পাহাড়ি-বাঙালি সম্পর্ক

(বন্ধু সাকিবের সাথে ই-মেইলালাপ)

সাকিব,

আসসালামু আলাইকুম।
ভাই, তুমি আমাকে বহুদিন আগে একটা কথা বলেছিলে বান্দরবান থেকে এসে:

পাহাড়িরা আসলে যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। মানুষ মনে করে উল্টো। সরকার তাদেরকে পাহাড় ধ্বংসের জন্য দায়ী করে, আসলে তারা আরো ভালো জানে কিভাবে পাহাড়কে রক্ষা করতে হয়।

এই কথার সাথে আরেকটা কথা বলেছিলে:

পাহাড়িরা খুব বন্ধু-বৎসল। তাদেরকে যতটা খারাপ মনে করা হয় ততটা না।

কথা দুটো হুবহু তোমার কথা না হয়তো, কথার নির্যাস। কথাদুটো আমি খুব মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে চেয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো কারণে আমি ঠিক সেটা আর বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি পাহাড়িরা আমাদের থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব। তবে সম্পূর্ণ না। কারণ:

  1. বান্দরবান গিয়ে আমি এক বাঙালির সাথে পরিচিত হই, নাম: গোলাম কবির চৌধুরী (৩৪)। তিনি আমাদেরকে বললেন পাহাড়িদের সাথে তাঁর যুদ্ধের কথা। তিনি বান্দরবানে বাঙালির আধিপত্য বিস্তারে সংগ্রাম করছেন। তিনি তো ইংরেজিতে এককথায় বললেন: “They are very inferior to the wild beast”। জানালেন পাহাড়িরা তাঁর অধীনে কাজ করতো, তিনি তাদের ভরণপোষণ দিতেন, তাদের সন্তানাদির লেখাপড়ার খরচ বহন করতেন, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর ক্ষতি করে পালায়। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে তিনিও তোমার-আমার মতো একজন বাঙালি, তাই পাহাড়িদের প্রতি স্বভাবতই তাঁর নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ। তিনি হয়তো যতটা মমতার কথা বলছেন, তার তিনগুণ অবহেলা দেখিয়েছেন তাদের প্রতি। হয়তো পাহাড়িদের এলাকায় বসতি করতে চাচ্ছেন বলে তারাও রিভেঞ্জ করছে… কিন্তু তারপরও কথা থাকে, তিনি যা বলছেন, তার সব মিথ্যা হতে পারে না। পাহাড়িরা সত্যিই হয়তো এর ১০% করে।
  2. আমার সিলেট এলাকায় খাসিয়ারা বাস করে। মাধবকুন্ডের থেকে আমার বাড়ি খুব বেশি দূরে না। তাই খাসিয়াদের সাথে বাঙালিদের চলাফেরার কাহিনী আমি কম-বেশি শুনেছি। খাসিয়াদের সম্বন্ধে বাঙালিদের সাধারণ যেই মত, তাতে তাদেরকে ডেপিক্ট করা হয় বড় রাম দা হাতে একদল ডাকাত হিসেবে। তাদের মাথা গরম হলেই নাকি তারা রাম দা বাগিয়ে এগিয়ে আসে। এরকম বহু কথা শুনেছি বহুজনের থেকে। যদিও আমার, তাদের সাথে ইন্টার-একশান তেমন একটা হয়নি, টুকটাক। নিরপেক্ষভাবে দেখলে, হয়তো বাঙালিরা পাহাড়িদের এলাকায় গিয়ে দখলদারিত্ব চালায়, তাই তারা ফেরোশাস হয়ে আক্রমণ করে… কিন্তু তারপরও তারা যে ১০% সত্যিই অন্যায়ভাবে করে না, তা-ও আমি উড়িয়ে দিতে পারছি না।
  3. তুমি যদি আমার বাড়িতে মেহমান হয়ে আসো, তাহলে আমি তোমাকে খাতির-যত্ন করবো, আমি যত খারাপ লোকই হই না কেন, আমি চেষ্টা করবো ফেরেশতা সেজে তোমার সেবা করতে। তাহলে তুমি যখন তোমার বাড়ি যাবে, তখন বলবে, আমি যে বাসায় ছিলাম, সে বাসার লোক ফেরেশতার মতো মানুষ। কিন্তু ধরে নাও আদতে আমি একটা খুনি। …তোমরা ট্রেকিং-এ গিয়ে হয়তো তাদের ভালো রূপটা দেখো ক্ষণিকের জন্য, কিন্তু সেটা সত্যি রূপ না। …কারণ, গ্রামের মানুষকে সবাই বড় আত্মার মানুষ বলে, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে না, মসজিদকেন্দ্রীক কোন্দল, জমিকেন্দ্রীক কোন্দল, এলাকাভিত্তিক কোন্দল শহরের চেয়ে গ্রামে বহুগুণ বেশি। আমার কাছে যদিও স্ট্যাটিস্টিক্স নাই। …তারপরও কিন্তু তোমার-আমার মতো শহুরেদের কাছে গ্রামের মানুষের মতো বড় আত্মার মানুষ আর হয় না।
  4. রাঙামাটি ভ্রমণে গেলে আমাদের গানের আসরে এসে এক কিশোর বসলো। অমায়িক ব্যবহার (অন্তত আপাতদৃষ্টিতে)। ছেলেটা বাঙালি। আমরা বেড়াতে এসেছি জেনে সে আক্ষেপের সুরে বললো, “এখনইতো আসবেন, আর ক’বছর পরে আমরাই তো থাকবো না। সরকার প্রত্যেক বাঙালিকে ১,৫০,০০০ টাকা করে দিয়ে পাহাড় ছাড়তে বলছে।” যদি এটা ‘পাহাড়িস্তান’ না হয়ে ‘বাংলাদেশ’ হয়ে থাকে, তবে কেন বাঙালিকে পাহাড় থেকে উৎখাত? যারা স্থানীয়ভাবে জায়গা কিনে বসবাস করছে, তাদের তো ওটাই মাতৃভূমি। এক্ষেত্রে পার্বত্য এলাকায় বাঙালিরা কিভাবে এক ঘরে হয়ে আছে, বুঝতে পারছো? …কিন্তু তারপরও কিছুদিন্ আগে রাঙামাটিতে পাল্টাপাল্টি হত্যাযজ্ঞের আমি তীব্র নিন্দা জানাই। …যদি বাঙালি গিয়ে পাহাড়িদের খোঁচায়, তাহলে তাদের উচিত, আত্মরক্ষার্থে বাঙালিদের আঘাত করা। …কিন্তু আমার মনে হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বাঙালিকে এমনিতেই শত্রু ভাবে।

