অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৯)

গত রাতে রাসেলের অবস্থা পর্যালোচনা-পূর্বক, কারবারির কথা শুনে আবুবকর পরিস্থিতির স্বার্থে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর নেয়া সেই সিদ্ধান্ত যে আমাদেরকে আমাদের নিয়তির পরম আশ্চর্য অংশে নিয়ে যাবে, ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। আবুবকর আমাদের গন্তব্য বদলেছেন। গত রাতেই কারবারির থেকে পথ জেনে নিয়ে ফিরতি পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। রাসেলের পায়ের এই অবস্থা নিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যাওয়া সম্ভব হবে না, কারণ সামনে অজানা পথে কোন মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখিন আমরা হবো, তার ঠিক নেই। তাই ফিরতি পথ ধরাই আমাদের উচিত হবে। কী সেই ফিরতি পথ?

লালহিম আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গতকালকের বাদ পড়া ঝরণাটা দেখাতে। তখনও আমরা রুমানা পাড়া থেকে নামিনি, কামরুল আমাদেরকে ডানদিকে তাকাতে বললো। দূরে একটা উঁচু পাহাড়ের চূঁড়া দেখা যাচ্ছে। কামরুল জানালো ওটা পাহাড় না, বরং ওটা পর্বত: কেওকারাডং পর্বত। আর ঐইই যে জিনিসটা চকচক করছে, ওটা হলো কেওকারাডংয়ের ল্যাট্রিন। কথাটা কামরুল খুব স্বাভাবিক আর ভাবলেশহীনভাবে বললো, যেন কথাটা সে এভাবে আরো অনেককে বলেছে।

রুমানা ঝরণা, দুই ধারায় ঝরছে পানি (ছবি: লেখক)
রুমানা ঝরণা, দুই ধারায় ঝরছে পানি (ছবি: লেখক)

আমরা কেওকারাডং-এর ছবি তুলে নিলাম, আহারে, ওখানেই যাবার কথা ছিল আমাদের, দেখা আর হলো না। লালহিম আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিচে নামতে নামতে একপর্যায়ে ডানদিকের একটা সরু পথ ধরলো। আমি, নাকিব আর আবুবকর অনুসরণ করছি তাকে। পথটা বেয়ে আরো কিছুদূর যাবার পর শোঁ শোঁ আওয়াজ কানে এলো। সামনে এগিয়ে দেখি একটা ঝরণা। খুব বেশি উঁচু না ঝরণাটা, ছোট। এটা হলো রুমানা ঝরণা। রুমানা ঝরণার উপর থেকে জিপিএস রিডিং নিলেন আবুবকর। তারপর নিচে নামতে গেলেন। নাকিব উপরেই রইলো, আমি আর আবুবকর, লালহিমকে অনুসরণ করে খুব সহজেই নিচে, ঝরণার পাদদেশে নেমে গেলাম। সেখান থেকে দেখলাম ঝরণাটা। দুইটা ধারা, পাথরের দুপাশ দিয়ে নিচে নেমেছে। বর্ষাকালে ঝরণার যৌবন অবশ্যই আরো সুন্দর হবে, এখনও পানি নেহায়েত কম না। লালহিম জানালো এখানে ভালোই মাছ পাওয়া যায়।

ঝরণা দর্শন শেষে আমরা উপরে উঠে এলে আবুবকর জানালেন, জিপিএস ট্র্যাক নিতে ভুলে গেছেন ঝরণাটার উচ্চতা কত। নিচ পর্যন্ত গিয়ে এলাম অথচ আমরা ঝরণাটার উচ্চতা না মেপে চলে যাব, এটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাই আমিই বললাম, আমি নিচে যাবো একা। জিপিএসটা হাতে নিয়ে ঐ পথেই আবার একা একা খুব দ্রুতই নিচে নেমে গেলাম। একা একা ঝরণাটা উপভোগ করতে মন্দ লাগছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জিপিএস যন্ত্রটাকে একটু সময় দিয়ে তারপর ফিরলাম উপরে। আবুবকর মার্ক করে নিলেন উচ্চতাটা।

আমরা ফিরতি পথ বেয়ে মুল পথে ফিরে এলাম। রাসেল, কামরুল, আপেল আর বিকাশ আগে-ভাগেই চলে গেছে, পথ এগিয়ে রাখতে চাইছে ওরা— ভালো। আমরা লালহিমের সাথে গলাগলি শেষ করে বিদায় নিলাম। আবুবকর তাকে লেখাপড়া শুরু করতে উপদেশ দিয়ে এলেন।

আমরা পথ নেমে একটা ব্রিজ পার হলাম। উঠতি সূর্যের তীর্যক আলো যখন গাছের ফাঁক গলে আমাদের স্বাগত জানিয়ে মনটা ভরিয়ে দিচ্ছে, তখন আবুবকরের মনটা একটু খারাপ। আমাদের কারণে, বিশেষ করে রাসেলের কারণে আমাদের গন্তব্য পর্যন্ত যাওয়া হলো না, ফিরতি পথ ধরতে হচ্ছে মাঝখান থেকে। আমি আবুবকরকে বললাম, এই ট্যুরটা কিন্তু আপনাদের জন্য একটা শিক্ষা। কক্ষণোও অজানা ট্রেইলে অচেনা মানুষকে সঙ্গে নিতে নেই। নাকিব আপত্তি করতে চাইলো, আমি বললাম, না, আমাকেও না। অচেনা মানুষ সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনে, তারা পাহাড়ে চড়তে পারবে কিনা না জেনে এভাবে উৎসাহের বশে সঙ্গী করে নেয়াটা উচিত না, আমাকেও না। কারণ আমাকে সঙ্গে নিয়ে এতদূর না আসা পর্যন্ত তারা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, আমি পাহাড়ে কেমন চড়তে জানি। আবুবকর মেনে নিলেন কথাটা।

সকালের মিষ্টি রোদ চুইয়ে আসছে গাছের ফাঁক গলে (ছবি: লেখক)
সকালের মিষ্টি রোদ চুইয়ে আসছে গাছের ফাঁক গলে (ছবি: লেখক)

তখন তিনি জানালেন, আমাদের সামনের গন্তব্য সুংসাং পাড়া, তারপর পাসিং পাড়া হয়ে ফিরতি পথ। আবুবকরের জন্য মনটা খারাপই লাগছে। কিন্তু আমরা সবাই-ই আসলে একটা অবস্থার শিকার। রাসেলেরও কোনো দোষ নেই, আমাদেরও এতে কোনো হাত নেই। নিজেদের অদৃষ্টের উপর রাগ ঝাড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

পথটা এগিয়ে চললো। ব্রিজ পার হতেই পথটা আবার চড়াই ধরেছে। পথটা অবশ্য পাহাড়িরা খাঁজ কেটে সিঁড়ি করে রেখেছে। তবু, উপরের দিকে উঠা বলে কথা, কষ্ট লাগে বেশ। কিন্তু পাতলা শরীর আর ভরা ব্যাগ নিয়ে উঠতে পারলাম অনায়াসে। একসময় আবার কামরুলের সঙ্গী হলাম। পথটা আবার নেমে যাচ্ছে। কিন্তু পথটা কেমন জানি পানি যাবার নালার মতো, আর দুপাশে উঁচুতে রয়েছে শুষ্ক কাঁশবন। ভোরে শীত ছিল বলে জ্যাকেট চাপিয়েছিলাম, এখন সেটা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম।

পাহাড়ের উপরে যেনবা কোনো শান্তির আবাস, কোনো বনলতা সেন... আহা! (ছবি: নাকিব)
পাহাড়ের উপরে যেনবা কোনো শান্তির আবাস, কোনো বনলতা সেন… আহা! (ছবি: নাকিব)

আবার পথটা খানিকটা উপরের দিকে উঠে সামনে এগোতেই একটা পাড়া নজরে এলো। এগিয়ে গিয়ে দেখি, ওটা পাড়া না, সেনা ক্যাম্প: সুংসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প। আর্মি ক্যাম্প সবসময়ই বেশ গোপনীয়, ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু কে কার নিষেধাজ্ঞা মানে, ছবি তুলে নিতে দ্বিধা করলাম না। আর্মি ক্যাম্পের বাঁশের বেড়া আর বাঁশের সুন্দর আয়তাকৃতি প্রধান ফটকের সামনেই একটা বড় ঝাউগাছ। ঝাউগাছ বা ক্রিসমাস ট্রিটা বেশ সুন্দর লাগছিল পিছনের নীলাকাশের দৃশ্যপটে। নাকিবের খুব শখ এরকম ছবিকে কম্পিউটারের ওয়ালপেপার বানাবে। তাই ওর জন্য ওয়ালপেপারের ছবি তুলে দিলাম।

সুংসাং পাড়া সেনা ক্যাম্প, দূর থেকে (ছবি: লেখক)
সুংসাং পাড়া সেনা ক্যাম্প, দূর থেকে (ছবি: লেখক)

ওদিকে সামনে গিয়ে পথটা আরো উঁচুতে উঠতে থাকলো। আবুবকররা এগিয়ে গেছেন ওতটুকু। সেই উঁচু পথের বাঁপাশে চোখে পড়লো একটা পাড়া। কামরুল জানালো ওটা সুংসাং পাড়া বা সংসং পাড়া। সুংসাং পাড়ায় আমরা উঠলাম না, পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম পথ ধরে। পথটা উপরের দিকে উঠছে। আমাদের ধারণারও অতীত ছিল, পথটা কোথায় উঠে যাচ্ছে, কত উঁচুতে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে…।

পথটা ধরে এগোতে থাকলাম। সামনে ডানদিকে অনেকগুলো কবর-ফলক দেখে বুঝলাম, ওটা এখানকার পাড়ার খ্রিস্টানদের কবরস্থান, লেখা: Welcome to Zawl, মানে বুঝলাম না। আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি সুংসাং পাড়ার আরেক মাথায় এক জায়গায় আবুবকরসহ বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে? …রাসেলকে আবারো কৃতকর্ম সারতে হবে। কী আর করা, বিকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, সে চরম বিরক্ত।

আর যাই হোক, রাসেলের কারণে আমাদের সবারই খানিকটা বিশ্রাম হলো। ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে একটু স্বস্থি পেতে চাইলাম। কামরুল তখন তার ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে আমাদের সবাইকে দিলো। এই চকলেট সে আর আবুবকর খাবার জন্য এনেছিল, কিন্তু এখন ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে ভাগ করে খাওয়াকে সে ভদ্রতা মনে করলো, যা না করলেও আমাদের কিছু মনে করার প্রশ্নই উঠতো না। কামরুলকে এজন্য বোধহয় ধন্যবাদের চেয়েও বড় কিছু— দোয়া দেয়া উচিত।

রাসেল যখন নিজেকে খুব দোষী ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসছিল, তখন মায়াই হলো। তারপর আবার পথ চলা। পাহাড়ের উপরে পাসিং পাড়া, প্রচুর পথ বেয়ে উঠতে হবে। সবাই তৈরি। পথটা মাটির, ঢালু হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। কিন্তু ঢালটা একটু খাড়াই। কিছুদূর উঠে পেছন ফিরে দেখি, রুমানা পাড়া, সুংসং পাড়া, আর আর্মি ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। কিছুক্ষণ আগেই পার করে আসা একটা আস্ত পাড়াকে এখন একনজরে দেখা যাচ্ছে পুরোটাই… অপূর্ব, অপূর্ব!!

পথটা এগিয়ে চলেছে, কখনও সামান্য একটু নামছে, তো আবার তার দ্বিগুণ উপরের দিকে উঠছে। ডানদিকের মেঝেতে, রাস্তার পাশ ধরে একটা পাইপ, অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি, অনেক দূর পর্যন্ত ওটা আমাদের পাশ দিয়ে সাপের মতো বয়ে চলেছে। কোথায় গেছে? আবুবকর বললেন, কাছের ঝরণা থেকে আর্মি ক্যাম্পে পানির সাপ্লাই করা হয়েছে পাইপ দিয়ে। …তারমানে, কাছে একটা ঝরণা আছে!

আমরা যখন আরেকটু সামনে এগোলাম, তখন একটা পথ পড়লো, রাসেল একটু বিশ্রাম চাইলো, চড়াই উঠতে ওর জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ও যখন গাছের ছায়াঘেরা জায়গাটায় বিশ্রাম করছে, তখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি…

…প্রজাপতি। অনেক অনেক প্রজাপতি। নাকিবের ক্যামেরাটা রীতিমতো চমৎকার, অনায়াসে ১২ গুণ অপটিক্যাল যুম করে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওরা কি আর আমাকে পোয দেয়ার জন্য বসে আছে? অনভিজ্ঞ হাতে শার্টার টিপে যাওয়া আরকি। অনেকগুলো ফুল চোখে পড়লো উপরের ডালগুলোতে। সাদা রঙের জাম ফুলের মঞ্জুরিগুলো যেন মৌমাছি আর প্রজাপতিদের জন্য মধুর আগার নিয়ে বসে আছে। প্রজাপতির ছবি তুলতে তুলতে হাতে ব্যথা হয়ে গেছে আমার। বেচারা কামরুল হয়তো ভালো কিছু ছবি পেত, কিন্তু ওর ক্যামেরার যুম অত উঁচুতে ধরে না।

জাম ফুলে প্রজাপতির অভয়ারণ্য (ছবি: লেখক)
জাম ফুলে প্রজাপতির অভয়ারণ্য (ছবি: লেখক)

বিশ্রাম শেষ, আবার আমাদের পথচলা শুরু। কিছুদূর এগিয়ে দেখি একটা ছোট্ট ঝিরি, আর তার উপর ব্রিটিশ আমলের একটা সিমেন্ট আর কাঠের ব্রিজ। ব্রিজটা আসলে কোন আমলের তা জানিনা— আসলে ওটার যে অবস্থা, ওটাকে ‘ব্রিটিশ আমল’ উপধায় বেশি ভালো সূচিত করা যায় আরকি।

কাঠের ব্রিজ, মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশ আমলের কথা (ছবি: লেখক)
কাঠের ব্রিজ, মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশ আমলের কথা (ছবি: লেখক)

আমাদেরকে আরো চড়াই উঠতে হবে, তাই নাকিব ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের জন্য। আমাদের সবাইকে পানি ভরে নিতে বললো ঝিরি থেকে। কথা সত্যি, তাই দ্বিধা না করে বোতলের পানিটুকু সাবাড় করে সবার সবগুলো বোতলই নিয়ে গিয়ে রিফিল করে আনলাম। পানি খুব একটা আহামরি না, কিন্তু পানি তো!

আবার হন্টন। এই একটা শব্দ শুনতে শুনতে পাঠক হয়তো বিরক্ত হতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটা ছিল… আর কী? …হন্টন। …এবার শুরু হলো খাঁটি চড়াই উঠা। চড়াই যাকে বলে আরকি। রাসেলের নাভিশ্বাস বেরিয়ে যাবার উপক্রম, কামরুলও শরীরের ওজনের কারণে কিছুটা হলেও ঝিম মেরেছে। ওদের কথা আর কী বলবো, এতোটা চড়াই যে, আমার মতো শুকনা কাঠিও রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে। নাকিবের কী অবস্থা কে জানে, ও বেশ আগে উঠে গেছে। আমি, রাসেলের সঙ্গ দিতে গিয়ে কামরুলেরই মতো পিছিয়ে গেছি।

উপরে উঠছি, একটু ঢালু-চড়াই ধরে সামনে এগোচ্ছি, আবার উপরে উঠছি। দাঁড়ালেই আরো বেশি ক্লান্তি লাগে, তাই উঠতে থাকাটাই সমিচীন মনে করলাম। নিজের ক্লান্তি নিজেকে বুঝতে দিতে নেই। তাই মনটাকে অন্যদিকে সরানোর প্রয়োজন মনে করলাম, আর সাথে সাথে কামরুল-আবুবকরের আনা খেজুরগুলোর গুরুত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। একেকটা খেজুর মুখের মাঝে অনেক কিছু দেয়, আর সাথে দেয় চিবিয়ে চিবিয়ে মন ফেরানোর প্রেষণা। তার সাথী হলো সাথে করে নিয়ে আসা ম্যাংগোবার। একটা ছোট্ট কামড় দিই, অনেকক্ষণ উপরে উঠি; আবার আরেকটা কামড়, আবার অনেকক্ষণ…।

পাসিং পাড়ায় উঠার পথে, রাসেলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী কষ্ট হচ্ছে তার (ছবি: লেখক)
পাসিং পাড়ায় উঠার পথে, রাসেলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী কষ্ট হচ্ছে তার (ছবি: লেখক)

যারা আবুবকরের ষড়যন্ত্র জানবার জন্য এই পর্ব পড়ছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলি: বন্ধু কখনোও বন্ধুর সাথে ষড়যন্ত্র করতে পারে না। না, কক্ষণোই পারে না। যাদের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, তারা গিয়ে দেখে আসুন, আগের পর্বে আপনারা একটা “যেন” মিস করে এসেছেন। আসলে, আবুবকর যেনবা ঈশ্বরের একটা ঘুটির মতোই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিংবা নিতে বাধ্য হয়েছেন, যা, আমাদেরকে ঘুরে-ফিরে সেই প্রথম প্ল্যানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।

রাতে, কারবারির থেকে পথ বাতলে নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমাদের আর গন্তব্যের দিকে যাওয়া হবে না, অসুস্থ একজনকে টেনে এভাবে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তিনি ওখান থেকে রুমা যাবার যে রাস্তাটা বেছে নিয়েছেন, তা আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে, যেখানে যাবার জন্য আমরা তিনজন মূলত এসেইছিলাম— হ্যা, সেই কেওকারাডং আর বগা লেক।

কে জানতো, ঈশ্বর, ঘুরেফিরে আমাদেরকে সেই পথে নিয়ে চলছেন, যে পথে না গেলে হয়তো, আবার বলছি ‘হয়তো’ আমাদের আক্ষেপ থেকে যেত। আর এখন, আমরা এই যে চড়াই উঠছি, তা বেয়ে আসলে পেছন থেকে উঠছি কেওকারাডং পর্বতে— প্রথম পর্বতারোহণ। আমাদের প্রথম লক্ষ্য অবশ্য পাসিং পাড়া। পাসিং পাড়াটা নাকি ঐ উপরে।

সাপের মতো আঁকাবাঁকা উপধাটা এবার স্বচক্ষে দেখুন (ছবি: লেখক)
সাপের মতো আঁকাবাঁকা উপধাটা এবার স্বচক্ষে দেখুন (ছবি: লেখক)

উপরে!! পর্বতের উপরে গিয়ে পাড়া বানিয়েছে, কামরুলের সূত্রমতে, তার মানেই হলো ওটা একটা বম পাড়া। এরা এই এত্ত উপরে অবশ্যই পানি পায় না, এদেরকে এই এখন আমরা যেদিক দিয়ে উঠছি, এদিক দিয়ে প্রতিদিন নেমে পানি জোগাড় করতে হয় নিচের ঐ ঝিরি থেকে। এদের অমানষিক জীবনযাত্রার কথা চিন্তা করেই আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।

আসলেই যদি চক্কর দিত, তাহলে আমি এতক্ষণে প্রপাতধরণীতল হয়ে যেতাম, কারণ পিছন ফিরে তাকিয়ে আমি যেন কোথাও হারিয়ে গেলাম। ফেলে আসা রুমানা পাড়া, সুংসাং পাড়া, সুংসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প —স-বগুলো পাড়া একসাথে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, এত্ত ছোট, এই এতটুকুন যেনবা। কতটা উপরে উঠে এসেছি ভেবে অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো। তার চেয়েও সুন্দর, আমরা যে রাস্তাটা ধরে এসেছি, সেই রাস্তাটা। আঁকা-বাঁকা সাপের মতন পথ বলতে সারাজীবন যে উপমাটা শুনে এসেছি, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই মোহময় অপরূপ রূপ দেখলাম। এ-যে পরম আকাঙ্ক্ষিত, পরম ত্যাগের ফসল আমাদের।

রাসেল, পিছিয়ে যায়, তার সাথে থেকে যায় কামরুল। আমি ম্যাংগোবার আর খেজুর খাচ্ছি, মাঝে মাঝে পানি খাচ্ছি, উপরে উঠছি। কিন্তু ডানদিকে, দূরে, কেওকারাডং পর্বতের একটা বাড়তি অংশ দেখা যাচ্ছে, ওখানটা দেখতে কেমন যেন। দেখে মনে হচ্ছে, কেমন যেন পাথরের মাথায় মুকুট পরানো। নাকিবের অসাধারণ ক্যামেরাটা তো আমার হাতে, তুলে নিয়ে যখন যুম-ইন করলাম, বুঝলাম, ওগুলো সব কাঁশবন। পাথরের একেবারে কিনারায় জন্মেছে বলে স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণচ্ছেদ না করে মাধ্যাকর্ষণের দিকে ঝুলে আছে সবগুলো শুষ্ক গাছ। আর তাই সবগুলোতে মিলে মনে হচ্ছে চুলের মতো ঝুলে আছে, যেনবা পাথর পরেছে মুকুট

অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে অবশেষে আমরা একটা প্রায় সমতলে এসে পৌঁছতে সক্ষম হলাম। এসেই দেখি কাঁশবাগানে নাকিব বাবাজি চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। তার পাশে এসে বসলাম আমি। জিরোবার দরকার হয়ে পড়লো। কিন্তু নাকিবের কথাগুলো কানে আসছে না, ঐ যে আরো উঁচু থেকে কিসের যেন ঢাকের আওয়াজ আসছে। গত রাতে, রুমানা পাড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে ওখান থেকে ন্যাঁজ ঘুটিয়ে পালাতে হতো। কারণ, ঢাক যুদ্ধের আহ্বান করে। কিন্তু গত রাতের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, শব্দটা আসছে উপরের পাসিং পাড়া থেকে, ওখানকার চার্চে চলছে রবিবারের বিশেষ সমাবেশ। ঢাকের তালে তালে সুরে সুর মিলিয়ে কিছু একটা আওড়াচ্ছেও এরা বম ভাষায়।

রাসেল আর কামরুলও এসে আমাদের সঙ্গী হলো। আবুবকর, আপেল আর বিকাশের নাম নিশানাও নেই। এতো তাড়াহুড়ার একটা বিশেষ কারণও আছে। কারণ আজকে ভোরে আমরা, আবুবকর ভাইয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, টার্গেট নিয়ে বেরিয়েছি, যেহেতু আমাদের মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না, তাই আমরা আর অযথা দেরি করবো না। যদি ঠিকমতো হাঁটতে পারি, তাহলে আজকেই আমরা রুমা ছেড়ে বান্দরবান গিয়ে ঢাকার বাস ধরবো। সেই লক্ষ্যটা একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছিল কামরুলের। সে কোনোভাবেই হিসাবটা মেলাতে পারছে না। আসলেও তো, যে রাস্তা বম পাড়ার কারবারিরাই একদিনে পার করে রুমা বাজারে গিয়ে প্রথম দিন বাজার করতে পারে না, সেখানে আমরা কিভাবে দুপুরের আগে রুমা ছেড়ে বান্দরবান পর্যন্ত চলে যাব? তবু আমরা এখনও পরিকল্পনা থেকে পিছু হটিনি। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠে পড়লাম। পাশে রেখে দেয়া ব্যাগটা আবার তুলে কাঁধে নিলাম।

কামরুল গতকালকে ব্যাগটা ঠিক করে দেয়ায় ফিতার সমবন্টনে কাঁধে আর ব্যাথা করছে না। মনে মনে কামরুলকে ধন্যবাদই দিলাম। এখনও খানিকটা উপরে উঠতে হবে। উপরে পাড়া দেখা যাচ্ছে। হেঁটে উঠে এলাম আমরা পাসিং পাড়ায়।

পাসিং পাড়া, মাঝখানে রাস্তা, দুপাশে ঘর; পথ ধরে হাঁটছে নাকিব (ছবি: লেখক)
পাসিং পাড়া, মাঝখানে রাস্তা, দুপাশে ঘর; পথ ধরে হাঁটছে নাকিব (ছবি: লেখক)

পাড়াটা অন্যান্য বম পাড়ার মতোই সুন্দর। এই উচ্চতায় বাতাসের তান্ডব থেকে বাঁচবার জন্য টিনের চালগুলো আটকে রাখতে উপরে বাঁশ আড়াআড়ি করে দিয়ে বাঁধা হয়েছে। পাড়ার ঠিক মাঝ বরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে, দুপাশে ঘর— যেনবা একটা বাজার এটা। চার্চটা খানিকটা উঁচু পাহাড়ের উপরে, আর ঠিক পিছনেই একটা একদিকে-মুখ-করা গাছ— দৃশ্যটা অপূর্ব!

পাসিং পাড়া থেকে আরো একটা জিনিস আমার আর নাকিবের নজরে এলো, দূ–রে, বহুদূ-রে যেসব পাহাড়শ্রেণী দেখা যাচ্ছে, সেগুলো কী অপূর্ব লাগছে। কিন্তু সৌন্দর্য্য সেখানেই না, সৌন্দর্য্য হলো তারও পিছনে। আকাশ আর ঐ পাহাড়শ্রেণীর মাঝখানে কিসের যেন একটা আভা। না সবুজ, না আকাশি, না নীল, বরং কেমন যেন মেটে। এই রেখাটা কিসের, আমি, নাকিব, কামরুল— কারো কাছেই জবাব ছিল না।

এগিয়ে গিয়ে আমি একটা ঘরে ঢুকলাম, যেখানে আবুবকর, আপেল, বিকাশ বিশ্রাম করছেন। আবুবকর আমার দিকে এক প্যাকেট বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে কামরুলের কথা জানতে চাইলেন, ‘কামরুল কোথায়?’

আমি সত্য কথা বললাম, কামরুল, রাসেলকে সঙ্গ দিচ্ছে। এসে পড়েছে ওরা, অপেক্ষা করতে হবে না।

আবুবকর অনুযোগ করলেন, ‘আমি কতবার বলেছি, রাসেলকে এত সঙ্গ দেয়ার দরকার নেই। ও এত হেল্প পেতে পেতে আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।’

আবুবকরের কথা সত্যি, একথা শুধু আবুবকর না, আমি, নাকিব, আপেল, বিকাশ সবাই-ই বুঝতে পারছি। কামরুল বুঝতে পারছে না কেন, জানি না। সম্ভবত দুজনেরই নেশা এক— সৌখিন ফটোগ্রাফার। আবুবকরের বক্তব্য হচ্ছে, রাসেল যেহেতু সহায়তা পেয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ক্রমশ, তাই তাকে আর সহায়তা দেয়া যাবে না। বিপদগ্রস্থ মুহূর্তে মানুষ টিকে থাকার চরম আকাঙ্ক্ষায় এমনিতেই নিজের ব্যবস্থা করে নিবে। ওকে রেখে চলে আসো। কথাটা ফেলে দেয়ার মতো না।

আর এভাবেই রাসেল ইস্যুতে চূড়ান্ত নাটকটি এখানেই মঞ্চস্থ হয়ে গেল। কামরুল, আবুবকরের কর্মকান্ডে খুব ক্ষুব্ধ, আর আবুবকর, কামরুলের। গোস্‌সার চোটে কিছু না খেয়েই কামরুল বেরিয়ে গেল। বিষয়টা আমাদের কারো জন্যই স্বস্তিদায়ক ছিল না।

বিষয়টা বুঝতেই আমার লাগলো কিছুক্ষণ। আমরা সবাই-ই এক জায়গায় বসে আছি, কামরুল বেরিয়ে গেছে। যখন বিষয়টা বুঝে এলো, তখন দ্রুত আমি ব্যাগ কাঁধে তুললাম। দলের একজন সদস্য রাগ করে একা চলে গেছে, এটা কোনোভাবেই সুসংবাদ নয়। সে রাগের মাথায় অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে। বাকিরাও ততক্ষণে উঠে পেড়েছে। সবাই-ই বেরিয়ে পড়লাম। সবাইকে রেখে আমি অনির্দিষ্টের পথে হাঁটা ধরলাম। কারণ, সামনে কোথাও কামরুলকে দেখা যাচ্ছে না।

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

_________________________

বিশেষ দ্রষ্টব্য: কথা দিচ্ছি, ইনশাল্লাহ, যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে, আগামী পর্বে দুটো প্যানোরামা আর একটা ভিডিও থাকবে।

শেষ পর্ব »

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (ভিডিও সাক্ষাৎকার)

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ধারাবাহিকটি চলছে অনেকদিন হলো। পাঠকদের আন্তরিক অভিনন্দন। এর ৯ম কিস্তির লেখা এখনও চলছে। সময় লাগছে, কারণ ব্যক্তিগত, পেশাগত, আর উইকিপিডিয়ার ব্যস্ততা। তবে খুব শিঘ্রই ইনশাল্লাহ আপনাদেরকে ৯ম কিস্তি উপহার দিতে পারবো বলে মনে হয়। সামনের কিস্তিগুলোতে থাকবে দুটো প্যানোরামা ছবি, আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

আপনাদের সাথে কথা ছিল, আমি রুমানা পাড়া বা রুমনা পাড়া’র কারবারির সাক্ষাৎকারের ভিডিওটা এডিট করে আপলোড করবো। নিজের অনভিজ্ঞতা আর ইন্টারনেট সংযোগের চরম দুর্বলতার দরুণ ভিডিওটা তিন দিনে অবশেষে আপলোড করেছি। একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি, কারবারি হলেন, পাহাড়ে, গ্রাম বা পাড়া-প্রধান।

-মঈনুল ইসলাম

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৮)

আমরা প্রচন্ড উচ্চতায় দীর্ঘ পথ বেয়ে রুমানা পাড়ায় উঠে যখন প্রচন্ড ক্লান্ত, তখন আবুবকর ঘোষণা করলেন তাঁরা দুটো ঝরণা দেখতে যাবেন, কে কে যাবে? “আমরা” বলতে যে, কামরুলকেও যোগ করা হচ্ছে, এটা নিশ্চিত; কারণ আমরা তিনজন ছাড়া কামরুলকে নিয়েই এই পথে ট্রেক করার পরিকল্পনা ছিল আবুবকরের। আর আমি তখন নিজের চিত্তের উপর বাজি ধরে রাজি হয়ে গেলাম চ্যালেঞ্জটা নেবার জন্য।

আবুবকর বললেন, ঝরণার ছবি তুলতে ক্যামেরা নিতে হবে। কিন্তু কামরুল প্রথমেই তার এসএলআরকে সরিয়ে রাখলো, না বাবা, আমি এই রিস্ক নিবো না। নাকিব কিংবা রাসেলও নিজেদের ক্যামেরা এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে নষ্ট করতে দিতে চাইলো না। আমি তখন সাহস করে বললাম, ঠিক আছে, আমি আমার আইফোন নিচ্ছি। (কারণ ওটা পকেটেই পুরে রাখা যায়)

ব্যস, আসন্ন অন্ধকারের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সবাই-ই টর্চ নিয়ে নিলাম, ব্যাগ রাখলাম কারবারির ঘরে, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এবারে আমি পুরাই পাঙ্খা হয়ে গেলাম। শুধু একটা পানির ছোট্ট বোতল নিয়ে নিলাম অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে। আমাদের দুই গাইডও চললো আমাদের সাথে, আপেলের হাতে আছে আমাদের আনা দা। কারবারির ছোট ভাই আমাদেরকে ঝরণা দেখাতে নিয়ে যাবে, তাই তাকে অনুসরণ করে আমরা চললাম দুটো ঝরণা দেখতে, যে-পথে উঠে এসেছিলাম এই চরম উচ্চতায়, সে-পথে আবার নিচের দিকে।

অন্ধকার হয়ে আসছে পথ, কিন্তু তাতে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই বিন্দুমাত্রও। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই— ঝরণা দেখতে হবে অন্ধকার নামার আগেই। পাহাড়ের চড়াই উঠা যতটা কঠিন, উৎরাই পেরোন তার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সেরকমটা হলো না, আমাদের শরীরের ওজন হালকা করায়। দ্রুতই নেমে গেল আমাদের ছয়জনের দলটা।

যে-পথে এসেছিলাম, সে-পথে নেমে নেমে সাঁকোর আগেই ডানদিকে একটা পাতাঝরা পথে আমাদের নিয়ে চললো কারবারির ভাই ‘লালহিম’। পথটা কিছুটা এগিয়ে নিচে নেমে গেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সামনে একটা ছোট্ট ঝিরি পার হবার জন্য একটা গাছ ফেলা, ধরার কোনো জায়গা নাই ওটাতে, ওটা ধরে দলটা খুব দ্রুতই পার হয়ে গেল।

এরপর হঠাৎ মনে পড়লো আমরা আসরের নামায পড়িনি। তাই দ্রুত ঝিরির পানিতে ওযু করে গামছা বিছিয়ে তিনজন আসর সেরে নিলাম। চললাম সামনে। এবারে কোমর পানি দিয়ে ঝিরি পেরোতে হলো। তারপর ঝিরি ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে শুনতে পেলাম ঝরণার শোঁ শোঁ আওয়াজ।

এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো একটা অল্প-উচ্চতার ঝরণা। ওটা নামতে তেমন কষ্ট হলো না। ওটা পেরিয়ে সামনে যেতেই হঠাৎ করে সামনে দেখা গেল কয়েক ফুট সামনে পায়ের নিচের পাথুরে জমিন উধাও।

বুঝতে কষ্ট হলো না, ওখানটাতেই ঝিরির পানি গিয়ে সবেগে আছড়ে পড়েছে নিচে। আবুবকর ভাই তাঁর কাজে ব্যস্ত, জিপিএস ট্র্যাক করছেন। আমি আমার ফোনখানা বের করে ছবি তুলতে চাইলাম। কিন্তু পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে মরতে চাইলাম না। কারণ ইতোমধ্যেই আবুবকর আমাদের জানিয়েছেন, স্থানীয়রা তাঁকে কী বলেছে: এখানে নাকি এক পাহাড়ি মেয়ে মারা গেছে ঝরণা থেকে পড়ে তারপরও গাইড বিকাশের হাত ধরে কোনো রকমে যথাসম্ভব সামনে ঝুঁকে, উপর থেকে ঝরণার ছবি নিতে চাইলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে, ফ্ল্যাশ ছাড়া প্রায়ান্ধকার ছবিগুলো কোনো মানেই রাখে না, তবুও, ছবি তো! (লালহিম পরে আমাদের নিশ্চিত করেছে, মারা যাওয়া সেই কিশোরি কিছুটা মানসিক বৈকল্যের শিকার ছিল।) (বিস্তারিত: পরিশিষ্ট ২-এ দেখুন)

উপর থেকে তোলা ঝরণার ছবি। (ছবি: লেখক)
উপর থেকে তোলা ঝরণার ছবি। (ছবি: লেখক)

এবার আবুবকর ডাকলেন আমায়। লালহিম আমাদেরকে ঝরণার পাশের একটা পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেল। পাহাড়ে উঠলাম। এরপর শুরু হলো নিচে নামা। খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামা। এই ব্যাপারটা এখন আমাদের যেনবা অভ্যাস হয়ে গেছে। তবুও সব সময়ই পাহাড়ে পাহাড়ে নতুন নতুন অবস্থা, নতুন নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন অনুষঙ্গের সাথে উঠতে-নামতে হয়, তাই থ্রিলটা সবসময়ই সমান প্রায়। লালহিম পথ তৈরি করা ছাড়াই নামছে। তাকে অনুসরণ করছে আমাদের গাইড বিকাশ আর আপেল। তাদের পিছনে আমরা।

গাছের শিকড়, ঝুলে থাকা ডাল, উপড়ে পড়া মোটা গাছ, মুখ-বের-করা পাথর, পাহাড়ি বাঁশের ঝোঁপ ধরে ধরে আমরা নামছি। আমাদের আপেল বাবাজি তার দা-খানা দিয়ে কোপ দিয়ে পথ পরিষ্কার করে করে নামছে। একসময় আবুবকর তার খুব কাছাকাছি চলে গেলেন। আর অমনি ও-ব্যাটা উপর থেকে মাটির দিকে দায়ের কোপ দিল, আর…

…সেই কোপ গিয়ে পড়লো আবুবকরের পায়ের আঙ্গুলে। রক্ত বেরোতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না। কিন্তু অত্যন্ত মনের জোর দিয়ে আবুবকর যখন বললেন, আরে, কিছু হয় নাই, তুমি এগোও —তখন সত্যিই মনে হলো এ ব্যাটা রোবট। আবুবকর প্রমাণ করলেন, তিনি আসলেই একজন অভিযাত্রী। এই পথ কিংবা জঞ্জাল পেরিয়ে আমরা অল্প সময়েই নেমে এলাম সেই ঝরণাটারই পাদদেশে।

অপূর্ব অনুভূতি। এই কিছুক্ষণ আগে যে ঝরণার উপরে দাঁড়িয়ে অসাধ্য কিছু বলে মনে হচ্ছিল, এখন সেই ঝরণার মালভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি তার সম্পূর্ণ দেহ। লালহিম জানালো, এটাই সেই তিন-ধাপ-ঝরণা। উপরে আমরা একটা ছোট্ট ধাপ রেখে এসেছি, এইমাত্র আমরা দ্বিতীয় ধাপটা উপর-নিচ থেকে দেখা সম্পন্ন করলাম আর তারও নিচে আছে তৃতীয় ধাপটা। ডানদিকে দ্বিতীয় ধাপটা রেখে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি আবারো পাথুরে জমিন কয়েক ফুট সামনে থেকে উধাও, তবে এখানে বেশ খাড়া ঝরণা।

দ্বিতীয় ধাপের পাদদেশ থেকে তোলা ছবি। (ছবি: লেখক)
দ্বিতীয় ধাপের পাদদেশ থেকে তোলা ছবি। (ছবি: লেখক)

আবুবকর জানালেন, খুব বেশি উঁচু না ঝরণার দ্বিতীয় ধাপটা: জিপিএস-এ দেখাচ্ছে ১৩২ ফুট। আমরা এগিয়ে গিয়ে তৃপ্তি ভরে পানি খেয়ে নিলাম। সেখানে দেখতে পেলাম দারুণ এক পাখি। কামরুল খুব মিস করলো পাখির ছবিগুলো। খুব ইচ্ছা করছিল, গোসল করে ফেলি। কিন্তু কেন জানিনা, সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে এখানে সময় নষ্ট না করার তাগিদ অনুভব করলো সবাই।

আমাদের খুব ইচ্ছা হলো নিচের ঝরণাটার ছবিও তোলা। লালহিম এবং পাহাড়িদের মতে ওটা আরো বেশি উঁচু। কিন্তু একেতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তার উপর আরো বেশি খাড়া পথ নামতে হবে। তাই আবুবকর একটা অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি শুধু লালহিমকে পাঠাবেন। লালহিম এই সিদ্ধান্তে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না বোধহয়। কিন্তু তাকে যেভাবে বুঝিয়ে দিলেন, সেভাবেই সে জিপিএস ডিভাইসটা নিয়ে চলে গেলো আবার পাহাড়ের ঢালে। সেখান ধরে সে যাবে নিচে, তৃতীয় ঝরণার পাদদেশে।

সে, ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই জিপিএস আপনা-আপনি ল্যাটিচিউড-লঙ্গিচিউড (ভৌগোলিক স্থানমান) আর এলেভেশন বা উচ্চতা ট্র্যাক করে নিবে। আমরা যখন দ্বিতীয় ঝরণার পাদদেশে দাঁড়িয়ে গুগল আর্থের মাহাত্ম-কীর্তন করছি, ততক্ষণে, এই মাত্র দেড় মিনিটের মাথায় লালহিম হাপাতে হাপাতে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। ওর অবস্থা দেখে আমরা সবাই-ই একটু বিচলিত হলাম, কী হয়েছে!

