সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ ২০১৪

ধারাবাহিক:  সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ —এর একটি পর্ব

বিয়ে করেছি ৭ মাস হয়ে যাচ্ছে, দেশের অবস্থা ভালো ছিল না বলে কোথাও বেরোন হয়নি। ভ্রমণ বাংলাদেশ থেকে একটা সস্ত্রীক ট্যুর আয়োজন করা হলো, কিন্তু অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ না করায় শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে যোগ দিতে হলো। ওরা প্রায় একমাস আগে থেকে ট্যুরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের ট্যুরের নাম: Hectic Tour to Saint Martin, বাংলা করলে দাঁড়ায় উত্তেজনাপূর্ণ। তবে এর অনেকগুলো মানের মধ্যে এটা একটা আরকি। কে জানতো বাকি মানেগুলোও এই ট্যুরের সাথে জুড়ে গিয়ে ট্যুরটাকে বিপদসংকুল করে তুলবে। সফরসঙ্গী মুনিম তো শেষ পর্যন্ত ঘোষণাই দিয়ে দিলো: ভবিষ্যতে আর কোনো ট্যুরে যদি হেকটিক ফেকটিক থাকে, তাহলে সে আর নেই। বোঝাই যাচ্ছে, হেকটিকের ভয়ংকর মানেটাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, আর সেখানে আমার সাথে আমার গিন্নীও…

যাবার আগে প্রস্তুতির চেকলিস্ট*:

  • সান’স ক্রীম বা রোদ-প্রতিরোধী লোশন (কারণ নোনা বাতাস আর রোদে গায়ের চামড়া পুড়ে যায়)
  • সানগ্লাস (কারণ প্রচণ্ড রোদ সেখানে)
  • পানির বোতল (দুটো ছোট বোতল মিলিয়ে ১ লিটার মতো হলে বহনে সহজ)
  • রাবারের, পিছনে ফিতা দিয়ে আটকানো যায় এমন জুতা (হাঁটতে এবং সাঁতরাতে কাজে লাগবে)
  • ব্যান্ডএইড-জাতীয় ছোট প্লাস্টার এবং ফার্স্ট এইড (কারণ প্রবালে হাত-পা কাটবেই)
  • ক্যামেরা, অতিরিক্ত ব্যাটারি, ম্যামোরি কার্ড এবং চার্জার
  • মাল্টিপ্লাগ (যদি দলে একাধিক লোক থাকে – অনেকে একসাথে চার্জ দিতে পারবেন)
  • মোবাইল ফোন, চার্জার এবং রিচার্জ (সব ফোনেরই নেটওয়ার্ক আছে, দুর্বল কিংবা সবল)
  • একটি এলইডি চার্জার বাতি (যখন থাকবে না বিদ্যুৎ, এর মতো উত্তম সঙ্গী শহুরেদের আর নেই)
  • মোমবাতি আর লাইটার (চার্জার বাতি ব্যর্থ হলে…)
  • টর্চলাইট (এখানে-ওখানে যেতে অন্ধকারের সঙ্গী)
  • মশা-নিরোধক ঔষধ (ওডোমস বা এজাতীয়)

*এর অনেকগুলোই দানিয়েল তৈরি করে দিয়েছে…

ট্যুরটা ছিল এরকম: সবাই তাবু নিয়ে যাবে, সেন্ট মার্টিনে তাবু করে রাত কাটাবে, মাছের বার্বিকিউ করবে, দুই রাত ওখানে থেকে, ফিরে আসবে। যাওয়া-আসা হবে, সীট্রাকের বদলে ট্রলারে করে। পুরো ট্যুরটাই প্রচলিত ট্যুরিস্ট ট্যুরের নিয়মের বাইরে উত্তেজনাপূর্ণ হবে আর পরিশ্রম করতে পারে না এমন কাউকে এই ট্যুরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। ট্যুরের সময় বাছাই করা হলো ২৬ মার্চের ছুটি, ২৮ তারিখের শুক্রবার, ২৯ তারিখের শনিবার আর ২৭ তারিখটা সবাই ছুটি নিয়ে নিলো – পাক্কা ঈদের ছুটি বলা যায়। ট্যুরের আগ মুহূর্তে ট্যুরের সঙ্গী হলো সর্বমোট ১৪ জন – নাকিব, নাকিবের কাযিন ইমরান, আরেক কাযিন শাকিল আর তাঁর স্ত্রী; দানিয়েল আর তাঁর স্ত্রী; শান্ত, শান্ত’র বন্ধু কলি, মুনিম, আদিল; ইফতি; রাসেল; নাকিবের প্রাক্তন সহকর্মী আবির আর ফুয়াদ। তারা ঠিক করলো, তারা সবাই ট্রেনে যাবে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে বাসে করে টেকনাফ, তারপর ট্রলারে সেন্ট মার্টিন। যেতে যেতে যে সন্ধ্যা হবে, সেটা তারা ধরেই নিল। এদিকে অভিজ্ঞ অগ্রজ ভ্রমণকারীরা আমাকে আমার গিন্নীকে নিয়ে ট্রলারে যেতে নিষেধ করায়, আমি ঠিক করলাম আমরা যাবো সীট্রাকে। সেজন্য আমরা আলাদা যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কাটলাম বাসের টিকেট। ঢাকা থেকে টেকনাফ, রিল্যাক্স পরিবহনে (জনপ্রতি ৳৯০০), সন্ধ্যা ৭টায় বাস।

