আমার পাঠকের কাঠগড়ায়

দিন-তারিখ মনে নেই, সম্ভবত ২০০৫/৬-এর কোনো একসময়। একদিন একটা ফোন এলো। তখন সবেমাত্র দাড়ি রেখেছি মনে হয়। ফোনটা অপরিচিত মানুষের – নাম্বার দেখে চিনলাম না। যাঁরা আমাকে খুব কাছ থেকে চিনেন তাঁরা জানেন, আমি সবচেয়ে অপ্রস্তুত থাকি ফোনালাপে। ফোন জিনিসটা আমার দুই চোখের শত্রু। ফোন আমার মস্তিষ্ককে বিকল করে দেয়। তো যাহোক, ফোন ধরলাম।

ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ: আপনি মইনুল ইসলাম? (সঠিক বানান: মঈনুল ইসলাম)

বললাম, জ্বি। আমার কন্ঠ সন্দেহবাতিক। আমার অপরিচিত কেউ আমার নাম ধরে ফোন দিলে তখন সেটা আমার কাছে ঐ পরিস্থিতিতে নিতান্ত সন্দেহজনক – এর মতলবটা কী? নাম জানলো কোত্থেকে? দাড়ি রেখেছি, বাইরে আমাকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। কখন কে জঙ্গী সন্দেহ করে ধরে নিয়ে যাবে, টেনশনে থাকি সারাক্ষণ। এই ফোনকারীও যখন ফোন করেই নাম বললেন, আমার মস্তিষ্ক ফ্রীয হয়ে গেলো।

কণ্ঠটি বললেন: আপনি নটর ডেমিয়ান?

বললাম, জ্বি।

বললেন, আমিও নটর ডেমিয়ান। আপনি তো ভাই অপূর্ব লিখেন। আপনার লেখা পড়ে খুব ভালো লেগেছে। খুব সুন্দর করে লিখেন আপনি।

লোকটা এত্তো এত্তো প্রশংসা করছে, নিজেকে এক্স নটর ডেমিয়ানও বলছে, তবু আমার অস্বাভাবিকতা কাটছে না। আমি নিষ্প্রাণ, স্থবির মানুষের মতো হ্যা, না, ধন্যবাদ বলে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। কথায় কোনো প্রাণ নেই। যেন, একটা মমী কথা বলছে।

ঐ ব্যক্তি (পাঠক) যে উৎসাহ নিয়ে ফোন দিয়েছিলেন, আমি নিশ্চিত তাঁর উৎসাহে ভাটা ফেলে দিয়েছি। একজন মানুষের ভূয়োসি প্রশংসা করার পরও সে কিভাবে হ্যা-না-ধন্যবাদ দিয়ে উত্তর দিতে পারে!! আমার সুনাম করে, লেখা চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমি ফোন রাখার পরে যেন, দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম। ফোন এলে আমি এতো অপ্রস্তুত হই কেন! জানি না। এবারে আমি ঠান্ডা মাথায় ফোনটার কথা ভাবতে থাকলাম, এবং আমি আবিষ্কার করলাম, আমি একটা হাঁদারাম। চরম হাঁদা।


সেলিব্রেটি জীবন বলে একটা জীবন আছে। বড় বড় মানুষরা, টিভি ব্যক্তিত্বরা এই জীবন অহরহ কাটান। যারা এই জীবনের স্বাদ পাননি, তারা ভাবেন, আহা, যদি পাইতাম। আরা যারা পেয়েছেন, তারা দুই শ্রেণীর: কেউ আরো চান; কেউ ভাবেন, কবে আবার সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারবো। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষরা তাদের ভক্তকুলের এতোটাই জ্বালাযন্ত্রণা ভোগ করেছেন যে, এই জীবন তাদের কাছে দুর্বিষহ। আর, যাদের ভক্তকুল ভালো, যন্ত্রণা দেয় না, শ্রেফ ভালোবাসার আহ্লাদে ভাসিয়ে রাখে, এরা এই জীবন আরো বেশি চায়। ঐ ফোনটা পাবার পরে আমি একবারের জন্যও চিন্তা করেছি, আমি কি সেলিব্রেটি টাইপের কিছু হয়ে গেছি নাকি। কারণ, আমার লেখালেখি নিয়ে কেউ আমাকে ফোন করে বাহবা দিচ্ছে – এটা আমি জীবনেও ভাবিনি। …কিন্তু সেলিব্রেটি তো হতে চাই না…।

