ধারাবাহিক: বান্দরবান ভ্রমণ ২০১১ —এর একটি পর্ব
গাড়ি নীলগিরির চূড়ায় উঠলে একটা পার্কিং এলাকা। এখানে পার্কিংয়ের জন্য যে টাকা দিতে হবে (৳৩০০), তা আমাদেরকে বহন করতে হবে, ড্রাইভারের সাথে এমনটাই চুক্তি হয়েছিল। যাবতীয় খরচ একহাতে হচ্ছে, তাই ইফতি এগিয়ে গেলো আর্মির ছোট্ট কমান্ড পোস্টটার দিকে। সেখান থেকে আবার জনপ্রতি টিকিট (৳৫০) কেটে উপরের চূড়ায় উঠতে হয়। যারা কটেজ ভাড়া করে আসেননি, তাদেরকে এই টিকেট করে চূড়ায় অবস্থান করার ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। পার্কিংয়ের সরাসরি সামনেই আর্মিদের ছোটখাটো একটা ক্যাম্প। আর বায়ে বেরিকেড পার হয়ে উপরের চূড়ায় থাকা কটেজগুলো পরিদর্শনে যাওয়া যায়। আমরা বোচকা-বাচকি গাড়িতে রেখেই চলে গেলাম চূড়ার দিকে। চূড়াতে একটা ক্যাফেতেরিয়া। নামে ক্যাফেতেরিয়া হলেও আদতে ডায়নিং রুম। কারণ এখানে কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়না। আমি যতদূর বুঝেছি যে, খাবার রান্না করে নিয়ে এলে এখানে সেটা বসে খাওয়া যাবে। অবশ্য বন্ধুরা কেউ কেউ বললো না, জিনিসপত্তর নিয়ে এলে নিজেরা রান্না করেও খেতে পারবেন চাইলে। যাহোক, সত্যিটা জানিনি আর। কারণ আমার চোখে তখন বেশ যন্ত্রণা করছে। গাছের ডালটা আচঁড় কেটে গেলেও এখন প্রচন্ড রোদের মধ্যে একটু কষ্টই দিচ্ছে। পানির সন্ধান করছি। তাই হেঁটে হেঁটে উপরে গেলাম।
সেখানে তিনটা কটেজ। ছিমছাম কটেজ। তাছাড়া জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও রিঙের মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছে উপজাতীয় ঝুড়ি, যেগুলোর নিচের দিকটা হয় চিকন, আর মুখের অংশটা হয় ছড়ানো। এগুলো এখানে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে: আঞ্চলিকতার আবেশ আনা হয়েছে আরকি। আমরা চাচ্ছিলাম মেঘের মধ্যে হাঁটবো, কিন্তু আমাদের জন্য খা খা রোদ অপেক্ষা করছিল। উপর থেকে নিচে তাকালে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা আমি প্রথম দেখেছিলাম আরব আমিরাতের ফুযিরাহ পর্বতের চূড়ায় উঠে। কিন্তু সেটা যদি সৌন্দর্য্য হয়, তবে এটা কী? না, সেটা সৌন্দর্য্য ছিল না। মরুময় পাথরের জঙ্গলে সৌন্দর্য্য থাকতে পারে না। সৌন্দর্য্য আমার এই দেশের সবুজ বিছানায়। নিচে, বহুদূরে ঝাপসা রঙে সবুজ চাদর বিছিয়ে, কিংবা সবুজ কার্পেট বিছিয়ে দেয়া পাহাড়ি প্রান্তরে।
যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের সারি। আমরা এতো উপরে আছি যে, পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে মাটির মধ্যে উঁচু-নিচু হয়ে থাকা “টুক”। সিলেটি ভাষায় মাটির মধ্যে ফোঁড়া বেরিয়ে থাকলে তাকে টুক বলে, তাই এখানেও বললাম। অথচ শাকিরের আনা দূরবিণটা যখন চোখে দিলাম, আশ্চর্য হয়ে গেলাম, অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আদিবাসীদের বসতি, অথচ ঘরগুলোকে মনে হচ্ছে পিঁপড়ার ছোট্ট ঘর। যদিও মেঘ তেমন একটা নেই আকাশে, তবু কেমন জানি একটা ধূসর কুয়াশা-ধাঁচের আবরণ আমাদের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হতে দিচ্ছিল না। এই ব্যাপারটা আমার ঠিক পরিষ্কার হয় না। সেই ফুযিরাতেও এই ব্যাপারটা দেখেছি, তখন ভেবেছি, ধুলাবালুর দেশ, কিন্তু এই গাছগাছালিপূর্ণ পাহাড়ে তো আর ধুলাবালি নেই! যাহোক, যে দৃশ্য দেখেছি, সেটা আসলে বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না।
অপূর্ব দৃশ্য! অপূর্ব! অপূর্ব!! অভূতপূর্ব!!!
