জাতীয় জাদুঘর কি গাইয়াদের জায়গা?

ঢাকায় বেড়াতে এলে গ্রামের আত্মীয়-স্বজনেরা যেসব জায়গায় বেড়াবার বায়না করেন, তার মধ্যে অন্যতম চিড়িয়াখানা, জাদুঘর -এগুলো। এটা সর্বজনীন চিত্র। আমার এক বন্ধুতো জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে ‘সরষের তেলের গন্ধ’ পায়, কারণ সেখানে নাকি এইমাত্র গ্রাম থেকে আসা বাঙালরাও চলে যায়। ঢাকার মানুষের কাছে অবহেলিত এই সরষের তেলের গন্ধসমৃদ্ধ স্থানটাতে কী পায় গ্রামের মানুষ? নাকি এটা শুধু গেঁয়োদেরই স্থান?

যদি আপনি জাতীয় জাদুঘরে যান, তবে যেদিনই যাবেন, গিয়ে দেখবেন জাদুঘর বন্ধ। এই ঘটনাটা ঘটে জাদুঘরের সময়সূচি জানা না থাকার কারণে। জাদুঘরে গিয়ে ফিরে আসার সময়ও কেউ এই সময়সূচি লিখে আনেন না। সকলের সুবিধার্থে সময়সূচি এখানে বিধৃত হলো:

  • গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর): শনি-বুধ ১০:৩০-৫:৩০; শুক্র ৩:৩০-৭:৩০
  • শীতকালীন (অক্টোবর-মার্চ): শনি-বুধ ৯:৩০-৪:৩০; শুক্র ৩:৩০-৭:৩০
  • রমযান মাসে: শনি-বুধ ৯:৩০-[সম্ভবত] ১টা; শুক্রবার বন্ধ
  • বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি (বন্ধ), সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থাকে।

এবারে আপনি যখন জাতীয় জাদুঘরে যাবেন, তখন শুরুতেই একটা মেটাল ডিটেক্টর দরজা (আর্চওয়ে) দিয়ে আপনাকে পার হতে হবে। এখানে আপনার টিকেট চেক করা হবে না। আপনার মনে হতে পারে, এরা টিকেট চেক করবে না, আপনার ধারণা ভুল। এসময় আপনার হাতে যা থাকবে, তা-ই পরীক্ষা করে দেখা হবে। যে জিনিস ভিতরে নেবার অনুমতি নেই, তা আপনাকে বাম দিকের একটা ডেস্কে জমা দিতে হবে। দামী জিনিস হলেও জমা দিতে হবে, দায়িত্ব নিজের, তারা শ্রেফ জমা রাখবে। তাই জাদুঘর ভ্রমণে কিছু সাথে না থাকাই শ্রেয়। আমার হাতে একগাদা বই ছিল, তাও জমা দিতে হয়েছে। আর অবশ্যই কোনো ক্যামেরা বহন করা যাবে না, তবে মোবাইল সাথে নেয়া যাবে। অফ দ্যা রেকর্ডে বলি: আমার মোবাইলে অবশ্য ক্যামেরা ছিল।

স্ক্রলের মধ্যে লেখা মহাভারত (গোপনে তোলা ছবি)
স্ক্রলের মধ্যে লেখা মহাভারত (গোপনে তোলা ছবি)

নিচতলায় একটা গ্যালারি আছে, আছে টয়লেট, অডিটরিয়াম, অফিস। আপনাকে সরাসরি সামনের বড় সিঁড়িটা দিয়ে দোতলায় উঠে যেতে হবে। এখানে আপনার টিকেট চেক করা হবে। আপনি প্রথমেই বাংলাদেশের বিশাল একখানা মানচিত্রের সামনে দাঁড়াবেন। বাতি জ্বালিয়ে ঐ মানচিত্রে বিভিন্ন জেলা চিনিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন রকম ভূ-তাত্ত্বিক, ভৌগোলিক আর অর্থনৈতিক মানচিত্র। এই কক্ষ থেকে আপনি ডানে-বামে যেকোনো দিকে যেতে পারেন। এব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, যেদিক দিয়েই যান না কেন, কোনো কক্ষই আপনার মিস যাবে না, কারণ জাদুঘরের নকশা করা হয়েছে অনেকটা চক্রাকার। আপনি সব দেখে আবার প্রথম কক্ষে ফিরবেন। এভাবে দেখে দেখে আপনি আবার এই প্রথম কক্ষে ফিরলে সিঁড়ি বেয়ে চলে যাবেন তৃতীয় তলায়, সেখানেই একইভাবে ঘুরতে থাকবেন। এই তলায় আছে মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি পরিচিতি, অস্ত্রশস্ত্র, চিত্রকলা, শিল্পী…।