আবুবকর বুঝে গেলেন, তুমি ভয় পাইছো? লালহিম অস্বীকার না করলেও স্বীকার করলো না ঠিক, তবু তাকে দেখে বোঝা গেল, পাহাড়ে থাকলেও অন্ধকার পাহাড়কে সে ভয় করে, যখন একা থাকে। জিপিএস ডিভাইসটা হাতে নিয়ে এলেভেশন দেখলেন আবুবকর, দেখাচ্ছে ১৩০ ফুট। তাহলে কি পাহাড়িরা ভুল বলে? হিসাবে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপটাই বেশি উঁচু। (আমার আর কামরুলের এখন যথেষ্ট সন্দেহ হয়, ও ব্যাটা লালহিম হয়তো ভয়ে পুরোটা পথ নামেইনি, তাই হিসাবটা ভুল হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।) (পরিশিষ্ট ৩ দ্রষ্টব্য)

যাইহোক, আসন্ন অন্ধকারকে সমীহ করে আমরা উঠবার চিন্তা করলাম। আবারো সেই পথে উপরে উঠে আসতে লাগলাম আমরা। একটু আগে মোটামুটি আলোতে অনেক কিছু দেখা যাচ্ছিল, এখন গাছের ছায়ায় তা অনেক বেশি অন্ধকার লাগছে। তাই পায়ের নিচের মাটিটা কোথাও কোথাও আন্দাজ করেই পা ফেলতে হচ্ছে। উপরে উঠে এসে আমরা আর দেরি করলাম না। মাগরিবের নামায ওখানেই পড়ে নিয়ে পাড়ার দিকে চললাম। পথে নিজেদের জুতাটুতা ভালোমতো পরিষ্কার করে নিলাম। আরেকটা ঝরণা না দেখেই আমরা পাড়ার পথ ধরলাম।

আপেল চলেছে সামনে, আমি আর আপেল গল্প করতে করতে সবার সামনে এগোচ্ছি। বাকিরা আসছে পিছনে, বেশ কিছুটা পিছনে পড়ে গেছে গল্প করতে করতে। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয় — আমি এত কষ্টের পরও এখন আর শরীরে তেমন কষ্ট অনুভব করছি না। আর আপেলের সাথে তাড়াতাড়ি ওঠার প্র্যাক্টিসটা করতে করতে বেশ ভালোই উঠতে পারছি পাহাড়ি ছাগলের মতো। আমি নিজেকে একটা ছাগল ভেবে কি তৃপ্তি পেলাম?!!!

উঠে এলাম রুমানা পাড়ায়। অন্ধকার পাড়ায় তখন ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে, অবশ্যই কুপির আলো। এপর্যায়ে রুমানা পাড়া আর বমদের সম্পর্কে একটু বলি:

রুমানা পাড়া, একটা বম পাড়া। আগে নাম ছিল সানকুপ পাড়া, সেটা ছিল ‘সানকুপ’ নামক কারবারির নামে। রুমা খালের শেষে পাড়াটার অবস্থান বলে এর নাম রুমানা পাড়া হয়েছে পরে। অন্যান্য বম পাড়ার মতোই রুমানা পাড়াও যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাড়া-প্রধানকে বলা হয় ‘কারবারি’। পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও আছে একটা গির্জা। বমরা পিতৃতান্ত্রিক এবং মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় স্বর্ণালঙ্কার এবং গৃহস্থালি অনেক কিছু দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। এটা যৌতুক-প্রথার মতো হলেও ঠিক যৌতুক হিসেবে গণ্য হয় না, প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার ঘরগুলো বাঁশের তৈরি, চাল দেয়া শন বা খড় দিয়ে। জানালাগুলো থাই-জানালার মতো স্লাইডিং, তবে স্লাইডিং প্যানেলটা তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে, এবং বেশ সাবলীল (smooth)। রুমানা পাড়ার লোকজন বাজার করতে যায় রুমা বাজারে, সেটা মোটামুটি দুই দিনের কাজ। একদিন লাগে গিয়ে বাজার করতে, সেখানে একরাত থাকে, তার পরদিন বাজার নিয়ে ফিরে আসে তারা। কারবারিরা বংশপরম্পরায় কারবারি হয়ে থাকেন। তাঁরা সরকার থেকে রেশন পান, এবং সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে সেই রেশন পাড়ায় পৌঁছে দেয়।

পাড়াটার নাম “রুমানা” নাকি “রুমনা” —এই বিষয়ে কামরুল আর আমার মধ্যে মতভেদ আছে। আমি বলছি “রুমনা” কামরুল বলছে “রুমানা”, অবশ্য এব্যাপারে কামরুলের যুক্তিটা শক্তিশালী। আমি ‘রুমনা’ বলছি, কারণ কোনো এলাকার স্থানীয়রা যে নামে এলাকাটাকে ডাকে, তা-ই নাম হিসেবে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। যখনই তাদেরকে কোনো প্রভাবমুক্তভাবে নামটা বলতে দেয়া হয়, তখন তারা উচ্চারণ করে ‘রুমনা’। কামরুল ‘রুমানা’ বলছে, কারণ পাড়ার কারবারির মুখে সে শুনেছে ‘রুমানা’।

কারবারি আমাদেরকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে “রুমানা” নামটা না বম, না বাংলা, বরং এটা মারমা ভাষা। মারমা ভাষায় “রুঃ” মানে হলো “পাগল” আর “মা” মানে হলো “মেয়ে”। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই ‘রুমা খাল’ থেকে ‘রুমানা পাড়া’ নামকরণ হয়। এই ‘পাগল মেয়ে’ নামকরণে আছে দারুণ এক রোমান্টিকতা, নৃতাত্ত্বিক ঐকতান— য়িন-য়িয়াঙ, বৈপরিত্বের মিলন: একসময় রুমা খালে, বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ মারা যেত। যারা মারা যেত, তাদের মধ্যে নারী ছিল না, শুধু পুরুষরা মারা যেত। তাই রুমাকে, প্রকৃতিদেবী গণ্য করে আদিবাসীরা একে এক মেয়ে কল্পনা করে নেয়, আর সেই মেয়েই যেনবা ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছে এভাবে। তাই সেই মেয়ে হয়ে যায় ‘পাগল মেয়ে’, মানে ‘রুঃমা’, যা থেকে হয় ‘রুমা’।

এই যাবতীয় আলোচনা থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, কামরুলের দাবি ঠিক, অর্থাৎ মারমা ভাষা অনুযায়ী পাড়াটার নাম ‘রুমানা’ই ঠিক। কিন্তু বম ভাষার উচ্চারণশৈলীতে সম্ভবত ‘রুমানা’ উচ্চারিত হয় না, তাই তারা বলে ‘রুমনা’। এখন যেহেতু পাড়াটায় মারমা-রা নয়, বরং বমরা থাকে, তাই আমি এর ‘রুমনা’ নামকে অগ্রগণ্য ধরবো; কোন খাতায় কী লেখা আছে, সেসবের বিচার করতে আমি রাজি না।

যাহোক, আমরা ঝরণা দেখে অন্ধকার রাতে পরিশ্রান্ত হয়ে যখন কারবারির ঘরে ফিরে আসি, রাসেল তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে, আর নাকিব গল্প করছে কারবারির সাথে। কারবারি, আর-সব পাহাড়িদের মতো ছিপছিপে শরীরের একজন ক্লিন-শেভ্‌ড মানুষ, লুঙ্গি আর শার্ট পরে বসে আছেন নাকিবের পাশে। কুপির আলোয় পরিবেশটা বেশ সুন্দর।

কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, আমাদের গাইড বিকাশ বেশ রেগে আছে। কী হলো? শুনলাম, আমরা ঝরণায় যাবার আগেই কারবারির থেকে একটা মুরগি কিনে রেখে গেছেন আবুবকর। নাকিব আর রাসেলকে ওটার ওজন কত হয় দেখতে বলা হয়েছিল, নাকিব সেটা দেখে রেখেছে। কিন্তু এতক্ষণ আমরা আসিনি, ওরা কেন সেটা জবাই করে রাখলো না? ক্ষিধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। অথচ রান্নার সিকি ভাগও প্রস্তুত করা হয়নি।

রাগটা অযৌক্তিক না। ক্ষিধের ঠ্যালায় নাড়িভুড়ি হজম হবার জোগাড়। পা থেকে অ্যাংকলেট আর নী-ক্যাপ খুলে আমি আর আবুবকর গেলাম মুরগিটা, থুক্কু মোরগটা জবাই করতে। ওটাকে ঝুড়ির নিচ থেকে বের করে যতবারই আমি একহাতে ডানা আর পা আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে গলা ধরতে যাই, অমনি ডানা হাত থেকে ফসকে যায়। এভাবে তিনবার হবার পর, আবুবকর বেশ বিরক্ত হলেন। আমিও নিজের উপর বিরক্ত হলাম, [শ্লীল গালি] হাতের গ্রিপটা কি এতোটাই ছোট হলো যে, মোরগটা ধরতে পারছি না। …এবারে আবুবকর নিয়ে যখন ধরতে চাইলেন, তখনই আবিষ্কার করলাম আমরা, এরা, মোরগটার উড়ে যাওয়া রোধ করতে ডানাদুটো একসাথে করে পাটের রশি দিয়ে আটকে রেখেছে। তাই ডানা ছোট হয়ে যাওয়ায় আমার হাত থেকে ফসকাচ্ছিল। হয়তো এভাবেই এই পাহাড়ের চূঁড়ায় মোরগ পালে এরা। বাঁধন কাটার পরে বেশ সহজেই জবাই করা হলো ওটা। জবাই করার পর হাত ধুতে গিয়ে মনে পড়লো, এরা থাকে অনেক উঁচু পাহাড়ে, তাই পানির ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই মিতব্যয়ী হতে হবে। আমরা খুব অল্প পানি খরচ করে হাত ধুয়ে নিলাম।

পরে শুনলাম, নাকিবেরও সময়টা ঠিক ব্যস্ততাহীন কাটেনি। রাসেলকে রীতিমতো নার্সের মতো পরিচর্যা করেছে সে। মূভ দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়েছে। মালিশ করে দিয়েছে পা। ও বেচারাকে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুইয়ে দিয়েছে আরামের জন্য, যদিও নিজেও বেচারা ব্যথায় কাতর ছিল। কিন্তু মোরগটা জবাই না করার অপরাধ থেকে তবু তাকে অব্যহতি দেয়া গেল না।

হঠাৎ শোনা গেল ঢোলের দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। পাহাড়িরা জংলি গান ধরে বসলো নাকি —এমন প্রশ্নে যখন কপালটা কুঁচকে উঠতে যাচ্ছিল, তখন আবুবকর জানালেন গির্জা থেকে আসছে আওয়াজ। কান পেতে শুনলাম, সুরে সুরে লয়ে লয় মিলিয়ে গানের কথা ভেসে আসছে গির্জা থেকে, সাথে পড়ছে ঢোলের তাল। বুঝতে কষ্ট হলো না, শাস্ত্রীয় খ্রিস্টধর্ম এখানে এসে শাস্ত্র ধরে বেশ জুত করতে পারেনি, তাই পৌত্তলিক বমদের ধর্মান্তরিত করতে তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বাদ না দিয়ে ‘ধর্ম’ বানিয়ে জুড়ে নিয়েছে— এজন্য একে আমি বলি লৌকিক খ্রিস্টধর্ম।

গির্জার সার্মন শেষে ঘরে ঢুকলেন এক পুরুষ, হাতে একটা বই। জানতে পারলাম ওটা বাইবেল। তিনি আমাদের সাথে পরিপূর্ণ ইংরেজিতে কথা বললেন। তাঁর শুদ্ধ ইংরেজি বোলে জানা গেল, তিনি ভারতের ত্রিপুরাতে লেখাপড়া করেন। সেখানে যাবার বর্ণনা দিলেন, কী করে তাঁরা পাহাড়ের পর পাহাড়, উঁচু উঁচু পাহাড় পায়ে হেঁটে কয়েকদিন পরে গিয়ে ত্রিপুরার বর্ডার পার হোন। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা যাবার এই বর্ণনা যতটা না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় এক সাধারণ বম যুবকের শিক্ষা-স্পৃহা। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান না, কারবারি নিজেই অসন্তুষ্ট চিত্তে তাঁর ছোট ভাই লালহিমের বদনাম করলেন, ফাইভ পর্যন্ত পড়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে সে।

একদিকে বিকাশ আর আপেল মিলে মোরগ কেটে ধুতে লাগলো, তাদেরকে সহায়তা করলো লালহিম আর কামরুল, আমিও পরে গিয়ে সঙ্গী হলাম। মোরগ ধোয়া শেষ করে কারবারির রান্নাঘরেই রান্না করতে বসলো বিকাশ। আরেকটা কুমড়া কাটা হয়েছে, আপেল আর লালহিম কেটে-কুটে একটা পাত্রে রাখছে। কামরুল আর আমি যখন পরে ওদের সাথে যোগ দিলাম, তখন কামরুল আবিষ্কার করলো, ক্ষিধে পেটে ঐ কাচা কাচা কুমড়া বেশ দারুণ উপাদেয় খাবার হয়ে উঠতে পারে। কামরুলকে দেখে আমিও এক টুকরা নিয়ে মুখে পুরে তাজ্জব বনে গেলাম, বেশ মিষ্টি, কুমড়াটা। কাচা কাচাই কামড়ে খাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। আমি আর কামরুল অনেকক্ষণ ধরেই খেয়ে গেলাম ঐ কাচা কুমড়া। বিষয়টা আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল।

আমরা যখন রান্নাবাটি খেলছিলাম, থুক্কু, করছিলাম, তখন ওদিকে আবুবকর আর রাসেল মিলে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন কারবারির। আর নাকিব তুলছিল স্থিরচিত্র। কুপির আলোয় ক্যামেরার ভিডিওতে চেহারা দেখার প্রশ্নই উঠে না, তাই নাকিব ওর এলইডি-চার্জলাইটটা জ্বালিয়ে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করলো। কিন্তু ভিডিওটা দেখার পরে বোঝা গেলো স্টুডিওর আলো কেন এতো উজ্জ্বল কিসিমের হয়। রাসেল তার বয়ে আনা ক্যামেরাটাকে ট্রাইপডের উপর বসিয়ে ভিডিও করার দায়িত্ব নিল। আবুবকর আর রাসেল প্রশ্ন করে উত্তর বের করতে থাকলেন কারবারির থেকে।

আবুবকর আর রাসেল সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন কারবারির। উৎসুক লালহিম দেখছে ক্যামেরার ফ্রেমে বড় ভাইয়ের ফ্যান্টম চেহারা। (ছবি: নাকিব)
আবুবকর আর রাসেল সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন কারবারির। উৎসুক লালহিম দেখছে ক্যামেরার ফ্রেমে বড় ভাইয়ের ফ্যান্টম চেহারা। (ছবি: নাকিব)

এদিকে যখন এই ডকুমেন্টারি নির্মাণ চলছিল, তখন আমরা রান্নাঘরে বসে গল্প করছিলাম। বিকাশ রান্না করছে, আমরা প্রয়োজনীয় সহায়তা করছিলাম। কারবারির ঘর থেকে একটা ডেকচি ধার করা হয়েছে। যে হাতাটা দিয়ে নাড়ছে বিকাশ, ওটা একটা বাঁশের টুকরা, একটা ছোট্ট কঞ্চিসহ কাটা হয়েছে টুকরাটা। এরকম প্রাকৃতিক জিনিসই পাহাড়িদের নিত্যসঙ্গী। চুলাটা তৈরি করা হয়েছে কাঠের মেঝের উপর মাটি জমা করে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে তার উপর। চুলার তিনটা পায়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শিল-পাটার শিলের মতো দেখতে তিনটা লম্বাটে পাথর। চুলার কয়লা নেড়ে দেয়ার জন্য এক টুকরা বাঁশকে গরম করে বাঁকিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক চিমটা। একটা কুপি সাধারণ বাঙালি ঘরাণার হলেও আরেকটা কুপি ছিল আকর্ষণীয়: একটা টিনের পটের মধ্যে ভরা হয়েছে মাটি। তার মধ্যে গেঁথে একটা টিনের ফানেল দাঁড় করানো হয়েছে। ফানেলটাই আসল কুপির আঁধার, ওটার উপরটা বন্ধ করে কুপির সরঞ্জাম যুক্ত করা হয়েছে। এসব ছাড়াও এদের নিজস্ব নিচ-চারকোণা-উপর-ছড়ানো-গোলাকৃতি ঝুড়ি, লম্বাটে কিরিচ-আকৃতির দা, বাঁশের ঘুটনি ইত্যাদি তো আছেই।

রান্নাবাটি: বিকাশ শেফ, আপেল আর লালহিম কুমড়া জবাই করছে, কামরুল আর আমি সহায়তা করছিলাম, কিন্তু নাকিবকে ক্যামেরা হাতে দেখে কুমড়া খেয়ে দেখালাম, কিভাবে একটু আগেই আমরা কাচা কুমড়া-খোর ছিলাম। (ছবি: নাকিব)
রান্নাবাটি: বিকাশ শেফ, আপেল আর লালহিম কুমড়া জবাই করছে, কামরুল আর আমি সহায়তা করছিলাম, কিন্তু নাকিবকে ক্যামেরা হাতে দেখে কুমড়া খেয়ে দেখালাম, কিভাবে একটু আগেই আমরা কাচা কুমড়া-খোর ছিলাম। (ছবি: নাকিব)

আমাদের বিকাশ বাবাজি, রান্না করতে করতে গল্প করছিল, যেকোনো পাহাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হলো বম মেয়েরাই। ও বেচারা বম মেয়েদের খুব ভক্ত। কিছুক্ষণ পরেই তার কারণ এবং যৌক্তিকতা পাওয়া গেল, কেননা এই বেচারা ইতোমধ্যেই এক বম পাড়ার একজন বম মেয়ের কাছে নিজের হৃদয়টাকে বন্ধক রেখেছে। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা সংকোচ আর কিছুটা গাল-লাল-করা ভালোবাসার আহ্লাদে মোবাইল বের করে নায়িকার ছবিখানাও কামরুলকে দেখিয়ে দিল।

যাহোক, রান্না হয়ে গেলে আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে ওদের সবাইকে ডেকে আমরা খেতে বসে গেলাম। লালহিমও আমাদের সাথে খাবে। খেতে বসে আর দেরি করলাম না। ক্ষিধায় যে পেট জ্বলে যাবার জোগাড়। খাবার মুখে দিতেই স্বাদ ছাপিয়ে যে জিনিসটা মুখে লাগলো, তা হলো গরম আর ঝাল। প্রচন্ড ঝাল করে রেঁধেছে বিকাশ। আমি ঝাল প্রায় খাই-ই না, কিন্তু এত্ত ঝাল, তবু ক্ষিধার ঠ্যালায় পটাপট গিলছি। বাকিদেরও একই দশা— বিকাশ, আপেল আর লালহীম অবশ্য ব্যতিক্রম।

এই ঝালের কারণ জানতে চাইলে বিকাশ জানালো, পাহাড়িদের নাকি এই ঝালের কারণেই ম্যালেরিয়া হয় না। সত্য-মিথ্যা কিংবা ডাক্তারি বিদ্যার প্রমাণ আমার কাছে নেই, তবে এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধকের কথা আমায় বেশ আকর্ষণ করলো। কারণ সোয়াইন ফ্লু যখন দেখা দিয়েছিল, তখন একদল জাপানি বিশেষজ্ঞ জানালেন, যেসকল দেশে মশলাদার খাবার বেশি খাওয়া হয়, সেসকল দেশে সোয়াইন ফ্লু খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। সোয়াইন ফ্লু, মশার কারণে না হলেও দুটোর মধ্যে একটা সূত্র মিল পড়ায় বিষয়টা আমার কাছে যৌক্তিকই মনে হলো।

খেয়ে-দেয়ে আমরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। সামনের ঘরটায়, মানে, কারবারির একমাত্র ঘরটায়ই আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা। এই ঘরটার পাশেই শ্রেফ একটা রান্নাঘর ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। ঘরটার একপাশে কারবারির পরিবার, আরেক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে আমাদের শোবার ব্যবস্থা। “শোবার ব্যবস্থা” শুনে মনে করার দরকার নেই, একেবারে খাট-পালং দিয়ে শোবার ব্যবস্থা। একইভাবে, কয়েক প্রস্থ কম্বল দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিচে আর উপরে দিয়ে বাঁশের চাটাইয়ের মেঝেতেই ঘুমানোর বন্দোবস্ত করা হলো। শোবার আগে সেদিনও পেইন কিলার খেয়ে নিলাম। মশা এখানেও নেই দেখে, ওডোমস মাখলাম না। (ওডোমস হলো মশা নিরোধক মলমবিশেষ)

ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ফযরের নামায পড়ে আরেকটা দিন শুরু করার প্রস্তুতি নিলাম। নাকিব, খুব ভোরেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা সেরে ফেলেছে। ঠিক নাস্তা করার আগ-মুহূর্তে রাসেলের আবারো যখন কাজটায় যাবার প্রয়োজন হলো, তখন সবাই যার-পর-নাই বিরক্ত হলো। কামরুল ওকে সঙ্গ দিল। আমিও যে মহাপুরুষ, সব বন্ধ করে বসে আছি, ব্যাপারটা তা না। গত রাতে, শান্ত পরিবেশে, আমার টর্চ নিয়ে একটা ল্যাট্রিনে বসে কাজ সেরে নিয়েছিলাম। ল্যাট্রিনটা পাহাড়ের খাঁজে বসানো, নিচে কিছু বাঁশ দিয়ে একটা পাটাতন বানিয়ে, তার মাঝখানে গর্ত রাখা হয়েছে। চট দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটাকে ‘চেষ্টা’ বলাটাই সমিচীন হবে। রাতে উপদ্রব না থাকলেও, সকালে নাকিব এবং রাসেলের অভিজ্ঞতা হয়েছে, ওরা যখন কাজ সারছে, ঠিক নিচে গপাগপ তা সাবাড় করায় ব্যস্ত ছিল বম পাড়ার পালিত বরাহরা।

নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকার সময় হঠাৎ রাসেলের চোখ পড়লো রান্নাঘরের মেঝেতে কারবারির ছোট্ট বল্টুটা হাতে, পাহাড়িদের বড় দা নিয়ে বসে বসে জুম থেকে তুলে আনা আদার টুকরায় কোপ বসাচ্ছে। নাকিব ক্যামেরা বের করতে করতে দৃশ্যটা মিস হয়ে গেল। তবে দৃশ্যটা যতটা না উপভোগ্য ছিল, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কজনক ছিল আমাদের জন্য।

কারবারির পিচ্চিটা সুযোগ বুঝে দা বের করে আদা কাটতে বসেছে, আতঙ্কজনক দৃশ্য! (ছবি: নাকিব)
কারবারির পিচ্চিটা সুযোগ বুঝে দা বের করে আদা কাটতে বসেছে, আতঙ্কজনক দৃশ্য! (ছবি: নাকিব)

যাহোক, রাতের খাবারের রেখে দেয়া অংশটুকু খেয়ে উফ্‌-আফ্‌ করতে করতে অবশেষে বেরোলাম আমরা কারবারির ঘর থেকে। যাবার আগে কারবারিকে তাঁর বিল পরিশোধ করলেন আবুবকর, মোরগের দাম শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ হলেও আবুবকর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব শান্ত কন্ঠেই বিষয়টার ইস্তফা দিয়ে (পরিশিষ্ট ১ দ্রষ্টব্য) ইতি টানলেন রুমানা পাড়ার। সাকুল্যে কারবারিকে দেয়া হলো ৳১,২০০ (মোরগের দামই ছয়শো-সাতশো’র উপরে ছিল)।

রুমানা পাড়া খুবই ছিমছাম, পরিষ্কার পাড়া। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলোয় চোখ যা বোলানো যায়, ততটুকু বোলালাম আমরা। এখানকার ঘরগুলো এক কিংবা বড়জোর দুই কক্ষের, পেছন দিকে থাকে বারান্দার মতো বড় একটা বাড়তি অংশ: যেখানে পানি ফেলা, হাত-পা ধোয়া, বাচ্চাদের পেশাব করানো থেকে শুরু করে বাঁশের ফাঁক গলে নিজেদের মুত্র বিসর্জনের কাজও তারা সেরে থাকে।

বিদায়ের প্রাক্কালে, রুমানা পাড়ার এক ঘরের সামনে কামরুল আর নাকিব। (ছবি: লেখক)
বিদায়ের প্রাক্কালে, রুমানা পাড়ার এক ঘরের সামনে কামরুল আর নাকিব। (ছবি: লেখক)

একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, বম পাড়ায় নারকেল গাছ। বেশ কিছু ঘরের পাশে বেড়া দিয়ে নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে। এর একটা বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, তা ওরা না জেনেই হয়তো কাজটা করে। কারণটা হলো, বজ্রপাত। নারকেল গাছ, বজ্রপাত আকর্ষণ করে। ফলে, কোনো ঘর কিংবা মানুষের গায়ে না পড়ে, তা নারকেল গাছের উপর পড়ে, মানুষের জীবন বাঁচে। আর, রুমানা পাড়ার মতো উঁচু বম পাড়াগুলোর জন্য এগুলোর গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ মেঘের স্তরের খুব কাছাকাছি, এমনকি মেঘের স্তরেই থাকে পাড়াগুলো।

আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে লালহিম। সে আমাদেরকে গতকালকের অবশিষ্ট ঝরণাটা দেখিয়ে দিয়ে চলে আসবে। আমাদের পথটা ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নিচে নামছে। আজকের গন্তব্য? অবশ্যই সামনের ঝরণাটি। কিন্তু তারপর?

অনাকাঙ্ক্ষিত ক’টি উৎসের পথে আমাদের পথ যে চলবে, সেটা জানা ছিল না তখনও আমার। আবুবকর যেন গভীর এক ষড়যন্ত্র করলেন!

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

___________________________________________________________________

পরিশিষ্ট ১:

কিছুদিন আগে রুমানা পাড়ার কারবারি নাকিবকে ফোন করেছিলেন, মানে মি’ছা কল দিলে নাকিব ফোন করে। তিনি রুমা বাজারে বাজার করতে এসেছিলেন (দুই দিনের ফাঁড়ি)। আমাদেরকে আবারো আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর পাড়ায়। …এখানে একটু বলে রাখি, ওখানে মোরগের এতো দাম হওয়ার কারণ হলো তাদেরকে ওখানে অনেক কষ্ট করে পালন করতে হয় ওগুলো।

পুনশ্চ, যাদের কাছে মনে হচ্ছে এই ভ্রমণ-বৃত্তান্তটা খুব বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে, তাদের অবগতির জন্য জানাতে চাচ্ছি, এটা একজন ভ্রমণকারীর বৃত্তান্তের চেয়ে একটু বেশিই একজন ভবিষ্যত ভ্রমণকারীর তথ্য-ভাণ্ডার। তাই এতে তথ্য যথাসম্ভব দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে কোনো কার্পণ্য না করেই।

পরিশিষ্ট ২ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫):

ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স-এর শ্রদ্ধেয় আকাশ ভাই বলছেন, ঝরণার নাম “জিংসিয়াম সাইতার”, যার মূল নামকরণ করা হয়েছিল “জিংসিয়াম (যুবতির নাম – Zingsiam) ত্লাকনাক (তিন ধাপ – Tlaknak) সাইতার (ঝরণা – Saitar)”- নামকরণে জড়িত ছিলেন ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স দল, নতুন রুমনা পাড়ার কারবারি কাপ্রিং ব্যোম, এবং জিংসিয়ামের আপন ভাই ন্যল ব্যোম । ঝরণাটিতে যে মেয়ে মারা গিয়েছিল, সে কিশোরী নয়, বরং ২৪/২৫ বছরের যুবতি ছিল। এই মৃত্যু নিয়ে উদ্ভট এবং বিকৃত বিভিন্ন তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। এজন্য প্রকৃত ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো:

মেয়েটি মারা গেছে ঝরণার পাশের পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে। যেখানে মারা গিয়েছিল, তার ভৌগোলিক স্থানাংক হলো 21°57’42.61″N 92°32’30.37″E। স্থানটা ঝরণার দ্বিতীয় ধাপের কাছে আর রুমনা পাড়ার সীমানার মধ্যে। রুমনা পাড়ার কারবারি আর গির্জার সার্মনদাতার ভাষ্য শুনে এবং মেয়েটির ভাই নল-এর দেয়া তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, মেয়েটির এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগ ছিল। একদিন সকালে সে ঐ পাহাড়ে কাজে যায় এবং রাত পর্যন্ত পাড়ায় ফিরেনি। তাই রাতে পাড়ার লোকজন তাকে খুজতে বের হন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে পাহাড়ের ঢালে তার ঝুড়ি আর দা দেখতে পান এবং ওখান থেকে কিছু পাতা ঝর্ণার দিকে সরানো ছিল (মানুষ পড়ে গেলে যেমনটা হয়)। লোকজন ঝর্ণার নিচে নেমে তাকে মাথা ফাটা আর হাত ভাঙ্গা অবস্থায় মৃত দেখতে পান (ঐ স্থান থেকে ঝর্ণার উচ্চতা ১২৮ ফুট)। এ থেকে ধারণা করা হয় সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। পাড়ার লোকজন লাশ না তুলে আর্মি ক্যাম্প-এ খবর দেয় এবং আর্মির অনুমতি নিয়ে লাশ, পাড়ায় আনতে আনতে রাত আনুমানিক ২টা বাজে। ঐদিন পাড়ায় কোনো পর্যটক ছিলেন না বা আসেনওনি। এবং এটা এখনকার পর্যটনস্বর্গ বান্দরবানের ঘটনা না, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। – তথ্যগুলো আবুবকর ভাই এবং সম্ভ্রান্ত ট্রেকিং ও গবেষক দল ডি’ওয়ে এক্সপেডিটর্‌স থেকে নিশ্চিত হয়ে লিখছি।

পরিশিষ্ট ৩ (সংযোজন: ১৪ আগস্ট ২০১৫):

ঝরণাটির ধাপের বর্ণনায় আমার একটা ভুল আছে: যেটাকে এখানে প্রথম ধাপ বলা হয়েছে, সেটা আসলে ধাপ হিসেবে গণ্য হবেই না। যেটাকে এখানে দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে বর্ণনা করা আছে, সেটা আসলে প্রথম ধাপ। আর এরও নিচে আরো দুটো ধাপ আছে।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৭)

 

হতাশায় যখন নেমে আসছি বেতকাঁটায় আটকে আটকে, তখন মোটেই ভালো লাগছিল না আমার। নিচে নেমে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। হতাশাটা আমি নাকিবের মাঝেও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আঁশ। দলনেতা আবুবকর একটা সূক্ষ্ম পথ যেন দেখতে পেলেন। সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন দুই গাইডকে।

নির্দেশনামতো, গাইডরা আলোচনা করতে গেল ঐ দুই পাহাড়ির সাথে, আগের ঝরণাটায়। আবুবকর বাতলে দিলেন, ওঁদেরকে বলেন, আমাদের একটু উপকার করতে, পথ পাচ্ছি না আমরা, আমাদেরকে একটু পথ দেখিয়ে দিতে বলেন, আগে থেকে টাকা-পয়সার কথা বলার দরকার নেই।

হয়তো অসম্মতি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর আমাদের সহায় হলেন। ঐ দুই ব্যক্তি আমাদেরকে ঝরণাটা পার হতে সহায়তা করবেন। কিন্তু, ওমা!