আপনি বাহবা দিবেন বলে আমি লিখি – তা আসলে কখনোই না। কারণ আমি ফরমায়েশী লেখা লিখতেই পারি না। লেখা বের হয় না। আমি লিখি, কারণ আমার ভালো লাগে। সেই ভালো লাগা যখন আপনারও ভালো লাগে, তখনই আসলে আপনার জন্য ম্যাজিকটা ঘটে যায়। কিন্তু তাসত্ত্বেয়, পাঠক যখন তার ভালো লাগার কথাটা লেখককে জানায়, তখন সেটা লেখকের জন্যও ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিন্তু সমস্যা হলো, মানুষ শুধুমাত্র মন্তব্য করবার জন্য একটা সাইটে রেজিস্ট্রেশন করবার মতো সময় দিতে ইচ্ছা করেন না। তাই অনেকেরই ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা তারা শ্রেফ জানান না, নিজের ভিতর পুষে রেখে দেন।

পাহাড় নিয়ে লেখালেখি তখনও শুরু হয়নি আমার। পাহাড় নিয়ে ১৫০ লাইনের না, ২০০ লাইনের না, রীতিমতো পর্বের পরে পর্ব করে প্যাঁচালি টাইপের লেখালেখি যখন শুরু করলাম, তখন দেখা গেলো, অনেকেই আমাকে কোনো এক মহিরূহ ভাবা শুরু করে দিয়েছেন। তারা ভাবতে শুরু করলেন, পাহাড়-টাহাড় বোধহয় সব আমি পায়ের নিচে নিয়ে বসে আছি, চাইলেই র‍্যুট প্ল্যান দিয়ে দিতে পারবো। অনেকেই আমার ব্লগের যোগাযোগ পাতা কিংবা ইমেইল, ফেসবুক ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে আমার কাছে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় যাবার র‍্যুট প্ল্যান চাইতে শুরু করলেন। সেলিব্রেটি জীবনের উল্টো পিঠটা দেখা তখন আমার শুরু হয়ে গেলো বলা যায়।

সমস্যা হলো, জানা থাকলে তো উত্তর দিতে বাধা নেই। লিখতে কতক্ষণইবা লাগে। কিন্তু যে জায়গায় আমি জিন্দেগিতেও যাইনি, সেসব জায়গার হদিস আমি কিভাবে দিবো? এটা আমার ঐসব পাঠক বুঝেন না। তারা ভাবেন আমি পাহাড়ের এনসাইক্লোপীডিয়া। 😘 কেউ আছেন, আমার IELTS নিয়ে লেখা পড়ে জানতে চান, তিনি কিভাবে আইইএলটিএস-এর প্রস্তুতি নিবেন – মানুষ যে লেখা মন দিয়ে পড়েন না, এটা তার প্রমাণ; কারণ ঐ লেখায় আমি স্পষ্ট লিখেছি, আমি আইইএলটিএস দিইনি। অনেকেই আমার জিপিএস বিষয়ক লেখা পড়ে ‘জিপিএস’ নিয়ে জানতে চান।

যাহোক, পাঠকদের ভালোবাসার কিন্তু শেষ নেই। র‍্যুট প্ল্যান চাওয়া ছাড়াও অনেকেই ভালোবাসার ছিন্নপত্র লিখে পাঠান। কোনো কোনো ধারাবাহিকের পরের পর্ব কবে দিবো, কেন দিচ্ছি না, কেন ঐ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে আটকে রাখলাম – এসব অভিযোগ জানিয়ে পাঠকদের অনেকেই আমাকে লিখে পাঠান। এগুলোও আমার জন্য প্রেরণাই দেয়। কিন্তু সত্যি বলছি, আমার করার কিছুই থাকে না তখন। কারণ যে লেখা আপনি দশ মিনিটে পড়ে ফেলেন, সেই লেখা লিখতে, তার ছবিগুলো গোছাতে, তার ইতিহাস-ব্যাখ্যা ঘাঁটতে আমার অনেক অনেক সময় লাগে, অনেক পড়ালেখা লাগে। সুতরাং সেই সময়টুকু আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন – এটাই চাইবো।