জয়নুল আবেদিনের সাঁওতালদের উপর আঁকা ছবিগুলোর একটির সামনে লেখক (গোপনে তোলা ছবি) :) (ছবি: তুহিন)
জয়নুল আবেদিনের সাঁওতালদের উপর আঁকা ছবিগুলোর একটির সামনে লেখক (গোপনে তোলা ছবি) 🙂 (ছবি: তুহিন)

আর কী কী দেখার আছে তার বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না, সংক্ষেপে দুয়েকটার নামোচ্চারণ করছি: হাতির দাঁতের পাটি; বিশাল একটা মৌচাক মৌমাছিসহ স্টাফ করা; দেখবেন একটা আঁকা ছবি, যা দেখে আপনি ঠাহর করতে পারবেন না এটা কি একটা উল্টো করে রাখা ফ্রেম নাকি সত্যিই একটা আঁকা ছবি; দেখবেন বৌদ্ধযুগের বোধিসত্ত্ব মূর্তি…স্পর্শ করতে পারলেই যেন অতীত হাতড়ানো যাবে, তবে স্পর্শ না করলেই ভালো হয়; বিশালাকৃতির শিবলিঙ্গ; কা’বা ঘরের গিলাফের টুকরা; নাসখ-গুবর-নাস্তালিক আরবি ক্যালিগ্রাফি; জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের বিখ্যাত ছবিগুলোর কয়েকটি; এসএম সুলতান, কামরুল হাসান…সবাইকেই পাবেন; উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী না হলেও দেখতে পাবেন [হার্বেরিয়ামের মতো করে] একেকটা গাছের বাকল, কাঠ, বীজ, পাতা, তন্তু, আর ঐ গাছ থেকে তৈরি প্রাকৃতিক রং দিয়ে রং করা কাপড়ের নমুনা; দেখবেন বাংলাদেশের কত নকশার নৌকা যে আছে; আমাদের দুই নেত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও সেখানে জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনকারী জিয়াউর রহমানও যেমন আছেন, তেমনি আছেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান; আছেন সোহরাওয়ার্দি, এমএজি ওসমানি, শহীদুল্লাহ কায়সার; দেখতে পাবেন বেগম রোকেয়ার নিজ হাতে লেখা ডায়রি; দেখতে পাবেন কাজী নজরুল ইসলামের এতোটুকুন বিছানা, আশ্চর্য হবেন, এখানে জায়গা হতো তো তাঁর!…আমি বলে শেষ করতে পারবো না…দেখতে পাবেন প্রথম শহীদ মিনারের পিলার, ভাষা শহীদের রক্তমাখা কোট-শার্ট; পাকিস্তানী বাহিনীর টর্চার যন্ত্র গিলোটিন; বদ্ধভূমির খুলি আর খুলি… আর বলবো না।