আমি বরং বর্ণনা না দিয়ে অল্প ক’টা ছবি দিয়ে দিই:
কটেজের ছবিগুলো আমি আর দিলাম না (পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। …নীলগিরির উপরে আছে হ্যালিপ্যাড। একটা সাইনপোস্টে মাইলেজ লিখে নীলগিরির অবস্থান বোঝানো হয়েছে: [নীলগিরি থেকে] থানচি ৩৩ কিলোমিটার, বান্দরবান সদর ৪৮ কি.মি., চিম্বুক ১৮ কি.মি., রুমা ৪৯ কি.মি., কেওক্রাডং ৬২ কি.মি. দূরে। …পরে দেখেছি আরো প্রায় তিনটা কটেজ আছে পাহাড়ের ঢালে। চূড়ায় আছে একটা বড় দূরবীণ, যা একটা কাচঘরের ভিতর রাখা, তালাবদ্ধ। ওটা দিয়ে সাইটসীয়িং করা যেত বেশ ভালোই। আমরা কটেজ ভাড়া করিনি বলে বোধহয় আমাদেরকে ওটা খুলে দেয়া হয়নি। একটা রেলিং আছে পাহাড়ের বাইরের দিকে বের করে দেয়া, ঝোলানো। সেটাতে উঠে ছবি তোলা সবারই একটা সাধারণ কাজ। কারণ ওটাতে দাঁড়ালে বাতাসে ভর করে দাঁড়ানোর একটা স্বাদ ঘোলে মিটানো যায় আরকি। তবে সেখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছবিটা তুলেছে নাকিব, সে রেলিং থেকে হাত বাড়িয়ে এমন একটা ভান করলো, শাকিল ভাইয়ের ক্যামেরার দৃষ্টিতে সেটা ধরা পড়লো উড়তে থাকা পাখি।
না, মুখ ধোয়ার জন্য কোনো পানি পাওয়া গেলো না। প্রত্যেকটা কটেজ বন্ধ। লোকজন নেই। আমরা আশান্বিত হলাম: থাকা যাবে হয়তো। কিন্তু আর্মির কাছে জানলাম, কটেজ খালি নেই। ফের আমরা ফেরার চিন্তায়ই ডুব দিলাম। কিন্তু যোহরের নামাযের সময় চলে যাচ্ছে, নামাযও তো পড়া দরকার। কমান্ড পোস্টে গিয়ে নামাযের কথা বললে আমাদেরকে পার্কিং এলাকার ভিতরকার মসজিদের দিকে যেতে বলে দিলেন দায়িত্বরত আর্মি-জোয়ান, যদিও প্রবেশ-মুখে লেখা:
বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ক্যাম্পে প্রবেশ নিষেধ
ভিতরে দুই সারি পাকা-ঘর-টিনের-চালা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পানি পান করার ব্যবস্থা। কোনো এক উপায়ে ওযু-গোসলের জন্য তুলনামূলক নোংরা পানি সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু সেই পানিও বর্ণহীন, গন্ধহীন, ঠান্ডা। নোংরা বলছি এজন্য যে, আমাদেরকে সেই পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা তাই ওযু সারলাম। আমি ওযু সেরে যখন বাকিদের জন্য অপেক্ষারত, তখন তাকিয়ে দেখি গাছে গাছে লেবু, আম এমনভাবে ঝুলে আছে, যেন ডাকছে: আয়, খা। কিন্তু নৈতিকতার বাধায় আমরা সেগুলোতে ছুলাম না। কারণ আমরা এখানে নামায পড়ার অনুমতি নিয়ে ভিতরে এসেছি।