ফকিরাপুল বাস স্টেশনে গিয়ে দেখি আমার অন্যান্য বন্ধুরাও একইসাথে যাচ্ছে সেন্ট মার্টিনে (ওরা আলাদা যাচ্ছে যদিও), আর মজার ব্যাপার হলো, যখন বাস এলো, তখন দেখা গেল আমাদের পিছনের সীটগুলোই ওদের। নন এ/সি বাসের বিলাসবহুল ব্যবস্থা, প্রশস্থ সীট দেখে আমরা সবাই-ই একটু বেশি খুশি। গাড়ি খুব সুন্দর করে চালালেন ড্রাইভার। সন্ধ্যা ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেই বাস ছাড়লো ১৯:৩৩। রাত ২২:১৭ কুমিল্লায় বিরতি দিলো। গভীর রাত ৩:০০টায় আমরা চট্টগ্রাম ষোলশহর। ভোর ৫:০০টা নাগাদ আমরা হারবাং নামক স্থান পার হলাম – এখান থেকে কক্সবাজার ৬৭কিলোমিটার। এরপর সম্ভবত নতুন করা লিংক রোডে উঠলাম আমরা, এখান থেকে টেকনাফ ৭০কিলোমিটার। ভোর ৮:৩০ আমরা টেকনাফে, কুতুবদিয়া ঘাটে নেমে পড়লাম। কুতুবদিয়া ঘাট, ৫টা আলাদা আলাদা জাহাজ ঘাটের একটা, যেখান থেকে কুতুবদিয়া নামক জাহাজ ছেড়ে যাবে। পরে জেনেছি, এই ঘাটগুলো সীট্রাক সূচক জাহাজগুলোর জন্য বানানো ঘাট এবং মূল টেকনাফ শহর থেকে বেশ আগে। ঘাটগুলো পাশাপাশিই।

টেকনাফ জাহাজ-ঘাট থেকে একসাথে ছাড়লো পাঁচটা জাহাজ, তারপর নাফ নদী ধরে চলা (ছবি: নিশাচর)
টেকনাফ জাহাজ-ঘাট থেকে একসাথে ছাড়লো পাঁচটা জাহাজ, তারপর নাফ নদী ধরে চলা (ছবি: নিশাচর)

এখানে নেমেই আগে সীট্রাকে টিকেট করলাম, এগুলো হলো এক্সট্রা সীটের টিকেট, মানে ডেকে পাতা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রোদ খেতে খেতে যাওয়া। টিকেট কাটা শেষে এখানে টয়লেট সেরে বন্ধুদের সাথে নাস্তা করলাম। জাহাজে উঠার ব্যাপারটা রীতিমতো কড়া প্রহরার বিষয় – তিন দফা টিকেট চেক করা হলে জাহাজে উঠলাম। ৯:৩০-এ এম ভি কুতুবদিয়া ছাড়লো। সাথে সাথে পরপর বাকি চারটি জেটি থেকে অন্যান্য জাহাজগুলোও ছাড়লো— কাজল, এম ভি বে ক্রুযার ১, কেয়ারি সিন্দবাদ, কেয়ারি ক্রুয অ্যান্ড ওয়ান (?), এম ভি কুতুবদিয়া। এদের মধ্যে কুতুবদিয়াই সবচেয়ে বড় মনে হলো।

ও, আরেকটা কথা, বন্ধু ইফতি’র এক বন্ধুবর সহকর্মীও আমাদের সাথে যাচ্ছেন জাহাজে, নাম ওমর ফারুক। জাহাজ ছাড়ার পরে নাফ নদী ধরে সমুদ্রের দিকে যাত্রাটা দেখার মতো দৃশ্য, বিশেষ করে সকালের রোদে। কারণ টেকনাফে অনেক অনেক উঁচু নাঙ্গা পাহাড় আছে। তার সামনে নদীর কোল ঘেষে আছে গাছের সারি, আর তারও সামনে নদীতে জেলেদের মাছধরা নৌকা আর মাছ ধরার দৃশ্য, আর সর্বপশ্চাতে দিগন্তে নীল অবারিত আকাশ – এই দৃশ্য দেখার মতো।

দূরে টেকনাফের নাঙ্গা পাহাড়, সামনে গাছের সারি, তারও সামনে মাছ ধরছেন একজন জেলে - প্রকৃতি ও জীবনের মেলবন্ধটা অপূর্ব (ছবি: নিশাচর)
দূরে টেকনাফের নাঙ্গা পাহাড়, সামনে গাছের সারি, তারও সামনে মাছ ধরছেন একজন জেলে – প্রকৃতি ও জীবনের মেলবন্ধটা অপূর্ব (ছবি: নিশাচর)

আমি ডেকের সীট কাটলেও ব্যাগগুলো বন্ধুদের সাথে রেখে বাইরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আড়াই ঘন্টার যাত্রাপথ কখন যে উড়ে উড়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।আমি আমার গিন্নীকে নদীর জলের রং দেখালাম – সবুজাভ নীল। সেই সবুজাভ নীল জল কেটে সাদা ফেনা তুলে দ্রুত গতিতে যখন জাহাজ এগিয়ে চললো, পাশে থাকা জেলে নৌকাগুলো তখন প্রচন্ড দুলুনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আরেকটু সামনে যেতেই অপূর্ব এক দৃশ্য: পাহাড়ের গায়ে কাটা রাস্তা দিয়ে টেকনাফ থেকে ট্রাক, বাস যাচ্ছে – নদীসমতল থেকে বেশ খানিকটা উপর দিয়ে।

পাহাড় কেটে বানানো টেকনাফ শহরে যাবার রাস্তাটা (ছবি: নিশাচর)
পাহাড় কেটে বানানো টেকনাফ শহরে যাবার রাস্তাটা (ছবি: নিশাচর)