আমি সবচেয়ে ভালোবাসি তৃতীয় তলা থেকে বেরিয়ে চতুর্থ তলায় চলে যেতে, যেখানে অনেকেই যান না, মনে করেন উপরে আর গ্যালারি নেই। যাবার পথেই তৃতীয় তলা আর চতুর্থ তলার মাঝখানে দেখতে পাবেন ‘জাতীয় জাদুঘর গ্রন্থাগার’। তবে দুঃখের সাথেই বলছি, ভেতরে যাবার অনুমতি পাবেন না, আগে থেকে অনুমতি না থাকলে ভেতরে বসতে পারবেন না। ব্যর্থ মনোরথে চড়ে চতুর্থ তলায় গেলে মন ভালো না হয়েই যায় না…সেখানে স্থান দেয়া হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যকে। ডানদিকের কক্ষে প্রথমেই পাবেন চীনের বিখ্যাত টেরাকোটা ওয়ারিয়রদের কয়েকজন অস্ত্র হাতে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম চীনাদের বিখ্যাত ঐ ঐতিহ্যমন্ডিত সৈন্যদলের কয়েকজনকে…সামনেই কোরীয় ভাষার বর্ণমালা আর একটা যন্ত্র বসানো, বিভিন্ন বোতামে চাপ দিলে নির্দিষ্ট উচ্চারণে কোরীয় ভাষা আওড়াবে যন্ত্র; আছে চীন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের পুতুল, পোষাক সম্বলিত লাইফ সাইজ (বাস্তবাকৃতির) মূর্তি বা পুতুল, দেখতে পাবেন নানারকম মুখোশ, সীল…। অন্য আরেকটা কক্ষে পাবেন প্রচুর আর প্রচুর পুতুল…বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যমন্ডিত, পোষাকসমৃদ্ধ পুতুল…ভালো না লেগেই যায় না…সবচেয়ে ভালো লাগবে যখন আপনি আরেকটা কক্ষে ঢুকে নিজেকে আবিষ্কার করবেন সরাসরি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির Last Supper”-এর সামনে, কিংবা পিকাসো’র Guernica”-র সামনে। এই কক্ষে বিখ্যাত বিখ্যাত সব শিল্পীর আঁকা বিখ্যাত বিখ্যাত সব চিত্রকর্মকে ডিজিটাল প্রিন্টআউট করে ফ্রেম করে রাখা আছে। লুভরে না গিয়ে অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্ম অনেকটা আসল ছবির আদলে দেখতে পাবেন।

এতো সুন্দর জাদুঘরে যতটা অনিয়ম আশা করছেন, অনিয়ম তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে চতুর্থ তলার কোরীয় ভাষার উচ্চারণ শোনার যে পোডিয়ামটা আছে, সেটা বন্ধ করে রাখা। সুন্দরবনের জঙ্গল, আমি দুদিন গিয়েও পরিচর্যার অধীন দেখেছি। বিশ্ব চিত্রকলার কক্ষে হল্যান্ডের Jan Vermeer-এর আঁকা Girl Reading a Letter at Open Window” ছবিটা সম্ভবত প্রথমদিকে কাচ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল না, সে সুযোগে কোনো এক স্বল্পশিক্ষিত প্রেমিক লিখে রেখেছে “অমুক+তমুক”, “চিঠি পেলাম -তমুক”। তবে প্রশান্তির কথা এটাই যে, এটা মাস্টারপিস না। এতো সুন্দর নকশার জাদুঘরে নামায পড়ার কোনো কক্ষ নেই। অডিটোরিয়ামের পাশে একটা সিঁড়ির নিচে পাতা একখানা কার্পেটের উপর আপনাকে নামায পড়তে হবে। আর অডিটোরিয়ামে যদি সেদিন কোনো অনুষ্ঠান থাকে, তাহলেতো পোয়াবারো। কার্পেটটাও যত্ন করে রাখা হয় না, সেখান দিয়ে অনেকেই জুতো পায়ে মাড়িয়ে যায়। …তারপরও এতোটুকু্ একটা দেশে এতো প্রাণ দেখে আপনি আশান্বিত না হয়েই পারবেন না।

আজই যান, স্বপরিবারে যান। গ্রামের মানুষদেরকে আপনি গোঁয়াড়, বুদ্ধু ভাবলেও তারা যে ফাঁকতালে কী সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে মাথায় করে, ঘুরে না এলে কল্পনাও করতে পারবেন না। মাত্র ৳৫ (পাঁচ টাকার) টিকেটে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বটাকে দেখে আসার অপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। আর সেদিন যদি গ্যালারিতে কোনো প্রদর্শনী থাকে, তো সেটা বাড়তি পাওনা।

পরামর্শ: সাথে ছোট্ট এক বোতল পানি নিয়ে যাবেন। প্রচুর সময় নিয়ে যাবেন। যা দেখতে যাচ্ছেন, তার সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জানাশোনা থাকলে দেখে আনন্দ পাবেন। সঙ্গে অভিজ্ঞ কেউ থাকলে অদেখার মাঝেও দেখার অভিজ্ঞতা হতে পারে।

-মঈনুল ইসলাম

প্রকাশ করেছেন

মঈনুল ইসলাম

An ex-Notre Damian, a Graphics, UI Design & Web Development professional, seeking truth in modern world using his interests in theology, theosophy, occult, psychology, cultures, linguistics, noetics, material science and logic.

2 thoughts on “জাতীয় জাদুঘর কি গাইয়াদের জায়গা?”

মন্তব্য করুন