মসজিদটা ছোট্ট, বাঁশ-বেত-টিনের। ভিতরে একজন দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি শুয়ে। পরে বুঝলাম ইনিও একজন আর্মি জোয়ান। আমাদেরকে দেখেই উঠে পড়লেন। বললেন, নাহ্, শোয়া যায় না। ছোট ছোট পোকা। জঙ্গুলে এলাকায় এগুলোই হলো সমস্যা। পোকা-মাকড়কে তাড়িয়ে মানুষ বসতি করে তো, তাই তারাও রিভেঞ্জ করে। মাত্র দুরাকা’আত নামায, কত সহজ। ভ্রমণে থাকলে এটা আল্লাহর উপহার: কসর নামায। এসময় দুরাকা’আতের জায়গায় চার রাকা’আত ফরয পড়লে উল্টা গুনাহ হয়। দ্রুতই নামায শেষ হয়ে গেলো। আমার চোখটা ধুয়ে নিতে পারায় এখন একটু ভালো লাগছে।
ওদিকে শাকিল ভাই দেখি কমান্ড পোস্টের আর্মি জোয়ানের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। এগিয়ে গিয়ে শুনলাম, তারা গ্রামীণ ফোনের সীম নিয়ে আলোচনা করছেন। সীম লক হয়ে গেছে, নাকি সীম চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে- হাবিজাবি। শাকিল ভাই কাস্টমার কেয়ারে আছেন বলে লোকটাও পেয়েছে সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার। খুব জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুজন। পরে শুনি, শাকিল ভাই ঐ জোয়ানকে বেশ কনভিন্স করে ফেলেছিলেন যে, আমাদেরকে কটেজে না হোক, তাদের তাবু দিয়ে হলেও থেকে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। কিন্তু আজকে নাকি কোন ব্রিগ্রেডিয়ার আসছেন কটেজে (সম্ভবত ফ্যামিলিসুদ্ধ), তাই সেটাতে সমস্যা হয়ে যাবে।
কী আর করা? মুখে দানা-পানি কিছুই না দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসা পানি দিয়ে উদোরপূর্তি করে চললাম আমরা ফিরতি পথে। এরই মধ্যে আমাদের গাইড মহাশয় আমাদের দলকে কনভিন্স করে ফেলেছে, নীলাচল নামক জায়গায় না গেলেই নয়। সে বাজি ধরে বলছে, সেই জায়গা যদি পছন্দ না হয়, সে আমাদের টাকাই ফেরত দিয়ে দেবে। তো এরকম মানিব্যাক গ্যারান্টি শুনে কে আর বসে থাকে বলুন। সবাই এক-বাক্যে রাজি। আমি কেন জানি হুজুগের পালে হাওয়া দিতে সব সময় একটু দেরি করি। হুজুগ জিনিসটা ভালো না। তাই একটু রয়েসয়ে। কারণ ওখানে যাওয়াটা আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের বাইরে, আলাদা করে গুনতে হবে ৳৭৫০।
আমরা নীলগিরি থেকে সূর্যাস্ত দেখার আশাতে গুড়ে বালি দিয়ে নীলগিরিকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথে চললাম পাহাড় বেয়ে নিচে। এবার দলটা একটু মিইয়ে থাকলেও মজা চলছেই। শাকিল ভাই খুব ফলাও করে বলছেন, আরেকটু হলেই তিনি থাকার ব্যবস্থা করেই ফেলছিলেন। কিন্তু কী আর করা? পরবর্তি গন্তব্যে যাবার আগে আপনাদের অবগতির জন্য নীলগিরি সম্পর্কে একটু তথ্য দিয়ে রাখি:
- নীলগিরিতে নিজস্ব যানবাহন নিয়ে যাবেন, নচেৎ ফেরা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।
