কতজন যে যাবে তার ইয়ত্তা নেই। যাকেই বলি, সে-ই যেন যাবে। শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো পুরো একটা গ্রামই কি যাচ্ছি নাকি? কিন্তু সব ট্যুরেই যা হয় আরকি, শেষ খেলায় থাকে হাতে গোণা ক’জন। প্ল্যানটা হলো বান্দবানের নীলগিরি আর বগা লেক (বগাকাইন হ্রদ) ভ্রমণ। বন্ধু সাকিব আর সাজ্জাদের কাছে বগা লেক-কীর্তণ শুনতে শুনতে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। সাকিব বলে দিলো আদ্যোপান্ত। সে হিসেবেই গুগল ম্যাপ্স ঘেঁটে প্ল্যানটা সাজালাম আমি। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। ২ জুলাই রাতে ট্রেনে ওঠার পরিকল্পনা করলাম। এতে ৩ তারিখ ভোরে চট্টগ্রাম, তারপর সেখান থেকে বান্দরবান। বান্দরবান শহরে একরাত থাকা। বন্ধু নাকিব আর [তার মামাতো ভাই] শাকিল যাবে পরদিন সরাসরি বান্দরবান, তাদেরকে নিয়ে রওয়ানা করবো বগা লেকের উদ্দেশ্যে। সেখানে একরাত থেকে পরদিন ফিরবো আবার, সরাসরি উঠবো নীলগিরিতে। সেখানে একরাত থেকে পরদিন ভোরে রওয়ানা হবো আবার চট্টগ্রামে, ফের ট্রেনযোগে ঢাকা ফেরত। প্ল্যানটা বেশ গোছানো এবং সব ঠিকঠাকমতো হলে আমরা ৬ তারিখ ঢাকা ফেরত আসতে পারবো।
প্ল্যান করার জন্য ওয়েবসাইট ঘেঁটে বান্দরবানের এক সপ্তাহের অগ্রিম ওয়েদার আপডেট নিয়ে নিলাম। আবহাওয়ার অগ্রিম খবর অনুযায়ী প্রতিদিনই বৃষ্টি ও বৃষ্টিঝড় থাকার সম্ভাবনা গড়ে ৩০%। তাপমাত্রার গড় ৩৪ ডিগ্রি (যদিও অনুভূত তাপমাত্রা হবে গড়ে ৪০ ডিগ্রি)।বৃষ্টিময় এই সময় তাই সবাই-ই ট্যুরের ব্যাপারে একটু সন্দিহানও ছিলাম। এছাড়া যেখান থেকে পারলাম বান্দরবানের খুঁটিনাটি মানচিত্র তৈরি করে নিলাম। সাকিব জানিয়ে দিলো: বগা লেক ট্যুরে বড় বোতলে ২ লিটার পানি, লাঠির মাথায় একটা কাপড়ে প্যাঁচিয়ে লবণ (জোঁক ছাড়ানোর জন্য), মশা ও ক্ষতিকর পোকা তাড়াতে ওডোমোস ক্রিম, আর মুখে রস জোগাতে ক্যাডবেরি চকলেট নিয়ে নিতে। সবই ঠিকমতো ছিল, কিন্তু…
কিন্তু প্ল্যান ঠিকমতো চললো না: শুরুতেই বাগড়া দিলো ট্রেন। ট্রেনের টিকেট মিললো না ২ তারিখের তূর্ণা এক্সপ্রেসের। এক সপ্তাহের টিকেট নাকি নেই। এবারে প্ল্যান বি: বাসের টিকেট করলাম ২টা: ইউনিক বাস, সরাসরি যাবে চট্টগ্রামে (জনপ্রতি ৳৩৫০)। আমরা সরাসরি বান্দরবান গেলেও পারতাম, কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে আমাদের সাথে যোগ দিবে আরো ক’জন, তাই চট্টগ্রামে যাওয়াই ঠিক করলাম। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে ২ তারিখ রাত ১১টার বাসে রওয়ানা করলাম আমি আর আমার বন্ধু ইফতি (হলি)। বাসের অবস্থা ঠিক ভালো না। হাতল ভাঙা, জানালাটা একটা পরপর হড়কে খুলে গিয়ে বৃষ্টিস্নাত ঠান্ডা বাতাসে কাবু করে ফেলছে। এভাবেই ভোর সাড়ে ৬টার দিকে পৌঁছলাম চট্টগ্রামে। সেখানে আমাদের সাথে যোগ দিতে সিলেট থেকে বাসযোগে আসছে আমার ফুফাতো ভাই আর তার দুই বন্ধু; চট্টগ্রামে ব্যাংকে চাকরি করে আমার বন্ধু নিঝু, সেও যোগ দিবে; আরো যোগ দিবে ইফতি’র এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাযিন। শেষ পর্যন্ত নিঝু ব্যাংক থেকে ছুটি পায়নি, আর ওদিকে আমার ফুফাতো ভাই শাকির নিয়ে এসেছে তিন বন্ধুকে। আমরা সবাই চট্টগ্রাম বহদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডে মিলিত হলাম আলাদা আলাদাভাবে।
আমাদের সাতজনের টীম (আমি, [বন্ধু] ইফতি, [ইফতির কাযিন] প্রিয়ম, [আমার কাযিন] শাকির, [শাকিরের বন্ধু] আব্দুল্লাহ, ফয়সল এবং ফরহাদ) বাসের টিকেট করলাম পূরবীর (জনপ্রতি ৳৮০)। বান্দরবান পৌঁছালাম দুপুর ১২টার দিকে। রোদ যদি সরাসরি গায়ে এসে লাগে তো মনে হয় পুড়িয়ে দিয়ে যাবে, বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও দেখলাম না কোথাও।
বান্দরবানে এর আগেও একবার ট্যুর দিয়েছিলাম ২০০৮-এ (২০০৮ ট্যুর বৃত্তান্ত)। সেবার যে হোটেলে থেকেছিলাম সঙ্গীদের সবাইকে সেই হোটেলে নিয়ে গেলাম: হোটেল গ্রীণ হিল। বাস থেকে নামতেই দেখি মাহিন্দ্র বেবি টেক্সি দাঁড়িয়ে আছে, প্রেসক্লাব পর্যন্ত জনপ্রতি ৳৫ করে নিলো। ট্যুরে আমি প্রথম যে নিয়ম মেনে চলি, সেটা হলো”খরচ কমাও”। গ্রীণ হিলে খরচ কম হলেও হোটেলের ভিতরের চেহারা যখন সবাই দেখলো, তখন কারোরই পছন্দ হলো না: খরচ বাঁচানোর পরিকল্পনায় প্রথম ধাক্কা খেলাম আমার টীমমেটদের পক্ষ থেকে। অগত্যা আরেকটু ভালো হোটেলের সন্ধানে বেরোতে হলো।
পূরবী বাসে আসতে ইফতি’র পাশে বসেছিলো এক যুবক। সে পরিচয় দিয়েছে সে হোটেল ফোর স্টার-এর মালিক। তার হোটেলে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইফতিকে, ফোন নম্বরও দিয়েছে। ভালো হোটেল খুঁজতে গিয়ে ফোর স্টার পেয়ে গেলাম। সেখানে রুমভাড়া বেশি, তবে চেহারা দেখে টীমমেটদের পছন্দ হয়ে গেল। যখন ইফতি মালিকের রেফারেন্স দিলো, তখন ম্যানেজার হোটেল ভাড়া আরো কমিয়ে অফার করলেন। ব্যস, আমাদের দুটো ডাবল রুম বুক করা হলো একরাতের জন্য অগ্রিম ভাড়া (রুমপ্রতি ৳৭০০) দিয়ে। রুম বুক করার পর শাকির আর তার তিন বন্ধু মিলে নিলো একটা, আমি-ইফতি-প্রিয়ম নিলাম আরেকটা। শুরুতেই গোসল করতে গেলাম, কিন্তু গোসলের পানি দেখে তো মেজাজ খারাপ: একেবারে কাদাগোলা পানি। তারপরও সেই পানি দিয়েই গোসল সেরে জুমার নামাযে রওয়ানা করলাম। শুরুতেই দলে বিভাজন পড়ে গেলো: শাকিরের তিন বন্ধু নামাযে যাবে না। অগত্যা আমরা চারজনই গেলাম। জুমার নামায পড়তে গিয়ে বান্দরবান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ দেখেতো চক্ষু চড়কগাছ। এতো বড় মসজিদ, তারউপর ঠান্ডা একটা মসজিদ। মসজিদের ইন্টেরিয়রে একটা বিষয় নজর কাড়লো: কয়েক সারি পরপরই রটের তৈরিজুতা রাখার র্যাক, চার তাকের র্যাকটির পঞ্চম তাকটিতে রাখা প্লাস্টিকের টুপি, তার উপরে একটা স্ট্যান্ডে একটা করে টাওয়্যাল ঝোলানো, যাতে ওযু করে মুখ মোছা যায়। পরিকল্পনাটা ভালোই লাগলো।
মসজিদের বয়ান থেকে পাহাড়ি-বাঙালি রেষারেষির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েই ফুটে উঠলো (পাহাড়ি-বাঙ্গালি সম্পর্ক বিষয়ে আমার মত)। ইমাম সাহেব জানালেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নাকি জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীকে বাংলাদেশে আনার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সরকার, অথচ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পুরষ্কারপ্রাপ্ত। কথাটার সত্যতা যাচাই করার উপায় ছিল না, তবে শুনে রাখলাম। বয়ানের মূল বিষয়বস্তু ছিল নিয়্যত: সমাজ নেতারা জনসেবা করছেন, কিন্তু তাদের নিয়ত আল্লাহমুখী না, যদি তা হতো, তাহলে তাঁরাও নামায-রোযার মতো ইসলামিক কাজের মর্যাদা পেতেন তাঁদের জনসেবার কাজে। এই বয়ানের কারণ হলো আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন: সারাদেশের মতো বান্দরবানেও লেগেছে নির্বাচনের হাওয়া।
নামায শেষে সবাই-ই প্রচণ্ড ক্ষিধা অনুভব করলাম, কিন্তু হোটেলে গিয়ে আবিষ্কার করলাম শাকিরের তিন বন্ধু আমাদেরকে রেখেই খেয়ে নিয়েছে। ফোর স্টারের দোতলায় একটা হোটেলে ২০০৮-এ খেয়েছিলাম, তাই সেখানেই চেষ্টা করলাম, কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষুধা থাকাসত্ত্বেয় খাবার মজা লাগলো না, আশা করি বুঝতেই পারছেন খাবার কতটা জঘন্য ছিল। খাবার বিল গেলো চারজনে জনপ্রতি ৳৭০।