…ওরা দেখি বীরদর্পে এগিয়ে এসে হাতের দা দিয়ে ঝরণার একেবারে লাগোয়া ৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়টার ঝোঁপ-ঝাড় কাঁটা শুরু করলেন। আমার তো মাথা নষ্ট— এরা এই দিকে উঠতে বলবে নাতো!! দেখা গেল ব্যাপারটা তাই। আবুবকর, দলকে তাড়া দিলেন, ‘সবাই খুব তাড়াতাড়ি করেন। এরা আপনাদের জন্য থেমে থাকবে না।’ আল্লা’র নাম নিয়ে শুরু করলাম ওদের পিছু পিছু। থাকলাম, সবার পিছনে।

এই ঝরণাটা বেশ সুন্দর, এর বর্ণনা করিনি এখানে তেমন, কারণ এই ডেড এন্ডে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল হতাশা (ছবি: লেখক)
এই ঝরণাটা বেশ সুন্দর, এর বর্ণনা করিনি এখানে তেমন, কারণ এই ডেড এন্ডে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল হতাশা (ছবি: লেখক)

আর এই প্রথম সার্ভাইভাল গাইডটার কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, যদি তুমি তোমার হতাশাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পার, তাহলে তা তোমায় উৎরে দিবে, কর্মোদ্যম বাড়িয়ে দিবে। তর তর করে বেয়ে উঠতে লাগলাম ঐ চূড়ান্ত খাঁড়া ঢাল। আমার ডান হাতের কনুই ভাঙা, ভিতরে দুটো স্পাইক ভরা; কিন্তু উঠতে লাগলাম সুস্থ মানুষের মতো। ওদিকে পাহাড়ি দুজন পাখির মতো তরতরিয়ে ঝোঁপ সাফ করে করে উঠে যেতে লাগলেন। আবারো নাকিবকে সহায়তা করতে থাকলাম। উঠতে উঠতে খেয়ালই করলাম না, কখন উঠে গেলাম আমরা পাহাড়টার চূঁড়ায়। তাকিয়ে দেখি, রাসেলও পেরেছে।

এটা অবিশ্বাস্য! সত্যি অবিশ্বাস্য!! এই অসম্ভবকে কিভাবে সম্ভব করলাম আমরা!!! …ঠিক তখনই বুঝে গেলাম, কোনো ব্যাপারই না আমাদের এই ট্রেইলে যেকোনো, হ্যা, যেকোনো বাধা ডিঙানো, ইনশাল্লাহ।

আমি এদিকে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চিন্তা করছি, ওদিকে দল চলে গেছে অনেক সামনে। এই উঠার কোনো ছবি নেই, তোলার প্রশ্নই উঠে না, সত্যি। তবু এই অভিজ্ঞতা আমাদেরকে মনোবল যোগাবে আজীবন। এবার এগিয়ে চলা: দুই পাহাড়ি যেনবা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তাদেরকে অনুসরণ করছে আবুবকর আর বাকিরা। আমি, নাকিব আর রাসেল পিছিয়ে পড়লাম। রাসেলকে রেখে এগিয়ে যেতে পারছি না, আর ইচ্ছে করে যাচ্ছিও না। কারণ আবুবকর শিখিয়েছেন, যে সবার পিছনে থাকে, সে পিছিয়ে পড়তে থাকে।

রাসেল তার ক্ষতিগ্রস্থ পা টেনে টেনে চলছে। পাথুরে ঝিরিতে গতি বাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব না। ওদিকে দলও চলে যাচ্ছে অনেক সামনে। সামনের বাঁক পেরিয়ে যাওয়ায় ওদের দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে ওরা ‘কুউউ’ বলে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, ওরা সামনে আছে, আমরা কি আসছি কিনা। প্রত্যুত্তরে আমিও চিৎকার করে জানান দিচ্ছি, আসছি, এগোও। আমি ঠিক করলাম, রাসেলকে সেনা কায়দায় একটু মোটিভেট করা যাক, পেছন থেকে তাড়া দিতে থাকলাম। বলতে থাকলাম, “মূভ, মূভ। …হ্যা হ্যা মূভ… পা চালাও।”

এভাবে চলতে থাকলাম আমরা। কিন্তু রাসেল বেশ বিরক্ত হলো, “আরে বাবা চলতে পারলে তো…”। সবই বুঝি, কিন্তু ওকে বসে পড়বার সুযোগ দিলে ও’ আর উঠতে পারবে না। চলতে থাকলেই ও চলতে পারবে শেষাবধি।

অনেক দূর পথ আমরা খুব অল্প সময়ে, বলতে গেলে প্রায় দৌঁড়েই চলে এলাম। নাকিবও বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে দলটা থামলো একটা দুমাথা ঝিরির সংযোগস্থলে। ঝিরিটা এখানে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে, একটা গেছে সোজা সামনে, আরেকটা গেছে ডান দিকে। দুই পাহাড়ি এখানে কেন থামালেন?

জানা গেল, তারা আমাদেরকে রুমানা পাড়ার একটা সম্ভাব্য (নিশ্চিত নয়) পথের সন্ধান দিচ্ছেন, আর সেটা এখান থেকেই শুরু। তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে দুটো ম্যাংগো বার খেতে দিয়ে বিদায় জানানো হলো। দলনেতা আবুবকর নির্দেশ দিলেন, সবাইকে পানি নিয়ে নিতে। কারণ এখান থেকে আমাদের পাহাড়ে উঠতে হবে, আমরা এবারে ঝিরি ছেড়ে দিব, আর পানির উৎস থাকবে না। আমরা পাথরের উপর বসে একটা বিস্কুটের প্যাকেট সাবাড় করে দিলাম।

খাবারের প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়, কামরুল আর আবুবকর তাদের নিজেদের জন্য বেশ কিছু খেজুর আর চকলেট এনেছিল। পাহাড়ে চড়ার এবং চলার জন্য খেজুর খুব উপাদেয় খাদ্য। তারা সেগুলো আমাদের সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল গত রাতে এনেঙ পাড়ায়ই। পথে হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায়ই সেগুলো থেকে কিছুটা দিয়ে নিজেদের মুখকে ব্যস্ত রেখেছি।

তবুও বিস্কুট খেয়ে তারপর পানি খেয়ে নিলাম সবাই। আমার বোতল খানিকটা সবসময়ই ভরা ছিল, তারপরও ভালো করে ভরে নিলাম। প্রশ্রাব করে পরিষ্কার হয়ে গেলাম সবাই।

সামনের দিকে একটা ঝিরি, ডান দিকে একটা ঝিরি আর ঠিক বাম দিকে একটা পাহাড়ে ওঠার পথ। এটাই হয়তো গেছে রুমানা পাড়ায়। আমাদের ওঠা শুরু। এটা হলো নিরবিচ্ছিন্ন পাহাড়ে ওঠা, এর মানে হলো আমরা অনবরত উঠতেই থাকবো অনেকক্ষণ ধরে। এটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

রাসেলকে সবার সামনে দেয়া হলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পিছিয়ে পড়তে শুরু করলো। সবাইকে এগিয়ে যেতে দিয়ে রাসেল রইলো পিছনের দিকে। এবারে ওর কষ্ট একটু বেশি হচ্ছে, কারণ ও ডান পা ভাঁজ করতে পারছিল না হাঁটুর ব্যাথার কারণে। আর সমতলে হাঁটার সময় পা বেশি ভাঁজ করতে হয় না, কিন্তু পাহাড়ে ওঠার সময় পা বেশ ভালোমত বাঁকা তো করতেই হয়, পায়ের উপর চাপ রেখে শরীরটাকে তোলার সময় শরীরের ওজনটা গিয়ে পড়ে ঐ হাঁটুতেই। রাসেলের রীতিমতো কষ্ট হতে লাগলো।

কামরুল আগে থেকেই রাসেলকে সঙ্গ দিচ্ছে যখন দরকার, এবারে সে থেকে গেল রাসেলের পিছনে। আমি থাকলাম ওর সাথে। ভ্রমণের শুরুতে কামরুলকে “আছেন”-জাতীয় আপনি সম্বোধন করলেও এখন বেশ “তুমি..তুমি” এমনকি “তুই…তুইও” করছি সবাই। এবং এই প্রথম কামরুল জানলো যে, রাসেলের শুধু বাম পায়ের পাতায় নয়, ডান পায়ের হাঁটুতেও ব্যাথা পেয়েছে।

যাহোক, পাহাড়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা না। বন্ধু সাকিব বলে দিয়েছিল, পাহাড়ে ওঠার সময় এক বোতল পানিও মনে হয় অনেক বড় বোঝা। তার কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য মনে হচ্ছে। একটুখানি উঠলেই শরীরে ক্লান্তি ধরতে চায়। বিশেষ করে হাঁটুতে চাপ পড়ে খুব বেশি। দুদিন ধরে হাঁটার পর পরিশ্রান্ত পায়ের হাঁটু নিশ্চয়ই এই ধকল সওয়ার জন্য প্রস্তুত না। আবার অন্য বিচারে কিছুটা হলেও প্রস্তুত, পরিশ্রম করতে করতে বেশ ধাতস্থ হয়ে গেছে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু তবু কষ্ট হতে থাকে। তারপরও আমি যথেষ্ট দ্রুত উঠতে পারতাম (কামরুল বলছিলও), কিন্তু রাসেল, আর, তাকে সাপোর্ট দেয়া কামরুলকে ফেলে রেখে উঠতে ঠিক মন চাইলো না।

রাসেল পাঁচ-সাত পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিশ্রাম নিয়ে আবার উঠছে। কোথাও কোথাও তার পাছায় ঠ্যালা দিয়ে তাকে সহায়তা করার দরকার পড়ছে। পানি চাইলো রাসেল, আমি বোতলটা বের করে দিয়ে বললাম, অল্প খেতে। কারণ দুটো: (১) পানি আমারও লাগবে, এবং পাহাড় থেকে না নামা পর্যন্ত পানি চাইলেও পাবো না; (২) সার্ভাইভাল গাইডে পড়েছি, একসাথে বেশি পানি নয়, অল্প অল্প কিন্তু নিয়মিত পানি পান করতে হয়। কিন্তু আমার কারণদুটো আমার মনেই থাকলো, ও বেচারা আমার পুরো বোতলটাই সাবাড় করে দিলো। কিছুটা মেজাজ খারাপও হলো, কিন্তু অসুস্থ মানুষকে দিয়ে পানি বহন করানোটাও ঠিক সমর্থন করলো না মন।

কিছুটা উঠেই জিরিয়ে নিচ্ছিল রাসেল, পথটা অনেক বেশি খাড়া, ওর জন্য একটু বেশিই (ছবি: লেখক)
কিছুটা উঠেই জিরিয়ে নিচ্ছিল রাসেল, পথটা অনেক বেশি খাড়া, ওর জন্য একটু বেশিই (ছবি: লেখক)

এভাবে ধীরে ধীরে উঠছি আমরা। উপরে উঠতে উঠতে আমরা অনেক উপরে উঠে গিয়েও দেখি পথ আর ফুরাবার নয়। উঠছি তো উঠছিই। উপরে উঠেও ওদের দেখা পাচ্ছি না, অনেক আগে চলে গেছে ওরা। কামরুল আমাকে ইঙ্গিতে বললো, আবুবকরের এই উদাসীনতা ওর ভাল্লাগছে না। এটা ঠিক না। বেচারার হেল্পওতো লাগতে পারে। আবুবকরের সেনা-অধ্যায়ের ‘রাসেল’ অংশটায় কামরুল মতদ্বৈততায় ভুগছে।

উপরে উঠতে উঠতে একসময় পিছন ফিরে তাকালাম। বিকেল সাড়ে চারটার পড়ন্ত রোদে পিছনের পাহাড়টা কিংবা অপূর্ব পাহাড়ের সারি দেখার মতোই। কিন্তু আমার কাছে আইফোনটা ছাড়া কোনো ক্যামেরা নেই, কামরুলও ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার অবস্থায় নেই। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে ফোনেই তুললাম ছবি।

পেছন ফিরে দেখা বিকেলের অস্তমিত সূর্যের আলোয় পাহাড়ি দৃশ্য (ছবি: লেখক)
পেছন ফিরে দেখা বিকেলের অস্তমিত সূর্যের আলোয় পাহাড়ি দৃশ্য (ছবি: লেখক)

একটা প্রশ্ন সব সময় আমাকে কুঁড়ে খেত যে, মানুষ এতো বোকা কেন, চলার পথে সামনে কোনো পাহাড় পড়লে মানুষ সেটা ডিঙাতে যায় কোন দুঃখে, মানুষ চাইলেই আরো কম কষ্টে পাহাড়টাকে মাঝখানে রেখে পাশ কাটিয়ে ওপাশে চলে যেতে পারে। কিন্তু এবার আমার ভুল ভাঙলো, কারণ যেখানে এরকম পাহাড় আছে, সেটা আসলে পাহাড় নয়, পাহাড়শ্রেণী। পাশাপাশি একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অনেকগুলো পাহাড়। তাই যদি আপনি পাহাড় না ডিঙিয়ে পাশ কাটাতে যান, তাহলে সেটা শ্রেফ পন্ডশ্রম হবে, কারণ মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এরকম পাহাড়শ্রেণীর ওমাথায় গিয়ে পাশ কাটিয়ে ওপারে যাওয়া আর মঙ্গল গ্রহে যাওয়া এক কথা।

আমাদের পথ উপরে উঠছেই, উঠছেই। আমি শঙ্কিত হলাম, কারণ ঐ পাহাড়ি দুজন আমাদেরকে নিশ্চিত করতে পারেননি এটাই রুমানা পাড়ার পথ কিনা। যদি এত্তো এত্তো কষ্ট করার পর সাব্যস্ত হয় যে, আমরা ভুল পথ ধরেছি, তাহলে সেটা শুধু বিপদজনকই হবে না, খুব বেশি হতাশাজনকও হবে। সার্ভাইভাল পরিস্থিতিতে হতাশা, অন্যান্য ফিযিক্যাল বিপদ থেকে অনেক বেশি বিপদজনক।

উপর থেকে কেউ আমাদেরকে ডাক দিল, আমরাও ডাক দিয়ে জানান দিলাম, আসছি। তবে একটাই স্বস্তি যে, পথটা অবশ্যই জংলি না, এটা মানুষের তৈরি পরিষ্কার পথ— মানুষের হাঁটা পথ। রাসেলকে বেশ কষ্ট করে উঠতে হচ্ছে, আর কামরুল সহায়তা করেই যাচ্ছে, আমিও কখনও করছি। তবে বেচারার কষ্টটা সত্যিই হচ্ছে।

আমার ঘাঢ়ের ব্যথাটা কষ্ট দিচ্ছে। কামরুলকে বলতেই ও আমার ব্যাগটার দিকে তাকালো। শিওর ব্যাগটা ঠিকমতো শরীরে ঝোলাইনি আমি। সে আমাকে শিখিয়ে দিল, কিভাবে ফিতা ধরে টেনে ওটাকে আরো আঁটোসাটো করে শরীরের সাথে আঁকড়ে নেয়া যায়। ওর কথামতো যখন করলাম, সত্যিই ব্যাগটা আরো হালকা হয়ে গেল। এবং দুপাশের ফিতা সমান হওয়ায় ব্যাগের ওজনটা দুকাঁধে সমানভাগে ভাগ হয়ে গেল। ধন্যবাদ দিলাম কামরুলকে। ব্যাগটা সত্যিই হালকা লাগছে।

কামরুলের সাথে কথা হচ্ছে আমার। সে তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছে। সে বললো, ত্রিপুরা পাড়া যেটা কাল দেখেছিস, ওরা বেশি উঁচুতে থাকে না। কিন্তু বমরা (চরম বাজে গালি) থাকে সেই রকম উঁচুতে। “সেই রকম” বলতে যে সে চরম উঁচু পাহাড়ের ইঙ্গিত করছে, তা আমরা বুঝে গেছি, আর ঐ বাজে গালিটা এটাও বুঝিয়ে দিল যে, এধরণের উচ্চতার পাড়া বেড়ানোর অভিজ্ঞতা তার মোটেই আনন্দদায়ক ছিল না, আর এটাও বোঝালো, বমদের পাড়ার উচ্চতা হয় মাত্রাতিরিক্ত।

কাঁশঘেরা পথে উঠে এলাম একসময় (ছবি: নাকিব)
কাঁশঘেরা পথে উঠে এলাম একসময় (ছবি: নাকিব)

দীর্ঘক্ষণ চড়াই পেরিয়ে অবশেষে আমরা তুলনামূলক সমতল একটা কাঁশঘেরা পথে উঠে এলাম। পথটা দারুণ! পথের ধকলসত্ত্বেয় এই রূপ উপভোগ করতে বিশেষ প্রেষণার দরকার পড়লো না। পথটা এগিয়ে গিয়ে একসময় ডানদিক ধরলো। সেপথে কিছুটা এগিয়ে যাবার পরে নাকিবকে দেখা গেল, নিচু হয়ে বসে, ওপাশের পাহাড় থেকে আমাদের পথ বাৎলে দিচ্ছে, ডান দিকে আয় তোরা।

আবুবকর, এবারে কামরুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, তোমার অন্তত আরো দ্রুত হওয়া দরকার। কামরুল তখন চিৎকার করে জানালো, আরে মিয়া রাসেলের ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যথা লেগেছে, পা বাঁকা করতে পারছে না। সংবাদটা আবুবকর এই প্রথম শুনলেন, এবং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যতটা সবেগে কামরুলের উপর চটেছিলেন, ততটাই হঠাৎ চুপ করে গেলেন ঘটনার প্রগাঢ়তায়।

খাল নেই, নেই নদী কিংবা কুমির, তবু এই সাঁকো ব্যবহার করতেই হবে আপনাকে (ছবি: লেখক)
খাল নেই, নেই নদী কিংবা কুমির, তবু এই সাঁকো ব্যবহার করতেই হবে আপনাকে (ছবি: লেখক)

নাকিবের দেখানো পথে এগিয়ে গিয়ে দেখি, নদী নেই, খাল নেই, একটা সাঁকো। এটা আবার কী! ঠিক এখানটায় পাহাড়টা খাড়া হয়ে নিচে নেমে গেছে, একটা গভীর খাদ। এই খাদের কারণেই আমার নাকিবকে মনে হয়েছিল আরেকটা পাহাড়ে, আসলে পাহাড় একটাই। সাঁকো পেরিয়ে রাসেল, কামরুল ওপারে গেলে আমিও পার হলাম। সাঁকো পেরোনোর অভ্যাস আমার আছে, সিলেটের মানুষেরা এক বাঁশের সাঁকো পেরোয় হরহামেশা, আর এখানে আছে তিন বাঁশের সাঁকো, তাই মোটেও কষ্ট হলো না।

সুউচ্চ একাঙ্গি গাছ, ছোটবেলায় পড়া তালগাছকেও হার মানাবে (ছবি: নাকিব)
সুউচ্চ একাঙ্গি গাছ, ছোটবেলায় পড়া তালগাছকেও হার মানাবে (ছবি: নাকিব)

ওপাশে গিয়ে আরো অনেকক্ষণ হাঁটা লাগলো, একসময় চোখে পড়লো একটা এপিটাফ বা কবর-ফলক, ক্রুশ আঁকা। স্বস্তি পেলাম, যাক অবশেষে আমরা অবশ্যই একটা পাড়ার কাছে আছি। পথটা উপরে উঠে গেল, আমরাও পথের সঙ্গী হলাম। এখানে ডানে চোখে পড়লো য়্যাব্বড় একাঙ্গি গাছ। অনেক নিচের খাঁদ থেকে উঠে এসেছে গাছগুলো, আর উঠে গেছে যেনবা আকাশ ফুড়ে।

ডানে-বামে, রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু কবর-ফলক, একটা বেড়া দেয়া কবর পার হয়ে শেষ ঢালটা উঠতে গিয়েই সামনে চোখে পড়লো টিনের চাল, টিনের বেড়ার ঘর। আশ্চর্য হলাম দুটো কারণে: (এক) এরকম উচ্চতা আর গহীনে একটা আধুনিক পাড়া কেমন করে! (দুই) পাহাড়িরা টিন দিয়ে ঘর বানায় নাকি!

বামপাশে একটা জবা-ফুলের-গাছ রেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি এই অতি-উচ্চতায় পাহাড়ি-সমতলে এক অপূর্ব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন পাড়া। পাড়ার পরিচ্ছন্ন রূপটা দেখে আমি সরাসরি কামরুলের দিকে তাকালাম, ও ব্যাটা ঠিকই বলেছে। বমরা আসলেই একেকটা (কামরুলের চরম গালি)— নাহলে এতো উঁচুতে পাড়া বানায় নাকি মানুষে? যে টিনের ঘরটি ঢাল থেকে দেখা যাচ্ছিল, ওটা একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টা সামনে রেখে যখন বামে তাকালাম, আমি এই পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের দিগন্তে যেন হারিয়ে গেলাম। কী অপূর্ব এই দৃশ্য! কী অপূর্ব!!

অপূর্ব পাহাড়ি দিগন্ত (ছবি: নাকিব)
অপূর্ব পাহাড়ি দিগন্ত (ছবি: নাকিব)

পড়ন্ত সূর্যের তেরছা আলো পড়া পাহাড়শ্রেণীর প্রত্যেকটা ভাঁজ যেন নতুন করে ডাকছে আমাকে। যদিও পাহাড়গুলোতে অত গাছ নেই, শুধু ঘাসের চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে ওগুলো নিথর, কিন্তু এই রূপ ভুলবার নয়, উপরের হু হু বাতাস আমাকে যেনবা তৃতীয়বারের মতো আরেক স্বর্গে নিয়ে গেল। কী দৃষ্টিনন্দন! কী মহোময়!!

এগিয়ে গেলাম আমরা তিনজন। দেখি পাড়ার সব ছেলেপিলেরা আমাদেরকে উৎসুক হয়ে দেখছে। আবুবকর ইতোমধ্যেই তাঁর বোঝা নামিয়ে রেখেছেন কোথাও। আমরা কাছে যেতে দেখি কথা বলছেন স্থানীয় এক কিশোরের সাথে। কিশোরের চেহারা সুন্দর, মাথায় ব্রুসলি-কাটিং চুল, পরনে শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। পাহাড়িদের চুলগুলো এতোটাই সিল্কি আর ল্যাপটানো যে, এদের বোধহয় স্টাইলের মধ্যে এই ব্রুসলি কাটিং চুলই আসে।

আবুবকরকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিন্ত হলাম: এটা রুমানা পাড়া। জানে পানি এলো শুনে, আবারো আমরা সঠিক পথেই আছি। আবুবকর জানালেন, আমরা আজকে রাতে এখানকার কারবারির ঘরে উঠবো। আপনারা আপনাদের ব্যাগগুলো ওঘরে রেখে আসুন। ঐ যে ঐ ঢালে নেমে সামনেই যে ঘরটা দেখবেন, ওখানে রেখে আসেন।

সেদিনের কাঙ্ক্ষিত ‘রুমানা পাড়া’ (ছবি: নাকিব)
সেদিনের কাঙ্ক্ষিত ‘রুমানা পাড়া’ (ছবি: নাকিব)

বেলা তখন প্রায় সোয়া পাঁচটা। এত্তো উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে যখন আমাদের সবারই শরীর প্রচন্ড ক্লান্তিতে বিশ্রাম চাচ্ছিল, এবং বিশ্রামের জন্য একটা পাড়া আর একটা সুন্দর ঘর পেয়ে সেই ক্লান্তি যখন জেঁকে ধরতে চাচ্ছিল, তখনই আবুবকর বোমা ফাটালেন:

এখানকার লোকজন বলছেন, কাছেই দুইটা ঝরণা আছে। আমরা এখন সেই ঝরণা দুইটা দেখতে যাচ্ছি, কে কে যাবেন?

এ ব্যাটা বলে কী? মাথা খারাপ নাকি? পাগল হলো নাকি? এত ক্লান্ত শরীরে এখন আমাদেরকে নিয়ে যাবে ঝরণা দেখাতে? রাসেলের তো যাবার প্রশ্নই উঠে না। নাকিবও সাফ ‘না’ জানিয়ে দিল। কিন্তু আমার কেন জানি না জেদ চাপলো, আরে রাখ্‌ শরীর। না গেলে তো মিস করবো এই ঝরণা। তাছাড়া সঙ্গে কামরুল আর আবুবকরের মতো ট্রেকার থাকতে পিছানোর কোনো মানেই হয় না। …আমি রাজি হয়ে গেলাম।

(চলবে…)
মঈনুল ইসলাম

পরবর্তি পর্ব »

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৬)

অন্ধকারের পথ ধরে আমরা চলছি কোনো এক অজানা পাড়ার সন্ধানে, কেউ জানিনা, আদৌ আছে কি নেই। পাড়া না পেলে অনেকটা পথ আবার ফিরে গিয়ে আস্তানা গাড়তে হবে নদীর বাঁকে। এমন সময়…

আবুবকর চিৎকার করে বললেন,পাড়া, পাড়া। পাড়া আছে এখানে।

সাথে সাথে মরুভূমির মধ্যে পানির কূপ পাবার মতো সবার মনে কী যে অনাবিল আনন্দ ছেয়ে গেল, বলে বোঝাবার নয়। সবার চলার গতি বেড়ে গেল দ্বিগুণ। ডানদিকের পাহাড়টা ধরে উপরে উঠতে লাগলাম আমরা। একসময় উপরে উঠে এলাম এক লোকালয়ে— হ্যা, এটা একটা পাড়া।

লোকজনের সাথে কথা বলতেই বেরিয়ে এলো, এটা “এনেঙ পাড়া”। আপেল নাকি নিচ থেকে বাচ্চাদের চিৎকার শুনে পাড়াটার সন্ধান পেয়েছে। ব্যস, আমাদের খুশি আর ধরে না। আবুবকর আর কামরুল আনন্দে উদ্বেলিত হলো, ওদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল না— দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো খুশিতে। আবুবকর, পরিচিত একটা ঘর পেয়ে গেলেন, তাদের বাড়িতেই থাকার পরিকল্পনা করলেন। কামরুল ততক্ষণে আমাদেরকে একটা ব্রিফ দিয়ে দিল এই পাড়া সম্বন্ধে:

এনেঙ পাড়া, কেউ কেউ বলেন এনঙ পাড়া। এটা একটা ত্রিপুরা পাড়া। এই পাড়াটার অবস্থান ভৌগোলিকভাবে বেশ আকর্ষণীয়, কারণ চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা এমন পাড়া আর সচরাচর নাকি দেখা যায় না। আরেকবার এসে কামরুল এখানেই ওদিকটার এক পাহাড়ের উপর দিয়ে য়্যাব্বড় একখানা রুটি, থুক্কু, চাঁদ দেখে একেবারে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সে। আজ অবশ্য চাঁদ দেখার কথা না, কৃষ্ণপক্কের রাত। আমরা ঘরে গেলাম।

সকালের এনেঙ পাড়া (ছবি: নাকিব)
সকালের এনেঙ পাড়া (ছবি: নাকিব)

জীবনে এই প্রথম কোনো পাহাড়িদের ঘরে থাকা। তাই প্রশ্নগুলো করে নিতে ভুলছিলাম না আবুবকরকে। জানলাম, প্রয়োজনীয় কিছু যদি এঁদের থেকে নিয়ে ব্যবহার করা হয়, এরা সেটা খুশিমনে দিবে, খুব সহায়তাপরায়ণ। যাবার সময় একটা গড়পড়তা হিসেব করে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেলেই এরা খুশি। কিছু না দিলেও এদের কোনো অভিযোগ থাকবে না, খুশিমনে বিদায় দিবে। জানলাম, এরা কিছুই করে না— না লেখাপড়া, না আড্ডাবাজি (তাই বলে সামাজিক গল্প-গুজব করে না বললে ভুল হবে, এদের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে এবং দ্বন্দ্ব-কোন্দলও আছে), শ্রেফ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে, সন্ধ্যা হলেই এরা খেয়ে-দেয়ে শ্রেফ ঘুমায়। আবুবকর বললেন, এই তো একটু পরেই দেখবেন, সবার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসবে। আরো জানালেন, আমাদের জন্য তাদের ঘুমের ব্যাঘাতই ঘটছে, সবাই ঘুম বাদ দিয়ে আমাদের দেখছে বসে বসে।

এনেঙ পাড়ার ঘরের এক কোণে পরিবারের সবাই জড়ো হয়ে আমাদের গিলছে (ছবি: রাসেল)
এনেঙ পাড়ার ঘরের এক কোণে পরিবারের সবাই জড়ো হয়ে আমাদের গিলছে (ছবি: রাসেল)

ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে, হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে এটা-ওটা মুখে নিচ্ছে। ওটাকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু যদি পেশাব করে দেয়, তাহলে মহা-ফ্যাসাদে পড়ে যাবো। তাই দূর থেকেই ঈশ্বরের ঐ আজব সৃষ্টিকে উপভোগ করলাম মন ভরে। শিশু, এই পৃথিবীর একটা অপূর্ব দৃশ্য।

শরীরটা বেশ ধরে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের পেশীগুলো ব্যথা করছে প্রচন্ড। যদিও যতটা মনে করেছিলাম, তার তুলনায় কম। কারণ হলো, অ্যাংকলেট, পায়ের গোড়ালিকে অধিক ব্যবহার-সত্ত্বেয় নড়তে দেয়নি জায়গা থেকে, নী-ক্যাপ, হাঁটুর বাটিকে ধরে রেখেছিল, তাই হাঁটার তুলনায় পেশিগুলো নড়াচড়া করেছে কম, ফলে তাদের পরিশ্রম কিছুটা হলেও শুষে নিয়েছে এই দুই বস্তু। তবু আমাদের দুই গাইড মাংসপেশীর ব্যথানাশক ওষুধ “মূভ” মাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। মূভ আমরা কেউই নেইনি, জানা গেল নাকিব নিয়েছে। দুই গাইড ওটা দিয়ে রীতিমতো গোসল করলো। রাসেল তার পায়ে মাখিয়ে নিল। আমার কেন জানিনা বাম কাঁধে খুব ব্যথা করছে। বুঝতে পারলাম, ব্যাগ বহনের কারণে। কিন্তু দুই কাঁধে ব্যথা না করে এক কাঁধে ব্যথা করছে কেন? আমি, কাঁধে একটু মূভ মাখলাম; আর পেইনকিলার খেয়ে নেয়া জরুরি মনে করলাম, কারণ সামনের দিনগুলোও আমাদের হাঁটতে হবে।

তারও আগে আমরা সবাই পাহাড় থেকে নেমে ঝিরির পানিতে মুখ-হাত ধুয়ে নিয়েছিলাম। খুশির ঠ্যালায় যে মাগরিবের নামাযটা ছুটে গেছে, সেটা খেয়ালই ছিল না। খুব আফসোস হলো। যাহোক, মুখ-হাত ধুতে গিয়ে আবার বুঝলাম, আমার টর্চটা অসাধারণ কাজ করছে। এদিকে কামরুলের আনা ছুরি দিয়ে আমাদের দুই গাইড বিকাশ আর আপেল, কিনে আনা মাছগুলো কেটে-কুটে পরিষ্কার করতে লেগে গেল। এদিকে কামরুল জানালো, এখানে প্রাকৃতিক কৃতকর্মটি সারতে হবে এই খোলা জায়গায়, কোনো এক পাথরের আড়ালে। আশ্চর্য হলাম না। তবে সমস্যা হলো নাকিব। ওর আবার কোথাও গেলে এই জিনিসটা বেশ ভোগায়। অনেক সময়ই সে পায়খানা না হবার ঔষধ খেয়ে যায়। তাছাড়া ওর আবার এরাকনোফোবিয়া (arachnophobia) আছে, মানে মাকড়সাভীতি। মাকড়সা দেখলে খাওয়াতো দূরে থাক, পায়খানা-প্রস্রাবও বন্ধ হয়ে যায়। আমি ওকে তাই ‘ল্যাডিস’ বলে ক্ষেপাই।

যাহোক হাত-মুখ ধুয়ে যখন আকাশে তাকিয়েছি, আমি যেন হারিয়ে গেলাম মহাশূণ্যে…। সবগুলো তারা যেন কোনো এক জ্বলজ্বলে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল আমায়। পাহাড়ের উপরে এত্তো এত্তো তারার ভিড়ে উরসা মেজর খুঁজতে মনে ছিল না।

ঘরে ফিরে আমরা বাসিন্দাদের থেকে একটা বড় কুমড়া নিলাম। তারপর সেটা কাটার পালা। পাহাড়িদের দা’র গঠনটা হলো কিরিচের মতো, ধারালো দিকটা লম্বাটে। তাই আমাদের দা দিয়ে তেমন একটা সুবিধা করা গেলো না কুমড়া কাটায়। কুমড়া কাটা শেষে পাহাড়ি ছোট্ট, এই এত্তটুকুন, কিন্তু ঝা–ল, মরিচ গুড়া করা হলো অন্যান্য মসলার সাথে (ছোট মরিচের ঝাল বেশি)। গুড়া করার জন্য এরা শিল-পাটা ব্যবহার না করে ব্যবহার করে ঘুটনি। বাঁশের ঘুটনির ভিতরে গাছের ডালের ছেচনি। ঘুটনি নামটা সিলেটে ব্যবহৃত হয়, ছেচনি নামটা আমি এখন দিলাম।

রান্না করছে আমাদের শেফ বিকাশ। সহায়তা করছে আপেল আর ঘরের একজন বাসিন্দা। রান্না করতে করতে আমরা ঘরের বাঁশের চাটাইয়ের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে নামায পড়ে নিলাম। বিশ্রাম পেয়ে শরীরটা যেন ব্যথা একটু বেশি করছে। এর মধ্যে খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল। আমরা সবাই পাহাড়ীদের প্লেটে খাবার নিয়ে বসলাম। তাদের প্লাস্টিকের বোতলে জমিয়ে রাখা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করলাম। এদের পানি রাখার জন্য, বোতল ছাড়াও আরেকটা পাত্র আছে: একটা ফল থেকে এটা বানায় এরা। ফলটা ঠিক কলসের ছোট্ট আকৃতি। লাউয়ের ভিতর থেকে শাঁস বের করে চুলার উপর শুকিয়ে যেভাবে ডুগডুগি কিংবা পাত্র বানানো হয়, ঠিক এভাবেই এটাকেও পানি রাখার পাত্র বানানো হয়। তবে সত্যি বলছি, ওটাতে রাখা পানির মধ্যে একটা গন্ধ হয়, গন্ধটা আমার ঠিক ভালো লাগেনি। যাহোক, মেনু হলো মাছ দিয়ে এক তরকারি, আর কুমড়া দিয়ে এক তরকারি। বাড়তি তরকারি রেখে দেয়া হলো, যাতে সকালে নাস্তা করা যায়।

রাত্রে ঘুমানোর সময় ওরা আমাদেরকে দুটো ছোট কম্বল দিল; আমাদেরকে ভাগ করে নিয়ে ঘুমাতে হবে। মশা মোটেই নেই, তাই ওডোমস মাখার প্রয়োজন মনে করলাম না। কামরুল আর আবুবকর একটা স্লিপিং ব্যাগে থাকবে, বিকাশ আর আপেল একটা কম্বলের নিচে, নাকিব নিজের আনা ফুলানো বালিশ আর শীত-চাদরের নিচে, আমি আমার কাপড়গুলো দিয়ে বালিশ আর নিজের আনা চাদরটার নিচে, রাসেল নিজের ফিতা-ব্যাগ দিয়ে বালিশ আর এদের দেয়া কম্বলের নিচে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। খুব একটা ঠান্ডা কিন্তু না। …কিন্তু রাত যত গভীর হলো, ঠান্ডা আমাদেরকে জেঁকে ধরলো। পাতলা চাদরটা ঠিক তাল মেলাতে পারলো না। রাসেলেরও খুব কষ্ট হচ্ছে, নাকিবও স্বস্তি পাচ্ছে না। এর মধ্যে রাত তিনটার দিকে জেগে উঠলো প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টিটা, ত্রাহী চিৎকার করে জানাতে থাকলো তার কোনো অবরুদ্ধ আবদার। সবার ঘুমেরই বারোটা।

পাহাড়ে ভোরের উজ্জ্বল চ্ছটা, এনেঙ পাড়া থেকে তোলা (ছবি: নাকিব)
পাহাড়ে ভোরের উজ্জ্বল চ্ছটা, এনেঙ পাড়া থেকে তোলা (ছবি: নাকিব)

সূর্য ওঠার আগে দেখি কামরুল আর আবুবকর উঠে পড়লো। পরে জেনেছি, এই আধো-অন্ধকারে ওরা কোথায় গেছিল। ওরা যাবার সময় রাতের ঠান্ডার কথা শুনে ওদের স্লিপিং ব্যাগটা আমাদের উপর দিয়ে গেল, ওটার উষ্ণতায় বেশ ভালো ঘুম হলো বাকি সময়টুকুতে। ভোর আটটায় বেরোবার কথা থাকলেও আমাদের উঠতে দেরি হয়ে গেল। উঠে, নাকিব চলে গেল নিজের কৃতকর্মটি সেরে পরিষ্কার হতে। গিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে বসলো। কাজ প্রায় শেষ, এমন সময় নাকি দুজন লোক ওপাশ থেকে হেঁটে আসছিল। নাকিব, দ্রুত পরিষ্কার হয়ে লুঙ্গি তুলে অ্যাটেএএনশন্! ভাবটা এমন— আমি আসলে প্রকৃতি দেখতে বেরিয়েছি!!