অনেকেই সমমনা মানুষ ভেবে আমার সাথে তাদের সুখ-দুঃখ অনেক কিছু শেয়ার করেন। কেউ হয়তো কোথাও গাইডের কাছে অসুন্দর আচরণ পেয়েছেন, কোথাও গাইড বেশি টাকা দাবি করেছে, কেউ হয়তো অন্য মুসলমানের ভুল আচরণের কারণে পাহাড়িদের মনে মুসলমান সম্পর্কে অশোভন মানসিকতা তৈরি হয়েছে সেই প্রমাণ পেয়ে কষ্ট পেয়েছেন – মোট কথা, পাহাড়, বিজ্ঞান, ভ্রমণ ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের সুখকর অভিজ্ঞতা, তিক্ত অভিজ্ঞতা সবই জানান পাঠকরা।

অনেকেই আমাদের সাথে পাহাড়ে ঘুরতে যাবার, কিংবা আমার সাথে দেখা করবার আগ্রহ জানিয়ে লিখে পাঠান। মেয়েদের কাছে মানুষ ফোন নাম্বার চায় জানতাম, অনেকে আমার কাছেও ফোন নাম্বার চেয়ে পাঠান। মেয়েদের ফোন নম্বর দিতে আপত্তি থাকে এক কারণে, আর আমার কারণ ভিন্ন – আমি ফোন দুচোখে দেখতে পারি না।

আব্দুলমাজেদ রহমান নামের একজন লিখলেন, তিনি আমার অজানা লেকের অভিযান পড়ে রোমাঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর, পাহাড়ে যাবার মতো কোনো বন্ধু নেই, আমাদের সাথে কোনো একদিন তিনি নিশ্চয়ই পাহাড়ে যাবেন।

একজন তো লিখলেন, আমি ভ্রমণ বিষয়ক লেখালেখি করি। দিবো কি? বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে পরের মেইলেই বিশাল লেখা পাঠিয়ে দিলেন।

রাহাত-বিন-হাশেম নামের একজন পাহাড়ে যাওয়ার ব্যাপারে টিংকু ভাইয়ের বাংলার পথে অনুষ্ঠানের সুনাম করে বললেন, পাহাড়ে এভাবে যাওয়ার ব্যাপারটাকে যে ‘ট্রেকিং’ বলে তা তিনি উনার কাছ থেকে শিখেছেন। লম্বা ইমেইলে তিনি নিজের পাহাড়ে যাবার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে লিখলেন:

… ঈদের পর যাব। মনে অনেক প্রশ্ন। যদি আপনাকে করার সুযোগ দিতেন কৃতজ্ঞ থাকব। সুযোগ না দিলে যে কৃতজ্ঞ থাকব না তা কন্তু না। আপনাদের মত মানুষদের লেখা পড়া মাত্রই কৃতজ্ঞতায় শিকলে আটকা পড়া ছাড়া উপায় নাই।

রাহাত-বিন-হাশেম

তিনি আবার আমাদের এক সঙ্গীর ঘাঢ়ে গিটার দেখে পাহাড়ে দোতারা নিয়ে যাবার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী।

নীরব ঘোষ জয় জানালেন:

“বাংলাদেশ রেলওয়ে: ভ্রমণে স্বাগতম” লেখাটি পড়েছি। বেশ ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ।

নীরব ঘোষ জয়

মাইনুদ্দিন সুজন লিখেছেন:

It’s a pleasure to the Bangla subtitle that u made on the mighty universe: “journey-to-the-edge-of-the- universe”. We hope to have more Bangla subtitle by u especially on scientific documentaries. Plz, keep it up.

