আবার, বারবার নভোথিয়েটার

ভুশ করে অন্ধকার চিরে বেরিয়ে এলো বিশাল গোলকটা। গোল্ডিলক অঞ্চলের এক বাসিন্দা। একটু দূরে যেতেই আমরা তার সূর্যটাকে দেখতে পেলাম। এবারে দেখলাম তার বাসযোগ্য একটা তাপমাত্রা কিভাবে আমরা এই দূর পৃথিবী থেকেই মাপতে পারি… কিন্তু এদিকে যে আমরা দুজন গোল্ডিলক অঞ্চলের বাইরে এসে প্রচণ্ড শ্বৈত্যে জমে যাচ্ছি…

নভোথিয়েটারে গিয়েছিলাম অনেকদিন আগে, মনে পড়ছে না কবে, কিন্তু বছর আটেক হয়ে যাবে নিশ্চিত। আবারও গেলাম সেখানে, এবারে সঙ্গে গিন্নীকে নিয়ে…। কী এই নভোথিয়েটার? কী হয় এখানে? কেন এর জন্ম? দেখার আছে কিছু? …সবই একএক করে জানবো আমরা…।

নভোথিয়েটার অবস্থানগতভাবে ঢাকার তেজগাঁও-এ পড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছেই, আগে যেখানে র‍্যাংগ্‌স ভবন ছিল, সেই মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালে গোলাকৃতি নীল রঙের গম্বুজের যে তিন/চার তলা দালানটা দেখা যাবে, ওটাই নভোথিয়েটার – বিজয় সরণীর সাথেই এটি। টিকেট কাটতে হবে বাইরে থেকেই, কিন্তু টিকেট কাটার আগে জানতে হবে কিজন্য টিকেট কাটবেন। তাই আগে আমরা জানবো কী এই নভোথিয়েটার…

নভোথিয়েটার আসলে বাংলা ‘নভোমণ্ডল’ (মানে ‘আকাশ’) আর ইংরেজি ‘থিয়েটার’ মিলিয়ে বানানো একটা নাম, যা আসলে একটি ‘প্ল্যানেটোরিয়াম’ – থিয়েটারে যেমন নাটক সিনেমা দেখানো হয়, এখানে দেখানো হবে মহাকাশ। বিষয়বস্তু যেমন আলাদা, তেমনি তার হল, হলের সরঞ্জামগুলো তো বেশ অনেকই আলাদা। তাহলে এই নভো-সিনেমাহলে ঢোকার একটা টিকেট কাটতে হবে। এছাড়াও আছে বাড়তি টিকেট কেটে দেখার মতো কিছু আকষর্ণীয় বিষয়, যার মাঝে আছে 5D মুভি, আর ক্যাপসুল রাইড সিম্যুলেটর। এছাড়া আরো অনেক বিষয় আছে, যেগুলোর জন্য আলাদা টিকেট কাটার দরকার নেই।

নভো-সিনেমাহলে ঢোকার টিকেট বর্তমানে (নভেম্বর ২০১৪) ৳১০০ [একশ’ টাকা], 5D মুভির টিকেটমূল্য ৳৫০ [পঞ্চাশ টাকা], আর ক্যাপসুল রাইড সিম্যুলেটর ৳২০ [বিশ টাকা]। যাবেনইতো নভো-সিনেমাহলে কিছু একটা দেখার জন্য, তাই প্রথম টিকেটটা আবশ্যিক। বাকিগুলো আপনার ঐচ্ছিক। নিচের তালিকা থেকে দৈনিক শো’র সময়সূচীটা জেনে নেয়া যাক:

শুক্রবার১০:৩০, ১২:৩০, ২:৩০, ৪:৩০, আর ৬:৩০
বৃহস্পতিবার – মঙ্গলবার১০:০০, ১১:৩০, ২:৩০, ৪:৩০, আর ৬:৩০
বুধবারসাপ্তাহিক ছুটি