দৃশ্য দেখে কুল পাচ্ছি না, নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছি এই প্রকৃতির অবারিত মুগ্ধতায়, এমন সময় যদি কেউ বিভিন্ন দেশের সাথে এদেশের তুলনা করে ‘এদেশকে দিয়ে কিছুই হবে না’ ‘ওমুক দেশের মতো ওরকম হলে ভালো হতো’ ‘পাশের দেশেই এটা দেখেছি, ওটা দেখেছি’ বলতে থাকে – তখন মেজাজটা কেমন হয়? ফারুক ভাই গাল্পিক মানুষ, বিভিন্ন দেশও ঘুরেছেন, আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যখন এসব গান গাচ্ছিলেন তখন আমার বেশ মেজাজ খারাপ হলো – বেচারাকে মুখের উপরই বলে দিলাম: ‘ভাই আমি এসব আলোচনা করি না, প্রশ্রয়ও দেই না। কারণ এগুলোতে আসলে সত্যিকার কোনো ফায়দা হয় না। আমি ততটুকুই বলি, যা আমি নিজে করি।’ হয়তো তিনি মন খারাপ করলেন, কিন্তু চুপ করে গেলেন। স্বীকার করলেন, সত্যিই এসব আলোচনায় দেশের কানাকড়িও ফায়দা হয় না (পরে কষ্ট লাগলো বেচারার জন্য, বেচারা হয়তো এভাবে গল্প জমাতে চাইছিলেন, একটু বেশিই জমে গেছে)। নাফ নদী আর তার প্রতিবেশের সৌন্দর্য্যে এবার আমি আমার গিন্নীর সাথে হারিয়ে গেলাম – কেননা এই নারীর জন্য জীবনের প্রথম সমুদ্রদর্শন হতে যাচ্ছে এটা…।

নাফ নদীর এক পাশে বাংলাদেশের টেকনাফ অপর পাশে মিয়ানমারের আরাকান। আমরা যেদিকে দাঁড়িয়ে এদিক থেকে টেকনাফ দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার আড়ালে। কিন্তু নড়ছি না, কারণ এখানে শান্তিতে দাঁড়িয়ে আছি, নড়লেই কেউ এসে জায়গাটা জুড়ে নিবে – কেউই ভিতরে গিয়ে বসতে রাজি না, সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের লু হাওয়ায় ভেসে যেতে চায়।

নাফ নদীর জল কেটে সাদা ফেনা তুলে চলা জাহাজগুলো... (ছবি: নিশাচর)
নাফ নদীর জল কেটে সাদা ফেনা তুলে চলা জাহাজগুলো… (ছবি: নিশাচর)

মেজাজ খারাপ হলো, যখন উপর থেকে কারো ছুঁড়ে দেয়া চিপ্‌সের প্যাকেট, চকলেটের খোসা, পানির কিংবা সফ্‌ট ড্রিংক্সের প্লাস্টিকের বোতল নদীতে পড়তে দেখলাম। মানা করেও অনেককেই নিরস্ত করতে পারলাম না। …নাফ নদী থেকে বেরিয়ে যেই না সমুদ্রে পড়েছি, আশা করেছিলাম উত্তাল ঢেউ দেখতে পাবো, কিন্তু নিরাশ হলাম। মার্চের শেষেও উত্তাল ঢেউয়ের দেখা পেলাম না। মনে হয় আমার নৈরাশ্য দেখেই হঠাৎ কোত্থেকে কঁক কঁক চিঁ চিঁ করে একঝাঁক সাদা বকের মতো পাখি উড়ে এসে আমাদের জাহাজের সাথে সাথে উড়তে থাকলো (এদেরকে সী গাল (sea gull) বলে)। পাখিগুলো ধবধবে সাদা, সামনে চোখা ঠোঁট, ডানার শেষ মাথা আর মুখের অংশটা কালো, দেখতে কবুতর কিংবা বক বলে মনে হয়। জলে যখন ভাসতে থাকে, তখন এঁদেরকে অনেকেই হাঁস বলে ভুল করে। যাহোক, আগেই বিষয়টা জানা ছিল, সামুদ্রিক এই পাখিগুলো খাবার পাবার আশায় জাহাজের কাছ ঘেষে থাকে। ফারুক ভাই বললেন, সামান্য খাবারের আশায় কিরকম ঝুঁকি নিচ্ছে দেখুন, জীবন বাজি রেখে জাহাজের কাছ ঘেষে উড়ছে ওরা।

সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন সমুদ্রে নোঙর করে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ (ছবি: নিশাচর)
সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন সমুদ্রে নোঙর করে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ (ছবি: নিশাচর)

জেনে যান:

  • সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোনো বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া হয়, এবং কোথাও কোথাও দিনের বেলা জেনারেটর দেয়া হয় না
  • প্রচুর মাছ পাবেন খাবার জন্য, সতেজ, তরতাজা, টাটকা – খাবার জন্য আছে কাঁকড়াও
  • দ্বীপের ভিতরে ঢালাই করা পাকা রাস্তা আছে, যেদিক দিয়ে ভ্যানের মতো রিকশা চলে। যেখানে অন্য সময় ৳১০ [টাকা] দিয়ে যাওয়া যায়, সীট্রাক থামার সাথে সাথেই সেখানে ৳১০০-৳২০০ [টাকা] দিয়ে যেতে হবে
  • বাচ্চাদের দেখা পেলেই তারা আপনার থেকে টাকা চাইবে, মনে হবে আপনি টাকার গাছ। কারণ এরা বড্ড বেশি অভাবি, দুবেলা পেট পুরে খাবার আর মাছ ধরা শেষে ফিরে এসে কুঁড়েঘরে একটু ঠাঁই – এতোটুকুতেই এদের জীবন – ভুলেও দয়াপরবশ হয়ে এই জীবন পাল্টাতে যাবেন না, কারণ আপনি আসলে এই জীবন পাল্টাতে পারবেন না, মাঝখানে লোভাতুর কিছু মানুষ তৈরি করবেন
  • হোটেল কিংবা কটেজ ভাড়া – এই দ্বীপে একটি পার্টটাইম ব্যবসা। কারণ এই ব্যবসাটা শুধুমাত্র নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে। বাকি সময়টা এরা এদের মূল ব্যবসায়ে থাকে – মাছ ধরা, মাছের আড়ৎ ইত্যাদি