মাইনুদ্দিন সুজন

যুবায়ের আল যামি জলপ্রপাতের খোঁজে: ছোট বোয়ালিয়া আর মালিখোলা পড়ে জানিয়েছেন:

ট্র্যাভেল ডেসক্রিপশনটা আসলেই অনেক সুন্দর হইছে। পুরো ট্রেকিং খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠছে আপনার ডেসক্রিপশন এ। এতোটাই ভালো লাগছে যে আমার নিজেরই যেতে ইচ্ছা করছে। এরকম একটা ট্র্যাভেল গিফ্‌ট দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ @Mayeenul Islam।

যুবায়ের আল যামি

সাইফুদ্দিন আহমেদ লিখে পাঠিয়েছেন:

শুকরিয়া আপনাকে।
প্রায় ৩/৪ মাস আগে বান্দরবান সম্পর্কে সার্চ করেতে করতে আপনার লেখাগুলি পড়ি।

এখন নিজে বান্দরবান যাওয়ার চিন্তা করি, তখন আপনার লেখার কথা মনে আসে, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেকগুলো লেখা পেলাম, কিন্তু কেন জানি আপনারটাই আমার চাই। তিনদিন ধরে সার্চ ইঞ্জিন সব খুঁজি, কিন্তু কেন জানি ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। এরপর বান্দরবানে চেকপোস্টে আপনার সত্য বলার ঘটনা মনে আসে, বাংলায় ওইটা লেখে সার্চ দিতে পেয়ে গেলাম।

তাই চিন্তা করলাম আপনাকে জানাই।
আল্লাহ হাফেজ।

সাইফুদ্দিন আহমেদ

অনেকেই সামাজিক প্রয়োজনে নিজেদের পাশে আমাকে পেতে চান। যেমন একদল যুবক আমাকে লিখে জানিয়েছেন, তারা মনে করছেন “তিন গোয়েন্দা” হারিয়ে যেতে বসেছে। সেবা প্রকাশনীও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তাই তাঁরা নিজেরাই তিন গোয়েন্দার জন্য তিনগোয়েন্দা.অর্গ নামে একটা ওয়েবসাইট খুলে ফেলেছেন, সেখানে থাকবে তিন গোয়েন্দার জন্য অজস্র ভালোবাসা। বড় হয়ে যাবার পরে আমরা ছোটবেলাটাকে অনেকটাই ভুলে যাই। তাঁদের এই ওয়েবসাইটের গল্পটা যখন তাঁরা আমায় জানিয়েছেন, সামান্য একটা ওয়েবসাইটও যে ছোট মানুষদের কাছে কত সাধনা আর পরিশ্রমের অর্জন তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করেছি।


সাধুবাদ দিয়ে পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য লিখেছেন অনেকেই। সুনাম করেন বলে, পাঠকদেরকে চাটুকার ভাবার সুযোগ নেই। পাঠকদের মুখে যা আসে, তাঁরা তা বলেন – এই একটা ব্যাপারে তাঁরা সত্যবাদী। যেমন: শাবাব ভাই (শাবাব মুস্তাফা) প্লুটো – দূরের ঐ শিশুটাকে কাছ থেকে দেখা – লেখাটা পড়ে জানালেন:

উপমা ঠিক হয় নাই। পৃথিবীতে শাঁই শাঁই শব্দের কারণ বাতাসের সাথে ঘর্ষণ। মহাকাশে বাতাস কই?

শাবাব মুস্তাফা

আমার সহকর্মী ছোট ভাই শেখ সাদি একদিন আমাকে অনেক বিপদে পড়ে জানালো:

ভাই, আপনার লেখা পড়তে বসছিলাম। এমন কঠিন কঠিন বাংলা, মানেও জানি না। শেষে পড়া বাদ দিয়া দিছি। স্থানাংক, টানাংক কী সব কঠিন শব্দ!

শেখ সাদি

এই ক্রিটিসিযমগুলো (ছিদ্রান্বেষণ?) অন্যের কাছে কেমন লাগে জানি না, আমার কাছে মন্দ লাগে না – নিজেকে পাঠকের আয়নায় দেখা যায়। প্রথম অফ-ট্র্যাক বান্দরবানে “হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট”-কে ভুলে “হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব” লিখে ফেললাম – রীতিমতো গুরুচণ্ডালী দোষ। গুরু ফযলে রাব্বি ভাই সংশোধন করে দিলেন। পরে আরেক লেখায় দেখি একই দোষ করে ফেলেছি। জিবে কামড় দিয়ে সংশোধন করে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।