আমি যখন গেলাম, তখন সেসময় যে শো চলছে, তার তালিকাটা নভোথিয়েটারের ওয়েবসাইট থেকে জেনে গিয়েছিলাম। সাড়ে ৪টার শো ধরতে পারলাম না বলে সাড়ে ৬টার শো’র টিকেট করে ভিতরে ঢুকলাম। সাথে 5D’র টিকেটটাও কেটে নিলাম। টেলিটক ব্যবহারকারীরা মোবাইলেই টিকেট বুক করে নিতে পারেন, কিন্তু শো শুরু হবার এক ঘন্টা আগে তাদেরকে গেট থেকেই টিকেট সংগ্রহ করে নিতে হবে (বিস্তারিত ওয়েবসাইটে দেখুন)। যাহোক, গেটের ভিতরে যে দৃশ্য, তা রাস্তা থেকেই দেখা যায়, তবু জলহীন ফুয়ারাটা ভিতরে গিয়ে দেখলেই মেজাজটা বিগড়ে যেতে চায়। কিন্তু সামনের ফুল বাগান, গ্রিক স্থাপত্যের আদলে গড়া দালান আর কাঁচের ডোমটা কিছুটা হলেও আহ্বান জানায় ভিতরের আকর্ষণীয় জগতটা দেখে আসবার জন্য।

নভোথিয়েটারে আমরা দুজন (ছবি: স্বয়ংক্রীয়)
নভোথিয়েটারে আমরা দুজন (ছবি: স্বয়ংক্রীয়)

লম্বাটে ঢালের সিঁড়ি দিয়ে এগিয়ে দোতলা দিয়েই ঢুকতে হয়। সেখান দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে গিয়ে দেখা যাবে মহাকাশের কিছু বস্তুর পরিচিতি। একটা বাক্সে সূর্য-পৃথিবী-চাঁদের একটা মডেল আছে, বাইরে থেকে বোতাম টিপলে কাজ করার কথা, কিন্তু বন্ধ আছে। একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের গোলকের ভিতরে পৃথিবীকে দেখা যাবে (Transparent Celestial Globe), বাইরের স্বচ্ছ গোলকটাতে সাদা রঙের ফুটিফুটি। কাছে গেলে বোঝা যাবে এটা আসলে আমাদের মাথার উপরে দেখা আকাশ, আমরা পৃথিবী থেকে আকাশের যেখানটাকে যেভাবে দেখি। …একপাশে একটা ATM মেশিনের মতো বাক্সে তারাদের তুলনামূলক আকার তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ্যে এটা পড়ে কতটুকু কী বুঝবে, জানি না।

মাথার উপরে তাকালে চোখে পড়বে ছাদ থেকে ঝুলে আছে বিশাল আকারের বৃহঃস্পতি, শনি [এমনকি এর বলয়] –এসব বহিঃগ্রহ, আছে পৃথিবী, মঙ্গল – এসব অভ্যন্তরীণ গ্রহও। কিন্তু গ্রহদের সাথে বেমানান প্লুটোটা এখনও ঠিকই ঝুলে আছে – পরিবর্তন আসেনি। কিংবা যোগ হয়নি, সেডনা, সেরেস প্রভৃতি বামন গ্রহ (Minor Planets) – এগুলোও সব নিষ্প্রভ ঝুলে আছে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানকে খানিকটা ব্যঙ্গ করে। মনটাই খারাপ হয়ে যায়।

কিন্তু…

নভোথিয়েটারে লার্জ ফর্মেট ফিল্ম রুম (ছবি: নিশাচর)
নভোথিয়েটারে লার্জ ফর্মেট ফিল্ম রুম (ছবি: নিশাচর)

ধীরে ধীরে সচল কিছু চোখে পড়ে… একটা কাচ ঘেরা ঘরের ভিতর দেখা যায় একটা মেশিন নড়ছে, তাতে একটা ফিতা ঘুরছে… একটা মনিটরে বাতি জ্বলছে, বড় বড় গোলাকৃতি চাকতি নড়ছে – এটা আসলে Astrovision-70 নামক একটা মেশিন, যা মূলত একটা জটিল ধরণের প্রোজেক্টর – লার্জ ফর্মেট ফিল্ম দেখাতে ব্যবহার করা হয়। ভিতরে যা দেখানো হবে, সেখানে এই প্রোজেক্টরটা ১২০° [ডিগ্রি] পর্যন্ত কোণে নড়াচড়া করে দেখাতে সক্ষম। এবারে নিশ্চয়ই একটু সক্রীয় হয়ে উঠবে মন… চলুন ভিতরে যাওয়া যাক-