জুম চাষের ব্যাপারে তোমার মতটাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। আমিও “শিকারিরাই সবচেয়ে বড় পশু সংরক্ষণবিদ” -কথাটির মতো করে বিশ্বাস করতাম, পাহাড়িরা আমার থেকে ভালো জানে, পাহাড়ের কী দরকার। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমার দাদা একটা গাভীর কী দরকার সেটা যতটা ভালো বুঝতেন, আজ আমি বিজ্ঞানমনষ্ক [অথচ বিজ্ঞানসম্মত না] হয়ে ততটা বুঝি না। তাই অনেক ক্ষেত্রে হয়তো আমি গাভীর প্রতি অবিচার করি। …পাহাড়িরা আসলেও জানতো জুমচাষ করে নিজের পুঁজি সংগ্রহ করতে, আবার এও জানতো কী করে পাহাড়ের খোরাক যোগাতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সেসব জানে না। অনেক ক্ষেত্রে জানলেও মানতে পারে না। আমি পরিবেশ বিষয়ক একটা বইতে পড়েছি, আগে জুমচাষ করার পর ১৫ বছর অব্যাহতি দেয়া হতো ঐ পাহাড়কে। ফলে পাহাড়, আবার তার গুণাগুণ ফিরে পেতো। কিন্তু এখন বাড়তি জনসংখ্যার চাপে, তাদের এতোদিন অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। তারা প্রায় প্রতি বছরই সেখানে ফলায়। এতে করে তারা সত্যিই পাহাড়দ্রোহী হয়ে উঠছে। যদিও তারা আমার বাঙালিদের থেকে বেশি পাহাড় সংরক্ষণ করছে, কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেটা সম্পূর্ণ না।

আমার সিদ্ধান্তে ভুল কী?

——
চিঠিটা এখানেই সমাপ্ত। আমার বন্ধু সাকিবের কোনো উত্তর আমি পাইনি। পরে জিজ্ঞাসা করেছি, সে বলেছে, তার উত্তর জানা নেই। কারো জানা থাকলে জানানোর অনুরোধ থাকলো।

-মঈনুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*