ভারতের দিল্লী থেকে বাঙালি অমিত রায় আমাকে অভিযোগ লিখে পাঠালেন: “তোমাদের ব্লগ মাঝে মাঝে পড়ি।” তারপর রীতিমতো অনুযোগ জানালেন, আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা নাকি ভারতের বাঙালিদের আপন করে নিতে জানি না। আমরা তাঁদেরকে ‘বাঙালি’ পরিচয় না দিয়ে ‘ইন্ডিয়ান’ বলি কেন? …পরে অবশ্য উনি স্বীকার করেছেন, আমার লেখায় আমি কষ্মিনকালেও সেরকম কিছু বলিনি। অমিত রায়ের সাথে এরপর অনেকগুলো চিঠি চালাচালি হয় আমার। দুটো এখানে তুলে দিলাম। দিল্লীতে তাঁর একটা কভার ডিযাইন আর প্রকাশনা সংস্থা আছে। তাঁর অলংকরণ করা পিডিএফে হাতের লেখা লিখে চিঠি দিতেন তিনি: ❤️

আমি লেখালেখি করে পাপও কামিয়েছি অনেক। যেমন: ট্রেকিং কম্যুনিটিতে অনেকেই আমাকে ভালোবাসলেও অনেকেই মনে করেন এতো খোলাখুলি সব লেখা উচিত না। কিছু কথা গোপনই রাখতে হয়। যেমন: প্রথম ট্রেকে গাইডের নামধাম, ফোন নম্বর প্রকাশ করে কী যে দুর্ঘট ঘটিয়েছি, তা বুঝেছি অনেক পরে, তখন কানে ধরেছি – এই পাপ আর করবো না। বড় ভাইদের, আপুদের থেকে শিখেছি, সব ট্র্যাক-এর কথা বলতে নেই, আবার সব ট্র্যাক-এ সবকিছু প্রকাশ করতে নেই। …শিখেছি, ধুশ খেয়ে হুশ হওয়ার মতো – ভুল করে শিখেছি।

অফ-ট্র্যাক বান্দরবান ২০১২, যে লেখার মাধ্যমে আমি পাহাড়চারী হতে শুরু করেছি। ছবিতে পিঠে বাচ্চাসহ একা পাহাড়িকে আর সামনেই সদ্য প্রয়াত গাইড আপেল মল্লিক আর ডানে আমার ভ্রমণসঙ্গী রাসেলকে দেখা যাচ্ছে।
আমার প্রথম পাহাড়ের গহীনে যাবার ভ্রমণ অফ-ট্র্যাক বান্দরবান-এর অপ্রকাশিত একটা ছবি। ছবিতে সদ্য-প্রয়াত গাইড আপেল মল্লিক-কে পাহাড়ের কোলে দেখা যাচ্ছে। সে নাকি আমার লেখার পরে গাইড হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছিলো। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে আপেল মল্লিকের, কিশোর বয়সে চিরবিদায় কষ্ট দেয়।

আমার বিরুদ্ধে পাঠকের আরো অভিযোগ আছে, পরম অভিযোগ হচ্ছে: ভাই আপনে নামায পড়েন, মুসলমান, তাইলে “আল্লাহ” না বইলা তথাকথিত প্রগতিবাদীদের মতো “ঈশ্বর ঈশ্বর” করেন কেন? অভিযোগটা গুরুতর। সত্যি বলতে কি, এর জবাব দিয়ে কাউকে সন্তুষ্ট করা যাবে না, কারণ যিনি বুঝেন, তিনি এই প্রশ্ন করেন না, আর যিনি বুঝেন না, তিনি এর উত্তর শুনেও বুঝবেন না কিংবা বুঝতে চাইবেন না। শুধু গা বাঁচাতে এতটুকু বলি: “ধর্ম” কোনো গোত্রের বিষয় নয়, ধর্ম কোনো জাতির বিষয় নয় – ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। তাই ঈশ্বর-ধারণা আমার কাছে অনেক ব্যাপক। আমার বিশ্বাস আমি অন্যের উপর চাপাতে চাই না। তাই বাংলায় লিখি: “ঈশ্বর” – সেটা আপনার ভাষায় যেকোনো কিছুই হতে পারে, যেমন আরবিতে “আল্লাহ”।