যাবতীয় ব্যয় বহন করছে ইফতি, রাতে আমরা সেগুলো হিসাব-নিকাশ করে যার-যার ব্যয়র্থ ইফতিকে ফিরিয়ে দিব। একহাতে খরচ হলে হিসাব পাওয়া সহজ হয় -এটাও ট্যুরের আরেকটা নিয়ম:”একহাতে খরচ করো”।
আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজকের দিনটা আমরা বান্দরবান সদরে আছি, সুতরাং আমি যেহেতু আগে একবার এসেছি, নতুন সবাইকে বান্দরবান সদরের স্পটগুলোতে ঘুরিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমার। পরিকল্পনামতো ঠিক করলাম সময় নষ্ট করা যাবে না, দশ মিনিটের বিশ্রাম শেষে তাই সবাইকে নিয়ে জোর করে বেরিয়ে পড়লাম (যদিও শাকিরের বন্ধুরা একটু বিশ্রাম করতে চাইছিল) বালাঘাটা বৌদ্ধ মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
বালাঘাটা বৌদ্ধ ধাতু জাদি
বান্দরবান সদর মোড় থেকে মাহিন্দ্র বেবিটেক্সি ঠিক করলাম। একেবারে বৌদ্ধ মন্দিরের গোড়ায় নিয়ে যাবে, খরচ পড়বে ৳১৪০, সাতজন একসাথে, তাই কনসেশন করে এলো ৳১২০-এ। বৌদ্ধ মন্দির আগেই ২০০৮-এ দেখেছিলাম, তবে ভিতরে যেতে পারিনি, এবার গিয়ে যখন ভিতরে ঢুকতে গেলাম, তখন দেখা গেলো জনপ্রতি টিকেট করতে হবে ৳১০ দিয়ে। আমি আপত্তি করছিলাম, “আগে তো ছিল না”, তখন এক বৌদ্ধ ছাত্র আমাকে বললো, “আপনিওতো আগে এরকম [এখনকার মতো] ছিলেন না।” কী আর করা, টিকেট করে মন্দিরের উপরে উঠলাম। মন্দিরের বর্ণনা আগেও দিয়েছি, তাই আবার দিচ্ছি না। নতুন যা দেখলাম তা-ই বলি: বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু বৌদ্ধ মূর্তি এই জাদিতে পাঠানো হয়েছে, সেগুলো শোভা পাচ্ছে মন্দিরের প্রতিটা খাঁজে। প্রতিটা বৌদ্ধমূর্তি পদ্মের আসনে দণ্ডায়মান এবং সেগুলোর সামনে প্লেকার্ডে দেশের নাম লেখা আছে, কত শতাব্দে সেগুলো দেয়া হয়েছে, তার সালোল্লেখ আছে। যেমন: জাপান (৮ শতাব্দি), আরাকান (৪-৯ শতাব্দি), মিয়ানমার (১৭ শতাব্দি), আফগানিস্তান (২-৪ শতাব্দি), কোরিয়া (৮ শতাব্দি), চীন (৭-৯ শতাব্দি), ভিয়েতনাম (৫-৬ শতাব্দি), থাইল্যান্ড (১৩-১৫ শতাব্দি), ইন্দোনেশিয়া (৮ শতাব্দি), লাওস (১৭ শতাব্দি), কম্বোডিয়া (১২ শতাব্দি), শ্রীলঙ্কা (৫ শতাব্দি), বাংলাদেশ (৭-৯ শতাব্দি)। তবে সালের এই এতো প্রাচীনত্ব দেখে অনুমিত হয়, এগুলো এতো আগের মূর্তি নয়, বরং এগুলো ঐ সময়কার মূর্তির সাংস্কৃতিক আদল-মাত্র। প্রতিটা মূর্তিই আলাদা আলাদা মুদ্রায় বিধৃত: কোনোটা অভয় মুদ্রায়, কোনোটা তর্পণ (তৃপ্তিসাধন) মুদ্রায় ইত্যাদি। প্রতিটা মূর্তির পায়ের কাছে একটা করে আধা লিটার পানির বোতল, হয়তো মূর্তির প্রতি অর্ঘ্য।
মন্দিরের গায়ে যখন এই দণ্ডায়মান মূর্তিগুলো সাঁটা, তখন বেদির সামনে বসানো কয়েকটি ছাতা-আচ্ছাদিত বসা-মূর্তি -এগুলোও বুদ্ধেরই মূর্তি, সম্ভবত শ্বেত পাথরের। প্রতিটা মূর্তির নাম লেখা রয়েছে ছাতার দণ্ডে: বুধ ১, বুধ ২, বৃহস্পতি, বৃহস্পতি ২, শুক্র-১, শুক্র-২, শনি, রবি (সূর্য), সোম-১ (চাঁদ), সোম-২, মঙ্গল, এবং রাহু। প্রতিটা মূর্তির আসনের সামনে মেঝেতে একটা উপ-বেদীতে কিছু প্রাণীর মূর্তি। যেমন: বৃহস্পতি ১ ও ২, শুক্র ১ ও ২-এর সামনে একটা খরগোশ কিংবা ইঁদুর (ঠিক ঠাহর করতে পারিনি), শনির সামনে নাগিন, রাহুর সামনে কালো হাতি, রবির সামনে গণেশাকৃতি মূর্তি, সোম ১ ও ২-এর সামনে ডোরা কাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মঙ্গলের সামনে সিংহসদৃশ মিথিকাল চরিত্র, বুধ ১ ও ২-এর সামনে শ্বেত হাতি। সম্ভবত এগুলো বুদ্ধের আলাদা আলাদা বাহন বোঝাচ্ছে।
মন্দিরের পিছনের দিকে একটা ঘণ্টা শোভা পাচ্ছে, যা অলঙ্কৃত এক সোনালি ড্রাগন-স্তম্ভের মধ্যে ঝোলানো। ঘণ্টার গায়ে খোদাই করা লেখা থেকে জানা যায় ঘণ্টাটি দান করেছিলেন, Takhon Timber Merchant, Yangon। আরেক পাশে বর্মী ভাষায় একই কথা লেখা ঠিকানাসহ।
দুপুরের প্রচণ্ড খাড়া রোদে মন্দিরের মেঝে উত্তপ্ত বালুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে আছে, তার উপর জুতা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। সবারই ত্রাহী অবস্থা। আমার হাঁটা-চলা একটু বেশি, পায়ের তলা শক্ত, আমারও কষ্ট হচ্ছিলো ঐ প্রচণ্ড রৌদ্রতপ্ত মেঝেতে হাঁটতে। যাহোক সবাই-ই মনমতো ছবি তুললো। সবাইকে একটু সুযোগ দিলাম, যাতে বিশ্রাম নিতে পারে, আর রোদও একটু কমে আসে। কারণ এর পরের যাত্রা হবে মেঘলা পার্কের উদ্দেশ্যে।
পুরোদমে ট্যুরিস্ট-মার্কা একটা পরিকল্পনা তখনও পর্যন্ত চলছিল, কারণ ঐদিনই আমরা নাকিব আর শাকিলকে রেখে বগা লেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে পারছিলাম না। মন্দির চূড়া থেকে নেমে এসে ২০০৮-এর মতো পাশের আরেকটা চূঁড়ায় ওঠার পরিকল্পনা নিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি সেই পথটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবাই-ই আমার কাজেকর্মে একটু বিরক্ত হলো, কারণ আমি তাদেরকে অতিরিক্ত কষ্ট করাচ্ছি- পাহাড়ে চড়াচ্ছি, আবার নামাচ্ছি। মনে মনে একটু সন্দিহান হলাম আমার টিমমেটদের ব্যাপারে, এদেরকে নিয়ে বগা লেকে ট্যুর দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? এরা কি পারবে ওতোগুলো চড়াই উৎরাই পার হতে? পারবে পিচ্ছিল রাস্তায় জোঁকের কষ্ট সহ্য করতে? পারবে মশা-মাছির কামড় সহ্য করতে? আমার মনে হলো না।
মেঘলা পর্যটন স্পট
যাহোক, যে মাহিন্দ্রতে করে মন্দিরে গিয়েছিলাম, সেটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সে নাকি আমাদেরকে বহন করলে যে ভালো এ্যামাউন্ট পাবে, তা সাধারণভাবে পাবে না। তার সাথে মেঘলা পর্যন্ত কত নিবে তা ঠিক করা হলো: সাকুল্যে ৳২২০ টাকা। সেখানে গিয়ে দেখি সেখানকার টিকেটের দামও বেড়ে গেছে (জনপ্রতি ৳২০)। ভিতরে সেই আগেরই দৃশ্য। ছবি তুললাম, লেকের পানিতে ওযু করে আসরের নামায সারলাম। এমন সময় ফরহাদ জানালো ওর মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে। মহা গ্যাঞ্জাম! অবশেষে সেটা পাওয়া গেলো সেই মাহিন্দ্র’র ড্রাইভারের কাছে। ব্যস, ওরা তিনজন পিছনে হটলো। আমি, শাকির, ইফতি আর প্রিয়ম হাঁটলাম, ছবি তুললাম।