দৃশ্যটা উপভোগ করার মতো। পাখিগুলো তাদের অ্যারোডায়নামিক শরীর নিয়ে জাহাজের কাছ ঘেষে উড়ছে। কেউ হয়তো বিস্কুট বা চিপ্‌স ছুঁড়ে দিলো, সেটা বাতাসে থাকতেই যদি ধরা যায়, তাহলে বাকি পাখিদেরকে এড়িয়ে খাওয়া গেল, তাই প্রতিযোগিতাটা সেখানেই বেশি। একটু সুন্দর করে উড়িয়ে মারতে পারলে উড়ন্ত অবস্থায়ই মুখে নিয়ে নিতে পারে পাখিরা। যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের তীক্ষ্ণ চোখ সমুদ্রের ফেনীল জলে কোথায় একটা চিপ্‌সের টুকরা পড়ে আছে, সেটা দেখে রাখতে জানে। উড়তে উড়তেই হঠাৎ সাঁই করে একটা অকষ্মাৎ ইউ-টার্ন নিয়ে তারা ফিরে গিয়ে পড়ে থাকা চিপ্‌সের টুকরাটা খেয়ে নিতে পারে। অনেকক্ষণ এরা আমাদের সঙ্গ দিলো। সঙ্গটা ভুলিয়ে দিলো এই আড়াই ঘন্টার দাঁড়িয়ে থাকার যদি কোনো ক্লান্তি থেকে থাকে। আমার গিন্নীতো পাখির মতো উড়তেই চাইছিলেন।

এবারে তাকে আবারো জলের রং দেখালাম – সবুজাভ রংটা নেই, পানিতে নীলাভ ছোঁয়াটা বেশি। তাকে বললাম সেন্ট মার্টিনের এখানেই কৃতীত্ব – এখানে এখনও নীল জল আছে। কিন্তু যেভাবে পর্যটকরা আবর্জনা ফেলছেন, কে জানে কদ্দিন থাকবে এসব। …একসময় দূরে দেখা গেলো নীল তটরেখার মধ্যে সবুজ একটা সরলরেখা যেন ভেসে আছে। দেখে মনে হতে পারে কচুরিপানার একটা বড় দল ভেসে আছে বুঝি – আসলে ওটাই আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ – নারিকেল জিঞ্জিরা।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (Saint Martin’s Island), প্রচুর নারিকেল গাছ থাকায় এর আরেক নাম নারিকেল জিঞ্জিরা বা নারকেল বাগান, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার, টেকনাফ উপজেলার অন্তর্গত একটি দ্বীপ এবং ইউনিয়ন – খাতায়-পত্রে ৬নং সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন (ভৌগোলিক স্থানাংক: ২০°৩৮′১.৯১″ উত্তর অক্ষাংশ ৯২°১৯′৩৬.৯৬″ পশ্চিম দ্রাঘিমাংশ)। বাংলাপিডিয়া মতে, দ্বীপটি সমুদ্রসমতল থেকে মোটামুটি ৩.৬ মিটার উঁচু, আর প্রতি বছর গড়ে ১৯ মিলিমিটার করে উঁচু হচ্ছে। এটি প্রবাল দিয়ে গঠিত একটি দ্বীপ। প্রবাল একপ্রকারের সামুদ্রিক প্রাণী। এরা একত্রে বাস করে, আর চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের স্তর তৈরি করে, যা তাদের মৃত্যুর পর শক্ত আবরণে রূপ নেয়। এভাবেই বিশুদ্ধ পানিতে এরা আবাস গড়ে, আর তাদের মৃতদেহ জমে হয় বিশাল, বিশালতর ভূমি – তৈরি হয় দ্বীপ – প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপের সবচেয়ে প্রাচীন প্রবাল জীবাশ্মটি কার্বন ডেটিং (c14) অনুযায়ী প্লাইস্টোসিন যুগের বলে সনাক্ত করা হয়েছে, যার বয়স ৩৩,২৩৮ বছর (তেত্রিশ হাজার… পুরাই মাথানষ্ট)। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আয়তন মাত্র ৮ বর্গ কিলোমিটার। তথ্যপ্রমাণ না পেলেও এরকম পেলাম যে, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এখানে ব্রিটিশদের পরিচালিত ভূজরিপের সময় খ্রিস্টীয় সাধু মার্টিন (Martin of Tours)-এর নাম দিয়ে দ্বীপটিকে নামকরণ করেন তাঁরা। মজার বিষয় হলো, ‘সেন্ট মার্টিন’ নামে পৃথিবীতে আরো একটা দ্বীপ আছে, উত্তর আমেরিকার ক্যারিবীয় অঞ্চলে, পুয়ের্তো রিকো’র পূর্বে; তাই একে সেন্ট মার্টিন’স আইল্যান্ড, বাংলাদেশ বলা ভালো। দ্বীপের প্রায় শতভাগ মানুষ মুসলমান এবং সেখানে মসজিদ-মাদরাসাও আছে। দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবিকার মূল উৎস সামুদ্রিক মাছ শিকার, বিক্রী, কিংবা তা থেকে তৈরি শুঁটকি বিক্রী। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এদ্বীপে পর্যটকরা আসা-যাওয়া করেন। স্থানীয়দের বক্তব্য, এখানে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা আসে, তবে ধরা পড়লে তাদের বিপদই হয়।