- নিজের খাবারের ব্যবস্থা করে যেতে হবে। (রান্না করা যাবে কিনা, আমি নিশ্চিত নই, কারণ সেটা শোনা কথা)
- আগে থেকে কটেজ বুক করে যেতে হবে। পিক সিযনে কটেজ খালি পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে। বুক করার জন্য যোগাযোগ করতে হবে 01769292338 নম্বরে (এই নাম্বার পরিবর্তন হয়, কারণ আমরা অন্য আরেকটা নাম্বার নিয়ে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে পেলাম এটা)। ফোনের ওপাশে একজন আর্মি ধরবেন, তার কাছে বৃত্তান্ত জেনে নেয়া যাবে।
- কটেজের আকৃতির ব্যবধানে ভাড়ার ব্যবধান আছে। ৩০০০টাকায় কটেজ ভাড়া পাওয়া যায় একরাত থাকার জন্য (২৪ ঘন্টার জন্য), ছোট কটেজ একটু কম হতে পারে। যতদূর জানি, বুকিংয়ের টাকা অর্ধেক প্রথমে ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। ব্যাংক ড্রাফটের প্রমাণপত্র নিয়ে নীলগিরিতে হাজির হতে হয়, তারপর বাকি অর্ধেক এখানে পরিশোধ করতে হয়। (নিয়ম পরিবর্তিত হলে জানিনা)
- বৃষ্টির দিনে গেলে নীলগিরি-চূড়ায় মেঘের মধ্যে ডুবে থাকতে পারবেন। শীতের দিনে গেলেও সেটা সম্ভব।
- কেউ কেউ নীলগিরিকে দার্জিলিংয়ের সাথে তুলনা করতে চান। আমাদের নাকিবও পথে মাঝে মাঝেই বলছিল, ওমুক জায়গাটা পুরাই দার্জিলিংয়ের মতো, তমুক জায়গাটা দার্জিলিংয়ের মতো…। সে একবার দার্জিলিং ঘুরে এলেও নীলগিরি উপভোগে তার বিন্দুমাত্র অনাগ্রহ ছিল না।
আমাদের পরবর্তি গন্তব্য হলো শৈলপ্রপাত। বান্দরবান সদরে হোটেলের কাদাগোলা পানিতে গোসল করে তৃপ্তি হচ্ছিল না, তাই আমরা ঠিক করেছি শৈলপ্রপাতে গিয়ে ঝরণার পানিতে গোসল করবো। বোচকা-বাচকি তো সাথেই আছে। কাপড়-চোপড় নিয়ে নেমে গেলাম শৈলপ্রপাতে। সেখানে এই বৃষ্টির মৌসুমেও প্রপাত তেমন একটা নজরে এলো না, যা আছে, সবই শৈল, মানে শিলা বা পাথর। পাথরের উপর দিয়ে পেচ্ছাবের মতো করে পানি গিয়ে নিচে পড়ছে। তবে সবসময় পানি বয়ে যায় বলে পাথরগুলো অস্বাভাবিক রকমের পিছলা। তাই সবাই-ই একে অপরকে সাবধান করে দিচ্ছিল।
আমাদের মধ্যে নাকিব, ইফতি, প্রিয়ম আর আব্দুল্লাহ -গোসল করতে রাজি নয়। তাই বাকিরা গোসলের জন্য ভালো জায়গা খুঁজতে লাগলাম। সমস্যা হলো আদিবাসী মহিলারা আর মেয়েরা পানিতে গোসল করছিল। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে সেটা যথেষ্টই স্বল্প-বসনা-গোসল। ব্যাপারটা মোটেও সুখকর না। নাকিব পুরোপুরি নাক সিঁটকাচ্ছিল। কিন্তু আমরা আসলে গোসলের ব্যাপারে এতোটাই ডেসপারেট ছিলাম যে, সব উপেক্ষা করে গোসল করতেই হবে। ঠিক করলাম, ঝরণার আরেকটু উজানে যাওয়া যাক, তাহলে পরিষ্কার-টলটলে পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু বিধি বাম, সেখানে যেতে আমাদেরকে নিষেধ করলেন আদিবাসী নারীরা। কারণ ওখান থেকে নাকি আদিবাসীরা খাবার পানি সংগ্রহ করেন। শেষ পর্যন্ত আদিবাসী নারীদের গোসল করার স্থান থেকে একটু উজানের একটা গর্ত দেখিয়ে আমাদেরকে বলা হলো ওখানটাতে গোসল করতে পারেন। ঝরণার পানি পড়তে পড়তে এখানটাতে হালকা একটা গর্ত হয়ে আছে। ব্যস, সবাই…