মেঘলা’র ভিতরের এই রাস্তাটা আমায় পাগল করে ছেড়েছে। [ছবি: লেখক]মেঘলা থেকে বেরিয়ে এলাম সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। আমাদের আগের মাহিন্দ্র চলে গেছে। অন্য আরেকটা মাহিন্দ্র বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আমি তাতে চড়তে অস্বীকৃতি জানালাম, কারণ খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ এগিয়ে এলো একটা জিপ-পিকাপ। সেটার পিছনের হুড খোলা। জনপ্রতি ৳১০ করে নিবে সদরে পৌঁছে দিতে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লো সবাই। তারপর উপরের রডের বাইরে মাথা বের করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম সবাই। আর গাড়ির ড্রাইভারও শুরু করলো রোলার কোস্টার চালানো। বান্দরবানের রাস্তা এমনিতেই চরম আঁকাবাঁকা, তার উপর চড়াই-উৎরাই, কিন্তু কোনো বাঁক পেরোতেই ড্রাইভার গতি কমাচ্ছে না, ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে চাকা বাঁক নিচ্ছে প্রতিটা মোড়ে, আমাদের জান তখন যেন হাতে চলে আসছে। তবে প্রচণ্ড বাতাসের তোড়ে সবাই-ই এই যাত্রা উপভোগ করছি।বান্দরবান সদরে ফিরে মসজিদে মাগরিবের নামায পড়লাম, তারপর একটা হোটেলে খাঁটি গরুর দুধ খেলাম। হোটেলে ফিরে আর ক্লান্তি ধরে রাখতে পারলাম না, গোসল করার আগেই চোখ ঘুমে বুজে এলো। শাকিররা ওদিকে মাহিন্দ্র’র ঐ চালকের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা উদ্ধার করেছে -বেচারা ওটা গাপ করে দেয়নি, এটাই ফরহাদের সাত জনমের ভাগ্য। হয়তো লোকটা ভালোই ছিল। সেদিনের যাবতীয় খরচের হিসাব সারলাম আমরা। রাতে গোসল করে ভাই ভাই হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেলাম। এখানে খাবারের মান কিছুটা ভালো। তারপর হোটেলে ফিরে পরদিনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকলাম।তখন নিজের কাছে কঠিন প্রশ্ন এসে দানা বাঁধলো: বগা লেক কি যাবো আমরা?
আসসালামু আলাইকুম।
ভাই, তুমি আমাকে বহুদিন আগে একটা কথা বলেছিলে বান্দরবান থেকে এসে:
পাহাড়িরা আসলে যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। মানুষ মনে করে উল্টো। সরকার তাদেরকে পাহাড় ধ্বংসের জন্য দায়ী করে, আসলে তারা আরো ভালো জানে কিভাবে পাহাড়কে রক্ষা করতে হয়।
এই কথার সাথে আরেকটা কথা বলেছিলে:
পাহাড়িরা খুব বন্ধু-বৎসল। তাদেরকে যতটা খারাপ মনে করা হয় ততটা না।
কথা দুটো হুবহু তোমার কথা না হয়তো, কথার নির্যাস। কথাদুটো আমি খুব মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে চেয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো কারণে আমি ঠিক সেটা আর বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি পাহাড়িরা আমাদের থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব। তবে সম্পূর্ণ না। কারণ:
বান্দরবান গিয়ে আমি এক বাঙালির সাথে পরিচিত হই, নাম: গোলাম কবির চৌধুরী (৩৪)। তিনি আমাদেরকে বললেন পাহাড়িদের সাথে তাঁর যুদ্ধের কথা। তিনি বান্দরবানে বাঙালির আধিপত্য বিস্তারে সংগ্রাম করছেন। তিনি তো ইংরেজিতে এককথায় বললেন: “They are very inferior to the wild beast”। জানালেন পাহাড়িরা তাঁর অধীনে কাজ করতো, তিনি তাদের ভরণপোষণ দিতেন, তাদের সন্তানাদির লেখাপড়ার খরচ বহন করতেন, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর ক্ষতি করে পালায়। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে তিনিও তোমার-আমার মতো একজন বাঙালি, তাই পাহাড়িদের প্রতি স্বভাবতই তাঁর নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ। তিনি হয়তো যতটা মমতার কথা বলছেন, তার তিনগুণ অবহেলা দেখিয়েছেন তাদের প্রতি। হয়তো পাহাড়িদের এলাকায় বসতি করতে চাচ্ছেন বলে তারাও রিভেঞ্জ করছে… কিন্তু তারপরও কথা থাকে, তিনি যা বলছেন, তার সব মিথ্যা হতে পারে না। পাহাড়িরা সত্যিই হয়তো এর ১০% করে।
আমার সিলেট এলাকায় খাসিয়ারা বাস করে। মাধবকুন্ডের থেকে আমার বাড়ি খুব বেশি দূরে না। তাই খাসিয়াদের সাথে বাঙালিদের চলাফেরার কাহিনী আমি কম-বেশি শুনেছি। খাসিয়াদের সম্বন্ধে বাঙালিদের সাধারণ যেই মত, তাতে তাদেরকে ডেপিক্ট করা হয় বড় রাম দা হাতে একদল ডাকাত হিসেবে। তাদের মাথা গরম হলেই নাকি তারা রাম দা বাগিয়ে এগিয়ে আসে। এরকম বহু কথা শুনেছি বহুজনের থেকে। যদিও আমার, তাদের সাথে ইন্টার-একশান তেমন একটা হয়নি, টুকটাক। নিরপেক্ষভাবে দেখলে, হয়তো বাঙালিরা পাহাড়িদের এলাকায় গিয়ে দখলদারিত্ব চালায়, তাই তারা ফেরোশাস হয়ে আক্রমণ করে… কিন্তু তারপরও তারা যে ১০% সত্যিই অন্যায়ভাবে করে না, তা-ও আমি উড়িয়ে দিতে পারছি না।
তুমি যদি আমার বাড়িতে মেহমান হয়ে আসো, তাহলে আমি তোমাকে খাতির-যত্ন করবো, আমি যত খারাপ লোকই হই না কেন, আমি চেষ্টা করবো ফেরেশতা সেজে তোমার সেবা করতে। তাহলে তুমি যখন তোমার বাড়ি যাবে, তখন বলবে, আমি যে বাসায় ছিলাম, সে বাসার লোক ফেরেশতার মতো মানুষ। কিন্তু ধরে নাও আদতে আমি একটা খুনি। …তোমরা ট্রেকিং-এ গিয়ে হয়তো তাদের ভালো রূপটা দেখো ক্ষণিকের জন্য, কিন্তু সেটা সত্যি রূপ না। …কারণ, গ্রামের মানুষকে সবাই বড় আত্মার মানুষ বলে, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে না, মসজিদকেন্দ্রীক কোন্দল, জমিকেন্দ্রীক কোন্দল, এলাকাভিত্তিক কোন্দল শহরের চেয়ে গ্রামে বহুগুণ বেশি। আমার কাছে যদিও স্ট্যাটিস্টিক্স নাই। …তারপরও কিন্তু তোমার-আমার মতো শহুরেদের কাছে গ্রামের মানুষের মতো বড় আত্মার মানুষ আর হয় না।
রাঙামাটি ভ্রমণে গেলে আমাদের গানের আসরে এসে এক কিশোর বসলো। অমায়িক ব্যবহার (অন্তত আপাতদৃষ্টিতে)। ছেলেটা বাঙালি। আমরা বেড়াতে এসেছি জেনে সে আক্ষেপের সুরে বললো, “এখনইতো আসবেন, আর ক’বছর পরে আমরাই তো থাকবো না। সরকার প্রত্যেক বাঙালিকে ১,৫০,০০০ টাকা করে দিয়ে পাহাড় ছাড়তে বলছে।” যদি এটা ‘পাহাড়িস্তান’ না হয়ে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে থাকে, তবে কেন বাঙালিকে পাহাড় থেকে উৎখাত? যারা স্থানীয়ভাবে জায়গা কিনে বসবাস করছে, তাদের তো ওটাই মাতৃভূমি। এক্ষেত্রে পার্বত্য এলাকায় বাঙালিরা কিভাবে এক ঘরে হয়ে আছে, বুঝতে পারছো? …কিন্তু তারপরও কিছুদিন্ আগে রাঙামাটিতে পাল্টাপাল্টি হত্যাযজ্ঞের আমি তীব্র নিন্দা জানাই। …যদি বাঙালি গিয়ে পাহাড়িদের খোঁচায়, তাহলে তাদের উচিত, আত্মরক্ষার্থে বাঙালিদের আঘাত করা। …কিন্তু আমার মনে হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাঙালিকে এমনিতেই শত্রু ভাবে।
জুম চাষের ব্যাপারে তোমার মতটাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। আমিও “শিকারিরাই সবচেয়ে বড় পশু সংরক্ষণবিদ” -কথাটির মতো করে বিশ্বাস করতাম, পাহাড়িরা আমার থেকে ভালো জানে, পাহাড়ের কী দরকার। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমার দাদা একটা গাভীর কী দরকার সেটা যতটা ভালো বুঝতেন, আজ আমি বিজ্ঞানমনষ্ক [অথচ বিজ্ঞানসম্মত না] হয়ে ততটা বুঝি না। তাই অনেক ক্ষেত্রে হয়তো আমি গাভীর প্রতি অবিচার করি। …পাহাড়িরা আসলেও জানতো জুমচাষ করে নিজের পুঁজি সংগ্রহ করতে, আবার এও জানতো কী করে পাহাড়ের খোরাক যোগাতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেসব জানে না। অনেক ক্ষেত্রে জানলেও মানতে পারে না। আমি পরিবেশ বিষয়ক একটা বইতে পড়েছি, আগে জুমচাষ করার পর ১৫ বছর অব্যাহতি দেয়া হতো ঐ পাহাড়কে। ফলে পাহাড়, আবার তার গুণাগুণ ফিরে পেতো। কিন্তু এখন বাড়তি জনসংখ্যার চাপে, তাদের এতোদিন অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। তারা প্রায় প্রতি বছরই সেখানে ফলায়। এতে করে তারা সত্যিই পাহাড়দ্রোহী হয়ে উঠছে। যদিও তারা আমার বাঙালিদের থেকে বেশি পাহাড় সংরক্ষণ করছে, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেটা সম্পূর্ণ না।
আমার সিদ্ধান্তে ভুল কী?