দ্রষ্টব্য: গুগল মানচিত্রের উপরে এই মানচিত্রটিতে বিভিন্ন স্তর যোগ করে শুধু কিছু স্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র। এক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ছবি, ভ্রমণ বর্ণনাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর সবগুলো নিখুঁত – এমন দাবি করছি না। বিশেষ করে, সমুদ্র বিলাসের অবস্থানটা আমার মতে অঠিক – এটি আরো পশ্চিম দিকে হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্র বিলাসের অবস্থান ঠিক করা হয়েছে। (হালনাগাদ: অক্টোবর ২০১৭)

একসময় দ্বীপটা আরো এগিয়ে এলো, দ্বীপ থেকে অদূরেই দেখা গেল নৌবাহিনীর একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সীমান্ত প্রহরা কিংবা সামুদ্রিক জরিপ যেকোনো কিছুই উদ্দেশ্য হতে পারে। বে ক্রুযার-১ দেখা গেলো আমাদের পরে রওয়ানা করলেও আমাদের আগেই জেটিতে গিয়ে থামলো। দ্বীপে একটাই নৌ জেটি, জেটিতে লাগলে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়, কারণ বড় বড় রশি দিয়ে জাহাজটা প্রথমে জেটিতে বাঁধতে হয়। তারপর সবাই দোতলায় গিয়ে র‍্যাম্প দিয়ে জেটিতে নামেন। জেটিতে নেমেই র‍্যাম্প ধরে হেঁটে গিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পা রাখতে হয়।

দ্বীপে পা রাখার বিষয়টা যতটা না উপভোগ্য, তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর – কারণ পাঁচটা শীপের মানুষকে বরণ করতে এখানে ডাকাতরা হাজির। আমরা যে কটেজে উঠবো, সেখানকার কর্তাকে ফোন করলাম, তিনি ঘাঁটেই আছেন। আমাদেরকে দেখে রিকশা ভাড়া করতে গেলে ভাড়া চাইলো ৳২০০ [টাকা]। যেহেতু আগে থেকে ম্যাপ ঘেঁটে গিয়েছিলাম, তাই ফাঁদে পা দিলাম না। পায়ে হেঁটে খুঁজে নিলাম উত্তর-পশ্চিম দিকে থাকা ‘জারিফ রিসোর্ট’। আহামরি কিছু নয়, টিনের চালের স্কুলঘরের মতো এল-শেপের ঘর। আমাদের যদিও তাবুতে থাকার কথা ছিল, আর এজন্য ইকো ট্র্যাভেলার্সের আবুবকরের কাছ থেকে ধার করে একটা তাবুও এনেছি, তবু চারটে রুম রাখা হয়েছে পুরো দলের জন্য। যদিও ও’দলে চৌদ্দজন আছে, আমরা তিনজনও কিন্তু তাদের সাথেই সামিল হবো।

রুমে ঢুকে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, কারণ বিদ্যুৎ নেই, তার উপর অপর্যাপ্ত জানালা, আর টয়লেটে কোনো জানালা তো নেই-ই ভেন্টিলেটারটাকেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হচ্ছে। প্রচন্ড রৌদ্রতপ্ত দিনে ফকফকা আলোর মধ্যেও টর্চ জ্বেলে টয়লেটের কাজ সারতে হচ্ছিল।

গরমে আর ভাল্লাগছে না – জেনারেটরও নাকি নষ্ট; সৈকতটা একবার দেখতে গেলাম আমার দুজন, ইচ্ছে ছিল ফিরে এসে গোসলের প্রস্তুতি নিয়ে যাব, কিন্তু সেখানে গিয়ে আর তর সইলো না। ভেসে থাকা প্রবালের পাথরের উপর গামছা, মোবাইল, চাবি রেখে ডুবতে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের দিকে – যেনবা আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে এক দম্পতি। আমার গিন্নীর জীবনে এই প্রথম সমুদ্রদর্শন – ভয়ে কাচুমাচু অবস্থা। সাহস দিয়ে যখন বেশ খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম তখন তো সে এক মহাযজ্ঞ – অপূর্ব অনুভূতি তার – তার এই খুশিতে ভরা চোখ আমি জীবনেও ভুলবো না।