বুঝে গেছেন নিশ্চয়, কামরুল আর আবুবকর কেন ভোরে উঠেছে?

রাতের বাড়তি খাবারটুকু গরম করে প্রস্তুত করলো বিকাশ। সবাই যখন খাবার খেতে বসবে, তখন রাসেলের দরকার পড়লো কৃতকর্মটি সারার। …আর সময় পেলো না। সবাই-ই একটু বিরক্ত হলো, ব্যাটা এতক্ষণ কী করেছিস!! সে আবার একা যাবে না, সঙ্গে নিলো আমাকে। কেন আমাকে? আমি নাকি ওকে পাহারা দিব, যাতে নাকিবের মতো কেউ এসে ওকে বিরক্ত না করে। যাহোক, আমি শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত-ল্যাট্রিনের পাহারাদার হলাম। কিছুক্ষণ হলো কাজ সারছে রাসেল, এর মধ্যে রাসেলকে দেখার লোভ সামলাতে পারলো না ‘একজন’!!!

এমন ‘একজন’, যার ব্যাপারে রাসেলকে আসলে ওয়ার্নিং দেয়ার ঠিক প্রয়োজন মনে করলাম না। সে গিয়ে পাথরের ওপারে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রাসেল পাথর ছুঁড়েও ওটাকে দূরে সরাতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত অস্বস্তিতে বেচারা দ্রুত কৃতকর্ম সমাধা করে উঠে এলো। আর উঠতেই… উঠে আসতেই, ঐ ব্যাটা ধাড়ি শুকর দৌঁড়ে গিয়ে মুখ দিল ঐ…।

রাসেল, এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারলো না। রাতে যদি উষ্ণ একটা ঘুম হতো, তাহলে এতক্ষণে বেচারা সুস্থ থাকতো, কিন্তু রাতের ঠান্ডায় পা তার স্বাভাবিক হয়নি পুরোপুরি, ব্যথা নাকি যেমন ছিল তেমনই আছে। তার উপর এই দৃশ্য দেখে বমির উদ্রেক হলো তার। কিন্তু পেটে দানাপানি নেই এই ভোরে, কোনো রকমে রক্ষা পেলো।

উপরে উঠে এসে দেখি সবার খাওয়া শেষ, শুধু আমাদের দুজনের জন্য দুটো প্লেটে খাবার রাখা। খাবারটাও দেখে খুব একটা সুবিধার লাগছিল না, হয়তো এইমাত্র ঘটে যাওয়া বিষয়টা আমাদের দুজনকেই একটু মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মনের জোর আমার সবসময়ই আছে, এসব ঘেন্না একটু কম। দ্রুত খেয়ে নিলাম। রাসেল তেমন খেতে পারলো না। হাত ধুয়ে বেরিয়ে এলাম, দলের সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে। আবুবকর ভাই এর মধ্যে হিসাব নিকাশ করে গড়পড়তায় ৳৫০০ ধরিয়ে দিয়েছেন ঘরের বাসিন্দাদের। তারা মহা খুশি!

বাইরে বেরিয়ে তাকালাম ঘরটার দিকে, রাতের অন্ধকারে কিছুই বুঝিনি এটার। ঘরটা অবশ্যই বাঁশের উপরে, সব পাহাড়ীরাই যেভাবে বানায়। বেড়াগুলো বাঁশের চাটাইয়ের। আর শন বা খড়ের চাল। ঘরকে যতটুকু উঁচু করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে, নিচে ততখানি জায়গা জুড়ে জ্বালানি কাঠ রাখা। নাকিব ওর ক্যামেরায় ধারণ করলো দূরের পাহাড়ের উপর সূর্যোদয়ের আগমনী আলোর চ্ছটা, আর এনেঙ পাড়ার কিছু ছবি। সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। একটাতে আমি নেই, একটাতে নেই কামরুল।

এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’, মেঝের খুব কাছাকাছি, তবু কলকল আওয়াজ তুলে মাতিয়ে রাখে (ছবি: লেখক)
এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’, মেঝের খুব কাছাকাছি, তবু কলকল আওয়াজ তুলে মাতিয়ে রাখে (ছবি: লেখক)

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আবার নেমে গেলাম আমরা ঝিরিতে, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে: সকাল ৯টা। রাসেলকে নাকিব খাইয়ে দিয়েছে একটা পেইনকিলার। গত রাতের এই শীতে আমরা এই ঘরের ভিতর কাবু হয়ে বুঝেছি, যদি পাড়া না পেতাম, শ্রেফ একটা পলিথিনের শেল্টারে কী বিপদই না ডেকে আনতাম নিজেদের। একটা পাড়া আমাদের কিছু টাকা খসিয়েছে হয়তো, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছে আগের মতো উদ্যম। তাই আজ এই সকালের মিষ্টি আলোয় হাঁটছি আমরা। এখনো সূর্য অতোটা উপরে উঠেনি বলে চলার পথে এখনও রোদ পড়েনি অতোটা। বেশিদূরে নয়, ছোট্ট একটা পাথুরে ঢালের দুপাশে ছোট্ট অনুচ্চ ঝরণা, এগুলোকে আমি বলি ‘মেটে-ঝরণা’। দেখে মন ভরবে না, মনে হবে ইশ! বর্ষায় কী যে দারুণ লাগবে জায়গাটা! আরো সামনে ডানদিকে দেখলাম একটা মৃত ঝরণা। বর্ষায় হয়তো এটা জেগে উঠবে। হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা ছোট স্বর্গে চলে এলাম আমরা।

দ্বিতীয় স্বর্গে ভোরের আলোকচ্ছটা। এখানে কামরুলের ছবিগুলো আশা করি ভালো এসেছে। (ছবি: লেখক)
দ্বিতীয় স্বর্গে ভোরের আলোকচ্ছটা। এখানে কামরুলের ছবিগুলো আশা করি ভালো এসেছে। (ছবি: লেখক)

স্বর্গটায় একটু অপেক্ষা করলাম। খুব ভালো লাগলো জায়গাটা। সকালের সূর্য গাছের ফাঁক দিয়ে চ্ছটা দিয়ে পথটাকে পুরো স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে। যাহোক, স্বর্গও ছাড়তে হলো সামনের স্বর্গ ধরার জন্য। কারণ সামনে অপেক্ষা করছে আরো আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গ।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা পাড়া এলাকায় পৌঁছলাম। সেখানে একটা বরই গাছ পেয়ে ওটা থেকে বরই খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। ঢিল ছুঁড়ে তেমন একটা বরই পেলাম না, স্থানীয়রা সাবাড় করে দিয়েছে। তবু যে ক’টা পেলাম, ভালো মিষ্টি। বরই খেয়ে আবার চললাম। সামনের পাড়াটি হলো মেনদ্রুই পাড়া। প্রথমেই একটা স্কুল পেলাম, ওটার সাইনবোর্ডে লেখা অবশ্য “মেনডক পাড়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” (২নং রুমা সদর ইউনিয়ন)। এই পাড়াটাও ত্রিপুরা পাড়া। বেশ সমতলেই (ঝিরি সমতল) থাকে এরা।

মেনদ্রুই পাড়ার অধিবাসী, পিঠে ঝোলানো বল্টু (ছবি: লেখক)
মেনদ্রুই পাড়ার অধিবাসী, পিঠে ঝোলানো বল্টু, সামনে আবুবকর জিপিএস রিডিং নিচ্ছেন (ছবি: লেখক)

রাসেলের অবস্থা আমাদেরকে একটু চিন্তিতই করলো। আমাদের এখনও আজকের দিনসহ আরো তিনদিনের পরিকল্পনা। সেখানে রাসেলকে এভাবে টেনে নেয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তাই রাসেলকে যদি এখান থেকে রুমাতে পাঠিয়ে দেয়া যায় কোনোভাবে, তাহলে আমাদের সামনে চিন্তা করা সহজ হয়। দুজন বাসিন্দাকে পাওয়া গেল স্কুলের সামনে। একজন পুরোপুরি স্থানীয়, পিঠে একটা বল্টু ঝোলানো। বল্টু মানে ঐ যে, বিধাতার আশ্চর্য সৃষ্টি! পিঠে ঝুলে ঝুলেই অতটুকু মিনি মিনি চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আমাদেরকে। কী বুঝলো কে জানে, নিস্পৃহ চেহারা নিয়ে ঝুলেই থাকলো পিঠে।

পাড়ায় অপূর্ব আলোকচ্ছটা, আইফোন না হয়ে এসএলআর হলে... ওফ্‌!
পাড়ায় অপূর্ব আলোকচ্ছটা, আইফোন না হয়ে এসএলআর হলে… ওফ্‌! (ছবি: লেখক)

স্থানীয় ব্যক্তি আমাদেরকে একটা পথ বাতলে দিলেন, সামনের পাহাড়ের ওপাশের একটা পাড়ার সন্ধান দিলেন, ওখানে নাকি ট্রাক আসে মাল নামিয়ে দিতে, নিয়মিত না অবশ্য; ওখানে গেলে ট্রাকে করে যাওয়া যাবে রুমা। কিন্তু হিসাব-নিকাশ করে যে বিষয়টা উদ্ধার হলো, ওখানে যেতে পাড়ি দিতে হবে বড় বড় পাহাড় আর ও’পাড়ায় গিয়েও যে গাড়ি পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। রাসেল যদিও বেশ উৎসাহী ছিল চলে যাবার জন্য, কিন্তু টীমলিডার আবুবকরের সিদ্ধান্ত হলো এরকম অনিশ্চয়তায় ওকে ঠেলে দেয়া যায় না। তাছাড়া বড় বড় পাহাড় ডিঙানো চাট্টিখানি কথা না, তাও পা ভাঙা অবস্থায়। তাছাড়া এই পাড়ায়ও কোনো স্থানীয় গাইড পাওয়া গেল না, কারণ সবাই-ই এই জুম-মৌসুমে ব্যস্ত। অগত্যা, রাসেলকে নিয়েই সামনে চলার চিন্তা করলাম আমরা। আজকের লক্ষ্য: সন্ধ্যার আগে রুমানা পাড়া খুঁজে বের করা।

আবারো ঝিরিতে নামলাম আমরা। চলার পথে আগের মতোই বড় বড় পাথর, পাহাড় থেকে পড়া গাছ, ভেজা পাথরে শ্যাওলা, উঁচু উঁচু পাহাড়ে তীর্যক সূর্যের অপূর্ব খেলা —একই দৃশ্য, তবু মায়াময়! চলতে চলতে এক জায়গায় আমরা পেলাম দুটো গয়াল, গতকাল যেমনটি পেয়েছিলাম। গয়াল (Bos frontalis) হলো গরুর জাতভাই, কেউ ডাকে বনগরু বলে। নিরীহ প্রাণী, কিন্তু ইদানিং তেমন আর দেখা যায় না এদের। গৌর আর গয়ালে সামান্য পার্থক্য আছে।

ছবিটাতে একসাথে দেখা যাবে উঁচু পাহাড়ে গাছ, জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া ঝিরি, আর মেটে-ঝরণা। ছবিটা দুটো ছবি জোড়া দিয়ে বানানো। (ছবি: লেখক)
ছবিটাতে একসাথে দেখা যাবে উঁচু পাহাড়ে গাছ, জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া ঝিরি, আর মেটে-ঝরণা। ছবিটা দুটো ছবি জোড়া দিয়ে বানানো। (ছবি: লেখক)

যা হোক এগিয়ে চললাম। গভীরে, আরো গভীরে। কোথাও ঝিরির পানিতে পথচলা, কোথাও পাথুরে পাহাড়ে বেয়ে উঠা, কোথাও গাছে ঢাকা পথে শুকনো পাতা মাড়ানো তো কোথাও গাছের মগডাল মাড়ানো… ‘মগডাল মাড়ানো’ পড়ে আশ্চর্য হবেন না, কারণ সত্যিই মগডাল মাড়ানো লাগতে পারে আপনার। কারণ জুম চাষের কারণে একটা পাহাড়ের সব গাছ কেটে সাফ করে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ঝিরিতে। গাছের কাটা, চিকন মগডালে সবকিছু ছেয়ে আছে পথটার। ওপথ দিয়ে খুব কষ্টে পাড়ি দিল দলটা, কিন্তু সবার শেষে থাকা আমি আর কামরুল জিতলাম। পরে দেখি বাম দিকে বনের ভিতর দিয়ে কন্টকবিহীন সুন্দর পথ আছে। অযথাই বেচারারা কষ্ট করলো!

কোথাও ঝিরির কাছেই এভাবে খানিক উঁচু পাথর ডিঙাতে হয়। (বাম থেকে: বিকাশ, আবুবকর, কামরুল, নাকিব) (ছবি: লেখক)
কোথাও ঝিরির কাছেই এভাবে খানিক উঁচু পাথর ডিঙাতে হয়। (বাম থেকে: বিকাশ, আবুবকর, কামরুল, নাকিব) (ছবি: লেখক)

সামনে পেলাম একদল পাহাড়ি কিশোর-কিশোরী, ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা কাছাকাছি হতেই ওরা একটা মাছ পেয়ে গেল। আবুবকর চাক্ষুস করে আমাকে বললেন, ওরা মাছ দেখেই দা দিয়ে দিয়েছে কোপ, ব্যস, লেজে পড়ে আটকে গেছে বেচারা। ওটা দেখে আমার কাছে মনে হলো ‘কুইচ্চা’ (অনেকে ডাকে ‘কুচিয়া’), সাপ আর বাইন মাছের গোত্রের। আবুবকর কিনে নিতে চাইলেও ওরা বিক্রী করলো না।

মেনদ্রুই পাড়ার পথে অপূর্ব সূর্যের আলোকচ্ছটা (ছবি: কামরুল)
মেনদ্রুই পাড়ার পথে অপূর্ব সূর্যের আলোকচ্ছটা (ছবি: কামরুল)

সামনে এগিয়ে চললাম। এবারে বালুময় ঝিরির বদলে পাথুরে ঝিরির পরিমাণ একটু বাড়লো। এতে আমাদের আরো একটু সাবধান হতে হলো। কারণ ঝিরির পানিতে ভিজে থাকা প্রত্যেকটা পাথর শ্যাওলা জমে মৃত্যুকূপ হয়ে আছে। এর মাঝে কোনো কোনো পাথর আবার নড়বড়ে। সামনের পা শ্যাওলা-ধরা পাথরে রেখে, ভালোমতো স্থির করে, তারপর পিছনের পা তুলতে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আবারো সামনে পেয়ে গেলাম গতকালকের মতো একটা পাথুরে বিছানা। কেন যে এটা বর্ষাকাল না, মনে করে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে, গতকালকেরটা ছিল আরো ভাটিতে, তাই ওখানে শ্যাওলা ছিল না, কিন্তু এটাতে পিচ্ছিল পাথরের অভাব নেই।

আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। খুব মজা করে কী যেন খাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বিকাশ একটা কাচা চালতা হাতে নিয়ে চামড়া ছিলছে আর সবাই সঙ্গে আনা লবণ বের করে তা মাখিয়ে খাচ্ছে। ক্ষুধার মধ্যে এই টকটুকুও যে স্বাদ হতে পারে বোঝা যাচ্ছিল এই ক্ষুধার্ত লোকগুলোকে দেখে। কষ থাকলেও খারাপ লাগেনি। তবে বেশি খাওয়া ঠিক হবে না। আবার পথ ধরলাম।

দেখে মনে হতে পারে জমজমের কূপ; বাম দিকে শুষ্ক-ঝরণা, ডান দিকে ঝরণার পানি যেখানে পড়ে (ছবি: লেখক)
দেখে মনে হতে পারে জমজমের কূপ; বাম দিকে শুষ্ক-ঝরণা, ডান দিকে ঝরণার পানি যেখানে পড়ে (ছবি: লেখক)

ডানদিকে চোখে পড়লো একটা পাথুরে ঝরণা, তবে সম্পূর্ণ শুষ্ক। কিন্তু এই ঝরণাটা যে বেশ আগের, সেটা খুব আন্দাজ করা যায়, কারণ পানির প্রবাহ পাথরে স্থায়ী খাঁজ বানিয়ে ফেলেছে। খাঁজটাও বেশ খানদানী খাঁজ। আবার যেখানে পানি পড়ে, সেখানখার খাঁজটাও বেশ কারুকাজমণ্ডিত। গাছের চিপায় কসরত করে ঢুকে ওটার ছবি তুলতে হলো।

কামরুল যেভাবে পার হচ্ছে, এভাবেই তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে পার হতে হয় এখানটায় (ছবি: লেখক)
কামরুল যেভাবে পার হচ্ছে, এভাবেই তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে পার হতে হয় এখানটায় (ছবি: লেখক)

সামনের পথটা পেরোতে হয় তিনটা পাথরের নিচ দিয়ে। আরো সামনে এগিয়ে চললাম। পাথরগুলো বিশ্রীভাবে ঝিরিপথে শুয়ে আছে। টপকাতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। একেতো একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বেশি, তার উপর একেকটার পুরুত্ব অনেক। তাই একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়েই যেতে হচ্ছে, আবার ভয়ে থাকতে হচ্ছে, ভেজা স্যান্ডেল না আবার পিছলে যায়।

আমাদের পথটা এগিয়ে গেল সামনে। সামনে গিয়ে দেখি একটা ঝরণা। অনুচ্চ, তবে বেশ বেগ আছে পানিতে। ঝরণার নিচে দুজন পাহাড়ি মাছ ধরছেন। তাদের ভেলাটা বাঁশের। পানির তীব্র তোড় ভেলাটাকে যেন সরিয়ে না নেয়, সেজন্য বিশেষ কৌশল নিয়েছেন: অশ্বক্ষুরাকৃতি অঞ্চলটার তিন দিকে তিনটা বাঁশ আটকেছেন এরা পাথরের খাঁজে। যখন যেদিকে যেতে হয়, সেদিককার বাঁশ ধরে টান দিয়ে এগোন তারা। আর মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করছেন কারেন্ট জাল। জাল পেতে রেখেছেন পানির নিচে। আর আরেকটা বাঁশ দিয়ে পানির নিচে, পাহাড়ের গভীর খাঁজগুলোতে গুতো দেন। এতে ওখানে আশ্রয় নেয়া মাছগুলো দ্রুত বেরিয়ে এসে আটকা পড়ে জালে। এদের মাছধরা দেখার চেয়ে ছায়াময় এই জায়গাটা, পানির সংস্পর্শ, বাতাস আর ঝরণার আওয়াজে আরো বেশি স্বর্গীয় আবেগে জড়িয়ে ফেলে।

স্বর্গীয় ঝরণায় মাছ ধরছেন দুই পাহাড়ি (ছবি: কামরুল)
স্বর্গীয় ঝরণায় মাছ ধরছেন দুই পাহাড়ি (ছবি: কামরুল)

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আমাদের পথটা এসে মিশেছে এই ঝরণায়। সামনে যেতে হলে ঝরণা পেরোতে হবে। কিন্তু ঝরণা পেরোন কি চাট্টিখানি কথা? পিচ্ছিল পাথর সোজাসাপ্টা বলে দিচ্ছে, উঠো আর পিছলে পড়ে মরো। এদের জিজ্ঞাসা করা হলো এরা কি জানে কিনা, উপরে উঠলে রুমানা পাড়া পাওয়া যাবে কিনা। এরা বললো জানে না, এরা অন্য পাড়া থেকে এসেছে।

আমি তখন তাকিয়ে আছি ডান দিকের একটা পাহাড়ের দিকে। একটা হালকা পায়ে-চলা-পথের মত রেখা মনে হচ্ছে। দেখলাম আপেল ওদিক দিয়েই পথ বের করেছে উপরে ওঠার। আমাদের আবারো খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠা। কিন্তু কেন জানি এবার বুক কাঁপলো না। বুঝতে পারলাম, বেশ মনোবল আসছে নিজের উপর, এটা ভালো লক্ষণ। তবে ওভার-কনফিডেন্ট না হয়ে যাই, সচেতন ছিলাম।

খাড়া পাহাড় বেয়ে ঝরণা পাড়ি দেয়া এবার যেন কষ্ট দেয়নি তেমন (ছবি: লেখক)
খাড়া পাহাড় বেয়ে ঝরণা পাড়ি দেয়া এবার যেন কষ্ট দেয়নি তেমন (ছবি: লেখক)

নাকিব খুব বিরক্ত। এতো পথ পাড়ি দিয়ে এসে এভাবে আবার পাহাড়ে চড়া মোটেই আকর্ষণীয় নয়। আমি, ওর পিছনে থেকে প্রতি মুহূর্তে বলে দিতে থাকলাম, না, ওটা না, বড় ডালটা ধর। না না, চিকন বাঁশ ধরিস না। হুঁ হুঁ, কক্ষণও গাছের উপরের দিকে না, গোড়ার কাছাকাছি জায়গায় ধর্। হুঁ হুঁহ, আরেকটু সামনে পা ফেল, ওখানে পাথর আছে। তবে আগের চেয়েও বেশ সহজেই পার পেয়ে গেলাম পাহাড়টা। উঠে এলাম ঝরণাটার উপরে।

'ধাপ-ঝরণা'র উপরের দুটো (ছবি: নাকিব)
‘ধাপ-ঝরণা’র উপরের দুটো (ছবি: নাকিব)

এখানে এসে তো আরো অবাক, উপরে আরো দুটো ঝরণা। এগুলোকে বোধহয় বলে ‘ধাপ-ঝরণা’, কে জানে? উপরেরগুলো তুলনামূলক ছোট ধাপের, ঐ-যে আমার ‘মেটে-ঝরণা’র মতো আরকি। নিচে থাকতে যদি খেয়াল করতাম, তাহলে দূর থেকে তিনটার একত্র ছবি তোলা যেত নাকিবের ১২এক্স অপটিক্যাল দিয়ে। যাহোক, আমরা ঝরণাটার কোনো নাম পেলাম না পাহাড়িদের থেকে। আন্দাজ করলাম, এটা এখনও কোনো ভ্রমণকারী আবিষ্কার করেননি, আমরাই প্রথম। তবে নাম আমরাও দিলাম না, ভ্রমণ বাংলাদেশ, এই দায়িত্ব তাদের কাছে রেখেছে। (তাদের স্বার্থে কোঅর্ডিনেটও শেয়ার করলাম না)

অনুভূতিটা এবার বেশ ভালো: যাক, অভিযানটা শুধু প্রথমবারেরই না, অভিযানটা সফলও। ফুরফুরে মন নিয়ে আরো সামনে এগোলাম আমরা। ঝিরি তার সৌর্যবীর্য দেখিয়েই যাচ্ছে। চলতে চলতে বেশি দূর যেতে হলো না, পথটা গিয়ে ঠেকেছে আরেকটা উঁচু ঝরণার পাদদেশে। একেবারে সাক্ষাৎ ডেড এন্ড

৮৫ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়, পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে উঁচু থেকে পানি পড়ছে, নিচে জলপতনে সৃষ্ট গভীর কূপে ভরাট পানি, উঠার কোনো পথ নেই: শুধু এই ঝরণা। আগের ঝরণাটার মতো পাশের পাহাড়টাও ডাকছে না, বরং এই পাহাড়ের গাছগুলো ৮৫ ডিগ্রির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের বলছে: যাও, বাছাধন, ফিরে যাও, এদিকে তাকিও না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব

এই প্রথম…, হ্যা, এই প্রথমবারের মতো আমি খুব হতাশ হলাম। কারণ ১: ফেরার পথ হলো যতটুকু পেরিয়েছি, ততটুকু ফিরে গিয়ে মেনদ্রুই পাড়ায় যাওয়া। কারণ ২: ফিরে না গেলে এখানে পঁচে মরা। কারণ ৩: না-মরতে-চাইলে ঐ খাড়া ঝরণাটা বইতে না পারলেও বাইতে যাওয়া, এবং অবধারিত মৃত্যু কিংবা গুরুতর জখম। এতোটা হতাশ এই অভিযানে আমি আর একবারও হইনি।

দলনেতা গাইডদের নির্দেশ দিলেন, সে নির্দেশ অনুযায়ী আমরা আবার পিছিয়ে এসে একটা কম ঢালু পাহাড় বেছে নিলাম। গাইডরা ওটা বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমরাও তাদের অনুসরণ করে উঠতে গিয়ে আটকে গেলাম মহা-ফ্যাসাদে: বেত কাঁটায় সবার হাত-পা-শরীর-ঘাঢ় ছড়তে থাকলো। পথটা মোটেই স্বাগত জানানোর নয়। সবারই রাগ পড়লো গিয়ে দুই গাইডের উপর, উঠার সময় বেতকাঁটাগুলো কেটে কেন উঠলো না!

মাঝপথে, পাহাড়ের ঢালে দলনেতা আবুবকর আটকে গেলেন। তাঁকে আটকাতে দেখে সবাই-ই নিজ নিজ জায়গায় আটকে থামলাম। মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে উপর থেকে দুই গাইড, বিকাশ আর আপেল যেন গর্ব করে জানালো: উপরে কোনো পথ নেই।

আমি একটা ঝরণা-পথের মতো দেখে, দলনেতার অনুমতি নিয়ে ওদিকটা দেখার চেষ্টা করলাম। জানালাম, কষ্ট করে উঠা যাবে, কিন্তু উপরে উঠে যে পথের দিশা পাব, তার কী গ্যারান্টি? এর মাঝে চেহারা দেখালো দুই গাইড, উপর থেকে নিশ্চিত করলো: কোনো পথ নেই!!!

আমার হতাশা আমাকে ঘিরে ধরছে। সার্ভাইভাল সিচুয়েশনে হতাশা… শ্রেফ, হতাশাই পারে একজন সার্ভাইভারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে। এক্কেবারে ডেড এন্ডে দাঁড়িয়ে সামনে কি আর ভাবা যায়?

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৫)

দুই পাশে উলঙ্গ, ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়, মাঝখানে কিছুটা গভীর পানি। এপাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা সাতজন, যেতে হবে সামনে, যাবার জন্যেই এসেছি।

এরকম পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছি, কিন্তু এরকম খাড়া নাঙ্গা পাহাড়ের সামনে পড়িনি সত্যি বলছি। একেবারে রক ক্লাইম্বার হওয়া লাগবে, যার প্রস্তুতি আমাদের নেই। সুতরাং আর একটাই সহজ পথ খোলা আছে আমাদের সামনে— সাঁতার। আবুবকর তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন না। দ্রুত সবাই প্রস্তুতি নিল। সত্যি বলতে কি প্রস্তুতি আমাদের ছিলই, তবু, পরনের কাপড়গুলোর সব ভিজানো ঠিক হবে না। নিম্নাঙ্গের কাপড় ভিজুক, কিন্তু উর্ধ্বাঙ্গের কাপড়গুলো শুকনো রাখতে পারলে ক্ষতি কী?

এমন সময় পানি যেখানে গিয়ে ওপাশের পাথরে মিশেছে, ওখানে দেখা গেল একটা কিছু পানির উপর ভাসছে। ভালো করে তাকিয়েই বুঝে গেলাম, ওটা একটা ভেলা। তবে কলা গাছের নয়, ওটা বাঁশের তৈরি ভেলা। একটু ডানদিকে সরতেই পাথরের আড়ালে দেখা গেল ভেলার মালিককে। এখান থেকেই ভেলাটা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নিলেন আবুবকর আর আপেল মিলে।

কিন্তু ভেলাটা রয়েছে ওপারে, ওটা গিয়ে আগে কাউকে আনতে হবে। আপেল আর আবুবকর ওটা আনার দায়িত্ব নিলেন। নেমে গেলেন পানিতে। এদিকে আমি সব খুলে গামছা দিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণ করলাম। ওরা ভেলাটা এপাশে নিয়ে আসতেই কামরুলকে সহায়তা করলাম ব্যাগগুলো উপরে তুলতে। কিন্তু খুব বেশি ব্যাগ ওতে তোলা গেলো না। ওটা বেশ হালকা, আর ফাঁক গলে পানি উঠে যাচ্ছিল। কামরুল বুদ্ধি করে আমাদের সাথে আনা বড় পলিথিনটা বিছালো ভেলার উপর, তারপর ব্যাগগুলো সন্তর্পনে রাখলাম। তবু কিছু পেছনে ফেলে যেতে হলো।

ভেলা এনে দিয়ে আবুবকর আর আপেল চলে গেলেন ওপাশে। সাথে করে নিয়ে গেলেন নাকিব আর রাসেলকে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, দলের সবাই সাঁতার জানতাম। সাঁতারের ব্যাপারটা কেন যে আগে নিশ্চিত করে আসিনি আমরা, সেটা আসলেই একটা বোকামি হয়ে গেছে। যাহোক, ওরা ওপারে চলে গেলে খালি ভেলা নিয়ে ফিরে এলো বিকাশ। এবারে ব্যাগ নিয়ে চললাম আমি, কামরুল আর বিকাশ।

সাঁতার কেটে ঝিরি পার
সাঁতার কোনো ব্যাপারই না, কিন্তু পানি আমাদের অনুকূলে ছিল না (পিছনে বিকাশ, সামনে বামে আমি, ডানে কামরুল (ছবি: রাসেল)

ছোট্ট এক টুকরা গামছা দিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা যে কী কষ্টকর, সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছিলাম। আবার এই গামছাকে ধন্যবাদ না দিয়েও পারছিলাম না এর বহুধা ব্যবহারের জন্য: প্রথমে মাথা ঢাকলাম রোদ থেকে; তারপর নাক-মুখ ঢেকে নিনজা হয়ে গেলাম ধুলা থেকে বাঁচতে; তারপর ঘাম মুছলাম; তারপর হাত-মুখ ধুয়ে পানি মুছলাম; তাছাড়া ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে গলাও প্যাঁচিয়ে রেখেছিলাম, যাতে কাশি না হয়; এবারে লুঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করছি।

পানিতে পা দিয়েই কেঁপে উঠলাম। পানি যে ঠান্ডা, সেটা আমরা ঝিরির পানিতে হেঁটে আসার সময়ই বুঝেছিলাম, কিন্তু এই পানিতে সাঁতার কাটার চিন্তাটা তখন করিনি। আমি বরাবরই ঠান্ডায় বেশি কাবু হয়ে যাই। এবারেও ঠান্ডা পানিটা আমায় ঠিক স্বস্তি দিল না। পানিতে নেমে আমরা যখন ব্যাগসুদ্ধ ভেলাটা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ টান খেয়ে ডানদিকে পানি উঠতে চাইলো। তাই আমি ডুব সাঁতার দিয়ে এগিয়ে কামরুলের সঙ্গী হলাম, ধরলাম ভেলার ঐ কোণাটা। এপারে আসতে আসতে আমাদের একপ্রস্থ ফটোসেশন হয়ে গেছে নাকিব আর রাসেলের ক্যামেরায়।

এপারে এসে ব্যাগগুলো নামিয়ে যখন ঠান্ডা থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচছিলাম, তখন কামরুল জানালো, ওপারের ব্যাগগুলো আনতে যেতে হবে। ও একা যেতে একটু দ্বিধাগ্রস্থ দেখলাম। অগত্যা দলগত কারণেই আবার চললাম ঐ প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে মরতে। পরের ধাপের ব্যাগগুলো এনে আমি যখন জমে যাচ্ছি ঠান্ডায়, কামরুল তখন, একটু হাঁপিয়ে ওঠা ছাড়া তেমন কষ্ট পাচ্ছে বলে মনে হলো না। তখন বুঝলাম, স্বাস্থ্যবান মানুষের শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে।

ফেলে এলাম ভেলা, ফেলে এলাম লাবাখুম (ছবি: নাকিব)
ফেলে এলাম ভেলা, ফেলে এলাম লাবাখুম (ছবি: নাকিব)

এপাড়ে এসে আমরা যখন কাপড় বদলে আবার ট্রেকার হচ্ছিলাম, তখন আবুবকর ঐ পাহাড়ির সাথে আলাপ জমিয়ে জায়গাটার নাম বের করে ফেলেছেন: লাবাখুম। জিপিএস রিডারে আবুবকর দেখলেন, লাবাখুম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৯৪ ফুট উঁচুতে (22° 1’36.80″N 92°28’26.91″E)। আরো একটা কাজ আবুবকর আর আপেল সেরে নিয়েছেন, ঐ পাহাড়ির কাছ থেকে ৪টা পাহাড়ি তাজা মাছ কিনে নিয়েছেন তারা (সাকুল্যে ৳১৫০.০০)। পাহাড়ি ব্যক্তি, মাছগুলোকে বাঁশের সুতায় একত্র করে আমাদের কাছে বিক্রী করে দিলেন।

পাহাড়ি ঝিরির মাছ, এই চারটা মাছ আমরা কিনেছিলাম
পাহাড়ি ঝিরির মাছ, এই চারটা মাছ আমরা কিনেছিলাম (ছবি: নাকিব)

মাছ নিয়ে আবার বাক্স-পেটরা পিঠে ঝুলিয়ে ট্রেকার হয়ে গেলাম সবাই। আমি, শুকনো কাপড়গুলো পরে যখন শরীরটাকে গরম করার জন্য একটু জোর দিয়ে হাঁটছি, তখন রাসেল ঘোষণা করলো, এই ঠান্ডা পানির গোসলটা তার জন্য পুরোপুরি রিফ্রেশিং— একেবারে ফাউন্টে’ন অফ ইয়ুথের মতো সে নাকি ডুব দিয়ে বুড়ো-রাসেল থেকে যুবক হয়ে গেছে। 🙂 হাঁটছে বেশ ঘটা করে। মাঝখানে আমি একটু হাসি, কারণ অনেকক্ষণ আগে খাওয়ানো পেইনকিলারটা কাজ করছে বেচারার।

আমাদের লক্ষ হলো, সন্ধ্যা নামার আগে যে-করেই হোক একটা পাড়ার সন্ধান বের করা। তখনও বুঝতে পারিনি, আবুবকর আর কামরুল কেন এতো মরিয়া হয়ে ‘পাড়া’ ‘পাড়া’ করছে। ওঁদের হিসাব ঠিক হলে আমরা এই পথেই আজ সন্ধ্যার আগে “এনেঙ পাড়া” নামে একটা পাড়া পাবার কথা। কিন্তু হিসাবটা খুব বেশি কাটাকাটা: যদি সবকিছু হয় সময়মতো, যদি হাঁটা হয় বিরামহীন, দ্রুত, কেবল তাহলেই…। একটু উচ্চাশা কি?

কিন্তু রাসেলের প্রাণ ফিরে পাওয়ায় দলটা এবার উদ্যোমই পেল। পথের সৌন্দর্য্য আলাদা কিছু নয়, নতুন কিছু নয়, তবু সুন্দর। একঘেয়ে পথেও আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। প্রকৃতি জিনিসটাই শহুরেদের মন ভরিয়ে দেয়ার মতো। তাই একঘেয়ে পথেও “এনেঙ পাড়া” নামক সোনার হরিণ ধরতে আমরা ঠিকই উদ্যোম নিয়ে হাঁটছিলাম।

এবার আমি লক্ষ করলাম, আমার মুখটা হা করে শ্বাস নিচ্ছি আমি। তারমানে হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই হাপিয়ে উঠেছি। কিন্তু শরীরটা এখনও বেশ সাপোর্ট দিচ্ছে দেখে আশ্চর্য হইনি। সব ট্যুরেই আমি সচল, একটু বেশি সচল থাকি। কিন্তু বিশ্রাম পেলে না আবার রোগ জেঁকে বসে!