——
চিঠিটা এখানেই সমাপ্ত। আমার বন্ধু সাকিবের কোনো উত্তর আমি পাইনি। পরে জিজ্ঞাসা করেছি, সে বলেছে, তার উত্তর জানা নেই। কারো জানা থাকলে জানানোর অনুরোধ থাকলো।
আমার ঘরকুনো স্বভাবটাকে বেদুঈন স্বভাবে পাল্টে নিতেই কিছুটা জিদের বশবর্তী হয়ে উদ্যত হয়েছিলাম রাঙামাটি আর বান্দরবান ঘুরে দেখবো বলে। বন্ধুদের একেকজনের নানা কাজ, কেউই গেলো না। একমাত্র নাকিব রাজি: সে যে যাবে সেকথা বলাই বাহুল্য। আমার এই বন্ধুটি আনন্দে থাকাটাই জীবনের ব্রত করে নিয়েছে। ওদিকে আমাদের পরিচিত এক বড় ভাই (এক বছরের সিনিয়র) হাসান ভাইয়ের চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কোথাও যাবার জন্য উদগ্রীব। আরো ক’জনের মৌন সম্মতিসত্ত্বেয় শেষ পর্যন্ত সবাই পিছলে গেল। যাত্রাকালে আমরা তিনজনই: আমি, [বন্ধু] নাকিব, আর হাসান ভাই।
অভিযাত্রী দল ছোট হবার কষ্টে মন ব্যথিত হওয়াসত্ত্বেয় পত্র-পত্রিকা আর ওয়েবসাইটের তথ্য, অমুক-তমুকের অভিজ্ঞতার গল্প, নিজেদের গ্রাম আর শহরের অভিজ্ঞতা আর প্রচণ্ড উৎসাহ পূঁজি করে আমরা রওয়ানা করলাম ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ রাতে। আমাদের জনপ্রতি বাজেট মাত্র পনেরশ টাকা; আর পাঁচশ টাকা বিপদাপদ সামলাতে রিযার্ভ। চট্টগ্রামমুখী তূর্ণা এক্সপ্রেসে (জনপ্রতি ১৫০/-) রওয়ানা করলাম। তিনজনের সিট, তাই ছন্নছাড়া ছিল।
ট্রেনে বসেই আমাদের পূর্ণাঙ্গ প্ল্যান ঠিক করে নিলাম। বান্দরবানে বাড়ি এরকম এক ব্যক্তির (একরাম সাহেব) সাথে যোগাযোগ করে তাঁর ফোন নাম্বার নেয়া হয়েছে, তিনি জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি দূরে, বান্দরবান কাছে। তাই আমরা বান্দরবান যাবো ঠিক করলাম, সেখান থেকে পরে রাঙামাটি হয়ে সরাসরি ঢাকা ফিরবো। যদিও কক্সবাজার যেতে পারলে ট্যুরটা সম্পূর্ণ হতো, কিন্তু অর্থস্বল্পতায় সে পরিকল্পনা বাদ দিলাম সচেতনভাবে। ট্রেনে খানিকটা ঘুমিয়ে নেবার পরিকল্পনা করলাম, যাতে পরদিন পূর্ণোদ্যমে বান্দরবান আস্বাদন করা যায়। ঘুম থেকে উঠে ট্রেনেই জীবনে এই প্রথম চাঁদ দেখে দিক নির্ণয় করে ফযরের নামায পড়লাম। মনে মনে আদিম মানুষের সমকক্ষ হতে পেরে অভিযাত্রী হিসেবে খানিকটা আন্দোলিতও হলাম।
পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়ও দেখলাম, আর পাহাড়ের রূপে নতুন করে মুগ্ধ হলাম। আমি সিলেটের মানুষ হিসেবে প্রচুর পাহাড় সারা জীবনই দেখেছি, তবে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম: অনেক উঁচু। এমন সময় হাসান ভাই বের করলেন তাঁর ‘রেড আই’। সামনের দিকে লাল উত্তল কাচসমৃদ্ধ একটা দারুণ দূরবীণকে হাসান ভাই এই নাম দিয়েছেন। ওটা আমাদের দৃষ্টিকে আরো প্রসারিত করে দিলো অপূর্ব ক্ষমতায়। এছাড়াও নাকিবের Sony-DSC-H2মডেলের একটা ডিযিটাল অপটিক্যাল 12xযুম ক্যামেরাও আমাদের সাথে রয়েছে; সেটার ঝকঝকে ছবির অপেক্ষায় আছি আমরা।
চট্টগ্রাম স্টেশনে নামলাম। এই স্টেশন হয়ে এতো এতো পর্যটক আসেন, অথচ এই স্টেশনটার এই পুরোন জীর্ণ চেহারার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। খরচ কমিয়ে আনতে ছাপড়া হোটেলে নাস্তা সারলাম। তারপর একটা বেবিটেক্সীযোগে (৪০/-) চললাম বহদ্দারহাট বাসস্টেশনে, সব বাসস্ট্যান্ড শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে পূর্বাণী, পূরবী যায় বান্দরবানে; আমরা পূর্বাণীর টিকেট কেটে (জনপ্রতি ৬০/-) বাসে চড়লাম। আমাদের বাক্স-পেটরা অনেক: আমার একটা পিঠে ঝোলানোর ব্যাগ, ছোট্ট একটা বহনযোগ্য বিছানা, হাতে বড় একটা পলিব্যাগে পানির বোতল ইত্যাদি; নাকিবের বড় স্যুটকেস, গীটার; হাসান ভাইয়ের একটাই ছোট পিঠ-ব্যাগ (মোবাইল মানুষ!)। বাসেই এক ব্যক্তি আমাদের জানালেন, আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বান্দরবান আসছেন, তিনি আর্মি’র পরিচালিত ‘নীলগিরি’ মোটেলে উঠবেন। তারপর ইনি রূপকথার গল্পের মতো করে প্রাসাদোপম নীলগিরির সৌন্দর্যের গল্প করলেন; রূপকথায় আমি বিশেষ মজা পেলাম।
বাস চলছে, তবে টিকেট-বাস হিসেবে নন-স্টপ নয়, পথে পথেই মানুষ তুলে নিচ্ছে। কর্ণফুলী সেতু পার হয়ে চান্দগাঁও, বাকলিয়া হয়ে তৈলারদ্বীপ সেতু ডানে রেখে বায়ের রাস্তা ধরে শান্তির হাট ছুঁয়ে কক্সবাজার রোড ধরে, পটিয়া পৌরসভা পার হয়ে কেরাণিহাট (রাস্তার মাথা) পার হয়ে বিডিআর-এর প্রশিক্ষণ এলাকা কাম ক্যাম্পে (RTC&S) এসে বাস থামলো; বিডিআর-এর চেকআপ হলে আবার চলা শুরু। আঁকা-বাঁকা রাস্তা সিলেটেও আছে, তবে এতো উঁচু-নিচু রাস্তা সত্যিই নতুন। নাকিব ব্যাপারটার মধ্যে রোলার কোস্টারের আনন্দ খুঁজে পেলো; তার উদ্যমে আমরাও উৎরাই পেরোতে গিয়ে মুখ দিয়ে আআআ… বলে মৃদু চিৎকার করে মজা লুটলাম: যেন রোলার কোস্টারে চড়ে নিচে নামছি, আর আমাদের আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যাচ্ছে…। বাজালিয়া, সূয়ালক, মেঘলা হয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পরে বিশাল বিশাল পাহাড়ি ইউ-টার্ন দিয়ে বাস গিয়ে থামলো পাহাড়ের বুক কেটে তৈরি করা বাসস্ট্যান্ডে। একরাম সাহেবের নির্দেশানুযায়ী বাস থেকে নেমে রিকশাযোগে (১০/-) চললাম প্রেস ক্লাবে। প্রেস ক্লাবের উপরের ‘গ্রীণহিল’ হোটেল নাকি বেশ স্বস্তা, দেড়শ টাকা করে ডাবল বেড পাওয়া যাবে।
গুঁটি গেলো উল্টে, ফকরুদ্দিন সাহেব বান্দরবান গিয়ে আমাদের বাজেট ঘাঁটতির সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললেন। তাঁকে কভার করতে সব সাংবাদিক গিয়ে উঠেছেন বান্দরবান শহরে, হোটেলের রুম খালি নেই। একরাম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তিনি ওয়ারিদ নাম্বার দিয়েছেন, বান্দরবানে র্যাঙ্কসটেল আর টেলিটক সচল। অবশেষে আমরাই খোঁজ-খবর নিয়ে অনন্যোপায় হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় (৩০০/-) গ্রীণহিলে উঠলাম: অফপিক সীযনে পিক সীযনের ভাড়া গুণতে হলো। রুমের অবস্থা যাচ্ছেতাই, তবে রাত কাটানোর জায়গা যে পাওয়া গেছে, তাতেই খুশি আমরা।