Danger Icon সেন্ট মার্টিন যেহেতু পুরোটাই একটা দ্বীপ, তাই চারদিকেই সৈকত। এতদিন কেউ না জানলেও ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে দ্বীপের উত্তর পাড়ার উত্তর দিকের সৈকতে ৪জন ছাত্রের মৃত্যুর পর তা দ্বীপের সৈকতের বিপদজনক এলাকা বলে চিহ্নিত হয়েছে। নাজমুল হাসান মেহেদি’র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ একটি ব্লগপোস্ট^ (Archive Icon - বাক্সবন্দী) থেকে (এটি ছিল মূল পোস্ট – এর পর এর উপর অনেক রং চড়িয়ে রিপোস্ট হয়েছে), মৃত্যু থেকে ফিরে আসা জাওদাত রহমানের এই ফেসবুক নোট^ (Archive Icon - বাক্সবন্দী) থেকে, এবং বাংলাভিশনে প্রচারিত তাদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে কোস্টগার্ডের একজন উদ্ধারকারীর বক্তব্য অনুসারে আমি আমার দেয়া মানচিত্রে তিনটি জায়গাকে বিপদজনক অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছি। শোনা যায়, আবার বলছি, শোনা যায়, সেখানে সৈকত খুব বেশি বিস্তৃত নয়, এবং সেখানে গর্ত রয়েছে, এছাড়াও নাফ নদী, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর – এই উভয় সংকটে উত্তর পাড়ার ঐ অংশটিতে, জলের তিনটি আলাদা স্রোতপ্রবাহ তৈরি হয়েছে, যা যেকোনো ব্যক্তিকে সাঁতার কাটার সময় বিপদে ফেলতে পারে – তা তিনি সাঁতার জানা ব্যক্তিও হতে পারেন। তবে, জিয়া হাসানের মতে, এটি রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোতের একটি ক্ষেত্র, তাঁর বক্তব্যটি তাঁর ফেসবুক নোট^ (Archive Icon - বাক্সবন্দী) থেকে বিস্তারিত জানা যাবে। যাবার আগে তিনি কক্সবাজার এলাকার জোয়ার-ভাটার তথ্য দেখে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। দেখুন: কক্সবাজার এলাকার সাগরে জোয়ার ভাটার তথ্য^। (ভিডিও দেখা যাবে এখানে^)

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফারুক ভাইও একটু দূরের ওদিকটাতে গিয়ে নামলেন জলে। বেচারাকে না বলেই চলে এসেছি, আসলে আমরা তো গোসলের উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। বেশিক্ষণ ডুবলাম না, উঠে গিয়ে সাধু পানি দিয়ে নোনা জল ছাড়ালাম। কটেজে, জেনারেটর ছেড়ে মোটর দিয়ে উপরের টাংকিতে পানি তোলা হয়, এছাড়া একটা টিউবওয়েলও আছে। …এখানে প্যাকেজ পদ্ধতিতে খাওয়া-দাওয়া। পাশের ময়নামতি কটেজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে জনপ্রতি ৳১৫০ [টাকা] দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম তিনজনে। শর্ত হলো: ভাত, সবজি, সালাদ আর ডাল যত-ইচ্ছা-তত, কিন্তু মাছ যেকোনো এক পদের নিতে হবে, এর মধ্যে আছে কোরাল মাছের ঝুল দিয়ে রাঁধা তরকারি অথবা রূপচাঁদা মাছের মচমচা ভাজি। আর বয়লার মুরগির মাংস খেলে ৳১৪০ [টাকা]। সমুদ্রের পাড়ে এসে শহুরে বয়লার দিয়ে খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কোরাল মাছ দিয়ে খেলাম। এখানে পানি খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না, পানিতে আয়রন কম, কেমন যেন পানশে লাগে।

Tips Iconভাটার সময় নামবেন না। যদি বিপদে পড়েই যান, ভাটার টানে যদি আপনি সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকেন, তা আপনি সাঁতার জানেন কিংবা না জানেন, বিচলিত না হয়ে শান্ত থাকুন। এব্যাপারে স্কাউটের শিক্ষা আমার সাথে শেয়ার করেছেন স্কাউট আসিফ, তিনি জানান, এসময় ডুব দিয়ে দিতে হবে, এবং নিচের বালিতে গিয়ে তলা আঁকড়ে বসে থাকতে হবে। যখনই বোঝা যাবে উপরের ঢেউটা আপনার পিছনে চলে গেছে, তখনই সাঁতরে সামনে এগোতে হবে। এরকম একাধিকবার করলেই তীরের কাছাকাছি চলে আসা যাবে। আর, উল্টো স্রোত (Rip Current) থেকে বাঁচার পন্থা হিসেবে জিয়া হাসান লিখেছেন: “যারা সাঁতার জানেন তারা রিপ কারেন্টে পড়লে, উল্টোদিকে তীরের  দিকে না গিয়ে সৈকতের সমান্তরালভাবে উল্টো স্রোত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। কারণ, সাগরের স্রোত যখন টান দিবে তখন শক্তি দিয়ে স্রোতের বিপরীতে ফেরা যাবেনা।” {ছবিসহ বিস্তারিত: ফেসবুক নোট^ (Archive Icon - বাক্সবন্দী)}

খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে এসে একটু জিরিয়ে তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম সৈকত পরিভ্রমণে। আমাদের কটেজের সাথেই উত্তর দিকের সৈকত। ফারুক ভাই মানুষটা গাল্পিক বলে সময়টা ভালোই কাটলো। আমরা হেঁটে হেঁটে দ্বীপের পশ্চিম সৈকত হয়ে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলাম। সৈকতে জোয়ারের পানি উঠছে ধীরে ধীরে। এর ফাঁকে সৈকত জুড়ে কাঁকড়ার বাবুরা সুন্দর করে শিল্পকর্ম করেছে, কক্সবাজার থেকে ফিরে সেটা আলোচনাও করেছিলাম। …অনেক অনেক কটেজ এদিকে, ওদিকে – কটেজ ব্যবসাটা এখানে বেশ চাঙা মনে হচ্ছে। একসময় হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি, মানে সমুদ্র বিলাসের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। রঙিন কাঠের বেড়া দিয়ে বানানো কয়েকটা টিনের ঘর ভাড়া দেয়া হয় এখানকার রক্ষণাবেক্ষণকারীর পক্ষ থেকে। শুনেছি এখানে নাকি সীট পাওয়াই দুষ্কর। বাঁশের তৈরি ফটকে সাইনবোর্ড টাঙানো: ‘কটেজ এর বোর্ডার ব্যতিত অন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ’ – সোজা বাংলায়: দূরত্ব বজায় রাখো।