হাঁটতে হাঁটতে আমাদের যোহরের ওয়াক্ত শেষ হবার মতো অবস্থা। তাই যাত্রাবিরতি নিয়ে আমরা নামাযের প্রস্তুতি নিলাম। আমি, নাকিব, কামরুল আর আবুবকর নামায পড়ার জন্য ওযু করে নিলাম ঝিরির পানিতে। নিজেদের কাঁধ থেকে গামছাটা পাতা-ঝরে-পড়া-মাটির উপর বিছিয়ে দিলাম, আর এতো কাজের কাজি গামছা হয়ে গেলো জায়নামায। নাকিবের আনা কম্পাসটা আমাদেরকে নির্ভুল দিক নির্ণয় করতে সহায়তা করলো। যদিও অচেনা জায়গায় দিক ঠিক করতে অসমর্থ হলে যেকোনো দিকে ফিরেই নামায আদায়ের অনুমতি ক্বোরআন-সিদ্ধ। সেদিন শুক্রবার হওয়াসত্ত্বেয় আমরা খুৎবা আর জামে মসজিদের অভাবে জোহরের নামায আদায় করলাম। তবে পড়লাম ক’সর নামায (পরিশিষ্ট ১): যোহরের ৪ রাকা’আত ফরযের বদলে ২ রাকা’আত ফরয।

নামায শেষ করে আবার পথ চলা। পাহাড়ের আড়ালে সূর্য ঢলে পড়ায় আলো কমে এসেছে। তবুও এখনও দিনের আলো আছে, তাই আমাদের পথচলা থামার নয়। মাঝে মাঝে কামরুল আমাকে জানায়, একটু অস্বস্তির কথা, একটু সংশয়ের কথা— সম্ভাব্য এনেঙ পাড়া পৌঁছবার পথ কিন্তু এখনও প্রায় ৩-৪ ঘন্টার। তবে আবুবকর কিছু একটা বলেও যেন বলতে চান না, শুধু বলেন হাঁটো; হাঁটার গতি দ্রুত করতে বলেন।

আবুবকরের এই জিনিসটা প্রশংসার দাবিদার। আমি এটাকে বলি “আর্মি ট্রিটমেন্ট”। সেনাবাহিনীতে যারা কাজ করেন, তারা কিন্তু আমার-আপনার মতোই মানুষ। কিন্তু অমানষিক কাজগুলো তারা করেন, শ্রেফ তাচ্ছিল্যের কারণে। তাদের উর্ধ্বতনরা সব সময়ই তাদের কাজকে অবজ্ঞা করেন, পড়ে গেলে চিৎকার করে বলেন, উঠো, হাত লাগাও। পড়ে যাওয়াটা সেখানে অপরাধ, সেজন্য পেতে হয় শাস্তি, চলতে থাকাটা সেখানে সাধুবাদের যোগ্য। আবুবকরও ঠিক একই ট্রিক কাজে লাগাচ্ছেন নাকিব আর রাসেলের উপর: নাকিব একটু মোটাসোটা, কোথাও হয়তো পাথরে পা লেগে একটু মাংস উঠে গেছে, আবুবকর বলেন, ও কিছু না, ওরকম কত হবে! উঠে পড়েন, ওগুলোর দিকে তাকাবেন না। (নাকিব নাকি বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল, এবং এক সময় মনে মনে আবুবকরকে ধন্যবাদও দিয়েছিল)। আবুবকর, রাসেলকে বারবার তাগাদা দেন, আপনি [সবার সামনে হাঁটতে থাকা] আপেলকে ধরেন, যান; পা চালান। এই ব্যাপারটা যে কাজে দিয়েছিল, তা আপনারা বুঝতে পারবেন, অনেক ছবিতে যেখানে আমাদের অনেক সামনে আপেল আর বিকাশের সাথে রাসেলকে দেখবেন। নাকি এটা ঐ ফাউন্টেন অফ ইয়ুথের কীর্তি!! 😉

কামরুলের সংশয় আমি আবুবকরের মতোই নিজের মধ্যে কবর দিলাম। কারণ সার্ভাইভাল গাইড থেকে জেনেছি, দলের মধ্যে, ভয় যদি একজন সদস্য পায়, তবে তা দাবানলের মতো পুরো দলকে গ্রাস করে ফেলে। তাই যা-হয়-হোক ভেবে নিয়ে সামনে এগোনোটাই নিজের কর্ম বানিয়ে নিলাম। পথে আমরা অনেক জায়গায়ই ছোট ছোট ঝরণার মতো প্রপাত দেখেছি। নীরব প্রকৃতিতে আমাদের পায়ের আওয়াজ ছাপিয়ে পানির গমগম আওয়াজ কেমন যেন ভীতি সঞ্চারক। ভয়-ডর আমার বরাবর একটু কম। তাই পরিবেশ যেমনটাই হোক, আমি আছি আমার পথে— পথ চলতে হবে, বোঝা হওয়া যাবে না দলের ঘাঢ়ে।

ঝিরির ঝরণা
রাসেল আমাদের অনেক সামনে, আপেল আর বিকাশের সাথে এগিয়ে যাওয়ার ক্লান্তি বসে, বিশ্রাম করে কমিয়ে নিচ্ছে। (ছবি: কামরুল)

পথ যেখানে নেই, সেখানে পথ বানিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এমন একটা স্থানে এলাম, যেখানে উঁচু পাথরের উপর আমরা দাঁড়িয়ে, ওপাশে বেশ দূরে আরো উঁচু পাথর, মাঝখানে বেশ কিছুটা (গভীর?) পানি। লম্বা একটা বাঁশ জোগাড় করে পানির গভীরতা আন্দাজ করা হলো প্রথমে। দলের নেতৃত্ব দিল বিকাশ। তারপর পাথরের খাঁজ ধরে স্বচ্ছ পানির মধ্যে খুঁজতে থাকলো পাথরের মধ্যে পা রাখার জায়গা। এমনিতেই সূর্য গেছে ঢলে, তার উপর জায়গাটায় অনেক বেশি গাছ-গাছালি। খুব বেশি একটা দেখা যাচ্ছে না। তার উপর বিকাশের হেঁটে যাওয়া পথে কাদা উঠে ঘোলা হয়ে গেছে পানি। আপেল আগেই পানি দিয়ে পার হয়ে গেছে। বিকাশের পিছন পিছন আবুবকর, তারপর রাসেল, নাকিব, আমি চললেম। সবার শেষে থাকলো কামরুল। সবাই নিজেদের ব্যাগগুলোকে টেনে মাথার উপর তুলে নিলাম, যাতে পানি না লাগে। তারপর পানির মধ্যে পা দিয়ে আন্দাজ করে করে পাথরের নিশানা খুঁজে নিয়ে নিয়ে পার হয়ে গেলাম ওপারে।

জঙ্গলের বন্ধুর পথ
এভাবে গাছের ডাল, আর খাড়া পাথরের ভাঁজ পেরিয়ে পথ চলতে হয়েছে কোথাও। এখানে নাকিবকে পার হতে দেখা যাচ্ছে (ছবি: লেখক)

বেশ কিছুটা সময় খেয়ে নিল বন্ধুর পথটা। সামনের খাঁজটায় আমরা আসরের নামায পড়ে নিলাম। এই বিশ্রামস্থলে আমরা একপ্যাকেট বিস্কুট খেয়ে নিয়ে নিজেদের অ্যাংকলেট আর জুতা পরিষ্কার করে বের করে নিলাম জমে থাকা নুড়ি পাথরগুলো। তারপর আবার পথচলা। সামনের দৃশ্যটা আমাদের পাগল না করে পারলো না। ছবিটার দর্শকরা আমাদের জানিয়েছেন, এরকম দৃশ্য হাম হাম-এ যেতেও নাকি দেখা গিয়েছিল। পাড় ধরে এগোচ্ছি আমরা।

আমাদের পথ যেন আর ফুরাতেই চায় না। এদিকে সন্ধ্যা ছয়টা বাজতে আর মাত্র ১৫ মিনিট। আমি আমার ফোনের একটা অ্যাপ্‌স থেকে জেনে নিলাম বান্দরবানের ভৌগোলিক অবস্থানে সূর্যাস্ত হতে আর ৫-৭ মিনিট বাকি। সূর্য দেখছি না আমরা অনেকক্ষণ থেকে। অনেকেই বলে থাকেন, পাহাড়ে অন্ধকার নামে ঝুপ করে, হঠাৎ। বিষয়টা ঠিক কিনা, দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

আমি নিশাচর মানুষ বলে রাতকে ঠিক ভয় পাই না। কারণ রাতে ভূতের বাড়িতে অভিযান পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু তবু কেন জানি আবুবকর আর কামরুলের মতো খুব তাগাদা অনুভব করছিলাম একটা পাড়ার বড্ড প্রয়োজন। কেন? —আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, আমি জানি না।

আশেপাশের পাথরের বিন্যাস, গাছ-গাছড়ার খোলামেলা ভাবসাব দেখে আমাদের মনে হতে লাগলো আশেপাশে কোনো পাড়া আছে। যে পাড়াই হোক না কেন, যদি পাড়া থাকে, তবে সেখানেই রাত কাটানো হবে; এনেঙ পাড়া পাবোই এমন নিশ্চয়তা আমাদের নেই। কারণ গুগল আর্থ দেখে করা পরিকল্পনা অনুযায়ী, আবুবকর আর কামরুলের ধারণা, এদিকে এনেঙ পাড়া থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এই মুহূর্তে ম্যাপের কোন জায়গাটায় আছি, সেটা দেখা যাচ্ছে না, কারণ আসার সময় আবুবকরের নেয়া গুগল আর্থের ফাইলটা (.gpx) করাপ্টেড ছিল, ওটা জিপিএস রিডারে কাজ করছে না।

আশেপাশের পাহাড়গুলো বেশ উঁচু। আমাদের বিকল্প পরিকল্পনা হলো, যদি পাড়া না পাওয়া যায়, তবে এই মৌসুমে পাহাড়-চূঁড়ায় জুমঘর নিশ্চিত পাওয়া যাবে, কেননা এখন জুমের মৌসুম— পাহাড়ে পাহাড়ে জুমচাষ হচ্ছে। ‘জুমঘর’ হলো পাহাড়ের উঁচু ঢাল কিংবা চূঁড়ায় বানানো বিশ্রাম-ঘর। রোদের মধ্যে পরিশ্রম শেষে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য এমন ঘর বানান পাহাড়িরা। এখানে জানিয়ে রাখি, “জুম” কোনো ফসলের নাম নয়, বরং পাহাড়ের ঢালে ভাঁজ সৃষ্টি করে চাষ করার পদ্ধতির নাম মাত্র। জুম পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ফসল চাষ করে পাহাড়িরা।

এই সেই জায়গা, যেন কোনো বারমুডা ট্রায়াঙ্গ্যাল, ঘুরছি আমরা যেন এক চক্রে
এই সেই জায়গা, যেন কোনো বারমুডা ট্রায়াঙ্গ্যাল, ঘুরছি আমরা যেন এক চক্রে (ছবি: লেখক)

ডানদিকের একটা ঢালে বেড়া দেখে আন্দাজ করা গেল, পাড়া খুব কাছেই আছে। কিন্তু এটা রীতিমতো অসম্ভব যে, এই শরীরে একটার পর একটা পাহাড়ে উঠে উঠে যাচাই করে আসা, কোন পাহাড়ে একটা পাড়া আছে। সামনে, ঝিরিটা দুই ভাগ হয়ে গেলো। বামের পথটা বেশ গাছগাছালিতে পূর্ণ, ডানের পথটা পরিষ্কার। আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু আবুবকর, কিভাবে যেন বললেন ডান দিকেরটা ধরতে। তাঁর কথার কনফিডেন্সকে সমীহ করলাম আমরা।

ডানদিকের পথটা ধরে চললাম। পাড়া পাবার আশা আমাদের মিইয়ে যায়নি এখনও। কারণ লক্ষণগুলো পাড়ার অস্তিত্বের কথাই বলছে। আমরা একটা পাহাড় ঘুরে এলাম। আমার কাছে মনে হলো আমরা যেন একটা পাক্কা ইউ-টার্ন নিলাম। কথাটা আবুবকরকে বলে বোধহয় একটু কনফিউজ করে ফেললাম।

সামনে, পাহাড়ের ঢালে হঠাৎ দেখি চারটা গয়াল। আবুবকর এক্কেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন, অবশ্যই এখানে কোনো পাড়া আছে। কিন্তু পাহাড়ের গাছ-গাছালির আড়ালে কোত্থাও কোনো পাড়ার ঘর-বাড়ি কিংবা মানুষ দেখলাম না। তবু আমরা ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে চললাম। অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে থাকলো আমাদের। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে পাঁচ মিনিট। এর মধ্যে আমাদেরকে বেশ দুর্গম বড় বড় কিছু পাথরের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের ঢাল টপকাতে হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো নাকিব, রাসেল কেউই কোনো সহায়তা ছাড়াই পার হয়ে গেলো পথটুকু। কোনো একটা পাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি আমরা, বেশ বুঝতে পারছি।

এবারে ঝিরিটা ডানদিকে বাঁক নিল। নদীর নিয়মানুযায়ী যেদিকে বাঁক নিয়েছে, তার বিপরীত দিকে তৈরি করেছে একটা বিস্তৃত ঢাল। অন্ধকার ঘিরে ধরতে শুরু করেছে আমাদেরকে। বাঁকের ধরণ দেখে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমরা একটা পাহাড়কে মাঝখানে রেখে এমন একটা ঝিরি ধরেছি, যা ধরে আসলে এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে বলে আবুবকর সিদ্ধান্ত জানালেন, আমরা সবাই আরেকটু সামনে দেখে আসবো। যদি কোনো পাড়ার সন্ধান না পাই, তাহলে এই ঢালে এসে রাতের মতো আবাস গড়বো। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। আমরা আরেকটু এগিয়ে দেখার জন্য চললাম। পথটা এখানেও পাহাড়ের উপর দিয়ে উঁচু-নিচু। অন্ধকারে শহুরে ছেলেদের চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। রাসেল হাঁক দিল, কেউ টর্চ জ্বালো…। অন্ধকারে দেখি নাতো কিছু…।

নিশাচর আমি বিশ্বাস করি, যত বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকা যায়, তত চোখ সইয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আলো জ্বাললেই আলোক-সংবেদী-চোখ অন্ধকারকে কিনে নেয়। তাই অসম্মতি থাকাসত্ত্বেয় দলের প্রয়োজনে টর্চটা বের করলাম। টর্চটা কিনেছিলাম বায়তুল মোকাররম থেকে মাত্র ৳১৭৫ [টাকা] দিয়ে। কিন্তু এক ব্যাটারির এই এলইডি বাল্বের টর্চটা যে এতো আলো দিবে, বুঝিনি। পথ দেখালো ওটা, রাসেলকে।

কিন্তু পাড়া কোথায়? আবুবকরের সিদ্ধান্ত শুনে বোধহয় শরীর হাল ছেড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু পাড়া তো দেখছি না। অন্ধকারে, ঝিরিতে, আমরা সাতজন…

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

পরিশিষ্ট ১:

ক’সর নামায: আমরা যেহেতু আমাদের বাসস্থান (ঢাকা) থেকে ৪৮ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য রয়েছি, তাই আমাদের জন্য আল্লাহর একটা উপহার আছে, কম নামায। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসাফিরদের জন্য উপহারস্বরূপ, সব ৪ রাকা’ত ফরজ নামায হয়ে যাবে ২ রাকা’ত, আর ফযরের নামায বাদে আবশ্যকীয় সুন্নত-নফলগুলো হয়ে যাবে ঐচ্ছিক। আমরা তাই ট্যুরে থাকাকালীন যোহর, আসর আর এশার দুই রাকা’ত নামায পড়েছি।


বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাবতীয় ভৌগোলিক কোঅর্ডিনেট “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সদস্য আবুবকর-এর সহায়তায় প্রাপ্ত।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৪)

রাসেলের বাম পায়ের পাতায় ব্যথা করছে। সম্ভবত তার পা বাঁকা হয়ে কোথাও পড়েছে, তাই ব্যাথা করছে। কিন্তু সে হাঁটতে পারছে, তাই আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার সম্ভাবনা নেই। আমরা আমাদের প্ল্যানেই থাকলাম। গাইড দুজনকে অনুসরণ করে আমরা একটা ত্রিপুরা পাড়ায় পৌঁছলাম। পাড়াটার নাম বিকাশ বলেছিল, কিন্তু লিখে রাখিনি তখন। বগামুখ থেকে নেমে এসে আমরা এই পাড়ার উপর দিয়ে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, “বগামুখ” নামটাই সঠিক, “বগা মুখ” সঠিক নয়। স্থানীয়রা ওটাকে একত্রে উচ্চারণ করেন (তাছাড়া সমাসবদ্ধ পদ একত্রে লিখার নিয়ম)।

যাহোক এই ত্রিপুরা পাড়ার ভিতর দিয়ে পার হবার সময় একজায়গায় দেখলাম বেশকিছু এপিটাফ বা কবর-ফলক। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, প্রত্যেকটাতে ক্রুশের ছবি (পরে অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে); আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যেকটা কবর-ফলক খুব কাছাকাছি, একটু বেশি ঘনঘন লাগানো। আরো একটা বিষয় স্পষ্ট হলো, ত্রিপুরারা এখন আর নিজেদের লিপি ‘ককবোরক লিপি’ ব্যবহার করে না, খ্রিস্টানদের উপহার দেয়া ল্যাটিন হরফ দিয়ে নিজেদের ভাষা লিখে। …কবর-ফলকগুলো যেখানটায় শেষ, ঠিক তার গা ঘেষে একটা বেড়া-পথ। ভিতরে একটা টিনের ছাউনির বাঁশের ঘর। দরজার উপরে মাইক লাগানো দেখে প্রথমে মসজিদ ঠাওরালেও কবর-ফলকগুলো স্পষ্ট করে দিলো ওটা একটা গির্জা —এই ত্রিপুরা পাড়াও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। তবে গির্জাটা স্কুল ঘরের মতো ল্যাটিন আই আকৃতির, প্রচলিত ক্রুশাকৃতির ভূমি-নকশায় নয়।

গির্জার পাশ দিয়ে এগিয়ে সামনে যেতেই আপেল নাকি বিকাশ বললো, পাশেই উপরের টিলাতে রয়েছে একটা বাদুড় গুহা। খবরটা আবুবকর ভাইকে জানালাম। সেই ঝিরিতে যখন নেমেছি, তখন থেকেই আবুবকর ভাই তাঁর জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসে কোঅর্ডিনেট নিচ্ছিলেন। কোঅর্ডিনেট নেয়ার জন্য কিছুই করতে হয় না, ডিভাইসটা চালু থাকলেই হয়। আবুবকর ভাইয়ের কাজ হলো বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলো একটা নাম অথবা মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা। এব্যাপারে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সাথে ঘুরাঘুরির সুবাদে; ডিভাইসটা আসলে দলেরই। আবুবকর ভাইয়ের রিডিংমতে, বাঁদুড় গুহার কোঅর্ডিনেট 22° 1’21.36″N, 92°27’37.55″E।

আমি সামনে এগিয়ে চললাম, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ওরা বেশ একটু পিছনে পড়ে গেছে। আমি ভাবলাম কামরুল বোধহয় বাদুড় গুহা দেখতে চলে গেছে। পরে জানলাম রাসেলের পায়ে ভালো ব্যথা পেয়েছে, ওকে সহায়তা করার দরকারে কামরুল পিছিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা এগিয়ে এলো, রাসেলকে পা ফেলতে সহায়তা করার জন্য গাছের একটা লম্বা ডাল দিয়ে লাঠি বানিয়ে দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে সে এগিয়ে আসছে, একটু স্বস্থি হলো।

বড় বড় পাথরের মাঝে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করতে থাকলাম। বড় বড় শিমুল গাছ তার লাল ফুলের শোভা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছিল। শান্ত নিথর পানির ভিতরে সূক্ষ্ম জলপ্রবাহমাত্র —কোনোরকমে জলের ধারা বইয়ে রেখেছে পাথরের দঙ্গলে। কোথাও পানি এতোটাই নিথর যে, ব্যাঙাচির শান্তির আবাস গড়ে উঠেছে বেশ। স্বচ্ছ পানিতে কালো চকচকে ব্যাঙাচিগুলোকে দেখে বেশ সুস্বাদু লাগছিল (সত্যি বলছি)। 🙂

ঝিরিপথ যেখানে দুপাশে মাঝারি উঁচু পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা, সেখানে দূ—রের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো আবারো হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমাদের। আমরা যেন সেই ডাকে সাড়া দিয়েই এগিয়ে চলেছি। দলটা একটু শ্লথগতিতে চলছে রাসেলকে সাথে নেবার জন্য। রাসেল দেখি পা ভালো করেই মচকেছে!

পাথরের বিছানা, উজানের দিকে খাঁজ
পাথরের বিছানা, উজানের দিকে খাঁজ (ছবি: নাকিব)

পথ কিছুটা একঘেয়ে, পাথর, পানি, পানির মাঝখানে জেগে থাকা পাথর, গাছ, নুড়ি পাথর —এরকমই। আমাদের পথচলা চলছে, কামরুল আর রাসেল একটু পিছিয়েই আছে। নাকিব তার ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছে। আর তখনই সামনে পড়লো একটা পাথরের বিছানা। পাথরের বিছানাতো আর সমতল হয় না, এবড়ো-খেবড়ো। পানি শুকিয়ে গেছে। যদি বর্ষাকাল হতো, তাহলে এই মুহূর্তটা হতো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত, যখন পানির তীব্র স্রোত এসে পার হতে চাইতো এই পাথরের বিছানার উপর দিয়ে, তখনই সৃষ্টি হতো অপূর্ব এক দৃশ্য, কারণ পাথরগুলো ভাঁজ হয়ে আছে উজানের দিকে। ব্যাপারটা আমার কাছে আশ্চর্যই লাগলো, কারণ পানির তীব্র ঘর্ষণে পাথরে যদি খাঁজ হয়ই, তাহলে সেটা হবে ভাটির দিকে, যাতে পানি আরামে যেতে পারে। কারণ পানির ধর্মই হলো বাঁধাকে সরিয়ে দেয়া, আর না পারলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। কিন্তু বর্ষাকালে নিরন্তর ঘর্ষণসত্ত্বেয় এখানকার খাঁজগুলো মানে উত্তল দিকটি কেন উজানের দিকে —তা আমার কাছে আশ্চর্যই হয়ে থাকলো। কামরুল সয়েল সায়েন্স বা মৃত্তিকা-বিজ্ঞানের ছাত্র; সে, দায়িত্বটা ভূতত্ত্বের ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলো।

আবার আমাদের পথচলা। এবারে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, স্বর্গ এসে মর্তে জায়গা করে নিলো। অপূর্ব এক পাহাড়ি খাঁজে গিয়ে আমরা হাজির হলাম, যেখানে দুপাশে উঁচু পাহাড়ি ঢাল, মাঝখানে গভীর পানির খাঁজ, আর দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ধু ধু বাতাস এসে উড়িয়ে নিচ্ছে আমাদেরকে স্বর্গের কোনো এক দুয়ারে। কাচ-স্বচ্ছ সেই পানিতে আসলে দেখা যাচ্ছিল অনেক অনেক গভীরে থাকা পাথুরে সবুজ শ্যাওলাগুলো, তাই পানিকে সবুজ লাগছিল। সুশান্ত পানি দেখলে বোঝার উপায়ই নেই যে, ভিতরে ভিতরে একটা প্রবাহ আছে। দুপাশে পাথরের খাঁজগুলো রীতিমতো গভীর ভাঁজের।

পথটা এবার সেই পাথরের চাপা খাঁজ ধরে গেছে। আপেল এগিয়ে গিয়ে জানালো, সামনে পাথরটা হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে, আর সেখানে নামার জন্য পাহাড়িরা দুটো বাঁশ লাগিয়ে রেখেছে। আবুবকর ভাই শুনেই বললেন, না, বাঁশ বেয়ে নামা যাবে না; অন্য পথ দেখো। অন্য পথ তো আর নেই। একটাই আছে, সাঁতরে যেতে হবে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে টীম-লিডার কেন জানি সাঁতারের সিদ্ধান্ত নিলেন না। তাকালেন পাহাড়ের দিকে।

আপেল আর বিকাশ, হাতে দা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে উঠে পড়লো খাড়া পাহাড়ে। কিছুক্ষণ পরেই জানালো, উঠে আসেন। ব্যস, শুরু হলো পাথুরে পাহাড় বাওয়া। তখনও বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারিনি যে, আমরা কোথায় উঠতে যাচ্ছি। যখন উঠে পড়লাম, তখন বুঝতে পারলাম, আমরা একটা ৮০ ডিগ্রি খাড়া ঢালে দাঁড়িয়ে।

সবার সামনে আমাদের দুই গাইড, তার পরেই আবুবকর ভাই, তারপর রাসেল, নাকিব, আমি আর সবার পিছনে কামরুল। রাসেল তার লাঠির উপর ভর দিয়ে এতক্ষণ চলছিল, এখন সেই লাঠি ফেলে দিয়ে দুই হাত দিয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে নিজের পতন ঠেকানোই সমিচীন মনে করলো।

এই প্রথম আমার পাহাড়ে ট্রেকিং, নিচে গভীর খাদ, অবশ্য খাদে যাবার আগে পাথরে ঘষটে ঘষটে হাত-পা পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের খোরাক হয়ে যাবে তার আগেই, তার-উপর এত্তো খাড়া ঢাল, সাথে আমাদের সাপোর্ট দেয়ার মতো ভারি কোনো রশি নেই যে রোপিং করে পাহাড় পাড়ি দিব। কিন্তু এই প্রথম আমি আমার ন্যাপস্যাকটার উপকারিতা পুরোপুরি টের পেলাম: এক্কেবারে আঁটোসাটো হয়ে পিঠের সাথে লেগে আছে, ওজন কমিয়ে আনায় ওটা বহন করতে মোটেই ‘বোঝা’ মনে হচ্ছে না, ছোট হওয়ায় কোথাও আটকে বাধা সৃষ্টি করছে না; আর পিঠে ঝুলে থাকায় দুই হাত এক্কেবারে আরাম্‌সে ব্যবহার করতে পারছি। এদিকে ৳১১০ [টাকার] জুতাও যে হিরোতে রূপ নিবে, বুঝতে পারিনি। এত্‌তো অপূর্ব গ্রিপ দিয়ে আমাদের বাঁকা হয়ে থাকা পা-গুলো আটকে রাখলো ঐ পাথরের মাঝে যে, বলাই বাহুল্য হবে।

কিছুটা ভয়ও কাজ করলো ভিতরে ভিতরে। মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসলো। কারণ আমার দুটো-রড-ঢোকানো-ভাঙা-হাত নিয়ে বান্দরবান আসতে দিতে তাঁর খুব একটা সম্মতি ছিল না। এখানে পড়ে মরলে সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ হবে তাঁর। কিন্তু, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আঁশ: আমরা পথচলা চালিয়ে গেলাম।

সামনে এগোতেই পাক্কা ৮০ ডিগ্রী খাড়া ঢাল, সারিবদ্ধ আমরা পাঁচ জন, পায়ের নিচে গুড়ি গুড়ি নুড়ি পাথরের ছড়াছড়ি, নিজের শরীরের ওজন আর ব্যাগের ওজন মিলে মাধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে টানছে; পা হড়কালে ১০০ ফুট নিচের পাথুরে খাঁদে চির সমাধি, তাও শুধু একজনের নয়, নিচে, খাড়া পাহাড়ের সাথে ঝুজতে থাকা আরো তিনজনেরও।

পা রাখতে খুব মাপতে হচ্ছে আমাদের। এমনকি আবুবকর ভাইও বেশ একটু ধীর হয়ে গেলেন। তাঁর সমস্যা হলো ভারি ব্যাগ। কিন্তু ঐ ব্যাগ নিয়েই তিনি নামতে চাইলেন। ধরার তেমন কিছুই নেই, বেশকিছু আলগা পাথর-মাটি খসালে কখনও বেরোয় একটু চোখা কোনো পাথর, তাতে কোনোরকমে হাতটা বাঁধিয়ে নিজের ভার স্থানান্তরের উপযোগী করে পা তুলতে হয়। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আবুবকর ভাই নামলেন। তার পিছনে রাসেল নামলো নুড়ি-পাথরের মেঝেতে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে। নাকিবকে তার খানিকটা মোটা শরীর নিয়ে একটু বেশিই কসরত করতে হলো। আমি আমার লিকলিকে শরীরখানা নিয়েও যে খুব সাবলীল ছিলাম, তা না। প্রথম ট্রেকিং হিসেবে বেশ খাটিয়ে ছাড়লো ঢালটা। পিছনে কামরুলকে দেখলাম নিজের শরীরের ওজন নিয়ে বেশ কষ্টই করছে। তবে কষ্ট হলেও সবাই-ই কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই নেমে এলাম ওপারে।

নেমে সবাই-ই বেশ খানিকটা ক্লান্ত। তবে আশার কথা হলো, আমরা পেরেছি। বিশেষ করে আমি, নাকিব আর রাসেল সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হলেও আমরা পেরেছি। তারও চেয়ে বিশেষায়িত, কারণ রাসেল তার মচকানো পা নিয়েও সে যে পার হয়েছে, এটা আশার কথা। এপারে পাথরের ফাঁক গলে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে সেই খাদের দিকে। আমরা বোতলে পানি ভরে খেয়ে নিলাম সবাই তৃপ্তি ভরে।

আমি আর আবুবকর ভাই ছুটে গেলাম সেই বাঁশের কাছে, যেদিক দিয়ে নামা যেত। গিয়ে দেখি ওই দুটো শুধু বাঁশ নয়, বরং ছিদ্র করা বাঁশ। ঠিক মইয়ের মতোই প্রত্যেকটা বাঁশে নির্দিষ্ট দূরত্বে ছোট ছোট ছিদ্র করা হয়েছে, শুধু মইতে দুটো বাঁশকে জোড়া লাগায় ছিদ্রগুলোতে জায়গা করে নেয়া আরো কিছু কাঠি, এখানে সেই জিনিসটা নেই। আমি তরতরিয়ে ঐসব গর্তগুলোতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঢুকিয়ে উঠতে লাগলাম এটা বোঝার জন্য যে, জিনিসটার ব্যবহার কেমন করে হয়। আবুবকর ভাই বেশ আশ্চর্য হলেন আমার কম্ম দেখে, কামরুলকে ডেকে বললেন ছবি তুলতে।

আমি ততক্ষণে নেমে আবার উঠলাম। এবারে নামার সময় আমি পায়ের দ্বিতীয় আঙ্গুল দিয়ে নামলাম, এবং আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, বুড়ো আঙ্গুলের চেয়ে এই আঙ্গুল দিয়ে আরো আরামে উঠা-নামা করা যায়। তবে এটা বুঝতে পারলাম, ঐ পাহাড়-চড়ার চেয়ে সহজেই আমি অন্তত এই বাঁশ বেয়ে নামতে পারতাম। 🙂 যাহোক পেয়ে গেলাম দুই পাহাড়ি কিশোরকে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কিভাবে উঠে। ওরা জানালো, ওরা বুড়ো আঙ্গুল দিয়েই উঠে।

যাহোক, আমরা আবার পথ চলার তাগিদ অনুভব করলাম। ওদিকে রাসেলের পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। আবুবকর ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে তাকে একটা নাপা (পেইন কিলার) খাইয়ে দিলাম। তারপর আবার পথচলা। রাসেল তার পা টেনে টেনে হাঁটছে।

আরোও আরোও সৌন্দর্য্য, আরো আরো অপূর্ব সব দৃশ্য… কত আর বলি? আমরা আমাদের পথচলা থামাই না। কোথাও পাহাড়ের গায়ে পাথরের স্তর দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, কোথাও পাথরের মেঝেতে কারুকাজ দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, কোথাও একটা পড়ে থাকা গাছের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি এর পতনের কারণ। পথ চলছি।

আরো বেশ কিছুদূর যাবার পর আমরা পৌঁছে গেলাম এক অপূর্ব স্থানে, যেখানে খুবই ছোট্ট, মাত্র তিন কি সাড়ে তিন ফুট উঁচু একটা ঝরণা। ঝরণার পানির কলকল, পাথরের খাঁজ ধরে আসা বাতাসের তীব্র প্রবাহ আমাদের ক্লান্তিকে এক্কেবারে ধুয়ে দিয়ে যেতে লাগলো। পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নিতে চাইলো সবাই, আসল কথা বিশ্রাম না, দৃশ্য উপভোগ। দলনেতাও সায় দিলেন। ব্যাগগুলো কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে একটু আরামে হাঁটাহাঁটি করার সুযোগ হলো। রাসেল শুয়ে নিজের পা-কে একটু বিশ্রাম দিতে চাইলো। কামরুল চলে গেলো ছবি তুলতে, নাকিব আর আমিও একই পথে।

যে পথে আমরা এসেছি, সেদিকে তাকিয়ে কী যে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম, সে নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো যাবে না। মনে হলো আমি জাপানে বসে আছি। ক্যামেরায় সেটা আপনাদের খানিকটা দেখানো যেতে পারে, কিন্তু উপভোগের মজাটা কী, সেটাতো বলে বোঝানো যাবে না। উঠতে মন চাইছিল না জায়গাটা ছেড়ে। তবু পানি-পান, দৃশ্য-ভক্ষণ আর বিশ্রাম-গ্রহণ শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম। বিদায় জানালাম জাপানকে।

সামনে সব বড় বড় পাথর। এর মাঝে বাম দিকে তাকিয়ে দেখি বিকাশকে দেখা যাচ্ছে ঐ যে দূরে একটা পাহাড়ের গভীর খাঁজে। ছবি তুললাম। আরো একটু সামনে গিয়ে রীতিমতো টাশকি খেলাম: এটা কী!!!

ইয়া— ব–ড়-একখান পাথর। বিশা—লাকৃতির। বলা যায় প্রায় দুই তলার সমান। ওটার পাশ দিয়ে যেতেও ভয় করে, যদি গড়ান দিয়ে গায়ের উপর এসে পড়ে, শ্রেফ ভর্তা হয়ে যাবো। এই জায়গাটা সিরিয়াস সব পাথরের আড্ডাখানা। দেখে মনে হতে পারে, সবগুলো একসাথে গল্প করে করে গোসল করবে বলে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝিরিতে!

কোনো রকমে এই সাবু-পাথরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। রাসেলকে বেশ বেগ পেতে হলো এগুলোকে পার করতে, কিন্তু সেও এগিয়ে চললো ব্যাথাকে দমিয়ে রেখে। কিন্তু সামনে আমাদের নিয়তি যে কী নিয়ে অপেক্ষা করছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি আমরা। সামনের এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে প্রথমে আমি কিছুটা বোবাই হয়ে যাই: সৌন্দর্য্যে না, ঝঞ্ঝাটের চিন্তায়! আবার কি পাহাড় বাইতে হবে?

মাঝখানে গভীর পানি, দুই পাশে পাক্কা ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়। যাও এবার সামনে!!