যোহরের নামায শেষে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া সারলাম আমরা, হোটেল খুঁজতে গিয়ে ওটা চোখে পড়েছিলো। খাওয়া বেশ ভালো হলো। হাসান ভাই ছোট্ট একটা পিঠে ঝোলানোর উপযোগী ব্যাগ এনেছেন, তাতে ‘রেড আই’ আর এক বোতল পানির সাথে ছোটখাটো ছুরিজাতীয় অস্ত্র আর ক্ষমতাধর কালো লম্বা টর্চলাইটটা পুরে নিয়েছি। নাকিবের সাথে আলাদা ব্যাগে ক্যামেরা। আমাদের ভয় হলো ডাকাত। তবে আমরা আগেভাগেই ঠিক করে নিলাম যে, ডাকাতরা আক্রমণ করলে আমরা লড়াই করবো; তবে ডাকাতদের একজন সদস্যও যদি আমাদের আওতা থেকে দূরে থাকে, তাহলে লড়াই না করেই সব দিয়ে দিবো। এই প্রথম ছোট দলের সুবিধাটা উপভোগ করলাম: দ্রুত মতৈক্য।
বাসে করে আসার সময় জলপ্রপাত/বনপ্রপাত আর মেঘলা দেখে এসেছি, ওখানেই যাবো। বাসস্ট্যান্ড হয়ে হাঁটাপথে চললাম আমরা। কড়া রোদ, তার উপর মাত্র খেয়েছি; পাকা রাস্তা ধরে হাঁটছি, তারপরও এই প্রথম উপলব্ধি করলাম খাড়া চড়াই পার হওয়া কতটা কষ্টকর। নিজেকে লিফ্ট করতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। এখানে এসে সবার আগে বানান শুদ্ধ করে নিয়েছি আমি, এই জায়গাটার নাম ‘বান্দরবন’ নয়, ‘বান্দরবান’। অপূর্ব বান্দরবানের উঁচু উঁচু পাহাড় দেখে তর সইছে না কখন উঠবো ওগুলোর চূঁড়ায়; হাঁটছি তো হাঁটছিই, ত্রয়ীর উদ্যমে ভাটা নেই। পাহাড়গুলো দেখে হাসান ভাইয়ের আক্ষেপ, ‘পাহাড়গুলো এরকম গাছ-গাছড়াহীন মরু কেন!’ হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে জলপ্রপাত/বনপ্রপাত পেলাম; সাইনবোর্ডের একপাশে ‘বনপ্রপাত’ লেখা, আরেক পাশে ‘জলপ্রপাত’। রাস্তার পাশেই খাঁদে সামান্য ঢালু হয়ে যাওয়া স্রোত-পথমাত্র: প্রপাত বলতে মাধবকুণ্ড-শ্রেণীয় বিশাল প্রপাত ভাবছিলাম, হতাশ হলাম। তার উপর পানিও নেই।
পাশেই একটা সাইনবোর্ডে ‘বনায়ন’ শব্দটা দেখে হাসান ভাই আগ্রহী হয়ে পাশের টিলায় উঠলেন। ওখানে পরিচয় হলো গোলাম কবির চৌধুরি নামে আনুমানিক ৩৪ বছর বয়সী একজনের সাথে, আমাদের সাথে প্রথম বাতচিত যার বিশুদ্ধ ইংরেজিতে। স্থানীয় মানুষ, এখানে বসতি করেছেন, রোহিঙ্গাদের কয়েকটি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগান, প্রপাতের পানি তিনিই আটকে রেখে সেচকাজ চালান, তাঁর ছাপড়া ঘরে ফ্রিযও আছে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, এখানে স্থানীয় এনজিও’র সাথে যুক্ত আছেন; রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে নেতিবাচক: ‘They are very inferior to the wild beast’। [আমার ধারণা] রোহিঙ্গাদের সাথে যুঝতে হচ্ছে বলে স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় সব প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ; ফকরুদ্দিন আহমদ যে টেলিযোগাযোগ উন্নয়নে আসছেন এই খবর তিনিই দিলেন; সেনা প্রধান, নৌ প্রধান, ডিসি, র্যাব, পুলিশ সবার সাথেই উঠবস; এমনকি সিলেটের মৌলভীবাজারের জনৈক জেলা প্রশাসককেও চিনতে পারলেন তিনি। সত্যিকার অর্থেই পাহাড়ের মাঝে পাহাড়ি ফুল হয়ে আছেন তিনি। (এসংক্রান্ত সঠিক দৃষ্টিকোণ পেতে দেখুন এই নিবন্ধটি) তাঁর ওখান থেকে পানি খেয়ে নামলাম আমরা।
আবারো হাঁটা, এবারে অনেক দূর হেঁটে এলাম মেঘলায়। এখানে টিকেট কেটে (জনপ্রতি ১০/-) ভিতরে ঢুকলাম অন্যান্য আরো পর্যটক আর শিক্ষা সফরকারীদের সাথে। ঢালু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আবিষ্কার করলাম অপূর্ব দুই দুইটা ঝুলন্ত সেতু। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু ছাড়াও যে বাংলাদেশে আর কোথাও ঝুলন্ত সেতু আছে এটা এই প্রথম জানলাম, দেখলাম। দুপুর সাড়ে তিনটার সূর্যের তপ্ততা বাতাসের তীব্রতায় ম্লান হওয়ায় অস্বস্তি লাগছে না, কিন্তু চারপাশ বেশ উজ্জ্বল সবুজ। আশেপাশে মিশ্র ফলের বাগান করা হয়েছে। ক্যামেরা চলছে সেই প্রথম থেকেই, ডিযিটাল ক্যামেরা, মেমোরীর বালাই নেই।
আলোকচিত্র ০১: ঝুলন্ত সেতু শুধু রাঙামাটি নয়, মেঘলায়ও আছে [ছবি: নাকিব আহমেদ]সেতু পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে ওঠা যায়, আমরা এগোলাম। উদ্দেশ্য সামনের ঐ উঁচু পাহাড়ের চূঁড়ায় চড়ে বিখ্যাত(!) হয়ে যাওয়া। কিন্তু বিধি বাম: উপরে যে পথটা পাহাড় চূঁড়ায় উঠে গেছে, সেই পথের মুখেই লেখা “প্রবেশ নিষেধ”। অগত্যা সামনের ছাউনি দেয়া দোকানগুলো লক্ষ্য করে চললাম। ওখানে গিয়ে এক পাহাড়ি ছেলের দোকানে বসে স্বস্তায় কলা খেলাম। গাছ পাকা ঐ কলার স্বাদ যে একবার খেয়েছে, ভুলবে না। স্বস্তায় নাকি মানুষ পস্তায়: আমরাও পস্তাই, তবে আবার না খেতে পারার পস্তানো। এবারে সামনের পথ ধরে চললাম।
পথের বাম পাশেই পাহাড়ের বুক কেটে এই রাস্তা করা হয়েছে। আলগা মাটি বেরিয়ে আছে। কোথাও তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি পাহাড়ের গায়ে তক্তা কিংবা ইট ঢুকিয়ে ধ্বস বন্ধ করা হয়েছে; তবে পরক্ষণেই ভেদ ভাঙান হাসান ভাই। ওগুলো পাথুরে মাটি, রঙে রূপে এরকম ইট আর তক্তা মনে হচ্ছে। ওখানে কয়েকটা ছবি তুলে পাথুরে মাটির কিছু স্যাম্পল হাতে করে সামনে গিয়ে দেখি মিনি চিড়িয়াখানা: পশু-পাখিদের কষ্ট দেয়ার অপ্রশস্ত আবাস। হরিণ, বানর, কালো ভালুক আর বিভিন্ন জাতের কিছু নাম না জানা পাখি। মিনি চিড়িয়াখানা পার হয়ে পথটা দ্বিতীয় ঝুলন্ত সেতু হয়ে সেই আগের জায়গায় গিয়ে মিশেছে; ঢোকবার পথটাই বেরিয়ে যাবার পথ।
