘিরে আমাদের ছবি দেখে আমার এক আত্মীয় মন্তব্য করলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো’: যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না।
এখানে এই ফলক ছাড়াও আরেকটা আকর্ষণ আছে: একটা বিরাট রসগোল্লা। অঙ্ক পরীক্ষায় যিরো পেলে যেমন বলা হতো রসগোল্লা পাইছো, তেমনি এখানে একটা বিশাল শূণ্য বানিয়ে রাখা হয়েছে একটা বেদির উপর: যার মোদ্দা কথা হলো: You are at the dead end of Bangladesh। সেখানে প্রচন্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েও ছবি তোলার অন্ত নেই। সবাই আমরা বঙ্গজননীর শিরচুমি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবার অভিপ্রায়ে আহ্লাদে যেনবা আটখানা!!
মজার ব্যাপার হলো এই সীমান্ত হলো ভারত-বাংলাদেশের, স্থলবন্দর হলো ভারত-বাংলাদেশের, কিন্তু যে ট্রাকগুলো মাল নিয়ে ঢুকছে, সেগুলো হলো নেপালের। এটাই বাংলাদেশে ঢোকার জন্য নেপালকে ভারতের দেয়া একমাত্র অনুমোদিত ট্রানজিট র্যুট। নেপালী ট্রাকগুলোর চেহারা সুন্দর না, কেমন যেন মান্ধাতা আমলের চেহারা-সুরত। …ক্যামেরা দিয়ে যুম করে দেখলাম, ট্রাক থেকে পাগড়ি বাঁধা লোক নেমে এসে বিএসএফ-কে কাগজপত্র দেখাচ্ছেন; তারপর একজন বিএসএফ জোয়ান গাড়িতে উঠে চেকআপ করে পাস দিলে পরে গাড়ি ছেড়ে এসে বাংলাদেশে ঢুকছে।
সবকিছুই দেখছি প্রচন্ড এক তাড়ায়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে… তাকিয়েই আরেফিনের উপর মেজাজটা বিগড়ে গেল, ব্যাটা কী সময় দেখেছিস! শেষ! জুম’আর নামাযটা গেল আমাদের। একটা সাইনবোর্ডে লেখা: “বাংলাদেশের সীমান্ত শেষ”, আমার মনে হলো, আমাদের দুনিয়া-আখিরাত সবই শ্যাষ!
মেজাজটা খারাপ নিয়েই পিছনে ফেলে আসা ঐ মসজিদটাতে ফিরে এলাম। জুম’আ তো গেল, তাই জোহরের নামায পড়লাম আমি আর নাকিব। আরেফিনকে একা দোষ দেয়া সমিচীন হবে না, দোষ আমারও আছে; নামাযের সময় চলে যাচ্ছে, আমার কি হুশ ছিল না?! …যাহোক ফেরার পালা, ফিরে চললাম ১৮ কিলোমিটার অতীতে আবার তেঁতুলিয়ার উদ্দেশ্যে। অটো চলছে তার শম্বুক গতিতে। পিছনের সীটে সাজ্জাদের কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত আদমব্যাপারি; সাজ্জাদের চোখে রোদচশমা, হয়তো ভিতরে তার চোখও বন্ধ, কে জানে। এমন অবস্থায় তখন ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি…
…ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি… তেঁতুলিয়ায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে… ‘বাঁশ’।
(চলবে…)
-মঈনুল ইসলাম
চমৎকার লিখেছেন। ছবি গুলো দেখে ভাল লাগল।