…কী মনে হয়, ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মোট্টেই না। কারণ ঐ গর্তের ভিতরে ঘোর অন্ধকার। সাপ না কেঁচো না জেনেই ঝাঁপ দেই কী করে? আমাদের অবস্থাটা আঁচ করতে পেরে এগিয়ে এলো এক আদিবাসী কিশোর। ভুষ্ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো গর্তটার ভিতর। তারপর দীর্ঘক্ষণ খবর নেই। পানির ভিতরে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তারপর একসময় ভুষ করে মাথা তুললো। আমাদের অভয় দিয়ে নিজেকে খুব বীর ভাবতে লাগলো ছোঁকরা। আমরা যখন পানিতে নামলাম, অসম্ভব ঠান্ডা পানির পরশে মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ভুলেই গেলাম আমাদের এতো দূর-পথে জার্নি। সব ক্লান্তি এক নিমিষে উবে গেলো। কিন্তু গর্তটার ভিতরে যখন ডুব দিলাম, একটু পরেই পায়ে ঠেকলো পাথুরে তলা। বুঝলাম ছেলেটা একটু সময় নিয়ে ডুব দিয়ে আমাদেরকে একটা ভাওতা দিয়েছে যে, গর্তটা অনেক গভীর। তবে অন্ধকার গর্তে পা দিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকাতে একটু অস্বস্তিই লাগে। তাই দুই গর্তের মাঝখানের জলভেজা দেয়ালে উঠে বসলাম আমি। বুদ্ধের মতো ধ্যানের একটা বাসনা জাগলো মনে। ধ্যানে বসলাম। লোকসমাগমে যদি আর ধ্যান হতো, তবে বুদ্ধ ধ্যানের জন্য প্রাসাদ ছাড়তেন না, আর মুহাম্মদ [স.] ধ্যানের জন্য গুহায় ঢুকতেন না। তাই ওটা আদতে ছিল ছবি তোলার পোয। তবে ছবিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নাকিব গোসল না করায় সে অন্তত আমাদের কিছু ছবি তুলে দিয়েছে।
গোসল-টোশল শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম। খুব সাবধানে, কারণ ভেজা শরীরে পাথরের উপরে আছাড় খাওয়া বিচিত্র নয়। ওদিকে আমাদের এই উপস্থিতি রীতিমতো বিব্রত করছিল কয়েকজন বৃদ্ধাকে। তাঁদেরকে বেশিক্ষণ বিরক্ত না করে আমরা মানে মানে কেটে পড়লাম গোসলের স্বার্থ উদ্ধার করে। গিয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। ঢাকায় ফিরে যখন ছবিগুলো দেখছিলাম, তখন নাকিব আমাদেরকে আশ্চর্য করে দিয়ে দেখালো দুটো ভিডিও। আমরা যখন গোসল করতে ব্যস্ত ছিলাম, তখন স্থানীয় বল্টুগুলো ব্যস্ত ছিল মেহমানদেরকে নিজেদের কৃতীত্ব দেখাতে। তবে ভিডিও দেখে আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে, আসলেই তাদের কৃতিত্ব আছে।
