আমরা সবাই-ই জানি, নদীর শুরু হয় পাহাড় কিংবা পর্বত থেকে। সেখান থেকে বৃষ্টির কিংবা বরফগলা পানি চুইয়ে চুইয়ে নামবে, গতি তৈরি হবে, নদী হয়ে যাবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন একটা নদী আছে, যার উৎপত্তি হয়েছে একটা কুয়া থেকে – আশা করি ভুল বলিনি।
নীল নদ (The Nile)
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী (আসলে নদ) “নীল নদ”-এর উৎপত্তি কোনো পর্বতে হয়নি… বরং আফ্রিকার উগান্ডার লেক ভিক্টোরিয়া (Lake Victoria), জিঞ্জ্যা (Jinja) থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই সত্যটা প্রথম আবিষ্কার করেন অভিযাত্রী জন হ্যানিং স্পেক (John Hanning Speke) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট। ১৮৬২ সালে দাবি করেন লেক ভিক্টোরিয়াই নীল নদের উৎস। কিন্তু তাঁর দাবি কে মানবে? পরবর্তিতে হেনরি মোর্টন স্ট্যানলে (Henry Morton Stanley) তাঁর এই দাবির সত্যতা খুঁজে পান এবং প্রতিষ্ঠিত করেন। অবশ্য লেক ভিক্টোরিয়াতে অন্যান্য আরো কয়েকটি জল উৎস এসেও মিশেছে।
ধন্যবাদ চ্যানেল আই-তে প্রকাশিত কৃষকের ঈদ আনন্দ (২০১৫) অনুষ্ঠানকে। ঐ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই প্রথম জানলাম ব্যাপারটা। দেখলাম, শাইখ সিরাজ নৌকা নিয়ে লেকের ঐ জায়গাটায় গেলেন, যেখানে একটা সাইনবোর্ড লাগানো:
The Source of R. Nile
Jinja
World’s Longest River
এবং ঠিক সেখানটাতেই পানির নিচ থেকে ঊর্ধ্বমুখি জলস্রোতের বলকা উঠে আসছে। ক্যামেরাতেই দেখা যাচ্ছিলো, একটু ওদিকটাতে আবার পানি তুলনামূলক শান্ত। ছবিতে গাছের পাশে আপনারা সেই সাইনবোর্ড লাগানো উৎপত্তিস্থলটা দেখতে পাচ্ছেন, পানিতে আলোড়নটাও দেখতে পাবেন। অনেক ভিডিও দেখা যাবে গুগলে অনুসন্ধান^ করলেই।
নীল নদ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদ, যা ১১টি দেশ ছুঁয়ে ভূমধ্যসাগরে মিশেছে। মিশর আর সুদানের এটাই মূল জলউৎস। এর হোয়াইট নাইল আর ব্লু নাইল নামে দুটো গতিপথ আছে – শ্বেত নীলনদ হচ্ছে মূল স্ট্রিম আর নীল গতিপথ হচ্ছে শাখাপথ। প্রাচীন মিশরে একে ডাকা হতো ‘হাপি’ (Ḥ’pī) ‘ইতেরু’ (Iteru)। ‘ইতেরু’ হায়ারোগ্লিফে লেখা হতো পাশের ছবির মতো করে।
প্রচ্ছদের ছবিতে উগান্ডাতে নীলনদ দেখা যাচ্ছে। আর নিচের ছবিতে লেক ভিক্টোরিয়া (নিচের দিকে ছোট্ট লাল ফোঁটা) থেকে বের হওয়া নীল নদ উপরের দিকে (উত্তর দিকে) গিয়ে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পড়েছে, তা লাল দাগ দিয়ে দেখানো হয়েছে।
দাবিটা এপর্যন্ত বলে শেষ করে দিলে আসলে সত্যটা গোপন করা হবে। গবেষকরা দেখেছেন, লেক ভিক্টোরিয়ার ঠিক উপরে না হলেও কাছাকাছি (৩৭০ কিলোমিটার দূরে) কঙ্গো আর উগান্ডার বর্ডারে একটি পার্বত্যাঞ্চল রয়েছে – রুয়েনযোরি পর্বতমালা (Rwenzori Mountains)। গবেষকরা এখনো এক কথায় নিশ্চিত করে বলে দেননা যে, ভিক্টোরিয়া লেকই নীল নদের উৎপত্তিস্থল, তাঁরা আরো একটু দক্ষিণে, আফ্রিকার আরো দুটি দেশ রুয়ান্ডা কিংবা বুরুন্ডি’র দিকে তাকান। কারণ রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, তানজানিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো – এই দেশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে The Great Lakes – মানে বেশ কয়েকটি বিশালাকায় লেক। এছাড়া রুয়ান্ডা আর বুরুন্ডির এলেভেশন প্রোফাইল দেখলেও দেখা যায়, ভিক্টোরিয়া লেকের তুলনায় তাদের গড় এলেভেশন কিছুটা উঁচুতে। সুতরাং এই ধারণা অমূলক নয় যে, উঁচু সেসব স্থান থেকে কিংবা রুয়েনযোরি পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জল – এসব কিছুই মাটির নিচ দিয়ে কোনো গুপ্ত নালা পথে ভিক্টোরিয়া লেকে এসে ঐ জায়গাটা দিয়ে বেরোচ্ছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত করে কোনো উৎসের নাম করতে পারছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া লেকই নীল নদের উৎস সই।