কোথাও আবার কেয়া গাছ কিংবা নারিকেল বাগানের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে স্থানীয়দের জীর্ণশীর্ণ ঘর। এদের ঘরগুলো দোচালা না, বরং দোচালার নিচে চৌচালা। কোনোরকমে বাঁশের বেড়ামতো ছাত আর শুকনো নারকেল পাতা দিয়ে চাল ছাওয়া। এখানে একটা টেকনোলজি আছে: বিষয়টা প্রথম আমার নজরে আসে একটা বাংলা ছায়াছবি দেখার পর, যদ্দুর মনে পড়ে একটা ঘূর্ণিঝড় সমাগত ছিল, রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনেতা ছিলেন, ঐ ছবিতে দেখেছিলাম, ঘরটা নিচু কিন্তু তার মাঝখানটা গম্বুজের মতো উঁচু। চালগুলো মেঝের খুব কাছাকাছি এসে মিশেছে, নিচু হয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। তখনই বুঝেছিলাম বাংলাদেশীদেরকে যে ‘চিরসার্ভাইভার’ বলা হয় তার পিছনে এই সাদামাটা অ্যারোডায়নামিক গৃহনকশাটাও একটা অংশ। সমুদ্র থেকে আসা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাস, নারিকেল গাছ কিংবা কেয়া গাছের দেয়াল ভেদ করে যা একটু ঘরের চালে লাগবে, তাও ভূমির কাছাকাছি চালে এসে লেগে উপর দিয়ে বয়ে চলে যাবে, চাল উড়িয়ে নিবে না। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের এই টেকনোলজিটা আমি নোয়াখালির নিঝুম দ্বীপেও দেখেছি। ‘টেকনোলজি’ শব্দটা বললে যারা এখনও লোহার কলকব্জা, যন্ত্রপাতি আর সার্কিট কল্পনায় ভাসান, তারা এসব টেকনোলজি দেখেও দেখেন না।

সেন্ট মার্টিনে প্রচুর বেওয়ারিশ কুকুর আছে (ছবি: নিশাচর)
সেন্ট মার্টিনে প্রচুর বেওয়ারিশ কুকুর আছে (ছবি: নিশাচর)

দ্বীপে বেওয়ারিশ, মানে মালিকবিহীন কুকুর আর কুকুর – দল বেঁধে যখন দ্বন্দ্বযুদ্ধ আর দৌঁড়ে মত্ত হয়, তখন মনে হয় আফ্রিকার সেরেঙ্গেতিতে সিংহের পাল দৌঁড়াচ্ছে। 🙂 …দ্বীপের একটা জায়গায় বেড়া দিয়ে সামুদ্রিক কচ্ছপদের ডিম পাড়ার জন্য আবাস করে দেয়া হয়েছে। সেখানে বরফি-আকৃতির সাইনবোর্ডে লেখা: Sea Turtle Nesting Beach, সতর্ক করে বলা আছে: সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার সৈকত, রাতে কোনো আলো জ্বালবেন না। এটা Marinelife Alliance-এর Sea Turtle Project Bangladesh-এর উদ্যোগে লাগানো। নিচে তাদের সাথে যোগাযোগের তথ্য দেয়া।

এখান থেকে আমরা আর সামনে না এগিয়ে দ্বীপের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। এখান থেকে ভিতরে ঢুকে মেঠো জমির ভিতর দিয়ে দ্বীপের অপর পাশটাতে (মানে উত্তর-পূর্ব পাশটাতে) গেলে কোস্ট গার্ড স্টেশন এবং ভিতরে তাদের হেলিপ্যাড চোখে পড়বে। আমরা অপরপাশের সৈকত ধরে ফিরতি পথ ধরলাম। কোস্ট গার্ড স্টেশন থেকে আরো দক্ষিণ দিকে গেলে পড়বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ফরওয়ার্ড বেস সেন্টমার্টিন আর [সম্ভবত নৌবাহিনী পরিচালিত] কটেজ কোরাল ভিউ

ডাঙায় তুলে রাখা একটা ট্রলার - পিছনে হাতের ছাপগুলো এঁদের নন্দনতত্ত্বের বিষয়ে আকৃষ্ট করে আমাকে (ছবি: নিশাচর)
ডাঙায় তুলে রাখা একটা ট্রলার – পিছনে হাতের ছাপগুলো এঁদের নন্দনতত্ত্বের বিষয়ে আকৃষ্ট করে আমাকে (ছবি: নিশাচর)

ফিরতি পথে চোখে পড়লো, দুজন জেলে মিলে টানা জালে মাছ ধরছেন। একজন জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অপরজন মাছের ঝাঁক পেরিয়ে কিছুদূর সমুদ্রের দিকে গিয়ে আবার তীরের দিকে এসে মাছগুলোকে কোণঠাসা করে জাল টেনে ধরে ফেললেন। সাথে কিছু কাঁকড়াও উঠলো। আরেকটু সামনে একজনকে দেখা গেল, সাম্পানের (সামুদ্রিক নৌকাকেতো এই নামেই ডাকে বলে জানি) দুই তক্তার ফাঁক বন্ধ করছেন তুলার সলতে, মুগুর আর বাটাল দিয়ে, চেপে চেপে। তুলার সলতে দিয়ে পাটাতনের ফাঁক বন্ধ করার বিষয়টি আমি এর আগে দেখিনি। আমাদের সিলেটে পাটাতনের ফাঁক বন্ধ করার জন্য কাঠের গুড়া আর আলকাতরা মিশিয়ে একটা মিশ্রণ বানানো হয়।