আলোকচিত্র ০২: বান্দরবানে স্তরিভূত মাটিতে তৈরি পাহাড় [ছবি: লেখক]বেরিয়ে সামনের পাহাড়ের উপরের মসজিদে আসরের নামায পড়ে আশপাশটা একটু দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এটা বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের এলাকা। চক্কর দিতে গিয়ে সেখানেই লেকের উপর পরিত্যক্ত একটা ঘর আবিষ্কার করলাম। ঘরটা ক্যাম্পিং করার মতোই, বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় পানির উপর দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে অস্তমিত সূর্যের আলোয় লেক এলাকা দেখে বাসে চড়ে আবার বান্দরবান শহরে ফিরে মাগরিব সারলাম। প্রতি পদক্ষেপেই আমরা পরবর্তি গন্তব্য সম্পর্কে এর-ওর থেকে যতটুকু সম্ভব জেনে নিচ্ছি: কোন বাস যায়, কত ভাড়া, কোনটার ভাড়া কম, ভালো হোটেল কী আছে; সবচেয়ে বেশি তথ্য পেলাম রেস্টুরেন্টের বয়দের থেকে।
গোসল করে বিশ্রাম নিয়ে এশার নামায পড়ে বেরোলাম আবার; উদ্দেশ্য স্বস্তা একটা হোটেল খোঁজা, যাতে কালকেই সরে পড়া যায়; কালকের দিনটা বান্দরবান থেকে চিম্বুক পাহাড় ঘুরে এসে পরশু রাঙ্গামাটি গিয়ে একদিন থেকে পরদিনই বাসযোগে ঢাকা ফেরত। মূল বান্দরবান শহরটা ছোট, হাঁটলে এমাথা-ওমাথা দশ মিনিটও লাগবে না। ভিতরের দিকে একটা হোটেল পেয়েও গেলাম, ‘কালকেই সেখানে পাড়ি দেবো’ এমন প্ল্যান করে রাতের খাওয়া সারলাম। তারপর সাঙ্গু নদীর ব্রীজের উপর বসে নাকিব গীটার হাতে নিলো: সে গীটার নিজে নিজে শিখেছে, কিন্তু ওর মতো ভালো গীটার-বাদক আমি আর দেখিনি। গীটারের সুরে পরিবেশ বদলে দিলো সে, হাসান ভাই তাল দিয়ে চলেছেন। আমি ব্যাগ থেকে [মার্চ মাসের আকাশের] ‘তারা-চিত্র’ বের করে নিলাম। যাবার সময় ডিসকভারি চ্যানেলের বই ঘেঁটে ওটা এঁকে নিয়েছিলাম, ওটার সাথে মিলিয়ে আকাশের তারা চিনবো। তারা চেনার প্রথম ধাপ হলো উত্তর-পূবাকাশের সপ্তর্ষী (উরসা মেজর) চেনা: সাঁতটা তারা একত্রে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন-মতো তৈরি করেছে। সপ্তর্ষীর মজার বিষয়টি আমি আবার বাবার থেকে শিখেছি: প্রশ্নবোধকের লেজের সোজাসুজি তিনটা তারা ধরে আকাশের আরেক প্রানে- তাকালে আরেকটা উজ্জ্বল তারা দেখা যায়, যা উত্তর দিক নির্দেশ করে (এবিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে দেখুন এই নিবন্ধ)। তবে ব্রীজের আলোয় আমার তারা দেখা গোল্লায় গেলো। রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে ফিরে নিচের ডেস্কেই জানলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান আগামীকাল চিম্বুক যাবেন, তাই ও-পথ বন্ধ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তটা নাকিবই নিলো, কক্সবাজার যাবার ইচ্ছাটা সে-ই ব্যক্ত করলো। ঠিক হলো কালকেই বান্দরবান ছেড়ে কক্সবাজার যাওয়া হবে, সেখানে একদিন থেকে পরেরদিন রাঙ্গামাটি: আবারো দ্রুত মতৈক্য।
পরিকল্পনামতো পরদিন সকালের নাস্তা সেরে চললাম দ্বিতীয় আকর্ষণ বৌদ্ধমন্দির দেখবো বলে। বালাঘাটার বৌদ্ধমন্দিরে যাবার পথ বাতলে দিলো হোটেল বেয়ারা, যাবার আগেই জেনে নিলাম কোন বাস ক’টায় ছাড়বে, এগারোটার আগেই মন্দির দেখে ফিরতে হবে। বান্দরবান থেকে বেবীটেক্সিতে করে (জনপ্রতি ৮/-) বালাঘাটা চললাম। বান্দরবান ক্যান্টনমেন্ট, কৃষি ইন্সটিটিউট, পাবলিক লাইব্রেরী পার হয়ে বালাঘাটা গিয়ে সেখান থেকে রিকশায় (১৫/-) করে বৌদ্ধমন্দিরের পাদদেশে। উঁচু পাহাড় চূঁড়ায় স্বর্ণালী মন্দিরটি পরিষ্কার আকাশের গায়ে যেন কেউ তুলিতে এঁকে রেখেছে। নিচেই প্লেকার্ডে লেখা রয়েছে “বুদ্ধ ধাতু জাদি: পুলপাড়া, বান্দরবান”। এই ‘জাদি’ শব্দটা পালি ভাষা থেকে এসেছে, বাংলা অভিধানে উল্লেখ নেই। জাদি-পাহাড়ে সিঁড়ি বানানো আছে, ওপথেই উপরে উঠতে থাকলাম। উপরে উঠে আমরা ঘোড়ার ডিম খেলাম। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে “পূজারি ব্যাতীত দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ” “দর্শনার্থী প্রবেশের সময় বিকাল ৩টা থেকে ৫টা”। পাশেই বৌদ্ধ ভিক্ষু শিক্ষাক্ষেত্র। আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়মকে শ্রদ্ধা করে ভিতরে যেতে নিবৃত্ত হলাম। বাইরে থেকেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটালাম; কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নেমে এলাম উপর থেকে।
আলোকচিত্র ০৩: বুদ্ধ ধাতু জাদির অলঙ্করণ মুগ্ধ না করে পারে না [ছবি: লেখক]কিন্তু ফিরে গেলাম না, পাশের পাহাড়ে গিয়ে চড়লাম। সেই পাহাড়ের পেটে দাঁড়িয়ে দেখলাম বেশ কয়েকটা বাঁশ দিয়ে একটা মাচা-মতো তৈরি করা হয়েছে, মাচা অবশ্য বেশ ফাঁক-ফোকরওয়ালা, মাঝখানে চোখা একটা বাঁশ উঠে গেছে; নিচে পুরো সমতল অংশ জুড়েই এখানে ওখানে ছাই পড়ে থাকতে দেখে সব মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এটা একটা শ্মশান- বৌদ্ধ শ্মশান। কিন্তু পাহাড়ের ঢালেও পোড়া ছাই দেখে শ্মশান হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলাম, ঢালে শবদাহ হবার সম্ভাবনা নেই। সমতলের সোজা ওপাশে একটা দোচালা ছোট্ট ঘরে একটি বৌদ্ধমূর্তি: কমলা রঙের বস্ত্রাচ্ছাদিত গৌতম বুদ্ধ পদ্মাসনে বসা, হাত দুটি [আমার ভুল না হলে] ‘বিতর্ক’ মুদ্রায় বিধৃত, পরস্পর লাগানো। পাশেই একটা ফলক পড়ে জানলাম যে, এখানকার বোধি বৃক্ষ ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী লাগিয়েছেন। এই সমতলে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজন প্রথম বারের মতো আবিষ্কার করলাম, আমরা কেউই জানিনা বৌদ্ধদের শেষকৃত্য কিভাবে হয়?