নীল নদের কাছে চিঠি
ভূতাত্ত্বিক এই ঘটনাটা আব্বাকে বলতেই তিনি আরো আশ্চর্য এক ঘটনার কথা বললেন, কোনো এক খলিফা নাকি নীল নদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। খুঁজে খুঁজে পেয়েও গেলাম সেটা:
বলা হচ্ছে ২০ হিজরিতে (মোটামুটি ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে), নীল নদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন মুসলমান খলিফা জনাব ওমর [আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন]। তখন নীল নদে বছরের একসময় পানি থাকতো, একসময় শুকিয়ে যেত (খরা মানে প্রয়োজন পরিমাণ পানি ছিল না, খুব ছোট্ট একটা স্ট্রিম চলতো বোধহয়)। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যুবতী মেয়ে বিসর্জন দিলে নীল নদে পানি আসে। তখনকার মিশরীয়রা খ্রিষ্টান হওয়াসত্ত্বেয় প্রাচীন পৌত্তলিক মিশরীয়দের অনুসৃত এই রীতি অনুসরণ করতেন এবং বছর বছর মানুষ বলিদান দিতেন পানির জন্য। ওমরের খিলাফতকালীন সময় ছিল বলে, এই জাহিলীয় প্রথা গ্রহণ করা হলো না; তিনি নীলনদের কাছে একটা চিঠি লিখেন… হ্যা, ঠিকই শুনছেন, নীল নদের কাছে… তিনি লেখেন:
من عبد الله عمر أمير المؤمنين إلى نيل أهل مصر، أما بعد: فإن كنت إنما تجري من قبلك ومن أمرك فلا تجر فلا حاجة لنا فيك، وإن كنت إنما تجري بأمر الله الواحد القهار، وهو الذي يجريك فنسأل الله تعالى أن يجريك.
অর্থ: “আল্লাহর দাস, বিশ্বাসীদের নেতা, ওমর-এর পক্ষ থেকে মিশরের নীল নদের প্রতি প্রেরিত এই চিঠি। অতঃপর হে নীল নদ! তুমি যদি নিজের ক্ষমতাবলে আর নিজের পক্ষ থেকে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে তুমি আজ থেকে আর প্রবাহিত হয়ো না। তোমার কাছে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আর তুমি যদি মহা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর হুকুমে প্রবাহিত হয়ে থাক, তাহলে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন।”
চিঠিটা নির্দেশমতো নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। পরদিন ১৬ কিউবিট (২৪ ফুট) উচ্চতা দিয়ে জলপ্রবাহ হচ্ছিল নীল নদে। এটা মনে করার দরকার নেই যে, চিঠি ফেলার স্থানই এই লেক ভিক্টোরিয়া… লেক ভিক্টোরিয়া উগান্ডাতে, আর চিঠি ফেলা হয়েছিল মিশরে। তবে এর পর থেকে মিশরবাসীকে নীল নদের খরায় আর কখনও ভুগতে হয়নি – আজ পর্যন্ত না। যদিও এই ১৯৮০-তেই নীল নদের খরায় ইথিওপিয়া আর সুদানে বিপুল মানুষকে কষ্ট পেতে হয়েছিল।
তবে,
কেউ কেউ এই হাদিসটিকে দুর্বল সনদের (বর্ণনা পরম্পরা) বলে উল্লেখ করেছেন, এবং তাঁরা মনে করেন এরকম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা বিস্মৃত হওয়ার ছিল না। যেহেতু ঐ হাদিসভিন্ন অন্য কোথাও এর উল্লেখ পাওয়া যায় না, তাই এই ঘটনাকে বিশ্বাসের প্রশ্নে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে ধর্মের কোনো লেনদেন নেই, তাই এই হাদিসটিকে শ্রেফ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করতে চান তাঁরা।
বাড়তি তথ্য
- নীলনদ আবিষ্কারের অভিযানের সংক্ষিপ্ত পাঠ^ লিখেছেন Richard Cavendish – HistoryToday.com ()
- নীল নদের উৎস অভিযানে স্পেক আর বার্টনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নিয়ে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে একটি চলচ্চিত্র হয়েছিল, উইলিয়াম হ্যারিসনের বই Burton and Speke অবলম্বনে; নাম: Mountains of the Moon।
সূত্র
- ছবি: Wikimedia Commons। প্রচ্ছদের ছবি তুলেছেন: Rod Waddington।
- চিঠির বক্তব্য: قصة نيل مصر:البداية والنهاية – الجزء السابع ^ লিখেছেন ابن كثير (১৩০১-১৩৭৩) – আরবি ভাষায় WikiSource ()
- চিঠি সম্পর্কে তথ্য: উমর [রা.]-এর জীবনী থেকে – Khalifa Umar bin al-Khattab – Expansion of Islam and Military Campaigns^ by Professor Masud-ul-Hasan – alim.com ()