কটেজে ফিরে আমাদের সৈকত থেকে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখলাম। এখানেই এক খালি গা বল্টু, কমলা হাফ প্যান্ট পরে এগিয়ে এলো আমাদের হাতে চিপ্‌সের প্যাকেট দেখে। তাকে বাকি চিপ্‌সটুকু খেতে দেয়া হলো। সে বালুর মধ্যে দুই পা ছড়িয়ে বিশাল আ-রা-মে দাঁড়িয়ে চিপ্‌স খেতে থাকলো। তাকে বললাম, খাওয়া শেষ হলে চিপ্‌সের প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে যেতে। ফারুক ভাই তখন পাশ থেকে ফোড়ন কাটলেন, তুই চিপ্‌সের প্যাকেট ফেরত দিলে উনি তোরে ট্যাকা দিব। ব্যস, সে চিপ্‌সের প্যাকেট ফেরত দিয়ে আমাদের পিছু আর ছাড়ে না, কোনোভাবেই বোঝানো গেল না যে, চিপ্‌সের প্যাকেটের বিনিময়ে টাকা হয় না। আর এভাবে কথায় কথায় টাকা দিতে থাকলে এদের অভ্যাসও খারাপ হয়ে যাবে। সৈকতেই মাগরিবের নামায পড়ে কটেজে ফিরলাম।

এদিকে আমাদের দ্বিতীয় হেকটিক দলটার সাথে যোগাযোগ হয়, তো হয় না। আসর নাগাদ তারা তখনও বাসে। কারণ ট্রেন থেকে নেমে তাদের ভাড়া করা বাসটা প্রথমে যাবে কক্সবাজারে, তারপর লোক নামিয়ে আসবে টেকনাফে। সেখান থেকে ট্রলার ভাড়া করে তারা আসবে সেন্ট মার্টিনে। রাতের অন্ধকারে মার্চের সমুদ্রে একঝাঁক ছেলে-মেয়ে ট্রলারে জীবন বাজি রেখে আসছে ভাবলেই গা শিওরে উঠে। যখন সূর্যাস্ত হচ্ছিল নাকিব তখন জানালো, ওদের আরো দেরি হবে ট্রলারে উঠতে, তবে ওরা টেকনাফে। ফোন ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে আমাকে বললো, ওরা ট্রলারে উঠছে এখন।

এদিকে আমরা তিনজন ওদের অপেক্ষায় সেন্ট মার্টিনের জেটিতে অপেক্ষা করছি অন্ধকারে। গল্প করছি, আর কল্পনা করছি, গতকাল রাত ১০:৩০ থেকে আজ রাত ৯:৩০ পর্যন্ত এই টানা ১১ ঘন্টার যাত্রাপথ কেমন হচ্ছে – নিশ্চয়ই সবগুলোকে ঘাট থেকে কোলে করে নিয়ে যাওয়া লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা সাথে তিনজন নারীও আছেন। ঘাটের কাছাকাছি একটা ট্রলার ভিড়তে দেখা যাচ্ছে, ঐ যে দূরে একটা বাতি জ্বলুনিভু করছে। এখানকার ট্রলারগুলো অন্ধকারে চলে না, তাদের আগে পিছে কিংবা শরীরের কোনো একজায়গায় একটা কিংবা দুটা লাল/সবুজ বাতি লাগিয়ে রাখে, বাতিগুলো জ্বলুনিভু করে জানান দেয় এখানে একটা ট্রলার আছে। এতো রাতে ট্রলার আসবে কোত্থেকে, অবশ্যই আমাদের দলটাই। হাতের টর্চ জ্বেলে নিভিয়ে সিগন্যাল দিলাম। কিছুক্ষণ পরে সিগন্যালের প্রত্যুত্তর পেলাম। ট্রলার এসে ঘাটে ভিড়লো, বিশাল একটি এলইডি চার্জার বাতি জ্বালালো নাকিব – সব ফকফকা।

ঘটনা দেখা গেল উল্টো – সবগুলো চিল্লাহল্লা করে একাকার – হেকটিক ট্যুরের উত্তেজনায় উত্তেজিত সবাই-ই, এগারো ঘন্টার জার্নি তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি – বোধহয় একেই বলে যৌবনকাল। সবাই-ই দেখা গেল বসে কিংবা দাঁড়িয়ে এখানে-ওখানে। শুধু শান্ত বসে আছে এক কোণায় কাঠের বাক্স একটাকে কষে ধরে রেখে। আর ইমরান একপাশে শুয়ে আছে মোবাইল ফোনে ফেসবুক চালাতে চালাতে। নাকিব বলে, আরে, ট্রলারে দুলাদুলি করতে করতে যদি ফেসবুকে চেকইন করা না যায়: I’m in mid-sea, bumping on waves, on a troller under starry night sky – তাহলে তো আর ফেসবুকে ভাব্‌য হয় না।

যেন কতদিন পরে আমাদের সাথে দেখা: বিয়ের এই সাতমাস পরে অবশ্য তারা আমার গিন্নীকে দেখছে আবার। ভাবির সাথে নতুন করে পরিচিত হবার পালা তাদের। সবার সাথে পরিচিতি শেষে তাদের বোঁচকাবাচকি নিয়ে, পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম কটেজে। সেখানে গিয়ে শুনলাম তাদের Life of Pi-এর সমুদ্রযাত্রার রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত। রাতের অন্ধকারে সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রযাত্রার সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী এখনও আপনাদের শোনানো বাকি…।

(চলবে)

পরের পর্ব »

-মঈনুল ইসলাম

২ thoughts on “সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ ২০১৪

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*