ভিতরে যাওয়ার আগে মনে করে দেখুন, সিনেমা হলে বেশি দামে কোন সিটগুলো পাওয়া যায়? উত্তর হলো- পিছনের সিটগুলো। এগুলোকে ডিসি বলা হতো। এখানেও কিন্তু বিষয়টা তাই, কিন্তু দুঃখের কিংবা সুখের বিষয় হলো, এখানে সিটের গায়ে সেরকম কোনো তকমা লেখা থাকে না – আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে আপনাকে সিট জুড়ে নিতে হবে। কিন্তু জানাসত্ত্বেয় আগেভাগে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ঘন্টাখানেক আগেই লাইন দাঁড়িয়ে গেছে – সবাই-ই হয়তো আমারই মতো চালাক (অবশ্য আমার থেকেও চালাক এরা)। কী আর করা… প্রায় শেষ ভাগেই ঢুকলাম… টিকিট দেখিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। ভিতরটা কোথায়?

…ঐ যে বাইরে থেকে কাচের যে গম্বুজটা দেখা যায়, সেটার ভিতরে। এখানেই আমাদের তথাকথিত সিনেমাহল (!)। আর-সব সিনেমা হল যেমন থাকে, তেমনটাই – ঢালু করে ধাপে ধাপে বসানো চেয়ারগুলো। আমরা পেলাম প্রায় নিচের সারিতে বামদিকে একটা জায়গা… আমাদেরও পরে যারা এলো, তারা তো একেবারে সামনে… একেবারে নিচে।

সাধারণ সিনেমা হল হয় একটা ঘর, আর এখানে একটা গম্বুজ – মাথার উপরেও গোলাকার ছাদ। সাধারণ সিনেমা হলে সামনে থাকে একটা সমান, সমতল দেয়াল, এখানে পেট ঢোকানো একটা গম্বুজের পেট। সাধারণ সিনেমা হলে পিছনে একটা প্রজেক্টর থেকে সামনের পর্দায় আলো ফেলা হয়, এখানে একটা নয়…

পিছনে সারি করে সাজানো অনেকগুলো ছোট-বড় প্রজেক্টর – এগুলো হলো এক্স-ওয়াই প্রজেক্টর, কাছে এনে, দূরে নিয়ে কোনো কিছু দেখাতে এগুলোর ব্যবহার হয়। আর এগুলোর মাধ্যমেই 3D কোণে কোনো কিছু গম্বুজ স্ক্রিনে (পারফোরেটেড এ্যালুমিনিয়াম পর্দা) দেখানো হয়। এছাড়াও… হলের উপর থেকে নিচের দিকে নামতে থাকলে মাঝখানের আইল বরাবর ঠিক মাঝখানে একটা জায়গা বেরিকেড দেয়া, তার মাঝখানে একটা গোল বল বসানো – দেখতে সাদামাটা হলেও এটা মানুষের বিষ্ময়কর এক আবিষ্কার – এটা প্রজেক্টর, কিন্তু যেনতেন প্রজেক্টর নয়, এটা একটা মহাকাশ প্রজেক্টর (GSS Helios Space Projector), আর এতে আছে ১৫০টি ছোটবড় প্রজেক্টর – এটা নিজের অবস্থানে থেকে ঘুরতেও পারে, আর এটি দিয়ে উপরের গম্বুজে ২৫,০০০ তারা ফুটিয়ে তোলা যায়।

বাতি নিভে গেল, ঘোর অন্ধকার। সাড়ে ৬টার শো ছিল Goodnight Goldilocks। নামটা ইংরেজি, তাই ধারাভাষ্যটা ইংরেজিতেই আশা করছিলাম, কিন্তু বরাবরের মতোই প্রথম শো-টা বাংলাতেই ধারাভাষ্য শোনা গেল – পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর, সম্ভবত বিটিভির সংবাদ পাঠক জায়েদ ইকবালের গলা।

