কীর্তিনাশার বুক চিরে এফোঁড়-ওফোঁড়

সৌন্দর্য, বিশুদ্ধতা, আর ক্রমোন্নতির প্রতীক, পবিত্র ফুল ‘পদ্ম’ (Lotus) – সংস্কৃত সেই ‘পদ্ম’ই কি বিদেশীদের বুলিতে হয়ে গেছে পদ্মা (Padma)? উজান থেকে ধেয়ে আসা গঙ্গা আর যমুনা একত্র হয়ে যেনবা আরো এক তেজস্বিনী সে। রাজা রাজবল্লভ (১৭০৭-১৭৬৩) ‘রাজনগর’ পরগণার বিরাণ ভূমিতে নবরত্ন, সপ্তরত্ন, একবিংশ রত্ন প্রভৃতি নামে যেসব সুউচ্চ অট্টালিকার কীর্তি গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, সেই স-ব কীর্তি ১৮৭০-এর দিকে এমন এক নদী এসে গ্রাস করে ফেলে, ১৭৮০ সালে প্রণীত ব্রিটিশ ভূজরিপবিদ বেনেল সাহেবের মানচিত্রেও যার অস্তিত্ব ছিলো না। তাক লাগানো সেসব কীর্তির বিনাশ থেকেই সেই নদীর নাম হয় ‘কীর্তিনাশা’ – ‘পদ্মা’ বললে যাকে চিনবেন অনেকেই।

বইয়ে-পত্রে নদীর গতিপথ হয় চার প্রকারের। সাধারণত প্রাকৃতিক জলধারা এক্কেবারে সরল-সোজা (Straight) হয় না; হলেও খুব অল্প দূরত্ব পর্যন্তই সেটা হয়ে থাকে। কিন্তু নদীর সর্পিলতা (sinuosity) বা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলার কারণে চলমান জলধারা যখন বাইরের দিকটাতে ধাক্কা দিয়ে ক্ষয় করে ফেলে, তখন ভেতরের দিকটাতে জলের চাপ কম হওয়ায় সেখানে পলি জমে হয়ে যায় আঁকাবাঁকা (Meandering)। এমন নদীরা তাই সময়ের বিবর্তনে কোথা দিয়ে বয়ে গিয়েছিলো, তার ছাপও রেখে যায়। সেই আঁকাবাঁকা নদীও আবার কোনো কোনো অংশে চুলের বেনীর (Braided) মতো অসংখ্য ছোট ছোট ধারায় রূপ নিতে দেখা যায়। সাধারণত বেশি ঢালু কিংবা বেশি পলিময় নদীর ক্ষেত্রে এমনটা হতে দেখা যায়। এরকম জলধারার মাঝখানে জেগে থাকে ছোট ছোট অস্থায়ী দ্বীপ, যেগুলোকে braided bars বলা হয়ে থাকে। আবার বিবর্তনের ধারায় বেনীর মতো আলাদা জলধারার কিছু কিছু আবার একত্র (Anastomosing) হয়ে বড় হয়ে যায়।

আমাদের পদ্মা মূলত আঁকাবাঁকা নদী, যা সময়ের বিবর্তনে কোথাও নিজের বেশি বড় বাঁকের চূট কেটে (chute cutoff) আবার সোজাও হয়ে যায়। কোথাও আবার গভীরতা কিংবা পলির আধিক্যে সে বেনীর মতোও হয়, আবার পরক্ষণে হয়তো পানির তীব্র তোড়ে হয়ে যায় একত্র। কিন্তু পদ্মা নদীর এতো পলি আসে কোত্থেকে? বিজ্ঞানীদের ধারণা ১৯৫০-এর আসাম-তিব্বত ভূমিকম্পের কারণে যে ভূমিধ্বস হয়েছিলো, তা-ই অর্ধশতাব্দি ধরে বয়ে চলেছে পদ্মা।

পদ্মা নদীর গতিপথের বিবর্তন: ১৯৮৮-২০১৮ (নাসা আর্থ অবযারভেটরি)

উপরের এই ছবি হলো দ্যা মাঈটী পদ্মার সবচেয়ে ক্ষয়িষ্ণু অঞ্চল – ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নাসা’র ল্যান্ডস্যাট ৫, ৭ ও ৮ স্যাটেলাইট দিয়ে তোলা ১৪টি ছবির সমন্বিত রূপ। নদীর বামের পয়েন্টটা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, আর ঠিক মাঝখানের পয়েন্টটা মাদারিপুরের চরজানাজাত। এই চরজানাজাতের অংশটিতে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, কতটা বিবর্তিত হয় পদ্মা সময়ে সময়ে।

অথচ এখানেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ু সেতু: পদ্মা সেতু (Padma Bridge)। বোঝাই যাচ্ছে কতটা চ্যালেঞ্জিং কাজটা। এই খরস্রোতা পদ্মার ক্ষয়িষ্ণু বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে একটা সংযোগ সেতু করাটা অনেকের কাছেই মনে হয় অসম্ভব। আশার কথা হলো, গবেষণা বলছে, পদ্মার ক্ষয় এখন আর আগের মতো নেই – আগের তুলনায় ক্ষয়ের মাত্রাটা এখন অনেক কম। তাই কেউ কেউ বলেন, সেতুটা হলে বরং সুফলই মিলবে – সেতুর কারণে সেখানকার ভুমিক্ষয় কমবে।

যুগ যুগ ধরে দুটো আলাদা নদীর ঔরসজাত সন্তান হিসেবে বয়ে চলা পদ্মার বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়া এমন মানবকর্ম অবশ্যই উচ্চাভিলাষী – এক অনবদ্য কীর্তি। তবে মানুষের কর্ম চিরঞ্জীব নয়; অনেক প্রতীক্ষার পদ্মা সেতুর জন্য এই নদী যেন আবার ‘কীর্তিনাশা’ না হয়ে উঠে – এটাই প্রত্যাশা।

প্রচ্ছদের ছবি: নাসা আর্থ অবযারভেটরি

তথ্য সহায়তা

  • প্রাথমিক নথি: নাসা আর্থ অবযারভেটরি
  • কীর্তিনাশা ও রাজবল্লভ – তানিম জুবায়ের; ১৯ জুলাই ২০১৯; ভুসুকু পার দিনলিপি
  • বাংলাপিডিয়া এবং উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন নিবন্ধ
  • নদীর চূট কাটা: ইউটিউব ভিডিও – চ্যানেল: Wout van Dijk
  • নদীর পাড়ক্ষয়ের চার প্রকার – lrlr.landscapeonline.de
  • নদী কেন বাঁক নেয়: ইউটিউব ভিডিও – চ্যানেল: MinuteEarth

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না

আপনি এই HTML ট্যাগ এবং মার্কআপগুলো ব্যবহার করতে পারেন: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*