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

_________________________________

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাবতীয় ভৌগোলিক কো-অর্ডিনেট “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সদস্য আবুবকর-এর সহায়তায় প্রাপ্ত।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ৩)

আমাদের প্রকৃত যাত্রাপথ রুমা খালের মুখ (22° 1’57.00″N, 92°24’53.48″E) থেকে শুরু বলে শেষবারের মতো আমরা সম্মিলিতভাবে হাত তুলে প্রার্থণা করে নিলাম আল্লাহ’র কাছে। স্বাভাবিকভাবেই সে প্রার্থণায় বিকাশ আর আপেল সামিল হলো না। আমরা পানিতে পা রাখলাম, ভিজিয়ে ফেললাম পরনের অ্যাংকলেট, এবং এটাও বুঝলাম, আমাদেরকে এভাবে পথে অনেক অনেকবার ভিজতে হবে, শুকাতে হবে —এগুলো গোনায় ধরা যাবে না।

এখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় আমাদের, রুমা খালের শুরু এখান থেকে। (ছবি: লেখক)
এখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় আমাদের, রুমা খালের শুরু এখান থেকে। (ছবি: লেখক)

পথ শুরু হলো আমাদের ঝিরি পথ ধরে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি যে প্রবাহ সৃষ্টি করে চলে, আমার সিলেট অঞ্চলে সেগুলোকে বলে ‘ছড়া’ (যেমন: ‘হাত ছড়া’/‘সাত ছড়া’ থেকে ‘সাতছড়ি’), আর চট্টগ্রামে সেগুলোকে বলে ‘ঝিরি’। আমাদের পথ এখন থেকে এভাবেই ঝিরি ধরে চলবে, তাই আমাদের পানি বহন করার দরকার নেই। ঝিরির পানি স্বচ্ছ, যদিও শীতকাল বলে পানি খুবই কম, তবে হীম্‌ম্‌ম্‌-শীতল —বরফের মতো ঠান্ডা।

দৃশ্য দেখা শুরু হলো। জানি, সামনে অপেক্ষা করছে এর থেকেও অপূর্ব অপূর্ব সব স্থান, তবু এই দৃশ্যও উপভোগ করতে মন চাইছে। কিন্তু হাঁটায় বিরতি দেয়া চলবে না — সময় = স্বর্ণ। আমরা পার করে চলেছি ‘বড়শি পাড়া’। বড়শি পাড়ার এই দিকে কাছেই রয়েছে ‘ইডেন রোড’। বলাই বাহুল্য, আমরা রোডে নয়, ঝিরিতে রয়েছি।

ঝিরিপথ ধরে আমাদের পথ চলা, প্রথম দিকে (ছবি: লেখক)
ঝিরিপথ ধরে আমাদের পথ চলা, প্রথম দিকে (ছবি: লেখক)

ঝিরি পথে চলার পদ্ধতি হলো, খালের পাড় ধরে চলতে হবে, সেখানে নুড়ি পাথর থাকতে পারে, কাদা থাকতে পারে, বালি থাকতে পারে, ঘাস থাকতে পারে, ঝোঁপ থাকতে পারে, পাথর থাকতে পারে —হাঁটতে হবে। আর যেখানেই সামনে খাড়া পথ আসবে, সেখানেই ঝিরি ডিঙিয়ে ওপর পাড়ে যেতে হবে, তারপর আবার চলা শুরু হবে। আবারো সামনে বাধা এলে এপাড়ে এসে চলতে হবে। আমরা পানিতে ভিজছি, আবার ডাঙায় উঠে বালিতে পা রাখছি, পায়ের অবস্থা হচ্ছে দেখার মতো। কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই। পথ চলতে থামা যাবে না।

আবুবকর তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে নির্দেশনা দিলেন, ‘নয়ন, আপনি সবসময় আপেলের সাথে সাথে থাকেন।’ আপেল চলছে সবার আগে, আমি দলনেতার কথা মান্য করলাম, এবং বলাই বাহুল্য, তাতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না। রাসেল, নাকিব একটু পিছিয়ে পড়েছে, দেখা গেল কামরুলও। রাসেল আর নাকিব পিছিয়েছে হাঁটার অনভ্যস্থতায়, রাসেল ছবিও তুলছে, আর কামরুল পিছিয়েছে ছবি তোলার কারণে। আবুবকর তাড়া দেয়ায় সবারই সম্বিত ফিরে এলো। ক্যামেরা পুরে নিয়ে পা চালালো। আবুবকর পরে আমাদেরকে শিখিয়েছেন, সবসময়ই সবার আগে যে থাকে, সে সব সময়ই আগে থাকতে পারে। আর সবার পিছনে যে থাকে, সে সব সময়ই পিছিয়ে যেতে থাকে। তাই দলকে সচল রাখতে পিছনের জনকে সব সময়ই সামনে এগিয়ে দিতে হয়। আমাকে আপেলের সাথে চলতে বলার উদ্দেশ্যও ছিল সেটা।

আমার দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি দুটোই সিলেটে। দাদাবাড়ি হাওরাঞ্চলে, নানাবাড়ি পাহাড়ে। এছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম একটু উদ্যমী, আলহ্বামদুলিল্লাহ। গাছে চড়তেও আপত্তি নেই আমার। তাছাড়া বয়সের তুলনায় শরীরটা একটু বেশিই হালকা, তাছাড়া সবসময়ই আমি প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে হাঁটি, ঢাকায় থাকলেও। তাই নিজেকে টানতে আমার কখনোই কোনো কষ্ট হয় না, বাতাসের বেগে চলি। 🙂 এবারে, তার সুফল হাতেনাতে পেতে থাকলাম। নিজের ব্যাপারে একটু সন্দিঘ্ন হলেও একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস পেতে শুরু করলাম।

আমাদের পথটা ‘লাইরাম্পি পাড়া’র পাশ দিয়ে চললো, এটা একটা মিশ্র পাড়া, যেখানে ত্রিপুরারা ছাড়াও আরো বিভিন্ন জাতির লোক একত্রে বাস করে। আপেল আর আবুবকর জানালেন, এখানেই আর্মি ক্যাম্প। আমরা চাইলে এদিকে দিয়েও নামতে পারতাম, কিন্তু আমরা খাল ধরে চলবো বলে খালের শুরু থেকে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের পথ চলছে, আমরা চলছি।

ত্রিপুরাদের সম্পর্কে একটু বলি: ত্রিপুরারা মূলত ভারতের ত্রিপুরা’র বাসিন্দা, তাদেরই অপভ্রংশ হলো বাংলাদেশের ত্রিপুরা উপজাতি, যাদের একটা বৃহৎ অংশের বাস কুমিল্লায়, এছাড়াও রয়েছেন সিলেট আর এই চট্টগ্রামে। বাংলাপিডিয়ামতে, এরা নিজেদেরকে টিপরা, তিপারা বা তিপ্রা নামেও পরিচয় দেয়। চাকমাদের কাছে এরা ‘তিবিরা’, মারমাদের কাছে ‘ম্রোং’, লুসেইদের কাছে ‘তুইতুক’, আর পাঙ্খোদের কাছে ‘বাই’ নামে পরিচিত এরা। ত্রিপুরাদের একটা নিজস্ব ভাষা ছিল, নাম ‘ককবোরক’ বা ‘ককবরক’, এই ভাষার ছিল নিজস্ব হরফ বা গ্লীফও। রহস্যপত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০০৮ সংখ্যায় আমি জানতে পারি, ককবরক ভাষার প্রথম “ককবর্মা” ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন একজন বাঙালি, নাম তাঁর দৌলত আহমেদ মজুমদার (এই বিজ্ঞজন, বিদ্যজন সম্পর্কে বলতে গেলে আলাদা একটা লেখার দরকার)। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর ককবরক ভাষার লেখ্যরূপের ১০০ বছর পূর্তিতে উৎসব (ককবরক ভাষায়: ‘ককবরক তের’) পালিত হয় ভারতের ত্রিপুরায়। ‘কক’ অর্থ ভাষা, আর ‘বরক’ অর্থ মানুষ, অর্থাৎ ককবরক অর্থ মানুষের ভাষা। ত্রিপুরাদের মধ্যে হিন্দুধর্মের প্রভাব দেখা যায়, তবে এখনকার ত্রিপুরাদের অনেকেই মিশনারীদের প্রভাবে খ্রিস্টধর্মে দিক্ষীত (আমি সেটাকে বলি ‘লৌকিক খ্রিস্টধর্ম’)।

বিরাট বিরাট উঁচু পাহাড়গুলো আমাদেরকে ডাকছে দূর থেকে, সেগুলোর দিকে তাকাতে পারছি না, কারণ মাথার উপরে তীব্র সূর্যের তাপ। সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে গামছাটা মাথায় দিয়ে রেখেছি। এর আগে ধুলা থেকে বাঁচতে গামছা দিয়ে মুখও ঢেকেছিলাম। বাঙালির এই উপাদানটি রীতিমতো ম্যাজিক। ঝিরিপথ ধরে চলতে চলতে কোথাও দেখা যায় বাঁধ, পাথর দিয়ে ঝিরির পানিতে বাঁধ দেয়া হয়েছে। ওগুলো দেখলেই আমার বীভারের বাঁধের কথা মনে পড়ে যায়।

বীভারের মতো এরকম বাঁধ দিয়ে আদিবাসীরা মাছ চাষ করেন (ছবি: লেখক)
বীভারের মতো এরকম বাঁধ দিয়ে আদিবাসীরা মাছ চাষ করেন (ছবি: লেখক)

বীভার (Beaver) হলো দক্ষিণ আমেরিকার এক প্রকারের প্রাণী, দেখতে কাঠবিড়ালির মতো, ঐ গোত্রেরই প্রাণী, বেশিরভাগই নিশাচর। ইউরোপ আর এশিয়াতেও কিছু আছে। এরা জঙ্গলে, পানির উৎসের কাছাকাছি থাকে। এরা এতোটাই দক্ষ যে, নিজেদের প্রয়োজনে এরা জঙ্গলের ছোট ছোট ডালপালা থেকে শুরু করে বড় বড় গাছ অবধি কেটে টেনে এনে, পাথর, মাটি, কাদা দিয়ে নদীতে জটিল বাঁধ সৃষ্টি করতে পারে। এরা সাধারণত গাছের নরম বাকল খায়, খায় লতাপাতা, জলজ আগাছা, সবজি ইত্যাদি। তাছাড়া এরা এতোটাই দক্ষ যে, ওরা পানির কাছেই ভূগর্ভস্থ গুহা বানায়, যার ঢোকার একাধিক মুখ থাকে, সবগুলো থাকে পানির নিচে। গুহার ভিতরে লতাপাতা, ডালপালা দিয়ে মেঝে বানায় ওরা। যাহোক, বীভারের বাঁধ হয় অপূর্ব, দেখার মতো। তবে জঙ্গলে, বীভারের কাছাকাছি কেউ যদি বাড়ি বানায়, তবে বীভারের কারণে তাদের অনেক ভোগান্তিও পোহাতে হতে পারে। হয়তো তাদের বাড়ির নিচেই সুড়ঙ্গ করে বিশাল গুহা দূর্গ গড়ে মাটি দিয়ে পুরো বাড়িটা ভরে ফেলে এরা।

বান্দরবানে বীভার থাকার কথা না। তাই এখানে, ঝিরিতে বাঁধ মানে হলো, পাশেই কোনো গ্রাম, মানে পাড়া আছে। কোথাও আবার ঝিরির পাথরের উপর কৃত্রিম ছোট ছোট মাঁচা। আবুবকর পরিচয় করিয়ে দিলেন, এগুলো দিয়ে আদিবাসীরা পূজা করেন; হয়তো জলশক্তির পূজা করেন প্রকৃতি-পূজারি মানুষগুলো, মাছের প্রয়োজনে। ধরে নিলাম পাশের কোনো পাড়ায় ত্রিপুরারা বাস করে।

পাহাড়ের কোলে কার্পাসের ক্ষেত (ছবি: লেখক)
পাহাড়ের কোলে কার্পাসের ক্ষেত (ছবি: লেখক)

আমাদের পথচলা থামার নয়, কখনও আদিবাসীদের চাষ করা কার্পাসের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে, কখনও তাদের কুমড়া ক্ষেতের, কখনও আফিম ক্ষেতের ভিতর দিয়ে চলছি। আমাদের কাছে আফিম ঘৃণিত নেশাদ্রব্য হলেও পাহাড়িদের কাছে এটা অনেকটা ঐতিহ্যগত উপাদান —হয়তো পাহাড়ের প্রচন্ড কষ্ট লাঘব করে দেয় বলেই এটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। কোথাও দেখা গেলো পাহাড়ধ্বস। উঁচু পাহাড়ের গা থেকে বড় গাছসহ পাথর ভেঙে পড়েছে ঝিরির পানিতে।

ঝিরির পানি খুবই স্বচ্ছ। তবে এখানে একাট কিন্তু আছে (ছবি: লেখক)
ঝিরির পানি খুবই স্বচ্ছ। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে (ছবি: লেখক)

পানির কোথাও কোথাও পাথর খুব পরিষ্কার, কোথাও আবার পাথরে প্রচুর সবুজ শ্যাওলা। শ্যাওলা-ধরা-পাথরে পা না দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই সেখানে পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটা ঢের ভালো। অন্তত পা পিছলে মচকাবে-তো না। …রাসেল দেখলাম বেশ পিছিয়ে পড়ছে। কারণ কী, জানতে চাইলে সে জানালো, তার বাম পায়ের পাতায় প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে, আমি আন্দাজ করলাম, কোথাও হয়তো বেকায়দায় পা পড়ে মচকে গেছে। কষ্ট করে হাঁটছে সে অবশ্য।

নাকিবের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে বৈকি, কিন্তু কষ্টটা হবে জেনেই সে এসেছে, তাই গা করছে না। কিন্তু শারীরিক কষ্টকেতো আর ঢেকে রাখা যায় না, চেহারায় তার ছাপও পড়ছে খানিকটা। আমরা প্রায় ২ ঘন্টার কিছু বেশি সময় ধরে হাঁটছি, আমি লক্ষ করলাম, আমার দুই ঠোঁট বন্ধ, অথচ আমার এতক্ষণ হাঁটায় হাঁপানোর কথা ছিল, মুখ হা করে শ্বাস নেবার কথা ছিল। নিজের প্রতি আরেকটু আশ্বস্ত হলাম, যাক, আমি বেশ উদ্যম ধারণ করছি তাহলে।

মাঝে মাঝে বোতল বের করে পানি খেয়ে নিচ্ছি আমি। বোতল বহন করতে নিষেধ করাসত্ত্বেয় আমি একটা বোতলে পানি ভরে ব্যাগের ভিতর রেখে দিয়েছিলাম। আমি সেটা বের করে গলা সামান্য ভিজিয়ে নিলাম। সার্ভাইভাল গাইড থেকে জেনেছিলাম, একসাথে অতিরিক্ত পানি পান না করে নিয়মিত অল্প পরিমাণ পানি খেতে থাকাটা খুব কাজের। শরীরে সব সময়ই পানির একটা প্রবাহ নিশ্চিত করা গেলে শরীরের কার্যক্ষমতা সঠিক থাকে। তাছাড়া আবুবকর বলে দিচ্ছিলেন, যদি পেশি সংক্রান্ত সমস্যায় পড়তে না চাও, তবে পানি খাওয়া চালিয়ে যাও। তাই মাঝে মাঝে পানি চালিয়ে, পথ চলছিলাম আমি।

মাঝখানে সামান্য বিরতি দিয়ে আবার অনেকক্ষণ পথ চলে আমরা হাজির হয়ে গেলাম ‘বগামুখ পাড়া’-তে। বগামুখ পাড়া মানে কিন্তু বগা লেক নয়, এখান থেকেও ঝিরি ধরে আরো প্রায় ২ ঘন্টার মতো হাঁটাপথ বগা লেক। আর আমরা যেখানে স্টেশন করেছি, সেটা ঠিক পাড়াটা নয়, এটা হলো ঝিরি ধরে বগা লেক গমনকারীদের বিশ্রাম এবং খাওয়া-দাওয়ার জন্য পাহাড়িদের একটা মিনি-বাজার-মতো। এখানে দোকান রয়েছে, পাহাড়ি রেস্তোরাঁ রয়েছে। এই মিনি-বাজার পাড়টিরও একটা নাম আছে, ‘উবাংখই পাড়া’ (22° 1’6.32″N, 92°27’22.15″E)। এখানে ইউরোপীয় কমিশনের দেয়া গণপাঠশালা কাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রও রয়েছে।

আমরা সেরকমই একটা রেস্তোরাঁ-তে গিয়ে বসলাম। ব্যাগগুলো খুলে রেখে গা এলিয়ে দিলাম পাশের বাঁশের বিছানাটায়। পা থেকে অ্যাংকলেট খুলে দেখি, তার ভিতরে জমেছে এক গাদা নুড়ি পাথর। সেগুলো ফেলে পরিষ্কার করে আবার পরে নিলাম। এখানে মাত্র আধা ঘন্টার বিরতি পাবো আমরা —ঘোষণা করলেন আবুবকর। আর এখানে যা খেয়ে যাবো, তার পরে আর রাতের খাবার। বিকালে আর খাবারের কোনো ব্যবস্থা হবে না। সুতরাং যত পারো ভালো করে খেয়ে নাও।

রেস্তোরাঁর দায়িত্বে থাকা মহিলা জানালেন ভাত রান্না করতে সময় লাগবে। তাই আমরা ঠিক করলাম কলা খাবো। বেশি, অনেক বেশি করে কলা খাবো, সাথে খাবো আমাদের সাথে করে আনা বিস্কুট আর দোকান থেকে কেনা বনরুটি। ব্যস, এভাবে আমরা প্রচুর কলা খেলাম। সেখান থেকে চা খেয়ে নিলাম ক্যাফেইন দিয়ে শরীরটাকে চাঙা করতে। গা এলিয়ে দিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে মনঃসংযোগের চেষ্টা করে নিজেকে প্রশান্ত করারও প্রয়াস ছিল। তারপর সেখানে কলার চামড়া গুনে টাকা পরিশোধ করলাম আমরা।

বগামুখ পাড়ায় আমরা বেরিয়ে পড়ছি আবার (সামনে আপেল, ডানে কামরুল, বামে দুই হাত ছেড়ে রাসেল, এক্কেবারে পিছনে আমি, একটু সামনে ক্যাপ মাথায় আবুবকর, তাঁর সামনে ক্যাপ মাথায় বিকাশ) (ছবি: নাকিব)
বগামুখ পাড়ায় আমরা বেরিয়ে পড়ছি আবার (সামনে আপেল, ডানে কামরুল, বামে দুই হাত ছেড়ে রাসেল, এক্কেবারে পিছনে আমি, একটু সামনে ক্যাপ মাথায় আবুবকর, তাঁর সামনে ক্যাপ মাথায় বিকাশ) (ছবি: নাকিব)

আবুবকর ঘোষণা দিলেন, উঠে পড়ো সবাই। নাহলে দেরি হয়ে যাবে। আবার ব্যাগ কাঁধে তুললাম। গামছা গলায় জড়িয়ে বেরিয়ে গেলাম রেস্তোরাঁ থেকে। পাশের পাহাড়েই বগামুখ পাড়া। সেখানে যাবার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আমরা এখন আর্মির বেঁধে দেয়া পথ ছাড়িয়ে যাবো, অচিন গন্তব্যে। আবার যাত্রা হলো শুরু, নেমে গেলাম আমরা ঝিরিপথে।

বিপত্তি ঘটালো রাসেল; তার পায়ে ব্যাথা করছে।

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

 __________________________________

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যাবতীয় ভৌগোলিক স্থানাংক “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর সদস্য আবুবকরের সহায়তায় প্রাপ্ত।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২ (কিস্তি ২)

শেষ পর্যন্ত সমাধান বেরুলো:

       আমরা তিনজন: উদ্দেশ্য বগালেক, কিওক্রাডাং (গাইড: সিয়াম)

       ওরা দুজন: উদ্দেশ্য বগামুখ পাড়া, তারপর নিজস্ব পরিকল্পিত পথ (গাইড: একজন)

রাতের খাবার শেষ হলে আবু বকর ঢাকায় ভ্রমণ বাংলাদেশ-এর বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে স্থানীয় গাইডকে খবর দিলেন। সে ব্যস্ত থাকায় পাঠালো পরিচিত গাইড সুমন দত্তকে। আবু বকর আর কামরুলের পথের বর্ণনা শুনে জানালো, তার সময় হবে না, তবে তার বড় ভাইকে ব্যবস্থা করে দিতে পারে। বড় ভাইকে খবর দিয়ে মামুনের রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো সুমন। সুমনের বড় ভাইকে যখন নিজেদের গন্তব্যপথের বর্ণনা দিলেন আবু বকর, তখন হঠাৎ পাশ থেকে কথা বলে উঠলো এক কিশোর, সে নাকি ওপথে আগে একবার গিয়েছিল। তারপর শুরু করলো দুর্ধর্ষ বর্ণনা। সেখানে নাকি বড় বড় ঝর্ণা, পানির তীব্র স্রোত, বানরের ডাকাডাকি; সেখানে ও’ গিয়েছিল মাছ ধরতে, রাতে সেখানে থেকেছে তারা, গা ছমছমে পরিবেশ; ঝিরির পানির তোড়ে তার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত ছিল। তার বর্ণনা শুনে আবু বকর তাকেই গাইড নিতে চাইলে সে ঐ ভয়ংকর জায়গায় যেতে রাজি হলো না। তাই আবার সুমনের বড় ভাইয়ের দিকে মুখ ফেরালের আবু বকর। সে ৪০০০ টাকা চাইলো। আবু বকর শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে তাকে ৳৩৫০০ বলে রাজি করালেন। ওমনি ঐ কিশোরও লাফিয়ে উঠলো, সেও যাবে, তবে তাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া লাগবে না, ফ্রি-তেই যাবে। (আসলে সে এই সুযোগে পথটা ভালো করে চিনে আসবে, আর পরবর্তি অভিযানকারীদের থেকে পয়সা কামাবে —বুদ্ধিমান ছেলে!)

কথা পাকাপাকি করে আমরা রুমে ফিরলাম। ওদিকে আমাদের তিনজনেরও বেশ লোভ লাগতে থাকলো বর্ণনা শুনে। জীবনে এমন সুযোগ আর আসবে কখন? একবারই এসেছে হাতের কাছে, কিভাবে সেটা হাতছাড়া হতে দিইইবা? ভাবতে ভাবতে একসময় নাকিব আর আমি চোখাচোখি হলাম। চোখে-চোখেই কী যেন পরামর্শ করে ফেললাম দুজনে।

রুমে ফিরে আলোচনা চলতে থাকলো আমাদের। ঐ দুজনের আমাদেরকে সাথে নিতে আপত্তি নেই। আমাদের একমাত্র সমস্যা হলো অফিস। অফিস থেকে মাত্র দুদিন ছুটি নিয়েছি। এখন যদি আবার অফিসে ফোন করে ছুটি বাড়ানোর কথা বলি, অফিস কিছুতেই রাজি হবে না। তাই যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। ঠিক করলাম গা ঢাকা দিব। অফিসকে কিছুই না জানিয়ে হারিয়ে যাব জঙ্গলে, ফিরে এসে জঙ্গলের দোহাই দিব, পথ হারিয়ে ঘুরে মরেছি, আর ফোন করিনি, কারণ নেটওয়ার্ক থাকেনা গহীন জঙ্গলে। বাসায় ফোন করে বলে দিলাম, বাস দেরি করায় আমাদের শিডিউলে বড় ধরণের পরিবর্তন হয়েছে, তো আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ফিরবো ইনশাল্লাহ। এর মধ্যে যোগাযোগ সম্ভব হবে না, কারণ নেটওয়ার্ক থাকবে না।

ব্যস, সব ঠিকঠাক। আমরা প্ল্যান করেছিলাম ২টা, প্ল্যান ‘এ’ আর প্ল্যান ‘বি’। এখন আমরা প্ল্যান ‘সি’ অনুসরণ করতে উদ্যত হয়েছি। রাতেই হিসাব করতে হলো, আমাদের কাছে কী কী আছে:

আবুবকর ও কামরুল: দুজনের একটা ডোম টেন্ট (গম্বুজ তাবু); দুজনের একটা বেডিং; গরম থাকার পোষাক; প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার; কামরুলের এসএলআর ক্যামেরা; দুজনের ব্যাকপ্যাক (Knapsack); পায়ে ট্রেকিং-উপযোগী জুতা; জনপ্রতি টর্চলাইট ইত্যাদি। (ওরা দুজনে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে ঔষধ খেয়ে এসেছে)

আমি, নাকিব, রাসেল: আমার বিছানার চাদর, নাকিবের গায়ে দেয়ার চাদর, অল্প-শীত নিবারক কাপড় (আমার আর নাকিবের); আমার ব্যাকপ্যাক, নাকিবের সাধারণ পিঠে-ঝোলানো-ব্যাগ, রাসেলের রশি-ব্যাগ; আমার মশা নিবারক ওডোমস ক্রিম; জনপ্রতি টর্চলাইট; নাকিবের 12x অপটিক্যাল যুম ক্যামেরা, রাসেলের এসএলআর ক্যামেরা, ট্রাইপড ইত্যাদি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা ওদের ছিল, তা হলো পাহাড়ে-জঙ্গলে চলার, পাহাড় বেয়ে উঠা-নামার, থাকার অভিজ্ঞতা, যা আমাদের কারোরই ছিল না (শুধু স্বপ্নটা ছিল)।

যেহেতু আমাদেরও ঐ শীতের রাতে থাকতে হবে, তাই আমাদের থাকার জন্য বড় একটা পলিথিন শীট কিনে নেয়া হলো। সম্মিলিত অর্থে কিনে নেয়া হলো পেঁয়াজ, ম্যাগি নুডল্‌স, ম্যাংগোবার, চকলেট, গজ-ব্যান্ডেজ ইত্যাদি। কামরুল জানালো আমরা যে রাবারের জুতা নিয়ে গেছি, ওটা বিপদ ডাকতে পারে। তাই রুমা বাজার থেকে তিনজন তিনজোড়া রাবারের জুতা কিনে নিলাম প্রতি জোড়া ৳১১০ [টাকা] দিয়ে। যাবার আগে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাতীত একটাও জিনিস যাতে না যায়, সেজন্য রাতেই আমরা সব প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে বাকি জিনিসগুলো আলাদা করে ফেললাম। ওগুলো রাসেলের একটা অফিস ব্যাগে পুরে রাখলাম, ওটা মামুনের রেস্টুরেন্টে রেখে যাওয়া হবে।

রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো খুব জরুরি, তবু আমাদের বারোটার মতো বেজে গেলো। নাকিব, বুঝলাম খুব উত্তেজিত। একটু পরপর নানান সম্ভাবনার কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। একসময় মশারির নিচে, হোটেল রুমের খাটে তিনজন ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাত!

 

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২; ভোর ৫:০০টা

ঘুম ভাঙলো মোবাইলের অ্যালার্ম শুনে। সময় হলো স্বর্ণসম। আবুবকর আর কামরুলও উঠে পড়েছে। আমরা ফযরের নামাযে যেতে চাইলাম, কিন্তু হোটেলের গেট বন্ধ। নিজেদের টয়লেটকর্ম শেষ করে ফযর, হোটেল রুমেই সারলাম। ৬টার সময় গাইড আসার কথা।

কিন্তু দেখা গেল, ছয়টা পেরিয়ে গেলেও তাদের খবর নেই। ফোন নাম্বারও রাখা হয়নি। ওদিকে আমাদের গাইড সিয়ামকে ম্যানেজ করার একটা উপায় বের করেছেন আবুবকর। শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করলাম, আমরাই বেরিয়ে যাই মামুনের হোটেলে, সেখানে নাস্তা করার পাশাপাশি আমরা খুঁজে নিব ওদেরকে।

আগের দিন স্থানীয় এক পরিচিত জনের থেকে “ভ্রমণ বাংলাদেশ”-এর পরিচিতি কাজে লাগিয়ে আবুবকর আরেকটা ফর্ম বিনামূল্যে জোগাড় করে ফেলেছিলেন। ওটা পূরণ করে ফেলা হলো আমাদের পাঁচ জনের নামে। মামুনের হোটেলে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে আমরা গাইডের খবর নিতে গেলাম। সিয়াম ইতোমধ্যে চলে এসেছে, তাকে আবুবকর ম্যানেজ করেছে। আবুবকর নিজের টাকায় হোক, ভ্রমণ বাংলাদেশের টাকায় হোক, খাবার চাল কিনে দেবার কথা বলে ক্ষান্ত করেছে তাকে। ওদিকে গাইড বিকাশ দত্তের (সুমনের বড় ভাই, আমাদের মূল গাইড) দোকানে গিয়ে দেখি সে আর আপেল মল্লিক (অত্যুৎসাহী কিশোর) মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। যাহোক ওদেরকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বলে আমরা রেস্টুরেন্টে ফিরে নাস্তা দিতে বললাম।

সকালের নাস্তা বলতে আছে ভাত, আলুভর্তা, ডাল। আমাদের কারোই তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু নাকিবকে দেখলাম সে পরোটা খাবে। সে চলে গেল অন্য আরেকটা রেস্টুরেন্টে। আমি নাকিবকে নিয়ে একটু সন্দিঘ্ন হলাম। জঙ্গলে যা পাওয়া যাবে, তা খেতে হবে; সেখানে তার যেভাবে পছন্দ গড়ে উঠছে, সেটা ঠিক জঙ্গলোপযোগী না —প্যাকেজ ট্যুর হলে ঠিক আছে। ওর আবার টয়লেট সংক্রান্ত সুঁচিবাই আছে, ভালো টয়লেট না হলে পায়খানা-প্রশ্রাবে ঝামেলা হয়। ওদিকে মাকড়সাকেও ওর তীব্র ভয়। একটু চিন্তিতই হলাম।

যাহোক, অবশেষে ৮টার দিকে আমরা রওয়ানা করলাম। রাসেলের ট্রাইপড বহন করলেন আবুবকর, তাঁর ব্যাগের সাথে বেঁধে নিয়ে। তিনি অতিরিক্ত ওজন বহন করতে রাজি হলেন, কারণ শিঘ্রই তাঁকে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট (HMI)-এ ট্রেনিংয়ে যেতে হবে, আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে চাচ্ছেন। আমাদের পূরণ করা ফর্মটা নিয়ে গাইড, আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে অনুমতি নিয়ে এসেছে। যাত্রা শুরুর মুহূর্তে বাজারের কামারের থেকে একটা নতুন দা শান দিয়ে নিয়ে নিল বিকাশ, সম্ভবত ভাড়ায়।

আমাদের যাত্রা শুরু হবে বগামুখ পাড়ার দিকে, ঠিক যে পথে বগা লেকে যায় অভিযাত্রীরা। পথে পুলিশ ক্যাম্পে রাখা খাতায় আমাদের নাম-পরিচয় লিখতে হলো আবার। ততক্ষণে গাইড বিকাশ একটা গাছের ডাল আর রাবার-ইলাস্টিক দিয়ে গুলতি বানিয়ে নিলো। আমাদের হাঁটা শুরু হলো পাকা রাস্তা দিয়ে।

এখানে একটু আমাদের পোষাক-আশাক সম্পর্কে বলা দরকার: আমাদের পরনে টিশার্ট, প্যান্ট (কেউ ফুল ট্রাউযার, কেউ থ্রি-কোয়ার্টার ঝোলা প্যান্ট), রাসেল পরেছে হাফ প্যান্ট। কামরুল আর আবুবকরের পরামর্শে আমরা সবাইই কিনে নিয়েছি ‘অ্যাংকলেট’ আর ‘নী-ক্যাপ’। এগুলো সাধারণত ফুটবল খেলোয়াড়রা পরে থাকেন, যা রাবারের আঁটোসাঁটো বন্ধনীবিশেষ। নী-ক্যাপ পায়ের পাতা দিয়ে পাজামার মতো পরে হাঁটুতে তুলে নিতে হয়, আর অ্যাংকলেট পায়ের পাতাসহ গোড়ালিতে পরতে হয়। এগুলো কেন পরতে হয়, তা আপনারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন। আর অবশ্যই আমাদের তিনজনের পায়ে রুমা থেকে কেনা ১১০টাকা দামের জুতা। যেগুলোর উপর আমার আর নাকিবের মোটেই ভরসা নেই। প্রত্যেকের সাথে রয়েছে গামছা। গামছা কেন, তাও আপনারা সময়ে সময়ে এর বহুধা ব্যবহার থেকে জানতে পারবেন।

‘থানা পাড়া’র ভিতর দিয়ে আমাদের পথটা চলে গেছে। থানা পাড়া একটা ত্রিপুরা পাড়া, মানে ত্রিপুরা উপজাতির বাস এ পাড়ায়। সমতলে যেমন আমরা ‘গ্রাম’ বলি, সেগুলো হলো ‘পাড়া’। ইট সো’লিং করা উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছি। রাস্তাটা এগিয়ে গিয়ে রুমা খালের উপর দিয়ে ব্রিজ ধরে বগা লেকের দিকে গেছে। আমরা সে ব্রিজটা না ধরে পাশ দিয়ে খালে নেমে গেলাম।

প্রকৃত যাত্রা আমাদের এখান থেকে শুরু হলো।

(চলবে…)

-মঈনুল ইসলাম

পরের পর্ব »

বান্দরবান ভ্রমণ ২০১১ : পর্ব ৪

যে দুজন আমাদের গাড়িতে লিফ্‌ট চাচ্ছিল, তাদের একজন বয়স্ক মানুষ, সাথে একটা ছোট্ট ছেলে। তাদেরকে নেয়ার প্রশ্নই উঠে না, কারণ এরা স্থানীয়। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হলো এরা আসলেই বিপদগ্রস্থ। কারণ, আমাদের গাড়ি যখন নীলাচলে, ঢাল বেয়ে উঠছিল, তখনও এরা আমাদের গাড়ি থামাতে চাচ্ছিল, লোকটার গলায় একটা ঢোল ছিল, আর ছেলেটা নিয়ন্ত্রণ করছিল লোকটিকে। আমার তখনই মনে হচ্ছিল লোকটা অন্ধ। যদিও অন্ধ কেউ ডাকাতদের সোর্স হতে পারবে না এমন কথা নেই, তবু কেন জানি আমি সুপারিশ করলাম এদের জন্য। শাকিল ভাই তাই এদের কারণে কোনো সম্ভাব্য অঘটনের দায়ও আমার ঘাঢ়ে চাপিয়ে দিলেন। শাকিল ভাইয়ের বিন্দুমাত্র দোষ নেই। কারণ আমার একার মায়া দেখানোতে বিপদ হতে পারে নয়জনেরই।

কিন্তু সিনেমার কাহিনীর মতোই জয় হয়ে গেলো মানবতারই: এরা ডাকাততো নয়ই, বরং গায়ক। ঢোল কাঁধে অন্ধ লোকটি ঢোল বাজিয়ে যখন গান ধরলেন, তখন পুরো গাড়ি ঐ ঘুটঘুটে অন্ধকারে নাচছে। গান শেষ হতে না হতেই কখন যে আমরা মূল সড়কে চলে এলাম টেরই পেলাম না, নামিয়ে দিলাম ঐ অন্ধ ঢোলবাদক আর তার সঙ্গী ছেলেটিকে। বড় দরদ ছিল ঐ কণ্ঠে, প্রাকৃতিক পরিবেশে বুদ করে দিয়েছিল আমাকে। মন জুড়িয়ে গেছে আমার। আমার একটা থিওরি হলো, প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতির সন্তান হয়ে যাও, ছুড়ে ফেলো সব ইয়ারফোন, ওয়াকম্যান, এমপিথ্রি। গাছের পাতার নড়াচড়া শোনো, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনো, পাখির মৃদু কুজন শোনো…। তাই ঐ বাদক একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ করে দিয়ে গেছে আমার।

ঢোলবাদক নেমে যেতেই আমি আর-সবার কানাঘুষা শুনতে থাকলাম। জিজ্ঞেস করে তো আক্কেল গুড়ুম: সবাই মিলে আজ রাতেই কক্সবাজার যাবার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে। যেহেতু কালকে হরতাল, বান্দরবান সদরে আমাদেরকে সারাদিন ঝিমোতে হবে, তাই বোচকা-বাচকি তো সাথেই আছে, কক্সবাজার চলে গেলে তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কিভাবে যাওয়া হবে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, বাসের টিকেট কাটা নেই, …বললেই হলো?

বান্দরবান সদরে গিয়ে ভাবলাম গাড়িতেই ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করবো, কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার আর গাইড ব্যর্থ হয়েছে আমাদেরকে নীলাচলে রাখতে, টাকা চুষে নিতে, তাই আমাদের প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়েছে। নতুন টিব নিতে হবে অজুহাত দেখিয়ে নামিয়ে দিল দ্রুতই। দ্রুত করতে গিয়ে হারিয়ে ফেললাম আমার ক্যাপটা। ভালোই হয়েছে, এই ক্যাপের জন্য পুরো ট্যুরে আমার ছবিগুলো বিশ্রী এসেছে: যে দেখেছে, সে বলেছে ফারুকীর মতো লাগছে- ওয়াক থুহ!