শুরু হলো গল্পের বই দিয়ে… সুন্দর অ্যানিমেশন… গোল্ডিলকের গল্প (The Story of the Three Bears)… গোল্ডিলক এগিয়ে গেল… তিনটে চেয়ার… তার মাঝে একটাই মাত্র সঠিক চেয়ার, সেটাতেই বসলো… আবার এগিয়ে গেল… তিনটে বিছানা… তার মাঝে একটাই মাত্র সঠিক বিছানা… সেটাতেই শু’লো… একটু একঘেয়ে মনে হতে পারে… কিন্তু মজাটা সেখানেই। সাধারণ সিনেমা হলের মতো সিনেমাটা সামনেই শুধু দেখছেন না, দেখছেন চারপাশে – ভুলে যাবেন না, আপনি একটা গম্বুজ সিনেমা-পর্দায় সিনেমা দেখছেন।

গোল্ডিলকের এই গল্পটা নিছকই গল্প বলা নয়, ধীরে ধীরে রাতের কালো গাছগুলো ছাড়িয়ে দৃশ্যটা অবারিত তারার আকাশে উঠে যায়… আপনি হারিয়ে যান অগুণিত, অযুত, নিযুত, অর্বুদ তারার এক বর্ণীল চাদরে… যেনবা আপনি রাতের অন্ধকারে গ্রামের খোলা প্রান্তরে দাঁড়ানো, মাথার উপরে অবারিত আকাশ – আসলে এসব ঐ হেলিয়স প্রজেক্টরের খেলা… সে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

প্রথম শো’র বক্তব্যই হলো মহাকাশের ‘গোল্ডিলক অঞ্চল’। সূর্যের খুব কাছে অনেক তাপ, আবার সূর্য থেকে বেশি দূরে অনেক ঠান্ডা – আর এর মাঝামাঝি একটা অবস্থানই হলো নাতিশীতোষ্ণমণ্ডল – একেই বলা হচ্ছে গোল্ডিলক অঞ্চল। বর্ণনার এক পর্যায়ে আমাদের সৌরজগতের বর্ণনা শেষ হলো, চোখের সামনে বিশাল একটা কালো বস্তু বেরিয়ে এলো… আমি দেখেই চিনলাম – কেপলার। কেপলার^ হলো একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্র যা আমাদের সৌরজগতের বাইরের বসবাস-করা-যেতে-পারে এমন গ্রহের সন্ধান করবে। একসময় আমাদেরকে সৌরজগতের বাইরের সেসব গোল্ডিলক অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া বাসযোগ্য গ্রহগুলোর কয়েকটাকে দেখানো হলো… আমার তো বেশ লাগলো…

কিন্তু যারা মহাকাশ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, ক্লাস এইটের পর মহাকাশ বিষয়ক আর কিছুই পড়েননি, পত্রিকায়ও মহাকাশ বিষয়ক প্রতিবেদন এড়িয়ে চলেন, তারা কতটা বুঝলেন – সেটা একটা প্রশ্ন বটে। পুরো তথ্যচিত্রের বর্ণনাভাষ্যটা তাদের কতটুকু উপযোগী হয়েছে – আমার মনে হয়, ততটা উপযোগী হয়নি। …তবে গম্বুজাকৃতি এই মহাকাশে ডানে-বামে, উপরে-নিচে, সামনে সবদিকে যেভাবে মহাকাশের বস্তুনিচয় ভুশ করে বেরিয়ে বেরিয়ে আসছে তাদের বিশালাকৃতি নিয়ে, তাতে এসব আনকোরাদের খানিকটা হলেও মহাকাশভীতি কাটবে, সে দিব্যি দিয়ে বলা যায়।