পিছলা পাথরের উপর দিয়ে স্লাইড করে করে তারা গিয়ে পড়ছিল একটু ঢালুতে থাকা গর্তে। গর্তটাও পিছলা। সেখান থেকে পিছলে গেলে পড়তে হবে গভীর খাদে। কিন্তু তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল ঐ গর্তটাই তাদের কাছে লজ্জা পাচ্ছে। তাদের উলঙ্গ শরীর ঐ পাথরের ঘষায় বিন্দুমাত্র ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল না। কী অনায়াসে কখনও বুক দিয়ে, কখনও পাছা দিয়ে, কখনও পিঠ দিয়ে, কখনও পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সে কী অপূর্ব স্লাইড। ভিডিও দুটা শেয়ার না করতে পারলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। নাকিবকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় ছিল না। এই অপূর্ব জিনিস মিস করতাম, যদি না সে গোসল না করতো। (ভিডিও কৃতজ্ঞতা: নাকিব আহমেদ)
(ভিডিওগুলো কোনো কারণবশত ইউটিউব থেকে মুছে ফেলা হয়েছে বলে ব্লগ থেকে ভিডিওদুটো পরবর্তীতে মুছে ফেলা হয়েছে)
গোসল শেষে আমাদের গাড়ির উলঙ্গ রডগুলো হয়ে গেলো আলনা। ভেজা কাপড়-গামছা-টাওয়্যালগুলো বাতাসের জন্য ঝুলিয়ে দেয়া হলো ওগুলোতে। গাড়ি চলছে, আমার শরীর ম্যাঁজম্যাজ করছে, জ্বর আসছে। শাকির দেখি কাহিল হয়ে আমার পায়ের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে রয়েছে। সবাই-ই একটু নেতিয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষিধা যা লেগেছে, মনে হচ্ছে গিলে খেয়ে ফেলবে। পথে পড়লো একটা স্থানীয় আদিবাসী গ্রাম, ইফতি, আমাদের গাইড ছেলেটাকে নিয়ে নেমে গেলো আনারস কিনবে বলে। এই গ্রামেও খাবার ব্যবস্থা হলো না। আমি ঠিক করলাম, মিলনছড়ি গিয়ে ডরমিটরিও নেয়া যাবে, খাবারের ব্যবস্থাও করা যাবে। গাড়িতেই আমি সূর্যের অবস্থান দেখে নিয়ে পশ্চিম নির্ধারণ করে আসরের কসর নামায আদায় করে নিলাম দুই রাকা’আত।
কিন্তু মিলনছড়িতে থাকতে আর কেউ রাজি নয়, আমি একা লাফিয়ে কী লাভ! সবাই চায় নীলাচল দেখতে। কিন্তু তার আগে খেতে হবে যে-করেই হোক। তাই বান্দরবান সদরে গিয়ে একটা হোটেলে দুপুরের (নাকি বিকেলের) খাবার সেরে আবার গাড়িতে করে নীলাচল রওয়ানা। সূর্য এখন এক্কেবারে ডোবার অপেক্ষায়। সবাই ঠিক করেছে নীলাচলে গিয়ে রাতে থাকবে, কারণ ওখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। অগত্যা, চলো।
