সুন্দরবনের করমজলের ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর, বাকপটু মানুষ। নিজেকে পরিচয় দিলেন, বন বিভাগের ‘ওসি’ হিসেবে। টুকটাক লেখালেখির বাতিক আছে বলেই মুখে খইও ফোটে বোঝা গেলো। আমাদেরকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আজাদ সাহেব। চা চলছে, আর ওদিকে আমাদের আশেপাশেই বানরদের পুরো একটা বহর – সুযোগ পেলেই খাবার ছিনিয়ে নিতে হাজির। এইমাত্র তাদেরই দুরন্ত একটা তো সবার অলক্ষে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘাঢ়ে পাড়া দিয়ে গেলো…
আমাদেরই কোনো এক প্রশ্নের উত্তরে আজাদ সাহেব চা-বিক্রেতা নারীকে দেখিয়ে বলছিলেন, “এখন তো মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, আমরাই আমাদের জন্য (বন বিভাগের কর্মীদের জন্য) সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানি থেকে এদেরকে (হকারদেরকে) দেই। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এরা নিজেরাই মোংলা থেকে পানি সাথে করে নিয়ে আসে।”
নতুন করে আবিষ্কার করবার কিছু ছিলো না – ঘরের চাল থেকে চুইয়ে নামা বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে বন-জীবন যায় এখানকার বনবিভাগের কর্মকর্তাদের। আমার এক সঙ্গী জিজ্ঞেস করলেন, “চালের ময়লা, গাছের পাতা এগুলো পানিতে পড়ে যায় না?”
আজাদ সাহেব সরলভাবেই উত্তর করলেন, “ওগুলো পানির নিচে গিয়ে জমে থাকে।” একটু থেমে যোগ করলেন, “শুধু কি পাতা? বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন? ওসব চিন্তা করলে কি আর চলে?”
বলছিলেন, “বৃষ্টির পানি খেতে খেতে এখন আর বাড়ি গেলে পানি খেতে ভালো লাগে না”। ফেরার পথে সুন্দরবন আর বাঘ নিয়ে নিজের লেখা কম্পিউটার কম্পোজ করা কয়েক তা কাগজ ধরিয়ে দিলেন আমাদের হাতেও।
পানীয় জল নিয়ে যখন কথা হচ্ছিলো, তখনই পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পশুর নদ – একটু উজানেই সে রূপসা আর মোংলা নদীর সব জল একত্র করেছে – শত শত লিটার জল নিয়ে বয়ে যাচ্ছে সে, গন্তব্য বঙ্গোপসাগর। নদীগুলোতে নাব্যতা কম, কিংবা ভারত, চীনে একাধিক বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে স্রোত কম থাকায় বঙ্গোপসাগরের নোনা জল প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার ঠেলে উঠে এসেছে এই মোংলা অবধি। এখানকার নদীর পানি, ভূগর্ভস্থ পানি সবই তাই নোনা। শুষ্ক মৌসুমে এখানে মানুষ সুপেয় পানি কিনে খায়।
পশুর নদ ধরেই জালিবোটটা আমাদেরকে নিয়ে ফিরতি পথ ধরলো। বিশাল নদের জলস্রোত ঠেলে ফেরার পথে একটু নীরবতা… ভাবছিলাম, টয়লেটের সিস্টার্ন থেকে যে জলটুকু ভুশ্ করে ঢেলে দেই নোংরা পরিষ্কারের জন্য, সেই জলটুকু কিন্তু নোনা না – মিঠাপানি। আর এই মিঠাপানির জন্যই এতো হাহাকার! থেমে থেমে একটাই কথা বারবার উঁকি দিচ্ছিলো আমার মনে:
“বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন?”
“বানরের পেচ্ছাবইবা বাদ দিচ্ছেন কেন?”