আমার একটা বদভ্যাস আছে। আমি মানুষের ভালোবাসা আর শিক্ষা ভুলি না। নাম মনে থাকলে, নাম বলতে কার্পণ্য করি না। তাই যাঁর কাছ থেকে লাত্থি খেয়েছি, তাঁর কথাও বলি; যাঁর কাছ থেকে দীক্ষা পেয়েছি তাঁর কথাও বলি। এতে অনেক পাঠক আবার খুব আশ্চর্য হন। যেনবা, তারা এজাতীয় আচরণ কারো কাছ থেকে প্রত্যাশাও করেন না। যেমন: স্মার্টফোনকে বানিয়ে ফেলুন জিপিএস ডিভাইস লেখায় মাসুম আল মিজান ভাইয়ের থেকে শেখা হালনাগাদ তথ্য দিয়েছি দেখে তিনি যার-পর-নাই আশ্চর্য, বলেন: এই রকম মানুষও আছে নাকি!। যোগী হাফং-এর দ্বিতীয় পর্বে সোয়াইব সাফি‘র নাম এসেছে দেখে তিনিও যার-পর-নাই আশ্চর্য। আমি তখন উল্টো আশ্চর্য্য: এই লোকগুলো আশ্চর্য হচ্ছে কেন! আজব! 🤔

ফেসবুক পেজের (fb.com/nishachorblog) লাইকের সংখ্যা অনেকের কাছে পাঠকদের ভালোবাসার নিদর্শন। আমাদের ইতিহাসে অনেক বদল এসেছে। আগের ফেসবুক পেজটা আমরা শুধু নাম আর ইউআরএল বদলাতে পারিনি বলে মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। নয়তো নতুন পাতার ১,৫০০’র বেশি লাইক হয়তো আরো বেশি হতো। ফেসবুকে আমরা একটা গ্রুপও খুলেছি: নিশাচর পাঠক সমাবেশ (fb.com/groups/nishachorblog) – চাইলে যোগ দিয়ে ভালোলাগা-মন্দলাগা আলোচনা করতে পারেন খোলামনে।

পাঠকদের কিছু আচরণ অদ্ভুত ঠেকে আমার কাছে। কোনো লেখা যখন প্রকাশ পায়, তখন অনেকেই হয়তো মন্তব্য করেন। কিন্তু লেখা পুরোন হয়ে গেলে আর তাদের মন্তব্য পাওয়া যায় না। এর মানে কি এটা যে, লেখা পুরোন হয়ে গেলে তার আবেদনটা পুরোন হয়ে যায়? আমি তো সেটা দেখি না। যেমন: প্রবন্ধ টাইপের লেখার বক্তব্যগুলো আজীবনই একই আবেদন। কিন্তু সেই লেখাগুলোতে মানুষজন আসে, কিন্তু কোনো খবর নাই। তারা মন্তব্য করেন না। বোঝা যায়, মানুষ পুরোন লেখা পছন্দ করে না। …সত্যি বলছি, আমার মতো মানুষজন তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে আপনাদের ভালোলাগা, মন্দলাগা জানবার জন্য।

পাঠক ভালোবাসা প্রকাশ করেন চাই না করেন, আমার গুরুজনের থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি এজীবনে, তা অতুলনীয়… বুঝেননি, তাই না? আসলেই বলছি, কোনো কিছুর সাথেই তার তুলনা করা যায় না। পাহাড়চারীরা, পর্বতারোহীরা, ট্রেকার-মাউন্টেনিয়ারসহ ভ্রমণচারীরা, পরিবেশবাদীরা আমার দোষত্রুটি, ভুলচুক মাফ করে দিয়ে আমাকে যেভাবে তাঁদের ভালোবাসা দিয়েছেন, তার জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো… আজীবন। নিশাচর আমার জন্য তাই অন্যরকম আরেক ভালোবাসার নাম।

যাহোক, পাঠকের ভালোবাসার শেষ নেই। আশিকুর রহমান খান যোগী হাফং নিয়ে লেখা, পড়ে শেষ করে লিখেন:

Noyon Vai, you should publish a book. Believe me the structure of writing is outstanding. You should publish a book and that will keep you alive in future.

আশিকুর রহমান খান

বই লেখার সত্যিই খুব ইচ্ছে আমার। কিন্তু কে ছাপাবে আমার বই? কেন ছাপাবে? ছাপাতে পারি কিবা না পারি, পাঠকের যে ভালোবাসা আমি এযাবৎ পেয়েছি, তা আমাকে উজ্জীবিত করে, শেখায়, অনুপ্রাণিত করে…।

– মঈনুল ইসলাম