নীলাচলের দৃশ্য আমাদের আর দেখা হলো না বোধহয়। সূর্য তো দেখাই যাচ্ছে না। তবে গাড়ি টানছে প্রচণ্ড গতিতে, যে করেই হোক আমাদেরকে দেখিয়েই ছাড়বে। সদর থেকে মেঘলার দিকে যাবার পথে হঠাৎ করেই গাড়ি বায়ে বাঁক নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই রাস্তা আটকে টোল আদায়: গাইড ইশারা দিয়ে দিলো যাতে ৳৫০ দিয়ে দিই: এই টোল জিনিসটা যেকোনো ট্যুরের জন্যই একটা খাঁটি বাধা। টোল পার হয়ে আরো অনেকখানি ভিতরে নিয়ে গেলো আমাদের গাড়ি। তারপর একসময় একটা পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেলো আমাদেরকে। অনেক অনেক পর্যটক। আমরা শুরুতেই থাকার জন্য কথাবার্তা বলতে গেলাম। আমাদের মধ্যেকার একদল গেলো পাহাড়ের চূঁড়াটা দেখতে। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আমাদেরকে জানালো: পানি নেই। গোসল হবে না। খাবার পানি কিনে খেতে হবে। খাবারের ব্যবস্থা নেই। বাজার থেকে এনে রান্না করে খাওয়া যাবে, চুলার ব্যবস্থা তারা করে দিতে পারবেন। এদিকে সমস্যা হলো: বাজার অনেক দূরে, সদরে ফিরে যেতে হবে। পরদিন আবার প্রধান বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। সুতরাং সারাদিন কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না।
শেষ পর্যন্ত আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলাচলে থাকা যাবে না। সদরে ফিরে গিয়ে আগের হোটেলেই রাত কাটাতে হবে। কাল সারাদিন সদর ঘুরে দেখতে হবে। নীলাচলে এতো কষ্ট করে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু এই ভজোভজো করতে করতে ওদিকে সূর্য কখন ডুবে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। দেখা আর হলো না আমার নীলাচল। তবে বুঝলাম যা, তাতে মনে হলো নীলগিরির মতোই হবে। …আর বলবো না, আপনারা আবার আঙ্গুর ফল টক-এর মতো কিছু একটা আঁচ করে নিবেন তাহলে।
আমার মোবাইলের একটা অ্যাপ্স আছে: প্ল্যানেট্স। ওটা মাথার উপর ধরলে আকাশের তারাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ চেনা যায়। খুব সহজেই তারাগুলো সনাক্ত করে দিক নির্ণয় করে আমি গাড়িতেই বসে মাগরিব সারলাম। খুব ভালো লাগলো তারা দেখে নামায পড়তে। ওদিকে সবাই কীসব যেন আলোচনা করে ফিরছে। এদিকে গাড়ির পাশে ঘুরঘুর করছে এক কিশোর, সাথে এক লোক। তারা আমাদের গাড়িতে করে মূল সড়ক পর্যন্ত লিফ্ট চাইছে। এই একইভাবে লিফ্ট চেয়েছিল নীলগিরির চূঁড়া থেকে দুই যুবক, গাড়ি নেই বলে। কিন্তু তাদেরকে আমরা মানবতা দেখিয়ে নেইনি, কারণ তাদেরকে আমরা চিনিনা, পথে ডাকাতিও করতে পারে। এদেরকে কি নিব তবে? আমার দলের ওরা কানাঘুষা করছে কী? কিছু একটা প্ল্যান করে ফেলেছে নিশ্চয়ই…
তখন বুঝিনি প্ল্যানের পরে প্ল্যান আমাদেরকে কতদূর অবধি নিয়ে যেতে পারে…
চলবে…
-মঈনুল ইসলাম
noyon excellent laglo pore.ar chobi gula josh hoiche……thanks for tagging me……amr khb jaoar echcha …..dekhi jodi jete pari…………….