এদিকে আমি টের পাচ্ছি, আমার জ্বর আসছে, চোখ জ্বলছে, মাথা গরম। শাকিল ভাই, নাকিব, আর ইফতি দৌঁড়ে গেলো বাসের টিকেট করতে। কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন, বাসের টিকেট পাওয়া গেলো না। কিন্তু নাছোড়বান্দারা কি আর প্ল্যান মাটি হতে দেয়? আরেকটা লোকাল বাসের টিকেট করে ফেললো ‘অমুক’ পর্যন্ত (এই জায়গাটার নাম এখন আর কেউই মনে করতে পারছি না, আমিও । সেখান থেকে নাকি কক্সবাজার যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। ব্যস, আঁটোসাটো সীটে ব্যাগগুলো কোলে নিয়ে চাপাচাপি করে বসলাম। অন্য সময় হলে চলে যেত, কিন্তু একে প্রচন্ড গরম, তার উপর আমার গায়ে জ্বর, মনে হচ্ছিল মারাই যাবো। ওদিকে সব পানি শেষ করে ফেলেছে ওরা। আমি আগেই আমার ব্যাগের ছোট্ট বোতলটাতে পানি পুরে নিয়েছিলাম। কারণ, মোবাইলে নামানো একটা সার্ভাইভাল গাইডে পড়েছি সার্ভাইভাল মেডিসিনের মধ্যে সবার আগে হলো পানি। একসাথে অনেক না খেয়ে অল্প করে নিয়মিত বিরতিতে খেয়ে যেতে হবে। আমি জ্বরের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। পা থেকে জুতা খুলে পায়ে ঠান্ডা লাগাতে চাইলাম, কিন্তু গরম গাড়ি থেকে কি আর ঠান্ডা লাগবে? তবে অল্প অল্প করে পানি চালিয়ে যেতে থাকলাম।

গাড়ি চলতেই থাকলো অন্ধকারে। ক্লান্তিতে চোখ লেগে এলো সবার। আমাদের গন্তব্য পর্যন্তই যায় বাসটি, গন্তব্যে গিয়ে নামলাম আমরা সবাই। ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। জ্বর এখনও আছে। ওখানে নেমে পড়লাম মহাসমুদ্রে। কোনো বাসেই সিট নেই। ইফতি, নাকিব আর শাকিল ভাই প্রয়োজনে সবচেয়ে দামি গাড়িতে করে হলেও টিকেট করে ফেলতে রাজি, কিন্তু বাস আমাদের নিতে রাজি হলে তো! দলে দলে ভাগ হয়ে কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলাম সবাই-ই। এখানে মাঝপথে পড়ে থাকলে বিপদে পড়ে যাবো।

কোনো উপায় না করতে পেরে ঠিক করা হলো একটা পিকআপ ভাড়া করে তাতে মালপত্র তুলে চলে যাবো সবাই মিলে। একটা পিকআপকে কথায় নিয়ে আসা গেল, কিন্তু কোনোভাবেই সে ভাড়া কমাতে চাচ্ছে না। আমরা ক’জন ভাড়া প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি, ড্রাইভার প্রস্তুত, এমন সময় শাকিল ভাই এলেন কোথা থেকে, তিনি একটা গাড়ি পেয়েছেন। আমাদের একদল গেলো ঐ গাড়িটা দেখতে।

ঐ গাড়িটা দেখে আমাদের সবারই পছন্দ হয়ে গেলো, যদিও ভাড়া একটু বেশি, কিন্তু নিরাপত্তা আছে এটাতে। কিন্তু ওটা থেকে বিদায় নেয়া যায় কিভাবে, ওখানেও তো কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। শেষমেষ মেঝেতে তেরপলের উপর বসে যেতে হবে- এরকম একটা খোড়া অজুহাত দেখিয়ে মানে মানে কেটে পড়লাম আমরা। গিয়ে সবাই হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম গু-কালার খাঁচার ভিতর।

খাঁচার ভিতর বন্দী সব বাঁদরের দল… (ছবি: আরেক বাঁদর)

হ্যা, এটা একটা স্কুল ভ্যান, হলুদ রঙের। গায়ের লেখা পড়ে বোঝা যায় এটা “লোহাগড়া মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের” বাহন। পুরোটাই একটা বানরের খাঁচা যেন। ভিতরে তিন দিকে সিট, দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। ভিতরে ঢুকেই ড্রাইভারকে রওয়ানা করতে বলা হলো, কোনো রকমে ঝামেলা থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই আমরা। অবশেষে আমরা রওয়ানা করলাম। উচ্ছাসের শেষ নেই সবার মাঝে। হঠাৎ করেই প্ল্যান আর তার বাস্তবায়নে আমরা এখন কক্সবাজার অভিমুখে- ব্যাপারটা সবাইকে আনন্দিত করছে। আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। কয়েকটা কারণ: এক, নাকিব আর শাকিল আজ সকালে এলেও আমি একদিন আগে থেকে খরচ করছি, বাজেটে টানাপোড়েন; বাজেট গড়মিল করা কোনো ব্যাপার না, আলহ্বামদুলিল্লাহ, কারণ এখন চাকরি করছি; কিন্তু তবু ট্যুরে বাজেট ফেল করা আমার ধর্ম না। দুই, আমি আগে একবার কক্সবাজার গিয়েছি; দেখা জায়গা বারবার দেখার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তিন, আমার গায়ে জ্বর- ভালো লাগার জিনিসও ভালো লাগছে না, মুখটা পানসে হয়ে আছে। নাকিব আমাকে কানে কানে বললো, টাকা-পয়সার জন্য ভাবিস না, আনন্দ কর; জীবনে আনন্দের চেয়ে টাকা বড় না। কিন্তু নাকিব যদি বুঝতো, আমার আনন্দ হৈচৈ-এর মধ্যে না, আমার আনন্দ দল বেঁধে ঘোরাঘুরির মধ্যে না, আমার আনন্দ হট্টগোলের মধ্যে না: আমার আনন্দ নির্জনতায়, ছায়ায়, সুবাতাসে, ঝিঁঝিঁ পোকার চিরচির ডাকাডাকিতে…।

গাড়িতে চড়ে বুঝলাম নাকিব কেন এই প্ল্যান করেছে। কক্সবাজারে ওর এক কাযিন আজকে রাতে চেক-আউট করছে ‘হোটেল জিয়া’ থেকে। ফোন করলো তাকে, যাতে তার রুমটা রেখে দেয় আমাদের জন্য। কোনো ব্যবস্থা না হলে সেখানেই থাকা যাবে। কিন্তু হোটেলের ম্যানেজার রাজি হলেন না: একজনের নামে বুক করা রুম আরেকজনকে তিনি দিতে পারেন না। ম্যানেজারতো ঠিকই বলেছেন, এতে আইনী জটিলতাও আছে। তবে হোটেল আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো, আমরা গেলে আমাদেরকে রুমের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।

গাড়িটার গতি কম। খুব একটা দ্রুত এগোচ্ছি না আমরা। পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা-বারোটা বেজে যাবে। এদিকে গাড়ি চলছে নির্জন ঝাউবনের ভিতরকার রাস্তায়, ঘুটঘুটে অন্ধকার দিয়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা-দুটা গাড়ি পাশ কাটায়। নয়-নয়জন মানুষ একত্রে, তবু একটা ভয়, ডাকাতের ভয়, ডাকাত ঘিরে ধরলে জখম করে ফেলবে, মেরেও ফেলতে পারে। তাই ভেতরে কোনো প্রকার আলো জ্বালানো হলো না, অন্ধকারে মৃদু আলোর রেখায় সবাই চেহারা আঁচ করছি। আর পেছন থেকে কোনো গাড়ি, মোটরসাইকেল এলে তার হেডলাইটের আলোয় ভিতরটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমরা তখন ওটাকে পাত্তা না দেয়ার ভান করি, গল্প করার অভিনয় করি, যাতে কেউ ডাকাতি করতে চাইলেও বোঝে এখানে সবাই আলাদা, একত্রে কোনো দল না। আবার ড্রাইভারকেও সন্দেহ করছি আমরা, কিন্তু কিছু করতে পারবে না বলে মনে করছি, কারণ সামনে, ড্রাইভারের সাথে বসেছে আমাদের একজন: ফরহাদ।

এদিকে শাকির করেছে আরেক বুদ্ধি: ইফতির কেনা আনারসগুলো নিয়ে রেখেছে দরজার একেবারে সামনে, যাতে বাইরে থেকে পাতাগুলো দেখা যায়, আর ডাকাত ভাবে, দূউর! খ্যাত! আনারস নিয়া গেয়ো কোনো লোক যাচ্ছে। কিন্তু তাসত্ত্বেয় হঠাৎই গতি কমতে থাকলো আমাদের গাড়ির। সবাই-ই সচকিত হয়ে উঠলাম। গাড়ি একসময় থেমে গেলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে, জঙ্গলের মধ্যে। আমি ফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখি, ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে…। শিওর, ডাকাতের হাতে তুলে দেবার পায়তারা…।

রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি আমি, অনুভব করছি: গাড়ির প্রত্যেকেই..। ড্রাইভার, গাড়ি থেকে নেমে গেলো রাস্তার ডান দিকে। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলাম, অন্ধকারে কোনো মানুষের অবয়ব চোখে পড়ে কিনা। কিন্তু না, কোনো মানুষ নেই। ড্রাইভার এগিয়ে গিয়ে একটা বড় দানবাক্সে কিছু টাকা ফেলে দিলো। তবুও আমি সন্দিহান, আশেপাশে নজর রাখছি, কোনো দিক থেকে যদি আক্রমণ আসে…। শাকিল ভাই আশ্চর্য হলেন, পুরান ঢাকার মানুষ তিনি, পুরান ঢাকায় পীর-ফকির বিশ্বাসী লোকের অভাব নেই, জানেন, ড্রাইভাররাও এগুলো মেনে চলে। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে টাকা দেয়ার ব্যাপারটা ঠিক মেলানো গেলো না।

ড্রাইভার আমাদের প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগ করে দিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। তারপর আবার চলা শুরু করলো গাড়ি। সবার মধ্যে আবার প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা দিলো নতুন আপদ- একটা মোটর সাইকেল আমাদের ঠিক পিছে পিছে ধীর গতিতে অনুসরণ করে চলেছে। আমরা যথারীতি ভাব দেখাচ্ছি, আমরা সাধারণ মানুষ। শাকির ঘোষণা করলো, যদি বুঝি ডাকাত, তাহলে একটা একটা করে আনারস গিয়ে পড়বে চান্দিতে। আনারসের মালিক ইফতিরও দেখি একই অভিপ্রায়। কিন্তু আনারসের জুস না খেয়ে কিছুক্ষণ অনুসরণ করে গতি বাড়িয়ে মোটর সাইকেলটা পাশ কাটালো আমাদের।

আমি কিছুক্ষণ এর-ওর গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে-বসে বিশ্রাম করে করে চলছি। মাঝে মাঝেই খুব অল্প একটু পানি গলায় দিচ্ছি। আমাদের সাথে আর কোনো পানি নেই, আমার বোতলটা স্বার্থপরায়ন হয়ে আমিই গলাধঃকরণ করছি। ধীর গতির যাত্রায় বিরক্তি লাগছে সবারই। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার টেনশনে কেউই ঠিক শান্তি পাচ্ছি না।

অবশেষে রাত ১২টার সময় গিয়ে পৌঁছালাম হোটেল জিয়ায়। সংক্ষেপে বলি: সেখানে গিয়ে আমাদের ভালো রুম মিললো না। রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দেয়া হলো দুটো বড় রুমে: একটাতে পাঁচজন, আরেকটাতে চারজন। শর্ত হলো কালকেই ভালো রুম দেয়া হবে, আপাতত এদুটোতে থাকতে হবে আমাদের। নিচতলার রুম দুটা স্যাঁতস্যাতে। তার উপর বোঝা গেলো একটা হলো তাদের ভাড়ার: নষ্ট টিভিগুলো স্টোর করে রেখেছে ঐ রুমে। মশার ঔষধ আর এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করিয়ে আমরা বেরোলাম খাবারের সন্ধানে। কিন্তু হায়, সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে; রাত তখন বাজে ১টা। একটা হোটেল আমাদের গলাটা কেটে খাওয়ালো। খেয়ে-দেয়ে ঘুম দিয়ে উঠতে উঠতে পরদিন বেলা এগারোটা।

এগারোটা বাজে সব হোটেলে নাস্তা শেষ। শেষমেষ একটাতে নাস্তার ব্যবস্থা করা গেলো। নাস্তা করে হোটেলে ফেরত। হোটেলে এসে শুনি আজম খান মারা গেছেন। শাকিল ভাই টিভি দেখতে লেগে গেলেন ম্যানেজার রুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্বিত ফিরে পেয়ে আমাদের নতুন রুমের দাবি জানালেন ম্যানেজারের কাছে। মোটাসোটা ম্যানেজার গা করলো না, ‘রুম খালি নাই।’ শাকিল ভাই তর্ক শুরু করলেন, আমি নিরপেক্ষ থাকলাম। কারণ আমার ওস্তাদের শিক্ষা “অচেনা জায়গায় প্রয়োজনে ঝগড়া করতে একজোট হয়ো না, একজন হলেও নিরপেক্ষ থেকো।” কিন্তু টলাতে পারলেন না শাকিল ভাই। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘তাহলেতো আপনারা চিটিং করছেন। আমাদেরকে বলা হলো রুম দেয়া হবে, এখন দেয়া হচ্ছে না। তাহলেতো চিটিং।’ আমাদেরকে যে চীট করা হচ্ছে, ব্যাপারটা কোনোভাবে আবার মানতে রাজি নয় ম্যানেজার।

ইত্যবসরে রুমে ঢুকলেন মোটাসোটা আরেকজন মানুষ, দাঁড়িওয়ালা। শাকিল ভাই তাকে দেখেই খুশি হয়ে গেলেন, ইশারায় বোঝালেন: মালিক। ব্যস, আর যায় কই? মালিকের কাছে সরাসরি ম্যানেজারের ব্যাপারে নালিশ। মালিক জানালেন, উপরে দুটো কাপল-বেড খালি আছে, কাপল বেডে তো আর পাঁচজনের ব্যবস্থা করতে পারেন না? কিন্তু শাকিল ভাইয়ের মুখে বারবার ‘চিটিং’ ‘চিটিং’ শুনে মালিক আমাদের পাঁচজনের জন্য দুটো কাপল-বেড বরাদ্দ করে দিলেন। পাঁচজন, কারণ, শাকির আর ওর বন্ধুরা আজকেই রওয়ানা করতে চায়।

দুপুরে আমরা সবাই একসাথে আনারস খেলাম খুব মজা করে। বান্দরবানের আনারস যে এতো স্বাদের, কল্পনায়ও ছিল না। রেস্টুরেন্টের বয়গুলোকেও ভাগ দিলো ইফতি। আর ইফতির প্রশংসায় সবাই অষ্টমুখ; তবে সত্যিই, ইফতি না কিনলে আমাদের খাওয়া হতো না বান্দরবানের এতো স্বাদের আনারস।

আনারস খেয়ে সরাসরি বীচে। বীচে যাবার সময় আমি তো থ’। কক্সবাজার বেড়াতে যাবার কথা যদি এই জীবনে আর কেউ আমাকে বলেছে, আমি শিওর কষে একটা থাপ্পড় দিব। এ-কী দেখছি আমি কক্সবাজারকে? এখানে দালান, ওখানে দালান, দালানের চিপায় চিপায় পথ। দুটো ঘনবসতিপূর্ণ দালানের মাঝখানের পথ জুড়ে গড়ে উঠেছে ছালাদিয়া বস্তি। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র ময়লা-আবর্জনা-গোবর। আবার কোথাও ময়লা পানির ডোবা, ভাসছে কচুরিপানা। আশ্চর্য হলাম- এটা কি কক্সবাজার, নাকি ঢাকার কোনো বস্তি!

বস্তি শহর থেকে যখন বীচে গেলাম, দেখি বীচে যাবার আগের পথটুকু জুড়ে নিয়েছে বার্মিজ মার্কেট নামক ক্লোন মার্কেটগুলো। মনে হচ্ছে কক্সবাজারটা আসলেই একটা বাজার, বীচ না। বীচে গিয়ে অবশ্য বরাবরের মতোই প্রাণ জুড়িয়ে যায়, কিন্তু প্রথমবারকার অনুভূতি এবারে আর হলো না, অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। নেমে পড়লাম নোনা জলে। বড় একটা বোর্ডে মোচনপ্রায় চকের আঁচড়ে দেখেছি একদিন আগের হিসাব: এখন ভাটার সময়। ভাটার সময় সমুদ্রে নামতে হয় না- তিন গোয়েন্দা থেকে শেখা। তবু আমরা নামলাম, সময়টা হলো গোসল করার, এখনই যদি না নামি বিকেলে নেমে হবেটা কী?

যা হবার তাই হয়, পানি টেনে নিয়ে যেতে চায় সমুদ্রগর্ভে। আমরা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখি যথাস্থানে, যথাসম্ভব। পানির তোড় সে কী তোড়! অসম্ভব শক্তিশালী। আগের অভিজ্ঞতাটা পড়লেই আপনারা মোক্ষম ধারণা পাবেন। ওদিকে শাকিররা কোথায় জানি চলে গেছে, হয়তো ওদিকটাতে, মেয়েদেরকে নিজেদের সাঁতার-কীর্তি দেখানোর জন্য!! আর শাকিল আর নাকিব শুরু করেছে বালি দিয়ে কিছু একটা বানানোর। যা-ই বানায়, অশ্লীল কিছু একটা হয়ে যায় –হাসতে হাসতে গড়াগড়ি ওরা।

আমি আর ইফতি তখন জলযুদ্ধের যোদ্ধা। এদিকে প্রিয়মের জীবনের প্রথম সমুদ্রস্নান, বেচারা ভয়ে কাবু হয়ে আছে, সামনে এগোতেই চায় না। গোসল শেষ করে নোনাবালুজলে স্নান শেষে হোটেলে ফিরে গোসল করে নোনাজল সাফ করলাম সবাই। শাকিরদের কোনো খবরই নেই। অনেক পরে এলো ওরা; ওরা নাকি অনেক দূরে চলে গিয়েছিল গোসল করতে।

সেদিন বিকেলেই শাকির, ফয়সাল আর আব্দুল্লাহ রওয়ানা করলো সিলেটের উদ্দেশ্যে। তখনও হরতাল শেষ হয়নি, ওরা চায় তখনই চট্টগ্রাম চলে যেতে। ওখান থেকে ট্রেনে যাবে সিলেটে। ফরহাদ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওয়ানা করবে সরাসরি বাসযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার থেকে পরদিনের টিকেট করেছি আমরা বাকি পাঁচজন। তাই বিকেলে হেঁটে বেড়ানোর অভিপ্রায়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে সার্কিট হাউজে, তারপর আবার বীচে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা…।

সার্কিট হাউজ থেকে দূরে চোখ পড়লে দেখি এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য: পাহাড় কেটে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে একঝাঁক লোক; খুব কষ্ট হলো। মানুষ যদি বুঝতো এই পাহাড়ের মর্ম, তাহলে এটা ভুলেও করতে পারতো না। এবার কক্সবাজারে এসে মন ভালো হওয়াতো দূরের কথা, মন খারাপ হওয়ার অনেকগুলো বিষয়ই ভিড় করেছে আশেপাশে। নির্মীয়মান বিল্ডিং, ময়লা-আবর্জনা, ফ্ল্যাট-হোটেলের ছড়াছড়ি আর খাবার হোটেলগুলোতে গলা-কাটা-দাম আপনাকে স্বাগত জানানোর বদলে ঘাঢ়-ধাক্কা দিতে চাচ্ছে।

যাহোক সার্কিট হাউজে ঝোলানো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করেও ছবি তুললাম আমরা কিছু। তারপর ওপাহাড় থেকে নেমে চললাম বীচে। সেখানে গিয়ে দেখি সূর্য ডুবে গেছে মাত্র। প্রায়ান্ধকারে কিছু ছবি তুলে আমরা চললাম কক্সবাজার শহরে, বার্মিজ মার্কেট থেকে বাসার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। একটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে শহরে চললাম। সেখানে বার্মিজ মার্কেটে যে-যার মতো পছন্দের কিছু খুঁজতে থাকলাম। বার্মিজ আচার, পোশাক আর মুলতানি মাটি ইত্যাদি কমন বিষয়ের বাইরেও কিছু খুঁজতে থাকলাম। দোকানের রাখাইন মেয়েগুলো তাদের চেহারা বিকিয়ে পণ্য বিক্রয়ে ব্রতী, কোনো কোনো দোকানে পুরুষ দোকানদারও আছেন। কোনো কোনো দোকানে গিয়ে বাঙালি মেয়েও দেখা যায়, তবে পোশাকে-আশাকে তাদেরকেও রাখাইনই মনে হয়। নাকিব আর শাকিল ভাই সুযোগ পেলেই তাদের রাখাইন ভাষার স্বল্প পুঁজি দিয়ে অভিবাদন জানায় রাখাইনদের:

মানামি যালে :: তোমার/আপনার নাম কী?

শিকো বাঁয়া :: বিদায়

একটা দোকানে ঢুকলাম আমরা, এক যুবতি আর ছোট্ট একটি মেয়ে বসে আছে। আমি সে দোকান থেকে বোনের জন্য চুলের একটা ছোট্ট ব্যান্ড কিনলাম। শাকিল ভাই ছোট্ট মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানামি যালে’। প্রশ্ন শুনে সাথের যুবতি তো আশ্চর্য, বাংলায় বললো, ‘আপনি আমাদের ভাষা কিভাবে জানেন?’ শাকিল ভাই জানালেন, অল্পস্বল্প শিখেছিলেন এক রাখাইন দোকানীর কাছে। ওদিকে পিচ্চি মেয়েটা কিন্তু তার নাম বলে ফেলেছে। মনে নেই নামটা কী ছিল। যুবতি জানালো পিচ্চি মেয়েটি তার ছোট বোন। পিচ্চির চেহারাটা খুব সুন্দর! এবারে পিচ্চি তার বোনকে রাখাইন ভাষায় কিছু বললো, আমরা কিছুই বুঝলাম না। যুবতি, শাকিল ভাইয়ের অনুরোধে অনুবাদ করে দিলে, শুনে, লজ্জায় লাল হলাম আমরাই, শাকিল ভাই বোধহয় আরেকটু বেশি লজ্জা পেলেন। মেয়েটি নাকি জানতে চেয়েছে, ‘আপনার মেয়ের নাম কী?’ শাকিল ভাই হাসতে হাসতে জানালেন, তিনি বিয়েই করেননি। প্রশ্নটা কি আদৌ ঐ মেয়েটা করেছিল, নাকি যুবতির কোনো ট্রিক্‌স ছিল, সেটা অবশ্য রহস্যই রয়ে গেলো।

এদিকে আমি আমার বোনের জন্য জুতা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। সুন্দর, আকর্ষণীয় জুতা চোখেই লাগে না, সব গৎবাঁধা নকশার। অবশেষে একটা দোকানে গিয়ে পছন্দ হয়ে গেলো, কিন্তু নাছোড়বান্দা রাখাইনরূপী বাঙালি মেয়েটি কোনোভাবেই দাম কমাতে চাইছে না। শেষ পর্যন্ত চলে আসতে বাধ্য হলাম। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে আর ওরকম জুতা কিছুতেই পাচ্ছিলাম না, তাই ঐ দোকানে গিয়ে আবার শেষ একটা দাম বলে এলাম, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই আর নামতে রাজি না। শেষে সে বলেই ফেললো, ‘আমি আর কমাতে পারবো না, আপনাকে পছন্দ হয়ে গেলো বলে এতোটুকু কমালাম’। বয়স কম হয়নি, এটা যে পটানি কথা -তা বুঝতে পিএইচডি করা লাগে না। চলে এলাম দোকান ছেড়ে। কিন্তু জুতার জন্য এতো ঘুরাঘুরি করেছি, আর শরীরে কুলাচ্ছে না, একটু বেশি দিয়েও ঐ জোড়া কিনে নেবার জন্য যখন ঐ দোকানের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন মেয়েটা পাশের দোকানের রাখাইন মেয়েটির গায়ে ঢলে পড়ছে, আর আস্তে করে বলছে, ‘আমি জানি, তুমি আসবা।’ তারা যে অর্থে বলছে, আমি যে সে অর্থে যাচ্ছিনা, সেটা আর ভাঙানো হলো না। মেয়েটাকে হাস্যোজ্জল রেখে আমরা এবারে রাতের খাবারের সন্ধানে বেরোলাম।

পেট পুরে খেয়ে দেয়ে আরেকটা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে হোটেলে ফিরলাম। সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা করেছে ইফতি, দুহাত উপচে পড়ছে তার: বোন, দুলাভাই, ভাগ্নে, ভাগ্নি সবার জন্য কিনেছে উদারভাবে। হোটেলে ফিরে রাত একটার দিকে আবার বেরোলাম আমরা। এতো রাতেই একবার সৈকতে যাবো আমরা। দুটো রিকশা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা। সৈকতে গিয়ে দেখি, দিনের বেলা ভাড়া দেয়া ঈযি চেয়ারগুলো খালিই পড়ে আছে। জোয়ার এসেছে সমুদ্রে, প্রচন্ড আওয়াজ করে পানি আছড়ে পড়ছে সৈকতে। বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দূরে কোথায় মেঘ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টির আশা করলেও বৃষ্টি এলো না। তবে এই নির্জনতাটুকু খুব উপভোগ করলাম সবাই।

হোটেলে ফিরে ঘুম। ভোরে উঠে নাস্তা। তারপর শ্যামলী পরিবহনের বাসে চড়ে ঢাকা রওয়ানা। পথ ফুরোতেই চায় না। পথে বিভিন্ন স্থানে দেখছিলাম বিভিন্ন সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের বন্দর সংলগ্ন এলাকায় জাহাজের বিশালাকার সব লোহার যন্ত্রপাতি; কুমিল্লায় দেখলাম ভোটের সাজে সেজেছে এলাকা, কারণ তখন চলছিল পৌরসভা নির্বাচন; আবার কুমিল্লা পার হতেই রাস্তার পাশে সবুজ কিসের ক্ষেত যেন: পরে বুঝলাম ভুট্টার ক্ষেত, হলুদ রঙে উদ্বেল কোনো কোনো কৃষাণের উঠান। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার-লেনের মহাসড়কের কাজ কিছুই হচ্ছেনা, মাটি ফেলে দেখানো হয়েছে- ‘এতোবড় হবে’ রাস্তা, কিন্তু কোনো যন্ত্রপাতিও নেই আশেপাশে।

ঢাকার কাছাকাছি এসে দেখি নদী থেকে ড্রেজ করে বালু রাখা হয়েছে স্তুপ করে, কিন্তু সেখানে আসলে দেখার মতো কিংবা শেখার মতো কিছু আছে। ড্রেজ করার মুহূর্তে বালু থাকে পানিপূর্ণ, মানে পিচ্ছিল। এই বালি যতই পাম্প করা হোক, তা পিছলে সরে যাবে, স্তুপ তৈরি হবে না, স্থান জুড়বে বেশি, অনেক বালির অপচয় হবে। তাই কিছুক্ষণ বালি পাম্প করে তার উপর বিছিয়ে দেয়া হয় একটা বিশাল পলিথিন। তারপর আবার পাম্প করা হয় বালি। তারপর আবার পলিথিন। তারপর আবার গলিত বালি। এভাবে অল্প অল্প বালির স্তুপ মিলে তৈরি হয় বিশাল টিলার মতো স্তুপ। পদ্ধতিটা আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। অবশ্য পুরো প্রক্রিয়া দেখার সৌভাগ্য হয়নি। চলন্ত পথে মোবাইল দিয়ে তুলে নেয়া ছবি ঘেঁটে এই তথ্য আবিষ্কার করলাম।

7 maynamati war cemetery (shakir)
ময়নামতি ও’আর সিমেট্রিতে নীরবে, নিভৃতে শায়িত সব ধর্মের মৃত যোদ্ধারা (ছবি: শাকির আহমেদ)

আমরা যখন ঢাকার পথে, ওদিকে আগের দিন রওয়ানা করা শাকিররা তখন যার যার বাড়িতে পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও তারা তখন কুমিল্লায়। আগের দিন রওয়ানা করেও চট্টগ্রাম শহর থেকে পায়নি ট্রেনের টিকেট, পায়নি বাসেরও। অগত্যা রাত কাটিয়েছে চট্টগ্রাম শহরে, হোটেলে। পরদিনও কোনো টিকেট না পেয়ে এসেছে কুমিল্লায়। সেখান থেকে ধরেছে সিলেটের বাস। তবে বাড়তি হিসেবে ওরা দেখেছে কুমিল্লার ময়নামতি ওআর সিমেট্রিতে। শাকিরের জন্য ভালোই হয়েছে, এই জায়গাটা ওর দেখা ছিল না। আমি অবশ্য নটর ডেম কলেজ আউটওয়ার্ড বাউন্ড এ্যাডভেঞ্চার ক্লাব থেকে ২০০৩-এ একবার ঘুরে গিয়েছিলাম। তবে শাকিরের ডিজিটাল ক্যামেরায় আমার কাঙ্ক্ষিত কিছু মূল্যবান ছবি এসেছে বলে শাকিরকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় ছিল না।

একসময় ফিরে এলাম ঢাকায়। জ্যাম দিয়ে স্বাগত জানালো যাত্রাবাড়ি মোড়। ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে যেতে রোমন্থন করছিলাম নীলগিরির সেই আকাশনীলা অনুভব আর জীপের উপর মাথা বের করে দেয়া উচ্ছল তারুণ্যের মাঝে নত হয়ে যাওয়া বিশাল পাহাড়সারিকে। বড় অসহ্য লাগছিল এই শহরটাকে। কিন্তু জীবিকার জন্য আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনো বিকল্পই ছিল না। অগত্যা, শিঘ্রই আবার বেদুঈন হয়ে যাবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হারিয়ে গেলাম ভিড়ের মধ্যে…।

(সমাপ্ত)

-মঈনুল ইসলাম

বান্দরবান ভ্রমণ ২০১১ : পর্ব ৩

নীলগিরি যাবার পথে এই অপূর্ব আকাশটা আমায় পাগল করে ছেড়েছে।

গাড়ি নীলগিরির চূড়ায় উঠলে একটা পার্কিং এলাকা। এখানে পার্কিংয়ের জন্য যে টাকা দিতে হবে (৳৩০০), তা আমাদেরকে বহন করতে হবে, ড্রাইভারের সাথে এমনটাই চুক্তি হয়েছিল। যাবতীয় খরচ একহাতে হচ্ছে, তাই ইফতি এগিয়ে গেলো আর্মির ছোট্ট কমান্ড পোস্টটার দিকে। সেখান থেকে আবার জনপ্রতি টিকিট (৳৫০) কেটে উপরের চূড়ায় উঠতে হয়। যারা কটেজ ভাড়া করে আসেননি, তাদেরকে এই টিকেট করে চূড়ায় অবস্থান করার ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। পার্কিংয়ের সরাসরি সামনেই আর্মিদের ছোটখাটো একটা ক্যাম্প। আর বায়ে বেরিকেড পার হয়ে উপরের চূড়ায় থাকা কটেজগুলো পরিদর্শনে যাওয়া যায়। আমরা বোচকা-বাচকি গাড়িতে রেখেই চলে গেলাম চূড়ার দিকে। চূড়াতে একটা ক্যাফেতেরিয়া। নামে ক্যাফেতেরিয়া হলেও আদতে ডায়নিং রুম। কারণ এখানে কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়না। আমি যতদূর বুঝেছি যে, খাবার রান্না করে নিয়ে এলে এখানে সেটা বসে খাওয়া যাবে। অবশ্য বন্ধুরা কেউ কেউ বললো না, জিনিসপত্তর নিয়ে এলে নিজেরা রান্না করেও খেতে পারবেন চাইলে। যাহোক, সত্যিটা জানিনি আর। কারণ আমার চোখে তখন বেশ যন্ত্রণা করছে। গাছের ডালটা আচঁড় কেটে গেলেও এখন প্রচন্ড রোদের মধ্যে একটু কষ্টই দিচ্ছে। পানির সন্ধান করছি। তাই হেঁটে হেঁটে উপরে গেলাম।

সেখানে তিনটা কটেজ। ছিমছাম কটেজ। তাছাড়া জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও রিঙের মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়েছে উপজাতীয় ঝুড়ি, যেগুলোর নিচের দিকটা হয় চিকন, আর মুখের অংশটা হয় ছড়ানো। এগুলো এখানে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে: আঞ্চলিকতার আবেশ আনা হয়েছে আরকি। আমরা চাচ্ছিলাম মেঘের মধ্যে হাঁটবো, কিন্তু আমাদের জন্য খা খা রোদ অপেক্ষা করছিল। উপর থেকে নিচে তাকালে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা আমি প্রথম দেখেছিলাম আরব আমিরাতের ফুযিরাহ পর্বতের চূড়ায় উঠে। কিন্তু সেটা যদি সৌন্দর্য্য হয়, তবে এটা কী? না, সেটা সৌন্দর্য্য ছিল না। মরুময় পাথরের জঙ্গলে সৌন্দর্য্য থাকতে পারে না। সৌন্দর্য্য আমার এই দেশের সবুজ বিছানায়। নিচে, বহুদূরে ঝাপসা রঙে সবুজ চাদর বিছিয়ে, কিংবা সবুজ কার্পেট বিছিয়ে দেয়া পাহাড়ি প্রান্তরে।

যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের সারি। আমরা এতো উপরে আছি যে, পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে মাটির মধ্যে উঁচু-নিচু হয়ে থাকা “টুক”। সিলেটি ভাষায় মাটির মধ্যে ফোঁড়া বেরিয়ে থাকলে তাকে টুক বলে, তাই এখানেও বললাম। অথচ শাকিরের আনা দূরবিণটা যখন চোখে দিলাম, আশ্চর্য হয়ে গেলাম, অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আদিবাসীদের বসতি, অথচ ঘরগুলোকে মনে হচ্ছে পিঁপড়ার ছোট্ট ঘর। যদিও মেঘ তেমন একটা নেই আকাশে, তবু কেমন জানি একটা ধূসর কুয়াশা-ধাঁচের আবরণ আমাদের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হতে দিচ্ছিল না। এই ব্যাপারটা আমার ঠিক পরিষ্কার হয় না। সেই ফুযিরাতেও এই ব্যাপারটা দেখেছি, তখন ভেবেছি, ধুলাবালুর দেশ, কিন্তু এই গাছগাছালিপূর্ণ পাহাড়ে তো আর ধুলাবালি নেই! যাহোক, যে দৃশ্য দেখেছি, সেটা আসলে বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না।

অপূর্ব দৃশ্য! অপূর্ব! অপূর্ব!! অভূতপূর্ব!!!