এই সমতল থেকে জাদিটি দেখা গেলো, আমরা রেড আই আর ক্যামেরা দিয়ে জাদি আস্বাদন করলাম। তারপর এই সমতল থেকে আরো উপরে উঠে যেতে থাকলাম, আরো উপরে, আরো উপরে, আর ভয়ে থাকলাম কারো বাড়িতে না ঢুকে পড়ি। অবশেষে অনেক উঁচুতে উঠে পাহাড় চড়ার স্বাদ মেটালাম ওখানে। উপরের গাছগুলো কেটে ফেলেছে কে যেন, আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে জাদি চূঁড়ারও অনেক উপর থেকে জাদিকে পূর্ণ উপভোগ করলাম। ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পেয়ে যে যার বাড়িতে ফোন করে নিজেদের আকাশ ছোঁয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে মহান হয়ে গেলাম। তারপর কক্সবাজার যাবার তাড়নায় দ্রুত নিচে নামতে থাকলাম। নামার সময় পায়ের হিসেবে ফুট বিবেচনায় আন্দাজ করলাম, আমরা মোটামুটি সাড়ে তিনশ ফুট উপরে উঠেছিলাম; এ যদিও এমন কিছু না, তবুও চিম্বুকের সাধ তো মিটলো।
ফিরলাম গ্রীণহিল হোটেলে, বাক্সপেটরা গোছগাছ করাই ছিল, ম্যানেজারকে বলে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা পূরবী’র টিকেট কাটলাম (জনপ্রতি ৮৫/-), বাস ছাড়লো সোয়া এগারোটায়। হাসান ভাই আর নাকিব একত্রে বসেছেন, আমার পাশে উপজাতি এক ব্যক্তি এসে বসলেন। হাসান ভাই আমাকে ইশারায় লোকটার হাতের দিকে তাকাতে বললেন, তাঁর চোখে ভীতি। লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে উল্কি দিয়ে বেশ কিছু চিহ্ন আঁকা। ভালো করে তাকিয়ে সেখানকার স্বস্তিক প্রতীকটি সনাক্ত করতে পারলাম; কারণ আমি কয়েকদিন থেকে ধর্মীয় প্রতীক বিদ্যা নিয়ে কিছু গবেষণা করছি। হাসান ভাইকে বললাম, ‘ভয়ের কিছু নেই, ভালো জিনিস’। হাসান ভাই’র ভীতি হলো এই লোক রোহিঙ্গা ডাকাত-টাকাত কেউ। আর যাই হোক, একজন ডাকাত স্বস্তিক প্রতীকের উল্কি নিয়ে ঘুরবে না। কারণ স্বস্তিক হলো ‘শুভ’ বা ‘কল্যাণ’-এর প্রতীক; অবশ্য নাৎসিবাদের স্বস্তিক বিবর্তিত; আমি সেটা গোণায় ধরছি না।
সারাটা পথ আমি লোকটার হাতের দিকে অসংখ্যবার তাকিয়েছি। স্বস্তিকতো চিনলাম, বাকিগুলো অপরিচিত কেন? অনেকক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে তাঁকে প্রশ্নটা করলাম। তিনি খুব সুন্দর অমায়িক নিষ্পাপ হাসি উপহার দিয়ে অনেক কষ্টে শুদ্ধ ভাষায় বললেন। হাতে উল্কি দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিয়েছেন ধর্মমতে কোন খাবারগুলো তাঁর জন্য নিষিদ্ধ; ওগুলো পালি ভাষা’র হরফ বোধহয়। আমি নিশ্চিত হলাম, ইনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী: বৌদ্ধধর্মে বামদিকে-বাঁকা-মাথা স্বস্তিক ভালোবাসা, ক্ষমা আর দয়া প্রতীকায়ন করে। আমার ফিযিওগনমি’র ক্ষমতায় নিশ্চিত হলাম, এই হাসি কোনো ডাকাতের হতেই পারে না।
বাস লোহাগাড়া, বানিয়ারছড়া, চকরিয়ার মালুমঘাট পার হয়ে চলেছে। এমন সময় মসজিদের দান সংগ্রহে এক ব্যক্তি বাসে উঠলে আমি নিজেকে নিবৃত্ত রাখলাম আমাদের অর্থ সীমিত বলে। অথচ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমার পাশের বৌদ্ধ ব্যক্তিটি কিছু টাকা দান করলেন, আর হাত আকাশের দিকে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন; বুঝলাম ইনি খুবই ধার্মিক একজন। আমি মনে মনে লজ্জিত হলাম, আমার মসজিদে আমিই দিলাম না, আর একজন বৌদ্ধ দান করলো! আমার মনে পড়লো ইসলামের বাণী: দান করলে আল্লাহ বর্ধিত করে দেন; আমি তো বাড়তি পেতাম। খুব লজ্জিত হলাম, শিক্ষা নিলাম। একজন পরধর্মীর কাছেও স্বধর্মশিক্ষা বাকি ছিলো। তবে ঐ ব্যক্তি আমার শিক্ষক হয়ে গেলেন, নিঃসন্দেহে।
আমাদের জুম‘আ মিস হলো; বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেকটা চাঁদের গাড়িতে চড়ে (জনপ্রতি ৫/-) কলতলী মোড়ে চললাম। মোড়ে পৌঁছার আগ মুহূর্তেই জীবনে দ্বিতীয়বার, কিন্তু বাংলাদেশে প্রথমবার সমুদ্রের দেখা পেলাম: অপূর্ব! মোড়ে নেমে বায়ের পথ ধরে নাকিব আমাদেরকে নিয়ে গেলো ওর পরিচিত ‘হোটেল লজ্’-এ; ও এ-নিয়ে চারবার এসেছে। হোটেল ভাড়া শুনে মহাশূণ্য থেকে পড়ার জোগাড়, সাড়ে তিনশ-চারশ টাকার ডাবল বেড এখন ৮০০/- টাকা! এবারে দ্বিতীয়বার গুঁটি উল্টে-পাল্টে গেলো। জানলাম, ছাব্বিশে মার্চ সরকারি ছুটি, সাতাশ তারিখ বৃহস্পতিবার, আটাশ-উনত্রিশ সাধারণ ছুটি: সবাই সাতাশ তারিখ ছুটি নিয়ে প্রথম পর্যটন স্থান হিসেবে কক্সবাজারে এসে উঠেছে। আবারো অফপিকে, পিক সীযনের ভাড়া গুণতে হবে। পরিচিতিও কাজ দিলো না বলে নাকিব মর্মাহত হলো। আমরা বাক্স-পেটরা নিয়ে রাস্তায় নামলাম। রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে হোটেল সন্ধান করতে লাগলাম, আর সবখানেই ভাড়ার ১১০০-১২০০ টাকার ত্রাহী চিৎকার দেখে গলাধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়তে থাকলাম।
ওদিকে রিকশাওয়ালারা করছে মহাযন্ত্রণা, এরা আবার হোটেলগুলোর দালাল। এদিকে আমরাও হোটেল খুঁজছি, আমাদেরই মতো ছন্নছাড়া আরেকটা ত্রয়ী দলও যেন হোটেল খুঁজছে। সংক্ষেপে বলি, ওরা তিনজন: সাইফ [ভাই], ফাহাদ আর মামুন। সাইফ আর ফাহাদ ঢাকা থেকে, মামুন চট্টগ্রাম থেকে; বাসে বিদায় দিতে এলে বাকি দুজন মামুনকে বাসে টেনে তুলে নিয়ে এসেছে পরনের এক কাপড়েই। ওদেরও একই দশা। আমরা একজোট হলাম, ওরা আরো হোটেল দেখেছে। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হলো নাকিবের পরিচিত হোটেলেই স্বস্তা+ভালো রুম পাওয়া যাবে নিশ্চিত, তাই আমরা ‘হোটেল লজ’-এর ৪০৮ নম্বর রুমটা নিলাম। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি কক্সবাজার থেকে রাঙামাটি সরাসরি কোনো বাস নেই। তাই আমরা ওদের সাথে আলাপ করে দুদিনের জন্য দুই দলই একত্রে ১৬০০/- টাকা দিয়ে রুম বুক করলাম: এটা নতুন নিয়ম, অগ্রিম জমা করতে হবে; অনেকে নাকি বকেয়া রেখে পালিয়ে যায়। রুমে ঢুকে মন ভরে গেল: ইয়া বড় বড় দুটো বিছানা, এক বিছানায় আমরা তিনজন, অন্যটায় ওরা তিনজন, আড়াআড়িতে বেশ হয়ে যাবে। আমাদের বারান্দা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়, গর্জনও শোনা যাচ্ছে। আমরা জামাতে যোহরের নামায পড়লাম। ফাহাদের আর তর সইছে না, সে এক্ষুণি নামবে সমুদ্রে।
আমাদের কক্সবাজারের কোনো প্রস্তুতিই ছিলো না। তবুও সব কেমন করে হয়ে গেল। আমরা মোবাইল, ঘড়ি, ক্যামেরা সবকিছু ঘরে রেখে বেরোলাম; আমরা বোধহয় ওদেরকে বিশ্বাস করলাম, কিংবা ওরা আমাদেরকে। বিপদে আমরা দুদলই নিরুপায়। সমুদ্রে নামার আগে তিন গোয়েন্দার বইতে পড়া সাবধান বাণী মনে পড়লো: ‘সমুদ্রে ভাটার সময় নামতে হয় না।’ এখন কি জোয়ার? …নাকিব আশ্বস্ত করলো। এই প্রথম সমুদ্রে নামলাম আমি। প্রথম অনুভূতি: বিধাতার কী অপূর্ব সৃষ্টি! দ্বিতীয় অনুভূতি: পায়ের নিচ থেকে বালু সরে যাচ্ছে ঢেউয়ের টানে। নাকিব শিখিয়ে দিয়েছে, ঢেউ এলেই ঢেউয়ের দিকে পিঠ করে লাফ দিতে হবে, তৃতীয় অনুভূতি: ঢেউ এসে আমার ঘাড়ে ঠাস করে চড় বসিয়েছে; আমি ব্যথা পেয়েছি। চতুর্থ অনুভূতি: লবণের ভাণ্ডার! চোখে লবণ-পানি ঢুকলেই জ্বালা করছে। তারপর আমরা সৈকত ধরে হেঁটে আরো জনারণ্যে গেলাম। ওখানে সামনে কয়েকজন সাহসী আছেন, আমরা তাদের সাথে গিয়ে মিশলাম। এখানকার ঢেউগুলো রীতিমতো পর্বতসম। যে ঢেউটা এসে ঠিক সামনে ভেঙে পড়ছে, সেটা খুব ভয়াবহ। পঞ্চম অনুভূতি: ভেঙে পড়া বড় ঢেউগুলো পানির নিচে আমাকে রীতিমতো নাকানি চুবানি খাইয়েছে; ‘নাকানি-চুবানি’ কী জিনিস আমি উপলব্ধি করলাম। সাঁতার জানি বলে পানির শক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতাম, কিন্তু জীবনে এই প্রথমবার পানির, ঈশ্বর-প্রদত্ত অসীম ক্ষমতাকে স্বীকার করেছি। তবুও আমরা পিছু হটিনি, বোধহয় মানুষ বলেই। ঢেউয়ের সাথে লড়াই করার সময় ঢেউয়ের চুঁড়ায় মাছের ঝাঁক দেখেছি, কিন্তু ওগুলো যথেষ্ট চালাক, ঢেউয়ের মধ্যেও নিজেদেরকে এক জায়গায় আটকে রাখতে পারে।