মহাকাশের গোল্ডিলক আবার গল্পের বইয়ের গোল্ডিলক হয়েই শেষ হলো… কেমন যেন অকষ্মাৎ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এদিকে যে গোল্ডিলক অঞ্চলের বাইরে আমরা দুজন বসে শ্বৈত্যে জমে যাচ্ছি, সে খবর আর কে রাখে। বামদিকে যেখানটায় বসেছি, শীতাতপের বাতাসটা প্রায় সরাসরি আমাদের গায়েই লাগছে… একেবারে জমে বরফ দুজনে।

প্রথম শো শেষ হতেই বাতি জ্বলে উঠলো… ব্যস, শো শেষ; কয়েকজন উঠে বেরিয়ে যাবার জন্য নিচ অবধি চলে গেলেন। কিন্তু আমরা তো জানি… শো হলো দুটো… অন্ধকার হলো… শুরু হলো দ্বিতীয় শো… “এই আমাদের বাংলাদেশ”।

ঢোকার আগেই এক যুবক বেশ তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুরে দেখায় আধা ঘন্টা… মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছিল – আর কত পঁচানো হবে একজন নেতাকে! শুরু হলো তথ্যচিত্রটা। কিন্তু শুরুতেই মেজাজ খিচড়ে গেল, অন্য কারণে – এটি মোটেই লার্জ ফর্মেট ঘরানার ফিল্ম বললে আমি বিশ্বাস করবো না – কারণ যা দেখানো হচ্ছে, এটা বহু আগে শ্যুট করা ম্যাটম্যাটে হলদে রঙের একটা অতি সাধারণ 2D ভিডিও তথ্যচিত্র, যা এই ত্রিমাত্রিক গম্বুজ পটভূমিতে পড়ার পরেই এমনভাবে ম্যাগনিফাইড হয়ে গেছে, যে একেকটা মানুষকে যখন যুম করা হচ্ছে, মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত পুরো মনিটর জুড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পুরো তথ্যচিত্রই একটা বক্রতলে বেখাপ্পাভাবে ব্যাঁকাত্যাঁড়া হয়ে ছিল, মোটেই ভালো লাগার মতো কোনো কিছু ছিল না।

ধরা যাক, একটা মসজিদ কিংবা মন্দির দেখানো হচ্ছে। মন্দিরের পিলারগুলো কি কখনও একটা বৃত্তের পরিধির মতো বাঁকা থাকবে? না, বরং ওটা একটা সরলরেখার মতো সোজা থাকবে। কিন্তু গম্বুজ তলে ঐ 2D তথ্যচিত্রটার প্রতিটা সরল সোজা জিনিস ব্যাঁকাত্যাঁড়া হয়ে যেভাবে দেখা যাচ্চিল, বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধা যার যতটুকু আছে, ততটুকুও উবে যাবে।

বাইরে থেকে যেভাবে “বঙ্গবন্ধু দেখাবে আধা ঘন্টা” বলে মেজাজ বিগড়ে দেয়া হয়েছিল, বিষয়টা সেরকম না। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের অতীত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ৭ মার্চের ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম..’-এর একটা ছোট্ট ক্লিপ দেখানো হয়; টুঙ্গিপাড়াও দেখিয়ে দেয়া হয় অবশ্য। যাহোক, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সঙ্গীত, ধর্মাচার কিংবা বিভিন্ন ধর্মের মেলবন্ধন – ইত্যাদি দেখিয়ে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার এই তথ্যচিত্রটা এই ত্রিমাত্রিক পটে মোটেই ভালো লাগেনি আমার। এরচেয়ে এ. মাসুদ চৌধুরি পিটু’র করা বাংলাদেশ বিষয়ক বেশ নতুন নতুন তথ্যচিত্র আছে বাংলাদেশে, যেগুলো অনেক আধুনিক (অবশ্য সেগুলোও এই ত্রিমাত্রিক হলের জন্য প্রযোজ্য নয় হয়তো)।

আমার মনে পড়ে, প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম, তখন দ্বিতীয় শো ছিল সমুদ্রের উপর, পুরোটা ইংরেজি একটা তথ্যচিত্র। সেখানে একটা দৃশ্য ছিল এরকম:

ক্যামেরাটা একটা জাহাজের সামনে বসানো, জাহাজটা একটা উত্থাল সমুদ্রে। সামনে থেকে বিশা—ল একটা ঢেউ এগিয়ে আসছে, এই বুঝি ঢেউটা আছড়ে পড়ে জাহাজে… কিন্তু না, জাহাজটা নিয়েই উপরের দিকে উঠে যায় বিশাল ঢেউটা… তখন সামনে দেখা যায় শুধু নীল আকাশ – আর কিচ্ছু না – সমুদ্র উধাও। হঠাৎই ধুপ্‌ করে জাহাজটা আবার আছড়ে পড়ে পানিতে, কারণ ঢেউটা চলে গেছে তলা থেকে আর ছিটকে পড়তে থাকে অবারিত জলরাশি, এবারে শুধু জল, আকাশ উধাও… ৫ সেকেন্ডও যায় না, আবার আরেকটা ঢেউ এগিয়ে আসছে জাহাজের দিকে… দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকি ঢেউটার…

ঐ ত্রিমাত্রিক পটেই আমি ঐ নরম ফোমের সীটে বসে রীতিমতো অনুভব করছিলাম ঐ তীব্র ঝাঁকুনি… অপূর্ব ছিল উত্তাল সমুদ্রে না গিয়েও সেই অভিজ্ঞতাটা।

নভোথিয়েটারের মূল আকর্ষণ শেষ। এদিকে মাগরিবের নামাযের সময় চলে যাচ্ছে। গতবার এসে টয়লেট আর নামাযের বেহাল অবস্থা দেখে গিয়েছিলাম, কিন্তু এবারে সব ঝকঝকে, তকতকে। এবারে ওযুর আলাদা ব্যবস্থা দেখা গেল, নামাযের ঘরে বেতের বেড়া দিয়ে মহিলাদের নামাযের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নামায শেষে গেলাম 5D মুভি থিয়েটারে, তৃতীয় তলায়। সেখানে গিয়ে শুনি বাইরে থেকে ঢুশ, ভুশ, শিইইই, আর মহিলা আর বাচ্চাদের চিৎকার আ আউ! থমকে যেতে হয়। কিন্তু আসলে কিছুই না। ভিতরের রাইডে সবাই এতোটাই মগ্ন যে, থ্রিডির জগতে ডুবে গিয়ে ভীত হচ্ছে সবাই। বাচ্চারা বেরিয়ে এলো অবাক বিষ্ময় নিয়ে।

আমরা ঢুকলাম। অন্ধকার ঘরে কিছু চেয়ার পাতা, সামনে একটা মনিটর ঝুলছে দেয়ালে। আমাদেরকে দেয়া হলো থ্রিডি চশমা। বাইরে 5D লেখা থাকলেও এটা যে আসলে ত্রিডিই, সেটা তো আমি জানি। তার উপর ভিতরের স্ক্রিনে লেখা দেখি Cinema 6D। মাথানষ্ট নাকি এদের! এইতো সেদিন একটা আর্টিক্যাল পড়েছি যার শিরোনাম, ‘এবার হয়তো 4D বলার সময় এসেছে’। অথচ এরা ইচ্ছামতো ডি (D for Dimension বা মাত্রা) বসিয়ে মশকরা করছে নাকি?

6D সিনেমার নাম করে থ্রিডি মুভি দেখানো (ছবি: নিশাচর)
6D সিনেমার নাম করে থ্রিডি মুভি দেখানো (ছবি: নিশাচর)

চেয়ারে বসা হলেও কোনো সিটবেল্ট বাঁধার ব্যবস্থা নেই। চোখে থ্রিডি চশমা লাগিয়ে আমরা শো দেখতে বসে গেলাম, গিন্নীকে সাহস দিলাম: ভয় পাবার কিছু নেই। দেখানো হলো ভৌতিক একটা থ্রিডি এনিমেশন, যেখানে যম্বিরা (Zombie – কল্পিত রক্তচোষা পিশাচবিশেষ) এগিয়ে আসছে আপনার দিকে করাত নিয়ে, মাকড়শা কিংবা মাকড়শার দল এগিয়ে আসছে কিলবিল করে (কারো আরকানোফোবিয়া বা মাকড়সাভীতি থাকলে নিশ্চিত সে হার্টফেল করবে, অথচ ঢোকার আগে এধরণের কোনো সতর্কবার্তা ছিল না)। মজার ব্যাপার হলো থ্রিডি চশমার কারণে ক্যামেরার দিকে বাড়িয়ে দেয়া মাকড়সার আঁকশিটা আপনি দেখবেন আপনার মুখের কাছে চলে এসেছে। এছাড়া দৃশ্যের সাথে সাথে কখনও চেয়ারগুলো নড়েচড়ে আপনাকে বিষয়টা অনুভব করানোর চেষ্টা করছে। বড় মাকড়শাটা যখন মুখ থেকে পিচ্ছিল আঁঠালো কিছু ছেড়ে দিচ্ছে (হাতে নিয়ে দেখেছিলাম নাকি পিচ্ছিল না থকথকে?), তখন সামনে কোথাও থেকে আসলেই সামান্য পানি তীব্র বেগে আপনার গলার একটু নিচে ভিজিয়ে দেবে, তখন আপনি আরো রোমাঞ্চিত হবেন। বাঁদুড়গুলো উড়ে যখন আপনার দিকে আসছে, তখন হঠাৎ সীটের নিচ থেকে আপনার পায়ে বাতাসের ফ্লো কিংবা তুলার বল কিছু একটা আঘাত করতে থাকবে, মনে হবে সত্যিই বুঝি বাঁদুড় উড়ে গেলো পায়ের নিচ দিয়ে। বাচ্চারা তো ভয়ে চিৎকার দেয়। আমি মাঝখানে একবার থ্রিডি চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে বাস্তবতা আর দেখা বিষয়ের ফারাকটা বুঝে নিলাম। আমার গিন্নী বেশ মজা পেয়েছেন। আর বাচ্চারা ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বেরোল।

আমি বিষয়টাতে তেমন একটা রোমাঞ্চিত হইনি। কারণ:

  1. এখানে সিটগুলো প্রায় সমতল। ফলে পর্দার দৃশ্যের দিকে চোখ থাকলেও সামনের সিটের পিছনটা আপনার দৃষ্টিসীমায় থাকবে, ফলে আপনি পর্দার দৃশ্যপটে হারিয়ে যেতে পারবেন না, মজাও কমে আসবে।
  2. সীট নাড়ানোর জন্য হাইড্রোলিক পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে, ভালো কথা, কিন্তু সেগুলো সীট নড়াচড়ার সাথে এতো জোরে জোরে ভুশ ভুশ, ফুশ ফুশ করে যে, দৃশ্যপটে মনকে হারিয়ে যেতে দেয় না। তাছাড়া কানে কোনো হেডফোনেরও ব্যবস্থা নেই।
  3. এটা একটা প্ল্যানেটোরিয়াম, শুদ্ধ বিজ্ঞান অর্থাৎ মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র, এখানে আপাত অবৈজ্ঞানিক ভুত কিংবা যম্বির মতো কাল্পনিক চরিত্রের একটা এনিমেশন দিয়ে কি বিজ্ঞানকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে?

যাহোক, নভোথিয়েটারে আমাদের ভ্রমণ-আনন্দ শেষ।

সেদিন ক্যাপসুল রাইড সিমুলেটরটা বন্ধ ছিল, ওটা নাকি আরো সুন্দর (যারা দেখেছে তাদের ভাষ্য)। সেখানে একটা গাড়ি কিংবা ক্যাপসুলে করে মিশর ভ্রমণ ইত্যাদি বেশ রোমাঞ্চ করে দেখায়। ক্যাপসুলটাও নড়েচড়ে বিষয়টাকে আরো বাস্তব করে তোলে। ওয়েবসাইট বলছে ভিতরে ২০জনের আসন আছে, টিকেট জনপ্রতি ৳২০[বিশ টাকা]।

এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন প্রদর্শনী হলে তাও দেখার সুযোগ তো থাকছেই। আমি যেবার প্রথম গিয়েছিলাম, সেবার আন্ডারগ্রাউন্ডে কম্পিউটার মেলা দেখেছিলাম; আবার বাইরে বের হয়ে রাতের আকাশে লেযার প্রদর্শনী দেখেছিলাম। ভালো লাগুক চাই না লাগুক, নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা নেয়াটাইতো অনেক কিছু। আবার একটা শো দেখেই ফিরতে হবে এমনটা নয়, প্রতি দেড় ঘন্টায় শো পরিবর্তন হয়, তাই শো’র তালিকা দেখে নিয়ে সবগুলোর টিকেট কিনে একটার পর একটা দেখে যেতে পারেন আপনি।

নভোথিয়েটার কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান, এটি পরিচালনার জন্য একটা আলাদা আইনই আছে: “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার আইন ২০১০^”, অর্থাৎ বুঝাই যাচ্ছে, এটি সংবিধানসিদ্ধ একটি সংস্থা। নিয়ম মানলে এখানে যা যা থাকার কথা:

  1. মহাকাশ বিষয়ক প্রদর্শনী (Astrovision Show, Film)
  2. জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা, সেমিনার, সিম্পোযিয়াম আয়োজন
  3. জ্যোতির্বিজ্ঞান পাঠাগার
  4. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সম্পর্ক তৈরি করে দেয়া
  5. স্পেস রাইড সিমুলেটর, থ্রি-ডি মুভি

আইন অনুযায়ী এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাধারণ্যের সেবা করতে বাধ্য, কারণ Penal Code^ (Act XLV of 1860)-এর ধারা ২১-এর বর্ণনানুসারে এরা Public Servant (জনসেবক)। এখানে অডিটরিয়াম, কনফারেন্স কক্ষ ভাড়া নেয়াও যায়।

যা-ই হোক, মহাকাশ জানি আর না-ইবা জানি, বুঝি আর না-ইবা বুঝি, নভোথিয়েটার এই দুই অবস্থার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে জ্ঞানের পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে দেয়ার এক অপূর্ব সুযোগ। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে খুব অল্প খরচে এর সুবিধা ভোগ করা যাচ্ছে – এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। সবচেয়ে বড় কথা, সিনেমা দেখতে গেলে বুঝেশুনে যেতে হয়, পরিবার নিয়ে উপভোগ করা যাবে কি যাবে না; কিন্তু নভোথিয়েটার এমন একটা জায়গা, যেখানে বন্ধুরা, ছাত্র-শিক্ষকগণ, গবেষকগণ, পরিবার নিয়েও বাছবিচার না করেই উপভোগ করতে চলে যাওয়া যায়।

বাসায় ফেরার সময় গিন্নীকে জিজ্ঞেস করলাম, কী বুঝলে? উত্তর এলো: ‘এইতো মহাকাশ’। 🙂 ব্যস, এটুকুই কি যথেষ্ট নয় – ‘আকাশ’-কে একজন মানুষ আজকে ‘মহাকাশ’ বলতে শিখেছে এটা কি কম গর্বের কথা? সবাই তো আর মহাকাশবিজ্ঞানী হবে না।

তাই নভোথিয়েটার, যাবো আমি বারবার…।

-মঈনুল ইসলাম

দ্রষ্টব্য: যাবার আগে নভোথিয়েটারের ওয়েবসাইট (novotheatre.gov.bd) থেকে সাম্প্রতিক তথ্য জেনে যাবার অনুরোধ থাকলো।

কৃতজ্ঞতা:

প্রচ্ছদের ছবি উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে নেয়া। আলোকচিত্রী নাহিদ সুলতানের কৃতজ্ঞতা স্মরণ করছি। তিনি একজন উইকিপিডিয়ানও।

২ thoughts on “আবার, বারবার নভোথিয়েটার

  1. নভোথিয়েটার আমার বাড়ির কাছে। বেশ কয়েক বার গেছি। কিন্তু এত সুন্দর করে সাবলীল বর্ণনা, বিস্তারিত তথ্য আর কেউ দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*