আমি বরং বর্ণনা না দিয়ে অল্প ক’টা ছবি দিয়ে দিই:

কটেজের ছবিগুলো আমি আর দিলাম না (পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। …নীলগিরির উপরে আছে হ্যালিপ্যাড। একটা সাইনপোস্টে মাইলেজ লিখে নীলগিরির অবস্থান বোঝানো হয়েছে: [নীলগিরি থেকে] থানচি ৩৩ কিলোমিটার, বান্দরবান সদর ৪৮ কি.মি., চিম্বুক ১৮ কি.মি., রুমা ৪৯  কি.মি., কেওক্রাডং ৬২ কি.মি. দূরে। …পরে দেখেছি আরো প্রায় তিনটা কটেজ আছে পাহাড়ের ঢালে। চূড়ায় আছে একটা বড় দূরবীণ, যা একটা কাচঘরের ভিতর রাখা, তালাবদ্ধ। ওটা দিয়ে সাইটসীয়িং করা যেত বেশ ভালোই। আমরা কটেজ ভাড়া করিনি বলে বোধহয় আমাদেরকে ওটা খুলে দেয়া হয়নি। একটা রেলিং আছে পাহাড়ের বাইরের দিকে বের করে দেয়া, ঝোলানো। সেটাতে উঠে ছবি তোলা সবারই একটা সাধারণ কাজ। কারণ ওটাতে দাঁড়ালে বাতাসে ভর করে দাঁড়ানোর একটা স্বাদ ঘোলে মিটানো যায় আরকি। তবে সেখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছবিটা তুলেছে নাকিব, সে রেলিং থেকে হাত বাড়িয়ে এমন একটা ভান করলো, শাকিল ভাইয়ের ক্যামেরার দৃষ্টিতে সেটা ধরা পড়লো উড়তে থাকা পাখি

না, মুখ ধোয়ার জন্য কোনো পানি পাওয়া গেলো না। প্রত্যেকটা কটেজ বন্ধ। লোকজন নেই। আমরা আশান্বিত হলাম: থাকা যাবে হয়তো। কিন্তু আর্মির কাছে জানলাম, কটেজ খালি নেই। ফের আমরা ফেরার চিন্তায়ই ডুব দিলাম। কিন্তু যোহরের নামাযের সময় চলে যাচ্ছে, নামাযও তো পড়া দরকার। কমান্ড পোস্টে গিয়ে নামাযের কথা বললে আমাদেরকে পার্কিং এলাকার ভিতরকার মসজিদের দিকে যেতে বলে দিলেন দায়িত্বরত আর্মি-জোয়ান, যদিও প্রবেশ-মুখে লেখা:

বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ক্যাম্পে প্রবেশ নিষেধ

ভিতরে দুই সারি পাকা-ঘর-টিনের-চালা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পানি পান করার ব্যবস্থা। কোনো এক উপায়ে ওযু-গোসলের জন্য তুলনামূলক নোংরা পানি সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু সেই পানিও বর্ণহীন, গন্ধহীন, ঠান্ডা। নোংরা বলছি এজন্য যে, আমাদেরকে সেই পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা তাই ওযু সারলাম। আমি ওযু সেরে যখন বাকিদের জন্য অপেক্ষারত, তখন তাকিয়ে দেখি গাছে গাছে লেবু, আম এমনভাবে ঝুলে আছে, যেন ডাকছে: আয়, খা। কিন্তু নৈতিকতার বাধায় আমরা সেগুলোতে ছুলাম না। কারণ আমরা এখানে নামায পড়ার অনুমতি নিয়ে ভিতরে এসেছি।

মসজিদটা ছোট্ট, বাঁশ-বেত-টিনের। ভিতরে একজন দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তি শুয়ে। পরে বুঝলাম ইনিও একজন আর্মি জোয়ান। আমাদেরকে দেখেই উঠে পড়লেন। বললেন, নাহ্, শোয়া যায় না। ছোট ছোট পোকা। জঙ্গুলে এলাকায় এগুলোই হলো সমস্যা। পোকা-মাকড়কে তাড়িয়ে মানুষ বসতি করে তো, তাই তারাও রিভেঞ্জ করে। মাত্র দুরাকা’আত নামায, কত সহজ। ভ্রমণে থাকলে এটা আল্লাহর উপহার: কসর নামায। এসময় দুরাকা’আতের জায়গায় চার রাকা’আত ফরয পড়লে উল্টা গুনাহ হয়। দ্রুতই নামায শেষ হয়ে গেলো। আমার চোখটা ধুয়ে নিতে পারায় এখন একটু ভালো লাগছে।

ওদিকে শাকিল ভাই দেখি কমান্ড পোস্টের আর্মি জোয়ানের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। এগিয়ে গিয়ে শুনলাম, তারা গ্রামীণ ফোনের সীম নিয়ে আলোচনা করছেন। সীম লক হয়ে গেছে, নাকি সীম চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে- হাবিজাবি। শাকিল ভাই কাস্টমার কেয়ারে আছেন বলে লোকটাও পেয়েছে সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার। খুব জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুজন। পরে শুনি, শাকিল ভাই ঐ জোয়ানকে বেশ কনভিন্স করে ফেলেছিলেন যে, আমাদেরকে কটেজে না হোক, তাদের তাবু দিয়ে হলেও থেকে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। কিন্তু আজকে নাকি কোন ব্রিগ্রেডিয়ার আসছেন কটেজে (সম্ভবত ফ্যামিলিসুদ্ধ), তাই সেটাতে সমস্যা হয়ে যাবে।

কী আর করা? মুখে দানা-পানি কিছুই না দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসা পানি দিয়ে উদোরপূর্তি করে চললাম আমরা ফিরতি পথে। এরই মধ্যে আমাদের গাইড মহাশয় আমাদের দলকে কনভিন্স করে ফেলেছে, নীলাচল নামক জায়গায় না গেলেই নয়। সে বাজি ধরে বলছে, সেই জায়গা যদি পছন্দ না হয়, সে আমাদের টাকাই ফেরত দিয়ে দেবে। তো এরকম মানিব্যাক গ্যারান্টি শুনে কে আর বসে থাকে বলুন। সবাই এক-বাক্যে রাজি। আমি কেন জানি হুজুগের পালে হাওয়া দিতে সব সময় একটু দেরি করি। হুজুগ জিনিসটা ভালো না। তাই একটু রয়েসয়ে। কারণ ওখানে যাওয়াটা আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের বাইরে, আলাদা করে গুনতে হবে ৳৭৫০।

আমরা নীলগিরি থেকে সূর্যাস্ত দেখার আশাতে গুড়ে বালি দিয়ে নীলগিরিকে বিদায় জানিয়ে ফিরতি পথে চললাম পাহাড় বেয়ে নিচে। এবার দলটা একটু মিইয়ে থাকলেও মজা চলছেই। শাকিল ভাই খুব ফলাও করে বলছেন, আরেকটু হলেই তিনি থাকার ব্যবস্থা করেই ফেলছিলেন। কিন্তু কী আর করা? পরবর্তি গন্তব্যে যাবার আগে আপনাদের অবগতির জন্য নীলগিরি সম্পর্কে একটু তথ্য দিয়ে রাখি:

  • নীলগিরিতে নিজস্ব যানবাহন নিয়ে যাবেন, নচেৎ ফেরা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।
  • নিজের খাবারের ব্যবস্থা করে যেতে হবে। (রান্না করা যাবে কিনা, আমি নিশ্চিত নই, কারণ সেটা শোনা কথা)
  • আগে থেকে কটেজ বুক করে যেতে হবে। পিক সিযনে কটেজ খালি পাওয়া কষ্টসাধ্য হবে। বুক করার জন্য যোগাযোগ করতে হবে 01769292338 নম্বরে (এই নাম্বার পরিবর্তন হয়, কারণ আমরা অন্য আরেকটা নাম্বার নিয়ে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে পেলাম এটা)। ফোনের ওপাশে একজন আর্মি ধরবেন, তার কাছে বৃত্তান্ত জেনে নেয়া যাবে।
  • কটেজের আকৃতির ব্যবধানে ভাড়ার ব্যবধান আছে। ৩০০০টাকায় কটেজ ভাড়া পাওয়া যায় একরাত থাকার জন্য (২৪ ঘন্টার জন্য), ছোট কটেজ একটু কম হতে পারে। যতদূর জানি, বুকিংয়ের টাকা অর্ধেক প্রথমে ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। ব্যাংক ড্রাফটের প্রমাণপত্র নিয়ে নীলগিরিতে হাজির হতে হয়, তারপর বাকি অর্ধেক এখানে পরিশোধ করতে হয়। (নিয়ম পরিবর্তিত হলে জানিনা)
  • বৃষ্টির দিনে গেলে নীলগিরি-চূড়ায় মেঘের মধ্যে ডুবে থাকতে পারবেন। শীতের দিনে গেলেও সেটা সম্ভব।
  • কেউ কেউ নীলগিরিকে দার্জিলিংয়ের সাথে তুলনা করতে চান। আমাদের নাকিবও পথে মাঝে মাঝেই বলছিল, ওমুক জায়গাটা পুরাই দার্জিলিংয়ের মতো, তমুক জায়গাটা দার্জিলিংয়ের মতো…। সে একবার দার্জিলিং ঘুরে এলেও নীলগিরি উপভোগে তার বিন্দুমাত্র অনাগ্রহ ছিল না।

আমাদের পরবর্তি গন্তব্য হলো শৈলপ্রপাত। বান্দরবান সদরে হোটেলের কাদাগোলা পানিতে গোসল করে তৃপ্তি হচ্ছিল না, তাই আমরা ঠিক করেছি শৈলপ্রপাতে গিয়ে ঝরণার পানিতে গোসল করবো। বোচকা-বাচকি তো সাথেই আছে। কাপড়-চোপড় নিয়ে নেমে গেলাম শৈলপ্রপাতে। সেখানে এই বৃষ্টির মৌসুমেও প্রপাত তেমন একটা নজরে এলো না, যা আছে, সবই শৈল, মানে শিলা বা পাথর। পাথরের উপর দিয়ে পেচ্ছাবের মতো করে পানি গিয়ে নিচে পড়ছে। তবে সবসময় পানি বয়ে যায় বলে পাথরগুলো অস্বাভাবিক রকমের পিছলা। তাই সবাই-ই একে অপরকে সাবধান করে দিচ্ছিল।

আমাদের মধ্যে নাকিব, ইফতি, প্রিয়ম আর আব্দুল্লাহ -গোসল করতে রাজি নয়। তাই বাকিরা গোসলের জন্য ভালো জায়গা খুঁজতে লাগলাম। সমস্যা হলো আদিবাসী মহিলারা আর মেয়েরা পানিতে গোসল করছিল। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে সেটা যথেষ্টই স্বল্প-বসনা-গোসল। ব্যাপারটা মোটেও সুখকর না। নাকিব পুরোপুরি নাক সিঁটকাচ্ছিল। কিন্তু আমরা আসলে গোসলের ব্যাপারে এতোটাই ডেসপারেট ছিলাম যে, সব উপেক্ষা করে গোসল করতেই হবে। ঠিক করলাম, ঝরণার আরেকটু উজানে যাওয়া যাক, তাহলে পরিষ্কার-টলটলে পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু বিধি বাম, সেখানে যেতে আমাদেরকে নিষেধ করলেন আদিবাসী নারীরা। কারণ ওখান থেকে নাকি আদিবাসীরা খাবার পানি সংগ্রহ করেন। শেষ পর্যন্ত আদিবাসী নারীদের গোসল করার স্থান থেকে একটু উজানের একটা গর্ত দেখিয়ে আমাদেরকে বলা হলো ওখানটাতে গোসল করতে পারেন। ঝরণার পানি পড়তে পড়তে এখানটাতে হালকা একটা গর্ত হয়ে আছে। ব্যস, সবাই…

…কী মনে হয়, ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মোট্টেই না। কারণ ঐ গর্তের ভিতরে ঘোর অন্ধকার। সাপ না কেঁচো না জেনেই ঝাঁপ দেই কী করে? আমাদের অবস্থাটা আঁচ করতে পেরে এগিয়ে এলো এক আদিবাসী কিশোর। ভুষ্ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো গর্তটার ভিতর। তারপর দীর্ঘক্ষণ খবর নেই। পানির ভিতরে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তারপর একসময় ভুষ করে মাথা তুললো। আমাদের অভয় দিয়ে নিজেকে খুব বীর ভাবতে লাগলো ছোঁকরা। আমরা যখন পানিতে নামলাম, অসম্ভব ঠান্ডা পানির পরশে মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ভুলেই গেলাম আমাদের এতো দূর-পথে জার্নি। সব ক্লান্তি এক নিমিষে উবে গেলো। কিন্তু গর্তটার ভিতরে যখন ডুব দিলাম, একটু পরেই পায়ে ঠেকলো পাথুরে তলা। বুঝলাম ছেলেটা একটু সময় নিয়ে ডুব দিয়ে আমাদেরকে একটা ভাওতা দিয়েছে যে, গর্তটা অনেক গভীর।  তবে অন্ধকার গর্তে পা দিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকাতে একটু অস্বস্তিই লাগে। তাই দুই গর্তের মাঝখানের জলভেজা দেয়ালে উঠে বসলাম আমি। বুদ্ধের মতো ধ্যানের একটা বাসনা জাগলো মনে। ধ্যানে বসলাম। লোকসমাগমে যদি আর ধ্যান হতো, তবে বুদ্ধ ধ্যানের জন্য প্রাসাদ ছাড়তেন না, আর মুহাম্মদ [স.] ধ্যানের জন্য গুহায় ঢুকতেন না। তাই ওটা আদতে ছিল ছবি তোলার পোয। তবে ছবিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নাকিব গোসল না করায় সে অন্তত আমাদের কিছু ছবি তুলে দিয়েছে।

ধ্যানী বুদ্ধ আমি ধ্যানের উচ্চমার্গে শায়িত 🙂 [ছবি: নাকিব]

গোসল-টোশল শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম। খুব সাবধানে, কারণ ভেজা শরীরে পাথরের উপরে আছাড় খাওয়া বিচিত্র নয়। ওদিকে আমাদের এই উপস্থিতি রীতিমতো বিব্রত করছিল কয়েকজন বৃদ্ধাকে। তাঁদেরকে বেশিক্ষণ বিরক্ত না করে আমরা মানে মানে কেটে পড়লাম গোসলের স্বার্থ উদ্ধার করে। গিয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। ঢাকায় ফিরে যখন ছবিগুলো দেখছিলাম, তখন নাকিব আমাদেরকে আশ্চর্য করে দিয়ে দেখালো দুটো ভিডিও। আমরা যখন গোসল করতে ব্যস্ত ছিলাম, তখন স্থানীয় বল্টুগুলো ব্যস্ত ছিল মেহমানদেরকে নিজেদের কৃতীত্ব দেখাতে। তবে ভিডিও দেখে আমাদের স্বীকার করতে হয়েছে, আসলেই তাদের কৃতিত্ব আছে।

পিছলা পাথরের উপর দিয়ে স্লাইড করে করে তারা গিয়ে পড়ছিল একটু ঢালুতে থাকা গর্তে। গর্তটাও পিছলা। সেখান থেকে পিছলে গেলে পড়তে হবে গভীর খাদে। কিন্তু তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল ঐ গর্তটাই তাদের কাছে লজ্জা পাচ্ছে। তাদের উলঙ্গ শরীর ঐ পাথরের ঘষায় বিন্দুমাত্র ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল না। কী অনায়াসে কখনও বুক দিয়ে, কখনও পাছা দিয়ে, কখনও পিঠ দিয়ে, কখনও পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সে কী অপূর্ব স্লাইড। ভিডিও দুটা শেয়ার না করতে পারলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। নাকিবকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় ছিল না। এই অপূর্ব জিনিস মিস করতাম, যদি না সে গোসল না করতো। (ভিডিও কৃতজ্ঞতা: নাকিব আহমেদ)

গোসল শেষে আমাদের গাড়ির উলঙ্গ রডগুলো হয়ে গেলো আলনা। ভেজা কাপড়-গামছা-টাওয়্যালগুলো বাতাসের জন্য ঝুলিয়ে দেয়া হলো ওগুলোতে। গাড়ি চলছে, আমার শরীর ম্যাঁজম্যাজ করছে, জ্বর আসছে। শাকির দেখি কাহিল হয়ে আমার পায়ের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে রয়েছে। সবাই-ই একটু নেতিয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষিধা যা লেগেছে, মনে হচ্ছে গিলে খেয়ে ফেলবে। পথে পড়লো একটা স্থানীয় আদিবাসী গ্রাম, ইফতি, আমাদের গাইড ছেলেটাকে নিয়ে নেমে গেলো আনারস কিনবে বলে। এই গ্রামেও খাবার ব্যবস্থা হলো না। আমি ঠিক করলাম, মিলনছড়ি গিয়ে ডরমিটরিও নেয়া যাবে, খাবারের ব্যবস্থাও করা যাবে। গাড়িতেই আমি সূর্যের অবস্থান দেখে নিয়ে পশ্চিম নির্ধারণ করে আসরের কসর নামায আদায় করে নিলাম দুই রাকা’আত।

কিন্তু মিলনছড়িতে থাকতে আর কেউ রাজি নয়, আমি একা লাফিয়ে কী লাভ! সবাই চায় নীলাচল দেখতে। কিন্তু তার আগে খেতে হবে যে-করেই হোক। তাই বান্দরবান সদরে গিয়ে একটা হোটেলে দুপুরের (নাকি বিকেলের) খাবার সেরে আবার গাড়িতে করে নীলাচল রওয়ানা। সূর্য এখন এক্কেবারে ডোবার অপেক্ষায়। সবাই ঠিক করেছে নীলাচলে গিয়ে রাতে থাকবে, কারণ ওখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। অগত্যা, চলো

নীলাচলের দৃশ্য আমাদের আর দেখা হলো না বোধহয়। সূর্য তো দেখাই যাচ্ছে না। তবে গাড়ি টানছে প্রচণ্ড গতিতে, যে করেই হোক আমাদেরকে দেখিয়েই ছাড়বে। সদর থেকে মেঘলার দিকে যাবার পথে হঠাৎ করেই গাড়ি বায়ে বাঁক নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই রাস্তা আটকে টোল আদায়: গাইড ইশারা দিয়ে দিলো যাতে ৳৫০ দিয়ে দিই: এই টোল জিনিসটা যেকোনো ট্যুরের জন্যই একটা খাঁটি বাধা। টোল পার হয়ে আরো অনেকখানি ভিতরে নিয়ে গেলো আমাদের গাড়ি। তারপর একসময় একটা পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেলো আমাদেরকে। অনেক অনেক পর্যটক। আমরা শুরুতেই থাকার জন্য কথাবার্তা বলতে গেলাম। আমাদের মধ্যেকার একদল গেলো পাহাড়ের চূঁড়াটা দেখতে। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আমাদেরকে জানালো: পানি নেই। গোসল হবে না। খাবার পানি কিনে খেতে হবে। খাবারের ব্যবস্থা নেই। বাজার থেকে এনে রান্না করে খাওয়া যাবে, চুলার ব্যবস্থা তারা করে দিতে পারবেন। এদিকে সমস্যা হলো: বাজার অনেক দূরে, সদরে ফিরে যেতে হবে। পরদিন আবার প্রধান বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। সুতরাং সারাদিন কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না।

শেষ পর্যন্ত আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলাচলে থাকা যাবে না। সদরে ফিরে গিয়ে আগের হোটেলেই রাত কাটাতে হবে। কাল সারাদিন সদর ঘুরে দেখতে হবে। নীলাচলে এতো কষ্ট করে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু এই ভজোভজো করতে করতে ওদিকে সূর্য কখন ডুবে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। দেখা আর হলো না আমার নীলাচল। তবে বুঝলাম যা, তাতে মনে হলো নীলগিরির মতোই হবে। …আর বলবো না, আপনারা আবার আঙ্গুর ফল টক-এর মতো কিছু একটা আঁচ করে নিবেন তাহলে।

আমার মোবাইলের একটা অ্যাপ্‌স আছে: প্ল্যানেট্‌স। ওটা মাথার উপর ধরলে আকাশের তারাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ চেনা যায়। খুব সহজেই তারাগুলো সনাক্ত করে দিক নির্ণয় করে আমি গাড়িতেই বসে মাগরিব সারলাম। খুব ভালো লাগলো তারা দেখে নামায পড়তে। ওদিকে সবাই কীসব যেন আলোচনা করে ফিরছে। এদিকে গাড়ির পাশে ঘুরঘুর করছে এক কিশোর, সাথে এক লোক। তারা আমাদের গাড়িতে করে মূল সড়ক পর্যন্ত লিফ্‌ট চাইছে। এই একইভাবে লিফ্‌ট চেয়েছিল নীলগিরির চূঁড়া থেকে দুই যুবক, গাড়ি নেই বলে। কিন্তু তাদেরকে আমরা মানবতা দেখিয়ে নেইনি, কারণ তাদেরকে আমরা চিনিনা, পথে ডাকাতিও করতে পারে। এদেরকে কি নিব তবে? আমার দলের ওরা কানাঘুষা করছে কী? কিছু একটা প্ল্যান করে ফেলেছে নিশ্চয়ই…

তখন বুঝিনি প্ল্যানের পরে প্ল্যান আমাদেরকে কতদূর অবধি নিয়ে যেতে পারে…

চলবে…

-মঈনুল ইসলাম

বান্দরবান ভ্রমণ ২০১১ : পর্ব ২

রাতেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এদেরকে নিয়ে বগা লেকে যাওয়া যাবে না। বন্ধু সাকিবকে ফোনে জানালাম সিদ্ধান্তের কথা, সেও সায় দিল। এরকম পিছুটান নিয়ে কোনোভাবেই দুর্গম ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হবে না, কারণ বগা লেক ভ্রমণে অনে-ক কষ্ট করতে হবে, চার-পাঁচটা পাহাড় ডিঙানো লাগবে, কম কথা না।

যেহেতু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তাই বাকিগুলো এখন খুব সহজেই নেয়া সম্ভব। পরদিন ভোরে নাকিব আর শাকিল ভোর ৭টায় বান্দরবান পৌঁছে গেল সরাসরি, পৌঁছে ঘুম ভাঙালো আমাদের। দুজনেই গোসল-টোশল করে প্রস্তুতি নিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হোটেলের গোসলের পানি মানে হলো কাদাগোলা পানি। মুখে দিয়ে কুলি করা তো দূরে থাক, গায়ে ঢালতেও ইচ্ছা করে না। অথচ ২০০৮-এর ট্যুরে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি আমাদের। তাছাড়া এবার হোটেলগুলোতেও খাবার পানি নিরাপদ না, ফিল্টার পানিও নেই; পানি তাই এবার পুরো ট্যুরেই আমাদেরকে কিনে খেতে হয়েছে। ট্যুরিস্ট ট্যুর আর কাকে বলে? ব্যাপারটা ঠিক আমার বোধগম্য হলো না। ঝরণার এলাকা বান্দরবান, তাছাড়া বর্ষা আসন্ন, এসময় পানির এই বিরূপ চেহারা দেখা লাগবে ভুলেও ভাবিনি।

যাহোক, আমার প্ল্যান জানালাম নাকিব আর শাকিলকে, যেহেতু আমরা বগা লেক যাচ্ছি না, আজকের দিন তাহলে আমরা নীলগিরি, শৈলপ্রপাত এসব জায়গাগুলো ঘুরে দেখে আসি। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। বান্দরবানে ১০টার সময় আর নাস্তার টিকিটাও পাওয়া যায় না। মহা মসিবতের সময় শেষ পর্যন্ত মাংসের ঝোল দিয়ে ভাতই খেলাম আমরা (জনপ্রতি ৳৪৮)। তারপর রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ারের থেকেই জানতে চাইলাম নীলগিরি সম্বন্ধে। তিনি আমাদের কিছু গাজাখুরি উপকথা শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন পিকাপ ড্রাইভারের খোঁজ দিলেন। তাঁকে ফোন করে তাঁর রেট জেনে নেয়া হলো। জানা গেলো: শৈলপ্রপাত, চিম্বুক আর নীলগিরি ঘুরিয়ে নিয়ে আসার প্যাকেজ ট্যুরের জন্য তাঁকে দিতে হবে সাকুল্যে ৳৩,৫০০। ফোন রাখতেই সেই ড্রাইভার এসে সরাসরি রেস্টুরেন্টে হাজির। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি এর কম নিতে পারবেন না। আমরা তাঁকে জানাবো মর্মে সেখান থেকে সরে পড়লাম। হোটেলে ফিরে হোটেলের ম্যানেজারের পরিচিত ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে এরচেয়ে বেশি রেট পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত আগের লোককেই ফোন করে আসতে বলে দেয়া হলো।

পনেরো মিনিটের মধ্যে সবাই বাক্স-পেটরা নিয়ে প্রস্তুত। আমরা হোটেল ছেড়ে দিব। কারণ বন্ধু সাকিব জানিয়েছে, মিলনছড়ি নামের একটা জায়গা পড়বে পথে, সেখান থেকে অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আমরা ঠিক করেছি সেখানে থাকার চেষ্টা করবো। আর যদি না পারি, তাহলে আবার হোটেলে ফেরত আসবো। হোটেল খুব একটা লোকে-লোকারণ্য না, তাই খালি পাবো আশা করি।

কোথায় বৃষ্টি কোথায় কী, আকাশে একফোঁটা মেঘও নেই! রোদের তাপ সরাসরি গায়ের যতটুকু অংশে লাগে, মনে হয় যেন পুড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারপরও জিপ-পিকআপ গাড়িতে উঠেই সবাই সমস্বরে মত দিলো, গাড়ির তেরপল সরিয়ে দিতে হবে। তথাস্থ। তেরপল সরিয়ে দিতেই রোদ এসে শরীর ভেদ করে যেতে লাগলো। কিন্তু গাড়ি ছাড়তেই সাথে সাথে সবাই যখন উপরের রডের ফাঁক গলে মাথা বের করে দিলো, তখন চলমান গাড়ির বাতাস এসে সব গরম উড়িয়ে নিয়ে গেলো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।

গাড়ি, বান্দরবান বাসস্টেশনে যাবার আগেই বামের একটা পথে মোচড় নিল। তারপর শুরু হলো আমাদের মূল যাত্রা। আকাবাঁকা রাস্তা সিলেটের মতোই, তবে অতোটা না। বান্দরবানের আকাবাঁকা রাস্তা শুধু আকাবাঁকাই না, উঁচু-নিচুও। চড়াই-উৎরাই দিয়ে পরিপূর্ণ। পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম আদিবাসিদের বিভিন্ন গ্রাম, ওরা বলে আদিবাসী পল্লী। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল গাড়ির উপর মাথা বের করে থাকা একঝাঁক বানরের দলকে। বান্দরবানে আমার, নাকিবের আর প্রিয়মের এটা দ্বিতীয় ট্যুর হলেও বাকি সবার এটা প্রথম ট্যুর। তবে আমাদের তিনজনেরও বান্দরবান সদরের বাইরে ঘুরতে যাওয়া এটাই প্রথম। তাই সবার অবস্থাই এক: প্রচণ্ড উত্তেজিত সবাই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মিলনছড়ি ছাড়লাম। আমাদেরকে জায়গাগুলোর পরিচয় দিচ্ছে আমাদের গাড়ির হেল্পার: আধা আদিবাসী-আধা বাঙালি এক ছেলে। কুব সুন্দোর সুন্দোর জায়গা দেকাবে সে আমাদেরকে –এরকমই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলো ক্ষণেক্ষণে। তবে, মিলনছড়ি সত্যিই দারুণ জায়গা, শহরের কাছাকাছি বেশ সুন্দর জায়গা বলা যায়। সবারই চিল্লাচিল্লি বন্ধ হয়ে গেল। উপভোগ করতে থাকলো অনেক নিচে বান্দরবান শহরটাকে। তবে চলমান গাড়ি থেকে ঠিক মন ভরে উপভোগ করা গেল না। মনে মনে বললাম, আসছি এখানে, একটু অপেক্ষা করো।

আরো কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে চোখে পড়লো একটা পানির-প্রবাহ। আমাদেরকে আমাদের গাইড মহাশয় জানালো, এটা শৈলপ্রপাত; তবে এখানে এখন সময় নষ্ট করার মানে নেই, সামনে অনেক সুন্দর জায়গা অপেক্ষা করছে। অগত্যা আমাদেরকে শৈলপ্রপাতের স্বাদ না নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হলো।

পথ একই রকম। তবুও তার মাঝে যেন কী একটা বৈচিত্র্য! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে পুরোটা পথই। কিন্তু সবাই কি আর শুধু তাকিয়ে আছে, বাঁদরামি চলছেই। ফয়সাল রাজনৈতিক ভাষণ ঝেড়ে দিচ্ছে, তো নাকিব একটা কথাকে ভ্যাংচি কাটছে, তো ইফতি হেরে গলায় গান ধরছে, তো শাকির আমার নীরবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। নীরব কি আর থাকা যায়? কেউ না কেউ আনন্দ করছেই, আর বাকিরা, না পারলে, তা উপভোগ করেই ঢের আনন্দ পাচ্ছে।

সঙ্খ আর সাঙ্গু যাই বলেন, দূরে সেই অপূর্ব দৃশ্য, আর সামনে আমরা ৭ নাদান
সঙ্খ আর সাঙ্গু যাই বলেন, দূরে সেই অপূর্ব দৃশ্য, আর সামনে আমরা ৭ নাদান

 আরো কিছুদূর যেতেই হঠাৎ রাস্তার বাম পাশে চোখ পড়তেই সবাই একযোগে “ওয়াও” বলে চিৎকার করে উঠলো। দৃশ্যটা আসলেও ‘ওয়াও’-টাইপের। বান্দরবানের নদী “সাঙ্গু”। আমাদের গাইড অবশ্য সাঙ্গু মানতে রাজি না, সে বারবার শুধরে দিলো “শঙ্খ” নদী।  আমাদের রাস্তার বাঁপাশে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট খাল, গাইডের বক্তব্য অনুযায়ী এটা শঙ্খ নদী। দৃশ্যটা অপূর্ব! নয়নাভিরাম! পরে যখন নাকিবের ১২এক্সঅপটিক্যাল যুম ক্যামেরার ছবিগুলো আমরা বড় করে দেখেছি কম্পিউটারে, তখন দেখেছি খালের মতো মনে হওয়া শঙ্খ নদী আসলে বেশ খানিকটা বড়, উপর থেকে দেখছিলাম বলে মনে হচ্ছিলো একটা খাল। আমাদের গাড়ি অবশ্য থামিয়ে আমাদেরকে ছবিগুলো শান্তিতে ধারণ করার সুযোগ দিলো। পরে ঘাটাঘাটি করে জেনেছি, সাঙ্গু নদীরই আরেক নাম শঙ্খ নদী।

তারপর আবার যাত্রা। ও…, বলা হয়নি, ইফতি এতক্ষণ একটা দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছে বসার জন্য: ড্রাইভারের মাথা। ড্রাইভারের মাথায় বসে যে থ্রিল পেয়েছে সে, সেটা নাকি তুলনাহীন –হ্যা, ড্রাইভারের মাথাই বলা যায়: পিকআপের সামনের অংশের হুডের উপর রড আকড়ে বসে চলছে সে। তাকে বারবার সতর্ক করে দেয়া হচ্ছিলো যেন, সে মরে আমাদেরকে বিপদে না ফেলে।

এই দুই নাদান, গাড়ি ছাড়তে চায়না। তারা যে যার জায়গায় অবস্থানরত। আপনারা এই ছবিতেই ইফতির বিশেষ অবস্থানটা দেখতে পাবেন।
এই দুই নাদান, গাড়ি ছাড়তে চায়না। তারা যে যার জায়গায় অবস্থানরত। আপনারা এই ছবিতেই ইফতির বিশেষ অবস্থানটা দেখতে পাবেন।

আমাদের যাত্রা চলছেই…। অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। আমি কখনো শাকিরের ছোট্ট ক্যামেরাটা দিয়ে তুলছি, কখনো আমার মোবাইল দিয়ে তুলছি। সমস্যা হলো রাস্তা আঁকা-বাঁকা। রডের মধ্যে শরীর ঘষা খেতে খেতে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে হাতে ক্যামেরা ধরে রেখে ছবি তোলা রীতিমতো কষ্টকর। আমার মোবাইলের রেযোল্যুশনে আস্থা আছে, তাই বেশ কসরত করে ওটাকে চার আঙ্গুলে আঁকড়ে ধরে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্ন্যাপ নিয়ে কোনোরকমে রাস্তার সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে চাইলাম, কারণ আরেকটা হাত দিয়ে তো রড ধরে দাঁড়ানো লাগবে। আর রাস্তাগুলো ভয়ঙ্কর তো বটেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই কয়েক শ’ ফুট নিচের খাদে। সুতরাং সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরকে ছেঁড়ে আসতে চাইলাম না।

চিম্বুক

একসময় আমাদের গাড়ি গিয়ে থামলো একটা টং দোকানের সামনে এক বড় গাছের নিচে। এটাই নাকি চিম্বুক। টং দোকানের গাছপাকা কলা সবাই পেটপুরে খেলো। তারপর পাশের ঢাল বেয়ে সবাই উঠে যেতে শুরু করলাম চিম্বুকে; আসলে এটা হলো চিম্বুকের উপত্যকা(?), আর পাশের লাগোয়া পাহাড়টা হচ্ছে চিম্বুক পাহাড়।

চিম্বুক উঠার এই পথটা বেশ লাগলো আমার।

চিম্বুক পাহাড়ের উপরে উঠে সবাই কিছুটা যেন আশাহত হলাম। সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো, চিম্বুক কী জন্য বিখ্যাত? সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন, আমি কি লাইব্রেরী নাকি? আমিও নিজেকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম না, চিম্বুকের বিখ্যাত হবার কারণ। যা জানি চিম্বুক হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়। কিন্তু ঐ যে দূরের পাহাড়টা তো এটা থেকেও উঁচু? তখন মনকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো “পাহাড়”-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী এটাই সর্বোচ্চ, বাকিগুলো পর্বতশ্রেণীভুক্ত, কিন্তু নামডাক নেই, কারণ ওগুলো কেওক্রাডংয়ের মতো অতো উঁচু হতে পারেনি। পরে অবশ্য পড়ালেখা করে জেনেছি, চিম্বুক হচ্ছে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পাহাড়। কিন্তু এক আর দুই নাম্বারে কী আছে জানা গেলো না। যদি ধরে নিই, তাজিংডং আর কেওক্রাডং হলো যথাক্রমে ১ ও ২, তাহলে ওদুটো হলো পর্বত, আর চিম্বুক তাহলে পাহাড়দের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু! তাহলে আমার হাইপোথিসিসটা ঠিক হয় আরকি। কিন্তু বাস্তব সত্যটা কী, জানিনা।

চিম্বুকে মঞ্চস্থ হলো আমাদের আনোখা ড্রামা: একজন আত্মহত্যা খেতে যাচ্ছে, আরেকজন নিচ থেকে আকাশে উঁকিঝুকি মারছে- যা-তা অবস্থা।।

এখানেই প্রথম এবং শেষবার আমরা নয় অভিযাত্রী একত্রে ক্যামেরাবন্দী হলাম। চিম্বুক থেকে দেখলাম নিচে ঐ…যে একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা এগিয়ে গেছে আরো সামনে, যেতে ইচ্ছে করলো রাস্তাটা ধরে। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না, আমাদেরকে এখান থেকে নীলগিরি যেতে হবে। যেহেতু উঠেছি খাঁজকাটা পথে, তাই এবারে পিছন দিকের গাড়ি-চলা পথ ধরে নামা ঠিক করলাম। যারা এই নামা-উঠাকে মনে করছেন ‘বহুত কিছু’, তাদেরকে নিরাশ করতে হয়, আসলে এটা পাহাড় চড়ার অপমান বলা চলে। যাহোক, পেছনের এই পথটাও দারুণ। নেমে আবার উঠলাম গাড়িতে। আর আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চললো সেই পথে, যে পথে যাবার ইচ্ছা হচ্ছিলো চিম্বুকের চূঁড়া থেকে।

চিম্বুক থেকে নামার পিছন দিকের পথটাও খুব সুন্দর!

পথগুলো আবারও অসাধারণ। পথ চলছি, গল্প করছি। আর শাকিল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে পিছন ফিরেছি, এমন সময়, হঠাৎ… এ্যাই সর সর, কিন্তু রক্ষা হলো না। ঠাশ্‌ করে একটা গাছের সরু ডাল এসে লাগলো ঠিক আমার ডান চোখে। ভালো ব্যাথা পেলাম। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ডানদিকে, আর তাই, ডালটা রেহাই দেয়নি আমাকে। ইফতি সামনে বসা ছিল, সে সরে আমাকে সাবধান করতে না করতেই যা ঘটার ঘটে গেছে। সৌভাগ্যবশত আল্লাহ মানুষকে কিছু ইন্সটিঙ্কট দিয়েছেন, যার বদৌলতে আঘাতের ঠিক আগমুহূর্তে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই চোখের ভিতরে কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে চোখের পাতা ছড়ে গেছে খানিকটা। একটু পরেই আমার আর কোনো কষ্টই রইলো না, কিন্তু যে-ই আমার দিকে তাকাচ্ছে, একটা করুণ চাহনি, আহারে!-টাইপের একটা অভিব্যক্তি। তবে, ধাক্কা আমি খেলেও সবাই ঐ এক ধাক্কায় সচেতন হয়ে গেল।

একসময় আমরা নীলগিরির কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। বাতাস ঠাণ্ডা এখানে। তবে আকাশে মেঘের কিঞ্চিত আনাগোনা, কিন্তু যে বৃষ্টির প্রত্যাশায় এসেছিলাম, তার গুড়ে বালি। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম সেই কাঙ্ক্ষিত নীলগিরিতে। বন্ধু [ট্রেকার] সাজ্জাদের ছবি আর ফেসবুক ফ্যানপেজের ছবি দেখে যে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, সেই নীলগিরিতে পৌঁছলাম অবশেষে। রাস্তা থেকেই দেখা যাচ্ছিলো পাহাড় চূড়ার কটেজ। গাড়ি এগিয়ে চললো গন্তব্যে…।

চলবে…

-মঈনুল ইসলাম