অনেকক্ষণ ভিজলাম। অবশেষে আমরা সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়ে হোটেলে ফিরে সাপ্লাইয়ের পানি দিয়ে নোনা জল ছাড়ালাম; নোনা জল চুলকে রুক্ষ্ম করে দেয়। আমরা আসরের নামায শেষ করে নাস্তা করলাম, সারাদিনে পেটে দানাপানি সকালের নাস্তা ছাড়া কিছুই পড়েনি। তারপর মাগরিব পড়ে বেরোলাম বার্মিয মার্কেটে কক্সবাজার শহরে। রিকশায় গিয়ে (১৫/-) বার্মিয মার্কেট চষে ফিরলাম রাতে। হাসান ভাই স্বীকার করলেন, ‘আমি আগে মনে করতাম, উপজাতিরা সুন্দরী হয় না। আজকে আমার ভুল ভাঙলো।’ ফেরার পথে এস. আলম বাসের টিকিট করলাম, সেখানেও চল্লিশ টাকা বেশি (জনপ্রতি ৩৯০/-)। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে সবকিছু রেখে নাকিব গীটার নিলো। দ্বিতীয় দলের তিনজন ঘরে বসে আছে, বেড়াবার জায়গা নেই। আমরা আবার হোটেলের কাছেই সৈকতে গেলাম। ডাকাতির ভয় করলেও সাথে তেমন কিছু নেই, আর বিশাল টর্চলাইটটা সাথে থাকায় কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে।
চাঁদ এখনও ওঠেনি, তারার চাদর ঢাকা আকাশের নিচে বালুতে বসে পড়লাম জুতার উপর। নাকিবের গীটারের ব্যাগটা বিছিয়ে হাসান ভাই শুয়ে পড়লেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। নাকিব গীটার নিয়ে ভাটায় নেমে যাওয়া সমুদ্রের জলের কাছে গিয়ে বাজাচ্ছে, নিজেই নিজেকে শোনাচ্ছে যেন। অপূর্ব সরব নীরবতা, অন্ধকার। উত্তাল বাতাস। শোঁ শোঁ একটানা গর্জন। কাব্যিক করে তুললো তিনজনকেই। হাসান ভাই নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। জীবনে এই প্রথম আমরা বোধহয় তিনজনই একান্ত নিজের কাউকে কাছে পেতে চাচ্ছি; সমুদ্র বোধহয় এমনই তিয়াস জাগায়। রাত আড়াইটার দিকে সৈকত ছেড়ে উঠলাম। নীরব কলাতলী মোড় হয়ে হোটেলে গিয়ে উঠলাম; দারোয়ানও আমাদেরকে বুঝলেন, গেট খুলে দেয়াকে নিজের দায়িত্বই মনে করলেন।
পরদিন সকালের নাস্তা সেরে সৈকত ধরে হাঁটতে থাকলাম আমরা ত্রয়ীতে। নাকিব আজকে ওর ক্যামেরা হাতে নিয়েছে, একের পর এক শার্টার পড়ছে। সৈকতের একটু ভেজা বালু আর শুকনা বালুতে কাঁকড়ার বাচ্চাদের শিল্পকর্ম দেখে আমি মুগ্ধ হলাম; সৈকতে ছড়ানো শামুক-ঝিনুকের ছড়াছড়ি দেখে মুগ্ধ হলাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় আর না পেরে জুতা খুলে পানিতে পা ভিজালাম। তারপর শুকনো বালু মাড়িয়ে ঝাউবনে ঢুকতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সূর্যের তেজ, যা এতক্ষণ সমুদ্রের বাতাসের কারণে বুঝাই যাচ্ছিলো না। ঝাউবন পেরিয়ে রিকশা নিয়ে আমরা সার্কিট হাউয চললাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে ডানে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের [জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী] রাডার স্টেশন।
রাডার স্টেশন ডানে রেখে বায়ের পথে এগোলে সামনে ছোট একটা জাদি, ঢোকার কোনো পথ নেই, পরিত্যাক্তই বলা যায়। জাদির পিছনেই কক্সবাজার সার্কিট হাউয। এই পাহাড় চূঁড়া থেকে ঝাউবনের উপর দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা রিকশাযোগে হোটেলে ফিরে যোহর পড়েই চললাম সমুদ্রে। আজকে ক্যামেরায় ছবি তোলা হবে। পালা করে ভিজলাম; ছবি তুললাম। তারপর হাসান ভাইকে কবর দিলাম বালুর নিচে: মমির মতো লাগলো দেখতে। হাসান ভাইয়ের অভিমত, ভেজা বালুর প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে হয়েছে তাকে। দূর থেকে সবাই এ দৃশ্য দেখে হাসছে। তারপর ক্যামেরা রেখে এসে আবার ভেজা। দী-র্ঘ-ক্ষ-ণ ভিজলাম। যেন নোনা পানির পাহাড়ের সাথে মানব জাতির যুদ্ধ: হয় হার, নয় জিত।
আলোকচিত্র ০৬: সৈকতের মমি হাসান ভাই [ছবি: লেখক]
ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে আসর পড়ে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর শরীরের ম্রীয়মান শক্তিটুকু পূঁজি করে হাঁটা ধরলাম সৈকতের বামদিক ধরে। নাকিব হাঁটছে আর সূর্যাস্তের ছবি তুলছে। আমি আর হাসান ভাই সামনের ঐ দূরের নৌকাগুলোর কাছে যেতে চাই। পথ আর ফুরোতেই চায় না। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা পার হলে ওখানে পৌঁছলাম, জেলে নৌকা দেখলাম। ওগুলোতে ইঞ্জিন বসানো হয়েছে, নৌকায় রাখা কুপির চারপাশে কাঁচ দিয়ে ঘেরা, যাতে সমুদ্রের বাতাস নিভিয়ে দিতে না পারে আলো। জানলাম জেলেদের কুসংস্কার: ‘জুতা দিয়ে নৌকা মাড়ালে বেশি মাছ পাওয়া যায় না’। তারপর আমরা ফিরতি পথে মাগরিব পড়লাম এক মসজিদে, হোটেলে ফিরে এসে অল্প বিশ্রামে ক্লান্তি দূর করলাম। আবার বেরোলাম অদূরে অন্য এক বার্মিয মার্কেটে। সামান্য কিছু কেনাকাটা করে ফিরলাম। রাতের খাবার খেয়ে সরাসরি সৈকতে গেলাম।
সৈকতে অন্ধকারের মধ্যে আরেক যজ্ঞ, কাঁকড়ারা সবাই বেরিয়ে পড়েছে খাদ্যের সন্ধানে। নাকিবের শক্তিশালী টর্চটা যতদূর গেলো পুরো সৈকত জুড়ে অগণিত লাল কাঁকড়া হাঁটাহাঁটি ছোটাছুটি করছে। আমরা কিছুক্ষণ কাঁকড়া তাড়িয়ে বেড়ালাম। সৈকতে আমরা ত্রয়ীতে বসে গল্প করলাম, তর্ক করলাম। একসময় হাসান ভাই বলে উঠলেন, ‘আমাদের তো ভাই উদার হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা তিনটা বৃহৎ জিনিস দেখলাম: পাহাড়, সমুদ্র আর আকাশ’। সত্যিই তাই, এই উদার ত্রয়ীর মহাতটে আমরা ত্রয়ী কি উদার হলাম? আমরা কি কিছু শিক্ষা নিলাম? সে বোধহয় আমাদের ভবিষ্যতই বলে দেবে।
পরদিন সকালে আমরা বাসে করে ঢাকায় ফিরলাম। বাস আমাদেরকে কলাতলী মোড় থেকেই তুলে নিলো। দীর্ঘ দশ ঘণ্টার পথ ক্লান্তিতে শ্রান্ত হলেও খুব উপভোগ করেছি এই স্বল্প বাজেটে এতো বড় ট্যুর। এই ট্যুরে আমার ব্যয় সর্বমোট ১৫১৫/-; দৈনিক গড়ে ২৫৮/-, যাতায়াত বাবদ গড়ে ৭৪০/- টাকা।
আলোকচিত্র ০৮: ত্রয়ীর পদচিহ্ন: লেখক, হাসান ভাই আর নাকিব [ছবি: স্বয়ংক্রিয়]
পরামর্শ: বাংলাদেশে ঘুরতে হলে সরকারি চাকুরের সাথে ঘুরতে বের হওয়া উচিত, খরচ প্রায় থাকবে না, ফ্রি থাকা-খাওয়া। অফ সীযন দেখে বের হতে হবে, যাত্রার পুরো সময়টায় কোনো ছুটির দিন না থাকাই ভালো। বিশেষ ব্যক্তিত্বের ঐ এলাকায় যাবার কথা থাকলে জেনেশুনে যাওয়াই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে গেলে সমবয়সীদের দলে কিংবা পরিবারের সাথে সবচেয়ে বেশি মজা হয়। দল যত বড়, খরচ তত কম; তবে মতানৈক্য তত বেশি। তবে পরিবার নিয়ে গেলে বাজেটে সীমাবদ্ধতা রাখা যাবেই না এবং আমার খরচের কয়েকগুণ বেশি অর্থ হিসেব করতে হবে। পাহাড়ে ক্যাম্পিং করলে মশা-নিবারক/নিরোধক আবশ্যক। সবার জন্যই পরামর্শ: ‘এই মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়ুন, কালকে বেরোলেও চলবে, কিন্তু পরশু বেরোলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে: প্রতিদিনই ব্যয় বাড়ছে’।
___ সতর্কতা ___
এই পোস্টে ২০০৮-এর মার্চের হিসাব উদ্ধৃত হয়েছে। নতুন অভিযাত্রীদের মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনাপূর্বক বাজেট পরিকল্পনা করার অনুরোধ থাকলো।
___ সতর্কতা ___
-মঈনুল ইসলাম
(পরিস্ফুটন: আগস্ট ১৪, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ)